অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-৫৩+৫৪

0
910

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৫৩ ❤

ঘড়িতে সময় এখন সকাল ছয়টা বেজে দশ মিনিট। মাত্রই কিছুসময় পূর্বে সকালের রক্তিম সূর্য তার নিজস্ব সৌন্দর্য নিয়ে পূর্ব আকাশে অবতরণ করেছে। নীলা আরেকবার জানালা দিয়ে বাহিরে উঁকিঝুঁকি মেরে বলে উঠল,

— ‘ এবার তাহলে যাই? অনেক সকাল হয়ে গিয়েছে তো। দেখেন সূর্য পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। ‘

সাদিদ তার কথায় বালিশে মুখ গোঁজেই নিঃশব্দে হাসলো। তারউপর আড়মোড়া ভেঙে শীতের সকালে আরামের নরম বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। নীলা ততক্ষণে একেবারে শীতের জামাকাপড় পরে বাহিরে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। তখন সাদিদই এগুলো ক্লোজেট থেকে বের করে রেখেছিলো৷ তাড়াহুড়ায় নীলা সাদিদের উঠার আর অপেক্ষা করেনি৷ নিজে নিজেই রেডি হয়ে গিয়েছে। হাঁটু পর্যন্ত শীতের লেডিস জ্যাকেটের সাথে লুজ প্লাজো। গলায় একটা স্কার্ফ পেচানো। এতো ভারি কাপড়ের নিচে তার পুঁচকোটাকে দেখায় যাচ্ছে না।
নীলা এখন ছয়মাসে পা দিয়েছে। ছোট্ট পিচ্চিটা মায়ের গর্ভে একটু একটু করে নিজের আধিপত্য স্থাপন করে চলেছে। অবশ্য অন্য সবার মতো প্রেগন্যান্সিতে নীলা খুব বেশি মোটা হয়নি৷ সমস্ত শরীরে চোখ বুলালে আলাদাভাবে কেবলমাত্র পেটটাই চোখে পড়বে। নতুবা শারীরিকভাবে তার খুব বেশি ওজন বাড়েনি৷ কিন্তু তারপরও চেহারায় কেমন যেন একটা নাদুসনুদুস ভাব এসেছে। দেখলেই মনে হয়ে কোমল তুলতুলে। সাদিদেরতো সারাদিনই বড্ড আদর করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নিজের প্রাণপাখিটা আর কলিজার টুকরোটার কথা ভেবে নিজেকে বহু কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করে রাখে।
সাদিদ স্মিত হেসে এগিয়ে এসে নীলার কানটুপিটা আরেকটু টেনে ঠিকঠাক করে দিলো। সে নিজেও জামাকাপড় পরে তৈরি ছিলো। কেবলমাত্র সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় নামাজ শেষে বিছানায় হালকা গা এলিয়েছে। কিন্তু এতো চেষ্টা করেও পাখিটাকে বিছানার ধারেকাছেও আনা যায়নি। তার এককথা, সে বিছানায় আসলেই সাদিদ তাকে বুলিয়ে বালিয়ে ঘুম পারিয়ে দিবে৷ তাই সে বিছানায় আসার মতো রিক্স নিবে না। আজকে তার কথা সাদিদকে রাখতেই হবে। সে আজ নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। পৃথিবী প্রয়োজনে উল্টিয়ে যাক। কিন্তু নীলা নিজের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসবে না। না মানে না।
সাদিদ একপলক নীলার উপর নিচ ভালোভাবে পরখ করলো। সব ঠিক আছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাঁটু ভাজ করে ফ্লোরে বসলো। অতঃপর নীলার কোমড় পেঁচিয়ে তাকে কাছে টানলো। নীলার গায়ের জামার উপর দিয়েই তার পেটে নিজের ঠোঁট বুলিয়ে অনাগত স্নেহের টুকরোটাকে আদর দিলো। নিচুস্বরে নিজের অংশের সাথে ফিসফিসিয়ে কথাও বলে নিলো৷ নীলা ততক্ষণ কিছুই বললো না। শুধু সাদিদের মিষ্টি পাগলামিগুলো ঠোঁট চেপে হাসি আটকিয়ে দেখলো। সাদিদ নিজের সন্তানের সাথে আদর-টাদরের পাঠ চুকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। শুধু কি একজনকে করলে হবে? তাহলে আরেকজন যে বাদ যাবে। সেটা কি হয়? তাই নীলার গালে হাত রেখে সাদিদ তার নরম তুলতুলে গালে-কপালে গুটিকয়েক উষ্ণ আদর দিলো। প্রিয়তমার কোমল ঠোঁটযুগল যে তাকে নেশালো দ্রব্যের ন্যায় সর্বদা টানতে থাকে৷ লোভ সামলিয়ে রাখতে সাদিদকে বরাবরই হিমশিম খেতে হয়। সময় আর সুযোগ যেহেতু সুপ্রসন্ন তাই সেখানেও নিজের অধরযুগলের বিচরণ চালালো। নীলার চোখজোড়া ততক্ষণে বন্ধ হয়ে এসেছে। এমন ভালোবাসা নিয়ে আদর দিলে কি নিজেকে সামলিয়ে রাখা যায়? মন উত্তর দেয় পারে না। তাই নীলাও যে নিজেকে সামলাতে পারে না। সাদিদের মতোই ছন্নছাড়া হতে হয়। নীলা হালকাভাবে সদিদের কাঁধ চেপে ধরলো। মিষ্টি সকালটা ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে সাদিদ সরে আসলো। অতঃপর ভিজে ঠোঁটজোড়া হালকা নাড়িয়ে মিষ্টিস্বরে বলল,

