অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0
769

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৪৬

দুর্বিষহ কয়েকটা দিনের যাত্রা কাটিয়ে সাদিদ এখন পুরোপুরি দিশেহারা। এতদিন নিজ মনকে কোনোভাবে স্বান্তনার বাক্য শুনালেও এখন আর ধৈর্য্য কুলিয়ে উঠছে না৷ এখন পর্যন্ত দেশের আনাচে-কানাচেতে নিজের সর্বোচ্চ উদ্যোগে নীলার খোঁজ চালিয়েছে সে। কিন্তু নীলার সম্পর্কে সামান্য ক্লু পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এটাও স্বাভাবিক। কেননা কোনো নিখোঁজ ব্যক্তিকে খোঁজে পাওয়া গেলেও যে ব্যক্তি নিজ থেকে হারিয়ে যায় তাকে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু তারপরও সাদিদ হার মানতে চায় না। সবাই এতো বলার পরও সে বিরামহীনভাবে তার প্রাণপাখির খোঁজ অব্যহৃত রেখেছে। সাদিদ ধৈর্য্য রাখতে না পেরে মিরপুরের রাস্তায় গাড়ি ঘুরালো। দুইদিন আগেও নীলার পরিবারের সাথে এই নিয়ে তার কথা হয়েছে। কিন্তু আজকে সে আবারও মিরপুরের রাস্তা ধরেছে। আরিফ মাহমুদকে ইতিমধ্যে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। তাই তারা সবাই এখন বাসাতেই রয়েছে। ঘণ্টা দুইয়েক ডাইভ করে সে নীলাদের মিরপুরের বাসার সামনে এসে পৌঁছালো। দুইবার কলিংবেল চাপতেই নিধি এসে দরজা খোলে দিলো। এইসময় দরজার সম্মুখে সাদিদকে দেখে সে একটু অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করলো না। বিনয়ের সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করতে বললো।

— ‘ শাদ কোথায়? ‘

সাদিদের এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে নিধি মলিন হাসলো। বাচ্চাটা বাবা ছাড়া কিছু বুঝে না। আর সেদিনের পর নিধি আর পদ্মলয়ায় ফিরে যায়নি। এককথায় ফিরে যাবার কোনো রাস্তা ছিল না। শায়লা রহমান এখনও প্রচন্ড ক্ষেপে রয়েছেন। হসপিটালে থাকাকালীন-ই নিধিকে দুই-চার কটুকথা শুনাতে পিছুপা হয়নি। তাই শাহেদ একপ্রকার বাধ্য হয়ে বলেছে আরিফ মাহমুদের শরীর ভালো না হওয়া অব্দি যেন তাদের সাথেই নিধি থাকে। নিধি স্বামীর মনোভাব বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। শাহেদ তাকে কোনোরকম কটুকথার সম্মুখীন করতে ইচ্ছুক নয়। আর পদ্মলয়ায় নিয়ে গেলে নিধিকে এখন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন অবশ্যই হতে হবে। তখন না পারবে মায়ের সাথে উচ্চ গলায় কথা বলতে। আর না পারবে নিধির কষ্ট সহ্য করতে। আর মাকেও এই মুহূর্তে বুঝিয়ে বলে লাভ হচ্ছে না। সে তার রাগ কমাতে পারছে না। নীলাসহ তার পুরো পরিবারের উপর উনার ভীষণ রাগ জমেছে। তাই বাধ্য হয়ে শাহেদকে এই কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছে। নিধিও চুপচাপ সেটা মেনে নিয়েছে। কেননা সে তো অবুঝ নয়। পরিস্থিতি সবটাই বুঝতে সক্ষম। কিন্তু বাচ্চা ছেলেটা কি এসব বুঝে? সে তার বাবাকে চায়। শাহেদও মাঝেমধ্যে এসে সময় দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ছেলের তাতে পোষায় না। সে আরও চায়। নিধি সেসব মনে করে নিঃশব্দে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। গলায় স্বাভাবিকতার চেষ্টা নিয়ে বলল,

— ‘ ঘুমিয়েছে। ‘
— ‘ ওহ্ ‘

কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে গেল। তারপর সাদিদই বলে উঠল,

— ‘ আমি একটু আঙ্কেলের সাথে কথা বলবো। ‘
— ‘ বাবা রুমেই আছে। এসো আমার সাথে। ‘

সাদিদকে নিয়ে নিধি দরজায় এসে দাঁড়াতেই নার্গিস খাতুনের নজরে আসলো। সুদর্শন ছেলেটার এমন উষ্কখুষ্ক মলিন মুখশ্রী তার একেবারেই সহ্য হচ্ছে না। আর সেখানে অসহ্যের মাত্রাটা যে আরও তীব্র। কেননা এসবের পিছনে কোনো না কোনোভাবে তিনিও দায়ী। শত হলেও উনি মেয়ের মা। তিনি স্নেহভরা কন্ঠেই ডাকলেন,

— ‘ আরে সাদিদ যে। এসো বাবা। দাঁড়িয়ে আছো কেন? ‘
— ‘ আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আঙ্কেল কি ঘুমিয়ে পরেছে? ‘
— ‘ হয়তো। শরীরটা তেমনটা ভালো নয়। তাই বোধহয় চোখ লেগে গিয়েছে। তুমি বসো আমি এখনই ডেকে দিচ্ছি। ‘
— ‘ তাহলে থাক আমি না-হয় পরে আসবো। ‘

নার্গিস খাতুন তার কথা শুনলো না। আরিফ মাহমুদকে হালকা স্বরে ডাক দিতেই তিনি চোখ খোলে তাকালেন। নার্গিস খাতুনকে কিছু জিজ্ঞাসা করার পূর্বেই তিনি বললেন,

— ‘ সাদিদ এসেছে। ‘

আরিফ মাহমুদ ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকালেন৷ সাদিদকে দেখে বরাবরের মতোই মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুললেন,

— ‘ এসো বাবা। ‘

সাদিদ ধীরপায়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশে চেয়ার টেনে বসলো। কোানো বণিতা না করে সোজাসাপটা বলে উঠল,

— ‘ আঙ্কেল আমি আবারও নীলাঞ্জনার মিসিং কেসটা নিয়ে এসেছি। জানি ঐদিন ফিরিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তারপরও আমি চাই আপনারা আবারও বিষয়টা ভেবে দেখুন। আমার নীলাঞ্জ.. না মানে ও এমনটা করতে পারে না। আমার দীর্ঘ বিশ্বাস এর পিছনে কোনো না কোনো কারণ অবশ্যই রয়েছে। এবং সেই কারণটা একমাত্র নীলাঞ্জনাই বলতে পারবে। তাই সর্বপ্রথম তাকে খোঁজে বের করা প্রয়োজন৷ এবং সেই জন্য আমাদের আইনি সহযোগিতা চায়। প্লিজ আমাকে পারমিশন দিন। আমি নীলাঞ্জনার মিসিং কেইস সাবমিট করতে চাই। ‘

আরিফ মাহমুদ সাদিদের মুখপানে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। এতো মায়া জড়ানো মুখটা যে দেখলেই পরাণটা জুড়িয়ে যায়৷ অথচ এই ছেলেটাকেই তার অবুঝ মেয়েটা ছেড়ে পালিয়েছে। এটাও তাকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে। তিনি হতাশার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবারও একই কথা বললেন,

— ‘ দেখ বাবা, তোমাকে আমি সেইদিনও একই কথা বলেছি। মেয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছে এটা এমনিতেই মা-বাবা হিসেবে আমাদের জন্য চরম লজ্জার বিষয়। তারউপর এখন যদি পুলিশে গিয়ে এসব জানাজানি হয় তাহলে যতটুকু সম্মান বাকি আছে ততটুকুও হারাবো। বাবা, জীবনে আর কিছু কামাই করি আর না করি কিন্তু সম্মানটা ঠিকই কামিয়েছি। আর আমাদের মতো উচ্চ মধ্যবিত্তদের জন্য সম্মানের উপরে কিছু হয় না। তাই আমি অন্ততপক্ষে পুলিশকে এরমধ্যে জড়াতে চাই না। বাকিটা এবার তোমার ইচ্ছে। আর কেউ না জানুক আমরা তো এটা অস্বীকার করতে পারব না। নিজের স্ত্রীর যেকোনো স্বীদ্ধান্ত তুমি নিতে পারো৷ ‘

এতটুকু বলে তিনি চুপ থাকলেন। সাদিদ মাথা নিচু করে রয়েছে। রাগ হচ্ছে তার। প্রচুর রাগ হচ্ছে। তাদের দিকটা ভাবতে গেলে হয়তো ঠিক, কিন্তু সাদিদের এখন সেসব ভাবতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছে না। তার মাথায় কেবলমাত্র নীলার চিন্তা। অন্য কোনোকিছু এই মুহূর্তে তাকে বশ করতে পারবে না। না লোকসমাজ, না তথাকথিত তাদের সম্মান। তার নীলাকে চায়, সেটা যেভাবেই হোক।
সে বিনাবাক্য উঠে দাঁড়ালো। কোনোকিছু না বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু দরজায় এসে হঠাৎ থেমে গেল। কিন্তু পিছনের দিকে তাকাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শুধু গম্ভীর থমথমে কন্ঠে বলল,

— ‘ আমি জানি না আপনারা কিভাবে সামান্য একটা চিঠির উপর ভিত্তি করে ওকে এতটা ভুল বুঝতে পারেন। মানলাম সে চলে গিয়েছে। তবুও সে কেন চলে গিয়েছে? তার পিছনে নিশ্চয়ই বড় কোনো কারণ রয়েছে। সেটা আমি তার স্বামী হয়ে হলফ করে বলতে পারছি আর আপনারা মা-বাবা হয়ে এতোটা পরের মতো আচরণ করতে পারছেন? আল্লাহ না করুক আমার পাখি বড্ড সরল, বড্ড নরম৷ কোনোদিন যদি এসব জানতে পারে তাকে আমি সামলাতে পারব না৷ আর সেই মুহূর্তে তার চোখে যদি একবিন্দু অশ্রুকণার রেষ আমি পাই, তাহলে আপনাদের কাউকে আমি ছাড়বো না৷ আমি ভালো কিন্তু আমার পাখিকে যারা কষ্ট দিবে তাদের জন্য খুব খারাপ। সেটা যদি তার জন্মদানকারী মাতা-পিতা হয় তাহলে তাদের জন্যও। ‘

সাদিদ চলে গেল। রুমের তিনজন মানুষ এখনও স্তব্ধ। কি বলে গেল সাদিদ এতক্ষণ? এটাও সম্ভব? শান্ত শিষ্ট ছেলেটা যে এমন সাধারণ ভাষায়ও ভয়ংকর হুমকি দিয়ে গেল সেটা যেন তাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না। আবার নিজ মনে বারবার প্রশ্নেরা উঁকি ঝুঁকিও দিচ্ছে। সত্যিই কি তাদের কোথাও ভুল হচ্ছে? তারা কি সত্যকে আড়াল করে ভুলের পিছনে ছুটে চলেছে?

_________________

দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে নীলা। এতটা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে যে গলা দিয়ে আর স্বর বের হচ্ছে না। নিজের শারীরিক দুর্বলতার সাথে সাথে যোগ হয়েছে আতংক, ভয়। প্রিয়মানুষ ভুল বোঝার ভয়। গত দুইদিনে তানহার সাথে তার দুইবার দেখা হয়েছে। সেটা ছিল মাত্র কিছু মুহূর্তের জন্য। সবাই যে তাকে বিশ্বাসঘাতক-দুশ্চরিততা বলে মেনে নিয়েছে এটাই বারবার বাঁকা হেসে বলে গিয়েছে। তার সাদিদ? তার ভালোবাসা? সেও নীলাকে ভুল বুঝেছে? কেবলমাত্র একটা চিঠিকে বিশ্বাস করে সে নীলাকে অবিশ্বাস করেছে? তাদের ভালোবাসা এতটা ঠুনকো, যে সামান্য কাগজের টুকরো তাদেরকে আলাদা করে দিবে?
নীলা চোখ বন্ধ করেই মলিন হাসলো। তার বন্ধ চোখের পাপড়ি বেয়ে পড়া অশ্রুজলে ভিজে গেল গাল।

— ‘ আপনার আর দোষ কোথায়? আমাকে এভাবেই যে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। আপনারা হয়তো আমার কপি করা হেন্ডরাইটিং দেখেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছেন৷ তারউপর তাদের মতো মুখোশ পরা শত্রু যে আমাদের আশেপাশে রয়েছে সেটা কি আপনারা ভাবতে পারবেন? পারবেন না। আমিও তো ভাবতে পারছি না। মানুষ এতো খারা…

নীলার নিচুস্বরের অভিযোগ গলায় আটকে গেল। সে খুকখুক করে কাশতে শুরু করলো। এরা এতটা নির্দয় যে একফোটো পানিও দেয় না৷ নীলার গলা শুকিয়ে মরুভূমি। খুব কষ্ট হচ্ছে। চোখ বেয়ে তেষ্টায়, ক্ষুদায় ঝরঝরিয়ে পানি বেয়ে পরছে। চোখজোড়া নিভু নিভু হয়ে আসতেই দরজা খোলার আওয়াজ পেল। সে তাকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঝাপসা চোখে স্পষ্ট দেখতে পারছে না।
তানহা সাথের ছেলেটার উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ দিয়ে আসো। ‘

