অনুর উপাখ্যান পর্ব-০৯

0
1946

গল্প : অনুর উপাখ্যান
পর্ব : ৯

— ভায়ে কইছে আইজ আমনেগো বাড়িত রাইতে থাকবো, কাইল সকালে বাড়িত আইব । তাই মায় জিগাইলো দুপুরে বাসায় খাইতো কিনা ?

— লীমা, তোমার ভাই তো আমার সাথে দেখা করে চলে গেছে । বলল যে কাজ আছে । বাসায় পৌঁছালে আমাকে একটা ফোন দিও প্লিজ ।

— আইচ্ছা দিমুনে ফোন । রাখি এহন ।

— ওকে, আল্লাহ্ হাফেজ ।

মারুফ বাসায় বলে এসেছে এখানে থাকবে, তবে চলে গেল কেনো ? তার মানে কি ? ধুর ! এত চিন্তা ভালো লাগে না । যা মন চায় করুক । আর কত চিন্তা করব এই লোকের জন্য ! আমি এখন নিজেকে নিয়ে ভাববো । আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববো । যে দিন থেকে বিয়ে হয়েছে, সেদিন থেকেই আমার জীবনটা সে নরক বানিয়ে রেখেছে ।

মারুফ এহন নেশায় বিভোর ! এই নেশা শুধু মদের নেশা না । এইডা অইলো শরীলের নেশা । বেলি তাকে এত সুখে ডুবাইয়া রাহে যে, তার নেশা সে কাটাইতে পারে না । তাই তো দুই বছর ধইরা বেলির মধ্যে ডুইবা আছে সে । বেলি দ্যাখতে গায়ের রং কালাই কওয়া যায় । চেহারা মোটামুটি । কিন্তু, শরীল ? ইসস ! সেই রকম লাগে । যারে কয় জাস্তি বডি ।

— কি গো , কি চিন্তা করো ? বউ এর কথা মনে পড়ছে ?

— আরে না । তোমার কতাই ভাবতাছিলাম ।

— তোমার বউ নাকি অনেক সুন্দর ? বয়স ও নাকি অনেক কম ?

— হ বেশি সুন্দর । পুতুলের মতো । কিন্তু, আমার কাছে তো তুমি বেশি সুন্দর ।

— তবে বিয়ে করলা ক্যান তারে ?

— কি করতাম ? মায়ে কান্না কাটি করে তাই করছি ।

— তোমার বউ থাকতে আমার কাছে কেনো আসছো ? তোমার তো আর আসা উচিত না । বিয়ে করবা বলে আমাকে দুই বছর ঝুলিয়ে রেখে এখন মায়ের পছন্দে বিয়ে করছ । আর কি চাও আমার কাছে ? তোমার কারনে আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিলাম । বিয়ে করলা না তোমার বাচ্চা টা ও নষ্ট করলাম । এখন আর কি চাও আমার কাছে ?

— আমার লক্ষী সোনা , তুমারে চাই তুমি জানো না ? বিয়া তো তোমারেই করতাম চাইছিলাম । এমন ঝামেলা অইব ভাবি নাই । কয়টা মাস যাক, পরে তো বিয়া করমু কইছি ।

— সত্যি ? আর ধোকা দিবা নাতো ?

— না, দিতাম না । দ্যাহো না বউ ফালাইয়া তোমার ধারে আইছি । কত মজা দেও তুমি আমারে ! তোমার কী লাগব কও ?

— অনেক কিছু লাগব । রাতে থাকবা তো ?

— হ, সারা রাইত ফুর্তি করমু দুইজনে ।কাইল দুপুরের পর যামু ।

— মা, ও মা । ভাবি কইল ভায়ে নাকি তাগো বাড়িত থাকত না । কাম আছে কইয়া নাকি বাইর অইয়া গেছে । রাইতেই নাকি চইল্লা আইবো ।

— কী কও লীমা তুমি !

— হ, ভাবি তো তাই কইল । আরো কইল ভায়ে পৌঁছাইছে নাকি ফোন দিয়ে জানাইতে তারে ।

— কী করতাম ? আইলে ফোন দিতাম ভাবিরে ?

— না, ফোন দেওন লাগতো না । হ্যায় আইতো না আইজক্যা । কার লারো গেছে তা বুঝতাম পারছি । এত চেষ্টা করলাম তবুও ঐ কমিন বেলির পিছ ছাড়াইতে পারলাম না । কত্ত সুন্দর দেইখ্খা একখান বিয়া করাইলাম । তবুও ঐ বেডির লারো যাইবোই । হুনো, বউ জানি জানতে না পারে মারুফ রাইতে বাড়িত আহে নাই । বউ ফোন দিলে কইবা রাইতেই আইয়া পরছে । আর তারে চাইলে কইবা ফার্মে গেছে ।

— ক্যা মা, মিথ্যা কমু ক্যান ভাবির লারো ?

