অনুর উপাখ্যান
পর্ব : ১৬
মারুফদের দোতলা বাড়িটা নতুন হলে ও বাড়ির ডিজাইন একদম সেকেলে । ইউ প্যাটার্ন এ করা বাড়িটার এক মাথায় বাথরুম ।যে কোনো ঘর থেকে বের হলেই বারন্দা পার হয়ে তবে বাথরুমে যেতে হয় ।
চোরের মতো করে ঘর থেকে বের হয়ে মারুফ সোজা বাথরুমের দিকে গেল । রেখার কাছে যাওয়ার আগে তার ফ্রেশ হওয়া দরকার । মনের মধ্যে একরাশ সুখ নিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় আসতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠল মারুফ । সামনে অনু দাড়িয়ে আছে ! অতি কষ্টে নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করল সে :
— কি অইছে অনু ? তুমি এইহানে কি করো ?
— বাথরুমে যাব তাই দাড়িয়ে আছি । আপনি দাড়ান একটু, একা ভয় লাগে আমার ।
— আইচ্ছা, দাঁড়াইছি তুমি যাও ।
থু থু থু, মারুফ নিজের বুকে থুথু দিয়ে ভয় কাটাচ্ছে । ইসস, আর একটু অইলেই ধরা খাইছিলাম । আমার কপালডা বালা, অল্পের লাইগা বাঁইচা গেছি । ভাগ্গিস বাথরুম পাইছিল । না, আরও সাবধান হওয়া লাগবো আমার । অনুকে আসতে দেখেই মারুফ চেহারাটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে ।
— কি হয়েছে আপনার ? মুখ কেমন যেনো লাগছে ? অনু জিজ্ঞেস করল ।
— কই ? কিছু নাতো ! চলো ঘুম আইতেছে ।
— হুম, চলেন ।
অনুর কাছে মারুফের আজকের আচরণ কোনো ভাবেই স্বাভাবিক লাগছে না । সে সব ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখছে। না, সব ঠিকই তো আছে । সে মারুফকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়ল । একটু পরেই মারুফের নাক ডাকার শব্দ পাওয়া গেল । কিন্তু, অনু ঘুমাতে পারছে না । যতই ঘুমের চেষ্টা করছে, ততই ঘুম যেনো পালিয়ে যাচ্ছে ! এভাবে এপাশ ওপাশ করতে করতে এক সময় অনু ঘুমিয়ে পড়ল ।
ফজরের আযান দেয়নি এখনো। মারুফ উঠে বারান্দায় গেল । কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার ঘরে এসে দেখলো অনু কি সত্যি ঘুমে কিনা ? এবার ঘর থেকে বের হয়ে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার সে ঘরে এলো । এবারও অনু ঘুমেই আছে দেখে নিশ্চিন্তে রেখার কাছে গেল ।রেখা মনে হয়ে তার অপেক্ষায়তেই ছিল । রেখা ন্যাকামি সুরে মারুফকে জিজ্ঞেস করল:
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
— এত দেরি করলেন ক্যান দুলাভাই ? আপারে ভয় পাইছেন বুঝি ? হি হি হি
—ইসস ! এত ঢং কইরো নাতো , এমনি তোমারে দেখলে মাথা ঠিক থাহে না আমার ।
— ক্যান ? এত সুন্দর বউ থাকতে আমারে দেখলে এমন হয় ক্যান দুলাভাই ?
— কারণ অইল, বউ তো বউ । বউ এর লগে অইলো শালি ফ্রি ।হের লাইগা তোমারে খালি আদর দিবার মন চায় । তুমি আমার শালি না ?
— হুম, বুঝলাম । আসেন দুলাভাই ।
গেটে শব্দ শুনে অনুর ঘুম ভাঙলো । উঠে গেট খুলতে যাবে সে, তার আগেই মঈন গেট খুলে মারুফকে ডাকছে । মারুফ তখনো ঘুমে । অনু ঘর থেকে বের হয়ে দেখে, গেটে ফার্মের ম্যানেজার নুরুল দাড়িয়ে আছে । অনুকে দেখে নুরুল প্রায় কেঁদে উঠল :
— ম্যাডাম, সর্বনাশ হইয়া গেছে ! কাল রাইত থাইকা খালি মুরগী মরতাছে ।
— কী ? কী বলেন এসব ! কত গুলো মরেছে ?
