অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-৪০+৪১

0
778

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৪০ 🎆❤🎆

ধুরু ধুরু বুক নিয়ে নিজের বাসা থেকেই নীলা একপ্রকার চোরের মতো বের হয়েছে। কাল যেই মেয়ের বিয়ে আজ যদি সে এতো রাতে বাড়ির বাহিরে বের হয় নিশ্চয়ই কেউ ভালো বলবে না? তারউপর বাসাভর্তি মেহমান৷ বড়রা এককথার তালে দশকথা বলবে৷
শান্তর সহযোগিতায় সবার নজর এড়িয়ে নীলা গেট পেরিয়ে বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো। এদিক-ওদিক তাকানোর প্রয়োজন পরেনি। কেননা সাদিদ তার সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু সবসময়কার মতো পাশে তার গাড়িটি নয় বরং প্যাডেল চালিত নতুন একটা রিক্সা। রিক্সার চালককে অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। নীলা কপাল কুঁচকে সামনে পা বাড়ালো। নীলাকে দেখে সাদিদও হাঁটা দিলো। দুইজন মুখোমুখি হতেই সাদিদ পিঠ গলিয়ে নীলার কাঁধ চেপে ধরল। বিনাবাক্য তাকে নিয়ে সামনে পা বাড়াতেই নীলা থতমত খেয়ে বলে উঠল,

— ‘ কি করছেন কি? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ‘
— ‘ পালিয়ে যাচ্ছি। ‘
— ‘ মানে? ‘

নীলা যতটাই চেঁচিয়ে বলল সাদিদ ততটাই ফিসফিসিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠল,

— ‘ মানে হচ্ছে আমরা পালিয়ে যাচ্ছি। ‘
— ‘ এসব কি পাগলামি? শুধু শুধু পালিয়ে যাব কেন? সবাইতো বিয়েতে রাজি তাহলে এসব কেন? ‘

নীলার অতিরিক্ত বকবকানিতে সাদিদ এবার বিরক্তমাখা দৃষ্টিতে তার মুখপানে নজর দিলো। নীলা একটু দমে গেলেও নিচুস্বরে বকবক করছে।
সাদিদ একপলক ডানে-বামে তাকিয়ে নীলার এতো প্রশ্নের উত্তরে তাকে সোজা পাঁজাকোলে নিয়ে নিলো। এতক্ষণ বোধহয় নীলার দম আটকে আসার এটার-ই কমতি ছিল। যা সাদিদ এখন ষোলো আনায় পূরণ করেছে।

— ‘ আপনি এসব কি করছেন? আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছে। প্লিজ দোহায় লাগি এমন পাগলামি করবেন না৷ আম্মু-আব্বু নির্ঘাত হার্ট এট্যাক করে ফেলবে। ‘

নীলা অনবরত সাদিদের নিকট ছেড়ে দেওয়ার জন্য আকুতি জানাচ্ছে। নিজেও তার থেকে ছাড়া পাবার জন্য জোর খাটিয়ে চলেছে। কিন্তু সাদিদের মতো শক্ত সার্মথ্যবান পুরুষের সঙ্গে কি নীলার মতো চুনিপুট্টি মেয়ে পারে?
সাদিদ নীলার এতকথার পরিবর্তে নিশ্চুপ রইল। কোলে নিয়েই তাকে রিক্সায় বসালো। নিজেও পাশে বসে চোখের পলকেই হুড উঠিয়ে নীলার ঠোঁট দুটো আঙুল দিয়ে চেপে ধরল।
নীলা ঠাগর ঠাগর চোখগুলো আরও খানিকটা বড় করে সাদিদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার অবুঝ মস্তিষ্ক শুধু এটাই জানতে ইচ্ছুক সামনে বসা এই ছেলেটা এখন কি করতে চায়ছে?
নীলার প্রশ্নের উত্তর দিতেই বোধহয় সাদিদ এগিয়ে আসলো। মধ্যকার সবটুকু দুরত্ব মিটিয়ে আলতো করে অপরহাতে নীলার গাল স্পর্শ করলো। অপরহাতটা এখনও নীলার ঠোঁটজোড়ায় স্থির। সে দুষ্টুমি করে আঙুল দিয়ে তার কোমল ঠোঁটে ছোট্ট করে চিমটি কাটলো।

— ‘ আউচ। ‘
— ‘ ব্যাথা পেয়েছ? ‘
— ‘ ব্যাথা দিয়ে বলছেন ব্যাথা পেয়েছি কি-না? ‘
— ‘ এরথেকেও তো বেশি ব্যাথা দেই। তখন তো কিছু বলো না। ‘

নীলা কয়েক সেকেন্ড থমকে রইল। মস্তিষ্কে কথাটা সম্পূর্ণরূপে পৌঁছাতেই মুখজোড়ে রক্তিম আভায় ছেয়ে গেল। লজ্জায় যেন তার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এতো নির্লজ্জ ছেলে কিভাবে হয়?
নীলাকে লজ্জায় চুপসে যেতে দেখে সাদিদ বরাবরের মতোই ভীষণ মজা পেল। আরও জ্বালাতে কানে ঠোঁট লাগিয়ে নেশাধরানো স্বরে বলল,

— ‘ তখন সহ্য করো? না-কি উপভোগ করো? ‘

নীলার আর পারল না। কান দিয়ে যেন গরম ধোয়া বের হচ্ছে। লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে সাদিদের বুকে মুখ গুঁজল।

— ‘ অসভ্য, নির্লজ্জ ঠোঁটকাটা পুরুষ। ‘

সাদিদ নীলার অভিযোগে হেসে ফেলল। কিন্তু অভিযোগের পাল্টা জবাব এই মুহূর্তে আর দিলো না। শুধু নিজের একহাত দিয়ে নীলার পিঠ জড়িয়ে ভালোকরে আঁকড়ে ধরল। আর অপরহাতে ফোন বের করে কাউকে কল করল। অল্প কিছুসময়ের মধ্যেই মধ্যবয়স্ক একজন পুরুষ সামনে আসতেই সাদিদ বলে উঠল,

— ‘ মামা, এইবার যেতে পারেন। ‘
— ‘ কেডা? ভাবী না আপা? ‘

সাদিদ হাসল। খুব সহজেই বুঝতে পারল রিক্সা চালকের প্রশ্নটা। তাই একপলক নীলার মুখপানে তাকিয়ে বলল,

— ‘ আমার বউ৷ সেই হিসেবে কি ডাকবেন সেটা আপনিই ঠিক করেন। ‘

রিক্সা চালক পানে লাল হওয়া দাঁত বের করে হেসে রিক্সায় টান দিলো। ততক্ষণে নীলা নিজেকে ঠিক করে নিয়েছে। কিন্তু তার মাথায় এখনও প্রশ্নের একঝাঁক মিলে কিলবিল করছে। তাই সহ্য করতে না পেরে নিচুস্বরে বলল,

— ‘ এসব কি হচ্ছে বলুন না? আমি আর নিতে পারছি না। ‘
— ‘ কি হচ্ছে? ‘
— ‘ ধ্যত। ‘

নীলা মুখ ফুলিয়ে অপরদিকে মুখ করে বসল। সাদিদ অভিমানিনীর অভিমান ভরা মুখশ্রী নিষ্পলক অবলোকন করল। অতঃপর খুব ধীরে মোহনীয় স্বরে কর্ণদ্বারে মুখ নিয়ে বলল,

— ‘ প্রেম করছি। অন্যসবার দৃষ্টিতে ব্যাচেলর। কিন্তু নিজের দৃষ্টিতে বিবাহিত। তাই সবমিলিয়ে বিবাহিত ব্যাচলরের অন্তিম মুহূর্তে প্রিয়তমারূপী প্রেয়সীর সঙ্গে প্রেম করছি। কাল থেকে হয়তো প্রেমের ধরণটা ভিন্ন হবে তাই শেষ সময়টুকু স্মৃতির পাতায় অম্লান করতে চাই৷ রাতের নিস্তব্ধতায় হলুদরঙা বউকে নিয়ে রিক্সায় চড়ে ঘুমন্ত এই ঢাকার রাস্তায় প্রেম করতে চাই। ‘

বাক্যগুলোকে কি এমন ছিল নীলার সেটা অজানা। কিন্তু এসব শুনে নীলার শ্বাসগুলো মুহূর্তেই দ্রুত হতে লাগল। সাদিদকে আর প্রশ্ন করে নিজের অবস্থা খারাপ করতে চাইল না। তাই চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইল।
সাদিদ নিঃশব্দে ঠোঁট প্রসারিত করল। সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে কোমড় চেপে নীলাকে নিজের সাথে মিশিয়ে বসিয়ে নিলো।
নীলা চমকিত দৃষ্টিতে তাকালো।
কিন্তু সাদিদের ঐ ঘোরলাগা চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। দৃষ্টিনত করল।
রাতের নিস্তব্ধতায় রিক্সার চাকার ঘর্ষনের শব্দগুলো ভীষণ দাগকাটা। তারউপর ইংরেজি মাসের নভেম্বরের শেষ পর্যায়। তাই প্রকৃতিতে বেশ শীতলভাব। সাদিদ নীলার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। তারই ভুল হয়েছে। তখন যেভাবে আছে ঐভাবেই আসতে বলা উচিত হয়নি। সঙ্গে মোটা কাপড় বা চাদর টাইপের কিছু নিয়ে আসার কথা বলার দরকার ছিল। কিন্তু ভুল যেহেতু করেই ফেলেছে এখন আর কি করবে? তাই আপাতত যেটা সাথে আছে সেটা দিয়েই কাজ চালাবে। তাই পাঞ্জাবির উপর থেকে নিজের মোটা কটিটা খুলে সে নীলার শরীরে দিয়ে দিলো। এতক্ষণে যেন নীরবতার সমাপ্তি ঘটেছে।

— ‘ এটা দিচ্ছেন কেন? ‘
— ‘ আমার গরম লাগছে, তাই। ‘
— ‘ কিন্তু বাহিরে তো ঠান্ডা বাতাশ। ‘

