অনুভবে তুমি পর্ব-০৮

0
579

#অনুভবে তুমি
#পর্ব_০৮
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

আমাদের পুরো পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এলো।কারন টিভি খুললেই এখন শুধু আমাকেই দেখা যায়।এতোদিন তমাল কে নিয়ে গণমাধ্যম বেশ গরম ছিলো।কিন্তু এই সিসিটিভি ফুটেজ বের হওয়ার পর থেকে শুধু আমাকেই খুঁজছে সবাই।
আমি বরাবরের মতো আজও নিশ্চুপ ই রয়ে গেলাম।কারন আমাকে নিয়ে চিন্তাভাবনার জন্য আমার পরিবারের লোকই যথেষ্ট।যে যেমন ভালোবাসে আমাকে সে তেমনভাবেই তার মতামত প্রকাশ করতে লাগলো।
আশেপাশের লোক কি বলবে?সমাজে মুখ দেখাবো কেমনে এই টেনশনে আমার আম্মু শেষ হয়ে যাচ্ছেন।আমার ছবি মিডিয়া অব্দি গিয়েছে,কেউ কেউ তো ভাবছে সন্ত্রাসীদের সাথে আমারও হাত আছে, এখন আমাকে কে বিয়ে করবে?দাদী এই ভেবে সারাদিন হা হুতাশ করছে।ওদিকে আমার ভাই চিন্তা করছে কখন বুঝি সন্ত্রাসীরা তার বোন কে উঠে নিয়ে যায় আর কখন বুঝি তারা এই পরিবারের উপর হামলা চালায়।

সবার এমন টেনশন দেখে আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছা করছে মিডিয়ার সামনে গিয়ে সব সত্যি বলে দেই।কারণ আমি তো অপরাধী না,তাহলে কিসের এতো লুকোচুরি?কিন্তু আমার পরিবারের সবাই একটু বেশি বেশি বোঝে।তারা চায় না আমি আর নতুন করে প্রতিটা চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ হই।তারা বুঝতেই পারছে না যে এভাবে লুকিয়ে থেকে সন্দেহের মাত্রা আরো বেড়ে যাচ্ছে।

আমরা বর্তমানে আমাদের গ্রামের বাড়ি আছি।শহর থেকে অনেক অনেক দূরে।একদম অজপাড়াগাঁ এটা।তবে এখানে চুপটি করে বসে থাকলে তো আর সংসার চলবে না।কারন ভাইয়া শহরে জব করে।গ্রামে থেকে সে কি করবে?এজন্য ভাইয়া আমাদের রেখে আবার শহরে চলে গেছে।
কিন্তু দুই দিন যায়,তিনদিন যায় ভাইয়া আর আসে না।আমরা ভাবলাম হয় তো ছুটির দিনে আসবে।তবে মোবাইল টা বন্ধ থাকায় আমাদের ভীষণ দুশ্চিন্তা হতে লাগলো।
হঠাৎ চতুর্থ দিনের মাথায় ভাইয়ার বন্ধুরা এলো গ্রামে।আমরা সবাইকে দেখে ভীষণ অবাক হলাম।কারন ভাইয়া ছাড়া আর কেউ জানে না আমরা এখানে আছি।
সবার মুখচোখ দেখে বুঝতে পারলাম খারাপ কিছু ঘটেছে।আমি তখন ভাইয়ার বন্ধু লিখন কে জিজ্ঞেস করলাম, অয়ন ভাইয়া কোথায়?
তখন তিনি বললেন অয়ন কে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।কারন তমাল হত্যার পিছনে অয়ন কে সন্দেহ করা হচ্ছে।
কথাটা শোনামাত্র আমরা সবাই শকড খেয়ে গেলাম।এটা কি করে সম্ভব?তমাল ভাইয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়।তাছাড়া তমালের সাথে ভাইয়ার কোনো শত্রুতাও নাই।তাহলে ভাইয়া কেনো তমাল কে মারতে যাবে?
তখন লিখন বললো,আসলে তমাল মারা যাওয়ার আগের দিন অয়নের সাথে একটু ঝামেলা হয়েছিলো।তর্ক করতে করতে এক সময় দুইজন দুইজনার উপর এট্যাকও করে।এটা অনেকেই দেখেছে।কেউ কেউ ভিডিও করে রেখেছে।তবে এই বিষয় টাকে কেউ গুরুত্ব না দিলেও এখন গুরুত্ব দিচ্ছে।কারন তোমাকেও সন্ত্রাসী দের সাথে দেখা গিয়েছে সিসিটিভি ফুটেজ এ।যা ইতোমধ্যে ভাইরাল।সেজন্য ধারনা করা হচ্ছে তুমিও ছিলে তোমার ভাইয়ার সাথে।

