অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব-১৩+১৪

0
594

#অনুবদ্ধ আয়াস
#ইফা আমহৃদ
পর্ব:১৩+১৪

আকাশ টা মেঘলা। ঝড় হাওয়া বইছে। বৃষ্টি হওয়ায় সম্ভবনা নেই বললেই চলে। আমি বসে আছি ডাইনিং টেবিলে। রৌধিক বসে আছে আমার পাশে। আদ্রিক আঙ্কেল এখনো নিচে নামেনি। তার সাথে নাকি কোন স্পেশাল গেস্ট আছে। কালকে একটা বড় ডিল ফাইনাল করা হবে। তাই সেই গেস্টের থেকে কিছু আইডিয়া ধার নিবে। আজকে খাওয়া একটু বেশিই ভালো। আদ্রিতা বসে আছে আমার সামনাসামনি। একট হাত গালে দিয়ে, মুখে চামচ পুড়ে চিবিচ্ছে‌। বাড়িতে গেস্ট আছে, তাই তাকে ছাড়া খাওয়া যাবে না। রৌধিক ফোনে কারো সাথে মেসেঞ্জারে কথা বলছে। ফোন টা না রেখেই দৃষ্টি সরিয়ে মৌমিতা আন্টির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,

” মা, বাবাকে আসবে না। কতোক্ষণ অপেক্ষা করব। কাল বাদে পরশু ওর পরিক্ষা। ওকে পড়তে বসতে হবে।”

আন্টি কিচেনে ছিল। খাবারের বাটি নিয়ে টেবিলের উপর রাখল। কিচেনের দিকে যেতে যেতে বলল,
“আমি জানি না কিছু। বাবা আসুক তারপরে খাওয়া শুরু করবে।”
রৌধিক বিরাগী হলেন। চেয়ার টেনে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“চলো, জোনাকি। গিয়ে পড়তে বসতে হবে। তারা খেয়ে গেলে আমি খাবার রুমে পৌঁছে দিবো।”

রৌধিক উল্টো ঘুরে হাঁটা দেওয়ার আগেই পায়ের শব্দ শোনা গেল। রৌধিক সেদিকে চাইলো। ফোনটা টেবিলের পাশে রেখে পুনরায় টেবিলে বসে পড়লেন। টেবিল সামনাসামনি হওয়ার কারণে আমি আদ্রিতার দিকে চেয়ে আছি। আদ্রিতা এক ধ্যানে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। অসাবধানতাবশত হাত থুতনি থেকে নিচে পড়ে গেল। বাড়ি খেয়ে টেবিলের সাথে শব্দ হলো মৃদু। হাত দিয়ে থুতনি ঘসতে লাগলো। রৌধিক ভ্রু নাচিয়ে বলল,

“তোরই হবু বর। এতো গিলার কিছু নেই।”

আদ্রিতা মৃদু শব্দে বলল, “ভাইয়া।”

“কী ভাইয়া হ্যাঁ?”

আদ্রিতা লজ্জা পেল। আমি উপরের দিকে চাইলাম। নিজের দৃষ্টিকে দৃষ্টিভ্রম হিসেবে ভাবতে আরো একবার চোখ পরিষ্কার করে তাকালাম। না আমার দৃষ্টি ভ্রম হয়। সেই ডাক্তার ছেলেটা। এসে বসলেন চেয়ারে। আন্টি খাবার দিতে লাগলেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“জোনাকি, আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? হুয়াই?”

সবাই আমাদের দিকে জিজ্ঞাসুলভ দৃষ্টি দিল। আমি না বুঝার কন্ঠে বললাম,
“আপনি? আপনি এখানে কী করছেন ডাক্তার সাহেব?”

তিনি মৃদু হেসে বললেন, ” আমি ডাক্তার ঠিকই, কিন্তু এখন ডাক্তার নই। তাই ডাক্তার সাহেব না বলাই ভালো।”

আমিও সায় দিলাম। অতঃপর সবাইকে সবটা খুলে বলতে চাইলাম, কিন্তু তার আগেই রৌধিক সবাইকে সবটা জানিয়ে দিল। আন্টি বিরিয়ানি আমার প্লেটে দিলেন। রৌধিক প্লেটটা টেনে নিলেন। সেই প্লেটে খেয়ে শুরু করলেন। আমি রুদ্ধ চোখে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছি। আন্টিকে আমার জন্য ভাত আর সবজি তরকারি দিতে বললেন। আন্টি অসন্তুষ্ট হয়ে বলে, আজকে সবার জন্য বিরিয়ানি, ডিমের কোরমা আর রোস্ট রান্না করেছেন। এখন আমাকে কিভাবে ভাত দিবে।

