অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব-০৫+০৬

0
575

#অনুবদ্ধ আয়াস
#ইফা আমহৃদ
পর্ব:০৫+০৬

” জোনাকি, কে মে’রেছে তোমায়? গালে এটা কিসের দাগ। দেখে তো মনে হচ্ছে আঙুলের দাগ। শরীরটাও তো বেশ গরম। জ্বর হয়েছে নাকি?”

রৌধিকের অতি স্বাভাবিক কন্ঠ। নিজের হাত কখনো গালে কখনো কপালে ছুঁয়ে দিচ্ছে। কি প্রত্যুত্তর দিবো খুঁজে পেলাম না। নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে রৌধিক হিংস্র হয়ে উঠলো। টেবিলের উপর রাখা শপিং ব্যাগ গুলো ছুঁড়ে ফেলল নিচে। এগুলো হয়তো আমার জন্য কিনে এনেছে। মাথা চেপে চেঁচিয়ে বলল,
“কি বলছি কানে যাচ্ছে না, আশ্চর্য। ঠিক আছে আমিই দেখছি।”
এবারও মাথা নিচু করে রইলাম আমি। রৌধিক একটা ব্যাগ তুলে এগিয়ে এলো আমার দিকে। ভয়ে ব্লাঙ্কেট মুড়ি দিলাম। রৌধিক মুখে কিছু বললেন না। ফেলে দিল ব্যাগ টা। হুট করে ব্লাঙ্কেট সমেত কোলে তুলে নিলো আমায়। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। ড্রয়িং রুমে বসে ছিলো সকলে। সেখানে এনে দাঁড় করিয়ে দিল আমায়। আমি সামনে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি, সবাই অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের মাঝখানে ঐ মেয়েটাও বসে আছে। রৌধিকের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। রৌধিক হাত ধরে সামনে নিয়ে এলো। দাঁতে দাঁত মিশিয়ে টেনে টেনে বললেন,

” কে? কে মে’রেছে ওকে?”

সবাই কিংকতব্যবিমূঢ় হলেন। আদ্রিক আঙ্কেল কিয়ৎক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে বললেন,” মানে? মা’রবে মানে কী? কে মা’রবে ওকে?”

“আমিও তো সেটাই জানতে চাইছি?” একরোখা জবাব দিলো রৌধিক।
আদ্রিক আঙ্কেল আমার দিকে তাকালেন। সন্দিহান কন্ঠে বললেন,

“জোনাকি কে মে’রেছে তোমায়?”

রৌধিক যা রেগে আছে, ঐ মেয়েটাকে দেখিয়ে দিলে তাকে প্রচুর বকবে। তাই মাথা নিচু করে রইলাম। কিন্তু সবাই আমার দিকে হতাশাগ্ৰস্থ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তাই মিনমিনিয়ে বললাম,
“কেউ মা’রে নি, এলার্জি প্রবলেম..

“চুপ। একদম চুপ। চড়িয়ে তোমার অন্যটাও লাল করে দিবো, স্টু’পিড। এখন তোমার কাছ থেকে আমাকে শুনতে হবে, কোনটা এলার্জি আর কোনটা আঙুলের ছাপ? সত্যি কথা না বললে চুপ করে থাকবে, কিন্তু মুখ থেকে যাতে কোনো আওয়াজ না বের হয়! বুঝতে পেরেছ তুমি? তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
আমার গাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে সবাইকে দেখালো। এখনো স্পষ্ট আঙুলের ছাপ দেখা যাচ্ছে। সবাই একে অপরের দিক জিজ্ঞাসা সূলভ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সবাই ইশারায় নাসূচক জানালো। তখন সবাই ঐ মেয়েটির দিকে চাইল। মেয়েটি মাথা নিচু করে আছে। আদ্রিক আঙ্কেল ডাক দিলেন,
” ইয়ানাত!”