— হাসা কইলে তোমার ভাইয়ের লারো এই বউ থাকবো ? না, থাকতো না । হ্যাসে ওরে আবার কে মাইয়া দিব ?

— হ ঠিক কইছেন আমনে । কমু না কিছু ভাবিরে । আমনে চিন্তা কইরেন না ।

লীমার ফোনের অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল । ইদানীং রাতে বার বার ঘুম ভেঙে যায় । ইউরিনের চাপ থাকে তাই উঠতে হয় । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত তিন টা বাজে । মারুফ নিশ্চই এতক্ষনে বাসায় পৌঁছেছে । না পৌঁছালে নিশ্চই আমাকে ফোন দিত । তবুও সকালে একবার খোঁজ নিব ফোন দিয়ে ।
একবার ঘুম ভাঙলে পরে সহজে ঘুম আসেনা । একা একা ভালো লাগছে না । ভাইয়া একটা বই কিনে এনেছেন গর্ভবতী মা ও শিশুর যত্ন ।বইটা নিয়ে পড়তে শুরু করলাম । কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাই নি । ঘুম ভাঙলো একটু দেরিতেই । সকাল নয় টা বেজে গেছে । ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে অনু ফোনের কাছে গিয়ে বসলো ।
— হ্যালো, কে লীমা ? তোমার ভাইয়া রাতে কয়টায় বাসায় গেছে ?

— বেশি দেরি করে নাই । চইল্যা আসছে ।

— এখন কি করে সে, ঘুমায় ?

— না, ভায়ে তো ফার্মে গেছে গা ।

— ও আচ্ছা । ঠিক আছে আমি রাখি এখন ।আল্লাহ হাফেজ ।

সন্দেহ জিনিসটা কত খারাপ ! শুধু শুধু আমি মারুফকে ভুল বুঝেছি । সে তো ঠিকই বাসায় চলে গেছে সময় মতো । যাক একটু শান্তি পেলাম ।
আম্মু আজ খিচুরি রান্না করেছেন । সাথে হাঁসের মাংস ভুনা, শুটকি ভর্তা, পোড়া বেগুন ভর্তা, সরিষা ভর্তা আর আমার প্রিয় বাদাম ভর্তা করেছেন । মনটা ভালো এখন, পেট ভরে খেতে পারব । বড় আপু ও আসছেন এক সাথে খাব বলে । হাঁসের মাংস আমার প্রিয় অনেক । কিন্তু, আম্মু এতদিন আমাকে খেতে দেন নি । কারন বাচ্চা পেটে নিয়ে পাঁচ মাসের আগে নাকি হাঁস খেতে হয় না । নানু বলেছেন, তাতে বাচ্চার কন্ঠ নাকি হাঁসের মত ফ্যাস ফ্যাসে হয় ! আম্মুর কথায় আমারা দুই বোন অনেক হেসেছি । কিন্তু, মেনে ও নিয়েছি । কারণ আমার কাছে আমার মা যতটা প্রিয়, তেমনি আম্মুর কাছে নানু ও ঠিক ততটাই প্রিয় । আর আমি উনাদের দু’জনকেই অনেক ভালোবাসি ।পাঁচ মাস শেষ হয়ে ছয় মাস চলছে । এখন আমি সব খাবার ই খেতে পারি । আমার খালা, ফুপু, মামিরা সবাই শুধু জিজ্ঞেস করেন কি খেতে মন চায় আমার ? এক জীবনের সব আদর মনে হয় মেয়েরা এই সময়ই পায় । অবশ্যই তা বাবার বাড়ি থেকে । শ্বশুড় বাড়িতে এমন আদর যদি কোনো মেয়ে পেতো, তবে পৃথিবীতেই মেয়েরা জান্নাত পেয়ে যেত ।

— কই বেলি, তোমার আর কতক্ষন লাগব রান্নায় ? দেরি অইতাছে আমার ।

— এই তো আর বিশ মিনিট লাগব । ক্যান এত অস্হির হইছ ক্যান ? বাসায় তো আর বউ নাই । নাকি গোমর ফাঁস হয়ে যাবে তার জন্য ভয় পাও ?