রৌধিক অসন্তুষ্ট হলেন। টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলে, জানো তো কালকে থেকে ওর পরীক্ষা শুরু। এই সময় তেলের জিনিস খেলে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।

আমি অসহায় হয়ে মুখ কুঁচকে রইলাম। সামনে বিরিয়ানি আর এই ছেলেটা বলছে, ভাত আর সবজি। রীতিমত অবিচার করছে আমার প্রতি। আন্টি তার স্থানে অনড়। কিছুতে আজ আর রান্না ঘরে যাবে না। তাছাড়া রান্না ঘরে বাড়ির বাইরের কেউ প্রবেশ করতে পারে না।
উঠে চলে গেলেন রৌধিক। কিচেনে গিয়ে নিজেই এক বাটি স্যুপ করে নিয়ে এলেন। আমার সামনে এসে রাখলেন। কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু জল কণা মুছে খেতে বললেন। মুখ ফুলিয়ে এক চামচ মুখে দিলাম আমি। এতো পানসে কেন?
আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,” প্লীজ,এটা খাবো না। হাঁফ প্লেট বিরিয়ানি।”

“নো, নো মানে নো। একটা দানাও না। এটাই খাও।”

সবাই মিটিমিটি হাসছে আমাদের দেখে। রৌধিক সবার দিকে চেয়ে সন্দিহান গলায় বললেন, “ওয়াট?”

আদ্রিতা প্রিন্ট করে বলল, “বাবা, তোমার ছেলে বউ পাগ’লা হয়ে গেছে। দেখতে পারছ তুমি? তুমি দুজনকে আলাদা থাকার পার্মিশন দিলে, কিন্তু ভাই বউ ছাড়া থাকতে পারবে না। তাই বউ নিয়ে নিজের ঘরের চলে গেছে। বউয়ের জন্য রান্না করছে। বাহ্। টেইক জিনিয়াস।”

লজ্জা কুঁকড়ে উঠলাম আমি। একটা মুহূর্তে জন্য হলেও মনে হলো, কোনো অদৃশ্য গাছের শিকড় মাটির ফাঁক করে বেরিয়ে আসুক। আমাকে নিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে যাবে। মিলিয়ে যাই আমি। ভেতরের গুমোট লজ্জা ভাবটা চিরতরে নিষিদ্ধ করে দেই। নাকের ডগা লাল হয়ে উঠলো আমার। মুখের মাঝে লাল আভা ছড়িয়ে পড়লো। কি হতো রৌধিক নিজেকে একটু সংযত করত। আমাকে অন্তত এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। ওড়না টা হাত দিয়ে খাঁমচে ধরলাম। মাথা নত করে রইলাম। যাতে কেউ আমার নজরে না পড়ে। রৌধিকও কম নয়, হাই তুলে বলল,
“তাই বুঝি। বলি, তাহলে ইভু কেন এলো। বাবার সাথে দেখা করতে। কিন্তু তুই তো এতো দেরী করে খাস না। তুই কেন বসে আছিস, মেঘলা আকাশের পূর্ণিমা দেখতে?”

সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল আদ্রিতা। এক ছুটে পালিয়ে গেল নিজের ঘরে। এবার সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও মাথা নত করে ধীর পায়ে ঘরে চলে এলাম। মুহুর্তেই হেঁসে উঠলো সবাই। লজ্জা যেন প্রচন্ড ভাবে ঝুঁকে ধরলো আমায়। পেছন থেকে অনবরত হাঁসির শব্দ শুনতে পেলাম।
_________

নিদ্রায় চোখের পাতা ঢুলুঢুলু। নিজে থেকেই চোখের পাতা বুজে যাচ্ছে। সময় বারোটা এগারো। আমি চোখে হাত দিয়ে বই পড়ছি। রৌধিক আঙ্কেলের ঘরে আলোচনায় বসেছে। শরীরটাও ক্লান্ত লাগছে। বইটা বেডের উপর রেখে উবুত হয়ে শুয়ে পড়লাম। এতে ঘুম আরো ঝোঁকে বসল। আমি উপায়হীন হয়ে বইয়ের উপর মাথা রাখলাম। চোখ বুজে গেল।

হুট করেই মাথায় চপল মারল কেউ। চোখ না মেলেই আরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পড়লাম আমি‌। হাত ধরে টেনে তুলল কেউ। ঘুমের মাঝেই বলছে,
” জোনাকি, ওঠ তাড়াতাড়ি!”

