অনুর উপাখ্যান পর্ব : ৮

0
1903

গল্প : অনুর উপাখ্যান
পর্ব : ৮

— বড় আপু, এসব চিন্তা তো আমি আগেই করেছি, আর তাই এতদিন আপনাদের কিছু জানাইনি ।কিন্তু, ওরা যখন আমার সন্তান নিয়ে বাজে কথা বলেছে, তখন আর সহ্য করতে পারিনি ।জানেন, এই মারুফের কারণে আজকে এতক্ষনে আমাকে আপনারা দাফন করতেন ।

— ও আল্লাহ্ কী বলো মা এগুলো ! কী হইছিল তোমার ?

— আমি ফাঁসি দিতে গিয়েছিলাম মা । পরে আল্লাহর রহমতে আর দেই নি । তুমিই বলো আম্মু আমি মরার পরে যদি মারুফের ভুল ভাঙ্গতো, তো কি লাভ হতো ?

— তাই তো । আমি তোমারে আর ঐ বদমাশের কাছে যেতে দিব না ।

— আম্মু, প্লিজ কাঁদবা না তুমি । আহা আমি তো বেঁচে আছি । কেনো কাঁদছো এভাবে ? শোনো, এ কথা কিন্তু আব্বুকে ভুলেও বলবা না । আব্বু জানলে সর্বনাশ হয়ে যাবে ।

— তুই এ কাজ কীভাবে করতে চেয়েছিস অনু ! তোর সাথে আর একটা জীবনও যে শেষ হতো জানিস না ?

— জানি আপু, এ জন্যই আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন । যত কষ্টই হোক না কেনো, আর জীবনেও এমন কাজ করব না । আল্লাহ আমাকে মাফ করুন ।

— অনু দেখ, জীবনটা তোর নিজের । কাজেই তোর সিদ্ধান্ত তুই নিজে নিবি । আমার কথায় রাগ করিস না বোন । আমি ভেবেছি তোর শাশুড়ি বুড়ো মানুষ, সে না থাকলে তো আর তোর কষ্ট হবে না । মারুফ যেহেতু তোরে এখন কেয়ার করে, তাই সব নিশ্চই ঠিক হয়ে যাবে । তুই চিন্তা করে দেখ কি করবি ।

— বড় আপু, বাদ দেন তো এখন এসব কথা ।
অনু আপু, প্লিজ আর কাঁদবি না তুই । এখন একটু নরমাল হ । ডিসিশন পরে নেয়া যাবে, ঠান্ডা মাথায় । আচ্ছা, তুই যে কলেজে ভর্তি হয়েছিলি, ক্লাস করেছিস একটা ও ? কথা ঘুরানোর জন্য ঝিনু জিজ্ঞেস করল ।

— না রে, ক্লাস কীভাবে করব ? আমাকে তো নিচেই নামতে দেন না শাশুড়ি মা ! শুধু শুধু ঐ এলাকার কলেজে ভর্তি করলেন আব্বু । বাসার কাছে কলেজ, আমার ক্লাস করতে সুবিধা হবে ! এখন হয়েছে সুবিধা ?

— এ্যাই, তুই ঐ ডাইনি বুড়িকে শাশুড়ি মা ডাকিস কেনো ? খবরদার আর ডাকবি না । আর আমার সামনে তো না-ই । রাগ দেখিয়ে ঝিনু বলল ।

— তোর যে কথা ! এত সুন্দর করে মা ডাকি; তাই পারলে ভাত দেয় না , আর তোর মতো করলে তো বিয়ের পরের দিনই ফেরত পাঠিয়ে দিতো ।

— তোর দেবরটা দেশে থাকলে ভালো হতো, দু’জন মিলে ঐ ডাইনি বুড়ি কে উচিত শিক্ষা দিতাম ।

— হ্যাঁ, আমার তো মাথা নষ্ট যে, তোরে আমি দিতাম ঐ নোংরা পরিবারে যেতে ? ভালোই হয়েছে যে, সে দেশে নেই ।

— আহ ঝিনু, থামতো তুই । খালি বেশি প্যাঁচাল পারিস । আমার মেয়েটা এত দিন পর এসেছে, একটু কথা বলতে দে ।

— ও মা ! তবে আমি কি বলছি ? কথাই তো বলছি ডিয়ার আম্মু ।

— পাজি মেয়ে আমার । সারাক্ষন ফাজলামি করে !

