অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব-১১+১২

0
569

#অনুবদ্ধ আয়াস
#ইফা আমহৃদ
পর্ব:১১+১২

একটা বড় কালো রঙের গাড়ি এসে আমার সামনে থামলো। এক নজর দেখেই বুঝতে পেরেছি, এটা রৌধিকের গাড়ি। তবুও আমি সেদিকে না তাকিয়ে সামনের দিক এগিয়ে যাচ্ছি। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো রৌধিক। পেছন থেকে ক্রমাগত “জোনাকি, জোনাকি” বলে ডেকে চলেছে। আমি পাত্তা দিলাম না। পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলাম। এই লোকটার সাথে কোনো কথা নেই আমার। কখনো কোনো কথা বলবো না। না মানে না‌। পেছন থেকে টেনে ধরলো হাত। আমার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
“কী হয়েছে তোমার? কতোবার ডাকছি, শুনতে পারছ না কেন? আশ্চর্য।”

আমি তার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলাম। আমাকে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন। নিজের অপর হাত দিয়ে চোখের পানিটুকু মুছে দিয়ে বললেন,
“কী হয়েছে তোমার জোনাকি? কাঁদছ কেন? হুয়াই?”

অভিমান ভরা মন নিয়ে শুধালাম,
“সমস্যা কী? সামনে থেকে সরুন।”
হাতটা আরেকটু চেপে ধরে বললেন,”আমার সাথে চলো।”

“এখন আপনি আমাকে শেখাবেন, আমি কী করব? তাছাড়া আমি কেন কাঁদবো? আমি মোটেও কাঁদছি না। সরুন আমার সামনে থেকে। পথ ছাড়ুন।”

রৌধিক আমার দিকে অসহায় চোখে চেয়ে রইলেন। পাশ থেকে রিক্সা যেতে দেখলাম। তাই রিক্সা দাঁড় করিয়ে চুপচাপ উঠে বসলাম। আশে পাশের মানুষ কেমন কটু চোখে আমাদের দিকে চেয়ে আছে। রৌধিক রিক্সায় হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন।‌ মানিব্যাগ থেকে থেকে টাকা বের করে মুঠ করে রিক্সা ওয়ালার হাতে দিয়ে দিলেন। মিটিমিটি হেসে বললেন,
“চাচা আমার বউ। একটু ঝগড়া হয়েছে, তাই কিছুতেই যেতে চাইছে না!”

রিক্সা ওয়ালাও তার সাথে আমাকে শান্তনা দিলেন,”মা, সংসারে এমন ঝ’গড়া ঝাঁটি স্বামী স্ত্রীর মাঝে সবসময় হয়। যাও, ফিরে যাও।”

আমি তৃক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে রৌধিকের দিকে তাকালাম। কিছু না বলেই কোলে তুলে নিলেন আমায়। হাত দিয়ে গাড়ির দরজা টা খুলে আমাকে ফন্ট সিটে বসিয়ে দিলেন। লক করে দিলেন, যাতে বের হতে না পারি। অতঃপর তিনি ঘুরে এসে সামনের সিটে বসলেন। গাড়ির কাঁচ তুলে দিলেন। বললেন,
“আশ্চর্য তো কাঁদছো কেন?”

আমি গাড়ির দরজার সাথে মিশে গেলাম। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। রৌধিক একটু এগুলেন। অতঃপর হাত টেনে নিজের কোলে বসিয়ে দিলেন। দুগালে হাত রেখে গম্ভীর গলায় বললেন,
“কথা বলবে না?”

প্রত্যুত্তর দিলাম না আমি। বিনিময়ে ফুঁপিয়ে উঠলাম। রৌধিকের হাত গাল থেকে নামিয়ে মুখ আড়াল করে নিলাম। রৌধিক আমাকে তার বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

” আমার উপর অভিমান করেছো তুমি? আ’ম স্যরি দীপ্তিময়ী। আমার মাথা এতোটাই গরম হয়ে গেছিলো। ওদেরকে না মা’রা পর্যন্ত আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। আমি তোমাকে হার্ট করে ফেলেছি?”

