অনুভূতিহীন পর্ব-০৭

0
466

#অনুভূতিহীন (পর্ব ৭)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

আজ রাতে ফাহিম ভাইয়ার গায়ে হলুদ। আর কালকে বিয়ে। আজ সন্ধায় বের হবো আমরা। ফাহিম ভাইয়ারা ভাড়া বাসায় থাকে। যেখানে বড় বিয়ের আয়োজন করা কঠিন। তাই গায়ে হলুদ আর বিয়ে কোনোটাই বাড়িতে হবে না। কমিউনিটি সেন্টারে হবে সব।
আমরা প্রথমে যাবো ফাহিম ভাইয়াদের বাসায়। সন্ধার পর ওখান তেকে সবাই বের হয়ে কমিউনিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে রওনা দিবো।

একটা লাল পাঞ্জাবি পরেছে সে। আমি একটা হলুদ রংয়ের শাড়ি। গায়ে হলুদ বলে কথা। আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল ঠিক করা ঘড়ি ঠিক করা কত ঢং করছে সে। এদিকে আমি রেডি হয়ে বসে আছি। সব সময় শুনতাম মেয়েরা রেডি হতে সময় লাগে। অথচ আমি রেডি হয়ে দেখলাম সে এখনো রেডিই হলো না। আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম,
– এতোক্ষন লাগে আপনার রেডি হতে?
সে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে দাড়িয়ে রইলো। তার পর বললো,
– কতোক্ষন লাগছে, এই পাঁচ মিনিটেই তো আমি রেডি হয়ে গেলাম।
– তো এর আগে আমাকে রেডি করিয়ে রাখলেন কেন? সেই বিকেল থেকে রেডি হওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছিলেন।
– কারণ তো নিশ্চই আছে। এই ধরো তোমাকে যদি আমি এখন রেডি হতে বলতাম, তাহলে তুমি রেডি হতে লাগিয়ে দিতে কম করে হলেও এক ঘন্টা। বা আরো বেশিও লাগতে পারে। আর আমি রেডি হয়ে তোমার জন্য বসে থাকবো। যা একধমই বিরক্তিকর। তাই বের হওয়ার দুই ঘন্টা আগে থেকেই তোমায় রেডি হওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছিলাম।
ওনার এমন অদ্ভুত যুক্তি দেখে মাথা গরম হলো আমার তাও চুপচাপ দাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বিশেষ করে তার মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ইচ্ছে করছে তার ওই ছোট ছোট দাড়ি গুলোতে গিয়ে নিজের গাল ঘসতে। ইশ ভাবতেই লজ্জায় গাঁ শিউরে উঠে। নিজেকে নিজে বকতে লাগলাম আমি।
‘তোর নজর এতো খারাপ কেন আরু?
তখনি আবার মনে হলো,
‘ধুরু খারাপ হতে যাবে কেন? আমি কি পর পুরুষের দিকে তাকাচ্ছি? আমি নিজের স্বামীর দিকেই তাকিয়ে আছি। আজব।

এর মাঝেই রিদ ভাই আমার মুখের সামনে দুই আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজাতেই আমি চমকে উঠলাম। তার পর তিনি চোখের দৃষ্টি আমার দিকে রেখে একটু হাসলো। এর পর ইশারায় বললো, ‘এবার চলো’।
একটা শ্বাস নিলাম আমি। এই ব্যাটা হটাৎ হটাৎ এমন অদ্ভুত কান্ড ঘটায় যা দেখলে অযথাই বুকটা কেঁপে উঠে।

আমি আর সে যখন সিড়ি দিয়ে নামছিলাম, তখন মামি দেখি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। হয়তো অবাক দৃষ্টি, নয়তো মুগ্ধ দৃষ্টি এটা।
এর পর এগিয়ে এসে আমার এক হাত রিদ ভাইয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– ফিরে আসার আগ পর্যন্ত এই হাত ছারবি না।

আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে আছি। হুট হাত তার এমন স্পর্শ গুলোয় যেন সারা শরির জুড়ে শীতল শিহরণ বয়ে যায়।
এর পর মামির থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম আমি। আর সে ড্রাইভিং সিটে। আমি তার দিকে চেয়ে বললাম,
– আমায় ড্রাইভিং শিখাবেন?
তিনি স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
– তুমি ড্রাইভিং শিখে কি করবে?
– এই ধরেন আমরা কখনো এভাবে বের হলাম। তখন বেশিক্ষন চালানোর পর আপনার শক্তি শেষ হয়ে গেলে আমি চালাবো।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– এতো অল্পতেই দম ফুড়িয়ে যাওয়ার চান্স নেই।
তার দৃষ্টির মুখোমুখি হতেই আমি চোখ সরিয়ে ফেললাম। চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
,
,
ওদের বাড়ি এসে সবার সাথে চলে গেলাম কমিউনিটি সেন্টারে। ওদিক থেকে মেয়ে পক্ষ আসবে। একসাথেই হবে সব। ফাহিম ভাই আজ অনেক খুশি। ভালোবাসার মানুষকে আপন করে পাচ্ছে সারা জীবনের জন্য। ভাবতেই কেমন একটা অদ্ভুত ফিল হচ্ছে আমার। আমি ঠিক তার উল্টো। সারা জীবনের জন্য কাছে পাওয়ার পর তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। আচ্ছা, আমি কি সত্যিই তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি? নাকি এটা মাত্রই একটু মোহ। বাড়ি ফিরে গেলে যখন ওর থেকে দুরে চলে যাবো, তখন এই মোহ কেটে যাবেনা তো?

মনকে প্রশ্ন করলাম, প্রেম আর মোহের মাঝে পার্থক্য কি?
মন উত্তর দিলো,
‘বাস্তবে যা প্রেম, তা কোনো মোহ নয়। প্রেমের জন্ম করুনা থেকে হয়। আর মোহের জন্ম, লোভ থেকে। প্রেম মুক্তি দেয়। আর মোহ আবদ্ধ করে। তাই প্রেম আত্মাত্বিক যা আত্মার সাথে মিশে যায়। আর মোহ একটা ঘোর, যা একটু পর কেটে যায়।
দুরুত্বই বলে দিবে, কে কাকে কতটুকু ভালোবাসি?

এখানেও রিদ ভাইয়ার সেই মেয়ে ফ্রেন্ড টাকে দেখে খুব রাগ হলো আমার। রিদ ভাইয়ার সাথে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কথা বলছে। তা মোটেও সহ্য হচ্ছে না আমার।

গায়ে হলুদের পার্ট শুরু হবে ১০ টার পর। এখন কয়েকজন মেহেদী লাগাতে বয়াস্ত আর কয়েকজন ছবি তুলতে।
আর নিরব ভাইয়া সেই কখন থেকে একটা মেয়েকে ফলো করছে। রিদ ভাইয়ার কাছে শুনলাম এই নিরব ভাইয়া নাকি খুব ফাজিল, সাক্ষন মাথায় মেয়ে পটানোর চিন্তা ঘুরে।
হটাৎ ঠাস করে একটা চরের শব্দে আমি পেছনে তাকালাম। দেখি নিরব ভাইয়া গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে আর সামনে মেয়েটা।
আমার বুঝতে বাকি রইলো না কি হয়েছে। নিজের অজান্তেই হেসে দিলাম আমি। নিরব ভাই হুট করে আমার সামনে এসে দাড়িয়ে বললো,
– ভাবি যা দেখেছেন প্লিজ কাউকে বলবেন না৷ বিশেষ করে রিদকে তো বলবেন ই না। কারণ এটা তারা শুনলে আমাকে নিয়ে সারা দিন মজা নিবে।
আমি একটু হেসে বললাম,
– কিন্তু আমি তো কিছু দেখিনি।
নিরব ভাই বুকে হাত দিয়ে একটা নিশ্বাস নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।