— হাজারের বেশি অইবো । এখনো মরতাছে । স্যার কই ?
— মঈন তোমার ভাইকে ডাকো । অনু মঈনের দিকে তাকিয়ে বলল ।
— নুরুল, আপনি সকালে আগে ডাক্তার ডাকেন নি কেনো ? অনু জিজ্ঞেস করলো ।
— ডাক্তার ডাকছি ম্যাডাম । ডাক্তার কইছে গামবোরো রোগ অইছে । আরও কত মুরগী মরব কওয়া যায় না ।
— নুরুল আপনি বসেন । আপনার স্যার আসছে । এ কথা বলে অনু ঘরে চলে গেল ।
মারুফ বিছানায় থুম ধরে বসে আছে । অনু আর নুরুলের সব কথাই শুনেছে সে । তার মাথায় যেনো বাজ পড়েছে ! কি করবে এখন সে ? তার হাতে টাকা ও বেশি নেই । ডিমের দাম এখন এমনিতেই অনেক কম । লাভ হয়না ব্যবসায় ।
— কি হলো আপনার ? এভাবে বসে আছেন কেনো? নুরুল আপনার জন্য বসে আছে । অনু বলল ।
— হ, যাইতাছি । গোসল কইরা লই । তুমি নাস্তা দেও ।
— আচ্ছা দিচ্ছি । অনু রান্না ঘরের দিকে গেলো ।
আজও রান্না ঘরের চিত্র আগের মতোই । ভেজা চুলে রেখা শরীরের একাংশ বের করে কাজ করছে । আজ আর রেখার গোসল করা নিয়ে অনুর মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করছে না । সে ফার্ম নিয়ে চিন্তায় আছে । এভাবে মুরগী সব মরে গেলে কি করবে মারুফ ? ব্যবসায় যে এমন ধ্বস নামবে অনু আগেই জানতো । যেদিন ফার্মে মেয়ে নিয়ে ফুর্তি হয়, জেনেছে সে । সেদিনই অনুর মনে ভয়ে কামড় দিয়েছিল । আজ সত্যিই তাই হলো ।এখন কি হবে তাদের ? কেমন একটা অজানা ভয় কাজ করছে অনুর মনে !
— আসসালামু আলাইকুম ভাবি । কি অইছে ভাবি ? ফার্মে মুরগী বলে সব মরতাছে ? সীমা জিজ্ঞেস করল ।
— ওয়াআলাইকুমুস সালাম । হ্যাঁ, মনটা ভালো না সীমা । মুরগীর গামবোরো হয়েছে । হাজার হাজার মুরগী মরে যাচ্ছে ।
— এহন কী করবা তাইলে ?
— আমি তো জানিনা কিছু । তোমার ভাই আসুক । দেখি কি বলে ?
— ভাবি, সুজনের ইচ্ছা মঈনরে তার সাথে চিল্লায় নিয়ে যাইতো । মঈন সারা দিন ঘুমায়, একবার গেলে দেখবা স্বাভাবিক হইয়া যাইব। তুমি কি বলো ?
— এটাতো খুবই ভালো কথা । আর এখন তো রেখা আছে । সমস্যা নেই নিহানকে রাখার । সুজন ভাইকে বলো মঈন কে নিয়ে যেতে ।
— ভাই কিছু কইতো নাতো মঈন গেলে ?
— না, বলবে না । তবুও আজ রাতে তাকে বলে রাখব ।
রেখা চা নাস্তা নিয়ে এসেছে । সীমা, অনু আর মঈন মিলে নাস্তা করছে । চার কাপ চা দেখে সীমা জিজ্ঞেস করল :
— চা একটা বেশি ক্যান ভাবি ?