বলেই সে পাশ থেকে একটা চেয়ার টেনে বসলো। ছেলেটা নীলার সামনে গিয়ে একটা খাবারের প্লেট আর একগ্লাস পানি রাখলো। সে ঝাপসা চোখে খাবারের প্লেট আর তানহার দিকে তাকাতেই সে বলে উঠল,

— ‘ তোকে বাঁচিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে না। আবার খুনি হতেও মনে সায় দেয় না। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে বাঁচিয়ে রাখছি৷ দ্রুত খেয়ে নে। ‘

নীলার এমন কথায় কান্না পাচ্ছে। খাবার নিয়ে কখনও তাকে এমন করে কেউ বলেনি। উল্টো কতো আদর-যত্নে খাওয়ার জন্য বলতো। আর সাদিদ? ইশশ! যেন পেট নীলার নয়, তার। সবসময় তার খাবারের পিছনে পরে থাকতো। আর নীলা সেসময় মনে মনে কতোশত রাগ পুষতো। সুখের স্মৃতির পাতাগুলো মনে হতেই নীলার ঝাপসা চোখজোড়া আবারও ঝাপসা হয়ে দাঁড়ালো। সে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে শুকনো খাবারের প্লেটটাই তুলে নিলো। ঢকঢক করে পুরো পানিটুকু খেয়ে নিলো। গলা কাঠ হয়ে গিয়েছিল। ভাতের সাথে ডাল। নীলা প্রচন্ড ক্ষুদায় সেটাই তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ পারলো না। দুই লোকমা খাবার মুখে দিতেই তার ভেতর থেকে সব গুলিয়ে উঠতে লাগলো। নীলার চোখ-মুখ আচমকা কুঁচকে এলো। কিছুসময় নিজের সাথে কি হচ্ছে সেটা বুঝে উঠতে পারলো না। মিনিট দুই-এক পার হতেই খাবারের প্লেটের উপরই গড়গড়িয়ে বমি করলো। পেটে কিছু নেই। তারপরও লাগাতার দুইবার বমি করে একেবারে নিস্তেজ হয়ে সো মেঝেতে মাথা হেলিয়ে দিলো। চোখগুলোও বন্ধ হয়ে আসলো।
তানহাসহ সাথের ছেলেটা আকষ্মিক এমন কান্ডে হতবাক। কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝে উঠতে তাদের একটু সময় লাগলো। মুহূর্তেই তানহার ঘা গুলিয়ে আসলো। বমির গন্ধে আর এক সেকেন্ডও বসতে পারলো না। নাক চেপে বাহিরে বের হলো। বাহিরে গিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতেই একজন মেয়ে গার্ড এগিয়ে আসলো। এতগুলো ছেলের মাঝে নীলাকে একা রাখতে তানহা অনিচ্ছুক। তাই সে এই ব্যবস্থা করেছে। আজকাল শত্রুও বোধহয় ভিন্ন ভিন্ন রূপধারণ করতে পছন্দ করে। তাইতো এতো নির্দয়তার মাঝেও একটুখানি চিন্তা। সে দ্রুত পায়ে কাছে এসে জানতে চাইল,

— ‘ ম্যাম আর ইউ ওকে? ‘

তানহা আরও কয়েকবার দম নিয়ে বলল,

— ‘ হ্যাঁ ঠিক আছি। কিন্তু ভিতরের মেয়েটা ঠিক নেই। বমি করে পুরো রুম গন্ধ বানিয়ে দিয়েছে। তারউপর নবাবজাদি খাবারও নষ্ট করেছে। ‘

মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

— ‘ বোধহয় অতিরিক্ত ক্ষুধায় হঠাৎ খেয়ে বমি হয়েছে। দুইদিন যাবত তো তেমনকিছুই দেওয়া হয়নি৷ তাই…

সে থেমে গেল। তানহা কটমট চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে অপ্রস্তুত হলো। খানিকটা ইতস্ততবোধ হচ্ছে। কিন্তু নীলাকে সে দেখেছে। এমন মায়াভরা একটা মেয়ের সাথে এতো অত্যাচার তার সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু সে নিজেও দুর্বল। পেটের দায়ে এসব জঘন্য কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু মায়াতো এতো সহজে কাটার নয়। তাই সে সাহস নিয়ে বলল,

— ‘ ম্যাম আবার কি নতুন করে খাবার দিব? না মানে..
— ‘ দিয়ে দিও৷ ‘

তানহা আর দাঁড়ালো না। রাগ নিয়েই কথাটা বলে গটগট পা ফেলে বেড়িয়ে গেল। মেয়েটা মৃদু হাসলো। তারপর নিজেই গিয়ে নীলাকে যতটুকু সম্ভব ফ্রেস করতে সাহায্য করলো। আর কিচেনে গিয়ে নতুনকরে খাবার আনলো। নীলা শুকনোমুখে মেয়েটার দিকে তাকাতেই সে ইশারায় খেতে বলল। শরীরটা বড্ড নিস্তেজ লাগছে। শরীরে যে বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই সেটা নীলাও বুঝতে সক্ষম। তাই সে চুপচাপ খাবারের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু প্লেটের ঢাকনা উঠাতে গেলেই খাবারের গন্ধে আবারও ভিতরটা মুচড় দিলো। শরীরটা একেবারে ছেড়ে দিয়ে সে তৃতীয়বারের মতো বমি করলো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়তে নিলেই পাশ থেকে মেয়েটা এসে দ্রুত ধরল। সে নিজেও হতবাক। বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে তার সময় লাগলো, কিন্তু স্বাভাবিক লাগলো না। সে মাথায় চিন্তা নিয়েই নীলাকে ধরে ধরে মেঝেতে বসালো। তারপর গ্লাসের পানি এনে নাকে-মুখে ছিটিয়ে দিলো। কিন্তু তারপরও নীলাকে চোখ না খুলতে দেখে তার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে নীলা জ্ঞান হারিয়েছে। সে দ্রুত মোবাইল বের করে কল লাগালো,

— ‘ ম্যাম তমা বলছি। মেয়েটার অবস্থা ভালো নয়। কিছু একটা করতে হবে নতুবা খারাপ কিছু হতে পারে। ‘
— ‘ কি বলতে চাচ্ছো তুমি? ‘
— ‘ আপনি যাওয়ার পর সে আবারও বমি করেছে এবং সেন্স হারিয়েছে। আমি পানি দিচ্ছি কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। আমার মনে হয় ডক্টর লাগ..

তানহা মেয়েটির মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে প্রচন্ড রাগ-আক্রোশভরা কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ ইডিয়ট! মাথায় ঘিলু বলতে কিছু নেই? এই মুহূর্তে ডক্টরের কথা তুমি কোন মুখে বলো? জানো না ঐদিকে কি হচ্ছে? ‘
— ‘ সরি ম্যাম। কিন্তু মেয়েটা এভাবে থাকলে যখন তখন কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। আমি বোধহয় আপনাকে সেটা বুঝাতে পারছি। ‘

তানহা কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করলো। অতঃপর বেশ গম্ভীরস্বরে বলল,

— ‘ঠিক আছে আমি দেখছি কি করা যায়। তুমি ওর খেয়াল রাখো। ‘

তানহা কল কেটে দিলো। তার মাথায় চিন্তারা এসে ভিড় জমাচ্ছে। হ্যাঁ একটু দুর্বলতা মানা যায়। কিন্তু এইরকমভাবে বমি করার মানে কি? সে নিজেও তাকে ঐ অবস্থায় দেখেছে। সেইজন্য হিসাবটা মেলানো আরও কষ্টকর।

_____________________

তানবীর আর অর্ণব সাদিদকে চেপে ধরে রয়েছে। রাগে তার ফর্সা বর্ণের শরীর লালচে হয়ে গিয়েছে। সে অনবরত সাপের মতো ফোঁসফোঁস করছে। দুইজনে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়েও তাকে ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। সে আবারও রাগীস্বরে গর্জে উঠল,

— ‘ হেই অফিসার, কি ভাবিস তুই নিজেকে? তুই যত বড় পোস্টেই থাকিস না কেন, আমার পাখিকে নিয়ে বাজে কথা বললে তোর ঐ জিহ্বা আমি টেনে ছিঁড়ে নিবো। ‘

একজন আইনের লোককে এতো বড় কথা বলায় মুহূর্তেই পুলিশ স্টেশনে হইচই লেগে গেল। যেই অফিসারটাকে উদ্দেশ্য করে রাগের মাথায় সাদিদ এসব বলেছে সে এসে এলোপাতাড়ি সাদিদকে আক্রমণ করলো। সাদিদ মুখ থুবড়ে মেঝেতে পরেছে। ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে হাতের মুঠি শক্ত করে পাল্টা মার দিতে গেলেই অর্ণব এসে সামনে দাঁড়ালো,

— ‘ সরে যা অর্ণব। আমিও দেখবো এই হারামি কি করতে পারে। আমার পাখিকে নিয়ে খারাপ কথা বলে আবার আমাকেই আঘাত করা! সামনে থেকে সর। ‘

অর্ণব সরে দাঁড়ালো না। উল্টো দুইজনে জোর খাঁটিয়ে তাকে থানা থেকে বের করলো। গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে তানবীরের উদ্দেশ্য অর্ণব বলে উঠল,

— ‘ সাদিকে কোনোভাবেই বের হতে দিবি না। আমি দুই মিনিটে আসছি৷ ‘

বলে সে দ্রুত পায়ে থানার ভিতরে গেল। আল্লাহ না করুক আজকে খারাপ কিছু একটা ঘটে যেত। এখনও বিপদ পুরোপুরি কাটেনি। সাদিদের বর্তমান মানসিক অবস্থা আর তাদের সম্পূর্ণ পরিচয় জানিয়ে যদি কোনোভাবে ঝামেলা মিটিয়ে নেওয়া যায়। নতুবা আইনের লোকের সাথে এমন দুর্ব্যবহারের জন্য সাদিদকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে। সে দ্রুত পায়ে অফিসারের কাছে চলে গেল।
এদিকে সাদিদ অনবরত গাড়ির দরজায় ঘুষি মেরে নিজের রাগ দমাতে চায়ছে। কিন্তু কোনোভাবেই রাগটা যেন পরছে না। শরীর আগুনের মতো জ্বলছে তার। সে আচমকাই জোরে চিৎকার করে উঠল,

— ‘ পাখি! ‘

দরজা জানালো বন্ধ থাকাতে পুরো শব্দটা বারবার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে। সাদিদ মাথা হেলিয়ে দিলো। তার নিজেকে বড্ড অসহায় অসহায় লাগছে।
তানবীর তার ঘাড়ে হাত রাখলো। অন্যসময় হলে থানার ভিতরের সাদিদের পাগলামি নিয়ে দুই-চার কথা শুনিয়ে দিতো। কিন্তু এই মুহূর্তে পারছে না। বিগত দিনগুলোতে এই ছেলেটার উপর দিয়ে কি যাচ্ছে সে স্বয়ং নিজে তার সাক্ষী। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম নিজের যাবতীয় সব কাজ বাদ দিয়ে সে পাগলের মতো এখানে-সেখানে নীলার খোঁজ চালিয়ে গিয়েছে। রাস্তাঘাট, অলিতে-গলিতে গিয়ে নীলার ছবি দেখিয়ে তাকে দেখেছে কি-না জিজ্ঞেস করেছে। বলতে গেলে আইনি সহযোগিতা ছাড়া ব্যক্তি হিসেবে কাউকে খোঁজে বের করার কোনোরকম গাফিলতি করেনি। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে এবং এখনও করছে। আজকে নীলাদের মিরপুরের বাসা থেকে বেড়িয়ে সোজা পুলিশ স্টেশনে মিসিং রিপোর্ট করতে এসেছিল। তার এখন ফ্যামিলির রেপুটেশন নিয়ে ভাবার সময় নেই৷ নীলাই তার জন্য সর্বপ্রথম। কিন্তু থানাতে এসে হলো আরেক ঝামেলা। পুলিশ অবশ্যই সবকিছু জেনে তারপর রিপোর্ট ফাইল করবে। সেইজন্যই নীলার সম্পর্কে সবকিছু জানতে চেয়েছে। সাদিদ কোনো মিথ্যা বলেনি৷ নীলার বিয়ের আসর থেকে নিখোঁজ ধরে চিঠির সবকিছু বলেছে। সবশুনে অফিসার প্রথমেই সাদিদদের বোকা বলে অক্ষায়িত করে৷ আজকাল মেয়েরা তার প্রেমিক পুরুষের হাত ধরে অহরহ বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে নীলা চিঠি লেখে সব জানিয়ে যাওয়ার পরও সাদিদদের এমন মিসিং ফাইল করাতে হাসাহাসিও করেছে৷ একসময় একজন নীলার নাম জড়িয়ে কটু বাক্য উচ্চারণ করতেই সাদিদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে। চেপে রাখা রাগের বশে অফিসারের সাথে খারাপ ব্যবহার করে বসে।
তানবীর ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। অতঃপর সাদিদের কাঁধে হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,

