অনুর উপাখ্যান পর্ব : ১০

0
2271

গল্প : অনুর উপাখ্যান
পর্ব : ১০

বাসায় আজ ভিন্ন আয়োজন চলছে । আজ অনুর প্রেগন্যান্সির সাত মাসে পড়েছে । তাই একটা ছোট খাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে । আম্মু, ছোট খালা, ফুপু সবাই মিলে রান্না করছেন । নানা রকম পিঠা, গুড়ের পায়েস রান্না হচ্ছে । অনু আজ বেশ খুশি । দেখতে দেখতে সাত মাস হয়ে গেল । এই তো আর মাত্র দুই মাস ! তারপরেই বাবুর মুখটা দেখতে পাবে সে !

মারুফদের বাড়ি থেকে সবাই আসবে আজ । কেউ রাজি ছিল না ওদের দাওয়াত দিতে । কিন্তু, শাশুড়ি মা আসতে চাচ্ছেন নিজের ইচ্ছেতেই । তাই আর না করতে পারি নি । দুপুরে সবাই এখানে খাবে । আমার জন্য বড় একটা থালা সাজানো হয়েছে অনেক রকম খাবার দিয়ে ।আমাদের বাসার সবাই আমাকে একটা করে শাড়ি গিফট করেছে । আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, শাশুড়ি মা, সীমা, বড় ভাবি তারা ও শাড়ি গিফট করেছেন । সব মিলিয়ে অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করছে । কেনো জানি মারুফের কোনো বিষয় আমাকে আর আগের মতো ভাবায় না । মনে হয় আমার দুনিয়া, আমার সবকিছু জুড়েই শুধু আমার সন্তান ।

আলট্রাসনোগ্রাম করিয়েছি গত কাল । রিপোর্ট এ ছেলে না মেয়ে উল্লেখ করেনি । কিন্তু, বড় আপু ডাক্তার কে অনুরোধ করলেন বলতে । ডাক্তার বললেন ছেলে হবে । শুনে খুশিতে আমার চোখে পানি এসে গেছে ! আমাদের বাসায় সবাই খুব খুশি । মারুফদের বাসার কাউকে বলা হয় নি ছেলে হবে । আগে নাকি বলতে হয় না । ডাক্তার ডেট দিয়েছেন ফেব্রুয়ারির বাইশ তারিখ । রোজার ইদের এক সপ্তাহ পরে । প্রতিদিন অনু আল্লাহর কাছে সন্তানের জন্য দোয়া করে । আয়াতুল কুরসি পড়ে শরীরে ফুঁক দেয় । সব যেনো ঠিক মতো হয় এটাই একমাত্র চাওয়া ।

ঈদের একদিন পরেই অনুর শরীর খারাপ লাগা শুরু হয় । ডাক্তার সব চেক করে বললেন, আজ দুপুরেই অনুর সিজারিয়ান অপারেশন করতে হবে । কারণ, কোনো পেইন ছাড়াই অনুর পানি ভেঙে গেছে ।তাই নাকি নরমাল ডেলিভারি করানো সম্ভব না । খবর পেয়ে মারুফ সাথে সাথে চলে এসেছে । দুপুর দু’টোয় অনুর কোল জুড়ে এলো ফুটফুটে এক ছেলে শিশু । গায়ের রং একদম অনুর মতো গোলাপি আভা ছড়ানো । ঠিক যেমনটি অনু দোয়া করেছিল । ছেলের নাম রাখা হলো নিহান ।

মাতৃত্ব এমন এক অনুভূতি যে, কাউকে তা শিখিয়ে দিতে হয় না । নিজের ভিতর থেকেই সেটা জাগ্রত হয়। অনুর ক্ষেত্রে ও তাই হলো । নিজেকে আর সেই ছোট অনু মনে হয় না । কেমন যেনো এক দায়িত্ববান মানুষ মনে হয় । হঠাৎ করেই যেনো অনু অনেক বড় হয়ে গেছে !

