অনুভবে তুমি পর্ব-০৩

0
444

#অনুভবে_তুমি
#পর্ব_৩
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
সকালে শিখা’কে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘-ভাবী আমাকে নাশতা দাও খুব ক্ষুধা পেয়েছে।
বাক্যটি শুনে টেবিলে বসে থাকা সকলের চোখ ডিমের মতো বড় হয়ে গেছে। এক রাতেই গার্লফ্রেন্ডকে এতো সহজে ভুলে গেলো কি করে? এক রাতেই এতটা পরিবর্তন? বড্ড ভাবাচ্ছে বিষয় টা। আর শিখা তো আহাম্মকের মতো হাঁ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
‘- কি ব্যাপার ভাবী এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আর তোমরা সকলে আমাকে এভাবে দেখছো কেন? আগে দেখনি আমাকে?
মা আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল,
‘- তুই ঠিক আছিস তো মুগ্ধ? শরীর খারাপ করেনি তো?
মায়ের কথা শুনেই মনের ভিতর জ্বলতে থাকা বাতিটা কেন যেন নিভে গেল। যেই মা আগে কোনো বাক্য শেষ করার আগে ‘বাবা’ শব্দটা জুড়ে দিতো, আজ সেই মা-ই কিনা নাম নিয়ে ডাকে। মনটাকে শক্ত রেখে বললাম,
‘- আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি। আর তোমরা এমন বিহেভিয়ার করছ কেন সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না!
কেউ কিছু বলার আগেই ভাইয়া কর্কশ কণ্ঠে বলে ওঠে,
‘- দেখো নেশাটেশা করেছে কিনা!
ছোটবেলা থেকেই মদকে খুব ঘৃণা করি। এই শব্দ শুনলেই মাথায় রাগ ওঠে। ভাইয়া হয়তো ভেবেছে কালকের মতোই আজও তার দিকে ক্ষিপ্ত হয়ে মারতে যাব।
আমি নিজেকে কন্ট্রোল করে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিলাম। এতে তার হাসিটা নিভে গেল।
‘- নেশা তো কাল রাতে করেছিলাম ভাইয়া। তাই কাল উল্টোপাল্টা সব কাজ করে ফেলেছি। ক্ষমা করে দিস ভাইয়া। আর ভাবী তুমিও ক্ষমা করে দিও প্লিজ। শিখা’র দিকে তাকাতেই চোখের কোণে পানি এসে জড়ো হলো। মেয়েটা কতটা স্বার্থপর। সবার চোখ এড়িয়ে সেটা মুছে নিলাম। কেউ না দেখলেও শিখা দেখে নিয়েছে। কারণ তখন তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। মনের ভিতর কষ্ট লুকিয়ে রেখে আর কতই বা হাসা যায়। মনটা তো খুব নরম। কোনো পাথর নয় যে সারাদিন পানি ঢাললেও সে গলবে না।
‘- উফফ ভাবী আর দেরি না করে নাশতা দাও। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তো।
শিখা মুখটা মলিন করে সবাইকে নাশতা পরিবেশন করলো।
প্রিয় মানুষটিকে পাইনি তো কি হয়েছে? তার হাতের রান্না খাওয়ার তো সৌভাগ্য হয়েছে। তাই দুঃখবিলাস না করে তৃপ্তি নিয়ে খেলাম৷
খাওয়া শেষ করে ছাদে গেলাম। এক কোণে দাঁড়িয়ে মনের সুখে সিগারেটে টান মারছি আর প্রকৃতির সাথে নিজের কষ্টগুলোকে ভাগাভাগি করছি।
কিছুক্ষণ পর কারো পায়ের শব্দ পেলাম। তাকিয়ে দেখি শিখা৷ সে গুটিগুটি পায়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো।
‘- হঠাৎ স্বামীকে ঘরে রেখে ছাদে এলেন যে?
‘- অফিসে গেছে।
‘- বাহ চমৎকার বিষয়। বিয়ের পরদিনই অফিস। বেশ দায়িত্ববান স্বামী পেয়েছেন।
শিখা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমিও আর কিছু না বলে আকাশ পানে চেয়ে রইলাম।
‘- কি ভাবছো এমন আকাশের দিকে তাকিয়ে?