কথাটা শোনামাত্র আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে গেলাম।এটা কি শুনছি আমি?এই পরিস্থিতিতে আমার কি করা উচিত আর আমি এখন কি করবো কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না।তবুও নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বললাম,আপনারা আসলেই পাগল হইছেন।আমি কেনো এরকম একটা কাজ করতে যাবো?তাছাড়া আমি আমার ভাইকে যথেষ্ট চিনি।সেদিন পাঁচজন সন্ত্রাসী ছিলো।যা আমি নিজের চোখে দেখেছি।তাদের মধ্যে অয়ন ভাইয়া ছিলো না।অয়ন ভাইয়া কখনোই এ কাজ করতে পারে না।

ভাইয়ার বন্ধুটি তখন বললো, আইন প্রমানে বিশ্বাস করে।এভাবে মুখের কথায় কিছু হবে না।তাছাড়া তোমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছো দেখেই সবাই আরো বেশি সন্দেহ করছে।
আমি কথা টা শোনামাত্র আম্মু আর দাদীর দিকে তাকালাম।শুধুমাত্র এই লোকদুইটার জন্য আজ এতো কিছু হলো।আমি আর একটা কথাও বললাম না।চুপচাপ রেডি হয়ে আসলাম।

আমাকে দেখামাত্র আম্মু আর দাদী এগিয়ে এলো।
–এই তুই কই যাচ্ছিস?
না যাবি না কোথাও।
আমি তখন বললাম এভাবে ঘরে বসে থাকলে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না।আমাকে মিডিয়ার মুখোমুখি হতে হবে।তাছাড়া সবাই আমাকে আর ভাইয়াকেই অপরাধী ভাববে।
আম্মু আর দাদী সেই কথা শুনে বললো,তাহলে আমরাও যাবো।একা একা তোকে যেতে দিবো না।

অনেক সাহস নিয়ে আমরা ভাইয়ার বন্ধুদের সাথে রওনা দিলাম।একদিকে নিজের জন্য ভয় অন্যদিকে ভাইয়ার জন্য ভীষণ টেনশন হচ্ছে।কিছুদূর যেতেই ভাইয়ার বন্ধুরা কেমন যেনো একে অপরের সাথে ফিসফিস করতে লাগলো।আম্মু তখন বললো বাবা কোনো সমস্যা?
সেই কথা শুনে তানিম বললো,না মানে আন্টি অনেক রাত হয়েছে তো কিছু মনে না করলে আজ রাতে আমাদের বাসায় থাকতে পারেন।
আম্মু আর দাদী আমার দিকে তাকালো।আমি আর কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম।কারন তানিম কে আমি আর সহ্য করতে পারি না।এখন বিপদে পড়ে বাধ্য হয়ে চুপ করে আছি।

তানিম আমাদের কে নিয়ে তাদের বাসায় গেলো।আমাদের কে দেখামাত্র আন্টি আর আংকেল এগিয়ে এলো।আমি খুব ইতস্তত বোধ করতে লাগলাম।কারন সেদিন সবার মুখের উপর না করে দিলাম আর আজ তাদের বাসায় এসে আশ্রয় নিয়েছি।তানিম আমাদের কে একটা সুন্দর গোছানো ঘরে নিয়ে গেলো।আর বললো ফ্রেশ হয়ে সবাই ডাইনিং রুমে এসো।
আমার কিছুই ভালো লাগছিলো না।এই টেনশনের মধ্যে খাওয়া যায় নাকি?তাছাড়া ভীষণ ভয় কাজ করছে।কেমন যেনো সব এলোমেলো লাগছিলো।কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।জানি না কাল কি হতে চলেছে?

