অন্তঃকরণে তোরই পদচারণ পর্ব-০৮

0
479

#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-৮
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★সময়ের পালাক্রমে অতিবাহিত দিনের সাথে যোগ হয়েছে আরও একটি সপ্তাহ। খুশির প্রয়াস এখনো জারি আছে। সে যথাযথ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে প্রহরের মন জয় করার। যদিও প্রহরের ওপর তার প্রচেষ্টার কোন প্রভাব পড়ছে কিনা সেটার তেমন কোন আভাস দৃশ্যমান হয়নি।

তবে প্রহরের দিক থেকে কিছু না বদলেও আবার যেন কিছুটা বদলেছে। আজকাল কেমন যেন খুশির উপস্থিতি ওকে বিরক্ত করে না। বরং ওর পাগলামি গুলোয় মাঝে মধ্যে অনেক হাসি পায় ওর। যদিও তার সেই মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ না করার যথাযথ চেষ্টা করে সে। উপরে উপরে খুশির ওপর রাগও দেখায় প্রহর। যদিও সে জানে না তাতে কতটা সফল হয়। কারণ না খুশি ওর রাগে ভয় পেয়ে দমে যায়। আর না প্রহর খুশির আবহমণ্ডল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হচ্ছে। খুশির চঞ্চলতা আর উদ্দীপনার ঘূর্ণি ঝড়ে প্রহরের শক্ত দেয়ালটা নড়ে উঠছে। মনে হচ্ছে হয়তো যেকোনো সময় সেটা ভেঙে পড়তে পারে।তবে প্রহর সেটা ঠিক রাখার যথাযথ চেষ্টা করছে। সে চায়না তার দেয়াল কেউ ভাঙ্গুক। ওর মন পর্যন্ত কাউকে পৌঁছাতে দিতে চায়না । এসব মোহমায়ার মিথ্যে জালে নিজেকে ফাঁসাতে চায়না সে। এসব যে শুধুই ছলচাতুরী আর ধূর্ততা।

খুশি আপনমনে হাটতে হাঁটতে দিয়াকে খুঁজছে। কলেজে আসার পর থেকে এখনো দেখতে পায়নি ওকে। আরও কিছুটা হাঁটার পর বটগাছ তলায় বসে থাকতে দেখলো দিয়াকে। খুশিকে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দিয়ার পাশে বসে হালকা রাগী কন্ঠে বললো।
–কিরে আবুইল্যার মা, কই হারায় গেছিলি? আবুইল্যার বাপেরে পাইয়া গেছস নি?

দিয়া কিছুটা বিরক্তির সুরে বলে উঠলো।
–ইয়ার মজা করিস নাতো। এমনই মেজাজ হাই হয়ে আছে।

–ওমা কেডা আবার তোর মেজাজের তন্দুরি চিকেন বানায় দিলো। তুই খালি একবার ক আমারে। অহনি তারে ধর তক্তা মার পেরেক কইরা দিমু।

দিয়া ওর হাতে থাকা একটা লেটার খুশির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো।
–নিজেই দেখে নে।

খুশি ভ্রু কুঁচকে লেটার টা হাতে নিয়ে খুলে পড়তে লাগলো।
“প্রিয় দিয়া,
তোয়ার লাই আর ফড়াণ ডা বাকুম বাকুম হরে। আই উঠতে,বইতে,খাইতে,হুইতে, নাইতে, যাইতে,হাগতে,মুততে ব্যাগ্গিন সময়ে তোয়ার কথাই মনে ফরে। এহন তো খোয়াবেও তোয়ারেই দেহি। তোয়ার চান্দের লাহান মুখটা দেখবার লাই আই হারাদিন বইয়া থাহি। হাগা আইলেও আটকাইয়া বইয়া থাহি। তোয়ার সুরত খানা দেইখা গাইবার মন চায়,
♬ হরেনা চোখের হলক (পরেনা চোখের পলক)
♬কি তোঁয়ার রূপের ঝলক (কি তোমার রুপের ঝলক)
♬দোয়ায় লাগে মুখডা তোঁয়ার (দোহায় লাগে মুখটি তোমার)
♬এক্কান্না আচলে ডাহ (একটু আঁচলে ঢাকো)
♬আঁই হুশ আজামু, মরি যামু(আমি জ্ঞান হারাবো,মরে যাবো)
♬ বাচাইতে হাইত্তো নো কেউ (বাঁচাতে পারবেনা কেউ)
তোঁয়ারে আই মেলাআআআ হেরেম(প্রেম) হরি। আঁই তোঁয়ারে ছাড়া বাচুম নো। দিয়া, তুমি আঁর দিয়া। আঁই তোঁয়ার বাত্তি। জলদি হইয়া যাও আঁর জীবন সাথী।
♬ ও দিয়া……….আ( ও প্রিয়া……আ)
♬ ওওও দিয়া……
♬ নিহাস আঁর তুমি জানে হগ্গুল দুনিয়া
(নিঃশ্বাস আমার তুমি জানে এই দুনিয়া)
♬ দিয়া আঁর দিয়া