আমিও হাতে মেহেদী দিলাম। মেহেদীর মাঝখানে হাতের তালুতে বড় করে লিখলাম ‘R’।
যা রিদ ভাইয়ার নামকে বুঝায়। আমি হাত একটু শুকানোর পর ধুয়ে নিলাম। এর পর রিদ ভাইয়ার সামনে গিয়ে ঘুর ঘুর করতে লাগলাম। হাতটা বার বাট ওর সামনে ধরতে লাগলাম। যাতে আমার হাতের দিকে তার চোখ পড়ে। কিন্তু ব্যাটা তো কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। খুব রাগ হলো আমার।
এবার নিজে গিয়েই তাকে বললাম,
– আমি হাতে মেহেদী দিয়েছি আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?
ওনি সোজা সুজি বললো,
– তো হাতে মেহেদী দিয়েছো এটা দেখার কি আছে?
– আচ্ছা দেখেন তো কেমন হয়েছে?
– হুম ভালো।
বলেই তিনি আবার ফাহিম ভাইয়ার কাছে চলে গেলেন। ওনার এমন ব্যবহারে পরচুর রাগ হচ্ছে আমার।
আমার মেহেদী রাঙা হাত দেখে প্রশংসা তো করলোই না। আচ্ছা প্রশংসা না হয় বাদ দিলাম। হাতে যে তার নামের প্রথম অক্ষর লিখলাম তা চোখে পড়েনি? একটুও বোঝার চেষ্টা করেনি এটার মানে টা?
মনে মনে তার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলাম।
‘সালা নিরামিষের বাচ্ছা, আবেগ অনুভুতি বলতে কিচ্ছু নাই।’

রাগে সেখান থেকে চলে গেলাম। হাতে পানি দিয়ে ঘসতে লাগলাম জোড়ে জোড়ে। আর মনে মনে বলতে লাগলাম,
‘আমার কপাল এটা। আল্লায় আমারে এমন নিরামিষ একটা জামাই দিছে। ভালোবাসা দুরে থাক, আবেগ অনুভুতিও কিচ্ছু নাই। আজকেই তুলে পেলবো এই অক্ষর।
তখনই পেছন থেকে রিদ ভাইয়ের গলার আওয়াজ কানে এলো,
– এতো ঘসে লাভ নেই। ওটা এতো সহজে উঠবে না। বরং আরো ছরিয়া গিয়ে সৌন্দর্য নষ্ট করবে।

এটা যেন কাটা গায়ে লবনের ছিটার মতো লাগলো।
,
,
কিছুক্ষন পর সকলের উদ্দেশ্যে নিরব ভাইয়া বলে উঠলো,
– হ্যালো এভরিওয়ান। বিয়ে মানেই হাসি-খুশি, আনন্দ, আর দুটি মানুষের জীবন একই সূত্র পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। চার দিকে এমন ঝাক ঝমক পূর্ণ পরিবেশ টা দেখতেই সুন্দর লাগছে খুব তাই না? হ্যা, আর এই ঝাক ঝমক পূর্ণ পরিবেশটা আরো মধুময় করে তুলতে, এখন সকলের মাঝে গান নিয়ে আসছে আমাদের প্রান প্রিয় বন্ধু রিদ।

আমার যেন খুশিতে হাত তালি দিতে ইচ্ছে করছে। এইবার বুঝো ঠেলা। নিরব ভাইকে আমার হাজার বার ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে।
আমি নিশ্চিত, এই অনুভূতিহীন মানুষ টা কখনোই এতো মানুষের সামনে গান গাইতে পারবে না। আর সে গান পারে এটাও কখনো শুনিনি। যাই হোক পরের সিন দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি রিদ ভাইয়ের দিকে।
তখনই ফাহিম ভাইয়ের ছোট ভাই নাঈম একটা গিটার নিয়ে রিদ ভাইয়ের হাতে দিলো।
রিদ ভাইয়া ভ্রু-কুচলে বললো,
– গিটারও রেডি রেখেছো? তার মানে আগে থেকেই প্লেন করেই আমায় এই চিপায় আটকানো হয়েছে?
নাঈম হেসে রিদ ভাইয়ের দিকে গিটার টা দিয়ে সরে গেলো।
গিটার টা নিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে বসলো রিদ ভাই। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তিনি কি এখন সত্যি সত্যিই গান গাইবে?

গিটারের শব্দ কানে আসতেই আমার মনে হলো এটা নতুন নয়। যেন আগে থেকেই প্রেক্টিস করা এই সুর।
আমার দিকে তাকিয়ে রইলো রিদ ভাই। আর গাইতে শুরু করলো,

‘তুমি না ডাকলে আসবো না,
কাছে না এসে ভালোবাসবো না,,,,,
দুরুত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়,,,?
নাকি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়,,,,,,,
দুরের আকাশ নীল থেকে লাল, গল্পটা পুরোনো,,,

ডুবে ডুবে ভালোবাসি, তুমি না বাসলেও আমি বাসি,,,,,,,,,,,

To be continue…..