অন্তঃকরণে তোরই পদচারণ পর্ব-০৯

0
509

#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-৯
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★অনেক ছোটাছুটি করে এখন একটু শান্ত হয়ে বসে সামনে ছাগল ছানার দূরন্তপনা দেখছে খুশি। তখনই পাশে এসে বসলো ফাহিম। মুচকি হেসে বললো।
–তো ভাবিজী, কি করছেন?

খুশিও মুচকি হেসে বললো।
–এইতো ক্যাটরিনার কাজকর্ম দেখছি।

ফাহিম ভ্রু কুঁচকে বললো।
–ক্যাটরিনা? কোথায়?

–আরে ওইযে, ওই ছানাটার নাম দিয়েছি ক্যাটরিনা। ভালো নাম না?

ফাহিম হেঁসে উঠে বললো।
–ভালো মানে, মারাত্মক ভালো হয়েছে। সত্যিই ভাবিজী ইউ আর গ্রেট। আচ্ছা আপনি কি ওদের সাথে কথাও বলেন?

–হ্যাঁ বলিতো। কখনো কখনো ওদের কথা ডাবিংও করে দেই।

–ও তাই। তাহলে বলুন তো এখন ওরা কি বলছে?

–বলতে পারি। তবে আপনাকেও আমার সাথে যোগ দিতে হবে। আমি ক্যাটরিনার ডাবিং করবো আর আপনি ক্যাটরিনার সামনের পশুটার ডাবিং করবেন ঠিক আছে?

–ওকে ভাবিজী। লেটস হ্যাভ সাম ফান।

ক্যাটরিনা নামের ছাগল ছানাটার সামনে কুকুর স্যামি এসে দাঁড়িয়েছে। ফাহিম স্যামির পক্ষ থেকে ডাবিং করে বললো।
♬ এহ,, কেয়া বলতি তু?
খুশি ক্যাটরিনার ডাবিং করে বললো।
♬ এহ,,কেয়া মে বলু?
♬ সুন (ফাহিম)
♬ সুনা (খুশি)
♬ আতি কেয়া খান্ডালা? (ফাহিম)
♬ কেয়া কারু আকে মে খান্ডালা? (খুশি)
♬ আরে ঘুমেঙ্গে,ফিরেঙ্গে,নাচেঙ্গে,গায়েঙ্গে
♬ এ্যাশ কারেঙ্গে অর কেয়া?

খুশি ক্যাটরিনার ডাবিং করে এটিটিউট নিয়ে বললো।
–এই স্যামি আমার সাথে একদম ফ্লার্ট করার চেষ্টা করবে না।আমাকে এসব আমির গান শুনিয়ে পটাতে পারবিনা। আমি আগে থেকেই অন্য এক খানের বাগদত্তা।

ফাহিম এবার স্যামির ডাবিং করে বললো।
–খান? কোন খান?

–সাবকি আন, সাবকি শান দ্যা ওয়ান ওনলি সালমান খান। আমি সালমান খানের বাগদত্তা বুজেছ?

–তো হাম ভি কিসি সালমান সে কাম হে কে? আরে কি আছে ওই সাল্লুর মাঝে?

–দেখ আমার উনাকে সম্মান দিয়ে কথা বলবে ঠিক আছে। আরে কোথায় সে আর কোথায় তুমি। উনার বডি দেখেছ? কি ফিট বডি উনার। এখন তো আমিও উনার মতো ফিট হওয়ার জন্য ডাইটিং করছি। আমি এখন শুধু দুই বেলা ঘাস খাই। আর ভাত ভুসি তো খাইই না।

–আরে কি সাল্লু সাল্লু লাগিয়ে রেখেছ?আমার মতো হ্যান্ডসাম, নওজোয়ান পাত্র রেখে তুমি ওই বুইড়ারে পছন্দ করলা? আরে বুইড়া হওয়ারও এক্সপায়ারি ডেট চলে গেছে ওর। আর তাছাড়া ওর ম্যানুফ্যাক্সারিং ইফেক্ট আছে।

–কি বলো সত্যিই?

