অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-৪২+৪৩

0
703

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৪২

মিরপুরের এই সাত তলা বিল্ডিংয়ের সুখনিড় বাসাতে আজ পিনপতন নীরবতা। সুখের রাজ্যে যেন এক আকাশ অন্ধকারের মেলা। যেখানে একবিন্দু সুখ দেখা দুষ্কর। কে বলবে এটা একটি বিয়ে বাড়ি? এই ঘরের ছোট মেয়ের আজ বিয়ে? এক কান দুই কান হতে ইতিমধ্যে সবার কাছেই কনে নিখোঁজের সংবাদটা পৌঁছে গিয়েছে। কেউ কেউ পরিবারের বদনামের কথা ভেবে আপসোস করছে আবার কেউ বা মেয়ের অনর্গল নিন্দা করে যাচ্ছে। দ্বিতীয় স্তরের লোকের সংখ্যাই যেন অধিক।

— ‘ মাফ করবেন বিয়াইসাব, কিন্তু আপনার ছোট মেয়ের প্রশংসা না করে পারছি না। নিজের কথা পরিবারের কথা নাই বা ভাবলো, কিন্তু তার যে আরেকটা বোন রয়েছে এবং সেই পরিবারে এইসবের কি প্রভাব পরবে এটা কিভাবে ভুলে গেল? নির্লজ্জ মেয়ে তার বোনের সংসারের কথা একবারও চিন্তা করলো না? ‘
— ‘ মা, বাদ দাও এসব। ‘
— ‘ তুই চুপ থাক। নেহাত আমরা ভদ্র পরিবারের সদস্য। নতুবা উনার এই গুণধর মেয়ের কুকীর্তি সবার সামনে মেলে ধরতাম। ‘
— ‘ আহা শায়লা চুপ করো তো। এমনিতেই দেখছ পরিস্থিতি ঘোলাটে। তারউপর তোমার এসব কথাবার্তা তাদের উপর কি প্রভাব পরবে একবার চিন্তা করো। ‘
— ‘ আমি কারো চিন্তা করতে পারব না। এতসবের পর তোমরা কিভাবে আমাকেই চুপ থাকতে বলো? আমি কি ভুল বলছি? যা করার সেটা তো ঐ চরিত্রহীন মেয়ে করেছে। ‘

শায়লা রহমানের শেষোক্ত বাক্যটা যেন আরিফ মাহমুদের আর সহ্য হলো না। তিনি এতো এতো চাপ নিতে পারছিলো না। তাই এবার বুকে হাত চেপে সেখানেই মেঝেতে পরে গেলেন।
উপস্থিত সবাই আকষ্মিক এমন কান্ডে হতবাক। কয়েক পলক পার হতেই নিধি শাহেদ দৌড়ে তার কাছে গেল।

— ‘ আব্বু, এই আব্বু কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? বুকে কষ্ট হচ্ছে তোমার? আব্বু। ‘

নিধি বাবার বুকে মালিশ করতে করতে ক্রমাগত হিচকি তুলে কান্না করছে৷ ছোট্ট শাদমান এতসব বুঝতে পারছে না। কিন্তু মায়ের কান্না দেখে সেও গুনগুন করে কাঁদছে। নার্গিস খাতুন ইতিমধ্যে আহাজারি শুরু করেছে।

— ‘ হে আল্লাহ, তুমি এসব কি দেখাচ্ছ আমাদের? তার থেকে বরং আমাকেও তুলে নিয়ে যাও। আমি আর এসব সহ্য করতে পারছি না৷ তুলে নাও আল্লাহ। তুলে নাও। ‘

শাহেদ ছেলেকে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চুপ করতে বলছে। আর নার্গিস খাতুনকে স্বান্তনা দিতে বলল,

— ‘ মা প্লিজ এসব বলবেন না। আপাতত বাবাকে হসপিটাল নিতে হবে৷ আপনি প্লিজ নিজেকে সামলান। ‘

সে কথাটা শেষ করেই পকেট হাতড়ে ফোন বের করলো। আরিফ মাহমুদের অবস্থা খুব একটা স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে শাহেদ সবাইকে এসব বলে আর বিচলিত করতে চাইল না। সে দ্রুত অর্ণবকে ফোন দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্ণবসহ তানবীর সেখানে এসে হাজির হলো। তারা বাসার সামনেই ছিল৷ আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে তিনজনে ধরাধরি করে তাকে নিচে নামিয়ে আনলো। শাহেদ নিজেই ডাইভিং সিটে বসে দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিলো। রাগ অভিমান ঠেলে দিয়ে শায়লা রহমানও হাসিবুর রহামানকে নিয়ে তাদের পিছন পিছন অপর গাড়িতে হসপিটালের উদ্দেশ্য ছুটল।
খারাপ পরিস্থিতিতে নিজের রাগকে সংযত করতে পারেনি। আর না পেরেছে নিজেকে সামলাতে। তাই কয়েকটা কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এখন যেন নিজের কাছেই তিনি ছোট হয়ে গিয়েছেন। বারবার কিছু মুহূর্ত আগের কথাগুলো ভেবে তিনি বড্ড অনুতপ্তবোধ করছেন।

— ‘ আমিনুল, আরেকটু দ্রুত চালা। এতো ধীরে ধীরে চালাচ্ছিস কেন? ‘
— ‘ খালাম্মা এর থেকে বেশি স্পিড দিলে এক্সিডেন্ট করতে হইবো। ‘
— ‘ চুপ থাক বেয়াদব। খালি মুখে মুখে কথা। তোকে যেটা বলছি সেটা কর। ‘
— ‘ এখন আমিনুলের উপর কেন রাগ দেখাচ্ছ? তখনতো কারো কথা শুনছিলে না৷ যা নয় তা বলেছ। এখানে তাদের কি দোষ বলতে পারো? তাদের কেন এইসব বলে আঘাত করলে? ‘

শায়লা রহমান স্বামীর কথার পরিবর্তে কিছু বলতে পারল না। শুধু মলিন মুখে গাড়ির জানালার বাহিরে দৃষ্টি দিলো। তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন কাজটা বড্ড অন্যায় হয়ে গিয়েছে। তিনিতো এমন স্বভাবের নন। তাহলে কেন আজ এই অবনতি?
সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। নতুবা সন্তানের দোষে কখনও পিতা-মাতাকে দোষারূপ করতো না৷