সাদিদ আলতো করে নীলার নাকটা টেনে দিলো। তারপর বলল,

— ‘ বোকা মেয়ে, সেইজন্যই দিচ্ছি। ‘

নীলাও বুঝতে পারল। কিন্তু সাদিদের নিজেরও ঠান্ডা লাগবে। তাই কটি সরাতে সরাতে বলল,

— ‘ আমার শরীরে শাড়ি রয়েছে। এটা বরং আপনি রাখেন৷ আমার এতটাও ঠান্ডা লাগছে না৷ ‘

সাদিদ রাগীচোখে বিনাবাক্য তাকে শাসালো। অতঃপর আবারও ঠিকঠাকভাবে নীলার শরীরে ভালোভাবে সেটা মুড়িয়ে দিলো। এতটুকুতেই ক্ষান্ত হলো না। নিজের উষ্ণ শরীরের তাপটুকুও নিজের কলিজাটার জন্য বরাদ্দ করলো। নীলাকে নিজের সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে সাদিদ এবার খানিকটা দুষ্টুমিস্বরে বলল,

— ‘ এখন এতটুকুই৷ আর উষ্ণতা দেওয়ার।জন্য এটা পারফেক্ট জায়গা নয়। আপাতত এতটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। ‘

নীলা কনুই দিয়ে সাদিদকে খোঁচা দিলো। আর বিড়বিড়িয়ে আবারও বলে উঠল,

— ‘ একেবারে অসভ্য পুরুষ । ‘

_________________

সবার নজর এড়িয়ে নীলাকে বাহিরে পৌঁছে দিয়ে যেন শান্ত হাফ ছাড়ল। নতুবা একদিকে সাদিদের ত্যাড়ামি তার কিছুটা হলেও জানা। আর অপরদিকে দাদি-ফুফুদের হাজার খানেক প্রশ্নের সম্মুখীন। সবগুলো থেকে যে নিস্তার মিলেছে তাই শান্ত পারছে না কয়েকটা ডিংকা-চিংকা মার্কা নাচ দিতে। কিন্তু তার খুশি বোধহয় কারো খুব একটা সহ্য হলো না। সিঁড়ি বেয়ে উপরে যেতে নিলেই কেউ তার মুখ চেপে টেনে হিঁচড়ে লোকচক্ষুর আড়ালে নিতে লাগল। সে সমানে নিজেকে ছাড়াতে মোচড়ামুচড়ি করছে আর মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে উমম উমম করছে। এদিকের লাইটগুলো বন্ধ। পার্কিং এড়িয়াতে এইমুহূর্তে কয়েকটা গাড়ি ব্যাতিত জনসমাগম নেই বললেই চলে৷ এখানেই একটা গাড়ির পিছনে এনে শান্তকে ছাড়া হলো। নিজেকে মুক্ত পেয়ে শান্তর মাথায় প্রথমেই যা আসলো তা হলো ভাগ শান্ত ভাগ।
কিন্তু মনের ভাবনা মনেতেই রইল। কেননা পূরণ করার সময় পাওয়া গেল না৷ আবারও শক্তপোক্ত হাতটা তার হাত চেপে ধরল। রাগে রণমুর্তি হয়ে শান্তকে পার্ক করা একটা গাড়ির দরজার সাথে চেপে ধরতেই শান্তর মুখটা আপনাআপনি খুলে গেল। আধা আলো-অন্ধকারে তানবীরের মুখটা শান্তর কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট। তার মুখ দিয়ে ধীরেস্বরে বেড়িয়ে আসলো,

— ‘ আপনি? ‘

সামনে থেকে কোনো প্রতিউত্তর এলো না। এতক্ষণের রাগী মুখটাতে যেন মুহূর্তেই অন্ধকার নেমে আসলো৷ তানবীর মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। কিন্তু শান্তকে ছাড়ল না।
তার অনুপস্থিততে মনের কোঠায় হাজারও অভিযোগ জমা করলেও এখন যেন সব ফিকে পরছে। এতো কিউট মুখের দিকে তাকিয়ে রাগ ধরে রাখা যায়?
শান্তও পারল না। কিন্তু তানবীরের কাছে স্বীকারও করল না। আগের মতোই ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,

— ‘ কি চান? এমন করে ধরে আনার মানে কি? ‘

তানবীর এবারও উত্তর দিলো না৷ শুধু হাতের বাঁধনটুকু আরও শক্ত করল। শান্তর এতে বেশ লাগল। তারপরও সহ্য করে নিলো। কিন্তু তেজ দেখিয়ে বলল,

— ‘ হাত ছাড়ুন বলছি৷ কেন এসেছেন এখানে? ছাড়ুন বলছি। আমি উপরে যাব। ‘
— ‘ কোথাও যেতে পারবি না৷ ‘
— ‘ কেন? কেন যেতে পারব না? মামার বাড়ির আবদার না-কি? ‘
— ‘ আমার মামা-টামা নাই। তাই আবাদারও নাই। আর আমিতো ভুলেও তোকে আবদার করবো না৷ ‘

শান্তর কথাটা গায়ে লাগল। এইজন্যই ছেলেটার সাথে ঝগড়া হয়েছে। শুধু বলেছিল শান্তর সামনে নিজেকে পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাবা-মায়ের সামনে যেন এই এটিটিউড না দেখায়। কোন মেয়ে না চায়, নিজের পছন্দের মানুষকে বাবা-মায়ের সামনে উঁচু করে দেখাতে?
শান্ত এমনটা ভেবেই খোলা মনে তানবীরকে বলে দিয়েছিল৷ আর এই একটা কথার পরিপ্রেক্ষিতে এই ছেলে গাল ফুলিয়ে বসেছে।
সে না-কি তাকে মন থেকে মানে না। নতুবা তাকে নিয়ে এতটা সংকোচ থাকত না। মুখে যতই বলুক কিন্তু শান্তর থেকে তার নিয়ন্ত্রণহীন মন মস্তিষ্ক বরাবরই পজিটিভ কিছু আশা করে এসেছে। তাই হুট করে শান্তর তাকে নিয়ে অভিযোগটা সে সহ্য করতে পারেনি৷ সহ্যের থেকে বেশি বোধহয় ভয় হচ্ছিল। আবারও হারিয়ে ফেলার ভয়।

— ‘ দরকার নেই আপনার আবদারের। আপনার এসব আবদারের আমি ধারদারি না। ‘
— ‘ মুখ আজকাল বেশিই চলে? ‘
— ‘ বরাবরই চলে এসেছে। ‘

তানবীরের রাগ উঠে যাচ্ছে। হাতের মুঠিতে ধরে রাখা শান্তর হাতটা আরেকটু জোরে চেপে ধরতেই শান্ত এবার নিয়ন্ত্রণহীন ব্যাথায় শব্দ করলো। চোখজোড়াও ম্লান হলো। তানবীরের রাগ মুহূর্তেই যেন নেমে গেল। ব্যস্ত হয়ে শান্তর হাত ধরতে গেলেই সে রাগে-অভিমানে ঝাড়া দিলো। আর সামনে এগিয়ে যেতে নিলো। তানবীর দ্রুত পাশে পিছন থেকে ধরে নিলো। শান্ত জোর খাটাতে চাইলেই কোনোকিছু চিন্তা না করে হেঁচকা টানে বুকে এনে ফেলল।
শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

— ‘ একদম রাগ তুলবি না৷ নতুবা কি করব নিজেও জানি না৷ ‘
— ‘ রাগ তোলার আর বাকি কি আছে? এমনিতেই কম করেছেন নাকি? ‘
— ‘ শান্ত মাথা খারাপ করবি না। তুই জানিস আমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারি না৷ ‘
— ‘ হ্যাঁ জানি৷ আর তাইতো আমার দায় পরেছে৷ ‘
— ‘ শান্ত। ‘

তানবীরের রাগীস্বরের চিৎকারে শান্ত এবার থেমে গেল। কিন্তু চোখগুলো টলমল করে উঠল। তানবীর একপলক অশ্রুসিক্ত ঐ চোখে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলো। বারকয়েক জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে ঠিক করতে চাইল। আর নিজের মধ্যেকার রাগটাকেও দমন করার প্রয়াস চালালো।
শান্ত এতক্ষণ চুপ থাকলেও অভিমানী মন আবারও তেতে উঠল। নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই তানবীর তাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। মাথাটা শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বলল,

— ‘ শুধু রাগটাই দেখলি? রাগের পিছনের কারণটা দেখলি না? ‘

তানবীরের নরম কন্ঠস্বরটা যেন শান্তকে ভিতর থেকে ভেঙে ফেলল। এই ছেলেটার কঠিন কথাগুলোই ভালো। নতুবা নরম স্বরটা যেন শান্তর গলা চেপে ধরে। শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় তার।
সে অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ রাগটা কমাতে বলা কি অন্যায় হয়েছে? ‘
— ‘ শুধু এতটুকুই? আর কিছু না? ‘
— ‘ আর কি? ‘
— ‘ কে বলেছে এমন করলে চলে যাবে? এমন করলে আমার সাথে আর থাকবে না? ‘

শান্ত সাথে সাথেই মাথা উঠিয়ে তানবীরের দিকে তাকালো। তাকে তাকাতে দেখে তানবীর মুখ ফিরিয়ে নিলো। আবারও যেন অভিমান জমেছে। শান্তর ধীরে ধীরে সবটা মনে পড়তে লাগল। আসলেই রাগ উঠলে মানুষের মাথা কাজ করে না। সেদিন এককথায় দুইকথায় শান্তও রেগে যায়। যার ফলস্বরূপ একসময় এই কথাগুলো বলে ফেলে। কিন্তু এতসবের মধ্যে এইকথাগুলোকে সে এতটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু তার কাছে যেগুলো গুরত্বহীন লেগেছে অপরজনের কাছে সেগুলোই তীক্ষ্ণফলার ন্যায়। তাইতো এরপরই তানবীর বিনাবাক্য ফোন কাটে। আর তারপর থেকেই চলছে এই মান-অভিমান পর্ব।
শান্তর এতক্ষণে সবটা মাথায় আসছে কেন তানবীরের হঠাৎ করে এতো রাগ-ক্ষোভ। আসলে এই কথাগুলো সে এতটা গায়ে না লাগালেও তানবীর বেশ আঘাত পেয়েছে। তাইতো এতদিন রাগ করে দূরে ছিল। এইছেলেটা তো নিজেই তার থেকে দূরে থাকতে পারে না৷ রাগ-জেদের পাল্লা এতদিন ভারি থাকলেও আজকে বোধহয় সবকিছুকে পিছনে ফেলে চলে এসেছে।
শান্তর এখন অনুতপ্ততাবোধ হতে লাগল। সে মাথা না তুলেই মিনমিনে স্বরে বলল,