— চা এক কাপ রেখা খাবে । আমি বলেছি চা বানালে ওর জন্য ও বানাতে ।
সীমার মনে হয় অনুক কথা পছন্দ হলো না । অনু বুঝেও না বুঝার ভান করল।
— রেখা তোমার চা নিয়ে যাও । চা শেষ করে ছাদে গিয়ে গাছে পানি দিও । আমি আজ আর ছাদে যাব না । অনু বলল ।
সীমা আর মঈনের সাথে অনেক্ষণ বসে গল্প করল অনু । মঈন ওর ব্যাগ গুছিয়ে সীমার সাথে চলে গেল সীমার বাসায় । অনু নিহানকে ঘুম পাড়িয়ে পড়তে বসেছে । তার মাথায় পড়া ঢুকছে না । শুধু একটাই চিন্তা এখন কি অবস্হা ফার্মের ?
প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে মারুফ বাসায় ঢুকল । অনু কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না । মারুফ ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার শেষ করার পর জিজ্ঞেস করল :
— কিছু বলেন না যে ? এখন কি অবস্হা ?
— কি বলতাম ? নতুন যে পাঁচ হাজার বাচ্চা উডাইছিলাম, আর একমাস পরই ডিম দিতো । হেই গুলান সব মইরা শেষ ! ডিম দেওয়া মুরগীর তো ডিমের সময় শেষ অইয়া আইছে । এহন কী করতাম !
— আল্লাহ ! এখন উপায় ? কি করবেন এখন ?
— এহন যদি নতুন কইরা একটু বড় মুরগী কিনতে পারতাম তাইলে আর সমস্যা অইতো না । তাইলে নতুন মুরগীর ডিমের সামনের চড়া দামটা ধরতে পারতাম ।
— তবে তাই করেন । দেরি করছেন কেন তবে ?
— তাই করেন কইলেই অইবো ? টেকা লাগতো না ? এত টেকা কই পামু ? মুরগীর খাবারের দোকানে টেকা বাকি আছে । ওষুধ আনছি বাকিতে । এগুলার টেকা শোধ করমু ; না কি মুরগী উডামু ?
— মুরগী আর না উঠালে কি হবে ?
— দুই মাস পর ফার্ম বন্ধ অইয়া যাইব । তহন না খাইয়া থাকবা । বুঝছো ?
— এতদিন যে টাকা কামালেন সেই টাকা কই ? মানে কিছুই রাখেন নি ? বাসায় ওতো আনেন না টাকা । আমাকে দিলে তো এখন আমি দিতে পারতাম !
— টেকা কামাইছি হেই টেকা সংসারে লাগছে না ?
— এতো টাকা সংসারের কোন খাতে খরচ হয়েছে দেখান তো ? না নতুন কোনো ফার্নিচার কিনেছি; না আমাকে কোনো গহনা কিনে দিয়েছেন । বলেন যে টাকা আপনি আপনার খাতে খরচ করেছেন ।
— তুমি কিন্তু বেশি কতা কইতাছ অনু !
— বলব না তো কি ? আচ্ছা বাদ দেন । আমাকে কিছু বলতে আসবেন না । অনু রেগে বলল।
— রাগ করো ক্যা ? শোনো তুমি আব্বুর কাছ তন ত্রিশ হাজার টেকা লোন আইনা দেও । পরে দিয়া দিমু ।
— আচ্ছা, এখনি বলছি আম্মুকে ।অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
রাতে অনু তার আম্মুকে টাকার কথা বলার পরই মারুফের একাউন্টে অনুর আব্বু আগামীকাল সকালে ত্রিশ হাজার টাকা জমা দিয়ে দিবে বলেছেন ।আর এটা লোন না । একবারেই দিয়েছেন মেয়েকে । মারুফ এখন খুশি এতে ।
ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই মুরগীর খাবারের দোকানের মালিক রিফাত বাসায় এসে হাজির । ড্রয়িং রুমে বসে আছে সে । মারুফ নানা ভাবে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে যে, টাকা সে ঠিকই ফেরত দিবে । কাজেই সে যেনো খাবার দেয়া বন্ধ না করে । কিন্তু, এই লোক তা মানতে নারাজ । মারুফ অনুকে ডাক দিল :
— অনু, এদিকে আইয়ো ।
— জি, বলেন । নাস্তা দিচ্ছি একটু অপেক্ষা করেন । অনু বলল ।
— আরে বহো তুমি । নাস্তার লাইগা না । এই হইলো আমাগো এক ছোট ভাই রিফাত । বাজারে এর পোলট্র্ ফীডের দোকান । উনার হেল্প না পাইলে আমি শেষ হইয়া যাইতাম । তুমি কতা কও উনার লগে । আমি রেডি অইয়া আহি ।
অনু চোখ বড় করে মারুফের দিকে তাকালো । কিন্তু, মারুফ তা পাত্তা দিলো না ।
— ভাবি, আপনার বাবার বাড়ি কোথায় ?