নিজের থেকে রৌধিককে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু এতোবড় একটা হাতির মতো মানুষের কাছে আমি মশার চেয়েও ক্ষুদ্র। কিয়ৎক্ষণ চেষ্টা করে না পেরে বললাম,
“একদম আমার সাথে কথা বলবেন না আপনি, একদম না। আমার চারপাশেও আসবেন না।
বুকে মুখ গুঁজেই রইলাম। রৌধিকের গলা জড়িয়ে ধরে দৃঢ় করে নিলাম। সামনের দুটো বোতাম খুলে নাক মুছে নিলাম শার্টে। নাক কুঁচকালেন। কিছু বললেন না মুখে। আমি নাক মুছতে মুছতে বললাম,
“আপনি বড্ড খা’রাপ রৌধিক। আমাকে সবর্দা কষ্ট দেন। কি করেছি আমি? জানেন ওরা আমাকে কতো বা’জে কথা বলছিলো? আমি দেখতে সাদাসিধে হলেও পেটে পেটে নাকি অনেক। আমি ছেলে দেখলেই শুরু করে দেই।”

তিনি কিছু বললাম না। তার হাত দুটি আমার পিঠে রেখে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন। রৌধিকের মুখের আকৃতি কেমন হয়েছে, ধারণা নেই। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
” স্যরি আর কেঁদো না, আমার জন্য যখন তোমাকে এতো কিছু সহ্য করতে হয়েছে। আমি সবকিছু ঠিক করে দিবো।”

“কী ঠিক করবেন আপনি? কী ঠিক করবেন? অহিও আমাকে বলছে, আপনি আমাকে চেনেন না। অথচ একটু আগে বললেন, আমি আপনাদের ওয়াইফ। তাহলে? তখন কেন ইগনোর করলেন? হুয়াই?”

রৌধিক আমাকে একপাশে নিয়ে নিজের পড়নের শার্টটার বোতাম খুলে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। নিচের দিকটা দিয়ে নাক মুছে দিয়ে বললেন,
“এবার পুরোটাই তোমার। নাক মুছা হয়ে গেলে বাড়িতে নিয়ে যেও। গোসল করে মাথা মুজো!”

“আপনি মুছেন। আমি এখন বাড়িতে যাবো‌। কোনো কথা বলবো না, আপনার সাথে।”
আর কিছু বললাম না আমি। কেঁদে চলেছি ক্রমাগত। রৌধিক আমার মাথায় হাত চালাচ্ছে। বোতলের ছিপি খুলে হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি পানি খেয়ে আবার রৌধিকের বুকে মাথা গুজলাম। তিনি বুঝিয়ে চলেছে আমায়। রৌধিকের মিষ্টি মিষ্টি কথায় বাচ্চাদের মতো ঘুম পাচ্ছে আমার। রৌধিকের কান্ডে ঘুমের পড়লাম একসময়।‌
_____________
মাঝরাত। চারিদিকে অন্ধকার বিরাজমান। যাকে বলে ঘুটঘুটে অন্ধকার। চোখ মেলেতেই আলোকহীন আঁধার দৃষ্টিগোচর হলো। জানালার মস্ত পর্দাটা হাওয়ায় উড়ছে। শিশির বিন্দু পড়ার আওয়াজ শুনতে পারছি। ওঠার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারলাম, অদৃশ্য কোনো বন্ধনে আমি পেঁচিয়ে আছি। সামনের দিকে চাইতেই ল্যাপটপের মৃদু আলো চোখে পড়লো। রৌধিক একহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আমি তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিলাম। আমাকে একহাতে পেঁচিয়ে ধরে ল্যাপটপে কাজ করছে সে। ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করলাম। রৌধিক আমার দিকে তাকিয়ে হাত সরিয়ে নিলাম। উঠে বসলাম আমি। তিনি ল্যাপটপ টা রেখে আলো জ্বালিয়ে দিলো। চোখ কুঁচকে এলো আমার। ঝাঁপসা সবকিছু পরিষ্কার হতেই বুঝতে পারলাম, আমি রৌধিকের ঘরে। রাত দুইটা বাজে। মাথায় বাজ পড়ল আমার। বাবা নিশ্চয়ই আমার জন্য চিন্তা করছে। আমি কখনো এতোক্ষণ ঘুমাই না, আজ কি হলো আমার। পানিটা খাওয়ার পরই ঘুম ঘুম পেয়েছে।
বালিশের পাশে ওরনাটা রাখা। আমি ঝরনা কোনোরকম শরীরে পেঁচিয়ে নেমে দাঁড়ালাম বেড থেকে। রৌধিক আমার হাত ধরে ফেললেন। সন্দিহান গলায় বললাম,
“দৌড়াচ্ছো কেন? কোথায় যাচ্ছ তুমি?”