এতোক্ষণে বুঝতে পারলাম মেয়েটির নাম ইয়ানাত। সে নত স্বরে বলল,”আসলে ও আমাকে ধাক্কা মেরেছিল।”

“তাই বলে তুমি ওর গায়ে হাত তুলবে।”

“আঙ্কেল ও ইচ্ছে করে আমাকে ধাক্কা দিয়েছিল। তাই। আমি বুঝতে পারি নি, এতোটা জোরে লাগবে।”

“দেখে তো মনে হচ্ছে না, আস্তে মে’রেছো। মনে হচ্ছে মনের ভেতরের ক্ষোভ থেকে মে’রেছো। জোনাকি লেখাপড়া করা একটা মেয়ে। ও তোমার মতো এতোটা অস’ভ্য মেয়ে নয় যে, তোমাকে ধাক্কা দিবে। [আমাকে উদ্দেশ্য করে] যখন তোমাকে মেরেছে, তখন তুমিও কয়েকটা মেরে দিতে। তাহলে নেক্সট টাইম মারার সাহস হতো না।
বাবা, তোমার বন্ধুর মেয়ের বিহেবিয়ার যদি চেঞ্জ করতে না পারে, তাহলে আমাদের বাড়িতে আসতে বারণ করে দাও।” রৌধিকের তেড়া উত্তর।

ইয়ানাতের গম্ভীর মুখ। স্বাভাবিক স্বরে বলল,”আঙ্কেল আমি আসছি।” ইয়ানাত বেরিয়ে গেল।
রৌধিক সার্ভেন্ট কে দুজনের জন্য খাবার আর আইসব্যাগ নিয়ে আসতে বলল। আইসব্যাগ আনতে দেরী হচ্ছে দেখে আবার চেঁচিয়ে উঠলো। আইসব্যাগ দিয়ে গালে ঘসে দিল। পুনরায় আমাকে কোলে তুলে নিল। রুমে এনে বেডের উপর বসিয়ে দিল। জামা কাপড় গুলো তুলে স্বযত্নে কাবার্ডে গুছিয়ে রাখল। ব্যাগ গুলো ভাঁজ করতে করতে বললেন,”আজকে আর জামা কাপড় চেঞ্জ করতে হবে না। একদম কালকে।”
ইতিমধ্যে খাবার দিয়ে গেছে। রৌধিক খাবার খাচ্ছে। আমি রৌধিকের দিকে চেয়ে আছি। মানুষটা একদম ভিন্ন রকমের। সেদিন আমার সাথে কেমন ব্যবহার করলো, আর আজ। আজকে আমার জন্য বাড়ি মাথায় তুলেছে। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি আমি আর তিনি বিদেশি মানুষ। কতো বছর বিদেশে ছিলেন। আমি কী আদোও তার যোগ্য। ভাবতে ভাবতে অজান্তেই বলে ফেললাম,
” আমি আপনার যোগ্য নই, তাই না?”

“মানে..
নিজের ভেতরে ফিরলাম আমি। কী বলতে কী বলে ফেলেছি। মৃদু স্বরে বললাম,” ক- কিছু না?”

“জোনাকি, কে বলছে এইসব?”

“কেউ বলেনি। আমি নিজেই বলছি।”

“আমি জানতে চাইছি, কে? কে বলেছে? কানে যাচ্ছে না আমার কথা। আর কি বলছে? ” চেঁচিয়ে বললেন সে।

কাঁপতে কাঁপতে বললাম,”ব বলেছে, আমাকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছে। এখন এই ধরনের জামা কাপড় প-পড়েছি। পরে তাও থাকবে না।”
ধমকে বললেন তিনি,
“ই’ডিয়েট, একটা। আমার সাথে কথা বলার সময় তো মুখ থেকে খই ফোটে। তখন কেন মুখে খই ফোটে নি? আমি যখন জিজ্ঞাসা করেছি, তখনও তো বলতে পারতে? আশ্চর্য মেয়ে।”

” ভয় করছিলো ত?”

“আমার সামনে ইয়ানাত তোমাকে খেয়ে ফেলতো?”

“আমার তো আপনাকে ভয় করছিলো।”

রৌধিক একগাল হাসলো। বাম গালে গর্তের সৃষ্টি হলো। অপূর্ব লাগছিল তাকে। হারিয়ে গেলাম তার রুপের মাঝে। তুরি বাজালো। ধ্যান ভাঙল আমার। বাম হাতে নিজের সাথে দৃঢ় করে মুড়িয়ে নিলেন। ভ্রু নাচিয়ে বলল,”

“আই নো, আ’ম এ প্রিটি বয়। সো দেয়ার ইজ নাথিং টু লুক এট মি! বুঝেছ?”

