অনুর উপাখ্যান পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব | অসমাপ্ত গল্প

0
5368

অনুর উপাখ্যান
পর্ব : শেষ পর্ব

অনু কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে নরমাল করার চেষ্টা করল । পরে ড্রয়িংরুমে গিয়ে আশিককে বলল :

— আশিক, আমি স্যরি ভাই । এই লোকটা আজ টাকা ম্যানেজ করতে পারে নি । তুমি তাকে আর কয়টা দিন সময় দাও প্লিজ ।

— জি ভাবি বুঝতে পারছি । সে টাকা না দিয়া কই যাইব ? আমনে চিন্তা করবেন না ভাবি । আমনে তো আর কোনো দোষ করেন নাই । মারুফ ভাইয়ের কাছ থাইকা টাকা আমি ফেরত নিয়া ছারমু । আমি তাইলে এখন যাই ভাবি ।

— আচ্ছা যাও । ওহ, আশিক একটা কথা ছিল । আমাদের এ বাড়ির নিচতলায় যে মহিলা থাকতো, যার সাথে মারুফের রিলেশন ছিল; তার নাম কি তুমি জানো ? আর দেখতে কেমন ছিল সে ? অনু জিজ্ঞেস করল ।

— আমনে জানেন সেই মহিলার কথা ! আমরা মনে করছি আপনি কিছুই জানেন না । ঐ মহিলা সুন্দর না । কালা, চেহারা মোটামুটি । তবে স্বাস্হ্য ভালো ছিল; মানে নাদুস নুদুস ছিল । নাম বেলি ।

— এখন ঐ মহিলা কই থাকে জানো ?

— শুনছি উত্তরায় থাকে । তবে আমি শিউর না ভাবি । বন্ধুরা বলাবলি করে, তাই জানি ।

— ঠিক আছে তুমি যাও । আল্লাহ হাফেজ ।

এতটা কুৎসিত একটা লোকের সাথে এতদিন এক বিছানায় ছিলাম ! এটা ভাবতেই অনুর বমি আসছে । বড় ভাবি যেমনই হোক, সেদিন তো সব সত্যি কথাই বলেছিলেন । আর ম্যানেজার নুরুল ? সে সেদিন কী বুঝাতে চেয়েছিল ? আর আমি কী বুঝেছি ! ছি : নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই ঘৃনা হচ্ছে অনুর । মানুষ মানুষকে এতটা বিশ্বাস করে ? কি ধারনা ছিল আমার ? আমি এত সুন্দর একটা মেয়ে, আমার মতো বউ রেখে মারুফ অন্য নারীর কাছে কখনোই যাবে না । এই তো ? হ্যাঁ, এটাই তো আমার সরলতা । আমি তো আমার চারপাশটা আমার মতো করেই দেখেছি । এটাই আমার চরম ভুল ছিল । অনু বার বার এক কথাই বলছে । সে ভুলের জন্য আজ তাকে এত বড় জঘন্য কথা শুনতে হয়েছে । এই লোক হচ্ছে নরকের কীট । একে ক্ষমা করলে আল্লাহ ও আমাকে ক্ষমা করবেন না । না, অনেক কেঁদেছি ; আর কাঁদব না । এবার এই কুকুরটাকে কাঁদাব । অনু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল।

ঘরে ঢুকে দেখে মারুফ ঘুমায়নি এখনো । পাশে নিহান ঘুমিয়ে আছে । অনুকে দেখে জিজ্ঞেস করল :

— আশিক গেছে ? কী কইছ তারে ? আর টেকা চাইব নাতো ? আমি কিন্তু টেকা আর দিতাম না । তুমি ভালো কইরা ম্যানেজ করছ তো ?

— কুত্তার বাচ্চা ! তুই কী বললি আমাকে ? আমি টাকা শোধ করব ? দাঁড়া তুই, দেখ কীভাবে শোধ করি আমি । অনু রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলছে ।

— অনু ! তোমার কিন্তু বেশি সাহস বাইড়া গেছে । মাইর খাইতে মন চাইছে ?