“বাড়িতে। জয়া, বাবার আমার জন্য চিন্তা করছে।”

“চিন্তা করছে না। হাত মুখ ধুয়ে এসো। কিছু খাবে। দুপুরে ঘুমিয়েছো, এখন উঠেছো। এতো ঘুম কাতুরে তুমি।”

বলেই মিটিমিটি হাসলেন তিনি। তিনিই কিছু একটা করেছেন, যাতে আমি এতোক্ষণ ঘুমাই। আবার বলছে চিন্তা করবে না।

“মানে..
“মানে জানতে হলে, আগে খেতে হবে। এতো রাত করে শাওয়ার নেওয়ার দরকার নেই। ঠান্ডা লেগে যাবে। কিছু খেয়ে নাও, যাও..

এতো রাতে একা বাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়। হাত মুখ ধুয়ে, মাথায় পানি দিয়ে বেরিয়ে এলাম। বেডের উপর একপা তুলে বললাম,
“এবার বলুন।”

রৌধিক টাওয়াল এনে ধীরে ধীরে চুল মুছিয়ে দিলেন। হাত পা মুখ মুছিয়ে দিয়ে খাবার এগিয়ে দিয়ে বললেন,
” আমি দুজন আয়া পাঠিয়েছি তোমার বাড়িতে। তারাই যাবতীয় কাজ এবং তোমার বাবার অসুস্থতা দেখবে। রান্নাও করবে।
আমি ফোন করে বলেছি, অফিসের কাজে আঁটকে গেছ। তাই আজকে ফিরতে পারবে না।”

রৌধিক টেবিলের উপর থেকে খাবার নিল। মেখে আমার মুখের সামনে ধরল। মুহুর্তেই মন পড়ল তার তিক্ত ব্যবহারের কথা। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। রৌধিক একহাত দিয়ে গাল চেপে অন্যহাত দিয়ে খাবার মুখে পুড়ে দিল। অধর চেপে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
“মুখের খাবার ফেললেই তোমার খবর আছে।”

আমি মুখ ফুলিয়ে খেতে লাগলাম। এই ছেলেটা সবসময় আমার উপর জোর খাটায়। আমিও জিম করব। তার চেয়েও বড়, শক্তিশালী বডি বানিয়ে গায়ের জোর দেখাবো। হমমম্।
_______
রৌধিক সকালে উঠেই অফিসে চলে গেছে‌। আমি ভার্সিটিতে এসেছি। অহি আমার পাশে বসে আছে। রৌধিক তো কালকে বড় বড় কথা বলেছিল, আজকে সে আসবে। কোথায় সে? আসেনি তো।
আমি মন খারাপ করে ক্লাসের দিকে পা বাড়াতেই অহি বলে উঠল,
“ঐদিকে দেখ জোনাকি। কালকে যেই ছেলেটা এসেছিল না, সেই ছেলেটা আজকেও এসেছে।”

আমি ফিরে চাইলাম। সবাই ছোট বড় বড় করে রৌধিকের দিকে তাকিয়ে আছে। রৌধিক ধীরে ধীরে হেঁটে আমাদের দিকে আসছে। আজকে আমি আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলবো না, যদি সে আজকেও এড়িয়ে যায়।