— ধুর, কি কও ? কে গোমর ফাঁস করত ? তুমি আমার মায় রে চিনো ? হ্যায় জীবনেও অনুরে বুঝতে দিত না আমি যে রাইতে বাইত
যাই নাই ।

— তাই ! ক্যান দিবে না ?

— আমারে বিয়া করাইছে মায় । এহন যদি অনুরে সব কইয়া দেয় তবে কি অনু থাকব ? তার ভয় আছে না ? মায় সব জাইন্না ও চুপ থাকবো । আর ফার্মে কাজ তাই যাইতে চাইতাছি ।

— বুঝলাম । আমার টাকা কই ? এই মাসের খরচ এর টাকা দিবা না ? আর ঐ যে বললাম একটা গয়না পছন্দ হইছে । কবে দিবা কিনে ?

— খরচের টেকা তো এহনি দিতাছি । আর গয়না কিনতে কবে যাইবা কও ? আমি টেকা ম্যানেজাররে দিয়া পাঠাই দিমুনে ।

— তাইলে সাথে ফার্মের জিনিস ওপাঠাবা কিন্তু ।

— আইচ্ছা পাঠামু । সবই তো তোমার ।

আমার দু’টো সুতির শাড়ি রেখেছি বাবুর জন্য । বাবু হলে সে গুলো টুকরো টুকরো করে কাঁথার মতো ব্যবহার করার জন্য । সেলাই করা কাঁথার চেয়ে এ গুলো নাকি বেশি ভালো । আমাদের বুয়ার কাছে আম্মুর শাড়ি দিয়ে কাঁথা বানাতে দিয়েছেন । আর যা যা লাগে বাবুর জন্য, সে গুলো বাবু হওয়ার পর কিনব । আম্মু আগে কিনতে না করেছেন । আগে নাকি কিনতে হয় না । এখন আমার সময় গুলো খুব আনন্দে কাটে বাবুর জন্য । বিশেষ করে ঝিনুর আনন্দ দেখে আরও ভালো লাগে ।

— আপু, তুই কোনটা চাস ? ছেলে না মেয়ে ?

— দোয়া কর যেনো বাচ্চা সবদিক থেকে সুস্হ থাকে । আর হ্যাঁ, আমি মন থেকে চাই আমার বাবুটা যেনো মাশা আল্লাহ এত সুন্দর হোক দেখতে, যাতে করে যারা ওর জন্ম নিয়ে খারাপ কথা বলেছে তারা ও বাধ্য হয় ওরে আদর করতে ! মানে ওর মুখটা দেখে যেনো সবাই ওরে আদর করে, এতটা মায়াবী যেনো ও হয় ।

— আমি ও এখন থেকে সেই দোয়া করব আপু । তুই মন খারাপ করিস না । আচ্ছা শোন না , বললি না তুই ছেলে না মেয়ে চাস ?

— আমার তো মেয়ে পছন্দ অনেক । কিন্তু, তবুও চাই আল্লাহ যেনো আমাকে একটা ছেলে সন্তান দেন । কারণ, আর একটা মেয়ে হওয়া মানে আর একটা অনুর জন্ম হওয়া ।

— আমি দোয়া করি মা তোমার ছেলে যেনো হয় । ছেলে হলেই তুমি ঐ বদ গুলোরে শিক্ষা দিতে পারবে । মেয়ের যন্ত্রনা অনেক । কষ্ট করে জন্ম দিবা, মানুষ করবা আর মারবে অন্য কেউ । কোনো দরকার নাই মেয়ের । ছেলেই হোক মা । আমি সবসময় আল্লাহর কাছে চাইছি যেনো একটা সুস্হ সুন্দর ছেলে হয় তোমার ।

— আম্মু, তুমি দোয়া করেছো না ? আল্লাহ নিশ্চই কবুল করবেন । ইন শাহ আল্লাহ ।

— তবে চল আপু আমরা ছেলের নাম ঠিক করি ।

— না ঝিনু, এখন না । সাত মাস শেষ হোক তখন রাখা যাবে । এখন শুধু সবাই দোয়া করবি । আমার মেয়েটার কষ্ট যেনো আল্লাহ দূর করে দেন । ফুটফুটে এক রাজপুত্র যেন ওরে দান করেন, আমীন ।

বাসে বইসা মারুফ চিন্তা করছে মায়রে কী কওয়া যায় ? এহন যদি সরাসরি বাড়িত যায়, তয় এত গুলান কতা হুনতে অইব । এহন বাড়িত যাওন যাইতো না । ফার্মে যামুগা । কাম শেষ কইরা পরে বাইত যামু । ততক্ষনে মার রাগ একটু কমবো ।