–আবার জিগায়। আরে সেই জন্যই তো সে এখনো বিয়ে করে না। দেখ আমি আবার জনদরদী টাইপস। কাওকে সমস্যায় পড়া দেখলে তার হেল্প করি। আমার কাজ ছিলো তোমাকে সাবধান করা। এখন বাকিটা তুমি দেখ।পরে যেন আবার আপসোস করে চোখের জলে সমুদ্র বানিওনা।

–ধন্যবাদ স্যামি। তুমি সত্যিই আমার কতবড় উপকার করলে। আমিতো না জেনেশুনে অনেক বড় ভুল করতে যাচ্ছিলাম। থ্যাংক ইউ হ্যাঁ?

–আরে মেনশন নট। এটাতো আমার কর্তব্য। বাইদা মেঠোপথ ওসব বাইরের মাল ছাড়োনা। আমার মতো দেশি মালে নজর দাও। আমার মতো স্থায়ি টেকসই মাল হারিকেন লাগিয়ে খুঁজলেও পানে না।

–যাহ কিযে বলোনা।

–আঃ আঃ হাসিতো ফাঁসি। তাহলে এখন বলো,
♬ মুজসে শাদি কারোগি
♬ হো মুজসে শাদি কারোগি

♬ তুজসে শাদি কারুঙ্গি
♬ হা তুজসে শাদি কারুঙ্গি

ফাহিম হাসতে হাসতে খুশির হাতের সাথে হাইফাই দিয়ে বললো।
–ওয়াও ভাবিজী তুসি তো গ্রেট হো।সুপার সে উপার হো। আই মিন লাইক ছাগলেরও লাভ স্টোরিও সেট করে দিলে। সত্যিই ইউ আর জিনিয়াস।

খুশি গর্বে গদগদ হয়ে বললো।
–বাচ,কখনো অহংকার করিনি।

–তো মহান মানবী জী এই অধমের ওপরও একটু আপনার কৃপাদৃষ্টি করুন। এই প্রহরের সাথে থেকে থেকে আমি নিজেও সিঙ্গেল থেকে গেলাম। এখন আপনিই কোন চমৎকার করেন। সিঙ্গেল মরতে চাইনা ভাবিজী।

খুশি এক হাত উঠিয়ে ঋষি মুনিদের মতে করে বললো।
–চিন্তা করোনা বৎস। এই মহান দয়াময় মাতা খুশি সবার কল্যাণে নিয়জিত। তোমারও একটা গতি করে দেবে সে। সো জাস্ট চিল বৎস।

খুশির কথা বলার ভঙ্গি দেখে ফাহিম হেঁসে দিল। খুশিও খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো।

প্রহর কফি হাতে বাইরে এসে দেখলো খুশি আর ফাহিম আড্ডা জমিয়ে বসে আছে। দুজনে হাসির ঝর্ণা বইয়ে দিচ্ছে। প্রহরের ভ্রু কুঁচকে এলো। ব্যাপার টা ওর কেমন যেন লাগছে। এ্যাক্সুয়ালি কেমন লাগছে সেটা ওর নিজেরও বোধগম্য হচ্ছে না। প্রহর গলা খাঁকারি দিয়ে ফাহিমকে ডাক দিয়ে বললো।
–ফাহিম তোর জন্য কফি এনেছি।

ফাহিম বলে উঠলো।
–আমি এখন কফি খাবোনা। তুই খা।
কথাটা বলে ফাহিম আবারও খুশির সাথে আড্ডা দিতে লাগলো। ওদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে। প্রহর যেন এখানে আনওয়ান্টেড পারসন হিসেবে চলে এসেছে। ব্যাপার টা কেন যেন গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না প্রহরের কাছে।