রৌধিক একদম আমার সামনে এসে দাড়ালো। ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। আমার গালে হাত রেখে হুট করেই অধরে অধরে ছুঁয়ে দিলেন। সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার আগেই সরে দাঁড়ালো সে। আমার হাত ধরে বলল, ” চলো।”
আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলাম। ছুটতে লাগলাম। রৌধিক পেছনে পেছনে আসছে। আমাদের এভাবে দেখে মেয়েগুলো বলছে,

“এইটা সেই মেয়েটা না, যাকে গতকাল রৌধিক রিজেক্ট করেছিলো। তাহলে ওরা একসাথে কি করছে..
দেখেছিস, একদিনে কতোদূর চলে গেছে।”

আরেকজন কটু করে বলল,
“মাত্র দেখলি না, পাবলিক প্লেসে কী করল। আই থিংক, নিজের শরীর দেখিয়ে ইমপ্রেস করেছে।”

বলেই হেঁসে উঠলো সকলে। এমন কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। পা জোড়া থেমে গেল। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসছে। চোখের পানি টলটল করছে, এই বুঝি ঝরে পড়লো। রৌধিক আমার চিবুক টেনে ধরে উঁচু করে নিল। বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্যে আমার চোখের পানিটুকু মুছে দিল। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“জবার টা দিবে, চলো।”

আমি পাথরের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। রৌধিক টেনে টেনে আমাকে ওদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। কোমড় জড়িয়ে ধরে বললেন,
“ও আমার কেউ নয়। আমি ওকে চিনতাম না, ইভেন্ট প্রেমিকাও নয়।”

আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম। কি বলছে রৌধিক। তিনি কী আমাকে সবার সামনে ছোট করতে নিয়ে এসেছে। আমি হাত ছাড়িয়ে চলে আসার উদ্যেগ নিতেই রৌধিক টেনে ধরলেন। ঘাড়ের পেছনে হাত রাখলেন। অধরে অধরে ছুঁই ছুঁই। সূক্ষ্ম কন্ঠে বললেন,
“ও আমার পৃথিবী। আমার সবকিছু। আমার ওয়াইফ।”

আমাকে ছেড়ে দিয়ে ওদের উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোমরাও তো মেয়ে, অন্য একজন মেয়ের সম্পর্কে এমন কথা বলতে তোমাদের বিবেকে বাঁধে না? আমি ভাবতেই পারছি না।
নেক্সট টাইম, এমন চিন্তা ভাবনা করো না।”

আমি রৌধিকের দিকে ফেলফেল দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। হাত জড়িয়ে বুকে মাথা গুঁজে বললাম,
“যাকে ভালোবাসি, তাকে শরীর দেখিয়ে ইমপ্রেস করার প্রশ্নই আসে না। এমনিতেই সে আমার। তাছাড়া রৌধিক আমার হাসবেন্ড। দিন শেষে সে নিজেই আমার কাছে আসবে।”

আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। রৌধিক আমাকে পূর্বের ন্যায় ধরেই সামনের দিকে অগ্ৰসর হলেন। প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে নিয়ে গেলেন। দরজা নক করতেই রৌধিককে দেখে ভেতরে প্রবেশ করতে বললেন। আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। রৌধিক বসলেন। আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। শত হোক, তিনি আমার শিক্ষক। তার সামনে কিছুতেই বসা সম্ভব নয়। প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এই তবে আপনার ওয়াইফ জোনাকি। আই ক্যান নট, বিলিভ ইট। বসো!
তুমি কী জানো, তোমার জন্য রৌধিক কতোটা হাইপার হয়েছে।”

“না স্যার। আমি ঠিক আছি।”
মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরতে লাগল, আমার জন্য রৌধিক হাইপার হয়ে গেছে। আমার জন্য রৌধিক এখানে এসেছিল, আর আমি তাকেই কতো কথা শুনিয়ে দিলাম। কিন্তু ঐ ছেলে গুলোকে কেন মারলেন।