— ‘ আসলে.. আমি এমনটা..
— ‘ সব বলতে পারবি শান্ত। তোর সব রাগ-জেদ সহ্য করব। কিন্তু ছেড়ে চলে যাবার কথা বলিস না প্লিজ। এটা সহ্য হয় না রে। আমি যে বড্ড অসহায়। নিজের বলতে যে সকল মানুষ বোঝায় সেটুকুর আমার বড্ড অভাব। তাই আরও একটু অভাব সহ্য হবে না৷ ‘

বলেই বুকের সাথে শান্তকে শক্ত করে চেপে ধরল। যেন ছাড়লেই শান্ত চলে যাবে৷ আর তানবীর যেটা কখনোই হতে দিবে না৷

_______________

রিক্সা এসে থামল বাসা থেকে অনেকটা দূরে নিরিবিলি একটা পরিবেশে। নিস্তব্ধতায় ভরা রাতে এমন একটা পরিবেশে যেন গা ছমছম করছে। নীলাকে দাঁড় করিয়ে রেখে সাদিদ রিক্সা চালকের সাথে টুকাটুকি কিছু কথা বলল। তারপর দ্রুত পায়ে এসে নীলার হাতটা নিজের মুঠিতে নিতে গিয়ে থমকে গেল। মনেই থাকে না মেহেদীর কথা৷ সে ছোট্ট করে হেসে সরি বলল। তারপর কাঁধে ধরে বলে উঠল,

— ‘ তাহলে যাওয়া যাক? ‘

নীলা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। জিজ্ঞাসা করে আর কি হবে? এখন পর্যন্ত কমবার বলেনি। কিন্তু সাদিদের সেই একি উত্তর। গেলেই দেখতে পাবে। তাই নীলা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল। বেশিক্ষণ হাঁটতে হয়নি। তারপরই সম্মুখে এসব দেখে সে চমকিত দৃষ্টিতে সাদিদের মুখপানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সে নিচের ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসির রেখা। নীলা কয়েককদম ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। অতঃপর আচমকা নিজেদের মধ্যকার সবটুকু দুরত্ব মিটিয়ে সাদিদের বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। সাদিদও হাসিমুখে প্রিয়তমাকে আঁকড়ে ধরল। উঠিয়ে নিলো মাটির স্পর্শ থেকে অনেকটা উঁচুতে। বুক পাঁজরে আঁকড়ে ধরে নীলার চুলে নাক ডুবাতেই সে কাঁপা স্বরের অস্থির কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ এসব আমার জন্য? ‘
— ‘ না আমার মিষ্টি বউয়ের জন্য। তুমি কি আমার বউ? ‘

নীলা ফিক করে হেসে দিলো। সাদিদ তাকে নিচে নামিয়ে নীলার মুখটা আঁজলাভরে ধরে বলে উঠল,

— ‘ আমার বউয়ের ছোট্ট একটা ইচ্ছে। সামর্থ্য থাকা সত্বেও যদি পূরণ না করি তাহলে হয়? ‘
— ‘ আমিতো আপনাকে বলিনি। বুঝলেন কিভাবে? ‘
— ‘ তোমার চোখগুলোই বলে দিয়েছে। সেদিন ছবি দেখার সময় ফানুস দেখে তোমার খুশিতে জ্বলজ্বল করা চোখগুলোই অব্যক্ত কথাগুলো বলে দিলো। ‘
— ‘ এতো কেন বুঝেন? ‘
— ‘ বউ বুঝে না তো। তাই আমাকেই বুঝতে হয়। ‘

নীলা দু’হাতে ছলছল কর চোখগুলো মুছতে গিয়ে হেসে ফেলল। হাতভরা মেহেদী তার। মুছার জায়গা নেই। সাদিদও বুঝতে পেরে মৃদু হেসে যত্ন সহকারে তার ভেজা গালটা মুছিয়ে দিলো। অতঃপর নীলাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
নীলা একপলক সাদিদের দিকে তাকিয়ে আবারও সামনে তাকালো। খুশিতে শব্দগুলো গলায় এসে আটকে গিয়েছে। এত কেন ভালোবাসে তাকে? সে কি আধোও এতটা পাবার যোগ্য?
সাদিদ তাদের একান্ত মুহূর্তটাকে উপভোগ করার জন্য কম আয়োজন করেনি। কিন্তু সবটাই যেন নীলার চিন্তা শক্তির উর্ধে।
মাদুর পেতে তারউপর অসংখ্য সাদা আর লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। ছোট্ট ছোট্ট দুইটা হার্টশেইপ কোশনও রাখা আছে। আর চারপাশে ক্যান্ডেল দিয়ে আলোকিত করা। আর একপাশে অনেকগুলো ফানুস। সাদিদ তাকে নিয়ে মাদুরের উপর বসল। নীলার মুখপানে তাকিয়ে বলল,

— ‘ শুরু করা যাক? ‘
— ‘ অবশ্যই। কোনো সন্দেহ রয়েছে? ‘
— ‘ আজ্ঞে না মহারাণী। ‘

নীলা তার কথায় আবারও মিষ্টি করে হাসল। তারপর দুইজনে মিলে ফানুসগুলো আকাশে উড়িয়ে দিলো। যার প্রতিটাতেই সাদিদ কাস্টমাইজড ‘ সাদিদের নীলাঞ্জনা ‘ কথাটা খোঁদায় করে নিয়েছে।
নীলার খুশি যেন উপচে পরছে। তার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল ফানুস উড়াবে। কিন্তু ইচ্ছেটা পূরণ হয়ে উঠেনি। যা কি-না সাদিদ আজ এইভাবে পূর্ণ করলো। সাদিদ নীলার মুখপানে একপলক তাকিয়ে মাদুরে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। একটা কুশন টান দিয়ে মাথার নিচে দিয়ে অপরহাতে নীলাকেও টান দিলো। নিজের বুকের উপর নীলাকে জড়িয়ে নিয়ে আকাশপানে তাকালো।
আজ আকাশভরা তাঁরাদের মেলা বসেছে। তার সাথে তাদের উড়ানো ফানুসগুলো মিলে একঝাঁক আলো ধাঁধানো সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে৷ আর তারসাথে হালকা ঝিরিঝিরি বাতাশে যেন শুধুই প্রেম প্রেম গন্ধ।
নীলাও গুটিশুটি মেরে সাদিদের বুকে মাথা গুঁজে নাক ঘষলো। আকাশের দিকে তাকাতেই
নীলার মনটা মুহূর্তেই মলিন হলো। সাদিদ তাদের প্রতিটা মুহূর্ত নিয়ে কতটা উৎসুক। কতটা সুন্দরভাবে সে সবকিছু প্ল্যান করে। অথচ এসব দিকে নীলা তার থেকে হাজার মাইল পিছিয়ে। নীলাকে হঠাৎ এমন মিইয়ে যেতে দেখে সাদিদ তার গালে হাত রাখল। উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে নীলা সাথেসাথেই তার দিকে ফিরে তাকালো। আর সাদিদের নজরেও এসে গেল প্রাণপাখির ছলছল করা চোখ, মলিন মুখমণ্ডল।
সাদিদ দ্রুত তাকে টান দিলো। বুকের আরেকটু উপরে তুলে গাল স্পর্শ করলো। কয়েক সেকেন্ডেই যেন তার অস্থিরতা বেড়ে গেল। নীলার দুইগালে হাত দিয়ে কিছুটা ঝাঁকিয়ে বলল,

— ‘ কি হয়েছে পাখি? মুখটা এমন কেন? ‘

নীলা বিনাউত্তরে নতজানু হতেই সাদিদ গালে রাখা হাতটা দিয়ে চেপে ধরে চোখে চোখ মিলালো। মুখ বরাবর ঝুঁকে এসে বলল,

— ‘ আমাকে বলো। তোমার এমন মুখশ্রী আমি সহ্য করতে পারি না জান৷ ‘

সাদিদের অস্থিরতায় ভরা তপ্ত শ্বাস এসে নীলার চোখে-মুখে ভারি খাচ্ছে। আর না চাইতেও সে কিছুটা কেঁপে উঠছে। সাদিদ আবারও অস্থিরতা মিশ্রিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেই সে মলিন স্বরে বলে উঠল,

— ‘ এতদিন এমনটা মনে না হলেও আজ মনে হচ্ছে। আমি বোধহয় আপনার মতো করে ভালোবাসতে পারিনি। আর না বোধহয় কখনও পেরে উঠব। ‘

সাদিদ অবাক হলো। নীলার মাথায় হঠাৎ এমন চিন্তা কেন আসলো? কন্ঠস্বরে চমকিত ভাব নিয়েই সে বলে উঠল,

— ‘ এসব কি বলছো? আর হঠাৎ করে এমনটা মনে হবার-ই বা কারণ কি? ‘
— ‘ কি করব বলেন? এমনটা ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। এই যেমন আজকে আপনি কতকিছু করে ফেললেন। অথচ আমাকে দেখেন এসবের কোনো খেয়াল-ই নেই। সবসময় শুধু আপনিই দিয়ে যান। আপনিই সম্পর্কটাকে স্পেশাল ফিল করান। কিন্তু এটাতো আমাদের দুইজনেরই করা উচিত। কেননা এটাতো আমাদের সম্পর্ক। দুইজনের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক। তাহলে সবসময় কেন শুধু আপনিই করেন? নিজেকে আজ বড্ড ছোট ছোট মনে হচ্ছে। আমি কি খুব খারাপ? আপনি আমাকে সত্যিই ভালোবাসেন তো? ‘