— জি, ঢাকাতে ।
— আপনার আব্বা কি করেন ?
— সরকারি চাকরি করেন । এছাড়া বিজনেস ও আছে । ভাই আপনি বসুন । আমার ছেলে ঘুম থেকে উঠে গেছে । এ কথা বলে অনু উঠে আসলো সোফা থেকে ।
রেখাকে দিয়ে চা নাস্তা পাঠিয়ে দিলো সে । হারামি লোকটা মনে হচ্ছিল চোখ দিয়ে অনুর আলট্রাসোনোগ্রাম করছে ! রাগে মারুফের মাথায় বাড়ি মারতে ইচ্ছে করছে অনুর ।
নাস্তা করে রিফাতকে সাথে নিয়ে বের হলো মারুফ । মনে মনে মারুফ খুশি একটু । অনুরে দেখার পর বেটা আর টেকার কথা তুলে নাই ।
— কি ভাই কী ভাবতাছ ? কইছিতো টেকা দিয়া দিমু । দুইটা মাস তুমি শুধু খাবারটা বন্ধ রাইখো না ।
— আরে ধুর মারুফ ভাই ! আপনি খালি মুরগী মুরগী করেন ক্যান ? আগে কন এমন সুন্দর পরী আপনি কই পাইলেন ? আপনার সাথে এরে কীভাবে বিয়া দিলো ? আমার তো মাথা নষ্ট হয়ে গেছে ভাবিরে দেখে ! মিয়া এমন মাল আপনার কাছে আছে জানিই না !
— সমস্যা নাই । তোমার যহনই দেখবার মন চাইবো, বাসায় চইলা আইবা । অনুরে কমুনে যেনো তোমারে একটু বেশি খাতির করে ।
— আরে না, আজ তো আর বাসায় যাওয়ার সময় নেই । আপনি এক কাজ করেন, ভাবিরে বিকেলে দোকানে নিয়া আসেন । আর ফার্মের মাল যা যা লাগে নিয়া যাইবেন । রিফাত বলল।
— ভাইয়ের দেহি পুরাই মাথা খারাপ অইয়া গেছে ।হা হা হা মারুফ হাসল জোড়ে জোড়ে ।
মারুফের মন এহন বালা একটু । শ্বশুড় টেকা পাঠাইছে । মুরগীর খাবারের ব্যবস্হা অইছে । এই টেকায় ফার্ম এক সপ্তাহ চালানো যাইব আশা করি । এখন দুপুরের কাজ দ্রুত শেষ কইরা বাসায় যাইতে অইবো । অনুরে নিয়া রিফাত ভাইয়ের দোকানে যাইতে অইবো । শালা এরেই কয় লক্ষী বউ ! বিপদে আমার কামে লাগতাছে ।
অনু নিহানকে ভাত খাওয়াচ্ছে পরম যত্ন করে । ছেলেটা এতটাই নম্র হয়েছে যে, অনু যদি বলে বসে থাকতে; তবে নিহান বসেই থাকবে । কোনো কিছুতেই তার না নেই । তার জীবনে তার আম্মি যা বলবে চাই ঠিক । অনুও ছোটবেলায় এমনই ছিল । এলাকার এমন কেউ নেই যে, নিহানকে পছন্দ না করে । মনে হয় অনুর জীবনে আল্লাহর বিশেষ এক উপহার হলো নিহান । অনুর শত কষ্টের একমাত্র শান্তনা তার ছেলে নিহান ।
— কি করে আমার আব্বুটা ? ভাত খায় ? খাও আব্বু, খাও । মারুফ বলল ।
— কি বিষয় মনে হচ্ছে খুব খুশি আপনি ? টাকা দিয়েছেন আব্বু ? অনু জিজ্ঞেস করল ।
— হ, টেকা তো দিছে । এই টেকায় কি আর সব অইবো ?