স্যার হয়তো উপলব্ধি করতে পারলেন আমার অবস্থা। মৃদু হাসলেন এক ঝলক। একটা পেপার বের করে এগিয়ে দিলেন রৌধিকের দিকে। রৌধিক পেপার গুলো পড়লেন। চোখ তুলে বললেন,
“এখানে তো চারজনের নাম রয়েছে। কিন্তু ওরা তো পাঁচজন ছিলো।”

“তা ছিল, কিন্তু হসপিটাল থেকে একজন পালিয়েছে। কে পালিয়েছে, ইনসিউর করে বলা যাচ্ছে না। পরে তার নামটাও এড করা হবে।”

“ওকে!”
________
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। সূর্য কিছুটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। ছায়া পড়েছে বিশাল বিশাল। রৌধিক আর আমি পাশাপাশি বসে আছি। রৌধিক ড্রাইভ করছে।‌ আমি নিজের ভেতরে কিয়ৎক্ষণ ভেবে ফট করে বললাম,
“আপনি আমার জন্য মারামারি করেছেন? কিন্তু কেন করেছেন?”

রৌধিক মিররের দিকে অবলোকন করলেন। যেখানে আমাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দৃষ্টি নামিয়ে পুনরায় গাড়ির ড্রাইভ করতে মন দিলেন। আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,
“আমি কিছু জানতে চাইছি আপনার থেকে, শুনতে পাচ্ছেন!”

পানির বোতল বের করে এক ঢোক খেলেন তিনি। পূর্বের জায়গায় রেখে দিলেন।
রৌধিকের এমন বিহেবিয়ারে মাথা বিগড়ে যাচ্ছে আমার। আমি নামক একটা তরুণী যে, তার গাড়িতে আছি। সেটা বুঝাই যাচ্ছে না। বিরাগী হলাম আমি। ব্যাগটা কাঁধে তুলে চেঁচিয়ে বললাম,
“স্টপ দা কার। আই সেইড স্টস দা কার।”

বন্ধ গাড়ির অন্তর্ভাগে শব্দ টা একটু বেশিই জোরে শোনালো। কয়েকবার প্রতিধ্বনি শোনা গেল। অতঃপর মিলিয়ে গেল। রৌধিকের কোনো ভাবাবেগ নেই। আমি নাক ফুলিয়ে দরজা খুলে নিলাম। বেল্ট খুলতে লাগলাম। রৌধিক ফট করে গাড়ি থামিয়ে দিল। আমার দিকে ঝুঁকে দরজা ভেতর থেকে টেনে লক করে দিলেন। এক পা সিটের উপর তুলে বললেন,
“সমস্যা কী তোমার? চলন্ত গাড়ি থেকে জাম্প দিবে নাকি?”
চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, “আমার উত্তর না পেলে, প্রয়োজন হলে তাই করব।”

রৌধিক কাঁধে ইয়ার ফোন গুঁজল। এসি অন করে দিল। চোখে নীল রঙের সানগ্লাস টা ব্যবহার করলেন। দুহাত বুকে গুঁজে বললেন,
“নাও স্টার্ট।”

“মানে কী?”
“মানে, এতোক্ষণ যেমন মাছির মতো ভনভন করছিলে, এখন আবার শুরু কর।”

এতোবড় অপ’মান। আমাকে মাছি বলা। হুট করেই রৌধিকের কোলে চেপে বসলাম। কান থেকে ইয়ার ফোন খুলে স্টেয়ারিং এর উপর রাখলাম।‌ চোখের সানগ্লাস টা নিজের চোখ পড়ে রুব্ধ স্বরে বললাম,

“আপনি বলবেন কি-না বলেন না?”
“সহ্য করতে পারবে না। না শোনাই শ্রেয়।”
“তবুও আমি শুনতে চাই, প্লীজ বলুন। প্লীজ।”