সাদিদ যেন অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। কি বলছে নীলা এসব? কিন্তু কয়েক পলক অতিবাহিত করে সাদিদ হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতে যেন পেটে খিল ধরে যাবার অবস্থা। নিস্তব্ধ পরিবেশে সাদিদের উচ্চ স্বরের মিষ্টি হাসিটা যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে নীলার কর্ণদ্বারে এসে ঠেকছে। অন্যসময় হলে হয়তো মুগ্ধ হতো। কিন্তু এইমুহূর্তে সে একদমই মুগ্ধ হতে পারছে না। বরং রাগ উঠছে। তাই রাগ দেখিয়ে সাদিদের বুক থেকে উঠতে চাইল। কিন্তু সাদিদ ছাড়লে তো? নীলা যত ছুটতে চায় সাদিদ ততই আঁকড়ে ধরে। একসময় নীলা বেশি নড়াচড়া করে উঠতেই সাদিদ তাকে উল্টো ঘুরিয়ে নিচে ফেলল। আর তারউপর আধশোয়া হলো।

— ‘ ছাড়ুন বলছি। ‘
— ‘ ইশশ এতো সহজে? ‘
— ‘ ভালো হবে না কিন্তু। ‘
— ‘ আমি তো খারাপটাই করতে চাই। ‘

কথা বলতে দেরি নেই আর নীলাকে শান্ত করতে কামড় দিতে দেরি নেই।

— ‘ আউচ। রাক্ষস একটা। ‘
— ‘ তাহলে কিন্তু আরও কামড় দিব। এবার কামড়ের সাথে রাক্ষসের ন্যায় খাবোও। কিন্তু রক্ত যেহেতু হারাম তাই এটার বিকল্প হিসেবে অন্যটা খাব। ‘

নীলার চক্ষু অক্ষোকোটর থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। অপরদিকে সাদিদ ভাবলেশহীন। শুধু ঠোঁট বাঁকিয়ে রয়েছে। নীলার এইমুহূর্তে সবগুলো মেহেদী ধুয়ে সাদিদকে ইচ্ছে মতো লাগাতে মন চাইছে।

— ‘ অসভ্য পুরুষ। সবসময় শুধু অশ্লীল কথাবার্তা। ‘
— ‘ এই এই৷ মানে কি? আমি কি এমন বলে ফেললাম? বলেছি রক্তের পরিবর্তে মধু খাব৷ এটাতে অশ্লীলের কি দেখলে! ‘

নীলা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে। সাদিদ এবার পুরোপুরি নিষ্পাপ বাচ্চা। যেন সে এটাই ভেবেছে। কিন্তু নীলার সিক্স সেন্স ঘণ্টা বাজিয়ে চিল্লিয়ে বলছে এই ছেলে মোটেই এমনটা ভাবেনি। তার দুষ্টু মাথায় দুষ্টু চিন্তায় ছিল।
নীলাকে এমনকরে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাদিদ ঝুঁকে আসলো। ধরা যেহেতু পরেই গিয়েছে আর সাধু সেজে লাভ কি?
নীলার নাকে নাক লাগালো। চোখ বন্ধ করে গালে গাল লাগিয়ে স্থির রইল। নীলাও এবার নিশ্চুপ। শুধু বুকের ভেতর হাতুড়িপেটাচ্ছে।
আর এরিমধ্য সাদিদ তার গাঢ় পুরুষালী গলায় বলে উঠল,

— ‘ বাহ্ বউ দেখি মারাত্মক বুদ্ধিমান হয়ে যাচ্ছে। নট ব্যাড। নতুবা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে চিন্তায় থাকতে হতো। ‘

নীলা পুরোপুরি চুপসে গিয়েছে। এমন এমন কাজ আর এসব কথাবার্তা বললে বুঝি ঠিক থাকা যায়?
সাদিদ একটু থেমে নিজেই আবার বলে উঠল,

— ‘ আর তখন যেন কি বলছিলে? ভালোবাসি কি-না? আমাকে স্পেশাল ফিল করাতে পারো না। আরও কি-না কি যেন বলছিলে? ‘

নীলা উত্তর দিলো না। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে মাদুরে বিছিয়ে রাখা ফুলের পাপড়িগুলো মুচড়াতে লাগল। সাদিদ নীলার অবস্থা দেখে নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল। আঙুল থেকে একটা হাত সরিয়ে নীলার গালে হাত রাখল। মুখোমুখি মুখ করে বলল,

— ‘ পাখি, সবসময় শুধু আয়োজন করে স্পেশাল ফিল করানোর প্রয়োজন পরে না। আর না দরকার আছে। আমি জানি তোমার কাছে আমার গুরুত্বটা ঠিক কতখানি। আমার অস্তিত্ব তোমার জীবনে ঠিক কতটুকু প্রভাব বিস্তার করে। তাই এসবের জন্য মন খারাপ করার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই। ‘

নীলা এবার তাকালো। তার চোখজোড়ায় যেন কৃতজ্ঞতার সাগর জল। এতটুকু বুঝার জন্য যেন অসীম ভালোবাসা জড়িত শ্রদ্ধা। সাদিদ নীলার প্রশান্তিময় মুখশ্রী দেখে নিজেও তৃপ্তিজনক হাসল। কিন্তু পরমুহূর্তেই দুষ্টু সাদিদ নিজের দুষ্টুমিতে মত্ত হলো। সাদিদ নীলার গালে তার বলিষ্ঠ হাতটা আলতো করে বুলিয়ে দিলো। শিহরিত হয়ে নীলা সঙ্গে সঙ্গেই মৃদু কেঁপে উঠল। তা দেখে সাদিদ থামল না। উল্টো ঘোরলাগা নেশালো কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ কিন্তু তুমি চাইলে আজও বিনা আয়োজনে আমাকে স্পেশাল ফিল করাতে পারো। যা তোমার কাছে রয়েছে তা অমূল্য। অমূল্য জিনিসটা আমাকে বিলিয়ে দিয়ে খুব সহজেই আমাকে খুশি করতে পারো। এরজন্য কোনো কিছুর আয়োজন করতে হবে না। শুধু একটু ইচ্ছা শক্তি নির্ভর করে৷ ‘

নীলা সাদিদের কথাটুকু বুঝতে পারলো না। কিন্তু তার ঘোরলাগা কন্ঠ আর ঝাপসা চোখ দেখে শুকনো ঢুক গিলল। কেন যেন মনে হচ্ছে সাদিদের চাওয়াটুকু পূরণ করা তার জন্য মোটেই এতোটা সহজ হবে না যতটুকু সাদিদ বুঝাচ্ছে। তার গলার স্বরও আটকে গেল।
সাদিদ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নীলার পুরো মুখশ্রীতে হাত বুলিয়ে হাতটা এনে ঠোঁটের উপর রাখল। একপলক নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে আঙুল স্লাইড করতে লাগল। যেন বিনাবাক্য নীলার উত্তরটুকু দিয়ে দিচ্ছে। নীলার শ্বাস দ্রুত উঠানামা করছে। অস্থিরতায় ক্লান্ত হয়ে সাদিদকে সরিয়ে অপরপাশে মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে স্থির রাখতে চাইল। নীলা সরে যেতেই সাদিদ সোজা হয়ে শুয়ে মুখ আকাশপানে স্থির করলো। আজ যেন সাদিদ নিজের চাওয়াটুকু নীলার কাছে ব্যক্ত করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ পুরোটাই নীলার ইচ্ছের উপর নির্ভর করবে৷ যদি তার ইচ্ছে হয় তাহলে এগিয়ে আসবে নতুবা সবসময়কার মতো পিছিয়ে যাবে। এবার সাদিদ কিছুই বলবে না৷ সবটাই নীলার সিদ্ধান্ত।
দুইজনেই পাশাপাশি কিন্তু তারপরও মধ্যে যেন নীরবতার দেয়াল৷ নীলা অস্থিরতায় ডুবে যাচ্ছে। একেতো মনের ভেতরকার লজ্জা, অস্বস্তি আর অপরদিকে সাদিদের নীরবতা। তার নীরবতায় যেন নীলাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করছে। আর সে এতটুকুও বুঝতে পেরেছে আজ সাদিদ নিজ থেকে কিছুই বলবে না৷ সবটাই তার উপর ছেড়ে দিয়েছে। নীলা নিজের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করে সাদিদের দিকে পাশ ফিরল। কিন্তু সাহস করে চোখে চোখ রাখতে পারছে না৷
এভাবেই বেশ কিছু মুহূর্ত কেটে গেল। কিন্তু নীলা এখনও নিজের জায়গায় স্থির এবং সাদিদ তার জায়গায়। নীলা নিঃশব্দে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে মাথা উঁচিয়ে সাদিদের বরাবর মুখ আনলো৷ এতক্ষণে সাদিদ তার মুখপানে দৃষ্টি দিলো। নীলার চোখ-মুখ অনবরত কাঁপছে। সাদিদ তা দেখে হাসল। হাত বাড়িয়ে গালগুলো টেনে দিয়ে বলল,