নিহানের জন্মের একমাস পরেই মারুফ অনু আর নিহানকে বাসায় নিয়ে গেল । সে নাকি তার ছেলে ছাড়া থাকতে পারছে না । তার এত আগ্রহ দেখে অনু বাধ্য হলো তার সাথে যেতে ।

— ও মা দ্যাহো কে আইছে ! ভাবি আইছে বাবুরে নিয়া । খুশিতে লীমা অস্হির !

— সাবধানে নিও লীমা । পড়ে না যেনো ।

— না, ভাবি পড়তো না । আমি পারমু রাখতে ।

এ বাড়ির সবাই বলতে গেলে খুশি নিহান কে দেখে । শুধু বড় ভাবি আর সীমার খুশি চলে গেছে । সীমার এক ছেলে । এতদিন এ বাড়িতে ওর ছেলের এক চেটিয়া রাজত্ব ছিল । এখন তো নিহান এসেছে, ওর ছেলের আদর যে ভাগ হয়ে গেল । এটাই সীমার দু:খ । আর বড় ভাবি এ জীবনে শুধরাবে কিনা সন্দেহ !

— কিরে অনু, তুই এত বেহায়া ক্যানরে ?

— কেনো ভাবি কি করলাম আমি ?

— এই যে চল্লিশ দিনের ছটি না যাইতেই আইয়া পরছোস। ক্যান স্বামীর লগে শোয়ার লাইগা ? না কি তর বাপে তরে আর খাওয়াইতে পারে না তাই আইছোস ?

— আল্লাহ ! আপনাকে কী বলব ভাবি ? আপনি আমাকে কেনো এভাবে কষ্ট দেন ? আসছি এখনো এক ঘন্টা পার হয় নি । আর আপনি এগুলো বলা শুরু করলেন ! শোনেন, কেনো আসছি ? এই সংসারটা কার ? আমার না ? হ্যাঁ, আমার সংসারে আমার যখন মন চাইবে, আমি আসব । এটাই নরমাল না বলেন ? আর একটা কথা ভাবি, আমাকে যা খুশি বলেন সমস্যা নেই । কিন্তু, আর কোনো দিনও আমার বাবা কে নিয়ে কিছু বলবেন না ।

ভাবি মুখ কালো করে চলে গেলেন । আশা করি আর কোনো দিন এমন বাজে কথা বলবেন না । একটা বিষয়ে অনু অবাক ! আশ্চর্য ! সে কি করে ভাবির কথার জবাব দিলো ? কোথায় পেল সে এত সাহস ? সবই কি তার মাতৃত্বের শক্তি ?

নিহান একটু একটু করে বড় হচ্ছে, আর ওর মিষ্টি মুখ খানা যেনো আরও মিষ্টি হচ্ছে । যারা আমার ছেলের জন্মটাকে মেনে নিতে চায় নি, তারাই এখন নিহান ছাড়া কিছু বুঝে না । সারা বিকেল নিহান তার লীমা ফুপির কোলে চড়ে আকাশ দেখে । আর তার বড় চাচি, সে ও নিহানকে সুযোগ পেলেই আদর করেন । সকালে ঘুম থেকে উঠলেই দেখি প্রতিবেশিদের কেউ না কেউ সিঁড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছে নিহানকে কোলে নেয়ার জন্য ! এমন কি ভিক্ষা করতে এসে আমার কোলে নিহানকে দেখে বলছেন : “তুমার পোলারে কোলে নিতে দিবা ?”আমি খুশি মনে তাদের কোলে দেই শাশুড়ি মার এক গাদা বকা উপেক্ষা করে ।ঠিক যে ভাবে দোয়া করেছি, মাশা আল্লাহ ছেলে আমার তেমনই মায়াবী হয়েছে ।

ভালো মন্দ মিলিয়েই অনুর সংসার চলছে ।মারুফ এখনো মাঝে মাঝে রাত করে বাড়ি ফিরে । কোথায় যায় তা বলে না । ঝুমা আপা এসেছেন । দুলাভাই আবার বদলি হয়েছেন, তাই আপা আপাতত তার দুই বাচ্চা নিয়ে এখানেই থাকবেন । আপার মনটা বেশ ভালো । অনুকে আদর করেন অনেক । অন্য কেউ অনুর ভুল ধরলে উনি প্রতিবাদ করেন ।সীমা ও এখন এ বাড়িতেই থাকে । পুরো বাড়ি ভরা মানুষ ।একা অনুকে এখন পুরো সংসার সামলাতে হয় !