— হারামজাদা, বদমাশ তুই মারবি আমাকে ? দেখ; কে কাকে মারে । একথা বলে অনু দৌড়ে রান্না ঘরে গেল, তাকের নিচ থেকে বড় বটি টা নিয়ে ঘরে আসল ।

— কি অইছে তোমার ? বটি আনছো ক্যা ? মারুফ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল ।

— আজ তোরে আমি জবাই করব । তুই ঘর থেকে বের হ, তাড়াতাড়ি বের হ বলছি । তুই কি চাস তোর ছেলের সামনে তোরে আমি জবাই করি ?

অনুর কন্ঠ শুনেই মারুফ থ ! অনুর এমন ভয়ংকর চেহারা আগে কখনো দেখেনি সে । ভয়ে সে ঢোক গিললো ।

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

— দ্যাহো, ভালো অইবো না কইতাছি । বটি রাখো । আমি বাইর অইতাছি । তুমি মাইরো না আমারে । বটি রাখো প্লিজ ।

— বটি রাখব ? তোর শাস্তি তোরে দিব না ? তুই বিয়ের পর ও বেলির কাছে গেছিস না ? সত্য বলবি, নইলে তোর মাথা এক কোপ দিয়ে দুই ভাগ করব । তুই ফার্মে রোজির সাথে শুইছিস না ? সব সত্য বলবি । আমি সব জানি । মিথ্যা বললেই তুই মরবি । অনু রাগে এখনো কাঁপছে ।

— হ, তুমি যা কইছ সবই সত্য । আমি আর এমন করতামনা । এইবার আমারে যাইতে দাও । মারুফ করুণ কন্ঠে বলল।

— কই যাবি তুই ? তুই তো রেখার সাথেও যিনা করেছিস । করেছিস না ? তুই ভাবছিস আমি টের পাবো না ? বল, রেখার সাথে তুই কিছু করিস নি ?

— হ, করছি । ভুল কইরা ফেলছি । আর করতামনা । বউ আমারে মাফ কইরা দাও ।

— খবরদার ! জারজ কোথাকার ! তোর মুখে আমাকে বউ ডাকবি না । তোর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই । তুই একটা নরপিশাচ ।
তুই আমাকে টাকার জন্য মানুষের কাছে দিয়ে দিস ! তোরে খুন করলে আল্লাহ খুশি হবেন ।

মারুফের করুণ কন্ঠ শুনে রেখা আর ঘরে থাকতে পারল না । বের হয়ে দেখে অনু বটি হাতে দাড়িয়ে আছে ।

— ও আল্লাহ গো ! আপা কি করেন আপনে ? দুলাভাইরে ক্যান মারতাছেন ? রেখা অনুর হাত ধরে টানতে টানতে দরজার কাছ থেকে সরিয়ে আনলো।

এই সুযোগে মারুফ ঘর থেকে বের হয়ে গেল । অনু রেখার হাত সরানোর চেষ্টা করছে । কিন্তু, রেখা হাত ছাড়ছে না ।মারুফ দ্রুত গেটের তালা খুলে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে চলে গেল ।

— এই হারামি, অসভ্য মহিলা । তুই আমার হাত ধরলি কেনো ? এবার তোরে খুন করব ।

— ক্যান আপা আমি কি করছি ? রেখা ন্যাকা ন্যাকা গলায় বলল।

— তুই কি মনে করেছিস আমি কিছু বুঝি না ? বাড়ির বউ হলাম আমি, আর সকালে গোসল করিস তুই ? থু ! অনু রেখার দিকে থুথু ছিটিয়ে বলল। তোরে বোনের মতো মায়া করেছিলাম আমি । আর তুই ? এই বেঈমানির শাস্তি তুই এই দুনিয়াতেই পাবি । তোর জামাইয়ের কাছে সবকিছু বলে দিব । তারপর দেখব তুই কীভাবে সংসার করিস ।