কিন্তু বিয়ের কনে নিখোঁজ থেকে এতকিছু ঘটে গেল তারপরও একজনের কোনো হেলদোল পরিলক্ষিত করা গেল না। তার মুখ দিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ একটা টু শব্দ বের হতে দেখেনি। বসার ঘরে এখনও নীলার নানু বাড়ির দাদু বাড়ির অনেকেই রয়ে গিয়েছে। আর এখন বারবার আড়চোখে সবাই সাদিদকেই দেখছে। শান্ত তাদের এমন আচরণ দেখে ভয়ার্ত পায়ে সাদিদের দিকে এগিয়ে আসলো। কান্না মিশ্রিত ভাঙা গলায় ডাকল,

— ‘ জিজু। ‘

ডাকটা যেন সাদিদের পুরো শরীর নাড়িয়ে দিলো৷ আধো কি সে এই সম্বোধনের যোগ্য?
সে এবার চোখ তুলে তাকালো। শান্ত সাদিদের এই অবস্থা দেখে ভয়ে দুইপা পিছিয়ে গেল। রক্তবর্ণ চোখজোড়াতে স্পষ্ট লোকায়িত জলের আনাগোনা৷ কয়েক ঘণ্টা আগে একেবারে পরিপাটি ছেলেটা এখন একবারেই অগোছালো। এলোমেলো, উষ্কখুষ্ক, মলিন মুখমণ্ডল। ঘন স্লিকি চুলগুলো যেন একেবারে রুক্ষ। শান্তর যেন সহ্য হলো না। সে সাদিদের এই অবস্থা দেখে মুখে হাত চেপে কান্না শুরু করল। সাদিদ কয়েক মুহূর্ত নির্বিকার তার কান্না দেখলো। তারপর শেরওয়ানির উপরের বোতামগুলো খুলতে খুলতে এলোমেলো পায়ে হাঁটা ধরল। কোন দিকে যাচ্ছে এই মুহূর্তে তার খেয়াল নেই। দিক-বেদিক হয়ে সে হাঁটতে লাগল। ডাইনিং টেবিলের সামনে আসতেই হঠাৎ দক্ষিণ পাশের রুমটাতে তার নজর পড়ল। দরজায় আকাশি সাদা বর্ণের পর্দাটা বাতাশের তুপে এলোমেলো ভাবে উড়ছে। সাদিদ পা টিপে টিপে রুমটার দিকে এগিয়ে গেল।
এই ছোট্ট রুমটা সাদিদের ভীষণ পছন্দের।
হয়তো বা তার নিজের আলিশান বিশাল রুমটার থেকেও। কেননা এখানে যে তার প্রাণপাখি দিনের বেশিরভাগ সময়টা অতিবাহিত করে। সে ঘুমায় এই ছোট্ট খাটে। অহ্ দুঃখিত সে ঘুমাতো এই খাটে। এখনতো ঘুমায় না। কোথায় সাদিদের প্রাণপাখি?
সাদিদ ঝাপসা চোখে পুরোটা রুমে নজর বুলালো। নীলা খুব গোছানো স্বভাবের মেয়ে। এলোমেলো দেখলেই সে খুঁতখুঁত করে। কিন্তু বিয়ের আমেজে রুমটা এখন অনেকটাই অগোছালো। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিয়ের কনের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস। সাদিদের নজর বারান্দায়ও পড়ল। সেখানেই নীলার গায়ে হলুদের পরিহিত শাড়িটা দড়িতে টাঙানো রয়েছে।
সাদিদের যেন এবার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে বার কয়েক টেনে টেনে শ্বাস ফেলে বিছানায় গিয়ে বসলো। কপাল, গলা বেয়ে তার চুয়ে চুয়ে ঘাম ঝরছে। সে এলোমেলো ভাবে মুখের ঘাম মুছে জড়সড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এই মুহূর্তে কেউ তাকে দেখলে নির্ঘাত ভাববে সে শীতে কপোকাত। বর্তমান পরিস্থিতি তাকে বাচ্চাদের মতো আচরণ করতে বাধ্য করছে। বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সাদিদের নিজের হাতে কেনা নীলার জন্য বিয়ের পোশাকসহ গয়নাগাটি। যা হয়তো এই মুহূর্তে নীলার পরিধেয় থাকতো৷ লাল টুকটুকে বউ সেজে সে সাদিদের অপেক্ষায় অধৈর্য্য পহর কাটাতো৷
কিন্তু দুর্ভাগ্য এমন কিছুই হয়নি৷ আর না আর কখনও হবে। সে লাল টুকটুকে বউ সাজবে কিন্তু সেটা সাদিদের জন্য নয়। বরং সে তার ভালোবাসার মানুষের জন্য সাজবে। তাহলে সাদিদ কি তার ভালোবাসার মানুষ না? কিন্তু সাদিদ এটা কিভাবে মানবে? সে যে তার চোখে নিজের জন্য উপচে পড়া ভালোবাসা দেখেছে। তাহলে ঐ চোখজোড়ার ভাষা কি সাদিদ এতদিন বুঝতে পারেনি? এতটা ব্যর্থ প্রেমিক সে?
সে কাঁপা হাতে নিজের ডান হাতের মুঠিটা সামনে আনলো৷ তার বুক ধক ধক আওয়াজ করে ক্রমাগত বেজে চলেছে। সে ধীরে ধীরে চিঠিটা আবারও মেলে ধরল,

— ‘ আব্বু-আম্মু আমাকে ক্ষমা করে দিও। কিন্তু এই বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ আমি একজনকে খুব ভালোবাসি। তাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। কেবলমাত্র তোমাদের সম্মানের কথা চিন্তা করে এই বিয়েতে মত দিয়েছি। কিন্তু আমি এটা পারব না। আমার পক্ষে তাকে ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে ঘরবাঁধা সম্ভব নয়। তার থেকে আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব। তাই শেষ সময়ে সহ্য করতে না পেরে চলে যাচ্ছি। আমার খোঁজ করার চেষ্টা করো না। তোমাদের জামাইকে নিয়ে আমি সুখি থাকব। আর ঐ পরিবারকেও বলে দিও আমাকে ক্ষমা করে দিতে। এই বিয়ে হলে না তাদের ঘরের ছেলে সুখি থাকতো আর না আমি৷ তাই আমার এই সিদ্ধান্ত। আশাকরি রাগ কমলে তোমরা সবাই আমার অবস্থাটা বুঝতে সক্ষম হবে।