— সেটা আমাকে বলে লাভ নেই । আমি আব্বুকে আর টাকার কথা বলতে পারব না । আর আব্বু যে নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন , আপনি তো জানেন ই । শুনলাম এই ব্যবসার জন্য নাকি আব্বু জব ছেড়ে দিবেন ! অথচ আব্বুর রিটায়ারমেন্টের এখনো কত বছর বাকি !
— হ, সবই তো জানি । শোনো খাওয়া শেষ কইরা রেডি হও । সুন্দর একটা শাড়ি পরবা । সাজবা ভালো কইরা ।
— হঠাৎ ? কই যাব সেজেগুজে ? নিহান যাবে না ?
— না, নিহান থাকুক । বাজারের দিকে যামু ।বেশি দেরি করমু না ।
— আচ্ছা ঠিক আছে, চলেন তবে খেয়ে নেন । খাবার রেডি ।
অনু লাল-কালো একটা সিল্কের শাড়ি পড়ল । আর সাজ বলতে চোখে কাজল আর ঠোটে ম্যাট লিপস্টিক দিলো । মারুফ অনুর দিকে তাকিয়ে দেখল অনুকে অনেক সুন্দর লাগছে । লাল-কালো শাড়িতে অনুর শরীর দিয়ে যেনো আগুন ঝরছে !
একটা রিক্সা ডেকে মারুফ অনুকে নিয়ে বসলো । রিক্সার হুড না দেয়াতে সবাই অনুর দিকে তাকাচ্ছে বার বার । অনুর ভালো লাগছে না এভাবে বসতে । কিন্তু, সে জানে তাতে আসে যায় না মারুফের । সে হুড দিবে না ।
— আচ্ছা, আমরা কোথায় যাচ্ছি বললেন না ? অনু জিজ্ঞেস করল ।
— এমনি তোমারে নিয়া একটু ঘুরতাম বাইড়াইছি ।
— তাই !
— এই রিক্সা এই ডাইনে গিয়া খাড়াও ।মারুফ রিক্সার চালককে বলল ।
অনু তাকিয়ে দেখছে আশে পাশে শুধু পোলট্রি ফিডের দোকান । বাজারের মধ্যে না । বরং বাজারে যাওয়ার আগেই দোকান গুলো । এদিকে অনু কখনো আসেনি । কেমন নিরবিলি জায়গাটা !
— নিহানের আব্বু এখানে কেনো থামালেন ? অনু জিজ্ঞেস করল ।
— একটু কাম আছে, তুমি বহো । আমি আসতাছি এহনই ।
রিফাত দোকানেই ছিল । মারুফকে দেখে বত্রিশটা দাঁত বের করে হাসি দিলো । দোকান থেকে অনুকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । অনুর দিকে রিফাত তাকিয়েই আছে, চোখ আর সরায় না সে ।
— রিফাত, মাল কিন্তু কয়েক বস্তা লাগব আমার । তোমার ম্যানেজাররে কও পাডাইয়া দিতে । মারুফ বলল।
— হ্যাঁ, বলে দিতাছি । যা যা লাগে নিয়া যান । মারুফ ভাই আমনে যে আমার মাথা নষ্ট কইরা দিলেন এর উপায় কি ? বলেন ।
— উপায় তো সহজ । তুমি আমার ছোডো ভাই লাগো না ? তোমার শখ কি আমি পূরন করতাম না ? অবশ্যই করতাম । তয় একটু সময় লাগতো অনুরে ভাও করতে । তুমি চিন্তা কইরো না । একদিন সুযোগ কইরা কল দিমুনে । তুমি টুক কইরা আইয়া পড়বা বাড়িত ।
অনু খেয়াল করছে সেদিনের সেই লোকটা তার দিকে তাকিয়ে কি যেনো বলছে । আর মারুফ দাঁত কেলিয়ে অসভ্যের মতো হাসছে । রাগে অনুর মনে হচ্ছে একাই বাসায় চলে যাই ।
— চলো, এই রিক্সা ঘুরাও । যেইহান থাইকা আইছো সেইহানে নিয়া যাও । মারুফ বলল ।
— মানে কি ? বাসায় চলে যাব ? তবে কেনো আমাকে নিয়ে এলেন ? এখানে আমার কি কাজ ! শুধু শুধু ছেলেকে একা রেখে এসেছি রেখার কাছে । আর আপনি তখন আমার দিকে তাকিয়ে এভাবে কেনো হাসছিলেন ? অনু রাগ দেখিয়ে বলল ।
— এমনি হাসছি । রিফাত তোমার খুব প্রসংশা করছিল তাই ।
— ঐ বেটা তো একটা অসভ্য । বাসায় এসব লোককে আর কখনো আসতে দিবেন না ।
— বেশি কতা কইও না । টেকা পায় লাখ লাখ আমার কাছে । আইতো না, তো কি করব ?
