অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব-০৯+১০

0
580

#অনুবদ্ধ আয়াস
#ইফা আমহৃদ
পর্ব:০৯+১০

“আমার বিবাহিত বউকে আপনি কার কাছে বিয়ে দিতে চাইছেন, শ্বশুর মশাই?
আমি এখানে। মানে আপনার মেয়ে জামাই এখানে।”

রৌধিকের কষ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম আমি। ভীত হলাম। অফিসের পোশাকে এসে হাজির হয়েছে এখানে। শুভ, বাবা আর শুভের মা রৌধিকের দিকে চেয়ে আছে সন্দিহান চোখে। রৌধিক তেড়া মানুষ। সত্যি বলে না দিলেই হয়। শুভ আমার দিকে অসন্তুষ্ট চোখে তাকালেন। টেনে টেনে বললেন,
“এই সেই ছেলেটা, যাকে আমি জোনাকির সাথে দেখেছিলাম। সেদিন আমার জোনাকির গায়ে হাত তুলেছিল। ওকে তো আমি..

কথা শেষ করল না। রৌধিকের কলার টেনে ঘু’ষি বসিয়ে দিল গালে। আকস্মিক ঘটা দূর্ঘটনায় রৌধিক নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো। দেয়ালের সাথে গিয়ে বাড়ি খেল। দেয়ালে হাত রেখে উঠতে নেওয়া আগেই আরো একটা ঘু’ষি দিল। রৌধিক মাটিতে পরে গেল। তার চক্ষু জোড়া আগ্নেয়গিরির ন্যায় ফুটছে। দাঁত দিয়ে উপরের অধর চেয়ে ধরেছে। ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরছে। রৌধিক তবুও শান্ত ভদ্র ছেলের মতো সব সহ্য করে রয়েছে। শুভ শান্ত নেই। পুনরায় রৌধিককে মারার জন্য হাত বাড়িয়েছে। আমি থামানোর জন্য এগিয়ে গেলাম। কিছু বলার উদ্যেগ নিতেই গম্ভীর গলায় বাবা বললেন,

“কে হচ্ছে কি শুভ? একজন মানুষ বাড়িতে এসেছে। বসতে না বলে মার’ছো। এটা কোন ধরনের অসভ্যতামি। যাও..
শুভ আরো একটা ঘুষি মা’রলো। চেঁচিয়ে বলল,
“তুমি জানো না, চাচা। এই ছেলেটা সেদিন পাবলিক প্লেসে জোনাকির গায়ে হাত তুলেছে..

“তো! তাই বলে তুমি ছেলেটার গায়ে হাত তুলবে। যাও এখান থেকে..

শুভ প্রখর চাওনি দিয়ে চলে গেল। রৌধিক ঠোঁটের রক্ত মুছতে মুছতে বাঁকা হাসলেন। পকেট থেকে ফোন বের করে টাইপিং করে মিটমিটে হাসলেন।
“কে তুমি বাবা?”

“আমি রাফসান আহম্মেদ রৌধিক। বাকিটা পরে বলছি, আগে আপনি খেয়ে নিন। কতো বেলা হয়ে গেল।”

রৌধিকের সোজাসুজি উত্তর। বাবাকে সালাম করলেন। আলিঙ্গন করলেন। পিঠের পেছনে বালিশ নিয়ে বাবাকে আধ শোয়া করে দিলেন। নাস্তা নিয়ে ধীরে ধীরে খাইয়ে দিলেন। আমাকে ইশারায় মেডিসিন দিতে বললেন। আমি মেডিসিনের বক্স এগিয়ে দিতে নিলেই ছো মেরে নিয়ে দিলেন। লিস্টের সাথে মিলিয়ে বাবাকে খাইয়ে দিলেন। চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন। আমি তার পেছন পেছন গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি জুতোর বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বললেন,
“আধ ঘন্টা সময় দিলাম। এর ভেতরে অফিসে দেখতে চাই। অফিসে এসে একদম আমার কেবিনে আসবে।”

“মানে! বাবার এই অবস্থা। আজকেই হসপিটাল থেকে রিলিজ করেছি, আর আজই অফিসে যাবো। বাবার কখন কী প্রয়োজন হয়!”