— ‘ কুল ডাউন ইয়ার। নিজেকে সামলা। ‘
— ‘ পারছি না দোস্ত। আমি আর পারছি না। আমার পাখিকে ছাড়া আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না। তাকে যে আমার প্রয়োজন। ভীষণ প্রয়োজন। ‘

সাদিদের কন্ঠ ধরে এসেছে। সে আর অর্ণবের আসার অপেক্ষা করতে পারলো না। ধরা গলায় প্রচন্ড রাগ নিয়ে বলল,

— ‘ গাড়ি ডাইভ কর। ‘
— ‘ মানে? ‘
— ‘ আই সেইড স্টার্ট দ্য কার। ‘

এতক্ষণের শান্ত সাদিদের হঠাৎ এমন গর্জনে তানবীর কিছুটা থমকে গেল। তাকে বিষয়টা পুরোপুরি বুঝতে না দিয়েই সাদিদ একপ্রকার ধাক্কিয়ে তাকে ডাইভিং সিট থেকে সরালো। সেকেন্ড সময় না ব্যয় করে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দৃষ্টির বাহিরে চলে গেল। অপরদিকে ফাঁকা রোডে তানবীর ফ্যালফ্যালিয়ে সাদিদের গাড়ি চলে যাওয়া দেখলো। কি হলো বিষয়টা?
সাদিদ প্রচন্ড অস্থিরতায় গাড়ি ডাইভ করছে। নামেমাত্র শান্তি তার মাঝে নেই। এসি চলাকালীনও ঘেমে অস্থির। সে বাম হাতে শার্টের উপরের তিনটা বোতাম খোলে দিলো। তারপরও শান্তি লাগছে না। সে মাঝরাস্তায় জোরে গাড়ি ব্রেক কষলো। চোখগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। সে হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখগুলো ঢলে নিলো। তার বড্ড কান্না পাচ্ছে। সে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল। কান্নাটা হয়তো তার সাথে বেমানান তাই সে জোরপূর্বক নিজের কান্না চেপে রাখতে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। কিন্তু কান্না দূর করতে পারলেও ভিতরের কষ্টটা যে দূর করতে পারছে না। কষ্টগুলো চেপে গিয়ে দমবন্ধ লাগছে। শেষ সম্বল হিসেবে সে পকেট থেকে ফোনটা বাহির করলো। পুরো গ্যালারি ভরা নীলার বিভিন্ন মুহূর্তের স্মৃতি দ্বারা। অর্ণবের বিয়েরকার একটি ছবির উপর এসে সাদিদ থামলো। নীলাকে সাদিদ এখানে-ওখানে দৌড়াদৌড়ির জন্য একটু বকা দিয়েছিল। আর সেটাতেই সে গাল, ঠোঁট, নাক ফুলিয়ে রেখেছিল। সাদিদ রাগ কমাতে গিয়ে উল্টো তার রাগ বাড়িয়ে দিয়েছিল। গালদুটো জোরে টিপে ধরেছিল। আর তাতেই নীলা রক্তিম গালে সাদিদের উপর রণমুর্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ক্যামেরাওয়ালা তখনকার এই মোমেন্টটা তাদের অগোচরে ক্যাপচার করেছে। পরে সাদিদকে দেখাতেই সে চট করে নিজের কাছে সেটা সংরক্ষণ করেছিল। এখনও তার চোখের সামনে সেই ছবিটা। সে আঙুল দিয়ে নীলার রাগী মুখশ্রীতে নজর বুলালো। ভীষণ মায়া আর নিচুস্বরে বলল,

— ‘ প্রাণপাখি, কোথায় তুমি? দেখো না তারা সবাই কিসব বলছে? তুমিই বলো তোমাকে নিয়ে এসব কি আমি সহ্য করতে পারব? কেন তারা বুঝতে চায়ছে না? আমার পাখি কখনও তার সাদিদকে ছেড়ে যেতে পারে না৷ তুমিই বলো পারে কি? ‘

সাদিদ কৃত্রিম মুখশ্রী থেকে কয়েক মুহূর্ত উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো। তারপর নিজেই বলে উঠল,

— ‘ না পারে না। কোনোভাবেই পারে না। আমার পাখি তার সাদিদকে ভীষণ ভালোবাসে। আমিও আমার পাখিকে ভালোবাসি। খুব খুব খুব বেশিই ভালোবাসি। ‘

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৪৭

ডক্টরের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ। রুগী দেখতে এসেছে নাকি জীবন হারাতে এসেছে সেটা বুঝা মুশকিল। চারপাশে এতো এতো গার্ড দেখে তিনি ভয়ে শুকনো একটা ঢুক গিললেন। নীলার শারীরিক কন্ডিশন জেনে তানহা এবং ইমরান দু’জনই এখানে হাজির হয়েছে। ইমরান এবার অধৈর্য্যে গলায় বলে উঠল,

— ‘ এই ডক্টর, এতক্ষণ কি দেখেন? কি হয়ছে ওর? ‘
— ‘ আপনি কে হোন উনার? ‘
— ‘ তোর জম হই। যেটা বলছি সেটার উত্তর দে। ‘
— ‘ স..রি সরি। আসলে সি ইজ প্রেগনেন্ট। দেড় মাসের অন্তঃসত্ত্বা তিনি। ‘

ডক্টরের মুখ নিঃসৃত শব্দটা পুরো রুমের উপর দিয়ে যেন ভূমিকম্পের মতো প্রবাহিত হলো। নীলার দুর্বল চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেল। তার কাঁপা হাতটা মুহূর্তেই পেটের উপর এসে অবস্থান করলো। আর গাল বেয়ে গড়াতে লাগল নোনাজলের ধারা। তানহাও অবাক। নীলা প্রেগনেন্ট? কিন্তু কিভাবে কি?
ইমরান নিজেও অবাক। কিন্তু পরমুহূর্তেই কিছু একটা ভেবে তার শরীর রাগে কেঁপে উঠল। সে নিচু হয়ে মুহূর্তেই নীলার চুল টেনে ধরল৷ আচমকা এতো জোরে চুলে টান পড়াতে নীলা ব্যাথায় কুঁকড়ে গেল। চোখভরে জল বেড়িয়ে আসতে লাগলো৷ পেটের উপর থেকে হাতটা সরিয়ে সে দুইহাতে নিজেকে ইমরানের থেকে ছাড়াতে চায়ছে। কিন্তু ইমরান সেটা হতে দিচ্ছে না।

— ‘ পেট বাঁধিয়ে বসে আছিস? হ্যাঁ পেট বাঁধিয়ে? আর আমি যখন একটু ছুঁতে চাইলাম তোর গায়ে ফোঁসকা পরে! চরিত্রহীনা মেয়ে৷ তোর মতো মেয়েকে নিয়েই তোর বাপ-মা আমার পরিবারকে ফিরিয়ে দেয়? আমার পায়েরও যোগ্য নস তুই। ‘

বলেই সে নীলার চুলের মুঠিটা জোরপূর্বক ঝাকিয়ে ছেড়ে দিলো। নীলা কাত হয়ে একপাশে পড়ল৷ মহিলা ডক্টরটা তাকে ধরতে যেতে চায়লেই আশেপাশের পেয়াদাদের দেখে সাহস করতে পারলেন না। তিনি শুধু নিচু কন্ঠে বললেন,

— ‘ এইসময় উনার সাথে এমন করবেন না। প্রেগন্যান্সির এটা খুব রিক্সি টাইম। সামান্য একটু ভুলে মিসক্যারেজ হয়ে যেতে পারে। ‘

নীলা আতংকিত চেহারা নিয়ে দুইহাতে নিজের পেট চেপে ধরল। আর ধীরে ধীরে পিছিয়ে গিয়ে একেবারে দেয়ালের সাথে চেপে বসলো। সে অনবরত মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে না করছে। কারো এতে মায়া জন্ম না হলেও উপস্থিত ডক্টর এবং তমা মেয়েটার ভীষণ খারাপ লাগলো। নীলার নিশ্চুপতাও তারা বুঝতে পারছে। কিন্তু চেয়েও কিছু করতে পারছে না।
ইমরান নিজের রাগ মেটাতে চেয়ারে জোরে একটা লাথি দিলো। সত্যি কথা বলতে তার সবচেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে নীলার ভার্জিনিটি নিয়ে। সে ভার্জিন নয় এটা যেন ইমরানের বিশ্বাসই হচ্ছে না৷ নীলার প্রতি ভালোবাসা তার কোনো কালেই ছিলো না। কেবলমাত্র মেয়েদের প্রতি তার ঝোঁক বরাবরের মতোই একটু বেশি ছিলো। নীলা যখন মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে মায়ের সাথে তার নানু বাড়িতে যায় তখনই তার উপর ইমরানের বদ নজর পড়েছিল। এরআগে দেখাসাক্ষাৎ কম হওয়াতে নীলার মুখোমুখি তেমন একটা হয়নি সে৷ আর নীলারাও পড়াশোনা, বাবার ব্যস্ততা সব মিলিয়ে খুব একটা নানুবাড়ির দিকে যায় না৷ সেবারই নীলার পরীক্ষা শেষ, তারউপর নানার জন্য মসজিদে মিসকিন খাওয়াবে বিধায় সব মামারা মিলে আয়োজন করলো। মোটামোটি সবাই সেখানে উপস্থিত হলো। নীলা তখন কৈশোর পেরিয়ে সবেমাত্র শরীরে যৌবনের ঘ্রাণ লাগিয়েছে। তাই ইমরানের খারাপ নজর খুব সহজেই তার ভরাট শরীরে পরে যায়। নানার মিলাদের দিন সন্ধ্যায় কারেন্ট না থাকাতে সবাই মিলে উঠোনে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। নীলাও সেখানে উপস্থিত ছিলো। পানি পিপাসা পাওয়াতে সে জায়গা ছেড়ে খাওয়ার রুমের দিকে যাচ্ছিলো। এটাই যেন ইমরানের জন্য মূখ্য সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে বহুক্ষণ যাবত এমন একটা মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল। অবশেষে পাখি যখন নিজ দায়িত্বে খাঁচায় বন্দি হতে চেয়েছে তাহলে সে আটকাবে কেন?
রুমে লাইট বলতে ছোট একটা চার্জার লাইট জ্বলছিল। নীলা পানি খেয়ে যেই না পিছু ঘুরতে গেল ইমরান হাত টেনে তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরেছিল। নীলার কোমড়ে একহাতে চেপে ধরে আঙুল দিয়ে গালে স্লাইড করতে করতে বলেছিল,

— ‘ বাহ্, কি শরীর বানিয়েছিস রে? শহরে থেকে থেকে বুঝি আমাদের গ্রামের ছেলেদের মাথা খাওয়ার ধান্দা? ‘
— ‘ ছিঃ ভাইয়া, কি বলছো এসব? প্লিজ ছাড়ো। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। ‘
— ‘ ইশশ ছিঃ বলিস কেন? তোরা শহুরে মেয়েগুলোতো ছেলেদের শরীরের উষ্ণতা পেতে হুড়মুড়িয়ে থাকিস। আমি কিছু জানি না বলছিস? ‘
তার ক্রমাগত অসভ্যতাপনায় একদিকে নীলার যেনন অস্বস্তি চেপে ধরেছিল অপরদিকে প্রচন্ড ঘৃণা। তাইতো ইমরান যখন হুট করে কিছু না বলে নীলার ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে চাইল, নীলা আর কিছু না ভেবে তার গালে সজোরে থাপ্পড় মারে। সেইসময় ছোটো খালামণি খাবার রুমে আসছিলেন। ফলে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা তিনি বুঝতে পারে। পরে এটা নিয়ে নানারকম কথাবার্তা হয়। দোষটা যেহেতু ইমরানেরই বেশি তাই তার মা-বাবা চেয়েছিল এসব জানাজানির চেয়ে ভালো ছেলে-মেয়ে দুইজনের হাত এক করে দেওয়া। কিন্তু বেঁকে বসে নীলার বাবা-মা দুইজনই। সবার সামনে এটা প্রকাশ না করলেও তাদের মনে ছিল মরে গেলেও আদরের মেয়ের হাত এমন চরিতহীন ছেলের হাতে তুলে দিবে না৷ সেখানে অর্থ-সম্পদের কোনো কারণ তারা দেখায়নি। শুধু বলেছে থাক ছেলে মানুষ তারা। ভুল একটা হয়ে গিয়েছে। আমরা এটাকে বাদ দিলেই হয়। নীলার বাবার কথায় পরিস্থিতি তখন স্বাভাবিক হলেও স্বাভাবিক হতে পারেনি ইমরান৷ কিভাবে তাকে শিক্ষা দেওয়া যায় তার মাথায় বরাবরই এটা ঘুরতো। কেননা এই ঘটনার পরেও ইমরান তার বাবা-মাকে দিয়ে নীলার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। কিন্তু নীলার পরিবার সেটা নাকচ করে। তাই জেদ আরও চেপেছিল ভালো করে। নীলাসহ এই পরিবারের মানসম্মান কিভাবে রাস্তায় নামাবে এটাই তার চিন্তা থাকতো। কিন্তু কেন যেন এতো চেষ্টা করেও নীলার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারতো না। সবসময় কেউ যেন অদৃশ্য থেকেও নীলাকে রক্ষা করে যেত৷ তাইতো ঢাকায় থেকেও অনেকবার নীলাকে উঠিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু সে বারবারই ব্যর্থ হয়েছে। অদৃশ্য শক্তির কাছে তার পরাজয় মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তাইতো যখন নীলার এনগেজমেন্ট পার্টির পরেরদিন তানহা তাকে এই প্রস্তান দেয় সে একসেকেন্ড সময় নষ্ট না করে হ্যাঁ করে দেয়। তানহা পার্টিতে খুব ভালোভাবেই ইমরানকে লক্ষ্য করেছিল। তার দৃষ্টি কেবল নীলাতেই স্থায়ী ছিলো। তখন তার ভুল ধারণা জন্মেছিল ইমরান হয়তো নীলাকে পছন্দ করে। তাই যদি কোনোভাবে ইমরানের কাছে নীলাকে গচ্ছা দেওয়া যায় সাদিদ পুরোপুরি তার হবে। তাইতো পার্টির পরেরদিনই দুইজন একত্রে হাওয়া হয়েছিল। আর সে বাসায় জানিয়েছে রিফ্রেসমেন্টের জন্য বেড়িয়েছে। কিন্তু তারা এখানে নির্ভুল প্ল্যান সাজাতে ব্যস্ত ছিল। সবটাই যেন কাকপক্ষীর নজরের বাহিরে থাকে সেই হিসেবেই সকল প্ল্যান করেছে। আর তারা সাকসেসফুল তাদের কাজে। নীলাকে বাসা থেকে অপহরণ পর্যন্ত, চিঠি এবং এখানে নিয়ে আসা অব্দি এখন পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারেনি৷ আর না আশা করা যায় পারবে। কেননা তারা সাজিছেই প্ল্যানটা এমনভাবে।
ইমরান পূর্বের কথা মনে করে আরও রেগে গেল। নিজের রাগ কমাতে সে দেয়ালে পরপর দুইটা ঘুষি দিলো৷ তারপরও রাগ যেন ক্ষণে ক্ষণে তরতর করে বাড়ছে শুধু। সে পিছন ফিরে নীলার দিকে তাকিয়ে আবারও বিরক্তিকর ভাব ফুলিয়ে তুললো। কোথায় সে ভেবেছিলো নীলার আত্মসম্মান হরণ করে তাকে বেশ লাঞ্ছিত করবে। কিন্তু তার আগেই মিষ্টিতে কেউ ভাগ বসিয়েছে এটা যেন তার হজম হচ্ছে না। সে মুখে বিরক্তিকর শব্দ উচ্চারণ করলো,