— আপাগো, মাফ চাই । আপনে আমারে মাফ কইরা দেন । অনুর পা ধরে রেখা কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল ।আমার কোনো দুষ নাই । দুলাভাই আমারে আসার দিন গাড়িতেই অনেক কিছু কইরা কিছু রাখে নাই । কইছে অনেক বেশি টাকা দিব । আমার তো টাকা দরকার, তাই রাজি হইছি । আর আমি রাজি না হইলে কি হইতো ? সে আরো অনেক মেয়ের সাথেই থাকে । সে যে কেমন খারাপ মানুষ আপনে জানেন না আপা ।

নিজের পা রেখার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে
অনু নিজ হাতে গেটে তালা লাগিয়ে দিলো । রেখা তো মিথ্যে বলেনি কিছু । রেখা সুযোগ না দিলে অন্য কাউকে যোগাড় করে নিতো ।মারুফের মতো কুকুরের জন্য এটা কোনো বিষয় না । না, মারুফ তো কুকুর না ? অনু ভাবতে থাকে কোন প্রানি যেনো নিজের স্ত্রীকে অনের সাথে যিনা করায় ? ও হ্যাঁ, শূকর । মারুফ হচ্ছে সাক্ষাত একটা শূকর । সে সব করতে পারে ।

— রেখা, সকালে উঠে তোমার কাপড় গুছিয়ে রেডি থাকবা । কালই এ বাড়ি থেকে বিদায় করব তোমাকে, মনে থাকে যেনো ।অনু বলল ।

অনু, হাতের বটি টা রান্না ঘরে জায়গা মতো রেখে নিজের ঘরে ফিরে আসল । ঘুমন্ত নিহানের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে । শুধু মাত্র এই সন্তানকে দুনিয়াতে আনার জন্য, তাকে একটা সুন্দর পরিবেশ দেয়ার জন্য ; সে কত চেষ্টাই না করল ! কিন্তু, কোনো লাভ হলো না ! তার সব চেষ্টা বৃথা গেল । হায়রে কান্না ! সেই যে বিয়ের দিন থেকে শুরু হয়েছে, আজও চলছে । এ কান্না যে আর ফুরোবে না তা আর অজানা নয় । না, আজ আর অনু চোখ মুছবে না । কাঁদুক চোখ দুটো আজ ; যত খুশি কাঁদুক । ছেলেকে জড়িয়ে ধরে এক সময় অনু ঘুমিয়ে পড়ল ।

নিহানের ডাকে অনুর ঘুম ভাঙল । তার খিদে পেয়েছে । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল আটটা বেজে গেছে । ঘরের দরজা খুলতেই অনুর গেটের দিকে চোখ গেল । না, তালা দেয়াই আছে গেটে । তার মানে মারুফ রাতে আর ফিরেনি । অনু ফ্রেশ হয়ে নিহানকে খাইয়ে দিয়ে নিজে ও খেয়ে নিল । আজ তার অনেক কাজ । রেখাকে বিদায় করতে হবে আজ । এখন মঈন থাকলে কত যে ভালো হতো । রেখাকে বাসে তুলে দিতে পারত। সমস্যা নেই কোনো, টিপু তো আছে ।

— রেখা, এ্যাই রেখা । এদিকে আসো । অনু ডাকল

— জি আপা । ডাকছেন আমারে ?

— হুম। নাস্তা করছ ?

— না, করি নাই । নাস্তা করমু না আপা ।

— কেনো করবা না ? বেশি ঢং বেড়েছে তোমার ? নাকি তোমার শাস্তি তোমাকে না দিয়ে ভুল করেছি । শোনো, শুকরিয়া আদায় করো যে, তোমাকে আমি এমনি ছেড়ে দিলাম । আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে; খুন্তি গরম করে তোমার ঐখানে ছ্যাঁকা দিয়ে দিতো । যাও আমার সামনে থেকে । নাস্তা করবা এখনই । করে রেডি হও । দেরি যেনো না হয় ।

— জি, আইচ্ছা করতাছি ।

রেখাকে বিদায় করতে হবে । কিন্তু, হারামি মারুফ না আসলে ওর বেতনের টাকা তো দিতে পারবে না । অনু চিন্তায় পড়ে গেল । বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনু টিপুকে ডাকল ।

— চাচি ডাকছেন ? কি অইছে ?