রৌধিক গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দিল। জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল,
“যে ছেলেটা হাত ভেঙেছি, সে পেছন থেকে তোমার ওড়না টেনে ধরেছিলো। যে ছেলেটার মাথায় আঘাত করেছি, সে ছেলেটা ভিডিও করছিলো। (একটু থেমে আবার) বাকি ছেলেরা সেই ভিডিও একে অপরের কাছে শেয়ার করছিল।”

অধর চেপে থেমে গেল রৌধিক। ধাক্কা খেয়াল আমি। বাঁধ ভেঙে গেল। ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি। বাম পাশে ফিরে গেলাম। ব্যাগ থেকে টিস্যু পেপার বের করে মুখ চেপে ধরলাম। রৌধিক হাত ধরে টেনে নিজের দিকে ফিরিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,
“এরজন্যই বলেছিলাম, না জানাই শ্রেয়। কিন্তু শুনলে না।”
আমি রৌধিকের কলার টেনে অশ্রুমিশ্রিত কন্ঠে বললাম, ” ওরা এই ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় আপ দেয় নি তো? আমি কিভাবে সবাইকে মুখ দেখাবো।‌ কী করব আমি এখন..

“কাঁদে না দীপ্তিময়ী। ওরা এখনো কিছু করতে পারেনি। শুধু ওদের ফোনেই ছিলো। আমি ফোন ভেঙ্গে ফেলেছি। আর কোনো ভয় নেই।”

“যদি থেকে থাকে তখন?”

এবার কিছুটা ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন, “বলছি তো আর কোনো ভিডিও নেই।”

“আপনি জানলেন কী করে?”

রৌধিক হাসলো মৃদু। বোতল বের করে এগিয়ে দিলেন। ইশারায় খেতে বললেন। আমি এক ঢোক খেয়ে চাতক পাখির নিমিত্তে তাকালাম। রৌধিক হাতের বন্ধন দৃঢ় করে বললেন,

“তুমি পায়ে কীভাবে ব্যাথা পেয়েছো, সেটাও আমি জানি। তুমি আমার অফিস থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছিলে। আমি তখনই তোমার পিছু লোক লাগিয়েছি। তোমার এক্সিডেন্টের পরপরই খবর পাই আমি। কিন্তু আমি আসতে আসতে তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয় কেউ। তারপরে আমি সেখানকার ফুটেজ চেক করি। এখন ঐ বাইক এবং চালক আমার হাতে বন্দী।
তারপর থেকে আমি তোমার জন্য গার্ডের ব্যবস্থা করি। গার্ডরাই আমাকে খবর দিয়েছে।”

একদমে কথাগুলো বলে গাড়িতে হেলান দেয়। তৃপ্তিকর শ্বাস নিলাম আমি।

“এখনো কী গার্ডরা আমাদের আশেপাশে আছে?”

“ওরা আমার অবর্তমানে থাকবে। আমি যতক্ষন তোমার সাথে থাকবো, ততক্ষণ তুমি নিরাপদ। বুঝতে পেরেছো তুমি।”

রৌধিকের বুকের উপর মাথা রাখলাম। পাশ দিয়ে গ্যাস বেলুন বিক্রেতা যাচ্ছে। আমি আদুরে গলায় বললাম,
“আমার বেলুন চাই।”

রৌধিক আমার দিকে চেয়ে রইলেন। বেরিয়ে এলেন গাড়ি থেকে। সবগুলো বেলুন কিনলেন। অতঃপর দুটো আইসক্রিমের আবদার করলাম।‌ রৌধিক কিছু না বলে একটা চকবার আরেকটা ভেনিলা ফ্লেবার আইসক্রিম কিনে দিলেন।‌ গাড়ির সামনে হুডের উপর বসে দুহাতে আইসক্রিম দু’টো নিয়ে খেতে লাগলাম। রৌধিক এক ধ্যানে চেয়ে রইল। হাতে তার বেলুন গুলো। আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,

“খাবেন?”
“তুমি খাও” বলে আমার পাশে বসে পা দুলাচ্ছেন।
আর আমি আমার কাজ করে চলেছি।

[চলবে.. ইনশাআল্লাহ]