প্রহর ওদের থেকে কিছুটা দূরে পেছনে পুল সাইডে রাখা একটা গোল টেবিলের চেয়ারে বসলো। কফি খেতে খেতে আরচোখে ওদের দেখছে। দুজন কথার ফুলঝুরি জ্বালিয়ে নিয়েছে।হাসিতো যেন থামছেই না। আবার হাসতে হাসতে দুজন হাত মিলিয়ে হাই ফাই দিচ্ছে। কি এতো কথা বলছে শুনি? রোজ তো আমার পেছনে ঘুরঘুর করে। আর আজ যেন আমাকে চোখেই পড়ছে না তার। যেন আমি এখানে ইনভিজিবাল। ফাহিমের সাথে খুব ভাব জমেছে তার। প্রহরের হাত পায়ের ভেতর কেমন শিনশিন করছে। কেমন একটা অধীরতা কাজ করছে। তখনকার ফাহিমের বলা কথাটা মনে পড়ছে ওর। কোথাও যেন জ্বলন অনুভব করছে ও। দ্রুত ক্রমে পা উপর নিচে নাচাচ্ছে শুধু। হঠাৎ করেই কেন যেন রাগ লাগতে শুরু হলো ওর। স্বাদহীন ব্লাক কফিটা আজ যেন আরও বেশি তিক্ত লাগছে। কি হচ্ছে এসব আমার সাথে? ওই মেয়ে যা খুশি তাই করুক তাতে আমার কি? ওই মেয়ে আমার থেকে যত দূরে থাকে ততই তো ভালো। তাহলে আমার এমন লাগছে কেন? এমন ইরিটেশন হচ্ছে কেন? বাই এনি চান্স আমি কি জেলাস হচ্ছি? লাইক রিয়েলি? আমি আর জেলাস? তাও আবার আমারই বন্ধুর ওপর? প্রহর তোর মাথাটা সত্যিই গেছে। এই মেয়েটা সত্যিই তোর মাথা নষ্ট করে দিয়েছে। ইউ হ্যাভ টু রিফ্রেশ ইউরসেল্ফ। ওই পুঁচকে মেয়েটার কাছে আমি হেরে যেতে পারি না। নো চান্স।
প্রহর নিজের ওপরই বিরক্ত হয়ে ওখান থেকে উঠে গেল।

ফার্মের সব কাজ শেষে প্রহর বাসার ভেতর এসেছে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। উপরে এসে নিজের রুমের দরজা খুলে সামনে তাকাতেই থমকে গেল প্রহর। রুমের ভেতর খুশি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তার ভেজা চুল ঝাড়ছে।তার পড়নে প্রহরের একটা সাদা শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। যা খুশির জন্য ফুল প্যান্ট বলা যায়। খুশির শরীরে নিজের জামাকাপড় দেখে রাগ হওয়ার কথা হলেও কেন যেন রাগ হচ্ছে না। বরং উল্টো খুশিকে এইভাবে দেখে কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে ওর।আশেপাশের সবকিছুর থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে ওর। সদ্য শাওয়ার নেওয়া খুশির স্নিগ্ধতা যেন প্রহরকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মোহিত করে দিচ্ছে। বুকের বাম পাশে জঙধরা কোন কিছু যেন জেগে উঠে নতুন উদ্যমে চলা শুরু করছে।

আয়নায় প্রহরকে দেখে পেছনে ফিরে তাকালো খুশি। প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–আরে তুমি, ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? চুপিচুপি চেক আউট হচ্ছিল বুঝি হ্যাঁ? আমাকে অনেক হট লাগছে বুঝি? আরে দেখতে চাইলে সরাসরি দেখনা। আমি তো তোমারই।
কথাটা বলেই খুশি দুষ্টু হেসে চোখ মেরে দিল।

প্রহর অপ্রস্তুত হয়ে বললো।
–শ শাট আপ ইডিয়ট। তুমি আমার রুমে কি করছ? আর আমার জামাকাপড় পড়েছ কেন?