অনু আর কোনো উত্তর দিলো না । বুঝতে পারছে এখন কথা বললে একগাদা কথা শুনতে হবে তার ।
মারুফের মোবাইল ফোন বেজে উঠল । কালকের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা না দিলে বাচ্চা ডেলিভারি দিবেনা । কারণ, মারুফ আগের টাকাই পুরোটা শোধ করে নি । মারুফ শুনে মুখ ভার করে চিন্তা করছে টাকা কই পাবে এখন ? হঠাৎ মনে হলো কারো কাছ থেকে লোন করবে সে ।
— অনু, এই অনু এদিকে আইয়ো । তুমি এক কাম করো সীমার বন্ধু আশিককে কও আমারে পঞ্চাশ হাজার টেকা ধার দিতে । আমি এহনই ওরে কইতাছি তোমার লগে দ্যাহা করতে ।
— এ্যাই, দাঁড়ান, দাঁড়ান । আশিকের কাছে টাকা ধার আমি চাইবো কেনো ? আর আমি চাইলেই কেনো আশিক আমাকে টাকা দিবে ? আমাকে টাকা দিলে, সে আপনাকে ও দিবে টাকা লোন। কাজেই আপনিই চান টাকা । আমি পারব না । অনু রাগ করে বলল ।
— কী ! টেকা চাইতে পারবি না মানে ? ঐ তুই টেকা না চাইলে তোর বাপরে ক আরও টেকা দিতে ?
— না , তা বলতে পারবো না । অনু চোখ মুঝতে মুঝতে বলল ।
— তোরে মন চাইতেছে লাথ্থি দিয়া দোতলা তন ফালাইয়া দেই । কুৎসিত মারুফের কঠিন কথা গুলো অনুর বুকে লাগল ।
আমি যাইতাছি বাজারে । আশিকরে কমু তুমি তারে ডাকছ । মনে জানি থাহে কতা ।
আশিক সাথে সাথেই চলে এসেছে । অনু তাকে ড্রয়িংরুমে বসতে দিলো । রেখাকে দিয়ে নাস্তা পাঠাল । পরে অনু ভালো করে ওড়না মাথায় দিয়ে অপজিটের সোফায় গিয়ে বসল । অনু কোনো রকম ভনিতা না করেই আশিককে বলা শুরু করল ।
— আশিক, তোমার ভাই পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার চেয়েছে । খুব দরকার তার । কথা বলতে গিয়ে অনুর দু’চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে ।
— মারুফ ভাইয়ের টেকা লাগব, সে নিজে বললেই তো অইতো । আমনে কেনো বলতেছেন ? আর আমনে কানতাছেন ক্যান ভাবি ?
— আমি বলতে চাইনি তোমাকে । কিন্তু, নিহানের আব্বু বলল : আমি বললে নাকি টাকা তুমি অবশ্যই দিবে । তাই আমাকে দিয়ে বলাচ্ছে । আচ্ছা আশিক, আমার কথায় টাকা কেনো দিবা তুমি ? আমার জীবনে যে এমন দিন আসবে;আমি চিন্তা ও করতে পারি নি !