আমি আরো নড়েচড়ে শুয়ে পড়লাম। মানুষটি একদম টেনে বসিয়ে দিল আমায়। আমি ঘুমের মাঝেই আওড়ালাম,
“প্লীজ, আমাকে ঘুমাতে দিন।”
উল্টো পানির ছিটা দিল মুখে। আমি লাফিয়ে উঠলাম। এক লাফ দিয়ে একদম বেলকনিতে ছুটে গেলাম। রৌধিক ছিটকে দূরে সরে গেল। বলল,
“কুল, কুল জোনাকি। এতো হাইপার হচ্ছো কেন?”

আমার ধ্যান ভাঙতে ভাঙতে বেশ সময় নিল। রৌধিক ততক্ষণে আমার পিছুপিছু বেলকেনিতে চলে গেল। আমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। আশ্বাসের স্বরে বলল,”
“ভয় পেও না, আমি খাবার নিয়ে এসেছি। বিরিয়ানি! চলো, খেয়ে নিবে।”

“খাবো না, পড়বোও না। ঘুমাবো। প্রচুর ঘুম পেয়েছে।”

রৌধিক আমার কথা শুনলো না। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। এক লোকমা মুখের ভেতরে পুড়ে দিয়ে বলল,
“পড়তে হবে না। কালকে হালকা পড়েই পরীক্ষা দিতে যাবে। তাহলেই হবে।”

পায়ের উপর কাঁচের টুকরো পড়তেই পিছিয়ে গেলাম আমি। ফিকনি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে পা থেকে। রক্ত দেখে ক্রমশ আমার শরীর দূর্বল হয়ে পড়ছে। রৌধিক কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতেও রক্ত। কাঁচের টুকরো হাতে ঢুকে গেছে। রেস্টুরেন্টের সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। আমার আর রৌধিকের দিকে তাকিয়ে আছে।

পরীক্ষা দিয়ে কিয়ৎক্ষণ আগে বের হয়েছি আমরা। বেশ ভালো হয়েছে পরীক্ষা। পরীক্ষার সময় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুপুর হওয়াতে পেটেও বেশ ক্ষুধা লেগেছে। তাই রেস্টুরেন্টে খেতে আসলাম আমি আর অহি। সেখানে এসেই বাঁধল বিপত্তি। ভেতর থেকে চ্যাঁচামেচির আওয়াজ পাচ্ছি। গন্ডগোল হচ্ছে। তাই ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। বাধ্য হয়ে আমি আর অহি ফিরে আসার জন্য পা বাড়ালাম। তদানীং শ্রবণ হলো অতি পরিচিত কন্ঠস্বর। রৌধিক চেঁচিয়ে বলছে,
“আমার সাথে কন্টাক্ট করেছেন। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এমন আপনারা ডিলটা ক্যান্সেল করছেন কিভাবে?”

থেমে গেল চরণ। আমি পেছনে ফিরলাম। স্টার্ফদের বাঁধা অগ্রাহ্য করে ছুটে গেলাম ফেলতে। সেখানে যেতেই দেখতে পেলাম রৌধিক তার ক্লাইন্ট দের সাথে কথা কাটাকাটি করছে। একপর্যায়ে ভেতরের ক্ষোভ সংযত করতে ব্যর্থ হয়ে কাঁচের গ্লাস চেপে ধরলেন। পরক্ষণেই বিকট শব্দে ভেঙে গেল। কেঁপে উঠলো সকলে। রৌধিকের চোখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে। যখন তখন সবকিছু ভস্ব করে দিতে পারে। আমি এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে। তার আগেই নিজের হাতের ভাঙা কাঁচের টুকরো টা ছুঁড়ে মা’রলো। চেঁচিয়ে বললেন,
“ডিল ক্যান্সেল।”

তার হাতের কাঁচের টুকরো সোজা আমার পায়ে পড়ল। গাঢ় কন্ঠে আহ্ করে উঠলাম আমি। সবাই ফিরে চাইলো।

.
বসে পড়লাম আছি। কাঁচ টেনে বের করার চেষ্টা করলাম। বিনিময়ে আরো কুঁকড়ে উঠলাম। মনে হলো, বেশ কিছুটা অংশ ভেতরে ঢুকে গেছে। চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে গেল। অধরে অধরে চেপে সহ্য করার চেষ্টা করলাম। অহি পাশে বসে পড়লো। আমার হাত ধরে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করল,
“জোনাকি থাম। হাত লাগাস না। ইনফেকশন হতে পারে। কাঁচের টুকরো এগুলো। ভেঙ্গে খন্ড যদি ভেতরে থেকে যায় তাহলে?”