— তোমার চাচা কই জানো ? দেখো তো খুঁজে পেলে এখনই আসতে বলবে ।

— চাচা তো আমাদের ঘরে । নাস্তা খায় ।

— খাওয়া হলে এখনই আসতে বলো । আর তুমি এক ঘন্টা পর উপরে আসবা রেডি হয়ে । একটু বাজারের দিকে যেতে হবে তোমাকে । অনু বলল ।

— ঠিক আছে, আমুনে ।

বিড়ালের মতো করে মারুফ ঘরে ঢুকল । অনু তার মুখের দিকে তাকিয়ে ও দেখলো না । সে নিহানের কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছে ।মারুফ বের হওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে বুঝতে পেরে অনু বলল :

— রেখার দুই মাসের টাকা যা হয়েছে সেটা দিয়ে তবে বাহিরে যা ।

— ক্যা ? টাকা দিয়া রেখা কি করতো ? মারুফ জিজ্ঞেস করল ভয়ে ভয়ে ।

— তোর জানার কি কোনো দরকার আছে ? তোরে টাকা দিতে বলছি, তুই টাকা দিয়ে যেখানে যাওয়ার যা ।

— তুই কইরা কইতাছ ক্যান ? ছেলে শুনতাছে না ?

— তাই ! অন্য মেয়ের সাথে শোয়ার সময় মনে হয়নি ছেলের কথা ? ধরা পড়লে যে তুই বউ, ছেলে সব হারাবি;সেই চিন্তা হয় নি ? কুকুর কোথাকার ! আমার সামনে থেকে যা তুই । নইলে এরপর কথা বলব বটি দিয়ে । অনুর চোখ দিয়ে যেনো বিষ ঝরছে !

মারুফ উপায় না দেখে বিছানার উপর টাকা রেখে চলে গেল । টাকা নিয়ে অনু বারান্দায় গিয়ে টিপুকে আসতে বলল । রেখা রেডি হয়ে বারান্দায় বসে আছে । অনুকে দেখেই কান্না শুরু করল ।

— আপা, আমারে মাফ কইরা দেন আপা । আমি আপনার সাথে বেঈমানি করছি ।

— না, আমার কাছে মাফ বলে কিছু নেই । আমি সারাজীবন শুধু মানুষকে মাফ করেই এসেছি । এই পরিবার আমার সাথে কত অন্যায় করেছে ! আমি শুধু মাফ করেই এসেছি । বিনিময়ে কি পেলাম ? বেঈমানি, তাই আর মাফ না ।

— শোনো রেখা, তোমার জামাইকে কিছু বলব না আমি । কাজেই চিন্তা করো না । কিন্তু, তোমাকে মাফ ও করলাম না আমি । তোমার পাপের শাস্তি তোমাকে আল্লাহ দিবেন । এই দুনিয়াতে এবং আখেরাতে দুই জায়গায় ই তুমি পাবে ।

টিপুকে আসতে দেখে অনু কথা থামিয়ে টিপুর দিকে তাকিয়ে বলল:

— টিপু, রেখাকে নিয়ে তুমি বাস স্ট্যান্ড এ যাবে । গিয়ে ওরে ঢাকার গেটলক বাসে বসিয়ে ভাড়া দিবে । আর হেলপারকে বলে আসবে ঠিকমত যেনো ওরে নামিয়ে দেয় । এই নাও ভাড়ার টাকা । বাকিটা তুমি নিও ।