বলেই নাক ধরে টেনে দিলেন।
_____________
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। সকালে বাড়ি থেকে বের হয়েছি‌। ঘুম থেকে উঠার পরে রৌধিকের দেখা পাই নি। আমি উঠার আগেই সে কোথাও একটা চলে গেছে। সময় ছিল ১০ টা ৯ মিনিট। সরাসরি হসপিটালে গিয়েছিলাম বাবাকে দেখতে। কড়া মেডিসিন আর স্যালাইনের কারণে ঘুমাচ্ছে সে। জয়া স্কুলে গেছে। এতোক্ষণ বসে ছিলাম সেখানে। বাবার ঘুম ভাঙে নি। জয়াও আসেনি। তাই বেরিয়ে পড়েছি। ডাক্তার বলেছে আরো কয়েকদিন লাগবে। তারপরে বাবাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করবে। আদ্রিক আঙ্কেল হসপিটালের বিল মিটিয়ে দিয়েছিল। এখানেও পাবে,
বেশ ক্ষুধার্ত আমি। ইদানিং খাবারে অনিয়ম করলে বমি বমি পায়। অসুস্থ লাগে। কাঁধ থেকে ব্যাগ বের করে টাকার পরিমাণ গুনে নিলাম। ব্যাগের ভেতরে আর মাত্র বিশ টাকা পড়ে আছে। দশ টাকার কচকচে দুটো নোট। অথচ এখান থেকে রৌধিকদের বাড়িতে যেতেই ত্রিশ টাকা খরচ হয়। একবার ভেবেছি রৌধিকদের বাড়িতে পৌঁছানোর আগে গাড়ি থেকে নেমে বাকি পথটা হেঁটে যাবো। কিন্তু ক্ষুধায় সহ্য হচ্ছে না।

কিছুটা পথ পেরুতেই শরীরটা আরো ক্লান্ত ঠেকলো। মাথাও ধরেছে। বমি বমি ঠেকছে শরীর টা। বিপরীত পাশে টং দোকান নজরে গেল আমার। ধীরে ধীরে রাস্তা পেরুলাম। এক কাপ চা দিতে বললাম। ড্রাম থেকে এক গ্লাস পানি তুলে চোখ মুখে ছিটিয়ে দিলাম। মাথায়ও পানি দিলাম। অতঃপর আঁচল দিয়ে মুছে নিলাম।

চা আর বিস্কিট নিয়ে টুলের উপর বসলাম। আরেকটু জিড়িয়ে হাঁটা ধরবো। বিস্কিট ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেলাম। শেষ অংশ টা মুখে তোলার আগেই গলে পড়লো নিচে। চায়ের কাপ মুখের দেওয়ার আগেই ধাক্কা দিলো কেউ। অধরে গরম ছ্যাকা লাগলো। দ্রুত কাপ সরিয়ে পাশে তাকিয়ে কিছু বলার উদ্যোগ নিলাম। পাশ তাকাতেই আমার সব বুলি উবে গেল। হাত ফসকে চায়ের কাপ পড়ে যেতে নিলেই ধরে ফেললো শুভ।
বাবা এই শুভ সাথেই আমার বিয়ে ঠিক করেছিল। শুভ বাবার বাল্যবন্ধু।
সন্তর্পণে কাপ টা পাশে রেখে বলল,
-” তুমি দিন দিন কেমন কেয়ার ল্যাস হয়ে যাচ্ছো জোনাকি! একটু হলেই তো কাপ টা নিচে পড়ে যেত।
মামা, দুই কাপ চা। কড়া লিকার। দুধ ছাড়া।”

বলেই উঠে দাঁড়ালো। পাশে রাখা কাপটা এগিয়ে দিলো।
এক হাঁটু ভাঁজ করে টুলের উপর বসলো। আমার দিকে মুখ করে। আমার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। অন্যহাত পকেটে ঢুকিয়ে রুমাল বের করলো। আমার ভেজা চুলগুলো স্বযত্নে মুছিয়ে দিলো। ভেজা রুমাল টা বাইরে ফেলে নিগলে নিল। অতঃপর পকেটে রেখে দিলো। আদুরে গলায় বলল,
-” কি হয়েছে তোমার জোনাকি পোকা। আমি ব্যস্ত ছিলাম। তাই তোমার ফোন রিসিভ করতে পারিনি। তাই বলে তুমি নিজের ফোন বন্ধ করে রাখবে। আমি জানতাম না, আঙ্কেল অসুস্থ। যখন জানতে পারি, তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। তাহলে..
তুমি যদি বলো, তাহলে আমি কাজ ছেড়ে সর্বক্ষণ আমার জোনাকির পাশে বসে থাকবো।”

তবুও আমি কোনো কথা বললাম না। প্রত্যুত্তরে কি বলবো, ভাষা নেই। চায়ের কাপ আমার হাতে দিয়ে নিজে চুমুক দিলো কাপে। কাঁপা হাতে চুমুক দেওয়ার আগেইঝড়ের গতিতে হাজির হলো কেউ। হাত থেকে কাপ নিয়ে তুমুল শব্দে নিচে ফেলে দিলো। তাকালাম আমি। রৌধিক রক্তচক্ষু করে আমার পানে চেয়ে আছে। এখানে কিভাবে এলো সে?