ইতি,
নীলা

এতো নিখুঁত অভিনয়! কবিরা ঠিক-ই বলে৷ নারীজাতি বড্ড রহস্যময়। তার সঙ্গে ছলনাময়। তাদের মতো রঙ বোধহয় গিরগিটিরাও পাল্টাতে পারে না। সাদিদের কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ছেলেদের কান্না এই সমাজের চোখে ঘৃণিত বস্তু। নাহয় সাদিদ বোধহয় এখন ডুকরে ডুকরে মেয়েদের মতো কান্না করতো। সে চিঠিটা মুঠিতে পিষে নিয়ে বুকে হাত চেপে ধরল। আবারও তার নিঃশ্বাসের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। রক্তিম বর্ণের চোখজোড়া হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিয়ে সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রুম থেকে চলে যেতে নিয়েও কি মনে করে যেন দাঁড়িয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থেকে নিজের অস্থিরতা মিশ্রিত নজর চারদিকে বুলিয়ে নিলো৷ অতঃপর পাগলের মতো বিয়ের শাড়ি, মালা, গহনা সবকিছু নিজের হাতে নিতে লাগল। দ্রুততার সহিত সবগুলো জিনিস গুছিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। সবাই তীক্ষ্ণ চোখে সাদিদের এই পাগলামি দেখছে। কিন্তু কিছু বলা বা বাঁধা দেবার সাধ্য কারো নেই। সাদিদ জিনিসপত্রগুলো নিয়ে নিচে নেমে গাড়ির পিছনে রেখে এসে আবারও নীলার রুমে আসলো। তারপর বাকি জিনিসগুলো হাতে নিয়ে আবারও বেড়িয়ে গেল। ডাইভ করার শক্তি বোধহয় তার শরীরে নেই। তাই ধরা গলায় শুধু বলল,

— ‘ বাসায় চলো। ‘

কারো আর কিছু জানার বাকি নেই। তাই ডাইভার বিনা বাক্য গাড়ি স্টার্ট দিলো। আর সাদিদ পা গুটিয়ে সিটে হেলান দিলো। হাতে তার নীলার বিয়ের শাড়িটা পেচানো।
পদ্মালয়ার সামনে গাড়ি এসে থামতেই ডাইভার নিচুস্বরে বলল,

— ‘ ছোট ভাই চলে আসছি৷ ‘
— ‘ হ্যাঁ? ‘

সাদিদ থতমত খেয়ে চোখ খুলল। সামান্য কথাটাতেই তার যেন ভয় পাওয়ার অবস্থা। ডাইভার শফিকের বড্ড মায়া লাগলো তার ছোট ভাইয়ের জন্য। সর্বদা হাসিখুশিতে থাকা ছেলেটার আজ একি অবস্থা হয়েছে। তার মুখের দিকে তাকালো যাচ্ছে না। ঐ একটা মেয়ে-ই যেন ছেলেটার জীবনটা আটকিয়ে রেখে দিলো। এই সাদিদের সাথে আগের সাদিদের যেন কোনো মিল নেই। দুইজন যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ। এই সাদিদ ছন্নছাড়া, নির্জীব। আর আগের সাদিদ হাস্যউজ্জ্বল, প্রাণোচ্ছল।
সাদিদ এলোমেলো ঝাপসা পায়ে গাড়ি থেকে নামলো। পদ্মলয়ার বাহারি আলোকসজ্জার দিকে নজর পরতেই তার বুকে যেন আবারও রক্তক্ষরণ হতে লাগল। সবকিছু আগের জায়গায় রয়েছে। সব আয়োজনও সমানতালে করা হয়েছে। এককথায় সাদিদের বউকে বরণ করার জন্য পদ্মলয়া সহ সবকিছু তৈরি। কিন্তু সাদিদের বউটাই নেই। কোথায় সে?
কোথায় তার প্রাণপাখি? সাদিদ লোকায়িত জলে চিকচিক করা চোখগুলো এদিক-সেদিক তাকিয়ে আড়াল করতে চাইল। তারপর পিছন থেকে একএক করে সবগুলো জিনিস উঠাতে নিতেই শফিক এগিয়ে আসলো,

— ‘ ভাই, আপনি যান। আমি নিয়া আসতাছি। ‘
— ‘ না। একদম না। এগুলো আমার পাখির। তুমি ছুঁবে না। আমার পাখি রাগ করবে। ‘