আমি চোখ জোড়া মেলে তাকালাম। মুহুর্তেই চোখের কার্নিশ বেয়ে জলকণা গড়িয়ে পড়লো। অহি নিজের ব্যাগ থেকে স্কার্ফ বের করে আমার পায়ে পেঁচিয়ে দিল। রৌধিক ছুটে এলো। ঝাপটে ধরল আমায়। থমকালাম আমি, ভিশন চমকালাম। রৌধিক নির্বিকার। আমি নিজের হাতটা রৌধিকের পিঠের উপর রেখে ধীরে ধীরে বললাম,
“শুনছেন? সবাই দেখছে?”
“বিলিভ মি, আমি ইচ্ছে করে এটা করি নি।”

রৌধিক মাথা তুলে তাকালো। আমি পূর্বের ন্যায় চেয়ে আছি রৌধিকের দিকে। রৌধিকের চাইনি পড়তেই চোখাচোখি হলো দুজনার। নেত্র যুগল খানিকটা সময়ের জন্য স্থির হয়ে রইল।
ডাক পড়ল অহির। মিনমিনিয়ে বলল, “ভাইয়া, চলুন। রক্ত পড়া থেমে গেছে‌। বেশিক্ষণ এমন থাকলে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে।”

রৌধিক দৃষ্টি ফেরালো। রক্ত স্কার্ফের অনেকটা ভিজে গেছে। এখন শুকিয়ে দানা বেঁধে গেছে। আলতো হাতে পায়ের ব্যাথার্ত স্থানে হাত বুলিয়ে দিল। কেঁপে উঠলাম আমি। তবে ব্যাথায় নয়। তার স্পর্শে। রৌধিক নিচ থেকে আমার ফাইলপত্র তুলে অহির দিকে এগিয়ে দিল। পেছনে ফিরে স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
“মিস্ আরু, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন? ওয়ার্ট? তাড়াতাড়ি ড্রাইভার কে গাড়ি বের করতে বলুন।”

“জ্বি স্যার! কিন্তু মিটিং।”

“জ্বি স্যার নয়। যান এখান থেকে! মিটিং আর হবে না। এখানেই শেষ। তারা ডিল করতে চাইছে না। ব্যস! এখানেই শেষ। কাউকে জোর করে কিছু করা যায় না, না আমি এটাকে সাপোর্ট করি। নাও গো..

“ইয়েস স্যার।” বলে বেরিয়ে গেল আরু নামক মেয়েটা। তিনি অফিসের নতুন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। সেদিনের পর আর অফিসে যাই নি, তাই জানি না।

রৌধিক পেঁচিয়ে রাখা স্কার্ফটা খুলে ফেললো ধীরে ধীরে। উষ্ণ গরম ফুঁ দিলো। নিজের হাতে পেঁচিয়ে নিল।‌ এসে বলে কোলে তুলে নিলো আমায়।
.
সোজাসুজি হসপিটালে নিয়ে এসেছে আমায়। ডাক্তার আরেকজনকে চেকআপ করছে। রৌধিক আমাকে ধরে বসে আছে। অহি আমার অন্যপাশে। আরু নামক মেয়েটা বাইরে। ডাক্তার আমার সোজাসুজি বসলেন। পায়ে হাত দিতেই ছিটকে গেলাম আমি। মৃদু স্বরে বললাম,
“ক-কি করছেন? পায়ে হাত কেন দিচ্ছেন?”

“পায়ে হাত না দিলে কাঁচ টা কীভাবে গেঁথেছে বুঝবো কীভাবে?” বিরাগী হয়ে বললেন তিনি।

আমি থেমে গেলাম। হাত পা ধরে বেডে শুইয়ে দিলেন আমায়। ইনজেকশন নিয়ে এলেন যাতে কাঁটা ছেঁড়া করলে বুঝতে না পারি। ইনজেকশন দেখেই গলা ফাটিয়ে এক চিৎকার দিলাম আমি। ডাক্তার সাহেব রৌধিককে আমাকে সামলাতে বললেন। রৌধিক হাত ধরলেন আমার। আমাকে নিজের বক্ষ মাঝারে টেনে নিলেন। ফিসফিসিয়ে বললেন,