বুইজ্জো নি কতা? তয় বুজবার হারলে আঁর হেরেম ডা মাইন্না লও। আর আঁরে ধন্য হরো। তোঁয়ার আঞ্চলিক ভাষা ফছন্দ দেইখ্যা আঁর নোয়াখাইল্যা বন্ধুরে দিয়া এই চিডি লেহাইলাম। আশা হরি তুমি খুশি হইবা।

ইতি তোঁয়ার দিওয়ানা,মাস্তানা
শাহিন্যা, থুক্কু শাহিন।

চিঠি শেষ হওয়ার আগেই এদিকে খুশি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বেচারি এমন খাতারনাক লাভ লেটার হজম করতে পারছে না। দিয়া রাগ দেখিয়ে বললো।
–তুই হাসছিস? আর আমার এদিকে শরীর জ্বলে যাচ্ছে রাগে। ওর শাহিন্যার সাহস কি করে হলো আমাকে লাভ লেটার দেওয়ার? ওরে তো আমি নর্দমার পানিতে ডোবাবো।

খুশি কোনরকমে হাসির ফোয়ারা থামিয়ে বলে উঠলো।
–আরে রাগছিস কেন? বেচারা কত্তো ভালোবাসে তোরে। একটু ওর প্রতি নজর দিলেই তো পারিস।

–তুইও ওর সাপোর্ট করছিস? তুই আমার বান্ধবী না দুশমন?

–তোর বান্ধবী দেখেই তোকে বলছি। বেচারা সত্যিই তোকে ভালোবাসে। একটা চাঞ্চ তো দিয়ে দেখতেই পারিস। তোর ওইসব ক্রাশ ফ্রাশের পেছনে পাগল না হয়ে ওর দিকেও তো একটু নজর দিতে পারিস। ছেলেটা কিন্তু সরল মনের। এমন ছেলে পাওয়া কিন্তু টাফ বুঝেছিস?

–তোর সত্যিই এমন মনে হয়? হুমম ঠিক আছে। একটু বাজিয়ে তো দেখায় যায় কি বলিস?

–ইয়া বেবি। এই না হলে আমার বুদ্ধিমান বান্ধবী।
__

নিভান অনেকক্ষণ হলো বসে আছে স্পৃহার অপেক্ষায়। কিন্তু মেয়েটির কোন খবরই নেই। একটু পরে স্পৃহা দৌড়াতে দৌড়াতে ওখানে এলো। নিভানের সামনে এসে হাঁটুতে ভড় দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো।
–অ্যাম সরি। আমি অনেক লেট করে ফেলেছি তাইনা? আসলে আমি না রিহার্সেল করছিলাম। তাই লেট হয়ে গেছে।

নিভান ভ্রু কুঁচকে বললো।
–রিহার্সেল? কিসের রিহার্সেল?

–আরে তুমি জানো না। কয়দিন পরই তো আমাদের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। সাথে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হবে। আর আমি নৃত্য প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছি।

–তুমি নাচও জানো বুঝি।

স্পৃহা বসতে বসতে বললো।
–তেমন জানি না। তবে শেখার অনেক শখ। নাচতে অনেক ভালো লাগে আমার।

–ওওও

–তা তুমি কোন কিছুতে নাম দাওনি?