সাদিদকে এমন মানসিক রোগীদের মতন আচরণ করতে দেখে শফিকের কান্না পেয়ে গেল। তার গলা ভেঙে আসছে। সে মাথা নিচু করে শুধু দাঁড়িয়ে থাকলো৷ সাদিদ নিজের মতো করে আগলে ভীষণ যত্ন সহকারে সবগুলো জিনিস উপরে নিজের রুমে নিয়ে গেল। রুমে ডুকতেই সাদিদের ক্ষতস্থানে যেন আবারও কেউ আঘাত করলো। বিশাল বড় রুমটা ইতিমধ্যে ফুলে ফুলে সজ্জিত করে ফেলা হয়েছে। ডেকোরেশনের লোকরা সাদিদের বলা অনুসারে বেলি, হাসনাহেনা, রজনীগন্ধার সাথে টকটকে লাল গোলাপের সাহায্য পুরো রুমটা সাজিয়েছে। এতো এতো ফুল মনে হচ্ছে এটা কোনো রুম নয় বরং ফুলের একটা বাগান। ফুলের তীব্র সুভাস আর জেসমিনের সুভাসের অসংখ্য লাভ সেইপ ক্যান্ডেল মিলে রুমটাকে যেন এক স্বপ্নের রাজ্যে পরিণত করেছে।
এতো আয়োজন না করে উপায় আছে?
আজ যে সাদিদ-নীলার বাসর রাত। একে-অপরের উষ্ণতায় ভালোবাসায় ডুবে থাকার রাত। তাই এই আয়োজন তো অনিবার্য। কিন্তু এখন কেবল এই রজনী স্বপ্নের রাজ্যের ন্যায় কল্পনা। যার বাস্তবের স্মৃতির পাতা অসম্ভব। সাদিদ ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো। ঝাপসা চোখে পুরো রুমটাতে একবার নজর বুলালো। তারপর বিয়ের সবগুলো জিনিস বাচ্চাদের মতন একটা একটা করে সাজিয়ে বিছানার উপর রাখল। কাজ শেষ হলে তার ঠোঁটের কোণে নিষ্পাপ এক হাসির রেখা ফুটে উঠল।
সে নিজের জন্য একটু জায়গা করে গুটিশুটি মেরে একপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। বিয়ের জিনিসগুলো দেখে আবারও মৃদু হাসলো। হাসিমুখেই কাঁপা হাতে বিয়ের শাড়িটা নিজের কাছে টেনে আনলো। কাঁথার মতন করে শাড়িটা নিজের বুকের উপর জড়িয়ে নিলো। অতঃপর আলতো করে হাত বুলাতে শুরু করল। যেন সে নীলার শাড়িকে নয় স্বয়ং নীলাকেই আদর করছে। সাদিদ চোখ বন্ধ করতেই তাদের একে-অপরের সঙ্গে অতিবাহিত করা ভালোবাসাময় সেই সুখস্মৃতিগুলো চোখের পর্দায় ভেসে উঠতে লাগল। ভেসে উঠতে লাগল সেই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলো যেগুলো তারা একে-অপরের সান্নিধ্যে অতিবাহিত করেছে। একে-অপরের উষ্ণতায় মত্ত হয়েছে।
সাদিদ চোখ বন্ধ করেই নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। আর গুনতে লাগলো তার প্রিয়তমার আকর্ষণিয় তিলকসহ দেহের অগণিত গৌড় বর্ণের নীলচে শিরা-উপশিরাগুলো। প্রিয়তমার কোমল শরীরের সবকটা ভাঁজ যেন সাদিদের মুখস্থ। সাদিদ মনের আঙিনায় সাজাতে লাগল তাদের প্রথম ভালোবাসার প্রকাশ। প্রথম উষ্ণ চুম্বন। প্রথমবারের অনুভব করা ওষ্ঠদ্বয়ের মিষ্টি স্বাদ। প্রথমবার একে-অপরের কাছে আসা। সম্পূর্ণভাবে একে-অপরের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। আর সেইসব মুহূর্তে নমনীয়তার আড়ালে নীলার লজ্জা রাঙা রক্তিম মুখখানাও যেন তার চোখের সামনে স্পষ্ট ভাসছে। সব যেন বাস্তব।
সাদিদের ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি। কিন্তু হঠাৎই ধীরে ধীরে সেটা মিলিয়ে যেতে লাগল। সাদিদ দ্রুত নিজের চোখ খুলে হুড়মুড়িয়ে বসল। এসি চলাকালীনও ইতিমধ্যে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সে আচমকা চোখে হাত চেপে বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠল,

— ‘ এই পাখি না৷ একদম না৷ আমি সহ্য করতে পারব না। পাখি, এই এই….

সাদিদের কন্ঠ লেগে লেগে আসছে সে চোখ ছেড়ে গলাতে হাত রাখল। কথা কেন বের হচ্ছে না? সে কাশতে শুরু করলো। ঝাপসা চোখগুলো দিয়ে সামনের কিছু আর দেখা যাচ্ছে না। সে বিছানা থেকে শাড়িটা নিয়ে পাগলের চোখ মুছতে শুরু করলো। তারপরও যেন জলকণা এসে বারবার চোখ ঝাপসা করে দিচ্ছে। ভাঙা স্বরে সে নীলার শাড়িটা বুকে চেপে ধরল,

— ‘ লক্ষ্মিটি এমন করিস না৷ আমি মরে যাব পাখি৷ তোর দেহে-মনে অন্য কারো বিচরণ আমি সহ্য করতে পারব না৷ প্লিজ দোহায় লাগে এমন করিস না আমার সাথে। প্লিজ পাখি, দয়া কর আমাকে৷ একটু রহম কর। সত্যিই বাঁচতে পারব না। আমি যে আমাদের সুখের ছোট্ট সংসার সাজাতে চেয়েছি। কিন্তু তুই কেন চাসনি? কেন পাখি? কেন এমন করলি? কিসের জন্য? কে…

আচমকাই এতক্ষণের আর্তনাদে নিস্তব্ধতা ভেসে আসতে লাগল। বুক চিঁড়ে আসা কথাগুলো থেমে থেমে যেতে লাগল। অবশেষে প্রিয়তমার সিঁদুর রাঙা বেনারসি শাড়িটা বুকে জড়িয়েই পাগল প্রেমিক বিছানায় ঢলে পড়ল।

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৪৩

চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। ডিসেম্বর মাসের হঠাৎ এই বৃষ্টিতে যেন জনজীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয়। আকস্মিক এই প্রাকৃতিক ধাক্কার সাথে বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্য যেন ইতিমধ্যে হাঁপিয়ে গিয়েছে। শায়লা রহমান ছেলের মাথাটা কোলে নিয়ে আহাজারি শুরু করেছে। আর হাসিবুর রহমান পুরো রুমজুড়ে পায়চারি করছে। আর বারবার ফোনে ডক্টরের অবস্থান জানতে চাইছে। বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে বিধায় ডাক্তারের আসতেও লেইট হচ্ছে। শাহেদকেও ইতিমধ্যে সাদিদের কন্ডিশন জানানো হয়েছে। আরিফ মাহমুদের অবস্থাও খারাপ। এমনিতেই তার হার্টে প্রবলেম ছিল। আর আজকের সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এতসবের ধাক্কা সামলাতে না পেরে তিনি মাইল্ড এট্যাক করেছেন। ডক্টর বলেছে উনাকে প্রপার রেস্ট নিতে। আর উনাকে একদম দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে হবে। নতুবা যেকোনো সময় যেকোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে।
নিধি-নার্গিস খাতুনও পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। বারবার কান্নায় ভেঙে পরছে। তানবীরকে এইদিকটা দেখতে বলে শাহেদ দ্রুত অর্ণবকে নিয়ে বাসায় রউনা দিয়েছে।
ডাইভিং সিটে অর্ণব বসেছে। সে নিজেও সাদিদের অবস্থা জেনে অস্থির। কিন্তু শাহেদকে কপাল চেপে ধরে রাখাতে নিচুস্বরে বলল,

— ‘ ভাই, টেনশন করবেন না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ‘

শাহেদ তার কথায় চোখ খুলে তাকালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