“জোনাকি মাথা রাখো আমার বুকে। দেখো তোমার একটুও ভয় করবে না। একটা ম্যাজিক শুনতে পারবে।”

আমি অস্বস্তি নিয়ে রৌধিকের বুকে মুখ গুঁজলাম। একদম বাম পাশে। ধুকপুক করছে। রীতিমত মিউজিক বাজছে। আমার তো হেব্বি নাচতে ইচ্ছে করছে। ইংলিশ গান বাজছে। আচ্ছা উনি কি ইংলিশ গান শুনতেন। নিশ্চয়ই শুনতেন। নাহলে কেন ইংলিশ গান বাজবে। আমার ভাবনার মাঝেই অহি বলল,
“এভাবে নড়াচড়া করছিস কেন জোনাকি? ডাক্তারকে অন্তত তার কাজটা করতে দে। মনে হচ্ছে, তুই জামাইয়ের কোলে উঠে শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছিস।”
_____________
বাড়িতে প্রবেশ করতেই সম্মুখীন হলাম আরো বড় কিছুর। রৌধিকের বন্ধুরা এসেছে। তাদের দেখে রৌধিকের মুখটা একদম ছোট হয়ে গেল। রৌধিক কোল থেকে আমাকে একদম সোফায় বসিয়ে দিল। সার্ভেন্ট রা আমার অবস্থা দেখে মৌনতা আন্টিকে এবং আদ্রিতাকে ডেকে নিয়ে এলেন। কী হয়েছে জানতে চাইলেন। রৌধিক কাউকে কিছু বললেন না। কারণ এর সাথে অফিসের ঘটনা জড়িত। পরে বললেন। আন্টিও আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। স্টার্ফদের লেবুর জুস করে আনতে বললেন। তারা নিয়ে আসতেই আন্টি আগে আমাকে খাইয়ে দিলেন। আমি পলকহীন চোখে চেয়ে রইলাম। নিজের মায়ের ছায়া দেখতে পেলাম। জ্ঞান হওয়ার আগেই মারা গেছেন তিনি।‌ বাবা তখন আমাদের সব আবদার পূরণ করেছেন। কিডনি সুস্থ হওয়ার পর, আর কোনো অবদান পূরণ করতে পারে নি। তখন পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে, আমাকেই দায়িত্ব নিতে হয়েছে। ভালো ভাবে কখনো যত্ন নেওয়া হয় নি। বাবা তখন আমার কষ্ট হবে ভেবে, বাড়ির কাজ করে রাখতেন।
দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম আমি। মৌমিতা আন্টি বললেন,
“মায়ের কথা মনে পড়ছে, বুঝি?”

“আমার মা নেই!” সোজাসাপ্টা উত্তর আমার।

“আ’ম স্যরি জোনাকি, আমি আসলে বুঝতে পারি নি।”

“আন্টি প্লীজ এভাবে বলবেন না।”
আন্টি মুচকি হেঁসে জড়িয়ে ধরলেন আমায়।
রৌধিকের চারজন বন্ধু এবং তিনজন বান্ধবী এসেছে। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“রৌদু, কে এই মেয়েটা? তোর বোন তো এই মেয়েটা (আদ্রিতাকে উদ্দেশ্য করে)। তুই আর শেফা কোথায় গেছিস, আদ্রিতাকে জিজ্ঞাসা করার পর ও কিছু বলেনি।”

রৌধিক কিছু বললেন না। দূর্বল হাসলেন। আদ্রিতাকে আমাকে ঘরে নিয়ে যেতে বললেন। হয়তো শেফার কথা শুনে, প্রচন্ড মিস্ করছে তাকে। সে কোনো কথা বলবে না, এতে অনড়। মৌমিতা আন্টি আর আদ্রিতা আমাকে ধরলো। উপরে নিয়ে যেতে লাগলেন। পেছন থেকে ওদের গলা একটু শুনতে পাচ্ছি। ওদের ভেতরে একজন ছেলে বলছে,
“এই মেয়েটা কে রৌদু। শেফা কোথায়?”

“ওর প্রতি সবাই এতো কেয়ারিং কেন? বাই এনি চান্স ও তোর বউ নাকি?”

“মেয়েটা কোনো কারসাজি করে তোকে বিয়ে করেনি তো?”

রৌধিক সবাইকে বসতে বলল। অতঃপর বলতে শুরু করল,

” শেফা পালিয়ে গেছে। নিজের সম্মান বাঁচাতে, বাবা জোর করে এই অচেনা মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে দিয়েছে।”

[চলবে.. ইনশাআল্লাহ]