–আরে এখানে আমার তোমার আবার কি? সবইতো আমাদেরই তাইনা? আসলে আমার জামাকাপড় সব কাঁদা ময়লা লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই গোসল করে সেগুলো পরিস্কার করে ড্রাই মেশিনে শুকাতে দিয়েছি। আর আমার পড়ার কিছু ছিলনা তাই তোমার জামাকাপড় পড়ে নিয়েছি। আমার জামাকাপড় শুঁকিয়ে গেলে চেঞ্জ করে নিবো।

প্রহরের কেমন গলা শুঁকিয়ে আসছে। আর বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ওর সর্বনাশ অবধারিত। তাই সে ওখান থেকে চলে যেতে উদ্যোত হলো। উল্টো ঘুরে এক কদম বাড়াতেই হঠাৎ কিছু একটা ভেবে প্রহর আবারও খুশির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–শোন, যতক্ষণ তোমার কাপড়চোপড় না শুকায়। ততক্ষণ নিচে যাওয়ার দরকার নেই। এখানেই থাক। চেঞ্জ করে তারপরেই বের হবে বুজেছ?

খুশি মাথা ঝাকালো। মানে সে বুঝেছে। প্রহর আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে চলে এলো ওখান থেকে। ওর সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। যেন ধীরে ধীরে সব ওর আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। খুশির মায়াজাল ওকে গ্রাস করার চেষ্টা করছে। প্রহর নিচে এসে সুইমিং পুলে ঝাপ দিল। পানিতে ডুবে নিজের অবাধ্য অনিয়ন্ত্রিত মন মস্তিষ্ককে শান্ত করার চেষ্টা করছে। যদিও তা কতটা কার্যকরী হচ্ছে তা জানা নেই প্রহরের।

ত্রিশ মিনিট পর খুশি চেঞ্জ করে নিচে নেমে এলো। প্রহর আর ফাহিম সুইমিং পুলের পাশেই বসেছিল। খুশি ওদের কাছে এসে বললো।
–এখন যেতে হবে আমার। নাহলে বাসায় যেতে দেরি হয়ে যাবে। বাই।
কথাটা বলে খুশি যেতে নিলে প্রহর বললো।
–তুমি একাই যাবে?

–হ্যাঁ, তো দোকা কই পাবো? আসার সময় তো একাই এসেছি।

ফাহিম বলে উঠলো।
–আরে ভাবিজী আপনার দেবর থাকতে আপনি একা কেন যাবেন? চলুন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসছি।

–আরে না না আমি একাই যেতে পারবো। আপনার কষ্ট করতে হবে না।

প্রহর দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–বেশি স্মার্টনেস দেখাতে হবে না তোমাকে। একা যাওয়ার কোন দরকার নেই। পরে কিছু হয়ে গেলে সেই দ্বায়ভার আমাকেই নিতে হবে।
প্রহর এবার ফাহিমের দিকে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–তোর এসব ঝামেলা নেওয়ার দরকার নেই। আমিই ওকে নামিয়ে দিয়ে আসছি।

ফাহিম বাঁকা হেসে বললো।
–ইয়েস বস। যাহা আপনি বলিবেন।

অতঃপর প্রহর খুশিকে নিয়ে গাড়িতে রওয়ানা হলো। খুশি গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে জানালার ওপর হাত রেখে, তাতে থুতনি ঠেকিয়ে বাইরের হাওয়া খাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে মুচকি হেসে মুহূর্ত টা উপভোগ করছে। বাতাসে চুলগুলো উড়ছে তার। গাড়ি চালানোর মাঝেই প্রহর আরচোখে তাকাচ্ছে খুশির দিকে। খুশির নিস্পাপ মায়াবী মুখের মায়া যেন ধীরে ধীরে প্রহরের সর্বত্র জুড়ে ছেয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন কালাযাদু করে বস করছে ওকে। এই প্রথম কারোর কাছে হেরে যাওয়ার ভয় হচ্ছে। এই নতুন আবহে ভেসে যাওয়ার ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তবে কি খুশি ওর এতবছরের গড়ে তোলা দেয়াল টা ভেঙে দিল? এখন কি করবে ও? কি করে এই অধই সমুদ্রে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাবে নিজেকে?