— ‘ ধ্যাত। ‘

হঠাৎ ঘর কাঁপিয়ে তানহা পাগলের মতো হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে যেন পেটে খিল ধরে যাবার অবস্থা তার। উপস্থিত সবাই অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এখানে হাসির কি হয়েছে সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না৷ কিন্তু নীলার চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ। বাচ্চার অস্তিত্ব জানার পর থেকেই সে ভয়ে চুপসে রয়েছে। এই হৃদয়হীন পাষাণ মানুষগুলোর মধ্যে তার অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সে ভয়ার্ত-চিন্তিত। তানহা হাসতে হাসতেই চুপসে যাওয়া নীলার দিকে একপলক তাকালো৷ তাতে যেন তার হাসির পরিমাণ আরও বাড়লো। সে নীলার দিকে আঙুল তুলে বিদ্রুপ স্বরে বলল,

— ‘ এই, এই মেয়েটার জন্য সাদি আমার ভালোবাসা প্রত্যক্ষাণ করেছে? সিরিয়াসলি! আমারতো বিশ্বাসই হচ্ছে না সাদির চয়েজ এতটা নিম্নমানের হতে পারে। অবশ্য বেচারার আর কি-ই বা দোষ? প্রেমে পড়লে সবাই অন্ধ। যাকগে ব্যাপার না। আমি আছি না? আমিই তার চোখে আলো ফুটিয়ে দিব। কিন্তু আফসোস হচ্ছে এটা ভেবে যে, এই খুশির খবরটা তাকে এই মুহূর্তে আমি দিতে পারছি না৷ নতুবা সবাই আমাকেই দোষরূপ করতে পারে। ইশশ বড্ড দুঃখজনক ব্যাপার। ‘

বলেই সে আরও একদফা হাসলো। ইমরান এমনিতেই রেগে বোম৷ তারউপর তানহার কথাগুলো আগুনের উপর ঘি ঢালার কাজ করেছে। সে আবারও নীলার দিকে তেড়ে গেল। একহাতে দুইগাল শক্ত করে চেপে ধরতেই ডক্টর বাঁধা দিতে চাইল। কিন্তু সে তাকেও পরোয়া করলো না৷ ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে নীলার গাল চেপে গর্জে উঠল,

— ‘ চরিতহীনা। বল কোন নাগরের পাপ নিয়ে নিজের পেট বাঁধিয়েছিস? বল হারাম** কার পাপের ফল দিয়া সতিত্ব নষ্ট করেছিস, বল। ‘

অন্যসময় কেউ এমন কথা বললে নীলা লজ্জায় কুঁকড়ে যেত। কিন্তু এই মুহূর্তে ইমরানের উপর ঘৃণায় তার দম আটকে আসছে। তার মুখের উপর থুথু ছিটিয়ে দিতে পারলে বোধহয় এই ঘৃণার পরিমাণ কিছুটা কম হতো। তাকে নিশ্চুপ দেখে ইমরান আরও রেগে গেল। বামহাতে নীলার নরম গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মেরে বলল,

— ‘ চুপ করে আছিস কেন? বল। আমাকে কাছে ঘেঁষতে দেস না অথচ কার সাথে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরিছিস? কার অবৈধ্য সন্তান এটা? ‘

ইমরান যতোটা না গর্জে কথাটা বলল নীলা এর তিন ডাবল জোরে ইমরানের গালে কষিয়ে আবারও পূর্বেকার ন্যায় একটা থাপ্পড় লাগালো। সকলেই আচমকা চুপসে যাওয়া নীলার এমন কান্ডে স্তব্ধ। ইমরান গালে হাত দিয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে নীলার মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। হঠাৎ করে এই মেয়ের এতটা সাহস কোথায় থেকে এসেছে সেটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না। ইমরান নিজের রাগ সামলে নীলাকে আবারও থাপ্পড় মারতে উদ্যত হতেই সে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে দেয়াল ধরে ধারালো। রুমের সবার দিকে আঙুল তুলে হুঁশিয়ার করলো,

— ‘ খবরদার। খবরদার যদি কেউ আমার বাচ্চাকে নিয়ে অপবাদ দিয়েছো তো। এতক্ষণ আমাকে বলেছো, সহ্য করতে কষ্ট হলেও করার চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু আমার সন্তানকে জড়িয়ে বৈধতার কথা তুললে কাউকে ছেড়ে কথা বলবো না৷ ‘

নীলার কন্ঠ নেমে আসলো৷ সে মলিন চোখে হাসলো। অতঃপর আলতো হাতে পেটে হাত বুলিয়ে বলে উঠল,

— ‘ ও..ও আমার সন্তান। না. না ও তার বাবা-মায়ের সন্তান। আমাদের সন্তান। তার বাবামায়ের পবিত্র ভালোবাসার উপহার হিসেবে আল্লাহপাক আমার গর্ভে তাকে পাঠিয়েছেন। খবরদার যদি আর কখনও আমার সন্তানের বৈধতা দিয়ে বিচার করতে আসবে তো। ‘

কিছু মুহূর্ত সবাই স্তব্ধ হয়ে থাকলেও তানহা নীরবতা ভেঙে এগিয়ে আসলো। মুখে তার এখনও হাসির রেখা। নীলার কথাগুলোতে তার নেহাৎই আজগুবি মনে হচ্ছে। বিয়ের আগে বাচ্চা পেটে নিয়ে বলছে এটা নাকি বৈধ সন্তান! এটাতো হাস্যকর বিষয়ই। সে মুখে হাসি নিয়েই বলল,

— ‘ আহারে অবশেষে তাহলে মেয়েটা পাগলই হয়ে গেল। এতোটা নিচু কাজ করেও গলা উঁচিয়ে কথা বলছো! এজন্যই লোকে বলে ছোটলোকের বলা গলা। বিষয়টা কিন্তু একেবারেই সত্য৷ ‘

সে আবারও বিদ্রুপের স্বরে হাসলো৷ নীলার চোখে-মুখে রণমুর্তি ভাব ফুটে উঠেছে। এতক্ষণ নিজেকে দুর্বল লাগলেও এখন যেন মায়ের শক্তি তার শরীরের সব দুর্বলতা হরণ করেছে। সে তো মা, আর মায়েদের কখনও দুর্বল হতে নেই৷ সে পেটে হাত রেখে তানহার দিকে কয়েককদম এগিয়ে গেল। তেজি গলায় বলল,

— ‘ পাগল আমি হইনি, হয়েছো তোমরা৷ আর তোমাদের পাগলামি কিভাবে ছুটাতে হয় সেটা বাবুর আব্বু খুব ভালো করেই জানে। যখন জানতে পারবে তার গর্ভবর্তী স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে তোমরা কি বাজে বাজে কথা বলেছো, সেই মুহূর্তের অগ্রীম স্মৃতি আমার চোখে ভাসছে। ইশশ তোমাদের মুখ দেখার মতো হবে। ওর বাবা কাউকে ছাড়বে না। সবকটাকে গুণে গুণে হিসাব ফেরত দিবে৷ উনি কিন্তু নিজের হিসাবে বড্ড পাকা। একচুল পর্যন্ত বাকিতে হিসাব রাখবে না। সো গাইস গেট রেডি। খুব শীঘ্রই তোমাদের কর্মের ফল ভোগ করবে। ‘

তানহা এসব বড় বড় কথায় ভীষণ রেগে গেল। এই মেয়ের হঠাৎ এতো সাহস হচ্ছে কিভাবে? এতগুলো মানুষকেও সে পরোয়া করছে না। তানহা নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না৷ রাগীস্বরেই বলল,

— ‘ মুখ যত বড় নয় কথা তত বড়! এতো যে পেটের সন্তানের অস্তিত্ব নিয়ে গর্ব করছিস, বাপ ছাড়াই সন্তানের এতো কদর? স্বামী ছাড়া সন্তানের জন্য এতো বড়াই? জানিস তো তোদের মতো মেয়েদেরকে এই সমাজ কি বলে? বে..
— ‘ বাকিটুকু বলে নিজের পাপের বোঝা আর বাড়িয়ো না আপু। উনি সহ্য করবে না। ‘
— ‘ এখনও মুখে খই ফুটছে! শুনিতো কে উনি? আমিও জানতে চাই কার বাচ্চার বাবার হয়ে তুই এতো বড় মুখে কথা বলছিস। বল শুনি৷ ‘

রাগে শেষোক্ত কথাটা বলতে তানহা চেঁচিয়ে উঠল। নীলা তাতে দমে গেল না। বরং প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে নীলাও জোর গলায় বলে উঠল,

— ‘ সাদিদ ইবনে শাহরিয়ার। এই সন্তানের পিতার নাম সাদিদ ইবনে শাহরিয়ার। বাবা-মায়ের পবিত্র ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সে এসেছে। ও আমাদের সন্তান। বুঝেছো তোমরা? ‘

নীলার কথাটা শেষ হতে না হতেই তানহা সজোরে তার গালে থাপ্পড় বসালো। নীলা আচমকা আক্রমণে ব্যালেন্স রাখতে না পেরে মেঝেতে পড়ল। কাঠের চেয়ারের কোণা লেগে কপালের বেশ খানিকটা জায়গা কেটে গিয়েছে। মুহূর্তেই লাল বর্ণের তরল পদার্থ কপাল বেয়ে পড়তে লাগল। নীলা কপালে হাত দিয়ে রক্তের অস্তিত্ব টের পেয়ে হুহু করে কেঁদে উঠল। সে নিজেকে নিয়ে বিন্দুমাত্র ভয় পাচ্ছে না। বরং এখন তার সম্পূর্ণ ভয় তাদের ভালোবাসার প্রতিককে নিয়ে। সাদিদের অনুপস্থিতিতে তার আমানতকে সে রক্ষা করতে পারবে কি-না সেটা নিয়েই তার ভয়। এই মানুষরূপী অমানুষগুলোর মাঝে সে পারবে তো নিজের অনাগত সন্তানকে রক্ষা করতে?
তানহার রাগ যেন তার রক্তের মধ্যে মিশে গিয়ে জ্বলে উঠছে। সাদিদকে জড়িয়ে এসব সে একেবারেই সহ্য করতে পারছে না। সে তেড়ে এসে আবারও নীলার ডানগালে থাপ্পড় বসালো। এতোটা জোরে ছিলো যে দাঁতের সাথে ঠোঁট লেগে খানিকটা কেটে গিয়েছে। উপস্থিত সবাই কেবল নীরব দর্শক। এতগুলো মানুষের সামনে বাচ্চা মেয়েটার উপর এতো এতো অত্যাচার হচ্ছে, অথচ সবাই নিশ্চুপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে চায়ছে। ইমরানও বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে চেয়ারে বসেছে। তার এই মেয়ের উপর থেকে রুচি উঠে গিয়েছে। সে হাজারো মেয়ের বেলা অসভ্যতামী করুক তাতে কোনো খারাপ নেই। কিন্তু নীলার এমন কান্ডে সে যথেষ্ট বিরক্ত। নীলার শরীর এবার প্রচন্ড দুর্বল লাগছে। একেতো না খাওয়া, তারউপর তাদের এমন নির্মম অত্যচারে নীলার চোখ ক্রমশ নেতিয়ে আসছে। সে মেঝেতে হেলে পরতে নিলেই তানহা তার বাহু খামচে ধরলো। নখ বোধহয় সুতি জামা বেঁধ করে বাহুতে এটে যাচ্ছে। ব্যাথায় নীলা দুর্বল চোখজোড়া মেলে ছলছল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তানহা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে প্রচন্ড ক্ষেপা স্বরে বলল,