— ‘ কি ঠিক হবে অর্ণব? সবকিছু যে হাতের নাগালের বাহিরে চলে যাচ্ছে। ঐদিকে বাবা আর এদিকে সাদি। কি করলে সবকিছু আগের মতো হবে আমি সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না৷ ‘

অর্ণব এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলতে পারল না। তার নিজের কাছেও এই প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা নেই৷ বন্ধু সমতুল্য ভাইয়ের জন্য মারাত্মক দুশ্চিন্তা-অস্থিরতা আর বর্তমান চারপাশের পরিস্থিতি বিবেচনাতে অর্ণবের রাগ হচ্ছে এইসবের মূলে যে রয়েছে তার প্রতি। তার নীলার উপর এই মুহূর্তে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। সামনে পেলে হয়তো সাদিদের পরোয়া না করেই দুই-তিনটা সমানে লাগিয়ে দিতো। যদি শেষ পর্যন্ত এটাই করার হতো তাহলে কেন প্রথমেই এইসবের বিরোধিতা করলো না? সাদিদ তো তাকে কখনও কোনো কিছুতে জোর করেনি। আর না করেছে কোনো কিছু নিয়ে বারণ। তাহলে শেষ পযার্য়ে এসে ছেলেটাকে এভাবে ভেঙে গুড়িয়ে দেবার কি মানে হলো?
অর্ণব চাপা রাগ নিয়ে বলে উঠল,

— ‘ ভাই, সব কিছুর জন্য একমাত্র নীলা দায়ী। ছোটবোনের মতো মনে করতাম। কখনও ভাবিনি সে এমন কিছু করে বসবে। আরে যদি অন্য কাউকে পছন্দ করেই থাকতি সেটা সময় থাকতে বলতি। সাদিটা তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে। হয়তো বা কষ্ট পেত তারপরও আমরা সবাই মিলে ওকে সামলিয়ে নিতাম৷ কিন্তু এখন আমরা কিভাবে কি করব? ‘

সে রাগে ফুঁসছে। শাহেদ নিজে এবার কিছু বলতে পারল না। কি বলবে? নীলাটা যে তারও হৃদয়ের বৃহৎ একটা অংশজুড়ে রয়েছে। ছোট বোনের মতো সবসময় আদর-স্নেহ করে এসেছে। সাদিদ তার আপন ভাই হলেও নীলার জায়গা কোনো অংশে তার চেয়ে কম নয়। তাই সে নীলা আজ এটা কিভাবে করতে পারলো সেটা শাহেদও বুঝে উঠতে পারছে না৷ সে জানালার বাহিরে বৃষ্টিস্নাতরত প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তাদের হয়তো বা এখন এই দীর্ঘশ্বাসই একমাত্র সঙ্গী।
তারা বাসায় পৌঁছাতেই মিনু এসে দরজা খুলে দিলো। পিচ্চি মেয়ে এসব সহ্য করতে না পেরে কান্নাই শুরু করেছে। শাহেদ আলতো করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে উপরের দিকে পা বাড়ালো।
তাদের পরিচিত ডক্টর ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছেন। তিনি সাদিদকে চেক-আপ করছে। শাহেদকে রুমে ডুকতে দেখে যেন শায়লা রহমানের কান্নার স্রোত আরও বেড়ে গেল।

— ‘ এই শাহেদ দেখ, দেখ আমার বাচ্চাটার কি হয়েছে। আমি কতবার করে ডাকছি সে উঠছে না। আমার সাদিটা আমাকে মা বলে ডাকছে না৷ এই সাদি, আব্বা উঠ। মা ডাকছি তো৷ ‘

শাহেদের রক্তিম বর্ণের চোখজোড়া যেন আরও লালচে হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে শায়লা রহমানের পাশে বসে মায়ের হাতটা মুঠিতে নিয়ে তাকে বুকে টেনে আনলো৷ স্বান্তনা এই মুহূর্তে দিয়ে লাভ নেই৷ তারপরও মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করতে লাগল। ছেলের স্নেহময় মমতা পেয়ে শায়লা রহমান আরও ফুঁপিয়ে উঠলেন। পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ দৃশ্যের মধ্যে একটি বোধহয় জন্মদাত্রীর চোখে অশ্রুজল দেখা। আর তখনতো আরও কষ্টকর হয়ে উঠে যখন তার চোখের পানি মুছে দেওয়ার কোনো উপায় দেখা যায় না৷ শাহেদের অবস্থাও এখন সেই পর্যায়ে। সে রক্তিম চোখজোড়া নিয়ে একহাতে শায়লা রহমানকে আগলে রেখে অপর হাতটা সাদিদের মাথায় রাখল। মলিন হেসে ভাইয়ের কপালে পরে থাকা এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিলো৷ পাগলটা এখনও পর্যন্ত বিয়ের শেরওয়ানিটা খুলেনি। এটা দেখে যেন শাহেদ আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারছে না৷ বুকটা হাহাকার করে উঠছে। ডক্টর ইফাজ তারই ক্লাসমেইট। তাই ইশারায় তাকাতেই সে বলে উঠল,

— ‘ অতিরিক্ত মেন্টাল প্রেসারে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে। চিন্তা করিস না। আপাতত ইনজেকশন পুষ করে দিয়েছি৷ জ্ঞান ফিরে আসলেই কিছু খাইয়ে এই ঔষধগুলো খাইয়ে দিস। ‘
— ‘ সাদির এমনটা কখনও হয়নি। ‘

শাহেদ যেন বাচ্চাদের মতো অবুঝ একটা কথা বলে ফেলল। ইফাজ বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত। তাই সোজা সাপটা বলল,

— ‘ পরিস্থিতি মানুষকে সবকিছু করতেই বাধ্য করে। সাদিদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা কিছুটা সেইরকম। স্ট্রং একটা ছেলে আজ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পরে ভেঙে গিয়েছে। হয়তো বা এতটাও হতো না, যদি না বিপক্ষে ভালোবাসার মানুষটার অবস্থান না হতো। ‘

শাহেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও সাদিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। এর বিপরীতে কিছু বলতে পারল না। ডক্টর ইফাজ এবার কিছুটা ইতস্ততবোধ করে বলল,

— ‘ এখনকার মতো ঠিক আছে। কিন্তু তোদেরকে এখন সাদিদের পূর্ণ খেয়াল রাখতে হবে। নতুবা আরও ভয়ানক কিছু ঘটে যেতে পারে। আই হোপ তুই আমার কথাটা বুঝতে পারছিস? ‘