প্রহরের ভাবনার মাঝেই ওরা খুশির বাসার সামনে চলে এলো। আজ কেন যেন প্রহরের মনে হচ্ছে রাস্তাটা অনেক তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল। খুশি নামার আগে সেদিনের মতো আবারও বলে উঠলো।
–প্রহর ওই দেখ ওটা কি?

প্রহর ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠলো।
–তোমার কি আমাকে এতটাই বোকা মনে হয়? একই ট্রিকস কতবার এপ্লাই করতে চাও?

খুশি ইনোসেন্ট ভাব ধরে বললো।
–আমি আর ট্রিকস? হায় এতবড় মিথ্যে অপবাদ জাতি সইবে না। আমার মতো মাছুম, ইনোসেন্ট, কুচ্চু, পুচ্চু, বাচ্চার নামে এমন অপবাদ শোনার আগে আমি কানে হেডফোন কেন লাগিয়ে নিলাম না? কেহ দো কি ইয়ে ঝুট হে।

–হয়েছে তোমার ড্রামা? ইউ ক্যান গো নাউ।

খুশি একটা ভেংচি কেটে গাড়ির দরজা খুলে এক পা বেড় করলো। প্রহর সামনে তাকাতেই খুশি ফট করে ঘুরে এসে চুমু দিয়ে দিল। কার্য সিদ্ধি করে বেড়িয়ে যেতে যেতে বললো।
–“জো মে বলতাহু, ও মে কারতাহু। জো মে নেহি বোলতা ও তো মে ডেফিনেটলি কারতাহু।”
তারপর হাসতে হাসতে দৌড়ে চলে গেল।

প্রহর কিছুক্ষণ মূর্তির মতো তাকিয়ে রইলো। তারপর সিটের সাথে মাথা এলিয়ে হঠাৎই নিচের ঠোঁট কামড়ে হেঁসে উঠলো। বুকের যন্ত্র টার গতি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেল। প্রহর বুকের বাম পাশে হাত রেখে বিড়বিড় করে বললো।
–শান্ত হ ভাই। এখন কি লাফিয়ে বাইরে চলে আসবি নাকি?

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে প্রহর আবারও ব্যাক করলো। সে আবার ফার্মহাউসেই ফিরে এলো। ফিরে আসার কিছু সময় পর ফাহিমও চলে গেল। প্রহর পুল সাইডে বসে শূন্য চোখে পুলের পানির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের সামনে ভাসছে শুধুই খুশির সেই প্রাণবন্ত মুখখানা। আর মাথায় চলছে আকাশ পাতাল ভাবনার বেড়াজাল। ভাবনায় ছেদ পড়লো রোজিনা বেগমের আগমনে। রোজিনা বেগম প্রহরের জন্য কফ নিয়ে এসেছে। গরম কফির মগটা প্রহরের দিকে এগিয়ে দিলো। প্রহর কফির মগটা হাতে নিল। তখনই ওর নজর পড়লো রোজিনা বেগমের হাতের দিকে। রোজিনার বেগমের হাতে একটা ব্রেসলেট দেখতে পেল প্রহর। যেটা সে বোধহয় খুশির হাতে দেখেছিল। প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–চাচী কিছু মনে করবেন না কিন্তু এটাতো বোধহয় খুশির তাইনা?