রৌধিক এগিয়ে এলেন। আমার হাত ধরে টেনে দুই দেয়ালের মাঝের ফাঁকা স্থান চেপে ধরলেন। হাত সরিয়ে দেয়ালের দুই পাশে রাখলেন। দুজনের মাঝের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে কাছে এলেন। ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললেন,

“আমি তোমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছি কিছু? আমি আসতে বলেছি মানে আসতে হবে। শুনতে পেরেছো তুমি?”

কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো আমার। ভীত কন্ঠে বললাম,” পেরেছি!”
সাথে সাথে দূরত্ব বজায় রেখে সরে গেল সে। পকেটে হাত রেখে
“গুড!” আই লাইক ইট।
তুমি জানো, এই রৌধিকের গায়ে হাত তোলার সাহস কারো নেই। সেদিন তোমার গায়ে আর আজ তোমার শুভ আমার গায়ে হাত দিয়েছে। ওর হাত আমি ভেঙ্গে দিবো। যাতে আমাকে কিংবা আমার জিনিসে হাত দেওয়ার আগে তিনবার অন্তত ভাববে।
আমি মেসেজ করে গার্ডদের শুভকে আটকাতে বলেছি।”

চামড়ার জোতার মৃদু শব্দ করে বেরিয়ে গেল সে। শূন্যতায় মিলিয়ে গেল সে। দমকা হাওয়া বইলো। ধুলো এসে চোখের মাঝে ঢুকলো। চোখের মাঝে কাঁটার মতো বাজতেই নুড়ে গেল চোখের পাতা। ধ্যান ভাঙল আমার। দৌড়ে অপর পাশের বেলকেনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। রৌধিক গাড়িতে বসে, কাঁচ নামিয়ে বেলকেনির দিকে তাকিয়ে আছে। যেন আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। সান গ্লাস টা শার্টের সাথে মুছে চোখে দিয়ে বলল,
“শ্বশুর মশাইকে দুটো ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। মনে হয় না রাতের আগে ঘুম ভাঙবে।”

“মানে কি, এই সময়ে বাবাকে?”

“নো প্রবলেম জোনাকি। আমি একটু হলেও ডাক্তারী সম্পর্কে জানি। তাই তাড়াতাড়ি চলে এসো। তুমি না আসা পর্যন্ত আমি মুখের এই রক্ত মুছবো না। তোমার ওরনা দিয়ে মুছে দিবে।”

অবাক হলাম আমি। রৌধিক গাড়ি চলে গেল। গাড়িটা চোখের আড়াল হতেই বাবার ঘরে এলাম। বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে ওষুধের ডোজে। ঘর গুছিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলাম।
_____________
অফিসে এসে জানতে পারলাম, রৌধিক অফিসে আসে নি আজ। কিন্তু আরো আধ ঘন্টা আগে বেরিয়েছে। ব্যাগ রেখে কাজে লেগে পড়লাম। এভাবে কেটে গেল ঘন্টা খানেক। বারবার আমার শুভোর জন্য ভয় করছে। রৌধিক যা বলেছে যদি সত্যি করে ফেলে। আমার ধ্যান ভাঙল পায়ের আওয়াজে। রৌধিক হনহনিয়ে নিজের কেবিনে গেছে। রৌধিকের পায়ের শব্দ অন্যদের হাঁটার শব্দ থেকে আলাদা। পেছনের পায়ের তলার সাথে ঘসে ঘসে হাটে।
কাজে মনোযোগ দিলাম আমি। বিকট শব্দে কেঁপে উঠলাম। সম্পূর্ণ ফ্লোরের সবাই জড় হয়ে গেল। একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে। ম্যানেজার সাহেব নেই। তাকে বদলি করা হয়েছে। কাল থেকে নতুন ম্যানেজার আসবে। সবাইকে কাজ করতে বলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। দরজা নক করলাম কোনো রেসপন্স পেলাম না। তাই বাধ্য হয়ে ভেতরে ঢুকলাম। কেবিনের সব জিনিস ভেঙে পড়ে আছে। রৌধিক কোথাও নেই। কয়েক পা ফেলতেই দরজাটা ঠাস করে বন্ধ হয়ে গেল। কেঁপে উঠলাম আমি। পেছনে ফেলতেই রৌধিকের ভয়ংকর মুখের সম্মুখীন হলাম।‌ মুখশ্রী পুরো লাল হয়ে গেছে। রাগে নাকি রোদের তাপে বুঝতে ব্যর্থ হলাম। এখনো রক্ত শুকিয়ে আছে। আমি ওরনা দিয়ে রক্ত মুছে দিতে লাগলাম। তিনি স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞাসা করল,
“শুভ তোমার কে হয়?”