মারুফ দিন দিন একটু বেশি ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে । ফার্মে নাকি কাজ বেশি । এত মানুষের তদারকি করে অনু যে একটু সময় বের করে তার সাথে কথা বলবে, সে সুযোগ নেই । শুধু রাতে বেলায় যে টুকু কথা হয় । নিহানের খেয়াল রাখতে গিয়ে অনুর রাত ও শেষ হয়ে যায় ।

— ভাবি, ও ভাবি কেমন আছেন আপনে ? সুজন এর কন্ঠে অনু চমকে তাকায় । নিহানকে গায়ে পাউডার দিচ্ছিল সে ।

— এই তো ভাই, আলহামদুলিল্লাহ ।

— টাকা কামাইলো এইবার আমগো মারুফ ভাই । সেই রকম টাকা !

— মানে কি ? বুঝতে পারলাম না ।

— এবার ফার্মের ব্যবসায় অনেক লাভ অইতাছে সবার । ডিমের দাম অনেক । মারুফ ভাই তো কোটিপতি হইয়া যাইব ভাবি । ক্যান আপনারে কিছু কয় না ভাই ?

— আমি তো আসলে এসব নিয়ে আলোচনা করার সময় পাই না । লাভ হলে তো ভালোই ।

— ভাই টাকা আইনা আপনের হাতে দেয় না ? তবে এত টাকা ভাই কি করে ? কই খরচ করে ?

সুজন ভাই যাওয়ার পর অনুর মনে হলো এই লোকটা কিছু একটা বলতে চাচ্ছে । কিন্তু, কি সেটা ?

রাতে মারুফকে বিছানায় শুতে দেখেই অনু চেঁচিয়ে উঠল : এ্যাই দাড়ান, ঘুমাবেন না । কথা বলব আপনার সাথে ।

— কী অইছে ? কও ।

— ফার্মের অবস্হা কেমন এখন ? মানে ব্যবসা কেমন চলছে ?

— বালা । ক্যান কি অইছে ?

— এখন নাকি ডিমের দাম অনেক বেশি । আপনার অনেক লাভ হচ্ছে । যদি তাই হয়, তবে টাকা কই ? মানে টাকা কই রাখছেন ?

— টেকার হিসাব দিয়া তুমি কি করতা ? তোমার কাম কি ?

— দরকার আছে আমার । আমারই হিসেব রাখতে হবে । আপনি এত টাকা কামান, অথচ আমি কোনো টাকাই চোখে দেখিনা ! কই আমাকে তো আজ পর্যন্ত কিছু কিনে ও দিলেন না ? থাক, না দিলেন আমাকে কিছু । কিন্তু, আপনার তো একটা ছেলে আছে । ওর ভবিষ্যত চিন্তা করে হলে ও তো আপনার টাকা জমানো উচিত ।

— তোমার এত চিন্তা করা লাগতো না । হেইডা আমি বুঝমনি ।

— ছেলের চিন্তা আপনি করলে; আমার আর কোনো চিন্তা নেই । তবে একটা কথা বলি : যদি কোনো ভাবে আপনি আমাকে ঠকান , আমার আর আমার ছেলের হক অন্য কাউকে দেন, তবে আল্লাহ কিন্তু আপনাকে কোনদিন ও মাফ করবেন না ।

— বেশি কতা কও ক্যান ? ঘুমাও ।

— মারুফ ঘুমায় পড়ছো ? দরজায় টোকা দিয়ে ঝুমা আপা ডাকছেন ।

— না আপা, ভিতরে আহেন । বসেন ।কিছু কইবেন ?

অনু তাদের কথা বলার সুযোগ দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল । নিহান তার ফুপির পায়ে ঘুমুচ্ছে । ড্রয়িং রুমে সবাই গল্প করছে । অনু ওদের সাথে যোগ দিলো । রাত এগারো টা বাজে তবু মনে হয় যেনো মাত্র সন্ধ্যা হলো ।

— মারুফ তুমি কী করতাছ এগুলো ?