— হ ভাবি, আমনে বলছেন তাই টাকা আমি দিমু । কারণ, আমি আপনাকে অনেক পছন্দ করি । অনেক ভক্তি করি । এমন একটা বাড়িতে যে আপনে টিকে আছেন তার জন্য সত্যি অবাক লাগে । আপনে চিন্তা কইরেন না ভাবি, কাইল সকালেই আমি টেকা দিয়া যামু ।
আশিক তার কথা মতো সকালে অনুর হাতে টাকা দিয়ে গেল । সাতদিন পর কথা মতো টাকা ফেরত নিতে আসবে বলে গেল । টাকা পেয়ে মারুফের চেহারার রং স্বাভাবিক হয় । কিন্তু, অনুর মনের ভিতরে দিন দিন ঘৃনা বাড়তেই থাকে ।
বাসায় হৈচৈ এ কান পাতা দায় । সীমা, লীমা এসেছে । নিহান আর সীমার ছেলে সামির সারা দিন বাড়ি মাতিয়ে রাখছে । অনুর ও এখন একটু ভালো লাগছে । ওরা কয় দিন থাকবে এখানে ।
যে বোনের কারণে মারুফ অনুর গায়ে হাত তুলেছিল, আজ সেই বোনকে দেখেই সে মহা বিরক্ত ! ওগো পাইয়া অনুর বালা লাগলে কি অইব ? আমার তো আর বালা লাগতাছে না । ওরা থাকলে তো আর রেখার কাছে যাওন যাইতো না । মারুফের মনে শুধু নোংরা আহাজারি !
দিন যেনো খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেছে । আজ ছয় দিন । আশিক কাল রাতে টাকা নিতে আসবে । অনুর মাথায় শুধু একটাই চিন্তা এখন । এ কয়দিন সীমারা বাসায় ছিল, তাই তেমন একটা মনে পড়েনি টাকার কথা । কাল বিকেলে ওরা সবাই চলে গেছে । এখন অনুর মাথায় টাকার কথা ছাড়া অন্য কথা নেই ।
— নিহানের আব্বু, কাল কিন্তু আশিক আসবে টাকা নিতে, আপনার মনে আছে তো ? টাকা রেডি আছে তো ?
— হ, মনে আছে । প্যান, প্যান কইর না । ঘুমাইতে দেও এহন ।
অনু আলহামদুলিল্লাহ পড়ল । যাক, আর চিন্তা নেই । সময় মতো টাকা না দিতে পারলে কতটা লজ্জা পেতো সে ।
আশিক সেই রাত আটটা থেকে এসে বসে আছে । কিন্তু মারুফের কোনো খবর নেই । অনুর মন চাচ্ছে চিৎকার করে কাঁদতে । আশিককে বলতেও পারছে না চলে যেতে । কী করবে সে ? খাবার আর টিভি ছেড়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমে তাকে বসিয়ে রেখেছে ।
রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে । মারুফ এসেছে । গেটে ঢুকে দেখে আশিক সোফায় বসা । মারুফের শব্দ পেয়েই অনু তার ঘর থেকে বের হলো । আশিক ও উঠে দাঁড়াল ।
— ও আশিক তুমি আইছ ? বহো তুমি । আমার শরীলডা অনেক খারাপ । মাতা সুজা রাখতে পারতেছিনা । তুমি এক কাম করো তোমার ভাবির লগে গল্প করো । আমি শুইয়া পড়লাম ।এ কথা বলেই মারুফ রুমে চলে গেল।
— এ্যাই অনু হুইনা যাও ।
— কী হয়েছে বলেন । ভাত খাবেন না ?
— না, খাইয়া আইছি । আমি ঘুমামু এহন ।
— ঘুমাবেন ভালো কথা । আশিকের টাকাটা দিয়ে ওরে বিদায় করেন । অনু বলল ।
— টেকা দিমু মানে ? টেকা আমি কই পামু ? আমি টেকা আর ফেরত দিতাম পারতাম না । তুমি আশিকরে কোণার ঘরে লইয়া যাও । ওরে এমন কইরা ম্যানেজ করবা যাতে টেকা শোধ অইয়া যায় । আর জানি কখনো টেকা ফেরত চাইতে না আহে ।
— কী ! এটা কি বললেন আপনি !
চলবে……
✍?নায়না দিনা