আম্মু আমাকে কোনো ভাবেই একা ঘুমাতে দিবেন না । ভয় পান, যদি আবার উল্টা পাল্টা কিছু করি ! ঝিনু আমার সাথে ঘুমাতে এসেছে পাহারা দেয়ার জন্য । ভালোই হলো দুই বোন মিলে গল্প করা যাবে । বড় আপুর সাথে আমাদের বয়সের পার্থক্য বেশি হওযায় যেমন ফ্রি হতে পারিনা, তেমনি ভয় ও পাই আমরা দুই বোন । কিন্তু, আম্মুর সাথে মন খুলে সব বলতে পারি ।

সময়টা এতক্ষন কত দ্রুত চলে গেছে । কিন্তু এখন যেনো সময় থমকে আছে । কেমন খালি খালি লাগছে আমার ! কি বিচিত্র নিয়ম ! যে মানুষটা আমাকে মানুষ হিসেবে গন্যই করে নি কখনো, তার শূন্যতা অনুভব করছি আমি ? পুরো দুটো মাস সে আমাকে এত অবহেলা করেছে, শুধু একটা রাত ভালোভাবে কথা বলেছে মাত্র। আর তাতেই আমি তাকে মনে করছি ? এটাই বুঝি সংসারের গোপন রহস্য ! এ রহস্য ভেদ করার ক্ষমতা আমার নেই । আচ্ছা, অন্য কারো কি আছে ?

— কিরে ঘুমাস না ? শরীর খারাপ লাগছে ? আম্মুকে ডাকবো ?

— ইস ঝিনু, তুই এত কথা বলিস কীভাবে রে ? শরীর খারাপ না আমার । এমনি ভালো লাগছে না ।

— ও বুজতাম পারছি, তোর এখন বুইড়া খাটাসের কথা মনে পড়ছে ।

— হা হা হা , তুই পারিস ও ! আমি এত দিনেও ওদের ভাষা শিখতে পারি নি । অথচ তুই এক দিনেই শিখেছিস ! আর কি যেনো বললি মারুফকে ?

— আবার শুনবি ? বুইড়া খাটাস ।

— এ্যাই , আমার কিন্তু খারাপ লাগছে ।

— লাগুক, আমি বলবই । তোর বাবুকে ও শিখাবো আমি । বলব : এই লোক কে বাপ ডাকবি না, বুইড়া খাটাস ডাকবি ।

— আচ্ছা, তোর এত রাগ কেনো মারুফের উপরে ? সত্যি বলতো ?

— রাগ হবে না ? তোর সাথে তারে মানায় ? তুই না হয় নিরুপায় ছিলি, কিন্তু ঐ বুইড়া কি জানতো না যে তুই এত ছোট ? তবে কেনো বিয়ে করল তোকে ? কচি মেয়ে দেখলে হুস থাকে না যে লোকের, তাকে তুই প্রান ভরে পছন্দ কর । আমার পছন্দ করা দরকার নেই, বুঝলি ?

— আচ্ছা আপু, তুই এত বোকা কেনো রে ? কবে তুই চালাক হবি বলতো ? এখনো সময় আছে একটু চালাক হ ।নয়তো সারাজীবন ঠকেই যাবি ।

— হয়েছে অনেক বেশি চালাক হয়েছেন আপনি , এবার থামেন নানি ।

— আপু জানিস ? তোর বিয়ের পর কত যে কান্না করেছি । এত আফসোস হয়েছে তোর জন্য ! আর আফসোস হবেই না কেনো বল ? তুই এত সুন্দর একটা মেয়ে ! ভালো ছাত্রী , কত শান্ত, নরম একটা মেয়ে তুই । তোর কপালে অমন বর জুটল ? অথচ এলাকার কত ছেলে তোর জন্য পাগল ছিল ! কে তোরে পছন্দ না করত বল তুই ?

— আর তোরে ঐ কুত্তাটা মারল কীভাবে রে ! তোর মুখের দিকে তাকালেই তো মায়া লাগে । তুই যে একটা মায়ার ডিব্বা, জানিস আপু ?

— কিজানি ? জানি না তো । তবে এটুকু বুঝি আমার এই রুপই আমার জীবনের কাল । এই যে বললি, পাড়ার বেশির ভাগ ছেলেই আমাকে পছন্দ করত । এটাই হলো আমার সর্বনাশের মূল কারণ । আব্বু ভয় পেয়েই এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়েছেন বুঝলি । এখানে আব্বুরও দোষ না । এখন সমাজের যে অবস্হা, মেয়ের বাবা মানেই এক গাদা টেনশন । আর আব্বু কি জানতেন মারুফের বয়স এত বেশি ? সে যে চুলে কালার দেয়, তা আব্বু কি করে বুঝবেন ? আমাদের সামনে তো সে ফিটফাট হয়েই এসেছিল । ঘটক বদমাশ টা একশ একটা মিথ্যে বলেছে । আর মিরা আপা দুলাভাই ? উনারা কি সত্য বলেছেন তোর মনে হয় ? না, বলেন নি । কাজেই সবাই শুধু আব্বুর দোষ দিস না । আব্বুর মুখের দিকে তাকালে যে কষ্ট দেখতে পাই, তা আমি সহ্য করতে পারি না । যা হবার হয়ে গেছে বোন, বাদ দে এসব । আমার কপালে ছিল, আমি মেনে নিয়েছি ।