–না আমার এসব এক্সট্রা কারুকলামে খুব একটা ইন্টারেস্ট নেই।

–আরে কি বলছ? তুমি তো এতো সুন্দর আর্ট করতে পারো। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলে তো তুমিই ফাস্ট হবে অ্যাম শিওর।

–আর্ট করি আমি আমার নিজের জন্য। কারণ এটাতে আমার মনের আলাদা এক প্রশান্তি পাই।তবে এটা নিয়ে কোন কম্পিটিশন করতে আমার ভালো লাগে না।

–আচ্ছা, তুমি যেটা ভালো মনে করো।

–আচ্ছা তাহলে আজকে আর আর্ট ক্লাসের দরকার নেই। তুমি বরং ভালো করে প্রাকটিস করো কেমন।

স্পৃহা মুখ লটকিয়ে বললো।
–আরে কি প্রাকটিস করবো? আমি তো ভালো করে পারছিই না। কেউ তেমন শেখানোর মতোও নেই। আমি বোধহয় এবারও পারবোনা।

নিভান কিছু একটা ভেবে বললো।
–আচ্ছা তুমি চাইলে আমার বাসায় এসে আপুর কাছ থেকে শিখতে পারো। আমার আপু অনেক ভালো নাচ জানে। স্কুলে সে নাচের জন্য অনেক প্রাইজ জিতেছে। আপু তোমাকে ভালো করে শিখিয়ে দিবে।

–ওয়াও সত্যিই? তাহলে তো অনেক ভালো হবে। আসলে তোমার কাছ থেকে এতো শুনে শুনে এখন আমারও আপুকে অনেক দেখার ইচ্ছে হয়। আর এই সুযোগে দেখাও হয়ে যাবে। আর নাচ শেখাও। সাথে তোমার বাগানটাও দেখতে পাবো। তাহলে আমি আজকে বাসায় বলে রাখি। তারপর কাল থেকে তোমার সাথে যাবো কেমন?

–আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে এখন আমি যাই ওকে।

–ওকে বাই।
___

আজ শুক্রবার। প্রহরের সাপ্তাহিক রুটিন অনুযায়ী সে আজ সে ফার্মহাউসে এসেছে। ছুটির দিন টা সে এখানেই কাটায়। যানবাহন আর কোলাহল মুক্ত এই মনোরম পরিবেশটা তার ভালো লাগে। আর সেই সাথে ওর পালিত পশুপাখি গুলোর সাথেও সময় কাটাতে পারে। এদের সময় কাটাতেও অনেক ভালো লাগে প্রহরের। মানব জাতির মতো মুখোশ ধারি না এরা। এদের মাঝে নেই কোন কৃত্রিমতা। নেই ধূর্ততা বা স্বার্থপরতা। এরা ভালোবাসার বদলে শুধু ভালোবাসায় দিতে যানে। তাইতো এদেরকেই সবচেয়ে আপন মনে হয় প্রহরের।

প্রহর ছুটির সারাটাদিন এদের সাথেই কাটায়। নিজের হাতে এদের সব কাজ করে। আজও তাই করছে। প্রহর এসেই কাপড় চেঞ্জ করে একটা টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে বাইরে এলো পশুপাখি গুলোর কাছে। প্রহরের সাথে আজ ফাহিমও এসেছে। ফাহিমও প্রায়ই আসে এখানে। প্রহরের মতো ওরও এখানে সময় কাটাতে ভালোই লাগে।

প্রহর ফার্মের দিকে এগিয়ে যেতেই ওর পোষা কুকুর দুটো দৌড়ে এলো প্রহরের কাছে। প্রহর নিচে এক হাঁটু গেড়ে বসে কুকুর দুটোকে আদর করতে করতে বললো।
–কি ব্যাপার জনি এন্ড স্যামি। কেমন আছিস তোরা? আজতো আমি আসার আগেই এতো চকচক করছিস? ব্যাপার কি বলতো? এতো পরিস্কার হলি কিভাবে?