— ‘ চুপ। আর একবার যেন তোর ঐ নোংরা মুখে আমার সাদির নাম না শুনি৷ সে আমার ছিলো এবং চিরকাল আমারই থাকবে। তোর মতো নোংরা মেয়ের সাথে তার পায়ের জোতাও যায় না। কোন সাহসে তুই তোর অবৈধ সন্তানের ভাড় আমার সাদির উপর চাপাতে চাস? কোন সাহসে? ‘
— ‘ ভালোবাসার সাহসে। স্ত্রীর অধিকারে। ‘
— ‘ স্ত্রী! ‘
— ‘ হ্যাঁ স্ত্রী। স্বামী হন উনি আমার। পুরো ধর্মীয় নিয়মানুসারে এবং নগদ দেনমোহরের পরিশোধে আমি উনার বিয়ে করা বউ। ‘

তানহার কানে যেন তব্দা লেগে রয়েছে। বউ, স্ত্রী, স্বামী, বিয়ে কথাগুলো যেন এখনও তার মাথার উপর দিয়ে ঘুরছে। তার সাথে সাথে রুমে উপস্থিত সবকটা মানুষের কানেও যেন বজ্রপাতের ন্যায় নীলার বাক্যগুলো ছিল। সবাই একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এতদিনতো জেনে এসেছিল বিয়ের আগে কনেকে অপহরণ করে তুলে এনেছে। আজ জানলো কি? মেয়ে না-কি পূর্বেই বিবাহীতা! আবার এখন বাচ্চাও হাজির!

___________________

প্রয়োজনীয় কার্ড, নগদ ক্যাশ, পাসপোর্ট এবং ফোনটা পকেটে নিয়ে বাসা থেক বের হতে নিলেই শায়লা রহমান পিছন থেকে সাদিদকে ডেকে উঠলেন। সাদিদ থামলো কিন্তু পিছনে ফিরলো না। তার মা তাকে এই মুহূর্তে কি বলতে পারে সেটা সে অনুমান নয় বরং গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারে। শায়লা রহমান ছেলের ভাবভঙ্গি দেখে বেশ বিরক্ত হলেন। এই কয়েকদিনে তার ছেলেটা তার দুটো কথা শুনে দেখেনি৷ মা হিসেবে সম্মান রক্ষাতে মুখের উপর কথা বলে না৷ কিন্তু কথা শুনেও না৷ এক মহা ঝামেলায় পরেছেন তিনি।

— ‘ কি ব্যাপার? এই সময় কোথায় যাচ্ছিস? ‘

সাদিদ দেয়াল ঘড়িতে একনজর তাকালো৷ পাসপোর্ট এবং কিছু টাকার প্রয়োজন না পরলে এই মুহূর্তে সে ভুলেও বাসায় আসতো না৷ যেহেতু মুখোমুখি হতেই হয়েছে তাই উত্তরও দিতে হবে। সে সামনে তাকিয়ে সোজাসাপটা জবাব দিলো,

— ‘ নীলাদের গ্রামের বাড়ি। ‘
— ‘ কি? কি বললি তুই? ‘
— ‘ যা শুনতে পেয়েছো ঠিক তাই বলেছি৷ আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি। ‘
— ‘ খবরদার সাদি। যদি এই রাতে চট্টগ্রামের পথে রউনা দিস তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। ‘
— ‘ এই মুহূর্তে তোমার চেয়ে খারাপ কেউ হতেও পারবে না মা। তোমার সম্মান আমার কাছে কতো উঁচুতে সেটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। তেমনিভাবে নীলাঞ্জনার প্রতি রয়েছে স্বামী হিসেবে আমার কিছু দায়িত্ব। বিপদের সময় আত্মীয় স্বজনদের পাশে থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হয়। কিন্তু তুমি কি করছো? এতটা নির্দয় তো আমার মা হতে পারে না। তুমি এই মুহূর্তে আমার মা নও। তুমি কেবল আভিজাত্যের চাদরে ঘেরা মিসেস হাসিবুর রহমান। আমার মা এতটা পাষাণ হতে পারে না। ‘
— ‘ যা আমি পাষাণ-ই। নিজ সন্তানের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে যদি আমাকে পাষাণের উপাধি দেওয়া হয় তাতে আমার আপত্তি নেই৷ ‘

সাদিদ পা ফেলে কয়েককদম এগিয়ে আসলো। শায়লা রহমানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মায়ের মুখটা আঁজলাভরে ধরে কপালে চুমু দিলো। এতক্ষণ নিজের মধ্যে ধরে রাখা ঝাঁঝালো রূপটা তিনি আর দেখাতে পারলেন না। ছেলের আদরমাখা মমতায় তার বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে দিলেন। সাদিদ তাকে সযত্নে বুকে আগলে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

— ‘ এইতো আমার মা। এতদিন আমার এই মা টা কোথায় ছিলো? ‘

ছেলের আদর পেয়ে মায়ের মন আরো গলে গেল। কিন্তু তিনি মুখে কিছু বলতে পারলেন না। সাদিদ তার মাথায় অনবরত হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

— ভালোবাসি মা। খুব ভালোবাসি। ভালোবাসার সাথে সাথে শ্রদ্ধাও ভীষণ করি৷ তাই এমন কাজ করো না যাতে করে মুখ ফিরিয়ে রাখতে হয়। ‘

শায়লা রহমান মাথা তুলে অভিমানী নজর দিতেই সাদিদ তার মাথায় চুমু দিলো। মায়ের অভিমানের পাহাড়টা গুড়িয়ে দিতে পরমুহূর্তেই বুকে আগলে ধরল। অতঃপর বলল,

— ‘ তেমনিভাবে নীলাঞ্জনাকেও আমি ভীষণ ভালোবাসি মা। সে শুধু আমার ভালোবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সঙ্গে রয়েছে তার প্রতি দায়িত্ব এবং কর্তব্য। নিজের দায়িত্ব থেকে পিছুপা তারাই হয় যারা কাপুরষ। আর আমিতো কাপুরষ নই, আর না তোমরা আমাকে তেমন শিক্ষা দিয়েছো৷ তাই মা, আমাকে আমার দায়িত্ব পালন করতে দাও। ভালোবাসার মানুষকে যে শুধু ভালোবাসলেই হয় না। বিশ্বাসও করতে হয়৷ আমি নীলাঞ্জনাকে বিশ্বাস করি মা। সাথে নিজের ভালোবাসার উপরও প্রচন্ড বিশ্বাস করি। কেবলমাত্র একটি চিঠি হাতে পেয়ে আমি তার উপর থেকে নজর সরিয়ে নিতে পারব না। আমার বিশ্বাস সে আমাকে কখনও ছেড়ে যেতে পারবে না৷ যদি কখনও এমনটা সত্য হয়ে দাঁড়ায় তার পিছনেও নির্ঘাত কোনো সত্যতা লুকিয়ে রয়েছে। এবং আমাকে এখন সেই সত্যিটুকুই খুঁজে বের করতে হবে৷ যার জন্য নীলাঞ্জনাকে আমার প্রয়োজন। তাই আমাকে যেতে দাও মা। ‘

সাদিদ তাকে ছাড়িয়ে দ্রুত সদর দরজা পেরিয়ে বেড়িয়ে গেল। শায়লা রহমান ছেলের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। সে আর পিছু ডাকবে না৷ এরপরও নিজের ভুল বুঝতে না পারলে তিনি নিজেকে হয়তো কখনও ক্ষমা করতে পারবেন না। সাদিদ তার চোখে অপার ভালোবাসার এক নিদর্শন তুলে দিয়ে গিয়েছে। ছেলের এমন মনোভাবে সে মা হয়ে গর্বিত। কতজন ছেলে তার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে এতটা ভাবে? সবাই যখন তার বিপরীতে তারপরও কিভাবে ঠাঁই আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে?
ছেলেটা চলে গিয়েছে। নতুবা তিনি তাকে ডেকে এনে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করতেন,

— ‘ এতোটা ভালো কবে বাসলি বাপ? তোর মাও তো হয়তো এতটা ভালোবাসার গভীরতা দেখেনি, যতটা না আজ তোর চোখে নীলার জন্য ভালোবাসা প্রবাহমান। ‘

.

সাদিদ ক্যাব ডেকে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য চলতে শুরু করলো। বাহিরে মৃদু হাওয়া বয়ছে। ঝিরিঝিরি বাতাশে আধখোলা জানালে দিয়ে মৃদু বাতাশ এসে সাদিদের সিল্কি চুলগুলোকে ক্রমাগত নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। যদিও চুলগুলো বড্ড নির্জীব-এলোমেলো। কয়েকদিনের অবহেলা, অযত্নে যেন তারাও নিজেদের প্রাণ হারিয়ে বসেছে। সাদিদের সেদিকে খেলায় নেই৷ সে শূন্য দৃষ্টিতে জানালার বাহিরে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে। মনে চলছে ঝড় সাথে হাজারো চিন্তা। চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা শুনে অর্ণব এটাকে সম্পূর্ণ বোকামি বলেছে। শত হলেও নীলা যদি পালিয়েই গিয়ে থাকে তাহলে ধরা পরার জন্য নিশ্চয়ই নিজের এলাকায় যাবে না?
কিন্তু সাদিদ তারপরও সেখানে যেতে চায়। নীলার যাওয়ার মতো যায়গা রয়েছে এমন কোনো স্থান সে বাদ রাখতে চায় না৷ আশার শেষ বিন্দু পর্যন্ত সে যাবে। প্রয়োজন পরলে শুধু চট্টগ্রাম নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি জায়গায় সে নীলার খোঁজ চালু রাখবে। তবুও তার প্রাণপাখিকে সে খোঁজে বের করতে চায়। শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছে তার এতটুকুই প্রার্থনা যেন নীলা যেখানেই থাকুক না কেন ভালো থাকুক। অন্ততপক্ষে সাদিদ তাকে খোঁজে বের করা অব্দি তাকে যে ভালো থাকতেই হবে৷

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৪৮

প্রায় দুইমাস পর..

মানুষ তার বর্তমান সময় নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুক আর নাই বা থাকুক, প্রবাহমান সময় কারো জন্য নিজের গতির বিরতি দেয়না। সে আদি থেকে অন্ত বিরতিহীনভাবে চলার চুক্তি নিয়েছে। তেমনিভাবে সাদিদও নিজের প্রিয়তমার জন্য হৃদয়হীন সময়টাকে আটকিয়ে রাখতে পারেনি৷ দিনশেষে প্রিয়তমার কপালে উষ্ণ চুম্বন এঁকে দেওয়ার সার্মথ্য তার হয়নি৷ সৃষ্টিকর্তা নাকি তার পছন্দের বান্দাদের বেশি বেশি পরীক্ষা নেন। কিন্তু সাদিদ যে এই পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক নয়। সে এই দমবন্ধকর পরীক্ষার ছাত্র হতে চায় না।
বাংলাদেশের একেবারের উত্তরাঞ্চল হিসেবে পঞ্চগড়ের শীতের তাপমাত্রা বরাবরই ভয়াবহ আকারের। এই শীতের সকালেও গায়ে চাদর আর পিঠে ছোট ব্যাগ ঝুলিয়ে কাউকে ছুটে চলতে দেখা যাচ্ছে। এতো সকালে রাস্তায় কাউকে তেমন একটা দেখা যাচ্ছে বা৷ হুটহাট মাঠে যাওয়া কৃষকদের সাথে দেখা হলেই সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করছে৷ তেমনিভাবে পিঠে খেজুরের রস চাপিয়ে যাওয়া এক রসের লোককে দেখে সে এগিয়ে গেল। শীতে থরথর করে কাঁপা হাতটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল,

— ‘ চাচা, এই মেয়েটাকে কখনও দেখেছেন? আজ বা তারও আগে? ‘

অপরিচিত লোকটা নিজের কান টুপিটা একটু নিচে নামিয়ে সাদিদের বাড়িয়ে দেওয়া মোবাইলের দিকে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড ভালোভাবে দেখে নিয়ে কাঁপা স্বরে বলল,

— ‘ না ভাজান, দেহি নাই। কেডা ইলা? ‘

সাদিদ মাথা নিচু করে হতাশার নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। আর কতো? একটুখানি আশার আলো কি খোঁজে পাওয়া যাবে না?
লোকটি এখনও যায়নি, সাদিদের সামনে দাঁড়িয়েই তার আগাগোড়া ভালোভাবে পরিলক্ষিত করছে। তাদের এলাকার মনে হচ্ছে না। সে কিছু বলবে তার আগেই ঘন কোয়াশায় আচ্ছাদিত হয়ে কাউকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। সে সাদিদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সেদিকে মনোযোগ দিলো। কয়েক সেকেন্ড পরই তারা ঘন কোয়াশার চাদর বেঁধ করে সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। একজন নয়, দুইটা ছেলে। সে কিছু বুঝবে তার আগেই ছেলেদুটো ধিরিম-ধারিম সাদিদের পিঠে লাগালো৷