— ‘ চলেন মহারাণী, আপনার সেবায় এই অধম হাজির। ‘

নীলা তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে মাথা নিচু করে নিজের লাজুকভাব প্রকাশ করলো। সাথে আড়চোখে সাদিদের দিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে খিলখিলিয়ে হাসলো। সাদিদ নিষ্পলক তার হাসিমুখটাতে চেয়ে রইল। হাসছে নীলা কিন্তু বুকে যেন সাদিদের শীতলতা অনুভব হচ্ছে। সময়ের কাটা সেকেন্ড অতিক্রম করে মিনিট পার করতেই নীলা তাকে মৃদুভাবে ধাক্কা দিলো,

— ‘ কি হলো? কোথায় হারিয়েছেন? ‘
— ‘ হ্যাঁ? না কিছু না পাখি। চলো তাহলে, যাওয়া যাক এবার। ‘

সাদিদ খুবই সাবধানে নীলাকে বাহিরে নিয়ে আসলো৷ খুব সকাল বিধায় মা-বাবা কাউকে লিভিংরুমে পাওয়া যায়নি। হয়তো বা নামাজ পরে তারাও এখন বিশ্রাম করছে৷
বাহিরে আসতেই সাদিদের শীতল চোখের দৃষ্টি এবার তীক্ষ্ণ চাহনিতে রূপ নিলো। সে কিছুটা অসন্তুষ্ট গলায় বলল,

— ‘ এখন না গেলে হয় না জান? দেখো, আবহাওয়াতে পুরোপুরি শীতের প্রকোপ না থাকলেও আংশিক রয়েছে। তোমার যদি তাতে ঠান্ডা লেগে যায়? ‘
— ‘ ইশশ আপনি আবার শুরু করেছেন? আমি আজকে যাবোই। আপনার এই প্যানপ্যান আমি আর শুনবো না। ‘
— ‘ লক্ষ্মি পাখি আমার। আমার টিয়া, ময়না, বুলবুলি..
— ‘ বাংলাদেশ এমনকি পৃথিবীর সমস্ত পাখির নাম নিয়ে তবজি পড়লেও আজকে আমি যাবো। এন্ড ইটস ফাইনাল। ‘