শাহেদ ভীষণ অসহায় চোখে তাকালো। তার চোখের দৃষ্টিই যেন বলে দিচ্ছে কিভাবে সামলাবো? ছেলেটা যে মারাত্মক জেদি। নিজের জেদের আগে কারও কথা শুনে না। আর তারা না পারবে তার কথায়-কাজে সাই জানাতে। নতুবা কি ঘটতে পারে কেউ হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না। নিজেকে তার বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। হাজার ইচ্ছে থেকেও যেন কিছুই করতে পারছে না৷
ডক্টর ইফাজ আরও টুকটাক কথাবার্তা বলে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। শাহেদ তাকে নিচ অব্দি এগিয়ে দিয়ে আসলো। সাদিদের এখনও সেন্স ফিরেনি৷ সে আবারও রুমে ফিরে মায়ের উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ সারাদিন কারো পেটে একবিন্দু দানা-পানি পরেনি৷ প্লিজ মা উঠো। ফ্রেশ হয়ে কিছু খাবে। ‘
— ‘ বিরক্ত করিস না শাহেদ। আমার খিদা নেই৷ ‘
— ‘ মা, প্লিজ বাচ্চামি করো না। না খেয়ে থাকলে বুঝি সব ঠিক হবে? খেয়ে তোমার ঔষধগুলোও তো খেতে হবে। ‘
— ‘ বললাম না একবার? বারবার এককথা বলবি না তো। যা এখান থেকে। ‘

শায়লা রহমান প্রচন্ড রেগে শাহেদের উদ্দেশ্য কথাগুলো বলল। সে মায়ের দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকাতেই শায়লা রহমান শাড়ির আঁচলে মুখ ডেকে আবারও চাপা স্বরে ফুঁফিয়ে উঠল। ছেলেগুলো তার কলিজার টুকরো। অভিমান- মেকি রাগ দেখিয়ে দুই-এক কথা বললেও কখনও উচ্চস্বরে ধমক পর্যন্ত দিতে হয়নি। কখনও তারা সেই সুযোগটুকুও তাকে দেয়নি। আর আজ পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলাতে না পেরে কি করছে কি বলছে সেটা তিনি নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না।
শাহেদও নিজের মাকে চিনে৷ তাই সবটাই বুঝতে পারলো। তাই এই মুহূর্তে আর কিছু না বলে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। ঐদিকের খবরটাও নেওয়া প্রয়োজন। বিপদ যখন আসে তখন যেন সবদিক দিয়েই আসে। নিধিকে কল করার কিছু মুহূর্ত বাদেই সে কল রিসিভ করলো।

— ‘ হ্যাঁ বলুন। ‘

প্রিয়তমা স্ত্রীর ভাঙা গলা শুনেই সে ওপাশের পরিস্থিতি ঠিক আঁচ করতে পারল। তারপরও নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করলো,

— ‘ বাবার শরীর এখন কেমন? ‘

নিধির উত্তর দিতে দেরি দেখেই শাহেদ ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। মায়াভরে কন্ঠে বলল,

— ‘ চিন্তা করো না। আল্লাহ চাহে তো সব ঠিক হয়ে যাবে৷ ‘

স্বামীর মধুর স্বরের স্বান্তনা বাক্য শুনে নিধি এতক্ষণের চেপে রাখা কান্না প্রকাশ করেই ফেলল। ছেলেটা তার বুকেই মুখ গোঁজে ঘুমিয়ে রয়েছে। তাই একহাত নিজের মুখে চেপে কান্না আটকানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। শাহেদ তাকে নিজেকে সামলিয়ে নেবার জন্য একটু সময় দিলো। খানিকবাদে নিধি ক্রমাগত হেঁচকি তুলে জানতে চাইল,

— ‘ তখন ঐভাবে গেলেন, সাদিদ কেমন আছে? ডক্টর কি বলল? ‘

শাহেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিধিকে সবটুকু বলল। সাদিদের শারীরিক কন্ডিশন শুনে নিধির অপরাধবোধ জাগতে লাগলো৷ হাজার হলেও নীলা তার আপন বোন। বোনের জন্য যদি এতসব হয়ে থাকে তাহলে আপনাআপনি নিজের গায়ে সেটা চলে আসে। সামনাসামনি না হলেও দূর থেকেই প্রিয়তমার মনের অবস্থা শাহেদ বুঝতে পারলো৷ তাই কথা ঘুরাতে বলল,

— ‘ আমার আব্বা কি করে? ‘

নিধি শাদমানকে বুকের সাথে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মাথায় স্নেহের একটা চুমু খেয়ে বলল,

— ‘ কান্না করেছিল। তাই তাড়াতাড়ি-ই ঘুমিয়ে পরেছে। ‘
— ‘ খেয়েছিলো? ‘
— ‘ আসলে তখন খাওয়ানোর অবস্থায় ছিলাম না৷ আর বাবুতো নিজেও খেতে চাইল না। তাই আরকি…
— ‘ আচ্ছা সমস্যা নেই। আমি আসবো কিছুক্ষণের মধ্যে। তারপর উঠিয়ে খাইয়ে দিব। ‘
— ‘ আপনি আবার কেন কষ্ট করে আসতে যাবেন? আমি নিজেই পারব। ‘
— ‘ চুপ। তুমি পারবে নাকি পারবে না এটা আমি জানতে চাইনি৷ ওকে বুকে না নিলে আমার ভিতরটা শান্তি হবে না বউ৷ আর এইমুহূর্তে একটু শান্তির বড্ড প্রয়োজন৷ ‘

নিধি এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে আর কিছু বলতে পারল না৷ শাহেদও অল্প কিছুক্ষণ সময়ের মধ্যে আসছি বলে ফোন কাটল।