হাত থেমে গেল। ভুতুড়ে ঢোক গিলে বললাম,
“মানে..
আমাকে ছেড়ে দেয়ালে আঘাত করে বলল,
“তুমি কানে শুনতে পাও না। আমি জানতে চাইছি, শুভ তোমার কে হয়?”

“শুভ আমার বাবার দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে।”

বিরাগী হলো রৌধিক। এগিয়ে এসে খামচে ধরলো বাহু। ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“আমি জিজ্ঞাসা করেছি, তোমার কী হয়? তোমার বাবার কী হয়, সেটা নয়।

রৌধিকের হাতের নক জামা ভেদ করে কাঁধে ঢুকে যাচ্ছে এমন অবস্থা হয়েছে। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠছি আমি। দেহ সহ্য করার ক্ষমতা রাখলেও চোখ রাখলো না। গড়িয়ে পড়লো অশ্রুধারা। নত কন্ঠে বললাম,
“ছাড়ুন। ব্যাথা পাচ্ছি।”

রৌধিক আমার দিকে চাইলেন। বাম চোখের পানিটুকু বৃদ্ধ আঙুল দিয়ে মুছে দিলেন। ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। নিজেকে সংযত করে স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
“জোনাকি, যাও। আমার সামনে থেকে, আমার অফিস থেকে যা। বাড়ি চলে যাও তুমি। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছি। মাথা খারাপ হয়ে গেলে আর পারব না।”

জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। হাত তার মুষ্টিবদ্ধ করা। আমি পেছনে দাঁড়িয়ে বললাম,

” শুনুন..

” কি শুনবো আমি। কি বলতে চাও। সামান্য একটা কথা বলতে তুমি পারছো না। অন্যর কাছে শুনতে হয়, তুমি তার বাধ্য’ক্তা। আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না, তুমি তার প্রাক্তন নাকি হবু বউ..

“স্যার, নতুন ম্যানেজার এসেছে। ”
দরজা খুলে একজন স্টার্ফ বলল। রৌধিক কোর্ট টা তুলে গায়ে জড়াতে জড়াতে বলল,
“তাকে বসতে বলুন। আর একজন স্টাফ পাঠান। এগুলো পরিস্কার করে দিন।”

“ওকে স্যার” বলে স্টার্ফ চলে গেল। রৌধিকও তার পিছু চলে গেল। আমি নামক একজন মানুষ যে এখানে আছি, তা হয়তো তার কাছে মনেই হয়নি। আমি চলে এলাম। নিজের টেবিলে রাখা ব্যাগ টা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। জীবন টা বড্ড অগোছালো লাগছে। রৌধিক নামক মানুষটা আমার জীবনের ছন্দ বদলে দিয়েছে। হারিয়ে দিয়েছে মানে। সে নিজেই জানে না, সে কি চায়।
আপনি বড্ড খারা’প রৌধিক। আমাকে বুঝতে পারেন না।

অতিশয় অপমানে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। রৌধিকের ব্যবহারে সবকিছু ঝাঁপসা লাগছে। মাথাটা ধরে আছে সকাল থেকে। রাস্তা জ্যামে আঁটকে আছে অধিক সংখ্যক গাড়ি। তার ফুট পাত দিয়ে হেঁটে চলেছি আমি। দু হাতে বাজারের ব্যাগ ভর্তি বাজার। সিগন্যাল পড়ল। যাত্রীরা একে একে রাস্তা পাড় করতে লাগলো। আমিও রাস্তা পেরুতে লাগলাম। মাঝপথে যেতেই একটা চলন্ত বাইক ছুটে এলো। আমার পা ঘেঁষে ছুটে গেল বহুদূরে। হাঁটুতে ধাক্কা লাগল। হুট করে নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে রাস্তার মাঝে পরে গেলাম আমি। পায়ে হাত দিয়ে বসে পড়লাম নিচে। ব্যাগটা হাতে থেকে নিচে পড়ে গেল। পাটের ব্যাগ হওয়াতে বাজারপত্র ব্যাগের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রইল। আমি চাপা আর্তনাদ করে সিগন্যালের দিকে চাইলাম। এখন লাল রঙের আলোটা জ্বলছে। দশ সেকেন্ডে রয়েছে। আমি নিজেকে সামলে উঠার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হলাম। সময় ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। ভিড় জমে গেল মুহুর্তেই। কেউ একজন গম্ভীর গলায় বললেন,
“আপনারা সরুন। আমি দেখছি।”