এক দিন ফার্মে আহি নাই, সবকিছু উল্টা পাল্টা কইরা রাখছে ! এত গুলান কর্মচারী রাখছি তবুও কাজ ঠিক মতো হয় না ।

— নুরুল, এদিকে আহো ।

— জি, স্যার ।

— হুনো , শুক্কুর বার তুমি উত্তরা যাইবা । ২০,০০০/ টেকা দিমু, দুই কেস ডিম, দুইডা বড় মুরগী, গাছের ডাব এগুলান নিয়া ম্যাডামরে দিয়া আইবা । মনে থাহে যেন । আগের তে কাম গুছাইয়া রাইহো ।

— স্যার, নতুন ম্যাডামের বাড়ি না গুলশান ? তয় উত্তরা যাইমু ক্যান ?

— নুরুল ! যা কই তা করো । আমার বউ এর বাড়িত তোমারে যাইতে কই নাই । কইছি তোমার বেলি ম্যাডামের কাছে যাইতে । বাসা তো তুমি চিনই । তয় ফাইজলামি করতাছ ক্যা?

— কিছু না স্যার । আর করমু না ।

— আর খবরদার, মায় জিগাইলে কিছু কইবা না । তয় কিন্তু, তোমার চাকরী থাকত না ।

— জি স্যার, কিছু কমু না ।

এহনো মারুফ আহে না ক্যা ? আইজ আহুক বাড়িত । আমার পোলা যে এত খারাপ অইছে ! বাপের স্বভাব পাইছে । ইস, কতক্ষন বারান্দায় বইয়া থাকমু । রিসকার শব্দ পাইলাম মনে হয় ? হ আইছে মারুফে ।

— এত দেরি করলা ক্যা আইতে ?

— কাম ছিল ফার্মে ।

— যাও কাপড় পাল্টাইয়া খাইতে বহো ।

— আমনে খাইছেন ?

— না, খাইনাই । আহো একলগে খামু ।

মা, লীমা কারো মুখে কোনো কতা নাই । বুঝছি এই বার বালা মতো প্যাঁচ লাগছে । খাওয়া শেষ সবার । তাও মায় কতা কয় না !

— কি অইছে ? আমনের কি শরীল খারাপ মা ?

— তুমি কাইল রাইতে কই আছিলা ?ঐ কমিনের লারো ?

— হ । আমনে তো জানেন ই ।

— ছি! তোমার একটু শরম করল না এইডা কইতে ? কোন মুহে তুমি এমন কতা কও মারুফ ? তোমার গরো বউ আছে না এহন ? বউ এর লারো গেছো, তার লগেই থাকতা । কেমনে এত সুন্দর বউ ফালাইয়া ঐ কমিনের লারো গেছো তুমি ?

— আমি কি কইছি আমার সুন্দর বউ লাগতো ? আমনেই তো বিয়া করাইলেন । আমার কাছে বেলিই সুন্দর । দিলেন না ক্যান তারে বিয়া করতে ?

— ঐ কালা বেডিরে তোমার লারো সুন্দর লাগে ? আর বউ ? হ্যায় কি দুষ করছে ? পরীর লাহান একটা বউ পাইয়া ও তোমার জী ভরে না !

— কালা কি সুন্দর হয় না ?

— অবশ্যই সুন্দর । তবে সুন্দর সে অইতো যদি তার চরিত্র সুন্দর অইত । যে বেডি স্বামী বিদেশ করে দ্যাইখা তোমার লগে শুইয়া প্যাট বাজাইতে পারে , হ্যায় কেমনে সুন্দর মানুষ হয় ? তুমি কবে বুঝবা ? বেলি তোমার টেকার লাইগা তোমারে পছন্দ করে । টেকা দেওয়া বন্দ কইরা দ্যাহো, তুমার দিকে ফিরা ও তাকাইবো না । আমার কতাডা মনে রাইখো।

মনডা প্রচুর খারাপ লাগতাছে । কেমতে আমি মারুফরে এই ডাইনির হাত তন বাঁচামু ? ওর টেকা পয়সা সব শেষ কইরা ছাড়ব ঐ কমিন বেডি । আর কত বড় অন্যায় করছি আমি সত্য গোপন কইরা, এটুকু একটা মাইয়ার জীবন নষ্ট করছি ! বউডা যেমন সুন্দর, তেমন বালা । অথচ, তারে বড় বউ আর সীমার বুদ্ধিতে আমি কত কষ্ট দিছি ! আল্লাহ কি আমারে কোনদিন মাফ করব ?

চলবে….

✍? নায়না দিনা