‘- ভাবছি মানুষ কতটা নিখুঁত অভিনয় জানলে দীর্ঘ আড়াই’টা বছর অভিনয় করে যেতে পারে। তাও আবার যেমন তেমন নয়, ভালোবাসার অভিনয়। আপনি চাইলেই নাটক বা সিনেমায় কাজ করতে পারেন। বেশ নামডাক হবে।
আমার কথার কোনো উত্তর দিল না শিখা।
কিছু সময় নিরব থেকে বলল,
‘- তখন খাবার টেবিলে কাঁদছিলে কেন?
ফিক করে হেঁসে দিয়ে ফেললাম।
‘- কাঁদিনি। চোখে কিছু একটা পড়েছিল তাই চোখে পানি এসেছিল। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
‘- এর আগে তো এমন ঘটা করে অনুমতি নিতে না, তবে আজ কেন,,,,,
তার পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই বললাম,
‘- আগে আপন ছিলেন। আর এখন আপনি আমার কেউ না। তাই আগের কথা টেনে কথা না বললেই ভালো। যাইহোক বলেই ফেলি। আমি আসলে জানতে চাচ্ছি আমার সাথে প্রতারণা করার কারণটা? কি এমন অপরাধ করেছিলাম যার জন্য এই ভয়ংকর শাস্তি দেওয়া হলো?
‘- সবকিছু তোমার ভাইয়ার কথায় করেছি।
চমকে উঠলাম কথাটি শুনে। তারমানে এটাতেও ভাইয়ার হাত রয়েছে?
‘- মানে?
‘- তোমার ভাইয়ার সাথে আমার রিলেশন তিন বছরের। একদিন হঠাৎ তোমার ভাইয়া আমাকে বলে, তোমার জন্য নাকি মা তাকে ভালোবাসেনি। সব ভালোবাসা তুমি একাই পেয়েছ। এমনকি সব সম্পত্তি তোমার নামেই করে দেবে। তাই সে তোমার সাথে আমাকে ভালোবাসার নাটক করতে বলে। তাই আমিও তার কথায় রাজি হয়ে যাই।
শিখার কথা শুনে বেশ পাগলের মতো হাসতে ইচ্ছে করছে। হেঁসেও ফেললাম।
‘- তুমি হাসছ?
‘- কাল দিন পর্যন্ত খুব অহংকার করে বলতে পারতাম আমার একটা আপন মানুষ ছিল। কিন্তু আজ যে সম্পূর্ণ একা হব এটা ভাবিনি কখনো। এখন থেকে আমি শুধুই আমার।
‘- তোমার কথার ঠিক মানে বুঝলাম না।
‘- হ্যাঁ তোমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি আমার নিজের মা বাবা নয়। দত্তক নিয়েছিল। ছোটবেলায় ভালোবাসতো ঠিকই। কিন্তু এখন আমি তাদের কাছে ডাস্টবিনের আবর্জনা। আর বাকি রইলো সম্পত্তি। আরে যেখানে আপন মানুষগুলো দূরে ঠেলে দেয় সেখানে তার থেকে বড় কষ্টের আর কি হতে পারে। সম্পত্তি দিয়ে কি হবে, যদি মনেই সুখ না থাকে? জানো শিখা, এই পরিবার থেকে যখন অবহেলা পাচ্ছিলাম তখন হুট করে তুমি আমার জীবনে অণুপ্রবেশ করলে। আর তারপর আস্তে আস্তে তুমি নিজেই ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিলে৷ তখন আমি আবার নতুন একটা পৃথিবী সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সবাই যখন আমাকে তাদের দার থেকে তাড়িয়ে দিল, তখন শেষে এসে তোমার দারে দাঁড়ালাম। তুমি দরজাটা খুললে ঠিকই, হাতটাও বাড়িয়ে দিলে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিলে। এখন আর আমার পৃথিবীতে কেই রইলো না। না পেলাম নিজের মা বাবার ভালোবাসা, না পেলাম টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া মা বাবার ভালোবাসা, আর না পেলাম প্রিয় মানুষটার ভালোবাসা। আমার জীবনটা কতটা রঙিন তাই না শিখা? চারিদিকে শুধু সুখ আর সুখ। আমার সাথেই কেন এমন হলো বলতে পারো?