পুরো রাত টা অস্থিরতার মধ্যে কাটালাম।দু চোখে একটুও ঘুম নাই।আম্মু আর দাদীও জেগে আছে।আমি শুধু ভাবছি, যে ভাইয়া আমাকে মিডিয়ার সামনে যেতে দেবে না দেখেই এতো লুকোচুরি করলো সেখানে যাওয়া কি ঠিক হবে?আমি আবার ভুল করছি না তো।কিন্তু তাছাড়া তো আর উপাইও দেখছি না।ভাইয়া আমাকে সবসময় সবার থেকে দূরে দূরে রাখতো আজ এমন এক পরিস্থিতিতে পরেছি যে আমার নাম সবার মুখে মুখে।

দূরের মসজিদ থেকে ফজরের আজানের ধবনি ভেসে উঠলো।আমরা তিনজনই নামায পড়ে নিলাম।
নামায পড়া শেষ হলে আমি রুম থেকে বের হলাম।কারন রুমে আর থাকতে ইচ্ছে করছিলো না।হঠাৎ তানিম পিছন দিক থেকে বললো,কিছু লাগবে তোমার?
আমি চমকে উঠে বললাম,না।এই বলে রুমের দিকে যেতে ধরলাম।হঠাৎ তানিম আমার হাত ধরে বললো,অতশী, আই লাভ ইউ সো মাচ।প্লিজ মুখ ফিরিয়ে নিও না।আচ্ছা মানছি আমি মিথ্যা বলেছি কিন্তু আমার ভালোবাসা তো আর মিথ্যা না।
তানিমের এমন কথায় আমি পুরাই অবাক।এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে এই ছেলে কি করে এসব বলতে পারে?যেখানে আমার জীবনে কি হতে চলেছে তা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারনা নেই সেখানে এই ছেলে আছে প্রেম ভালোবাসা নিয়ে।আমি সাথে সাথে আমার হাত সরিয়ে নিলাম।তানিম তখন বললো, অতশী প্লিজ একবার শুধু তোমার মনের কথা টা বলো।প্লিজ।আমি শুনে একটু শান্তি পাই।
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে রুমে চলে গেলাম।এ ব্যাপারে আর কাউকে কিছু বললাম না।

কিছুক্ষন পর আন্টি সবাইকে নাস্তা খেতে দিলো।আমার কিছুতেই গলা দিয়ে খাবার নামছে না।আমাকে চুপচাপ দেখে আন্টি বললো,মা খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি। না খেলে দূর্বল হয়ে যাবে তো।তাছাড়া চিন্তা করে কি আর সমস্যা দূর হবে?
আমি সেই কথা শুনে জোর করেই খাওয়ার চেষ্টা করলাম।খাওয়া দাওয়া শেষ করেই আমরা রওনা দিলাম।
আমি নরমালি যেকোন ড্রেস এর সাথে হিজাব পড়ি।আর নিকাব ও পড়ি। আজ ও সেটাই করলাম।আমার সাথে আম্মু,দাদী, তানিম আর ভাইয়ার বাকি ফ্রেন্ডরাও ছিলো।আমরা এখন জেলে যাচ্ছি।সেখানে গিয়ে সেদিনের সব সত্যি কথা বলবো।
তানিমের বাসা থেকে জেলখানা বেশি দূর ছিলো না।এক ঘন্টার মতো সময় লাগে।সেজন্য আমরা একটা সি,এন,জি নিলাম।আমরা সি,এন,জির মধ্যে ছিলাম।আর ভাইয়ার বন্ধুরা বাইকে করে পিছন পিছন আসছিলো।
কিন্তু কিছুদূর যেতেই হঠাৎ সি,এন,জি টা অন্য রাস্তার দিকে চলে গেলো।আমি যদিও আগে জেলখানা দেখি নি তবুও রাস্তা টা নিয়ে কেমন যেনো সন্দেহ হলো।কারন তানিম বলেছিলো সোজা রাস্তার কথা।কোনো মোড়ের কথা বলে নি।পরে আবার ভাবলাম ভাইয়ার ফ্রেন্ডরা তো পিছন পিছন আছেই।কিসের এতো চিন্তা?