— জি চাচি, চিন্তা কইরেন না । ঠিকমতো বসায় দিয়া আসমু । টিপু বলল ।

অনু রেখাকে ওর টাকা বুঝিয়ে দিয়ে টিপুর সাথে যেতে বলল । রেখা সুযোগ খুঁজছে অনুকে একটু ইমোশনাল ভাবে কাবু করার । কিন্তু, অনুর চেহারার কঠিনত্ব দেখে আর সাহস পায়নি । বাধ্য হয়ে সে চলে গেল ।

এবার অনু নিজের কাজে মনোযোগ দিলো । প্রথমেই আসল কাজটা করতে হবে । হ্যাঁ, আব্বুকে কল দিতে হবে । ফোনের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে । এই একটা ফোন কল তার জীবনের সব কিছু পাল্টে দিবে !

— আসসালামু আলাইকুম আব্বু ।কেমন আছেন ? আব্বু কাল আপনি গাড়ি নিয়ে আসবেন, আমি বাসায় যাব ।

— ওয়াআলাইকুমুস সালাম । তা আসব সমস্যা নেই । কিন্তু, কিছু হয়নি তো মা ? তুমি ভালো আছো তো ?

— আব্বু, আমি একবারে চলে আসব । আপনি আমাকে নিতে আসবেন না ? আমি একাই যেতে পারতাম নিহানকে নিয়ে । কিন্তু, এভাবে গেলে মানুষ বদনাম রটাবে । আপনি নিয়ে যান আমাকে । যদি ঐ বাসায় থাকতে নাও দেন; থাকব না আমি । শুধু এখান থেকে আমাকে বের করে নিয়ে যান, প্লিজ আব্বু ।

— কী বলো এসব ! নিয়ে যাব না কেনো ? আর বাসায় থাকতে দিব না মানে ? তুমি চিন্তা করবা না মা । আমি কাল সকালেই আসছি তোমাকে নিতে ।

— আব্বু, বাসায় কাউকে কিছু আগেই বলবেন না । আমি আসি আগে, পরে সব বলব ।

— ঠিক আছে মা । চিন্তা করো না । নিজের খেয়াল রেখো ।

আসল কাজটি শেষ হলো । এবার লাগেজ গোছাতে হবে । অনু নিহানের সব কাপড়, খেলনা সব নিলো । নিজের কাপড় গোছাতে গিয়ে অনু দেখল : তার বাহিরে পড়ার শাড়ি বলতে হাতে গোনা কয়টা শাড়ি মাত্র ! বিয়ের শাড়িটা ছুড়ে ফেলে দিলো সে । বাকি পড়ার কাপড় গুলো সব নিলো । তার সাজের তেমন কিছুই নেই । শুধু একটা জিনিস আছে তার সম্পদ,তার আত্মা : বই । তার নিজের বই গুলো সব নিয়ে নিলো সে । সব গোছানো শেষ । এখন শুধু আজ রাতটা পার করতে হবে ।

মারুফ বাসায় এসে দেখল অনুর লাগেজ গোছানো । অনু যে রাগ করে চলে যাচ্ছে তা বুঝতে পারছে । মারুফ মনে মনে হাসছে আর বলছে : কই যাইবা তুমি ? যাও, কয়দিন থাহো দেহুমনে । ফিরা তো আবার এই বাড়িতই আইবা । তুমি যতই সুন্দরি হও না ক্যান , বিয়া অইয়া গেছে, পোলা আছে একটা । কে তোমারে আবার বিয়া করব ? হেই আমার লারোই আইতে অইবো । “মুরগী তুমি যাইবা কই ? ঘুইরা ফিইরা খোলাতোই ।” আমার লগে দেমাগ দ্যাহায় আবার !