আমার হাত ধরে টেনে তুলেই চ’ড় বসিয়ে দিল গালে। চায়ের কাপটা পড়ে ভেঙে গেল। শব্দ হলো মৃদু। গলা চেপে ধরলেন। শুভ ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল। রৌধিক কে ছেড়ে আমাকে ধরলো। চেঁচিয়ে বলল,

” কে আপনি? সাহস হয় কি করে জোনাকির গায়ে হাত দেওয়ার?”

” আমি তো হাজবেন্ডের অধিকারে ওর গায়ে হাত দিয়েছে। আপনি কোন অধিকারে ওকে সেভ করছেন। প্রেমি’ক নাকি কাস্ট’মার?”

রৌধিকের ত্যাড়া উত্তরে শুভ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। আমার দিকে অসহায় চাওনি দিয়ে বলে,

” এই ছেলেটি কি বলছে জোনাকি? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

আমি এবারও আগের মতো চুপ। কি বলার বাকি আছে আমার? শুভ হাত ছেড়ে গালে দুহাত রাখল। রৌধিক সঙ্গে সঙ্গে ছাড়িয়ে নিল। কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে টানতে লাগলেন। গাড়ির ভেতরে এনে ফেলে দিলেন। দরজা লক করে অন্যপাশ দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লেন। গম্ভীর মুখে ড্রাইভ করতে লাগলেন। ফুল স্পিডে ড্রাইভ করে বাড়ির সামনে এসে থামালেন। যেখানে বাড়িতে চলে বাড়ি আসতে মিনিট দশেক সময় লাগে, আজ সেখানে চোখের পলকে এলাম। গাড়ি থামিয়ে আবার হাত ধরে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে এলেন।

ততক্ষণে সন্ধ্যায় ঘনিয়ে এসেছে। চারদিকে মাগরিবের আযান পড়েছে। অধিকাংশ মানুষ নামাজ পড়তে গেছে। রৌধিক ড্রয়িং রুম পর্যন্ত আনতেই চিৎকার দিয়ে উঠলো বাড়ির কাজের লোকেরা। রৌধিক হিংস্র চোখে তাকাতেই ভয়ে পিছিয়ে গেল। দু তিনটা সিঁড়ির উপরে সে। তাই হাতে টান লাগছে বারবার। এনে সোজা বেডের উপর ফেললো। দরজা বন্ধ করে দিলো। এগুতে লাগলো আমার দিকে। ভয়ে সিটিয়ে গেলাম আমি। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

” কি হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন?”
” এখনো বুঝতে পারছো না, কি করছি? কে ঐ ছেলেটা? বাবা মাকে জানাবো, তার আদরের বউমা। বিয়ের পর ছেলেদের সাথে ঢলাঢলি করছে।”

” আমি ঢলাঢলি করছিলাম?”

” না তো কি, রাস্তার মাঝখানে ছিঃ।
এই চুড়িদার কেন পড়েছো হ্যাঁ। বাড়িতে থাকতে তো দিব্যি, শাড়ি পড়ে ঘুরো।”
ওরনা টা খুলে ফেলে দিলেন।
-” আপনি তো আমাকে শাড়ি পড়তে বারণ করেছেন। তাছাড়া আপনার মনে তো আমার জায়গায় নেই। তাহলে আমি কি করছি, না করছি কি যায় আসে আপনার? ওয়ার্ট?”

গাল চেপে ধরলো আমার। টেনে টেনে বলল,
” তোমাকে আমার বউ হিসেবে মানবো, কি মানবো না। সেটা পড়ে দেখা যাবে। এখন তুমি আমার বউ। আজকের পর যদি কোন ছেলের সাথে কথা বলতে শুনি, জানে মেরে দিবো। মনে থাকবে?”