সবাই ফাঁক করে তাকে ভেতরে আসার জায়গা দিলেন। হুট করে কেউ এসে সামনে দাঁড়ালো। ফর্সা একজন ছেলে। গায়ে সাদা এপ্রোন। হাঁটু গেড়ে বসলো পাশে। ব্যাগ গুলো হাতে নিয়ে নিজের গাড়িতে রাখল। আমার পাশে বসে ধরে ধরে উঠানোর চেষ্টা করলো। ব্যর্থ হলো সে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
“দাঁড়িয়ে না থেকে তুলুন ওনাকে।”
পেছন থেকে একজন তরুণ বেরিয়ে এলো।
আমার বাহুতে হাত রেখে ফুটপাতে নিয়ে এলেন। বিদ্যুৎ খাম্বের সাথে দাঁড় করিয়ে এদিকে ওদিক চাইলেন। ধৈর্য হারা হয়ে বললেন,
“এখানে তো একটা ফার্মেসি ছিলো। ফার্মেসি টা কোথায় গেল!”

এই প্রথম ছেলেটির মুখ দেখলাম আমি। কাকতালীয় ভাবে এই ছেলের মুখের সাথে আমার যথেষ্ট মিল রয়েছে। আমার থুতনির মাঝবরাবর যেখানে তিল তারও ঠিক একই জায়গা তিল রয়েছে। সেই তরুণী না বুঝার কন্ঠে বললেন,
“স্যার আপনিই তো ডাক্তার। আপনিই যদি ওনাকে ব্যান্ডেজ টা করিয়ে দিতেন।”
বুঝতে পারলাম, এই মেয়েটা তার এসিস্ট্যান্ট। ডাক্তার ছেলেটি মেয়েটির দিকে বিরাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
“এরজন্য আপনাকে আমি অপদার্থ বলি মিস্ বিভা। আমি ডাক্তার হলেও একজন পুরুষ। মহিলা মহিলার কাছে ক্লোজলি সবকিছু শেয়ার করতে পারে।”

ডাক্তার কিয়ৎক্ষণ গভীর ভাবে ভেবে আমাকে নিজের গাড়ির কাছে নিয়ে গেলেন। ফাস্ট এইড বক্স বের করে বিভার কাছে দিয়ে বেরিয়ে এলেন। হাঁটুতে অনেকটা ছিলে গেছে। বিভা নিজেই ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে।

গাড়িতে বসে আছি ডাক্তার সাহেব, বিভা আর আমি। বাড়ির সামনে এনে গাড়ি থামালেন। বিভার দিকে চেয়ে সহজ ভাষায় বললেন,

“ওনাকে রুমের ভেতরে দিয়ে তবেই আসবেন। (ব্যাগগুলো দেখিয়ে) এগুলোও দিয়ে আসবেন।”

বিভা মেয়েটি আমাকে একদম ঘরে রেখে এলো। অতঃপর আবার ব্যাগ নিয়ে এলো।

পায়ের এই অবস্থা দেখে জয়া পুরো কেঁদে দিলো। বাবাও একটু বকলেন। জয়া কাঁদতে কাঁদতে ঘরের পুরো কাজ করলো। আমাকে একদম কোনো কাজে হাত লাগতেই দেয় নি। রাতে ব্যাথাটা একটু বেড়েছিল। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
_________
সকাল ১০ টা এগারো। লাইব্রেরী তে বসে আছি আমি
সকাল সকাল অহির ফোন করে পরীক্ষার কথা জানায়। দুদিন পর থেকে পরীক্ষা। তাই পায়ে ব্যাথা নিয়েও ক্লাস করতে এসেছি।

খাতায় কলম চালাচ্ছি আমি। অহির দেওয়া নোটস গুলো নিচ্ছি। কনুই দিয়ে গুঁতা দিয়ে বলল,
” কি ব্যাপার তোর জোনাকি? এসে থেকে দেখছি, কেমন চিন্তায় আছিস। কেমন জানি বদলে গেছিস তুই।”