— ‘ হারামি, তোর লাইগ্গা দুইডা দন্ড ঘুমাইয়াও শান্তি পাই না৷ হেই পোলা, আমার প্রাণের সখি ঘুমের লগে তোর কি শত্রুতা? এমন হহোনের মতো পিছে পইরা থাহস ক্যান? ‘

বলেই তানবীর আরও দুইটা লাগালো। অপরদিকে সাদিদ নিঃশব্দে মার খাচ্ছে। অর্ণব তার চুপসে যাওয়া মুখ দেখে বলল,

— ‘ আরও জোরে দে। সম্ভব হইলে আমার পক্ষ থেকেও চারটা দে। এই পাথরটার গায়ে হাত লাগাইয়া ইতিমধ্যে আমার হাত ব্যাথা করতাসে। ‘

তারা দুইজন নিজেদের মধ্যেই কতক্ষণ বকবক করলো। কিন্তু সাদিদের মুখ থেকে এখন পর্যন্ত একটা শব্দ বের করতে পারলো না৷ দুইজনই একে-অপরের দিকে তাকালো। এটা নতুন নয়। এই দুইমাসের মোট দিনের সংখ্যা অনুযায়ী সাদিদের মুখ থেকে ষাটটি কথা শুনেছে কি-না এতে সন্দেহ। সারাদিন পাগলের মতো এখানে সেখানে নীলাকে খোঁজে বেড়াবে। অতঃপর নিশ্চুপ হয়ে বসে থেকে নির্ঘুম রাত কাটাবে তার স্মৃতি বুকে আগলে ধরে। এতো কষ্টে বুকে চেপে রেখেও ছেলেটা কান্না করে না। অশ্রুকণাগুলোকে আটকে রেখে আঁখিদ্বয়গুলোকে সবসময় লাল বানিয়ে রাখবে৷ সাদিদ নিঃশব্দে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই অর্ণব এসে কাঁধে ধরে তাকে বাঁধা দিলো,

— ‘ কাল রাতেও কিছু খাসনি৷ না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবি? চুপচাপ এখানে দাঁড়া। ‘

অর্ণব সাদিদকে ধরে রেখেই রসওয়ালাকে বলে উঠল,

— ‘ চাচা, আমাদের তিন গ্লাস রস দেন। ‘

তাদের সবাইকে তিনি পাত্র থেকে রস দিলেন। সাদিদের হাতে গ্লাস দিতেই সে একপলক অর্ণবের মুখপানে তাকালো। কিছু বলার আগেই অর্ণব বলল,

— ‘ তাকিয়ে লাভ নেই। এটা খা, নতুবা আমাদের হাতের শক্ত মাইর খা৷ ‘

সাদিদ চুপচাপ গ্লাসে চুমুক দিলো। একচুমুক দিয়ে আর খেতে পারলো না। কান্নারা এসে তার গলায় আটকে গেছে। সে ঢুল গিলে তাদের সামনে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে হনহনিয়ে হাঁটা ধরল। ঘন কোয়াশায় খুব অল্প সময়ে সে তাদের চোখের আড়াল হয়ে গেল৷ অর্ণব সেদিকে তাকিয়ে হতাশাজনক নিঃশ্বাস ফেলল। আর কতো? এভাবে যে চলতে পারে না৷ নীলা ছাড়া যে সাদিদ বেঁচে থাকতে পারবে না এই দুইমাসে কারো সেটা বুঝার বাকি নেই৷ সবাই যত যায় বলুক না কেন সাদিদ নীলাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। মেয়েটাকে ছাড়া হয়তো বাঁচতে পারবে। কিন্তু সেটাকে বাঁচা বলে না৷ যেমনটা এই মুহূর্তে সে বেঁচে আছে। প্রাণহীন এক জীবন। যেখানে জীবন নামক প্রাণ থাকলেও প্রাণোজ্জ্বল জীবনের বড্ড সংকট। অর্ণব টাকা দিয়ে তানবীরকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে সাদিদ কয়েকজন শীতের সবজি বিক্রেতাদের ধরে ফোন দেখাচ্ছে। তারা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। সাদিদের মলিন মুখটা দেখেই তারা অনুমান করে নিয়েছে৷ এবার কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে তার পিছনে হাঁটা ধরল। শূন্য রাস্তায় কয়েক কিলোমিটার হেঁটে তার ক্লান্ত লাগছে। পূর্বে হয়তো এমন কয়েক কিলো সে এমনিতেই জগিংটাইমে পার করে ফেলতো৷ কিন্তু এখন আর পারে না। কেননা আজকাল মনের সাথে সাথে শরীরটাতে যে অসুখের বীজ বুনছে৷ এতো অবহেলা, অনিয়ম, অনাহার এসব যাবে কোথায়? শরীরের উপর দিয়েই তো যাবার কথা।
ক্লান্ত সাদিদ পিছনে ফিরে তাকাতেই অর্ণব আর তানবীরকে দেখল। কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তারপরও দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

— ‘ আমার পিছনে কি? ‘
— ‘ কথা যেহেতু বলেছিস-ই তোর ঐ ধন্য মুখে অন্য কিছু বল। ‘
— ‘ চলে যা। আমার পাখিকে আমি একাই খোঁজে বের করব। ‘
— ‘ সরি ব্রাদার, এটা সম্ভব নয়। বউসুদ্ধ পারমিশন দিয়ে দিয়েছে৷ আর মা-বাবা বলেছে ভাইকে ছাড়া বাড়ি ফিরলে তোকেও বাড়ি ছাড়া করবো৷ তাই বাড়ি ছাড়ার রিক্স নিতে পারব না৷ ‘

অর্ণবের কথা শুনে যে সাদিদ রেগে যাচ্ছে সেটা তার মুখে পরিলক্ষিত। তাই তাকে আরেকটু জ্বালাতে সে তানবীরের কাঁধ জড়িয়ে বলল,

— ‘ কিরে দোস্ত, তোর কোনো সমস্যা? ‘
— ‘ কি কস! আমার আবার কি সমস্যা? বউ নাই তারউপর পরিবারও নাই। আমারতো যেহানে রাইত ওহানেই কাইত। ও.. সরি। একটা পিচ্চি উডবি আছে। সেও তোগো বউদের মতো মহান। কোনো নিষেধাজ্ঞা নাই৷ ‘

তানবীর কথাটুকু বলে দাঁত কেলালো। সাদিদ দু’জনের উপর একপলক বিরক্তিকর দৃষ্টি ফেলে কোনো কথা না বলে সামনে এগিয়ে গেল। তারাও নিজেদের মতো বকবক করতে করতে তার পিছনে চলল। সাদিদ আর কিছু বলতে গেল না। হাজার বার বললেও এরা যে তার পিছু ছাড়বে না এটা সে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। মনটা ভালো থাকলে হয়তো বন্ধুগুলোকে বুকে আগলে ধরত। এতো ভালো কেন তারা? কিন্তু ইচ্ছে করে না৷ জীবনটা কেমন যেন নির্জীব হয়ে গিয়েছে। সেখানে তার কিছুই আর ইচ্ছে করে না। সে কোয়াশা আচ্ছন্ন রাস্তায় আবারও বিরামহীন হাঁটতে লাগল।

_____________________

— ‘ নীলা, খাবারটা খেয়ে নাও। ‘

তমার কথায় নীলা চোখ পিটপিট করে তার দিকে তাকালো। তমা তার মলিন মুখে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। নীলার শরীরটা আজকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। গতকাল রাতেও জ্বর এসেছিল৷ এমনিতেই শুকনো তারউপর এই অবস্থায় খাবারের রুচি একেবারে চলে গিয়েছে। যতটুকু খায় তার সবটুকু আবার বমি করে বের করে। এখন অবশ্য আগের থেকে বমির পরিমাণ একটু কমেছে। কিন্তু শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। তমা ভেবে পায় না এমনটা চলতে থাকলে সামনে কি হবে? নীলাকে বাঁচানো সম্ভব হবে তো? তারউপর এই বাচ্চা!
তার নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। বড্ড ইচ্ছে করে এই অসহায় মেয়েটার একটু সাহায্য করতে৷ কিন্তু তাকে দমে যেতে হয়। কেননা দিনশেষে সেও ভীষণ অসহায়। পরিবার, পেটের দায়ে এসব খারাপ কাজে জড়িয়ে পরেছে। এখান থেকে পিছিয়ে যাওয়ার রাস্তা নেই।
নীলাকে উঠতে না দেখে তমা নিজেই তাকে বাহু আগলে বিছানা থেকে উঠালো। শীতের সিজন শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই তমা তানহাকে নীলার থাকবার বিছানা নিয়ে কথা বলে৷ তানহা আপত্তি জানায়নি। নীলার জন্য একটা সিঙ্গেল বেডের ব্যবস্থা করতে পেরে তমা ভীষণ খুশি হয়েছিল। কিন্তু সেটা সবার নিকট অপ্রকাশিত-ই রয়ে গেল। নীলা নিস্তেজ কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আপু, আজ কত তারিখ? ‘
— ‘ ডিসেম্বর মাসের ২০ তারিখ। কেন, কি হয়েছে? ‘

নীলা কিছু বলল না। চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। মনে পরছে পুরোনো অনেক সুখস্মৃতি। সব ঠিক তাহলে আজকের দিনটা কতই না সুন্দর হতো৷ সে, সাদিদ এবং তাদের সন্তান। ইশশ ভাবতেই নীলার মন পুলকিত হয়। আবার বর্তমান ভেবে বুকটা চাপা কষ্টে ভরে উঠে। নীলাকে পেটের উপর হাত রাখতে দেখে তমাও সেদিকে তাকালো। যদিও চারমাসে বাচ্চার অস্তিত্ব খুব ভালো একটা বুঝা যায় না। কিন্তু নীলা এতো পরিমাণ শুকিয়েছে যে এখন এই কাঠ শরীরে কেবল হালকা উঁচু পেটটাই উঁকি দিয়ে থাকে। নীলা আলতো করে নিজের পেটে কয়েকবার হাত বুলিয়ে দিলো। অতঃপর পেটে হাত রেখেই চোখজোড়া বন্ধ করে অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আপনি কোথায়? আমি যে আশায় রয়েছি। আমাদেরকে নিয়ে যাবেন না? খুব কষ্ট হচ্ছে। ‘

নীলা আর কান্না চেপে রাখতে পারলো না। শুকনো গালগুলো মুহূর্তেই ভিজে গেল। তমা তার সামনেই বসা ছিলো। সে আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। নীলা বহুবার তার হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ জানিয়েছে৷ শুধু তাকে নয়, তানহা এমনকি ইমরানের কাছেও। যদিও সে নীলার পথ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যতদিন ছিলো নিজের জন্য নয় তার সন্তানের ভালোর কথা চিন্তা করে তাকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছে। কিন্তু ঐ পাষাণগুলোর মন গলাতে পারেনি৷ নীলার প্রেগন্যান্সির কথা জেনেই ইমরান তার নিজের রাস্তা ধরেছে। সে তানহাকে সোজা বলেছে তার আর নীলার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। তাই তানহা যদি এখন নিজের স্বার্থে নীলার খুনও করে ফেলে সেটাতে তার কোনো আপত্তি থাকবে না। কিন্তু মুখ বন্ধ রাখার জন্য নগদ অর্থের প্রস্তাব অবশ্যই রেখেছে। এবং তানহা সেটাতে আপত্তি করেনি। তাদের এসব কথাবার্তা সব নীলার সম্মুখেই হয়েছিল। তাই তমা অথবা কারো জানার আর বাকি নেই। তমা এটা বুঝতে পারে না আপন রক্তের মানুষগুলোও এইরকম পশুর ন্যায় কিভাবে আচরণ করতে পারে। আর না বুঝতে পারে তানহার নীলাকে বাঁচিয়ে রাখার আসল উদ্দেশ্য। সে চাইলেই পারতো এতোদিনে নীলাসহ তার বাচ্চাকে মাটির নিচে জিন্দা পুঁতে ফেলতে। কিন্তু সে সেটা করেনি। এমনকি নীলাকে মুক্তিও দেয়নি। এভাবেই এতদিন যাবত মেয়েটাকে বন্দি রেখে দিয়েছে।
তমা আবারও নিঃশব্দে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নীলার উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ খাবারটা খাও। নতুবা নিজের সাথে সাথে বাচ্চাটাকেও কষ্ট দিবে। ‘

নীলা আচমকা তমার পা দুটো আঁকড়ে ধরল। আকষ্মিক এমন কান্ডে তমা হতবাক। বুঝে আসতেই সে নীলার থেকে নিজের পা সরিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু নীলা কিছুতেই ছাড়ছে না।