রোজিনা বেগম হাসিমুখে বললো।
–যে প্রহর বাবা, এইডা খুশি ম্যাডামের। আমারে দিয়া দিছে। মাইয়াডা খুবই ভালো। আমি খালি কইছিলাম আপনের হাতের এইডা মেলা সুন্দর। আমার মাইয়ারেও একটা কিনা দিমু। কত দাম এইডার? হেই কথা হুইনা সে সাথে সাথে আমারে এইডা খুইলা দিয়া দিলো। কইলো তোমার মেয়েরে দিয়ে দিও। এটা আমার পক্ষ থেকে গিফট। আমি কতো মানা করলাম হুনলোই না। হাচা কইতাছি এমন সাফ মনের মাইয়া পাওন যায়না। আজকাল কার জামানায় যেইহানে ধনী লোকেরা গরীব গো ঘেন্নার চোখে দেখে। সেইহানে এই মাইয়াডা কি সুন্দর একদিনেই এক্কেরে আপন কইরা লইছে আমগো।সারাদিন আমগো লগে কত্তো মিইল্যা মিশা কাটাইলো। যেন আমরা হের আপন লোক। মাইয়াডার সাথে সময় কাটাইয়া আমগোও অনেক ভালো লাগছে। আপনে কিছু মনে না করলে একখান কথা কইতাম।

–বলুন না চাচী। জিজ্ঞেস করার কি আছে?

–প্রহর বাবা, মাইয়াডা হাচাই আপনেরে অনেক ভালোবাসে। আমি মাইয়াডার চোখে সেইডা দেখছি। আপনে ভাইবা দেখেন একটু। ছোট মুখে একখান কথা কই আপনেরে। মাইনষের জীবনে সত্য ভালোবাসা পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। তয় সবচেয়ে দূর্ভাগা ওই মানুষ, যে সেটা সময় থাকতে চিনবার পারেনা। মেলা কথা কইলাম ভুল হইলে মাফ করবেন।
কথাগুলো বলে রোজিনা বেগম চলে গেল।

আর পেছনে প্রহরের ভাবনা যেন আরও পাহাড় সমান রুপ ধারণ করলো। এলোমেলো সবকিছু যেন আরও ছন্নছাড়া হয়ে গেল।খুশি যে একটা সরল মনের মেয়ে এই ব্যাপার টা ও নিজেও বুঝতে পারছে। এই প্রথম কারোর ওপর বিশ্বাস করতে মন চাচ্ছে ওর। তবে খুশি কি পারবে ওর বিশ্বাসের মান রাখতে?
__

খুশি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাঁটছে। তখনই দরজায় টোকা পড়লো। খুশি সেদিকে তাকিয়ে দেখলো ওর ফুপি বেলি এসেছে। খুশি আনন্দচিত্তে উঠে দাঁড়িয়ে বললো।
–ফুপি……
দৌড়ে গিয়ে বেলিকে জড়িয়ে ধরে বললো।
–ওয়াও ফুপি তুমি এসেছ। জানো কতো মিস করেছি তোমাকে? মিস করতে করতে আমি নিজেই মিসিং জাচ্ছিলাম।

বেলি ভেতরে এসে বেডের ওপর বসে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ কতো মিস করেছিস তা জানা আছে। এইজন্যই তো একটা ফোনও করিসনি। এখন নওটাঙ্কি করে লাভ নেই। চকলেট একটাও পাবি না। যা সর।

খুশি তার ওভার অল মেলোড্রামা চালু করে দিলো। কপালে হাত ঠেকিয়ে দুখিয়ারি ভাব ধরে বললো।
–নেহি নেহি,, এই অবলা নারীর সাথে এতো অবিচার কইরেন না। ♬ কইরেন না কইরেন না ফুপিজান গো, ও ফুপিজান কইরেন না এমন গোওওও… আমার ফুপিইই.. ফুপিজান গোওওও…

বেলি হেঁসে দিয়ে বললো।
–হইছে হইছে আর ড্রামা করতে হবে না। তুই পারিসও বটে।

খুশিও হেঁসে দিয়ে বেলির কাঁধ জড়িয়ে ধরে দুষ্টুমি করে বললো।
–তো টুরে কেমন মজা করলে? ওখানে কোন ফুপার টুপার সন্ধান পেলে নাকি?