— ‘ থাক বাদ দাও। এতো জড়তা নিয়ে প্রয়োজন নেই। ‘

সাদিদ কথাটা নীলার অবস্থা দেখে মন থেকেই বলেছিল। কিন্তু নীলার সেটা তীক্ষ্ণভাবে বুকে গিয়ে বিঁধল। নিজের ভালোবাসার মানুষের সামনে যদি লজ্জা বড় হয়ে দাঁড়ায় সেটা কি মানা যায়? মন বলে কখনও নয়। তাই নীলাও এবার সব বাঁধা-বিপত্তি ঠেলে দিয়ে এগিয়ে গেল।
কম্পনরত শরীর আর ধুরু ধুরু বুক নিয়ে প্রিয়তমের ওষ্ঠদ্বয়ে নিজের কোমল ওষ্ঠযুগল ছুঁয়ে দিলো।
যখন একেবারেই আশা ছেড়ে দেওয়া হয় এবং জিনিসটি অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া যায় তখন খুশিটুকু ব্যক্ত করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। আর নিজেকে গুছিয়ে নিতেও খানিকটা সময় লেগে যায়। সাদিদেরও সেই অবস্থা হয়েছে। অবশেষে নীলার পক্ষে যে এই কাজটুকু করা সম্ভব হবে সেটা সে বিশ্বাসই করতে পারছে না৷ কিন্তু যখন-ই প্রিয়তমার আদর মিশ্রিত ভালোবাসাটা অনুভব করতে পারলো চোখজোড়া বন্ধ হয়ে গেল। সাদিদ নীলার পিঠ আঁকড়ে ধরতেই সে লজ্জা পেয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে আনতে চাইল। কিন্তু এবার সাদিদ নিজেই দিলো না৷ মত্ত হয়ে রইল নীলাতে।
রাতের হিমশীতল ভাবটা যেন এখন ক্রমশ কমে এসেছে। কেননা উষ্ণতা যে চারপাশ দমিয়ে নিয়েছে৷ তাহলে শীতের পরশ শরীরে লাগবে কেমন করে?
ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দগুলো যেন রাতের নিস্তব্ধতায় আরও মাদকিয়তা বাড়িয়ে তুলেছে। নীলা সরতে চাইছে কিন্তু সাদিদ একেবারেই নারাজ। এতদিনের প্রত্যাশিত জিনিসটা পেল। এত তাড়াতাড়ি কিভাবে ছাড়বে?
নীলার অবস্থা এবার কাহিল। একদিকে অধরযুগলে অত্যাচার চলছে আর অপরদিকে সাদিদের দুষ্টু হাতটা তার পুরো শরীরে এলোমেলোভাবে বিচরণ করছে। যা নীলাকে একেবারেই স্থির থাকতে দিচ্ছে না৷ তার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠছে।
নীলার অনবরত দাপাদাপি আর নিঃশ্বাসের সমস্যা উপলব্ধি করে সাদিদ অবশেষে নিজেকে তার থেকে ছাড়িয়ে আনলো। কিন্তু নিজের ভিতরে যেই আগুন জ্বলছে সেটা নেভাবে কিভাবে? অস্থিরতায় একাকার সাদিদ নীলার গলায় মুখ ডুবালো। ঘন ঘন উষ্ণ স্পর্শে নিজেকে শান্ত করতে চাইল। কিন্তু এতে যেন হিতে আরও বিপরীত হচ্ছে। ক্রমশ-ই নীলার নেশায় মত্ত হয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই নেশার তারটা কাটা যাচ্ছে না। গায়ে পরিহিত হলুদের শাড়ির আঁচলে সাদিদের হাত পরতেই নীলার শরীর ঘামতে শুরু করল। কিভাবে সাদিদকে আটকাবে?
অবশেষে নীলাকে কিছু করতে হলো না। প্রিয়তমার বুকে মুখ গোঁজে লম্বা লম্বা কয়েকটা শ্বাস টেনে সাদিদ সরে আসলো। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে তাই দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে নীলাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— ‘ পাখি উঠো। আর একমিনিটও থাকা চলবে না৷ তোমাকে দ্রুত বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। আর লেইট হলে বোধহয় আমার পক্ষে তোমাকে ছাড়া সম্ভব হবে না৷ ‘

নীলাও নিজেকে সামলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু কয়েককদম এগিয়ে গিয়েই সাদিদ আবার পিছিয়ে গেল। মুখ ফুটে বলে উঠল,

— ‘ ওহ্ শিট। ‘

নীলা ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। কিন্তু বুঝতে কিছুই পারল না৷ সাদিদ মাথা চুলকে নীলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। উপর থেকে নিচে ভালো করে একবার নজর বুলিয়ে বাচ্চাদের মতো কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,

— ‘ তোমাকে আর আদর করতে দেওয়া যাবে না পাখি৷ আমাকে পুরো এলোমলো করে দিয়েছ। ‘

নীলা এবার লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল। কিন্তু সাদিদ নিজের মতোই বলল,

— ‘ এটা কিভাবে ভুলতে পারলাম? আমার মাথাতেই আসছে না৷ আসো তো। ‘

বলেই নীলার বাহুতে টেনে আবারও মাদুরে বসিয়ে দিলো। তারপর পরিহিত পাঞ্জাবির পকেট থেকে যত্ন সহকারে আলতার শিশিটা বাহির করলো৷ আর নীলা চমকিত দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়েই রইল। কিন্তু সাদিদ যখন নীলার পায়ে হাত দিতে চাইল সে মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে উঠল,

— ‘ পায়ে ধরছেন কেন? ‘
— ‘ কেটে ফেলব। তাই৷ ‘
— ‘ যতসব আজগুবি কথা৷ ‘
— ‘ তাহলে জিজ্ঞাসা করো কেন? ‘
— ‘ তাহলে কি করব? ‘
— ‘ বসে বসে মুড়ি খাও। ওহ সরি মুড়ি নাই। তাই আপাতত নিজের সুদর্শন স্বামীকেই গিলে খাও। ‘
— ‘ এহ্ আসছে আমার সুদর্শন পুরুষ। যতসব ত্যাড়া পাবলিক। ‘
— ‘ পাখি আমার কাজে বাঁধা দিলে কিন্তু এখন ডাবল শাস্তি দিব। ভুলে যাব কাল আমাদের বিয়ে। তখন না পারবে কাউকে বলতে আর না পারবে সহ্য করতে। তাই চুপচাপ বসে থাক। ‘

স্বাভাবিক কন্ঠে এমন ভয়ানক ধমকিতে নীলার অন্তর আত্মা পর্যন্ত নড়ে উঠল। নীলার আর নড়ার সাধ্য হলো না। নীলাকে এমন অবস্থায় রেখে সাদিদ দিব্বি নিজের কাজে স্থির রয়েছে। মনোযোগ সহকারে সে নীলার দুইপায়ে ঘন করে আলতা পরিয়ে তবে ক্ষান্ত হলো। নিজের কার্য সমাপ্তি করে সে বাচ্চাদের মতো দাঁত বেড় করে হাসল।
নীলার মেহেদী পরা হাত আর আলতা রাঙা পাগুলো বারবার অপলক দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে বলল,

— ‘ একেবারে লাল টুকটুকে গ্রাম বাংলার বউ। ‘

নীলা সাদিদের এমন কথা শুনে নিজের দিকে তাকালো। পরিহিত শাড়ির স্টাইল, হাতে চুড়ি আর পায়ে রঙিন আলতায় তাকে সত্যিই গ্রামের বউদের মতোই লাগছে। সে বেশ লজ্জা পেল।
সাদিদ এগিয়ে এসে কপালের মধ্যিখানে গাঢ় চুমু খেল। মুখটা আঁজলাভরে ধরে মোহনীয় স্বরে বলল,

— ‘ হয়তো বা দিন গড়িয়ে মাস আসবে। চোখের পলকে বছর শেষ হবে৷ যৌবনের এই মলিনতা ফিকে পরবে। বার্ধক্যের ছাপে কোমল চামড়া নেতিয়ে যাবে। তারপরও সেইসকল দিনে আমি এই আজকের লাল টুকটুকে বউটাকেই চাই। তখনও আমার জন্য সাজবে তো? পরবে তো আলতা? হাত রাঙাবে তো এই মেহেদীতে? ‘

নীলা কান্না চেপে সাদিদের বুকে ঝাপটে পড়ল। রুদ্ধ শ্বাস কন্ঠে বলল,

— ‘ ইনশাআল্লাহ। সৃষ্টিকর্তা যেন আমাকে সেই তাওফিক দান করেন। আমার সবটুকুই আমি কেবল এই পুরুষটার জন্যই বরাদ্দ করতে চাই। ‘

সৃষ্টির চরম বাস্তবতাগুলো মাঝেমধ্যে বড্ড কষ্ট দেয়। কিন্তু তারপরও যদি দিনশেষে হাতে হাত রাখার জন্য নিঃস্বার্থ সম্পর্কের ন্যায় অটুট বন্ধন বিদ্যামান থাকে তাহলে সবকিছুই যেন রংধনুর রঙে রঙিন।

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৪১

রিক্সা ছুটে চলেছে তার আপন গন্তব্যের উদ্দেশ্য। ঘড়ির কাটার হিসাব করলে রাত বেশ গভীর। দিনের আলোয় ঢাকার এই ব্যস্ততা যেন এখন পুরোপুরি অনুপস্থিত। ঠিক যেন শান্ত-শিষ্ট একটা ভদ্র বাচ্চা। নীলা ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে বসা সাদিদের দিকে তাকালো। সে এতক্ষণ নীলার দিকেই নিষ্পলক তাকিয়ে। নীলা বুঝতে পারে না তার মধ্যে এমন আহামরি কি রয়েছে যার দরুন এই ছেলেটার দৃষ্টির কখনও পরিবর্তন হয় না? সবসময় যেন চোখে-মুখে তার উপচে পরা মুগ্ধতা।
নীলা নতজানু হয়ে পায়ে পা দিয়ে আলতোভাবে ঘর্ষণ করতে লাগল। কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আড়চোখে আবারও সাদিদের দিকে তাকাতেই তার ঝাপসা চোখগুলোর সম্মুখীন হলো৷ যা নীলার ভেতরটা পুরোপুরি এলোমেলো করে দিতে সক্ষম। নীলা দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে রিক্সার অপরপাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বলাবাহুল্য সেটা রমণীর এলোমেলো অস্থিরতা মিশ্রিত এক দৃষ্টি। সাদিদ নিজের তীক্ষ্ণ চোখের গভীরতায় সবটাই পরখ করলো। তাই ঠোঁট কামড়ে ধরে স্লিকি চুলগুলোকে আঙ্গুল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করলো। তারপর নীলার দিকে আরেকটু মিশে বসে শাড়ি ভেদ করে পিছন থেকে উন্মুক্ত কোমড়ে নিজের হাত রাখল।
প্রকৃতিতে যতটুকু না শীতলতা বহমান সাদিদের উষ্ণ হাতের স্পর্শটা যেন নীলার শরীরে আরও এঁটে বসেছে। নতুবা এমন শিহরণ বয়বে কেন? আর কেন-ই বা দেহ এমন হিমশীতল বরফে পরিণত হবে?
নীলার শরীর মৃদুভাবে কাঁপছে। কিন্তু তারপরও সেটা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছে। কিন্তু দুষ্টু সাদিদ যখন কোমড়ে রাখা নিজের হাতটা নীলার কোমড়সহ পেটের আশেপাশে বুলাতে লাগত তখন আর নীলা স্থির থাকতে পারল না৷ কাঁপা চোখে-মুখে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সাদিদের দিকে তাকালো। পরমুহূর্তেই আবার তাকালো সামনের রিক্সা চালকের দিকে। চালক একধ্যনে রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছে। নীলা একবার সাদিদকে দেখছে তো আরেকবার রিক্সা চালককে। আর ইশারায় সাদিদকে অনুরোধ করছে এমনটা না করতে।
কিন্তু সাদিদ কি এত সহজে কথা শুনার মানুষ? সে দিব্বি নিজের দুষ্টুমিতে মত্ত।
নীলা পরেছে বেকায়দায়। হাতের মেহেদী এখনও পুরোপুরি শুকায়নি। তাই হাত দিয়ে সাদিদের হাত ছাড়াতে পারছে না। নতুবা এতক্ষণের সব কষ্ট বিফলে যাবে। তার থেকে বড় কথা হলো এটা সে সাদিদের নামে পরেছে। তাহলে এতো সহজে ভালোবাসার মানুষের নাম কিভাবে নষ্ট হতে দিবে? আর এই সুযোগটুকুই সাদিদ যেন পুরোপুরি উশুল করে যাচ্ছে।
নীলার দিক থেকে সব দিকেই যেন বিপদ। কেননা নীলা খুব একটা নড়াচড়া করেও সাদিদকে ছাড়াতে পারছে না। নতুবা আওয়াজের শব্দে চালক তাদের দিকে অবশ্যই ফিরে তাকাবে। আর নির্লজ্জতা সাদিদের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত থাকলেও তার তো এমন পরিস্থিতিতে পড়লে লজ্জায় মরে যাবার অবস্থা হবে৷ তাই নিজেকে যথাসম্ভব সামলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যখন আর সহ্য করতে না পেরে নীলা মুখে হাত চেপে আপত্তিকর শব্দ বের করা থেকে নিজেকে সংযত করতে চাইল, তখন সাদিদ আস্তেধীরে নিজের হাতটা হালকা করে দিলো। কিন্তু পুরোপুরি ছাড়ল না। নীলার বাহুচেপে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখল।
নীলা যেন এতক্ষণে হাফ ছেড়েছে। কিছুক্ষণ আগের পরিস্থিতি চিন্তা করলেই তার গায়ে রীতিমতো কাটা দিয়ে উঠছে।
বাসার থেকে খানিকটা সামনে এসে সাদিদ চালককে রিক্সা থামাতে বলল। নীলাকে এবারও সাদিদ নামতে সহায়তা করলো। আজকে একে তো নীলা শাড়ি পরা, তারউপর আবার হাতে মেহেদী ভরা। সাদিদ তার বাহুতে চেপে ধীরস্থির ভাবে রিক্সা থেকে তাকে নামালো৷ সাদিদ রিক্সা চালককে বিদায় করে দিয়ে নীলাকে নিয়ে বাসার দিকে হাঁটতে লাগল। নীলা কয়েককদম যাওয়ার পর-ই নিচুস্বরে বলে উঠল,