সাদিদ ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। মেয়েটা আজকাল তার একটা কথাও শুনতে চায় না। সাদিদও জোর দিয়ে কিছু বলতে পারে না। ক্ষণে ক্ষণে মুড সুয়িং জিনিসটা মেয়েটার বড্ড বেশি হচ্ছে। এইমাত্র ভালো তো একটু পরেই অকারণে রেগে যায়। আবার হুট করেই কেঁদে গাল ভাসায়। এখন এটা চাই মানে চাই-ই। না শব্দটা শুনলেই চোখের কোণে জলধারা এসে ভিড় জমায়।
সাদিদ প্রবল ভালোবাসাময় দৃষ্টি নিয়ে নির্নিমেষ তার পাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। অতঃপর এগিয়ে এসে নীলার কানটুপি বেধ করে আসা ছোট চুলগুলোকে সন্তপর্ণে কানের পিছে ঠেলে দিলো। প্রিয়তমার মুখটা আঁজলাভরে ধরে কপালে আলতো করে উষ্ণ ঠোঁটযুগল চেপে ধরলো। শীতের আমেজে উষ্ণ কোমল স্পর্শটা যেন নীলার দেহে আলোড়ন তুলছে৷ তার চোখজোড়া আবেশে পিটপিট করছে। প্রিয়তমাকে শীতের সকালের নরম উষ্ণ আদর শেষে সাদিদ একহাতে তাকে আগলে নিলো। ছোট ছোট পা ফেলে খুবই সাবধানে নীলাকে নিয়ে মেইট গেইট পেরিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামলো।
নীলার খুশি আর দেখে কে! মুখে হাত চেপে ধরে সে ঘন কালো আঁখিপল্লবের নিচে লোকায়িত ডাগর ডাগর মায়াবী চোখজোড়া দিয়ে সবকিছু পরখ করছে। যেন সাদিদ তাকে বাড়ির সামনে নয় বরং শীতের সকালে কোনো সমুদ্র সৈকতে নিয়ে এসেছে। তাছাড়া এটা সমুদ্র সৈকত থেকে কম কোথায়? এই মুহূর্তটা লাভ করার জন্য নীলাকে এইপুরো সপ্তাহটা সাদিদের পিছনে হাত ধোয়ে পরে থাকতে হয়েছে। কতো কথা এমনকি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল পর্যন্ত করেছে। কিন্তু সাদিদ কিছুতেই তাকে সকালে নিয়ে বের হতে রাজি হচ্ছিলো না। তার এককথা সকালের ঠান্ডা কোয়াশায় নীলার শরীর খারাপ করবে। আর এই রিক্স সাদিদ নিতে পারবে না। কিন্তু গতকাল রাতে হুট করেই সাদিদ বলল আজকে তাকে নিয়ে বরে হবে৷ নীলার তখন থেকেই উপচে পরা আনন্দ। এতো উত্তেজনায় রাতটাই যেন কাটতে চাইছিলো না৷ নীলা চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস টানছে। চোখে-মুখে তার প্রবল খুশির ছাপ।
প্রাখপাখিটাকে এমন আনন্দে আত্মহারা হতে দেখে সাদিদের মনের খচখচানিটা এবার ক্রমশ মিলিয়ে যেতে লাগলো। সে নিজেও যে চায় সবসময় তার ছোট্ট পাখিটার মুখে এই হাসি-আনন্দটুকু লেগে থাকুক। সেই অনুযায়ী চেষ্টাও থাকে সর্বোচ্চ। কিন্তু মাঝেমধ্যে তার কলিজাটা এমন সব আবদার করে বসে যে সাদিদের তাতে বড্ড ভয় হয়। এককথায় তার এখনও প্রচন্ড ভয় হচ্ছে। যদি সকালের এই ঠান্ডা বাতাশে মেয়েটার শরীর খারাপ করে? তখন? তখন সাদিদ কিভাবে তাকে সামলাবে? আর.. আর কিভাবে নিজেকেই বা সামলাবে?