আমি এক গাল হাসলাম। ভ্রু কুঁচকে বললাম,
” কেমন লাগছে?”
“মনে হচ্ছে তুই বিয়ে করে ভূত হয়ে গেছিস। ”
“বিয়ে করলে বুঝি ভূত হয়ে যায়?”
“তা নয় কিন্তু তোকে বিবাহিতা মহিলাদের মতো লাগছে।”

আমি কিছু বলবো তাই আগেই বেল বেজে উঠলো। ব্যাগ গুছিয়ে ক্লাসের দিকে হাঁটা দিলাম।
ক্লাসে বসে আছি। স্যার ক্লাসে পড়া বুঝাচ্ছে। গালে হাত গিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি। হুট করেই মনে হলো আমার ওরনাটা আমার কাছে নেই। কেউ পেছন থেকে ধীরে ধীরে ক্রমাগত আমার ওরনা টেনে চলেছে। আমি বুকে হাত দিলাম। ওরনাটা টেনে পেছনে তাকালাম। একটা ছেলে আমার ওরনা টেনে হাতে পেছাচ্ছে। আমি একটু সামনে এগিয়ে বসলাম। নত কন্ঠে বললাম,
“অহি তোর কাছে কোনো সেপটিফিন আছে?”

“কেন?”

“ওরনাটা পড়ে যাচ্ছে। থাকলে দে!”

অহি সেফটিপিন দিতেই ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিলাম শরীরে। একটু পরে সামনের দিকে খেয়াল করলেই বুঝতে পারলাম। কয়েকটা ছেলে ফোন হাতে নিয়ে কিছু একটা দেখছে আর হাসছে। বিশ্রী তাদের হাঁসি। ইশারায় আমাকে দেখাচ্ছে। বিরক্ত হলাম আমি। বারবার মনে হচ্ছে, আমাকে নিয়েই তারা হাসছে। ভেবে নিলাম, আর ক্লাস করব না। তাই ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। অহিও আমার পেছনে পেছনে চলে এলো।
করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“কি হয়েছে তোর জোনাকি? এতো দিন পর ভার্সিটিতে এসেছিস। তারপরেও ক্লাস করবি না।”

“আমার ইচ্ছে। আমি কী করব না, না করব। এখন তোকে জিজ্ঞাসা করতে হবে..

“কুল জোনাকি। আমি শুধু জিজ্ঞাসা করছি, কেন এসেছিস। এতো হাইপার হওয়ার কী আছে। আশ্চর্য।”

ছেলেগুলোর উপর রাগ দেখাতে গিয়ে অহির সাথে বা’জে ব্যবহার করে ফেললাম। তাই ছোট করে স্যরি বললাম। অতঃপর করিডোর দিয়ে বাইরে তাকালাম। মনে হলো রৌধিকের মতো কেউ ভার্সিটির ভেতর আসছে। আমি চোখ পরিষ্কার করে আবার চাইলাম।‌সেটা রৌধিকই ছিলো। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাঁসি ফুটে উঠল। রৌধিক মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চাইলো। অতঃপর উপরের দিকে এগিয়ে এলো। আমিও রৌধিককে দেখে নেমে গেলাম নিচে। চারপাশে সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। পারলেই যেন গিলে খায়। মেয়েরা রীতিমতো বলছে,
“কী হ্যান্ডসাম বয়। যে করেই হোক এই ছেলেটার সাথে প্রেম করতেই হবে।”

আমি বিরবর করে বললাম,” দাঁড়া শাত’চুন্নি।
রৌধিক আমার সামনে আসতেই তার পথ আঁটকে দাঁড়ালাম। পায়ের দিকে চেয়ে রইল। ধীরে ধীরে মুখ উপরে তুলে মুখের দিকে চাইলো। স্বাভাবিক স্বরে বললেন,
“সমস্যা কী? সামনে থেকে সর।”
রৌধিক পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই আমি হাত দিয়ে আঁটকে দাঁড়ালাম। সন্দিহান স্বরে বললাম,
“আপনি এখানে কী করছেন?”

আমার হাত সরিয়ে ধমকে বললেন,
“তোমাকে আমি সরতে বলছি। সর..