— ‘ এতো রাতে রিক্সা বিদায় করেছেন কেন? আপনার যেতে তো সমস্যা হবে। ‘

সাদিদ তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। কিন্তু প্রতিউত্তর জানালো না। শুধু আপনমনে বিড়বিড় করলো,

— ‘ বউটা এত বোকা কেন? ‘

সাদিদকে উত্তর না দিতে দেখে নীলা-ই আবার বলতে শুরু করল। এবার যেন তার কন্ঠস্বরে ভীষণ আপসোস।

— ‘ লোকে বলে বিয়ের আগের রাতে না-কি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেতে হয়। নতুবা বিয়ের দিন চোখের নিচে কালি পরে ভূতের মতো দেখা যায়। নিঃসন্দেহে কালকে আমাকে ভূতের রাণী লাগবে। কেননা ঘুমাবো আর কি? রাত যে প্রায় শেষের দিকে। ‘

সাদিদ তার কথায় নিঃশব্দে মৃদু হাসল। ততক্ষণে তারা বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সাদিদ নীলাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তার গালে নিজের বলিষ্ঠ হাতজোড়া স্থির করলো। সাদিদের ভাবভঙ্গি দেখে নীলা ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল,

— ‘ কি? ‘

সাদিদ তার এই প্রশ্নের উত্তরে কপালে গাঢ় চুমু খেল। অতঃপর একে একে বোকা মেয়ের সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগল,

— ‘ এইজন্য চালক ভাইকে পাঠিয়ে দিলাম। নতুবা আমার আর আমার বউয়ের মাঝের ভালোবাসাটা সে দেখে নিতো। যা আমি কখনোই চাই না৷ তুমি আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ। তাই সবার সম্মুখে কিভাবে ভালোবাসাটা বিলিয়ে দিব? ‘

নীলা লাজুক হেসে মাথা নিচু করল। সাদিদও হাসল। পরমুহূর্তেই ঠোঁট কামড়ে ধরে নীলার কানের পিছনে ঠোঁট লাগিয়ে ফিচেল কন্ঠে বলল,

— ‘ আর কি যেন বললে? বিয়ের আগের রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হয়। কথাটা অবশ্য ভুল নয়। কিন্তু তুমি এটা জানো কি? কনের মুখের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ছাড়াও এর পিছনে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ যে রয়েছে? ‘

নীলা সাদিদের চোখে চোখ রাখল। উত্তরটা তার জানা নেই৷ তাই সাদিদ বাঁকা হেসে নীলার ঘাড়ে ঠোঁট ঘষে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

— ‘ যেন বাসর রাত নির্ঘুম কাটাতে গিয়ে সমস্যা না হয়। ‘

ইশশ! বড্ড নির্লজ্জ এই ছেলে। নীলা তাকে মৃদুভাবে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে চলে যেতে চাইল। আর অপরদিকে সাদিদ তার টমেটোর ন্যায় গাল দেখে হেসে ফেলল। পিছন থেকে পেট জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রেখে আবারও তাকে লজ্জায় ফেলতে বলে উঠল,

— ‘ আমাদের অবশ্য প্রথম নয়। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বিয়ের বাসর হিসেবে কিন্তু প্রথমবার-ই। তাই আমি তো দ্বিগুণ এক্সাইটেড। ডাবল হলে তো এক্সাইটেড লেবেলও ডাবল হবার কথা। তাই নয় কি? ‘
— ‘ অসভ্য একটা৷ ‘

নীলা লজ্জায় জড়সড় হয়ে ছুটার জন্য আবারও নড়াচড়া শুরু করলো। সাদিদ এবার হাসতে হাসতে তাকে ছেড়ে দিলো। মুখে হাসি নিয়েই বলল,

— ‘ বউ যে এতো লজ্জা কেন পায় আমিতো সেটাই বুঝি না৷ এত প্রেম করলাম, এতো আদর-ভালোবাসা দিলাম তারপরও বউয়ের লজ্জা ভাঙতে পারলাম না। বরং তার লজ্জা যেন আগাছার মতো ডালপালা মেলে বাড়তেই থাকে। ‘
— ‘ আমি যাচ্ছি। ‘

নীলা আর একমুহূর্তে দাঁড়ালো না৷ এই ছেলের কথার মধ্যেই যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেবার বিষ মিশ্রিত থাকে। নীলার শ্বাসটা কোন দিন না তার কথার জালেই বেড়িয়ে আসে!
কিন্তু যেতে চাইলেই কি যাওয়া যায়? সাদিদ কি এতো সহজে বাঁধন ছিন্ন করে?
সে পিছন থেকে নীলার শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে নীলার একেবারে কাছে চলে আসলো। শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পিছন থেকে নিজের গালের সাথে তার গাল লাগিয়ে বলল,

— ‘ যাচ্ছি নয়। বলতে হয় আসি। আর আমিও আসব। কাল একেবারে বর সেজে আমার বউটাকে উঠিয়ে নিয়ে যাব। মধ্যকার দুরত্বটা বড্ড পীড়া দিচ্ছে পাখি। এতদিন যন্ত্রণা ভোগ করেছি। তাই কাল থেকে যন্ত্রণা নিরসনের দায়িত্ব তোমার। আমার সবটুকু যন্ত্রণা ভালোবাসা দিয়ে মুছিয়ে দিতে পারবে না? ‘

নীলা আর সহ্য করতে পারল না। সামনে ফিরে সাদিদের বুকে মুখ লুকালো। আর টেনে টেনে শ্বাস নিতে লাগল। সাদিদ নিঃশব্দে মৃদু হাসলো। অতঃপর নীলার মাথায় ভালোবাসাময় চুমু খেয়ে তাকে বাহুবন্ধনে শক্ত করে আবদ্ধ করলো।
কিছু মুহূর্ত এই প্রেমিকযুগল একিভাবেই একে-অপরের উষ্ণতাটুকু অনুভব করল। তারপর নীলা-ই মাথা উঁচিয়ে নিচুস্বরে অনুমতি চাইল,

— ‘ এবার তাহলে আসি? ‘

সাদিদ নিজের মনকে বুঝতে পারছে না। কিন্তু নীলাকে তার ছাড়তে একেবারেই ইচ্ছে হচ্ছে না। তাই আবারও নীলাকে বুক পাঁজরে টেনে আনলো। মাথাটা বুকের বামপাশে শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠল,

— ‘ আর একটু প্লিজ। ‘

নীলাও মৃদু হাসল। নিজের হাতদুটো দিয়ে সাদিদ পিঠ আঁকড়ে ধরল। আর সাদিদকে বুঝতে না দিয়ে লুকিয়ে বুকে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে নিলো।
সাদিদ মৃদু হেসে ফেলল। তার প্রাণপাখিটা বরাবরই এসব দিক দিয়ে পিছিয়ে। থাক সমস্যা নেই। তার ভাগের টুকু সাদিদ হাসিমুখেই পুষিয়ে দিবে।
সে নীলাকে ছাড়ল। কিন্তু পুরোপুরি নয়। মুখটা আঁজলাভরে ধরে চোখের পাতায়, গাল, কপালে চুমু দিয়ে আদর করলো। অতঃপর নীলার কম্পিত মুখশ্রীতে নজর বুলিয়ে আলতো করে প্রিয়তমার পাতলা অধরযুগলেও ছুঁয়ে দিলো। ভালোবাসাময় কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত করে বহু কষ্টে যেন শ্বাসরুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ যাও৷ ‘