‘- নিচে যারা আছে তারা তোমার আপন মা বাবা নয়?
‘- কেন সবকিছুই যখন বলেছে তখন এটাও নিশ্চয়ই বলেছে?
‘- তুমি এতিম এটা কখনো বলেনি।
শিখার দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়েই চলেছে।
‘- করুণা হচ্ছে আমার প্রতি?
শিখা আমার পা জাপ্টে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চাইতে লাগলো।
‘- তুমি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। বিশ্বাস করো আমাকে ভুল বুঝিয়ে এসব করানো হয়েছে। আমি জানতাম না তুমি এতিম।
‘- বুদ্ধ কী লোপ পেয়েছে নাকি? দেবরের পায়ে ধরে কেউ? আর আমি এতিম জানলে নাটক করতে না, কিন্তু মা বাবা আছে জেনে নাটক করেছ। কেন কষ্টটা কি মা বাবা মোচন করে দিত? এটা কেমন চিন্তা তোমার? তোমার দেওয়া কষ্ট কেন আমার মা বাবা মোচন করবে? পা থেকে ওঠো তাড়াতাড়ি। কেউ দেখে ফেলবে। পরে তোমারই সম্মানে আঘাত আসবে।
‘- আগে বলো তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ?
‘- কি আজিব ব্যাপার তাইনা? কষ্ট দিচ্ছো নিজের ইচ্ছায় আবার ক্ষমা করতেও বাধ্য করছ। নিয়তির কী খেলা! তোমাকে জায়গা দিয়েছিলাম বুকের অতল গহ্বরে আর আজ রয়েছ তুমি আমার পায়ে। একেই বলে সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। প্লিজ পা থেকে ওঠো।
শিখা পা থেকে উঠে দাঁড়ায়। চলে আসতে যাব ঠিক তখনই শিখার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পেলাম। দীর্ঘ আড়াই বছরের সম্পর্কে তার উপর যতবারই রাগ করেছি ততবারই সে এভাবে ফুঁপিয়ে কেঁদে আমার রাগ ভাঙিয়েছে৷ সেসব তো সবই মিথ্যা ছিল। আজও কি সে মিথ্যা কান্নার মায়ায় জড়াতে চায় আমায়?
‘- প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও গুড্ডু।
বলেই আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মেয়েটা।
শিখা আমাকে ভালোবেসে এই “গুড্ডু” নামে ডাকতো। ওর চোখের পানি কেন জানি না আমার সহ্য হচ্ছে না। মনের ভিতর অজানা এক চিনচিন ব্যাথা অনুভব করছি। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে শিখাকে জড়িয়ে ধরলাম। সে আমাকে ভালো না বাসলেও আমি তো বেসেছি। আমিও যদি তাকে কষ্ট দেই তাহলে আমাদের মধ্যে পার্থক্য রইলো কী? আমি তো সত্যিই ভালোবেসেছি৷ তাই আমার উচিৎ তাকে ক্ষমা করে দেওয়া। শিখার কপালে ছোট্ট একটা চুম্বন করে বললাম,
‘- আচ্ছা ক্ষমা করে দিলাম তোমায়। দোয়া রইলো তোমার জীবনের প্রতিটি কোণা সুখ দিয়ে ভরে উঠুক।
আমি জানি এখানে থাকলে আমাদের সম্পর্কটা একদিন পরকীয়ায় পরিণত হবে। তাই আমাকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে।
দুদিন পরে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম ঢাকা শহরে। আসার সময় সবাই খুশি হলেও শিখার চোখের কোণে ছিল জমাট বাঁধা পানি। তাকে ইশারায় বলেছিলাম, – কখনো কাঁদবে না, সবসময় মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে রাখবে। তোমাকে হাসিতেই মানায়। তুমি হচ্ছো একটা গোলাপ গাছ, আর সেই গাছে ফুল ফোটা আবশ্যক।
চলবে ইনশাআল্লাহ,,,,,
কেমন হলো সবাই অবশ্যই মতামত দেবেন। ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
নামাজ কায়েম করুন।
ধন্যবাদ সবাইকে।