নিহানের দুনিয়া হচ্ছে তার আম্মি । মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিহান কি বুঝল ? এক মিনিটের জন্য মায়ের কাছ থেকে সে সরে না । মারুফ কত চেষ্টা করল নিহানকে কাছে নেয়ার, নিহান যাচ্ছে না কাছে । অনু ছেলেকে রাতে খাইয়ে, নিজে খেয়ে ঘরের দরজা আটকে শুয়ে পড়ল । ছেলেকে প্রতিদিনের মতো দোয়া পড়ে ফুঁক দিলো । আদর করে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়ালো । ছেলের পাশে অনু কতক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে রইল ।

মাঝরাতে উঠে অনু তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করল । দুই হাত তুলে অনু আল্লাহর কাছে চাইল : হে আল্লাহ আপনি আমাকে পবিত্র থাকতে সাহায্য করুন । আমি এই নোংরা জীবন থেকে মুক্তি চাই । আমাকে আপনি একটা পাপ মুক্ত জীবন দান করুন । আমার সন্তানকে নিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্হা করে দিন আপনি । হে আল্লাহ ! আর কেউ না জানুক; আপনি তো জানেন আমি অনেক চেষ্টা করেছি সংসার টিকিয়ে রাখার । অনেক সহ্য করেছি । কিন্তু, আর সম্ভব না । আপনি আমাকে সাহায্য করুন, আমীন ।

আর কয়েক ঘন্টা পর সব কিছু বদলে যাবে । অনুর নিজের সংসার বলে আর কিছু থাকবে না । আচ্ছা সংসার কাকে বলে ? খাট-পালং, থালা-বাসন এসব এর সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখা ? অনুর তো এখানে জীবনটা শুধু এগুলো নিয়েই কেটে গেল ! তবে মায়া কার জন্য হচ্ছে তার ? থালা-বাসনের জন্য ? স্বামী নামক পিশাচটা তো কখনোই তার ছিল না । এ বাড়ির কোনো কিছুই কখনো তার ছিল না ।

অনু এখন আর কাঁদতে চায় না । সামনে তার কাঁদার দিন অনেক পড়ে আছে । তার মনের মধ্যে তীব্র ঘৃনা ছাড়া কিছু নেই । পুরো পুরুষ জাতের উপর তার ঘৃনা কাজ করছে এখন । মারুফ নামের এই প্রানিটা অনুর জীবনের সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছে । যে অনুর মায়াবি মুখটার দিকে তাকিয়ে এক জীবন অনায়াসে পাড় করা যায়, সেই অনুকেই সে এত তাচ্ছিল্য করেছে ! যার সুন্দর মেয়ে পছন্দ না ;তবে কেনো বেছে বেছে সুন্দর কাউকেই বিয়ে করতে হবে ? মারুফের রুচি অবিকল “গর্ভধারিণী” উপন্যাসের সেই সুদীপের বাবার মতো কুৎসিত রুচি ! বইটা পড়ার সময় অনু অবাক হয়ে ভেবেছে, এ কেমন রুচি মানুষের ? কোনোদিন অনু চিন্তা ও করে নি যে, তার ভাগ্যেই এমন লোক জুটবে ! এমন সাইকোপ্যাথরা যে কেনো বিয়ে করে ? কেনো আমি মারুফকে মানসিক রোগী বলে এই রোগটাকে অপমান করছি ? অনু নিজের উপর বিরক্ত হয় । এটা কোনো মানসিক সমস্যা না । এটা হচ্ছে তার জন্মগত স্বভাব । যে ছেলে কাজের মেয়েদের সাথে যিনা করে করে বড় হয়েছে, সে ভালো মেয়ে কীভাবে হজম করবে ? কুকুরের পেটে কি ঘি হজম হয় ? না, হয় না । তাই মারুফের ও হজম হয় নি ।