— শোন, এ জন্য আমি চিন্তা করেছি নিজের পছন্দে বিয়ে করব । আর ছেলের বয়স আমার চেয়ে কম হবে । যেমন ধর আমার চেয়ে কমপক্ষে দশ বছরের ছোট । বাসায় রাজি না হলে প্রয়োজনে ভাগিং করব । তাও আব্বুর পছন্দে বিয়ে করব না ।

— ঝিনু, তুই কিন্তু ভুলের মধ্যে আছিস । আব্বু বিয়ে দিলে খারাপ হবে, আর তুই নিজে বিয়ে করলে ভালো হবে ; সেটা কউ বলতে পারে না । এখন দেখিস না নিউজে যে,প্রেম করে বিয়ে করেছে অথচ যৌতুকের জন্য গলা টিপে হত্যা ! এমন অনেক আছে । বাবা বিয়ে দিলে তো তাও বিপদে বাবার বাড়িতে ঠাঁই হবে, কিন্তু নিজে বিয়ে করলে সেটাও পাবি না । সো চিন্তা ভাবনা পাল্টা ।
আর হ্যাঁ, ছেলে বয়সে তোর ছোট হতে হবে কেনো ? তা বুঝতে পারলাম না । বুঝিয়ে বল তো ।

— শোন, একটা পুরুষ যদি তার হাঁটুর সমান ছোট একটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারে, তবে একটা মেয়ে কেনো পারবেনা তার চেয়ে ছোট ছেলেকে বিয়ে করতে ? আর এমন তো না যে এমন বিয়ে নিষিদ্ধ । কি বলিস তুই ? ঠিক বলেছি না ?

— হয়তো । কিন্তু, পাগলি এখানে ঠিক বেঠিক পরে আসছে । প্রথম বাঁধাই হচ্ছে নিয়ম ভাঙা । পারবি তুই এত বড় এক নিয়ম ভাঙতে ?

— হুম, পারব । পারতে হবে আমাকে । তোর মতো করে আমার জীবন আমি নষ্ট হতে দিব না । লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াব । দেন বিয়ে করব । তুই বিয়ে বসেছিস আপু, আর আমি বিয়ে করব । বুঝলি ?

— জি, বুঝেছি । আমার কিউটি পুচকে বোন টা অনেক বড় হয়ে গেছে । খুশি এবার ? এখন একটু চুপ কর বোন , বকবকটা থামা । ঘুমাতে দে আমাকে ।

— ইস, আমার আপুটা কত লক্ষী । উম্মাহহহহ !

— হয়েছে আর ঢং করিস না । ঘুমা পাঁজি ।

আব্বু প্রতিদিন জিজ্ঞেস করেন বাজার থেকে কী আনবেন ? আর আম্মু পরম যত্নে সে গুলো রান্না করেন । খেতে বসলে আব্বু আমার পাশে বসেন , খাবার তুলে খাওয়ান আমাকে । বাসার সবার খেয়াল এখন আমার দিকে । আমি যেনো ছোট একটা বাবু ! সবাই কত আদর করে আমাকে । বড় আপু মাঝে মাঝে চলে আসেন এখানে । তখন তিন বোন মিলে অনেক মজা করি আমরা । আর আপুর ছেলে শুভ্র কে পেলেই আমি খুশি । প্রান ভরে ওকে দেখি আমি । আম্মু বলেছেন ঘুম থেকে উঠে যেনো আমি প্রথমেই আয়নায় নিজের চেহারা দেখি । তবে বাবু নাকি দেখতে আমার মতোই হবে ! যখনই চিন্তা করি আমার বাবুটা আমার মতো হবে, কেমন যেনো এক শান্তি লাগে ।

মারুফ আজ তাড়াহুড়ো করে ভাত খাচ্ছে । সময় কম তার, ঢাকা যাবে । খাওয়া শেষ করে আলমারি থেকে সুন্দর একটা শার্ট বের করল সে । রেডি হয়ে গায়ে পারফিউম মাখছে ।

— কী, এত হুড়াহুড়ি করতাছ ক্যা ? কই যাইবা তুমি ?

— ঢাকা যাইমু মা । বাস ছাইড়া দিব তাই হুড়াহুড়ি করতাছি ।

— ঢাহা কই যাইবা ? বউ গো বাড়িত ?