কুকুর দুটো তখন ঘেউ ঘেউ করে সামনের দিকে কিছু ইশারা করে দেখাচ্ছে। প্রহর ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকাতেই, আচমকা খুশি সামনে এসে প্রকট হলো। দুই হাত ছড়িয়ে সারপ্রাইজ দেওয়ার মতো করে বলে উঠলো।
–টাডা……

হঠাৎ খুশিকে এখানে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেল প্রহর। আর খুশির পোশাক আশাক দেখে আরও ভ্রু কুঁচকে এলো ওর। খুশি শার্ট আর জিন্স প্যান্ট পড়েছে। শার্টের সামনে দুই মাথা গিট্টু দেওয়া আর পায়ের কাছে প্যান্ট গোড়ালির অনেক টা ওপর পর্যন্ত গুটিয়ে রেখেছে। মাথায় একটা স্কার্ফ বাঁধা। আর দুই হাতে দুটো ক্লিনিক ব্রাস ধরে আছে। খুশির এই আবতার দেখে প্রহর ভ্রু কুঁচকে ভাবছে, খুশি? এই মেয়ে আবার এখানে কখন এলো? আর কিভাবে এলো? আমি যে এখানে আসবো তা ও জানলো কি করে? প্রহর এবার তীক্ষ্ণ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো ফাহিমের দিকে। এই কাজ এই ফাহিমের তা ভালোই বুঝতে পারছে ও। প্রহরের তাকানো দেখে ফাহিম জোরপূর্বক হেসে বললো।
–এ এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? আমি মোটেও নিয়ে আসিনি ভাবিজীকে।

প্রহর দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–আচ্ছা তো সে নিজে নিজেই সব জেনে গেল তাইনা? বোকা পেয়েছিস আমাকে? তোকে তো আমি পরে দেখছি।
প্রহর এবার খুশির দিকে তাকিয়ে বললো।
–তুমি এখানে কি করছ হ্যাঁ?

খুশি তার বৈশিষ্টতা অনুযায়ী নিজের মতো করে বলে উঠলো।
–ওমা কি করছি মানে? এটা আবার কোন প্রশ্ন হলো? আরে আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি। আমার হবু বরের সবকিছু দেখাশোনা করার দায়িত্ব তো আমার তাই না? আপনার মতো এই পশুপাখি গুলো এখন থেকে আমারও বাচ্চার মতো। তাই আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে সকাল সকাল চলে এলাম। আর এসেই আমি আমার কাজে লেগে পড়েছি দেখেন।
খুশি ওখানকার কর্মরত মহিলা রোজিনা বেগম কে ডাক দিয়ে বললো।
–এই রোজিনা সুন্দরী তুমি বলোনা।

রোজিনা বেগমকে এমন নামে ডাকতে দেখে ফাহিম মুখ টিপে হাসছে। খুশির কথামতো রোজিনা বেগম প্রহরের সামনে এসে বললো।
–জে বাবা, মাইয়াডা সকাল সকাল আইয়াই কামে লাইগ্যা পড়ছে। আমি কতো মানা করলাম, কিন্তু হেই হুনলোই না। এই জনি আর স্যামিরেও হেয়ই গোসল করাই দিছে। এক্কেরে শ্যাম্পু দিয়া ঘইষা মাইজা চকচকা কইরা দিছে।

প্রহর এবার সামান্য বিস্ময় নিয়ে তাকালো খুশির দিকে। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–দেখ তোমার এসব করার কোন দরকার নেই। তুমি যাও এখান থেকে।

খুশি জেদ ধরে বললো।
–মোটেও না। আমি এখানেই থাকবো। দেখ আমার এই পশুপাখি গুলোর ওপর অনেক মায়া বসে গেছে। তাই ওদের সাথে একটু সময় কাটাতে চাই। দেখ আমি তোমাকে প্রমিজ করছি আজকে আমি তোমাকে একটুও জ্বালাবো না। তোমার কাছেও যাবোনা। শুধু ওদের সাথে একটু থাকতে দাও। প্লিজ প্লিজ প্লিজ….