শেষের কথা টা চিৎকার করে বললেন তিনি। কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু সাউন্ড প্রুফ ঘর হওয়াতে বাইরে সাউন্ড যাচ্ছে না। আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিতেই ধপাধপ পা ফেলে চলে গেলেন তিনি। তিনি যেতেই প্রবেশ করলো আদ্রিতা আর মৌমিতা আন্টি। আমি হাত পা ছড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। এই বলছে, আমি তার কেউ না। এই বলছে, কেউ না মানায় কিছু যায় আসে না। আদ্রিতা আর মৌমিতা আন্টি প্রবেশ করলেন।
আন্টি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,” আদ্রিতা তুমি কোণার রুমটা জোনাকি কে দেখিয়ে দাও। আজ থেকে ও ওখানেই থাকবে।”

” কিন্তু বাবা..

” আমি বুঝে নিবো। আজ থেকে জোনাকি এই বাড়ির মেয়ে হয়ে থাকবে। তোর আর জোনাকির ভেতরে কোন তফাৎ হবে না।”

আদ্রিতা আমাকে টেনে টেনে অন্য একটা ঘর নিয়ে এলো। এই ঘর টা রৌধিকের ঘরের মতো আভিজাত্য না থাকলে শান্তি রয়েছে।
চোখের পাতা বড্ড ভারী ঠেকছে। তাই শাওয়ার নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি। চুল মুছারও সময় হয়ে উঠে নি। টাওয়াল পেঁচিয়ে নিদ্রায় পাড়ি জমাই।
.
মাঝরাতে ফোন বাজতে। ঘুমু ঘুমু চোখে তাকালাম। বালিশের পাশেই ভাঙা ফোনটা ভাজছে। স্ক্রিনে না চেয়েই ফোন রিসিভ করে কানের কাছে ধরলাম। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
” দীপ্তিময়ী, আমার দীপ্তিময়ী কি করছে?”
উঠে বসলাম আমি। একমাত্র শুভই জোনাকি পোকা বলে ডাকে। বাকিরা জোনাকি হিসেবে। কিন্তু শুভর কন্টাক্ট নাম্বার নয়। কন্ঠ টাও ওর নয়। সন্দিহান গলায় বললাম,
” কে আপনি? কাকে চাই?”

” আমার ভালোবাসা চাই। আমার দীপ্তিময়ীকে আমি বকেছি, মেরেছি। তুমি কষ্ট পাচ্ছো, দীপ্তিময়ী?”

” ঐ মিয়া, আমাকে কি আপনার দালাল মনে হয়। মাঝরাতে ফোন করে ভালো বাসা চাইছেন? আমি নিজেই মানুষের বাসায় থাকি। আপনারে ভালো বাসা দিমু কোথা থেকে? আশ্চর্য। আর দীপ্তি টিপ্তি কে? আমি চিনি না।”

বলেই ফোন রেখে দিলাম। পুনরায় আবার ভেজে উঠলো। কিয়ৎক্ষণ বসে থেকে রিসিভ করলাম। রুদ্ধ কন্ঠে বললাম,

” কি চাই তোর হ্যাঁ? মাঝরাতে ছেড়’রামি করতে মন চায়। তোরে আমি সামনে পেলে..

” ছিঃ, এভাবে বলছো কেন? ভালোভাবে কথা বলতে হয়। সামনে পেলে কি করতে হ্যাঁ? চু’মু খেতে?”

” আবার ছিঃ বলোস। তোরে সামনে পাইলে। সাহস থাকলে সামনে আয়..

ফোনটা কেটে সাইলেন্ট করে রেখে দিলাম। বালিশ ঠিক করে শুতেই নক পড়লো দরজায়। ঘড়ির দিকে চাইলাম। রাত তিন টা পনেরো। এতো রাতে সবাই তো ঘুমে থাকার কথা। আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলে দিলাম। আমার চোখ কপালে। মহাশয় নিজে এসেছে। চোখ মুছে আবার অবলোকন করলাম। না আমার দৃষ্টি ভ্রম নয়। লাভ দিয়ে বালিশের পাশে থেকে ওরনা নিয়ে গায়ে জড়ালাম। ততক্ষণে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেছে রৌধিক। বেডের উপর টান টান হয়ে শুয়ে পড়লো। আমি কোমড়ে হাত দিয়ে বললাম,

“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

“আশ্চর্য, বউ এখানে তো আমি কোথায় থাকবো? বউ নিজে আমাকে আসতে বলেছে।”

“কে আপনার বউ? আমি কারো বউ না। আমি কাউকে আসতে বলিনি!”

“আমার ফোনে রেকর্ড ফাংশন অন করা। এইমাত্র তুমিই আমাকে আসতে বলেছো!”

“তারমানে একটু আগে আপনি আমাকে ফোন করে ডিস্টা’র্ব করছিলেন?”