— ক্যা আপা, কি করছি আমি ?

— দেখো আমি সব জেনেই তোমারে বলতেছি ।তুমি কিন্তু ঠিক করতেছ না । তুমি বিয়ে করছ, ছেলে ও হইছে । তারপর ও তুমি বেলির কাছে যাও ! ক্যান করো তুমি এমন পাপ ? অনুরে দেখছো ? কত ছোট মেয়ে । আঠারো বছরের আগেই বাচ্চার মা হয়ে গেছে ! তোমার কারণেই তো ? এই মেয়েটার উপর ক্যান অবিচার করতেছো ? আর তোমার ছেলেকে দেখো, রাজপুত্রের মতো দেখতে । এখনও সময় আছে ভাই ভালো হও । আমার কথা শুইনো । আর খবরদার অনুর গায়ে হাত তুলবানা । একবার চিন্তা করো অনু আমাদের নিপার সমান বয়স ! তারে কেমনে মারো তুমি ?

— বুঝতাম পারছি । আর মারমু না ।

— তুমি যদি আর ঐ দিকে যাও, তবে আমি কিন্তু ঠিকই জানতে পারব ।শোনো, অনুরে একটু সময় দাও । ঘুরতে নিয়া যাও কোথাও । কিছু কেনাকাটা কইরা দাও । বাচ্চা মানুষ খুশি হবে অনেক ।

— আইচ্ছা দিমুনে ।

কয়দিন ধরে শাশুড়ি মায়ের শরীরটা খারাপ । মারুফ ও সীমা মাকে ঢাকা নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছে । অনেক টেস্ট করতে দিয়েছে ডাক্তার । এক সপ্তাহ পর রিপোর্ট দিবে ।এদিকে মালয়েশিয়া থেকে দেবর মঈন আসবে কাল সকালে । মঈনের আবদার আমি যেনো এয়ারপোর্টে যাই তাকে রিসিভ করতে । বাড়িতে এত মানুষ ! বড় ভাবির তিন ছেলে মেয়ে এখানেই থাকে সারাদিন । বড় বড় পাতিলে রান্না হয় প্রতিদিন । রান্নার দায়িত্ব লীমাকে বুঝিয়ে দিয়ে মঈনকে আনতে গেলাম আমরা । আমাকে দেখে মঈন বেশ খুশি । তার ভাবি এত সুন্দর ! শুধু এটাই বলছে বার বার ।

শাশুড়ি মায়ের রিপোর্ট নিয়ে মারুফ ডাক্তার দেখিয়ে এসেছে । বাসায় এসে কোনো কথা বলে নি সে । ফ্লোরে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে ।অনু রিপোর্ট নিয়ে পড়ে দেখে মায়ের ওভারিতে ক্যানসার হয়েছে । সেই ক্যানসার পুরো পেটে ছড়িয়ে গেছে । ক্যানসার এখন লাস্ট স্টেজে আছে । আল্লাহ ! কি হলো এটা !

মারুফের পাশে বসে শান্তনা দিতে গেলেই মারুফ মাটিতে গড়িয়ে কান্না শুরু করল । অনু ও কাঁদছে সাথে । সীমা, ঝুমা আপা, মঈন সবাই আমাদের ঘরে এসে সুর করে কান্না করছে ।

— প্লিজ, তোমরা একটু থামো সীমা ।মা শুনে ফেলবেন তো । আপা শোনেন, মাকে যদি বাঁচাতে চান তবে কোনো ভাবেই মার সামনে কেউ কাঁদবেন না । মাকে বলাই যাবে না যে উনার ক্যান্সার হয়েছে । তবে মা ভয়েই মরে যাবেন ।

— হ অনু ঠিক কইছে । তোরা কেউ মায় রে বুঝতে দিস না । মারুফ বলল ।

— ভাবি, ও ভাবি গো তোমার পায়ে ধরি, আমার মার চিকিৎসা তুমি করতে দিও । আমার মারে তুমি বাঁচাও । তুমি না দেখলে মারে বাঁচাইতে পারমু না । আমার মারে বাঁচাও তুমি ভাবি ।

চলবে…..

✍? নায়না দিনা