খুশির এমন অনুনয় দেখে প্রহর কেমন যেন আর মানা করতে পারলোনা। ফাহিমও পাশ থেকে বলে উঠলো।
–থাকতে দেনা ওকে। বেচারি শুধু একটু পশুপাখি গুলোর সাথে সময়ই তো কাটাতে চাচ্ছে।

প্রহরও তাই মাথা ঝাকিয়ে বললো।
–ঠিক আছে। তবে বেশিক্ষণ না। কিছুক্ষণ থেকে চলে যাবে।

খুশি আনন্দিত হয়ে বললো।
–ওকে ওকে।

খুশি আবারও ধেইধেই করতে করতে গিয়ে নিজের কাজে লেগে পড়লো। মনের আনন্দে এদিক ওদিক লাফাতে লাগলো। কখনো মুরগির পেছনে দৌড়াচ্ছে, তো কখনো ছাগল ছানা কোলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার নিজের মতো তাদের সাথে কথাও বলছে। যেন ঈদের আনন্দ লেগেছে ওর মাঝে। প্রহর কিছুক্ষণ সেটা দেখে আবার নিজের কাজে অগ্রসর হলো সে। প্রহর পাইপ লাগিয়ে ঘোড়া গুলোকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে।যদিও এসব কাজের জন্য অনেক লোক রাখা আছে। তবুও প্রহরের নিজের হাতে সব করতে ভালো লাগে। এক হাতে পাইপ ধরে আরেক হাতে ঘোড়ার গায়ে ব্রাস দিয়ে ঘষে দিচ্ছে। পাইপের পানি ছিটে প্রহরের শরীর ভিজে যাচ্ছে। টিশার্ট গায়ে লেপ্টে গিয়ে প্রহরের সুঠাম বডি দৃশ্যমান হয়ে যাচ্ছে। চুল ভিজে কপালে পড়ায় প্রহর সেগুলো হাত দিয়ে ব্রাস করে পেছনে ঢেলে দিচ্ছে।

এদিকে প্রহরের এই এট্রাক্ট্রিভ প্রদর্শন দেখে আরেকজনের মনে হাই হুতাশ উঠে গেছে। প্রহরের থেকে কিছুটা দূরে ছাগল ছানাকে কোলে নিয়ে, ছানাকে আদরের ছলে শুধু প্রহরকেই অবলোকন করে যাচ্ছে খুশি। চোরা চোখে লোলুভ দৃষ্টিতে প্রহরকে দেখতে দেখতে, ছাগল ছানার উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বললো।
–হায়,, কেউ তো একটু ঠেকাও তাকে। এতোটা হটনেস যে, স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর সেটা কি সে জানে না? সেতো পানিতেও আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে।মাই হটি কাউ বয়। দেখেছিস ক্যাটরিনা, আমার বয়ফ্রেন্ড কি হটি? না না তুই দেখিস না। তোর দুলাভাই হয়। দুলাভাইয়ের দিকে এভাবে তাকাতে নেই। পাপ হয় বুঝেছিস। তুই বরং তোর হবু বর সালমান ভাইকে দেখ। এই দেখ আমি তার নতুন ছবি নিয়ে এসেছি।

খুশি ওর ফোন বের করে সালমান খানের একটা ছবি বের করে দেখালো। ছানাটা হঠাৎ খুশির কোল থেকে লাফ দিয়ে নেমে ছুটে গেল। খুশি দুষ্টু হেসে বললো।
–হায় বেচারি হবু বরকে দেখে লজ্জা পেয়ে গেছে। এই এই শোন না?
খুশিও ছানার পেছন পেছন ছুটতে লাগলো।

কাজের ফাঁকে না চাইতেও অবাধ্য চোখ শুধু খুশির দিকেই যাচ্ছে প্রহরের। মেয়েটার এই প্রাণবন্ত, হাস্যোজ্জ্বল মুখ খানাই যেন প্রহরের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। খুশির থেকে আসা তপ্ত আবহে প্রহরের মাঝে কিছু যেন গলতে শুরু করেছে। কোন এক অদৃশ্য মধ্যাকর্ষন শক্তি ওকে চুম্বকের মতো খুশির পানে টানছে। প্রহর নিজের সর্বশক্তি নিজেকে ফিরিয়ে আনার যথাযথ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে বারবারই ব্যাহত হচ্ছে সে। মনে হচ্ছে যেন ওর মন মস্তিষ্ক ওর সাথেই বেইমানি করছে। সব হয়তো এই মেয়েটারই ষড়যন্ত্র। এর জন্যই আমার নিজের সবকিছু আমার সাথেই বিদ্রোহ করছে। প্রহর কোনরকমে মাথা ঝাকিয়ে নিজের কাজে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করলো।