________________

ঘড়ির কাটাতে রাত দুইটা বেজে সাইত্রিশ মিনিট। সাদিদের রাত থেকেই শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। তাই সেন্স ফিরে আসলেও একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। শায়লা রহমানসহ বাড়ির প্রতিটি লোক অনেকরাত পর্যন্ত তার রুমেই ছিল। ছেলের অস্থিরতায় আবারও বাড়িতে ডক্টর ডেকে আনা হয়। ডক্টর সাদিদের চেকআপের পাশাপাশি জ্বরের জন্য কিছু মেডিসিন দিয়ে তারপর গিয়েছেন। কিছু খেতে রাজি হয়নি বিধায় না খাইয়েই জ্বর কমার জন্য ঔষধ দিতে হয়েছে। শায়লা রহমান সেই থেকে লাগাতার ছেলের মাথায় জলপট্টি দিয়ে চলেছেন৷ সময় বাড়তেই একসময় ছেলের কপালে হাত রেখেই বালিশে হেলান দিয়ে তিনি চোখজোড়া বন্ধ করেছেন৷ বয়স তো আর কম হয়নি৷ সারাদিন যেসব হলো শরীর আর কতো কুলাবে?
সাদিদের বন্ধ চোখের পাতা মিটিমিটি নড়েচড়ে উঠছে৷ আঙুলগুলোও ধীরে ধীরে জায়গা পরিবর্তন করতে লাগল। রাতের নিস্তব্ধতাকে বেধ করে হঠাৎই চিৎকার করে উঠে বসল,

— ‘ পাখি। ‘

শব্দটা যেন পুরো রুমজুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। শায়লা রহমান ছেলের চিৎকার শুনে মুহূর্তেই জেগে গেলেন। সাদিদের পিঠে ক্রমাগত হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

— ‘ বাবা উঠেছিস? খুব ভালো হয়েছে। সারাদিন কিছু খাসনি৷ কি খাবি বল? আমি এখনি নিয়ে আসছি। ‘
— ‘ মা পাখি, আমার পাখি কই? ‘
— ‘ নাই। কেউ নাই৷ তুই বস আমি এখনই তোর খাবার নিয়ে আসছি৷ জ্বর এখনও পুরোপুরি যায়নি। তাই খেয়ে বাকি ঔষধগুলো খেতে হবে। ‘
— ‘ না, না আমি কিছু খাব না৷ আমার পাখিকে চাই৷ মা আমার পাখিকে এনে দাও৷ ‘

শায়লা রহমানের ধৈর্য্যের বাদ যেন এবার ভেঙে যাচ্ছে। বুঝের ছেলে কেমন অবুঝের মতন আচরণ শুরু করছে। তাই তিনি রাগী স্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

— ‘ নাই তোর পাখি৷ কোথাও নাই। সে তোকে ফাঁকি দিয়ে তার নাগরের কাছে চলে গেছে। ‘
— ‘ মা। ‘

মায়ের কথার পরিবর্তে উচ্চস্বরের এই চিৎকারে ছেলের রাগ প্রকাশ পেল না। পেল শুধু আকুতিভরা করুন আর্তনাদ। অভিমানে ছেলের ফর্সা মুখটা আরও মলিন হয়ে গেল৷ সে আবারও একপলক মায়ের দিকে তাকিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। শায়লা রহমান তাকে এভাবে উঠতে দেখেই বাধা দিলো,

— ‘ বাবা না। একদম উঠবি না। শরীর টলমল করছে তোর। পরে যাবি সাদি। ‘
— ‘ আমি ঠিক আছি মা। চিন্তা করো না। ‘
— ‘ না তুই ঠিক নেই। বস এখানে। ‘

সাদিদ শুনলো না। মায়ের অবাধ্য হয়েই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। শায়লা রহমানও তার পিছন পিছন ছুটল। সাদিদ যেন নেশা না করেও আজ মাতালের ন্যায় আচরণ করছে। পাগুলো তার থরথর করে কাঁপছে। সাথে পাল্লা দিয়ে সে নিজেও।
তাই হাঁটার সময় এখানে সেখানে হুঁচট লাগল। যার ফলস্বরূপ কিছু জিনিস মেঝেতে পরে ভেঙে গেল। নীরবতার চাদরে ঢাকা এই সুনশান রাতে ছোট্ট আওয়াজগুলোা যেন ভীষণ দাগকাটে। তারউপর শায়লা রহমানের এমনভাবে ছেলের পিছন পিছন দৌঁড়িয়ে আসাতে বাড়িসুদ্ধ অনেকেরই ঘুম ভেঙে গেল। তারা দরজা খুলে বাহিরে এতরাতে কি হচ্ছে সেটা দেখার জন্য বেড়িয়ে আসলো।

— ‘ সাদি বাবা আমার, মায়ের কথা শোন৷ কোথায় যাচ্ছিস? শরীরটা ভালো না বাবা, পরে যাবি। শোন৷ ‘

সাদিদের কোনো হেলদোল নেই৷ সে টলতে টলতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো। সদরদরজা খুলতে গেলেই শায়লা রহমান গলার আওয়াজ বাড়িয়ে হাসিবুর রহমানকে ডাকতে লাগলো,

— ‘ শাহেদের বাবা, এই কোথায় তুমি? জলদি আসো৷ দেখ সাদি কি করছে? এই বাবা শোন মায়ের কথা। যাস না আব্বা। ‘
— ‘ দাঁড়া সাদি। এতোরাইতে একদম পাগলামি করবি না৷ সারাদিন তোর অবস্থা দেইখা কিছু কই নাই৷ তাই বইল্লা ভাবিস না এহনও তোর এমন পাগলামি চুপ কইরা দেহুম। ‘

দিলারা রহমান নাতির পাগলামি সহ্য করতে না পেরে বেশ রাগ নিয়েই কথাটা বলে উঠলেন। বড়দের সাথে বেয়াদবি সাদিদের স্বভাবে নেই৷ তাই বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। নিচুস্বরে দাদুর উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ দাদু বাধা দিও না। আমার পা.. নীলাঞ্জনাকে খোঁজে বের করতে হবে৷ ‘
— ‘ চুপ একদম চুপ। তোর পছন্দ দেইখা আমরা কেউ বিয়াতে না করি নাই৷ কিন্তু এহন কোনোমতেই ঐ মুখপুড়ি মাইয়ারে আমাদের বাড়ির বউের আসনে বসাইতাম না৷ ভুইলা যা ঐ চরিত্রহীনা মাইয়ারে। তোরে আমি পরির লাহান সুন্দরী মাইয়া দেইখা বিয়া করামো। যা ঘরে যা। ‘