আচ্ছা, একটা মানুষের সুখ কত লাগে ? কী পরিমাণ শরীরের সুখ পেলে সে খান্ত হবে ? ঘরের বউকে যারা ঠকায়, তারা কী যুক্তিতে এমন করে ? বাহিরে যে নারীর কাছে সে যায় ;তার শরীর কি প্লাটিনাম দিয়ে তৈরি ? সেই নারীর শরীরে এমন কী আছে, যা তার স্ত্রীর মধ্যে নেই ? অনুর এই প্রশ্নের উত্তর কি কেউ দিতে পারবে ? অনুর খুব জানতে ইচ্ছে করছে ঐ বেলি, রোজি, রেখা ওদের শরীর দিয়ে কি তবে মেশকে আম্বরের সুগন্ধি ছড়ায় ? ধ্যাত ! ভুল হয়েছে তার, রেখাকে জিজ্ঞেস করলেই পারতো ! কী মনে হচ্ছে ? অনুর মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? আরেহ না, অনু ঠিকই আছে । বরং এতদিন অনু ভুলের মধ্যে ছিল । এখন সে সম্পূর্ণ সজাগ । বেশি না আর একটা প্রশ্ন অনুর জানার ইচ্ছে : যে সব স্বামীরা, নিজ স্ত্রীতে সন্তুষ্ট না থেকে সুখের লোভে যেভাবে অন্য নারীর কাছে যায়, ঠিক একই ভাবে যদি তাদের স্ত্রীরাও অন্য পুরুষের কাছে যায় ; তবে কী হবে ? উপযুক্ত বিচার হবে । বিষয়টা বুমেরাং ছুড়ে মারার মতো হবে ।

আমি কি নারীবাদী হয়ে যাচ্ছি ? অনু জোড়ে জোড়ে মাথা নাড়ছে আর না বলছে : আমি কোনো নারীবাদী না । অনুরা কখনো নারীবাদী হয় না । অনু নারীবাদী হলে তো আর অনুকে এভাবে আজ ঠকতে হতো না । অনু আল্লাহকে ভালোবাসে । আর তাই আল্লাহর উপর ভরসা করেই তার সকল পদক্ষেপ নেয়া । অনুর আর অন্য কাউকে প্রয়োজন নেই । কারণ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন : “যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করবে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হবেন।” (সূরা ত্বলাক:৩) কাজেই অনুর সকল কান্না শুধু আল্লাহর দরবারে ।

সকালে উঠে অনু নিহানকে নাস্তা করিয়ে রেডি করল । সে নিজেও রেডি হয়ে আছে । জামিল সাহেব দেরি করেন নি আসতে । মেয়ের জন্য তিনি অস্হির হয়ে আছেন । বেশ তাড়াতাড়িই চলে এসেছেন । আব্বুকে দেখে অনু একটু হাসার চেষ্টা করল ।

— কি অবস্হা মা ? তোমরা রেডি আছো ? জামিল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন ।

— জি আব্বু, আমরা রেডি আছি । তবে আপনি একটা কাজী অফিসে গিয়ে তালাক নামা সহ কাজী নিয়ে আসেন । আমি একবারে তালাক নামায় সই করেই যাব ।অনু বলল।

— ঠিক আছে মা, আমি নিয়ে আসছি ।

মারুফ সবই শুনল । অনুর দিকে তাকিয়ে বলল:

— যাইতাছো যাও । তালাক দিয়া যাওন লাগতো না । ফিরাতো আবার আমার কাছে আইবা ।

— এটা তোর ভুল ধারনা । অনু বলল ।

— আইচ্ছা, আব্বু চলেন কাজী আমি আনতাছি । কিন্তু, আমনে সাক্ষী থাকেন : আমি অনুরে আবার বিয়া করমু একশ এক টেকা দেনমোহর দিয়া । যদি তা না করছি আমনে আমার নাম পাল্টায়ে রাইখেন । মারুফ বলল ।

— আব্বু, আপনি যান তো । এই লোকের কথা শুনবেন না । সে স্বপ্ন দেখছে; দেখতে দেন । অনু বিরক্তি নিয়ে বলল।