“ডিস্টা’র্ব কই করছিলাম? বউয়ের সাথে ফোনে কথা বলছিলাম। বউ তোমার মুখের ভাষা এতো বি’শ্রী।”

তিনি ফোন দিয়েছেন ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। ফোন করে আমাকে না চেয়ে অন্য কাউকে চাইছিলেন। মুখ ভার করে বললাম,
” মাঝরাতে ফোন দিয়ে দীপ্তিময়ীকে চাইবেন? আর আমি বললেই দোষ। যান, নিজের ঘরে যান!”

আমার হাত ধরে টেনে নিজের বুকের উপরে রাখলেন। অতঃপর আমার কোমড়ে নিজের হাত রেখে বললেন,

” জোনাকি মানেই তো নিভু নিভু মৃদু আলো। আর দীপ্তিময় মানেও ক্ষুদ্র আলো। তুমি তো মেয়ে তাই ময়ী দিলাম। বুঝতে পেরেছো তুমি?”

নাক ধরে টেনে দিলেন তিনি। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলাম আমি। নিজেকে কোনো রকম সামলে রৌধিককে টেনে বের করে দিলাম ঘর থেকে। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়লাম। আমাকে দীপ্তিময়ী বলছে সে। বউ বলে দাবি করছে। বিশ্বাস করতে কেমন কষ্ট হচ্ছে আমার।
_________________
দুদিন বাড়িতে বসে থাকার পর উপলব্ধি করার বাবার কথা। যতোই হোক, আদ্রিক আঙ্কেলের সাথে করা চুক্তি অনুযায়ী মাস ছয় পর আমরা আলাদা হয়ে যাবো। তাছাড়া বাবার ওষুধ পত্র কিনতে এখনো অনেক টাকার প্রয়োজন আছে। তাই অফিসে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। আদ্রিক আঙ্কেল অনুমতি দিলেন। তবে আমি তার ছেলের বউ সেটা জানাতে বারণ করলেন।
অফিসে ঢুকে ব্যাগটা রেখে টেবিলে বসতেই ম্যানেজার ছুটে এলেন। টেবিলে আঘাত করে বললেন, ” তা ম্যাডাম, এতোদিনে অফিসের কথা মনে পড়লো
আপনার? বলি এতো দিন কোথায় ছিলে তুমি? এই মাসে তোমার সেলারি অর্ধেক কাটবো।”

” আপনার সংসারে আগুন লাগাতে গিছেলাম। কিন্তু আপনার বউকে পাই নি। ভাবছি এবার আপনার বউকে জানাবো। বউ রেখে প্রেমিকা নিয়ে ঘুরতে যাওয়া।”

ফোন বের করতেই দমে গেলেন ম্যানেজার। সৌজন্য হাসি দিয়ে দিলেন। ঠোঁট বাঁকিয়ে জোর পূর্বক হাসি দিলেন। অতঃপর চলে গেলেন। তিনি যেতেই আহির, সারা ঘিরে ধরলো আমায়। আমার মাথা থেকে পা স্ক্যান করলো। ভ্রু কুঁচকে আহির বলল,
” জোনাকি, তোকে কেন জানি বিবাহিত লাগছে?”

” হ্যাঁ! আমারও তেমনই লাগছে। এতো দিন কোথায় ছিলিস তুই। ফোনে পাই নি। তোদের বাড়ি গেছিলাম। বাড়ি ওয়ালা বলল তোরা নাকি হসপিটালে। কার কি হয়েছিল?”

” বাবা অসুস্থ হয়ে গেছিলো।”
বিচলিত হয়ে বলল সারা, ” কি হয়েছে আঙ্কেলের?”

” এই কয়দিনে অনেক কাজ জমে আছে। পরে বলছি।”

কাজে মন দিলাম আমি। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরে স্টার্ফ এসে বলল, ” স্যার আপনাকে ডাকছে।”

” স্যার! স্যার কখন এলেন। তিনি তো বাড়িতে!”

” বড় স্যারের ছেলে ছোট স্যার। তিনদিন ধরে তিনি অফিসে আসছে। আপনি তো আসেন নি, তাই জানেন না।”

ছোট স্যার মানে বুঝতে বেশ বেগ পেতে হলো আমাকে। দরজা নক করে ভেতরে প্রবেশ করতেই মাথায় বাজ পড়লো আমার। রৌধিক পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। আমাকে না দেখেই বললেন,

” নাম কি আপনার?”

[চলবে..ইনশাআল্লাহ]