সাদিদ হাতের মুঠি শক্ত করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখজোড়াতে যেন রক্তের স্রোত। ফর্সা মুখে কপালের নীলচে রগটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। দাদুর জায়গায় অন্যকেউ হলে হয়তো সে এতক্ষণে তার জিহবা টেনে ছিঁড়ে ফেলত। কিন্তু ভুল মানুষ ভুল জায়গায় দাঁড়ানো। তাই নিজের রাগটাকে শক্ত হাতে চেপে নিতে চাইল।
সে দাদুর কথায় বেয়াদবি করলো না কিন্তু তার কথা শুনলোও না৷ আবারও সামনের দিকে পা বাড়াতেই শায়লা রহমান কেঁদে কেটে বলে উঠলেন,

— ‘ ঐ মেয়ে তোর কাছে সব? আমরা তো কিছু না সাদি? তোর বুড়া দাদু বলছে, আমি বলছি সেটা তোর কানে যাচ্ছে না? দুইদিনের এক মেয়ের ভালোবাসায় মায়ের ভালোবাসা ভুলে গেলি? বাহ্ বেটা বাহ্। সত্যিই অসাধারণ৷ ‘

শায়লা রহমান মুখে শাড়ির আঁচল খুঁজে আবারও হতাশার কান্না শুরু করলেন। সাদিদ মলিনমুখে একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকালো। সময় দেখেই তার বুকটা ধক করে উঠল। কতগুলো মুহূর্ত কেটে গেল অথচ সে এখনও তার প্রাণপাখির দেখা পেল না। এখন দ্বিধাদ্বন্দে ভোগার সময় নয়৷ জলদি সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ তাই সে প্রথম নীলাকে খোঁজে বের করার সিদ্ধান্তই স্থির করলো। প্রথমে নীলাকে খুঁজে বের করা জরুরি। তারপর না হয় মায়ের পায়ে ধরে বসে থাকবে। তবুও মায়ের রাগ ভাঙিয়ে ছাড়বে৷ সে নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থেকে সামনে পা বাড়াতেই তার ফুপি বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলল,

— ‘ তুইতো বড্ড বেয়াদব হচ্ছিস সাদি? এতগুলো মানুষ বলছে তারপরও তুই এতোরাতে ঘরের বাহিরে পা রাখতে যাচ্ছিস? তাও ঐ চরিত্রহীনা- বেশ্য মেয়ের জন্য? ‘
— ‘ চুপ। ‘

সাদিদ এতজোরে হুংকার দিয়ে উঠলো যে ফুফি ভয়ে কয়েকপা পিছিয়ে গেল৷ আচমকা এমন শান্ত-শিষ্ট রূপ থেকে সাদিদ যে বাঘের মতো গর্জে উঠবে সেটা কেউ আঁচ করতে পারেনি৷ সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সামনে হেঁটে এসে ফুফি সামনে দাঁড়ালো। এতক্ষণের নম্রতা-ভদ্রতা সবকিছু ভুলে গিয়ে ডানহাতের তর্জনী আঙুল উঠিয়ে শাসিয়ে বলে উঠল,

— ‘ খবরদার ফুফি। নতুবা সম্পর্কের গুরুত্ব ভুলে যাব৷ যাকে তুমি এইসব অপবাদ দিচ্ছ সে আমার পৃথিবীর বৃহৎ একটা অংশজুড়ে রয়েছে। তার বিরুদ্ধে এমন কটু কথা আমি জীবিত থাকতে সহ্য করবো না৷ তাই মুখ সামলিয়ে৷ নতুবা আমার থেকে খারাপ কেউ আর হবে না। ‘

ফুফি প্রথম অবস্থায় ভয় পেয়ে গেলেও এখন পুরোপুরি তেতে উঠলেন৷ সেই ছোট্ট সাদিদের কি ভয়ংকর সাহস! তারও আবার কার জন্য? পুরো পরিবারের বদনাম রটানোর জন্য যে দায়ী তার জন্য? ফুফিও এবার কড়া গলায় বলে উঠলেন,

— ‘ এতো অধঃপতন! ছিঃ সাদিদ ছিঃ। তোর থেকে এটা আশা করিনি৷ ঐ বাহিরের মেয়ের জন্য দুই আমাদের সাথে বেয়াদবি করছিস? ‘
— ‘ অন্যসময় হলে বেয়াদবির জন্য ক্ষমা চাইতাম ফুফি৷ কিন্তু আজ চাইবো না৷ কেননা তুমি যেই অপরাধ করেছ সেটা আমার কাছে ক্ষমাযোগ্য নয়। শুধু সম্পর্কের খাতিরে আজ তুমি সুস্থ সবল এই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছ। আল্লাহ না করুক তোমার স্থানে অন্য কেউ হলে আমি এই মুহূর্তে কি করতাম সেটা নিজেও জানি না৷ ‘
— ‘ সাদি চুপ। বহুহ কইছস৷ তো ফুফু ভুল কি কইছে? ঐ বেশরম মাইয়ারে আরও খারাপ কওন দরহার। বিয়ের মজলিস থাইক্কা প্রেমিকের হাত ধইরা ভাইঙ্গা যায় কেমন লাজহীন মেয়ে মানুষ! ছিঃ এমন মাইয়া থাহন থাইক্কা না থাহন উত্তম। ‘

সাদিদের চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। হাজার চেয়েও নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না। কিন্তু তার বিপরীতে যারা দাঁড়িয়ে সবাই তার গুরুজন। এই জায়গায় সে ফেঁসে গিয়েছে৷ তাই আর একটা কথা না বাড়িয়ে পাশের সেন্টার টেবিলে সজোরে লাথি দিলো৷ আশেপাশে খুঁজে যতগুলো ভাঙার মতন জিনিস পেল সবগুলো ভেঙে চুর্ণ-বিচূর্ণ করলো। তার এই ধ্বংসলীলা হতে টিবি, ফুলের টব, এন্টিক শুপিজ কোনোকিছু বাদ পড়ল না। সাজানো গুছানো ঘরের সবকিছু ভেঙে দিয়ে সে হনহনিয়ে দরজা খুলে বাহিরে বের হয়ে গেল। কাঁচের টুকরোগুলো এখনও এখানে সেখানে গড়াগড়ি করে আওয়াজ তুলছে। মুহূর্তেই যেন শান্ত শিষ্ট পদ্মলয়ার উপর দিয়ে একটা ঘুর্ণিঝড় বয়ে গেল। সবাই বোধহয় এখনও আকস্মিক শক থেকে বেড়িয়ে আসতে পারল না৷ তাই ধ্বংসাত্মক আসবাবপত্রের দিকে এখনও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে।

#চলবে…