হঠাৎ আরেকটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো আমাদের সি,এন,জির সামনে।আর আমাদের সি,এন,জি সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলো।
আমরা কিছু বলার আগেই গাড়ি থেকে নেমে এসে কেউ একজন আমাকে হ্যাচকা টেনে সেই গাড়িতে ওঠালো।
আমাকে চিৎকার চেঁচামেচি করারও সুযোগ দিলো না।সাথে সাথে চোখ মুখ বেঁধে দিলো।

এদিকে আম্মু আর দাদী জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগলো।ততোক্ষনে আমাকে নিয়ে চলে গেলো গাড়ি টা।আমি বুঝতে পারছি খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে।হয় তো আমাকে আজ খুন করা হবে।কারন এসব সন্ত্রাসী রা কাউকে মেরে ফেলতে বিন্দুমাত্র ভয় পায় না।আমি আল্লাহর দরবারে সেজন্য প্রার্থনা করতে লাগলাম।যাতে আমাকে সরাসরি খুন করা হয়,আমার মানসম্মান যেনো ঠিক থাকে।আমার ইজ্জতের যেনো কোনো ক্ষতি না হয়।
সন্ত্রাসীরা ভেবেছে আমি হয় তো তাদের কে চিনতে পেরেছি, সেজন্য আজ সবার নাম বলে দিবো পুলিশ কে।কিন্তু আমি তো কাউকেই চিনি নি বা তাদের ব্যাপারে কোনো কিছু বলতেও পারতাম না পুলিশ কে।

সন্ত্রাসী গুলো হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে আমাকে নামালো।বুঝতে পারলাম তাদের আস্তানায় এখন আমি।একজন আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে জায়গা টা গাছপালায় ঘেরা অন্ধকার বনের মতো।একদম শান্ত আর নিরিবিলি।শুধুমাত্র পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে।এখানেই হয় তো এদের সব অপকর্ম চলে।আমি এতো বেশি ভয় পাচ্ছিলাম যে সিদ্ধান্ত নিলাম আমার সাথে খারাপ কিছু হওয়ার আগে নিজেই নিজেকে শেষ করবো।কারন সবার আগে আমার মানসম্মান।আমি ধরেই নিয়েছি আজকেই আমার শেষ দিন।
কিন্তু সন্ত্রাসী গুলো কিছুই করলো না আমার সাথে।একটা কথা পর্যন্ত বললো না।
তারা আমাকে কেমন যেনো এক এবড়োখেবড়ো পথে নিয়ে যাচ্ছে।
কিছুদুর যেতেই হঠাৎ সন্ত্রাসী রা আমার চোখ মুখের বাঁধন খুলে দিলো।আমি চোখ কচলাতে কচলাতে সবার দিকে তাকালাম।ভালো করে লক্ষ্য করে দেখি এরা সেই পাঁচজন সন্ত্রাসী।
আর আমি এখন একটা সুন্দর রাজপ্রাসাদের মধ্যে।
আমি কিছু বলার আগেই তারা আমাকে ঘরে বন্দি করে চলে গেলো।

#চলবে,,,,,