বেলি খুশির মাথায় আলতো করে চাপড় মেরে বললো।
–বদমাশ মেয়ে। মুখে কিছুই আটকায় না তাইনা? আমি একজন টিচার।আমি ওখানে স্কুলের স্টুডেন্ট দের নিয়ে টুরে গিয়েছিলাম। তোর ফুপা খুঁজতে নয়।

–হ্যাঁ তো কি হয়েছে? টিচার হয়ে কি প্রেম করা যায় না নাকি? কিন্তু তুমি তা করবে কেন? তুমি তো তোমার না হওয়া বয়ফ্রেন্ডের শোকে সারাজীবন কাটিয়ে দিবে। ফুপি এতো বছর হয়ে গেছে তবুও তুমি তোমার অতীত ভুলতে পারলে না? যে ব্যাক্তি তোমাকে হয়তো মনেও রাখেনি তার জন্য তুমি তোমার জীবন কেন নষ্ট করছো?

বেলি শান্ত সুরে বললো।
–এতে তার কি দোষ আছে? সেতো আর জানতো না আমি তাকে ভালোবাসি। সেতো শুধু আমাকে তার বন্ধু ভাবতো। দোষ তো আমারই। আমিই বলতে দেরি করে ফেলেছি। ততদিনে সে অন্য কাওকে মন দিয়ে দিয়েছে। আর দুটো ভালোবাসার মানুষের মাঝে আসার আমি কে?

খুশি ক্ষোভ নিয়ে বললো।
–কে মানে? অ্যাম শিওর ওই লোকটাকে তোমার চেয়ে বেশি ভালো আর কেউই বাসতে পারবেনা। আরে তুমি এতো সহজে কেন হার মেনে নিলে? একবার বলেতো দেখতে? আমি হলে কখনোই এতো সহজে হার মানতাম না। অন্তত মনের কথা টা তো বলতাম। তারপর সে ডিসাইড করতো সে কাকে চায়।

–এতো সহজ না। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়াটা বড় কথা না। তার খুশিটাই বড়। সে যাতে খুশি থাকে সেটাই মেনে নেওয়া ভালো।

–বুঝলাম। কিন্তু তুমি তো তাকে ভুলে জীবনে সামনে এগুতে পারছোনা। তাকে ভুলে গিয়ে অন্য কাওকে বিয়ে কেন করে নিচ্ছো না? ভুলে যাও ওই স্বার্থপর লোককে।

–এটা যে সম্ভব নারে। তাকে পাই বা না পাই। কিন্তু মনটা তো তার নামেই লেখা।এখন অন্য কাওকে যে আর ভালোবাসতে পারবোনা। এমনিতেও বুড়িই হয়ে গেছি। বাকি জীবনও তার স্মৃতি আকড়ে ধরে খুশি খুশি কাটিয়ে দিবো। এটাতেও এক অন্য রকম আনন্দ আছে। তুই এখন এসব বুঝবি না। যখন কাওকে মনে প্রাণে ভালোবাসবি তখন বুঝবি।

বেলির কথায় খুশির বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো। সেও যে এখন কাওকে ভালোবাসে। মনে প্রাণে ভালোবাসে। ওর ভালোবাসার পরিণতিও যদি ফুপির মতো হয় তাহলে কি করবে ও? প্রহর যদি কখনো ওকে ভালো না বাসে তাহলে? ও কি পারবে প্রহরকে ছাড়া বাঁচতে? ফুপির মতো ওযে এতো শক্ত না। ও হয়তো মরেই যাবে। প্রহর বিনা এই জীবনের কল্পনা করাও যেন ওর জন্য অসম্ভব। কি হবে ওর ভালোবাসার পরিণতি?

চলবে…….