— ‘ একি, কি করছো এসব? আবারও পাগলামি শুরু করেছো! পা ছাড়ো নীলা। ‘
— ‘ আপ.. আপু প্লিজ আমাকে সাহায্য করো। তুমি আমার বড় বোনের মতো। ছোট বোনকে এই বিপদের সময়ে একটু সাহায্য করো৷ ‘
— ‘ নীলা কি হচ্ছে কি এসব? ছাড়ো বলছি। তুমি যেটা বলছো সেটা আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। ছাড়ো পা। ‘
— ‘ আপু, দোহায় লাগি একটু সাহায্য করো৷ আমি নিজের জন্য চিন্তা করছি না। আমার বাচ্চাটা এভাবে থাকলে বাঁচবে না। ও আমার কাছে আমানত আপু। আমি মা হয়ে কিছু করতে পারছি না৷ প্লিজ আমাকে একটু সাহায্য করো। ‘

নীলার কান্নামাখা কন্ঠের আবদারগুলো তমার আর সহ্য হচ্ছে না। না তাকে দুর্বল হলে চলবে না। সে জোরপূর্বক নীলার হাত থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো।
নীলার কান্নাগুলো বাঁধ মানছে না৷ সে হাঁটুতে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এতগুলো অমানুষের মাঝে শুধু এই তমা মেয়েটাকেই তার আপন মনে হতো। এতগুলো দিন কেবলমাত্র এই মেয়েটাই সবসময় নীলার পাশে থাকার চেষ্টা করেছে। এতগুলো চোখকে ফাঁকি দিয়ে নীলার খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছে। তাকে এই বন্দি জীবন থেকে বের করতে না পারলেও সবসময় পাশে থাকার চেষ্টা করেছে৷ শেষ আশাটুকু বিলীন হয়ে যাওয়ার আশংকায় নীলার কান্নাগুলো থামছে না। কি করবে সে? কিভাবে সাদিদকে তার এই অবস্থার কথা জানাবে? কেউ কি সাহায্য করবে না? সবাই তো বলে সৃষ্টিকর্তা তার বান্দাদের জন্য আশার সব দরজা একসাথে বন্ধ করে দেয় না। কিন্তু নীলা যে এখানে পুরোপুরি আশাহীন হয়ে বসে রয়েছে।
হঠাৎ করেই মাথায় কারো হাতের স্পর্শে নীলা মাথা তুলে তাকালো। তার সামনে তমা বসে রয়েছে। সে এখনও যায়নি। সে নীলার কাছে ফিরে এসেছে। তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলসে। নীলা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সে কেবল নিষ্পলক তমার মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। নীলার এমন চাহনি দেখে তমা নিঃশব্দে মৃদু হাসলো। তারপর নিজের জিন্সের প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে নীলার সামনে ধরল। নীলা একবার তার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার ফোনের দিকে৷ সে আবারও মুচকি হাসলো। অতঃপর বেশ স্বাভাবিক স্বরেই বলে উঠল,

— ‘ কি? এতক্ষণ তো অনেক পাগলামি করছিলে। এখন কি হয়েছে? নাও ধরো৷ জানাও তাকে। নিয়ে যেতে বলো এই বন্দিজীবন থেকে৷ ‘

নীলা কয়েক মুহূর্ত নির্বাক তমার মুখপানে তাকিয়ে রইল। সম্পূর্ণ বিষয়টা বুঝে আসতেই তার চোখজোড়া আবারও ঝাপসা হতে লাগল। এতো খুশি সে প্রকাশ করতে পারছে না। সে কান্না থামাতে ঠোঁট কামড়ে ধরল। তমার হাত থেকে ফোন নিয়ে কল লাগাতে গেলেই সে হঠাৎ থেমে গেল। সে তো অমানুষ নয়। তার মানবিকতা তাকে বাঁধা দিচ্ছে। সে কান্না মিশ্রিত অসহায় কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আপু, তোমার মা এবং ভাই? আর তুমি? তারা যদি জানতে পারে তাহলে আমাকে বাঁচিয়ে রাখলেও তোমাকে ছাড়বে না৷ আমি কি করবো আপু? ‘

তমা নীলার নিষ্পাপ মুখটাতে তাকালো। তার মতো মেয়ের থেকে এমনটাই আশা করা যায়। এই কয়েকটা মাসে তাকে বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে সে৷ তাই তমা আর অবাক হলো না৷ বরং নীলার অশ্রুসিক্ত ভেজা গালগুলো মুছিয়ে দিয়ে বলল,

— ‘ আমার কথা বাদ দাও৷ তুমিতো বলেছিলে তোমার স্বামী অনেক বড়লোক৷ টাকা-পয়সার অভাব তাদের কোনো কালেই ছিলো না৷ যদি বেঁচে ফিরতে পারো তাহলে তাকে বলো আমার মা আর ভাইটাকে যেন দেখে রাখে৷ আমার পরিবারে আমি ছাড়া উপার্জনের আর কেউ নেই৷ তারা সুখে থাকলে আমি মরে গেলেও শান্তি পাবো। ‘

তমা নিজের কথাটা শেষ করে মলিন হাসলো। নীলার চোখজোড়া ভেজা৷ কে বলেছে আপন আপনই হয়৷ কখনও কখনও আপন মানুষগুলো বুকে ছুঁড়ি বিঁধতে পারলেও দূরের লোকগুলো ক্ষতস্থানে মলম লাগাতে এগিয়ে আসে।
নীলাকে সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগতে দেখে তমা নিজেই তার হাতে ফোন তুলে দিয়ে বলল,

— ‘ সময় নষ্ট করো না নীলা। এই সময়টুকুর বড্ড দাম। কেউ চলে আসলে আমি তখন কিছুই করতে পারব না। প্লিজ তাড়াতাড়ি করো৷ আমার কথা ভেবো না৷ জানাও তাকে। ‘

তমা নীলার কাছে আর বসলো না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ তাদেরকে খেয়াল করেছে কি-না সেটা দেখলো। তাকে বেড়িয়ে আসতে দেখে একজন ছেলে বলে উঠল,

— ‘ এতক্ষণ কি করস? ‘
— ‘ মেয়েটা অসুস্থ। আবার বমি করেছে। তাই পরিস্কার করতে সময় লাগলো। ‘

ছেলেটা আর কিছু বললো না। নীলার এই অবস্থা সবাই-ই জানে। তাই নিজেদের মধ্যে আবার কথা বলতে শুরু করলো৷ তমা স্বস্তির শ্বাস ফেলল। অপরদিকে নীলা এখনও ফোন হাতে নিয়ে বসে রয়েছে। তার শরীর মারাত্মকভাবে কাঁপছে। কিন্তু সে আর এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সময় নষ্ট করতে পারবে না। তাই কাঁপা হাতে ফোন লাগালো।

.

কোয়াশার চাদর সরিয়ে পঞ্চগড়ের এই ছোট্ট গ্রামে হালকা রৌদ্রের আলো ফুটছে। যদিও সূর্যাদয় আরও অনেক আগেই হয়েছে, তারপরও প্রচন্ড কোয়াশায় সূর্যের আলোর দেখা পাওয়া কঠিন। তানবীর আর অর্ণব স্থানীয় একটা রাস্তার পাশের ছোট্ট হোটেলে সকালের নাস্তা করতে বসেছে। সাদিদ বসতে চায়নি। কিন্তু তারপরও তাকে জোর করে বসিয়ে খাবার সামনে দিয়েছে। অর্ণব তানবীর খাওয়া শুরু করলেও তার খাবারের প্লেট এখনও একি জায়গায়৷ তা দেখে তানবীর বিরক্তির স্বরে বলে উঠল,

— ‘ তুই কি রোবট? না খাইয়া এভাবে চলবো? দুই কদম হাঁটার আগেই তো উষ্ঠা খাইয়া পরবি। ফাইজলামি না করে খা। তুইতো অবুঝ না। অবুঝ হলে না হয় বুঝতাম। দ্রুত নাস্তা শেষ কর। তারপর তো আবার তোর অভিযান অব্যহৃত রাখতে হইবো৷ শক্তির দরকার না? খা জলদি৷ ‘

সাদিদকে তারপরও একধ্যানে বসে থাকতে দেখে তানবীর বিড়বিড়িয়ে তার গালমন্দ করলো। সাদিদের তাতে কোনো খেয়াল নেই। সে নিষ্পলক সামনের খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে যেন মানুষ হয়েও আজ রোবট হয়ে গিয়েছে। ফোনের আওয়াজে তার ধ্যান কাটলো৷ সে পকেট হাতড়ে ফোন বের করলো। অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসছে। সাদিদ চোখজোড়া কুঁচকে নিয়ে ফোনের ডিসপ্লের দিকে তাকালো। আজকাল শায়লা রহমান বিভিন্ন জনের ফোন থেকে কল করে তাকে বাড়ি ফিরে যাবার কথা বলে। এবারও হয়তো তিনি কল করছেন বিধায় প্রথমবারে সাদিদ ফোন রিসিভ করলো না। বারবার মায়ের কথার অবাধ্য হতে ভালো লাগে না৷ আবার তিনি যা বলেন সেটাও সাদিদের পক্ষে শোনা সম্ভব নয়। নীলাকে খোঁজে পাক আর না পাক কিন্তু হাত গুটিয়ে সে বাসায় বসে থাকতে পারবে না। সবাই এটাকে তার পাগলামি বললেও সে নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। বাড়ি থেকে যেহেতু বের হয়েছেই নীলাকে সাথে না নিয়ে সে ফিরবে না৷ যদি আজীবন চলে যায় তাতেও সাদিদ নিজের প্রাণপাখিকে ব্যতিত গৃহে প্রবেশ করবে না। আবারও কল আসাতে সাদিদ এবার রিসিভ করলো। কানে ফোন লাগিয়ে হ্যালো বলতেই অপরপাশ থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার ভেসে আসতে লাগল। সাদিদ আচমকা এমন ঘটনায় কপাল কুঁচকে নিলো। কিন্তু সেকেন্ড সময় অতিবাহিত হয়ে মস্তিষ্কে তার অপরপাশের শব্দের উৎস পৌঁছাতেই সাদিদের চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে উঠল। সে ধরা গলায় মায়াভরা কন্ঠে ডেকে উঠল,

— ‘ পাখি। ‘

কতদিন আহ কতগুলো দিন পর এই ডাকটা নীলার কর্ণকোহরে এসে পৌঁছিয়েছে। সে নিজেকে সামলাতে পারছে না। বারবার কিছু বলতে চায়ছে কিন্তু কান্নারা এসে গলায় আটকে গিয়েছে। অপরপাশ থেকে এবার সাদিদের অস্থির কন্ঠ ভেসে আসলো,

— ‘ এই পাখি, লক্ষ্মি বউ আমার। একদম কান্না করে না। আমি আছিতো। কান্না থামাও। ‘
— ‘ আ.. আমি…
— ‘ কি? কি হয়েছে বলো আমাকে? এই প্রাণপাখি এমন করে কাঁদে না। কষ্ট পাচ্ছি তো। ‘

সাদিদ নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না। এতদিন পর নীলার কন্ঠ শুনতে পাওয়া, তারউপর আবার এখন এমনকরে কান্না করছে। সে আশেপাশের সবকিছু ভুলে ক্রমাগত পাগলের মতো চেঁচিয়ে যাচ্ছে,

— ‘ প্রাণপাখি, কথা বল৷ এমন করে থাকে না। বল না আমাকে। প্লিজ কিছু তো বল। ‘

অর্ণব তানবীরও সাদিদের অস্থিরতায় উঠে দাঁড়িয়েছে। সাদিদের কথা শুনে তাদের আর বুঝতে বাকি নেই ফোনের অপরপাশের ব্যক্তিটি কে। কিন্তু এভাবে সাদিদের পাগলামিতে কিছু সমাধান হবে না৷ তাই অর্ণব এগিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক সাদিদের হাত থেকে ফোন নিয়ে সেটা লাউডস্পিকারে দিলো। তারাও স্পষ্ট নীলার ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনতে পারছে।

— ‘ নীলা কি হয়েছে, কথা বলো? এভাবে কাঁদলে বুঝবো কিভাবে? ‘
— ‘ আমি নীলা নই তমা বলছি। আর ফোনে কথা বলা সম্ভব নয়। আপনি কোথায় আছেন? ‘
— ‘ আপনি কে? আমার পাখি কোথায়? আমার পাখিকে দিন৷ আমার পাখি কাঁদে কেন? আপনি কাঁদিয়েছেন ওকে? ছাড়বো না কিন্তু, একেবারে মেরে ফেলব। ‘
— ‘ চুপ কর সাদি৷ সবসময় মারামারিতে থাকিস। ‘

অপরদিকে তমা কানে ফোন লাগিয়ে নিঃশব্দে হাসছে। ফোনের অপরপাশ থেকে সাদিদের এমন ধমকি শুনে তার বড্ড হাসি পাচ্ছে। কিন্তু এখন হাসার সময় নয়। আবারও একপলক দরজার দিকে খেয়াল করে সে নিচুস্বরে বলে উঠল,

— ‘ আপনার পাখি রাঙামাটিতে রয়েছে। দ্রুত এসে পাখিকে নিয়ে যান। আমি এড্রেস এই নাম্বারে সেন্ড করে দিচ্ছি। কিন্তু একা আসার ভুল করবেন না। তাহলে কেউ জীবিত ফিরে যেতে পারবেন না। সম্ভব হলে পুলিশফোর্স নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন। আর কল দিবেন না আমাকে। নতুবা বিপদে পরতে হবে। ‘
— ‘ আমার পাখি ও.. ওকে দিন। ওর..
— ‘ প্লিজ বুঝার চেষ্টা করুন। নতুবা বিপদ আরও বাড়বে। ‘