কাজীর সামনে তালাক নামায় অনু বিনা দ্বিধায় সই করে দিলো । তিন মাস তেরো দিন পর তালাক পুরোপুরি কার্যকর হয়ে যাবে । অনুর মুখে কোনো ভাবান্তর নেই ! তার মনের মধ্যে উথাল ঝড় কেউ টের পাচ্ছে না । জামিল সাহেব মেয়ের মুখের দিকে বার বার তাকাচ্ছেন । অনুর চোখে পানি নেই । মারুফ কুকুরটা তার চোখের পানি দেখুক সেটা অনু কোনো ভাবেই চায় না ।

মারুফ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে । সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছেনা অনুর মতো এত নরম মনের মেয়ে এতটা কঠিন হতে পারে ! তবে মারুফ এটা নিশ্চিত অনু তিন মাসের আগেই চলে আসবে ।

গাড়ি চলছে ঢাকার উদ্দেশ্যে । অনুর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে । নিহান তাকিয়ে আছে মায়ের মুখের দিকে । এবার আর অনু নিজেকে সংযত করতে পারলো না । জোড়ে কেঁদে উঠল । মেয়ের কান্না দেখে কোন বাবা ঠিক থাকতে পারে ? অনুর সাথে অনুর আব্বু ও কাঁদছেন । অনু অনেকক্ষণ প্রান ভরে কাঁদল ।

মনের মধ্যে অনুর এক অজানা ভয় কাজ করছে । বিয়ের আগের সেই অনু, আর আজকের অনুর মধ্যে কত পার্থক্য ! সমাজ তাকে কী বলবে ? স্বামীর ভাত খেতে পারেনি, ডিভোর্স হয়েছে যে মেয়ের; সে কি ভালো মেয়ে নাকি ? আরও কত কি যে শুনতে হবে তাকে ! আর অনুর বাবার বাড়িতে ? তাদের বাড়ির পরিবেশ ও অনেক পাল্টে গেছে এখন । ভাইয়া বিয়ে করেছেন । ভাইয়ার একটা ছেলে হয়েছে । ভাবি ? ভাবি কি আমাকে সহজে মেনে নিবেন ? অনুর এখানেই যত টেনশন কাজ করছে । যদিও এখনও পুরো সংসারটা আব্বুর আয়ের উপরেই চলে । তবুও সংসারটা তো এখন আম্মুর পরেই ভাবিরই।

আজ অনু যেনো এক চরম সত্য উপলব্ধি করতে পারল । অনুর নিজের বাড়ি তবে কোথায় ? অনুর কি নিজের বাড়ি আদৌ ছিল কখনও ? যেখানে এতদিন সে ছিল, সেটা স্বামীর বাড়ি । যেখানে এখন ফিরে যাচ্ছে; সেটা বাবার বাড়ি । তবে অনুর বাড়ি কই ? ক্লান্ত অনু চোখ বন্ধ করে চিন্তার সাগরে ডুব দিলো । হঠাৎ অনু চোখের সামনে একটা ছোট্ট বাড়ি দেখতে পেল । মাটির সুন্দর একটা বাড়ি ! যে বাড়িটা শুধুই অনুর । যেখান থেকে অনুকে কেউ তাড়াতে পারবে না । যে বাড়িতে কেউ ভাগ বসাতে ও পারবে না । হ্যাঁ, সেই সাড়ে তিন হাত “কবর” হচ্ছে অনুর একান্তই নিজের বাড়ি । অনুর মনে তাই এখন একটাই আশা, এই বাড়িতে যেনো অনন্তকাল সে সুখে কাটাতে পারে । আর একমাত্র আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানই অনুকে সেই সুখের ঠিকানা দিতে পারবে । নিমিষেই অনুর সব কষ্ট দূর হয়ে গেল । অনু এখন সুখি একজন মানুষ । সবাই এই সুখের সন্ধান পায় না; কিন্তু, অনু পেয়েছে । সেই সুখের বসতের আশায় অনুর সাথে অনুর চোখ দুটো ও যেনো এখন পরম আনন্দে হাসছে !

~ সমাপ্ত ~

✍? নায়না দিনা