রোজিনা বেগম বসে বসে ঘোরার জন্য ঘাস কাটছে। পাশেই খুশি বসে একটা খরগোশ ছানাকে নিয়ে আদর করছে।সে তার ওয়াদা অনুযায়ী আজ আর প্রহরের কাছে গিয়ে ওকে জ্বালাবে না। তাই খুশি শুধু পশুপাখি গুলোর সাথে আর এখানকার কর্মচারীদের সাথেই সময় কাটাচ্ছে। সে খরগোশ ছানাকে আদর করতে করতে রোজিনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–আচ্ছা রোজিনা সুন্দরী তুমি এখানে কতদিন ধরে আছ?

রোজিনা বেগম ঘাস কাটতে কাটতে বললো।
–সেতো মেলা বছরই হইলো। পিরাই দশ বছর তো হইলোই। এইহানে প্রথমে আমরা শুধু কেয়ার টেকারের কাজ করতাম। তবে প্রহর বাবা এইসব জীব জনার আনার পর থাইকা এইগুলার দেহাশোনা করি।

–তোমরা মানে? আর কে কে আছে?

–মানে আমি আর আমার হেই। আরও অনেক লোকজন আছে।

খুশি দুষ্টু হেসে বললো।
–আরেব্বাহ,, রোজিনার তো দেখছি আলমগীরও আছে। তাইলে তোমারই মজা রোজিনা সুন্দরী। এই খোলা ফার্মহাউসে রোজিনা আলমগীর খালি রোমাঞ্চ করে বেড়াও তাইনা?

রোজিনা বেগম লাজুক হেসে বললো।
–কি যে কন্না আফনে। আমগো কি হেই বয়স আছে নি?

খুশি বিজ্ঞ জ্ঞানীদের মতো বললো।
–আরে এজ ইস জাস্ট নাম্বার রোজিনা সুন্দরী। মন জওয়ান থাকলেই হলো।

খুশির কথায় রোজিনা সুন্দরী লজ্জায় লাল,নীল হয়ে গেল।

প্রহর বসে কবুতর গুলোকে দানা খাওয়াচ্ছে। ফাহিমও ওর সাথেই আছে। দুজনেই কবুতর গুলোকে দানা ছিটিয়ে দিচ্ছে। সব কবুতরগুলো ওদের সামনে জড়ো হয়ে দানা খাচ্ছে। তবে প্রহরের বেইমান চোখ দুটো আবারও ওর সাথে বিরোধীতা করতে লাগলো। নজরের তীর ঘুরেফিরে শুধু খুশিতেই বিঁধে যাচ্ছে। খুশি প্রাণবন্ত ভাবে নিজের কাজে মত্ত। সে মিউজিক সিস্টেমে #আয়ই রে খুশি গানটা ছেড়ে দিয়ে ছাগল আর কুকুর গুলোর সাথে নাচছে।মাঝে মধ্যে রোজিনা আর বাকি কর্মচারীদেরও টেনে নিয়ে নিজের নাচের সঙ্গী বানাচ্ছে।তারাও কোনরকমে হাত পা নাড়ছে।কখনো ফোন বের করে সবার সাথে সেলফি নিচ্ছে। এমনকি বেচারা পশুপাখি গুলোও বাদ যাচ্ছে না। খুশি ছাগল ছানার সাথে গাল ঠেকিয়ে ঠোঁট চোখা করে পাউট করে সেলফি নিচ্ছে। সাথে ছানাটার মুখটাও চোখা করে পাউটের মতো করে দিচ্ছে। কখনো আবার মাঠে যে পানি জমে ছিল সেগুলোর মাঝে লাফিয়ে লাফিয়ে আনন্দে কাঁদা ছিটাচ্ছে। লাফাতে লাফাতে আবার পিছলে কাঁদায় ঠাস করে পড়েও যাচ্ছে। নিজে পড়ে গিয়ে নিজেই আবার হাসছে।