তমা তাদেরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো। নীলা মুখ চেপে কান্না করছে। তমা এখনও নিঃশব্দে হেসে যাচ্ছে।

— ‘ পাগল মেয়ে। এতো কান্না করলে চলবে? ‘

নীলা তমাকে ঝাপটে ধরল। এতো খুশি সে কিভাবে প্রকাশ করবে? কতোদিন পর আজকে সেই প্রিয় কন্ঠটা শুনতে পেল। সে তমার কাঁধে মুখ চেপে কান্না মিশ্রিত গলায় বলতে লাগল,

— ‘ আমি তোমার কাছে ঋণী আপু। সারাজীবনেও তোমার এই ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। ‘

অপরদিকে সাদিদের ফোনে তমা লোকেশন সেন্ড করেছে। এবং তার সাথে ছোট একটা ইনফরমেশনও দিয়েছে। যেটা দেখে তাদের আর বুঝার বাকি নেই যে নীলা কোনো বিপদে রয়েছে। সাদিদতো এখন পাগলপ্রায়। এতদিন সন্ধান ছিলো না। আর এখন সন্ধান পেয়েছে তাও এমনভাবে। সাদিদকে আর পায় কে। সে জায়গা থেকেই পাগলের মতো দৌড় শুরু করেছে। তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা কতক্ষণে তার প্রাণপাখিটার কাছে পৌঁছাতে পারবে। তাকে বুক পাঁজরে আঁকড়ে ধরতে পারবে। অস্থির সাদিদের পিছনে অর্ণব তানবীরও দৌড়িয়ে আসছে। এইজন্যই তারা এতটাদিন সাদিদকে একা ছাড়েনি। সাদিদ বিরক্ত হয়ে যেতে বললেও তারা সবসময় সুপারগ্লোর মতো তার পিছনে লেগে ছিলো। কখনও তো কেবলমাত্র বন্ধু বলে মনে করেনি। ভাই ভেবে এসেছে আর এখনও ভাবে। তাইতো পিছু ছাড়তে পারেনি। তারা এগিয়ে এসে একটা অটোরিকশা পেল। তিনজনই তাতে উঠল। সাদিদ অস্থির কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ ভাই জলদি বাস স্টেশন যান। ‘

চালক জলদিই চালিয়ে যাচ্ছে তারপরও সাদিদের যেন তাতে পোষাচ্ছে না। সে অস্থিরতা মিশ্রিত রাগী স্বরে ধমকে উঠল,

— ‘ ভাই আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন না কেন? জলদি চলুন। নতুবা জায়গা দেন আমি চালাই। ‘

সাদিদের পাগলামি মার্কা কথাবার্তা শুনে চালক হতবাক। কি বলে এই লোক? অর্ণব পাশ থেকে তাকে শান্ত করতে বলল,

— ‘ পাগলামি করিস না সাদি। উনি জোরেই চালিয়ে যাচ্ছে। ‘

তানবীর অর্ণব পাশ থেকে আরও অনেককিছুই বলে যাচ্ছে কিন্তু কোনো কিছুতেই সাদিদ শান্ত হতে পারছে না। একেকটা সেকেন্ড যেন বিষ কাটার মতো শরীরে বিঁধছে।
সাদিদরা রাঙামাটি এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সেইদিন পার হয়ে নতুন দিনের সূচনা হয়েছে। ভয়ে বোধহয় সাদিদের আত্মায় একফোটা পানি অবশিষ্ট নেই। এত ভয় সে আজকের আগে কখনও পায়নি। এখনপ ভয় দূর হচ্ছে না। যতক্ষণ বা পর্যন্ত নীলাকে তার সামনে সুস্থ অবস্থায় পাচ্ছে এই ভয়-অস্থিরতা দূর হবার নয়। সাদিদ বাহিরের দিকে তাকালো। চারপাশে গাছগাছালিতে ঘেরা ঘন জঙ্গল। এখনও ভোরের আলো পৃথিবীর বুকে ফুটেনি। অন্ধকার রাস্তায় পুলিশ ব্যানে তারা ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় পুলিশের একদল টিম তাদের সাথে রয়েছে। সাদিদদের পুলিশ স্টেশনে যেতে হয়নি৷ ঢাকা মহানগরীর পুলিশ অফিসারই তাদেরকে ইনফর্ম করেছে। পঞ্চগড় থেকে ফেরার রাস্তায়-ই তারা ঢাকা মহানগরীর পুলিশ কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছিল। সাদিদ সেদিন রাগারাগি করলেও পরে অর্ণব গিয়ে তাদের সাথে কথা বলে তখনকার সবটুকু পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলে। ফলাফলে তারাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এতদিন নীলার খোঁজ জানার জন্য তাদের টিমও কাজ করেছে। আর সেইজন্যই তানহা নীলার নিরাপত্তা আরও জোরদার করে। কিন্তু নীলার ভাগ্যে হয়তো সেটা ছিল না। তাই তাদের এতো অভিযানও কাজে আসেনি। এতদিন পর আশার একটু আলো দেখেছে সবাই। তাই সবার মনোবলই ভীষণ দৃঢ়। পূর্বেই সর্তক থাকাতে তারা কোনো ভুল করার সুযোগ রাখেনি। সাদিদও ভিতরে ভিতরেই নিজের অস্থিরতাটা লোকায়িত করেছে। এটা তার প্রাণপাখির সাথে জড়িত। তাই নিজের পাগলামির জন্য সে কখনই নীলার ক্ষতি হতে দিবে না। যেহেতু রাতের শেষ প্রহর চলছে তাই পাহারা দেয় এমন অনেকগুলো গার্ড বিশ্রাম নিচ্ছিলো। এরমধ্যেই সাদিদরা তমার দেওয়া ঠিকনাতে এসে পৌঁছালো৷ এতগুলো গার্ড দেখে সাদিদরাও অবাক হয়েছে। নীলার সাথে এমন শত্রুতা কার থাকতে পারে? যার ধরুন এভাবে তাকে আটকে রেখেছিল!
তারা বেশ বুদ্ধিমত্তার সাথে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু ভিতরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাদের উপস্থিতি তারা বুঝে যায়। আর শুরু হয় একে-অপরের বিপক্ষে অস্ত্রধারী আক্রমণ। আচমকা এতো গুলির শব্দে নীলার ঘুম ছুটে যায়। বেশিক্ষণ হয়নি তার চোখ লেগেছে। সাদিদকে জানানোর পর থেকে একদণ্ডও স্থির থাকতে পারেনি৷ শুধু অস্থিরতায় সময় অতিবাহিত করেছে। এখন এতো গুলাগুলির আওয়াজে নীলা ভয়ে চুপসে গিয়েছে। ভয়ে সে কানে হাত দিয়ে চেপে ধরেছে। অপরদিকে সাদিদের জন্য চিন্তায় শ্বাস আটকে যাওয়ার অবস্থা। হঠাৎ করে এমন গুলিবর্ষণ কেন? তাহলে কি সাদিদ তাকে নিয়ে যেতে এসেছে? আর তারা সাদিদের উপর হামলা করেছে?
নীলার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমন চিন্তায় তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আর নিজেকে মনে মনে দোষারূপ করে যাচ্ছে। তার জন্যই সাদিদ আজ এই বিপদে এসে পরেছে। এখন তার যদি কিছু হয়ে যায় নীলা কখনও নিজেকে এর জন্য ক্ষমা করতে পারবে না।
আচমকা দরজা খোলে যাওয়াতে নীলা নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়ে ভয়ার্ত চোখে দরজার দিকে তাকালো।
সাদিদ যতটাই না দ্রুত ঘরে প্রবেশ করেছিল নীলাকে সামনে দেখে ততটাই থমকে গেল। কতগুলো মিনিট, কতগুলো ঘণ্টা, এমনকি কতগুলো দিন পেরিয়ে প্রিয় মুখখানি তাদের দুজনেরই চোখের সামনে। নীলার চোখজোড়া মুহূর্তেই ঝাপসা হয়ে গেল। অশ্রুকণা ভিড় জমিয়ে সাদিদকে ঝাপসামান দেখাচ্ছে। তাই নীলা দ্রুত চোখ মুছে আবারও সাদিদকে দুচোখ ভরে দেখতে লাগল।
সাদিদ কিভাবে দৌড়ে এসেছে সেটা সে নিজেও বোধহয় জানে না। প্রচন্ড শক্ত করে সে নিজের সাথে প্রিয়তমা স্ত্রীকে জড়িয়ে নিলো। নীলার হাড়গোড় বোধহয় ভেঙে যাবার উপক্রম। কিন্তু এতে তার বিন্দুমাত্র ব্যাথা অনুভব হচ্ছে না। এ যে সুখের ব্যাথা। আর সুখময় ব্যাথা কখনও কষ্টের অনুভুতি দেয় না।

— ‘ কলিজা, আই মিসড ইউ। আই মিসড ইউ সো মাচ বেবি, আই মিসড ইউ। ‘

সাদিদের ধরা গলা শুনে নীলা এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। শীতের কাপড়ের উপর দিয়ে সাদিদের পিঠে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। নীলার কান্নার আওয়াজ শুনে সাদিদ তার কাঁধ থেকে মুখ উঠিয়ে প্রাণপাখির মুখটা আঁজলাভরে ধরল। কপালে দীর্ঘ চুমু খেল।

— ‘ আমার লক্ষ্মী পাখি, কাঁদে না৷ আমি এসেছি তো৷ ‘

কে শুনে কার কথা নীলার কান্না কি আর থামে? প্রিয়তমার অশ্রুসিক্ত মুখটার কানায় কানায় সাদিদ তার ঠোঁটের উষ্ণ পরশ বুলিয়ে দিতে লাগল। ভেজা চোখ, ভেজা গাল, কপাল, নাক কোনো কিছু বাদ রাখলো না৷ আদরে আদরে প্রিয়তমাকে পূর্ণ করতে লাগল। তারা নিজেদের মধ্যে এতটাই বিভোর যে পিছনে যে অর্ণব তানবীরসহ পুরো পুলিশফোর্স দাঁড়িয়ে রয়েছে সেদিকে তাদের কোনো খেয়াল নেই। নিজেরা লজ্জিত হয়ে তারা নিজেদের পথ দেখলো। রুম থেকে বেড়িয়ে যাবার মুহূর্তে সবার মুখেই ছিল চাপা হাসি।
সাদিদ নীলাকে আবারও বুকে জড়িয়ে নিলো। মাথায় গভীর চুমু খেয়ে চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

— ‘ আর কাঁদে না পাখি৷ কষ্ট হচ্ছে তো। আমাকে আবারও কষ্ট দিবে? আর কষ্ট দিলে মরে যাবো তো। ‘

নীলার হেঁচকি উঠছে। সে সাদিদের এমন কথা শুনে বুক থেকে মাথা তুলে তার মুখের উপর নিজের ডানহাত রেখে মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে না করতে লাগল। সাদিদের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা দেখা গেল। সে নীলার হাতটা নিজের দুইহাতের মুঠিতে নিয়ে উষ্ণ চুম্বন একে দিলো৷ তার চোখজোড়াও আবার ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। সে নীলার মুখপানে তাকিয়ে ভীষণ আবেগ-অভিমান জড়ানো গলায় বলে উঠল,

— ‘ খুব কষ্ট দিয়েছিস পাখি। খুব কষ্ট। ‘
— ‘ আ’ম সরি। খুব সরি আমি৷ ক্ষমা করে দিন৷ ‘

সাদিদ নীলার কোমল অধরযুগল ছুঁয়ে দিয়ে অন্য উপায়ে মুখ বন্ধ করে দিলো। নীলার শরীরে ক্রমশ শিহরণ বয়ছে৷ সাদিদ ঠোঁটে আলতো ছুঁয়ে দিয়ে সরে আসলো। কিন্তু আবারও কাছে গিয়ে ছোট করে একটা চুমু খেল। অতঃপর নীলার গালে নিজের দুইহাত রেখে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

— ‘ ওহ্ আর কখনও এটা বলবে না। আমার পাখি কোনো অপরাধ করেনি, আর না কখনও করতে পারে। সরি বলার জন্য তাকে কিন্তু শাস্তি দেওয়া হবে৷ সাদিদের ভয়ংকর সব শাস্তি তার জন্য বরাদ্দ করবো। ‘

নীলা এবার ফিক করে হেসে উঠল। সাদিদ তার হাসির আওয়াজ পেয়ে নিজেও নিঃশব্দে মৃদু হাসল। মাথা নিচু করে ঠোঁটের কোণে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল,

— ‘ আপাতত সরি বলার জন্য এতটুকু দিলাম৷ বাকিটুকু দেনা রইল। সবার ক্ষেত্রে বাকির নিয়ম নেই। স্পেশাল পার্সন বিধায় তৈরি করেছি। কিন্তু শাস্তি মওকফ করা হবে না। সময়মতো সুদসমেত পুষিয়ে দিবো৷ ‘

নীলা আবারও হাসল। সাদিদও প্রিয়তমার মিষ্টি হাসিতে হেসে দিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাকে নাক ঘষে দিলো।

#চলবে…