আমাকে সরিয়ে দিয়ে ধপাধপ পা ফেলে চলে গেলেন। মুহুর্তেই হেঁসে উঠলো সকলে। বিদ্রুপ করে বলল,
“দেখ, মেয়েটার অবস্থা। পাত্তাই দিল না। বলি, তোমাকে দেখতে তো ভালো ঘরেই মেয়ে মনে হয়। কিন্তু তোমার পেটে পেটে এতো দূর।”

আরেকজন বলল,
“ছেলে দেখলেই শুরু হয়ে যায়। বলি পেটে পেটে এতো দূর?”

একদিকে ক্লাসের ছেলেদের কান্ড, অন্যদিকে রৌধিকের এই অবহেলা আবার এদের কটু কথা। সবকিছুতেই কান্না পেয়ে গেল আমার। কাউকে কিছু না বলে কাঁদতে কাঁদতে চলে এলাম।
.
বেশ কিছুক্ষণ ধরে লাইব্রেরী বসে কেঁদে চলেছি আমি। সবাই আমাকে দেখলেই হাসে। অহি এসে আমার পাশে বসে বলল,
“তুই এখানে আর আমি তোকে সব জায়গায় খুঁজছি।”

আমি প্রত্যুত্তর দিলাম না। অহিও কোনো কথা বললো না, হয়তো উত্তর টা ওর জানা। আমাকে শান্তনা দিতে দিতে বলল,
” ঐ ছেলেটা কে? তুই চিনিস তাকে? তোর ব্যবহার দেখে মনে হলো, তুই তাকে চিনিস। কিন্তু তার ব্যবহার দেখে মনে হলো, সে তোকে চেনে না।”

এবারও কিছু বললাম না। আমি নির্বিকার ভাবে কেঁদে চলেছি। এভাবেই সময় অতিবাহিত হলো কিয়ৎক্ষণ। অহি পুনরায় বলল,
“ছেলেটা মাঠের মাঝখানে কতো গুলো ছেলেকে মা’রছে। কেউ ধরার সাহস পাচ্ছে না।”

“মানে?”

“আমি নিজেই জানি না। দেখলাম ঐ ছেলেটা কতোগুলো ছেলেকে মাঠের মাঝখানে ফেলে মারছে। ভিড় জমে গেছে।”

আর শোনার মতো পরিস্থিতিতে রইলাম না আমি। আগে পিছনে না চেয়েই ব্যাথার্ত পা নিয়ে ছুটলাম। মাঠের মাঝখানে ভিড় জমে গেছে। ভিড় ঠেলে ভেতরে গেলাম। রৌধিক ক্লাসের সেই ছেলেগুলোকে এবড়ো থেবড়ো লা’থি দিয়ে যাচ্ছে। ভয়ংকর লাগছে তাকে। একটু পরে কপালের ঘামটুকু মুছে ফেলছে। হাতে তার মোটা লাঠি। ছেলেগুলোর নিচে পড়ে আছে। হাত পা থেকে রক্ত পড়ছে। রৌধিকের থামার নামই নেই। ফোনগুলো ভেঙ্গে পড়ে আছে নিচে।

আমি রৌধিকের কাছে গিয়ে লাঠি ফেলে দিলাম। চেঁচিয়ে বললাম,
” কী? সমস্যা কী আপনার? এভাবে মা’রছেন কেন ওদের? কী করেছে ওরা?”

“এখন তুমি আমাকে শিখাবে আমি কী করব?”

তৎক্ষণাৎ প্রিন্সিপাল স্যার এসে হাজির হলো। চেঁচিয়ে বললেন,
“কে আপনি? আমাদের ভার্সিটির স্টুডেন্টদের কে কেন মা’রছেন?”

” আমি রৌধিক। আহম্মেদ গ্ৰুপ এড ইন্ডাসট্রির মালিক আদ্রিক আহম্মেদের একমাত্র ছেলে। কেন এদের মা’রছি তাই তো। চলুন বলছি..

বলেই প্রিন্সিপালের সাথে চলে গেলেন তিনি। সাথে সাথে এম্বুলেন্স এসে এদেরকে নিয়ে গেল। আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম।
সবাই আমার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছে। বিদ্রুপ করে বলছে,
” হিরোর সামনে হিরোইন সাজতে এসেছিলো, এখন জিরোইন হয়ে গেছে।”

আমি আশাহত মন নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কেন আমার সাথে সবসময় এভাবে ব্যবহার করেন তিনি। আমার সাথে একটু ভালোভাবে কথা বলা যায় না।

[চলবে..ইনশাআল্লাহ]