কন্ঠটাতে এতটা বিষাদ মিশ্রিত ছিল যে নীলার চোখজোড়া মুহূর্তেই ছলছল করে উঠল। কিন্তু এমন কেন হচ্ছে? বা সাদিদ-ই হঠাৎ করে এমন কেন করছে?
নীলা উত্তর পেল না। কিন্তু প্রিয়তমকে কষ্টের পরিবর্তে একটুখানি সুখ দিতে সব বাঁধাগুলোকে পিছিয়ে ফেলল। সে পা উঁচিয়ে সাদিদের বুকের পাঞ্জাবিতে হাত মুঠি করে ধরল। সাদিদ নীলার মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। হঠাৎ করে নীলা কি করতে চাইছে এটাই বুঝার চেষ্টায় নিয়োজিত। নীলা হাতদুটো ধীরে ধীরে সাদিদের গলায় নিয়ে ঠেকালো এবং তার মাথাটা খানিকটা নিচে নামাতে চেষ্টা করলো৷ কেননা সাদিদের উচ্চতা তার থেকে বেশি। পা উঁচিয়েও নাগাল পাওয়া কষ্টকর৷
সাদিদের কাছে যেন এতক্ষণে সবটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। সে ঠোঁট কামড়ে ধরল। অধরকোণে ফুটে উঠল ঈষৎ হাসির রেখা। সে এবার নিজেই মাথাটা নিচু করলো এবং নিজের একহাতে নীলাকেও তার সাথে জড়িয়ে নিলো৷
নীলার চোখ-মুখ সমানে কেঁপে যাচ্ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাঁপছে তার সমস্ত শরীর। সে বারকয়েক লম্বা শ্বাস টেনে চোখজোড়া বন্ধ করে প্রিয়তমের ওষ্ঠযুগল চেপে ধরল। সাদিদ যেন এই মুহূর্তটার-ই অপেক্ষায় ছিল। এবার সেও নীলার কোমল পেলাভ ঠোঁটজোড়া নিজের মধ্যে পুরে নিলো। আর প্রিয়তমাকে সমানে আদর বিলিয়ে দিতে লাগল। যতক্ষণ না নীলা অস্থির হয়ে পড়ল ততক্ষণ একটানা প্রিয়তমা স্ত্রীকে ভালোবাসা মুড়ানো সোহাগ দিতে সে কৃপণতা করলো না।
সাদিদ তার থেকে নিজেকে আলাদা করতেই নীলা একমুহূর্ত ব্যয় না করে দৌড়ে গেইটের ভিতর ডুকে গেল। নতুবা এই মুহূর্তে সাদিদের চোখে চোখ রাখার তার একেবারেই সামর্থ্য নেই। লজ্জায় মরেই যাবে সে।
সাদিদ নীলার গমনপথের দিকে তাকিয়ে হাসল। পিছন থেকে নীলার মুখশ্রী নজরে না আসলেও সাদিদ বেশ বুঝতে পারছে এই মুহূর্তে নীলার মুখটা কোন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ঠিক যেন পাকা লাল টমেটো। সে হাসি আটকে আপনমনে বলে উঠল,

— ‘ আমার লজ্জাবতী। ‘

_______________

গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত বিয়ে বাড়ির হইহট্টগোল আমেজটা যেন এখন আর নেই। ক্রমশই সবকিছু যেন বিষাদে পরিপূর্ণ। বড়দের সবার মাথায় হাত। তাদের এই গভীর ভাবনায় মগ্ন দেখে ছোট্টরাও যেন টের পাচ্ছে পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। তাই তারা নিজেদের দুষ্টুমিগুলোকে আপাতত নিজেদের মধ্যে বন্দি করেছে।

— ‘ নিধির বাবা, আর কতক্ষণ? এবার তো কিছু একটা করতে হবে। আর ছেলের পরিবারকেও কথাটা জানাতে হবে। ‘

এতক্ষণের সবার নীরবতা পাল্লা ছাপিয়ে বড় ফুফা হঠাৎই আরিফ মাহমুদের উদ্দেশ্য কথাটি বলে উঠলেন। তার কথাটা কানে পৌঁছাতেই আরিফ মাহমুদ আবারও চুপসে গেল। চোখে মুখে তার অসহায়ত্বের ছাপ। তিনি মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললেন,

— ‘ ভাই আর একটু দেখি। এখনওতো সময় আছে। যদি তার মধ্যে ভালো একটা খবর পাই? ‘

বড় ফুফা রাগি মানুষ। এতক্ষণ মাথা ঠান্ডা রাখতে পারলেও এখন আর সম্ভব হচ্ছে। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হুংকার ছুড়লেন,

— ‘ সময় আছে! এখনও কোন মুখে এই কথা বলছো? কই আমাদের মেয়ে ছেলেও তো শহরে থেকে পড়াশোনা করছে। কিন্তু তারা তো তোমার মেয়ের মতো পরিবারের এমন নাক কেটে বসেনি। এইজন্যই বুঝি মেয়েকে এত আদর-যত্নে বড় করেছো? আমার মেয়ে হলে তৎক্ষনাৎ এমন মেয়েকে আমি গলা টিপে মেরে ফেলতাম। ‘

আরিফ মাহমুদের দেহের লোমকূপগুলো যেন এমন কথার পরিবর্তে শিউরে উঠল। কলিজার টুকরো মেয়ের গায়ে যদি কেউ এমন কথা ছুড়ে দেয় তাহলে কলিজা যে পুড়ে কয়লা হতে চায়। তারও এমন অবস্থা। কিন্তু বড়দের সাথে এই মুহূর্তে বেয়াদবি করলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটের দিকে যাবে। তাই তিনি মাথা নিচু করে চেয়ারের হাতল শক্ত করে চেপে ধরলেন। আর নার্গিস খাতুনের উদ্দেশ্য ধরা গলায় বলে উঠলেন,

— ‘ নিধির মা, একগ্লাস ঠান্ডা পানি দিও। আমার ভিতরটা বোধহয় জ্বলে যাবে। ‘

_______________

পদ্মালয়ায় চলছে বউ আনার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। শায়লা রহমান চিল্লিয়ে সবাইকে তাড়াতাড়ি করতে বলছে। অন্যসব দিনে এইসব কাজ তিনি একা করলেও আজ ছোট্ট শাদমানও তার সঙ্গ দিয়েছে। সাদিদের মতো সেও বরের স্টাইলে শেরওয়ানি-পাগড়ী পরেছে। ছোট্ট ছোট্ট পা নিয়ে দাদির পিছন পিছন সবাইকে তাগাদা দিচ্ছে।

— ‘ মা, পাপা আসো। বড় আপু আসো। দাদাভাই তাড়াতাড়ি আসো। পাপু আসো। দাদুমণি কেউ আসে না কেন? ‘

শায়লা রহমান এতক্ষণ সবার উপর বিরক্তিতে রেগে গেলেও এখন যেন এই পুঁচকের কথা শুনে বিরক্তি চলে গেল। শাদমানের বরাবর বসে মাথার পাগড়ীটা ঠিক করে দিয়ে বললেন,

— ‘ সবাইতো তোমার মতো ভালো না দাদাভাই৷ তাই আসে না৷ আমরা আজ সবাইকে বকে দিব। ‘
— ‘ নতুব বউকেও? ‘
— ‘ না। তোমার নতুন বউকে বকবো না। সে হচ্ছে লক্ষ্মি মেয়ে। ‘
— ‘ লল্ক্ষ…
— ‘ থাক দাদাভাই তুমি এটা বলতে পারবে না। নতুন বউ হচ্ছে ভালো মেয়ে। আমার মিষ্টি আরেকটা মেয়ে। ‘

শাদমান যেন এবার বেশ খুশি হলো। বিয়ে সম্পর্কে পুরোপুরি না বুঝলেও এটা বুঝে বিয়ে মানে বর-বউ। টিভি-মোবাইলের কৃপায় এই ছোট্ট বয়সে বিয়ে সম্পর্কে এতোটুকু ধারণা তার বেশ জন্মেছে। তাইতো সাদিদ-নীলার বিয়ে হবে জেনে ছোট্ট শাদমান নতুন বউ নতুন বউ করে বাড়ির সবাইকে অস্থির করে ফেলছে। নীলা যে তার খালামণি এটা সে মানাতে নারাজ। তার এককথা নীলা যেহেতু পাপুর বউ হবে সেহেতু তার নতুন বউ।
নীলা এমনিতেই লজ্জায় কাচুমাচু। আর যখন ছোট্ট শাদমান এই নতুন বউ বলে বুলি আওড়িয়ে মাথা খায় তখনতো আরও করুণ দশা।
সে এখনও দাদির পিছন পিছন নতুন বউয়ের বুলি ছেড়ে এগিয়ে আসছে৷ শায়লা রহমান সাদিদের রুমের সামনে এসেই আবারও বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলল,

— ‘ তোদের এখনও শেষ হয়নি? তোরা দেখি মেয়েদের মতো শুরু করেছিস। ‘
— ‘ হ্যাঁ মা এবার আমি একমত। কি শুরু করেছে এগুলো একটু দেখ৷ বলছি তাড়াতাড়ি কর কিন্তু কে শুনে কার কথা! বিরক্তিকর। ‘
— ‘ হা হা। মামা তুমি দেখি আর ধৈর্য্য কুলাইতে পারতাছো না। একটু সবুর করো। বিয়া কি বারবার করবা না-কি? ‘
— ‘ তাই বলে তোরা এসব করবি? আমি কি মেয়ে? এতো ঠিকঠাক আমার হয়ে কি কাজ? ‘
— ‘ দেখলি অর্ণব, শালাই পুরোই বউ পাগল। আধা ঘণ্টায় তার অবস্থা পাগল প্রায়। ‘
— ‘ এই চুপ। মুখ সামলা। ‘

সাদিদের রাগীচোখের ইশারায় তানবীর একপলক দরজায় দাঁড়ানো শায়লা রহমানের দিকে তাকিয়ে কেবলা হাসলো৷ শায়লা রহমান সবকটাকে আবারও তাড়াতাড়ি করতে বলে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। আর রুম থেকে বেড়িয়েই এতক্ষণের চেপে রাখা হাসিটুকু দিয়ে দিলো। শাদমান হঠাৎ দাদিকে হাসতে দেখে বলে উঠল,