— হ , অনুরে দেইখ্যা আহি একটু ।

— তয় আইজকা আইয়্যা পরবা না ?

— না মা , আমু ক্যা ? রাইতে অনুগো বাড়িত থাকমু আইজকা । কাইল সকালে আইমু । চিন্তা কইরেন না আমনে । আহি এহন, দেরি হইয়া গেছে ।

আম্মুর পাশে শুয়ে গল্প করছি আমরা । হঠাৎ মারুফের গলা শুনে চমকে উঠি ! কিযে খুশি লাগছে আমার ! লোকটা তবে সত্যি আমাকে ভালোবাসে ? আমি তো তাকে আসতে বলি নি, নিজের ইচ্ছাতেই এসেছে সে ।

— কই বাসার সবাই কই ? কি শালিকা কেমন আছো ?

— ভালো । দুলাভাই শ্যালিকা কি ? আপনি আমাকে শ্যালিকা ডাকবেন না তো । আমি আপনির ছোট বোনের মতো ।

— কি কও শালিকা ? বিয়া করছি আর শালী থাকতো না ?

— না, থাকতো না । আমনে আমনের বউ নিয়া থাকেন ।

— হা হা হা । ঝিনু তুমি তো বেশ মজা কইরা কথা কও !

অনু এসে ওদের কথার সমাপ্তি ঘটালো । ঝিনু যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচল । বদ বেটা কোথাকার ! চোখের মধ্যে স্পষ্ট শয়তানি দেখা যায় । আচ্ছা আপু দেখতে পায় না ওর বরের যে চোখ ভালো না ?

— কি ব্যাপার, আপনি হঠাৎ করে আসলেন যে ? ফোনে তো কিছু বললেন না ?

— আইলাম তোমার কতা মনে পড়ল তাই ।

— সত্যি বলছেন আপনি ?

— হ হাসাই তো কইছি । তোমারে দ্যাখতাম আইছি ।

— আলহামদুলিল্লাহ । শোনেন আম্মু জিজ্ঞেস করলেন কি খাবেন রাতে ? খিচুড়ি না পোলাউ না বিরিয়ানী ?

— না, কিছুই খাইতাম না আমি । হাতো সময় কম ।

— মানে ? সময় নেই মানে ? আপনি এখানে রাতে থাকবেন না ?

— না ।

— তবে কেনো এসেছেন এত দূর থেকে কষ্ট করে ?

— গুলশান কাজ আছে তাই আইছি । ভাবলাম এত কাছে আইছি যহন তোমারে এই ফল গুলা দিয়া যাই ।

কি ? গুলশান মানে ? বারে যাবেন ড্রিং করতে ?

— হ । জানোই তো আমি আগে থাইক্কাই যাই । তো কি হইছে তাতে ?

— না, কিছু হয়নি । কী হবে আমার ? আর কী হওয়া বাকি আছে বলেন ?

— আইচ্ছা থাহো তুমি । ফল গুলান ঠিক মতো খাইয়ো ।

— আপনার কি ধারণা আমার আব্বু আমাকে ফল কিনে খাওয়ান না ?

— তা কইছি নি আমি ? আমি আনছি আমার বাচ্চার লাইগ্যা ।

— কি ! কী বললেন আপনি ? আপনার বাচ্চা ? আপনি না কোথায় যাবেন বললেন ? দেরি হচ্ছে না ? তাড়াতাড়ি যান ।

— রাগ করো ক্যা তুমি ? বাচ্চা তো আমারই ।

— রাগ করি নি আমি । হ্যাঁ, এখন সে আপনারই সন্তান । খুশি হইছেন ?

— হ, ওকে যাই তাইলে ।

অনু অনেক চেষ্টা করছে চোখের পানি থামাতে । পারছে না । এত অমানুষ লোকটা ! আমার মনটা একটু ও বুঝল না ? তাকে দেখে যে আমি কত খুশি হয়েছিলাম । আমার চেয়ে তার কাছে বারে যাওয়া বড় হয়ে গেল ?

— আপু, তোর ফোন এসেছে । ঝিনু ডাক দিলো ।
— হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম । কে বলছেন ?

— ভাবি, আমি লীমা ।

— ও কি খবর, কেমন আছ তুমি ? মার শরীর ভালো ?

— আমরা ভালো আছি । ভায়ে কি পৌঁছায়ছে ? মায়ে চিন্তা করতাছে ।

— হ্যাঁ, ঠিক মতো পৌঁছেছে ।

— মায় জিগাইলো ভায়ে কি কাইল দুপুরে খাইয়া আইবো ? না বাসায় আইসা খাইবো ?

— কি ! কাল দুপুরে মানে ?

চলবে…..

✍? নায়না দিনা