খুশির এই মহান কৃতকার্য দেখে প্রহরের ঠোঁটে চলে এলো হাসির রেখা। ফাহিম সেটা দেখে স্মিথ হেঁসে বললো।
–দেখেছিস আমি বলেছিলাম না মেয়েটা ইউনিক? সি ইস স্পেশাল। দেখ সে আজ অসম্ভব সাধন করে দিলো।তোর মতো রোবটের মুখে হাসি ফুটিয়ে দিল।ভাবতে পারছিস এটা কতো বড়ো ব্যাপার?

আজ আর ফাহিমের কথায় রাগ হলোনা প্রহর। বরং খুশিকে পর্যবেক্ষণ করায় মনোনিবেশ করলো সে। আজ প্রথম প্রহর খুশিকে ভালো করে দেখছে। মেয়েটার উচ্চতা স্বাভাবিকই হবে। খুব লম্বাও না আবার খাটোও না। গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা না,উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। কিছুটা স্বর্ণের রঙ। চেহারায় নিস্পাপ পরিস্ফুটিতা ভাসমান। কেমন যেন অদ্ভুত এক মায়া আছে ওই মুখমণ্ডল জুড়ে। আর সবচেয়ে বেশি মায়ার সমুদ্র বইছে ওই ডাগর ডাগর আঁখি যুগলে। ওই চোখে বেশিক্ষণ তাকালে মনে হয় ওই মহাসমুদ্রে ডুবে যাবে সে। আজ না চাইতেও ফাহিমের কথাটা মানতে হচ্ছে প্রহরের। মেয়েটা সত্যিই ইউনিক। যেখানে আজকাল কার মেয়েরা এসব পশুপাখির ফার্মে আসলে নাক সিটকে কপালে তুলে নেয়। ফাহিম কয়েকবার ওর বন্ধুদের নিয়ে এসেছিল। তাদের মাঝে মেয়ে বন্ধুও ছিলো। তারা এসব পশুপাখির ধারে কাছেও যায়নি। দূর থেকেই নাক সিটকে চলে গেছে। সেখানে এই মেয়েটা ওদের সাথে এমন ভাবে মিশছে যেন,নিজের ভাই বোন। মেয়েটা সত্যিই যেন কোন প্রকৃতির রুপ। ওর মাঝে কোন কৃত্রিমতা নেই। প্রহর মেয়েটাকে কখনো অন্য সব মেয়েদের মতো আটা ময়দা মেখে সাজুগুজু করতে দেখেনি। সবসময় সিম্পল ভাবেই থাকে।

সব পর্যালোচনা শেষে প্রহরের মন মস্তিষ্ক এই রায় দিল যে,মেয়েটা সুন্দর। শুধু সুন্দর না।অসম্ভব সুন্দর আর মায়াবী। ফাহিম পাশ থেকে দুষ্টু হেসে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো।
–এমন একটা মেয়ে আমাকে এভাবে এপ্রোচ করলে আমি কবেই হ্যাঁ বলে দিতাম। নিজেকে পরম সৌভাগ্য মনে করতাম।

ফাহিমের কথায় প্রহরের ঘোর কাটলো।মজা করে বললেও ফাহিমের কথাটা কেন যেন প্রহরের পছন্দ হলো না। কোথায় কিছু একটা বিঁধল ওর। প্রহর কিছু না বলে গলা খাঁকারি দিয়ে ওখান থেকে উঠে গেল। ওর মাঝে কেমন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে ওর ঘোছাতে হবে। এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে গেলে চলবে না।

প্রহরের যাওয়া দেখে ফাহিম হালকা হাসলো। বন্ধুর মনোভাব বুঝতে পারছে সে। দুষ্টু হেসে গেয়ে উঠলো।
♬ না না কারতে পেয়ার হায় তু কারগায়া কারগায়া
♬ ইউ আর ইন লাভ, ইউ আর ইন লাভ

চলবে…..