— ‘ দাদুমণি হাসো কেন? ‘
— ‘ তোমার নতুন বউ যে আসবে, তাই আসছি। খুশির বিষয়ে হাসতে হয়। ‘
— ‘ ওহ্। ‘

শাদমান কপাল কুঁচকে খানিকটা চিন্তা করলো। তারপর নিজেও এবার হাসল। সত্যিই তো তার নতুন বউ আসছে। এটাতো খুশির খবরই।
শাদমানরা চলে যেতেই তানবীর আবারও তার দুষ্টুমি বহাল রাখল,

— ‘ মামা, তোমার-ই জীবন। আহা! কি সুখ। বিয়ে করা বউরে আর কতবার বিয়া করবি মিয়া? ‘

সাদিদ আয়নার দিকে তাকিয়ে শেরওয়ানীর ব্রজটা ঠিক করতে করতে হাসল। বর সাজাটা কেমন যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। সেটা বোধহয় কেবল যারা এই মুহূর্তটার সাথে সাক্ষাৎ করেছে তারাই বুঝতে পারবে। সাদিদেরও আজ অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করেছে। পাঞ্জাবি আগেও পরা হয়েছে। কিন্তু আজকেরটা যেন অন্যসব দিনের তুলনায় একেবারে ভিন্ন। সে নিজের বেশভূষায় মৃদু হাসলো৷ অতঃপর আয়নার মধ্যেই তানবীরের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,

— ‘ প্রয়োজন পড়লে হাজারবার। এরও অধিক হলে সমস্যা নেই। আমি সর্বদাই তাকে গ্রহণ করতে একপায়ে দাঁড়ানো৷ ‘

তানবীর-অর্ণব দুইজনই হাসিমুখে সাদিদের পিঠে চাপড় দিলো। দুইটা মিলে এতো জোরে দিয়েছে যে সাদিদ মৃদু ব্যাথা পেয়ে গেল। আর এটা নিয়েই আবারও তিন বন্ধু একদফা দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়া করে ফেলল।
অবশেষে সাদিদ তাদেরকে থামাতে থামাতে অস্থির গলায় বলে উঠল,

— ‘ ভাই থাম। এবারের মতো আর না। সত্যিই এখন লেইট হচ্ছে। আমার বউটা অপেক্ষা করছে। ‘
— ‘ শালা বিয়া কইরা হানিমুন পর্যন্ত শেষ তারপরও আর কিসের অপেক্ষা? ‘
— ‘ হারামী, একবার না করছি। আর মাত্রই না তোকে বললাম হাজার বার করতে ইচ্ছুক। তাই সংখ্যা বাড়াতে তো দিবি? ‘
— ‘ তুই আর শুধরাইলি না। নীলা মানে আমাদের ভাবী জানে, তোমার এই নির্লজ্জ রূপ? ‘
— ‘ মামা, তোমার ভাবীর জন্যই তো সব নির্লজ্জতা। সে জানবে না তো কে জানবে? ‘

বলেই সাদিদ ঠোঁট বাঁকিয়ে চোখ টিপল। তার কথার ধরণে তানবীর-অর্ণব হেসে ফেলল। আবারও নিচ থেকে তাগদা আসতেই সাদিদ নিজেকে একপলক আয়নায় ঠিকঠাক দেখে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো।
সাদিদরা নিচে নামতেই সবাই একএক করে বাসা থেকে বের হলো। বাসার সামনেই সব কটা প্রাইভেট গাড়ি দাঁড়ানো। সাদিদের নিজস্ব চারটা গাড়িসহও আরও বেশ কয়েকটা গাড়ি বর যাত্রীর জন্য ভাড়ায় বরাদ্দ করা হয়েছে। বরের গাড়িতে সাদিদের সাথে শাদমান, নিধি এবং শাহেদ বসেছে। সাদিদ গাড়িতে বসেও বারবার ফোনে তাকাতেই সামনে থেকে শাহেদ টিটকারি দিয়ে বলে উঠল,

— ‘ শালিকার আমার বিরাট কপাল। জামাই তার বউ বলতে পাগল। ‘

নিধি পিছন থেকে তার বাহুতে থাপ্পড় দিতেই সে হাসতে হাসতে বলল,

— ‘ সমস্যা কি? তুমি আমায় আঘাত করো কেন? ঠিক-ই তো বললাম। ‘
— ‘ তোমার ঠিক তোমার কাছেই রাখো৷ বেশি ঠিক-বেঠিক বলতে হবে না৷ ‘
— ‘ তোমার দেখছি আমার সবকিছুতেই সমস্যা। বুঝলি সাদিদ, পুরোনো সবকিছুতেই যেমন জং ধরে তেমনিভাবে সম্পর্কেও জং ধরে। নতুন নতুন সবকিছুতেই ভালোলাগা ছিল। আর এখন দেখ, সবকিছুতেই তার খারাপ লাগে। তুই-ই ভালো। নতুন সবকিছু শুরু করবি৷ ভাবছি আমাকেও একটা নতুনত্বের ব্যবস্থা করতে হবে৷ ‘

শাহেদের এমন কথায় নিধি মুহূর্তেই রণমুর্তিতে পরিণত হলো। ছোট শাদমান ড্যাবড্যাব চোখে মা-বাবার খুনসুটিময় ঝগড়া দেখছে। আর সাদিদ শুধু শুনে যাচ্ছে। আর মুখে জোরপূর্বক হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।
কিন্তু কিছুতেই সে স্বস্তি খোঁজে পাচ্ছে না। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বললেও একমাত্র সে জানে নিজের মধ্যে কি চলছে৷ বুকে যেন তার তোড়পার হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে নীলার উপর তার ভীষণ রাগও জমা হচ্ছে।
নীলাকে বলা হয়েছিল বিয়ের সাজ কমপ্লিট করেই যেন সাদিদকে সে ভিডিও কল করে। সর্বপ্রথম বধু রূপে নীলাকে সাদিদ-ই দেখতে চায়। কিন্তু সেই মহারাণী কল করবে কি, তার কোনো খবর-ই নেই৷ রাতের পর থেকে আর অনলাইনেও দেখা যাচ্ছে না। ফোনটা বন্ধ। সাদিদ জানে সে ব্যস্ত থাকবে। কিন্তু তাই বলে কয়েকমিনিট নিয়ে কল করলে কি হয়? সে কি জানে না, সাদিদ তার অনুপস্থিততে অস্থির হয়ে যাবে?
সাদিদের মাথা কাজ করছে না৷ বারবার ফোনটার দিকে তাকাচ্ছে আর অনবরত কল করে যাচ্ছে। আর বারবার অপরপাশ থেকে সুমধুর কিন্তু সাদিদের কাছে এই মুহূর্তে ভীষণ বিরক্তিকর এক কন্ঠস্বর ভেসে আসছে। অর্থাৎ প্রিয়তমার ফোনটা সুইচঅফ।
মন মস্তিষ্কে চরম অস্থিরতা নিয়েই সাদিদদের গাড়ি এসে কনভেনশন সেন্টারের সামনে থামল। একে একে সবকটা গাড়ি এসে দাঁড়াতেই শাহেদ দরজা খোলে নিজে বেড়িয়ে নিধির পাশের দরজাটা খোলল। সাদিদ বের হতে গেলেই শাহেদ বলে উঠল,

— ‘একটু বস। কনে পক্ষের লোক এসে তোকে নামাবে। ‘

বাধ্য হয়ে সাদিদকে গাড়িতেই বসতে হলো। অপরদিকে নিধি-শাহেদ দুইজনই একে অপরের দিকে কিছুটা আশ্চর্যজনক দৃষ্টিতে তাকালো। কেননা কনে পক্ষ আসবে কি? ঐ বাড়ির কাউকেই এখানে দেখা যাচ্ছে না। অথচ হিসেব মতে তাদেরকে এই মুহূর্তে গেইটের সামনে উপস্থিত থাকার কথা। মনে মনে দুইজন অবাক হলেও মুখে সেটা কেউ-ই প্রকাশ করলো না। নিজেরাই কনভেনশন সেন্টারের ভিতরে চলে গেল। তাদের দেখাদেখি অনেকেই ভিতরে গেল। আবার কেউ কেউ কনে পক্ষের জন্য গাড়ির সামনেই অপেক্ষা করতে লাগল।
কিন্তু অপেক্ষার প্রহর যে আর কাটে না। সাদিদ না পেরে নিজের গাড়ির সামনে দাঁড়ানো তানবীরকে ডাক দিলো।

— ‘ কিরে, কি হয়েছে? ‘
— ‘ বুঝতাসি না মামা৷ ভাই আর ভাবীতো গেল। কিন্তু কেউরে তো আসতে দেহি না। ‘
— ‘ আরে তুই অস্থির হচ্ছিস কেন? এই তানবীর, যা তো এখান থেকে। তোর এসব ভাবভঙ্গি দেখলে যে কেউ আতংকে উঠবে৷ ‘
— ‘ লাথি দিমু হারামি। আমি আবার কি কইলাম! ‘
— ‘ এই চুপ করবি তোরা? আমার বিরক্ত লাগছে এখন৷ ‘

সাদিদের মৃদু ধমকে দুইজনই চুপ হয়ে গেল। আরও কিছু মুহূর্ত পার হতেই শাহেদ হন্তদন্ত হয়ে কনভেনশন সেন্টার থেকে বেড়িয়ে আসলো। আর তার পিছু পিছু নিধিও। তার ফর্সা মুখটা যেন আঁধারে ছেয়ে গিয়েছে। তাদের এই অবস্থা দেখে সাদিদ আর বসে থাকতে পারল না। গাড়ি থেকে বের হয়ে নিজেই কয়েককদম এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলো,

— ‘ কি হয়েছে ভাইয়া? ইজ এভরিথিং ওকে? ‘
— ‘ না ভাই, কিছু ঠিক নেই৷ সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে সাদি। সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে। ‘
— ‘ মা..নে? ‘

সাদিদের কন্ঠস্বর যেন লেগে আসছে। এতক্ষণের বুকের তীক্ষ্ণ ব্যাথাটা এখন বোধহয় কাটা হয়ে হৃদপিন্ডে বিঁধছে। সাথে না চাইতেও মন-মস্তিষ্কে এসে ভিড় জমাচ্ছে হাজারো ঘন কালো মেঘের ছায়া।

#চলবে…