— ‘ এই যে শুনছেন? আরে এই মশায় শুনুন না। ‘
— ‘ হ্যাঁ.. হ্যাঁ জান। কি হয়েছে? ‘
— ‘ বারবার কোথায় হারিয়ে যান বলুন তো? ‘
— ‘ আমার আর জায়গা কোথায় পাখি? সব জায়গাতে তো নিজের নামের সিল লাগিয়ে বসে রয়েছো। ‘

নীলা ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই সাদিদ মৃদ হাসলো। নীলার নাকটা হালকা করে টেনে দিয়ে তাকে বুকের সাথে আগলে নিয়ে আবারও বলে উঠল,

— ‘ দিনদিন বড্ড আদুরে হয়ে যাচ্ছো পাখি। বারবার শুধু আদর করতে ইচ্ছে করে। কি করবো বলো তো? ‘
— ‘ ধেৎ। ‘

নীলা লাজুক হেসে মাথা নিচু করে সাদিদ থেকে খানিকটা দূরে সরে আসলো। আড়চোখে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো তাদেরকে কেউ দেখেছে কি-না। কিন্তু না। এতো সকালে এদিকটা বেশ জনমানবশূন্য। তাই নীলা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর সাদিদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছুটা ক্ষেপাস্বরে বলল,

— ‘ এমন হুটহাট চিপকে যান কেন? কেউ দেখলে কি ভাববে? ‘
— ‘ কি আর ভাববে? ভাববে এই সুদর্শন ছেলেটা তার মিষ্টি বউটাকে বড্ড আদর করে। আদর করে করে একেবারে তুলতুলে করে ফেলে..
— ‘ চুপ চুপ। আল্লাহরওয়াস্তে আপনার বিখ্যাত মুখটাকে কিছুসময়ের জন্য অফ রাখুন৷ ‘
— ‘ বারে! তুমিই তো জানতে চাইলে। আমার এখানে কি দোষ? ‘
— ‘ আমার ভুল হইছে ভাই। মাফ করেন আমাকে। ‘

সাদিদের মুখের দুষ্টু হাসিটা নিমিষেই মিলিয়ে গিয়ে এবার চোয়াল শক্ত হলো। তার এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে সামনে দাঁড়ানো এই নাদুসনুদুস মেয়েটার নরম গালদুটো এখন মেরে লাল বানিয়ে দিতে। অপরদিকে নীলা নির্বাক। ভুল করে যে কি একটা মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে সেদিকে তার বিন্দু মাত্র ভ্রক্ষেপ নেই। সাদিদ রক্তিম চোখজোড়া বন্ধ করে নিজের রাগটা দমন করতে চাইলো৷ কিন্তু না পারা যাচ্ছে না। তাই আঁখিদ্বয় বন্ধ রেখেই সে থমথমে গলায় বলে উঠল,

— ‘ আমি তোমার ভাই লাগি? ‘

ইশশ যা। নীলার আত্মা এবার শুকিয়ে কাঠ। কি বলতে কি বলেছে এতক্ষণে তার খেয়াল আসছে৷ সাদিদের থমথমে গম্ভীর কন্ঠ শুনে তার আর এখানে থাকার বিন্দুমাত্র সাহসে কুলাচ্ছে না। তাই ধীরপায়ে সাদিদের দৃষ্টির বাহিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সাদিদ তার ডানহাতটা খপ করে ধরে ফেললো। নীলার প্রাণপাখি এবার ফুড়ুৎ হবার আশংকায়। সে বারকয়েক শুকনো ঢুক গিলে মিনমিনিয়ে বলতে চাইল,

— ‘ আ.. আসলে
— ‘ ইচ্ছেতো করছে গালদুটোতে সজোরে কয়েকটা থাপ্পড় বসাতে। কিন্তু আ’ম হেল্পলেস। তোমাকে মারা আমার পক্ষে সম্ভব নই। কিন্তু তোমার কৃতকর্মে রাগটা কিছুতেই নিবারণযোগ্য নয়। তাহলে এখন কি করে রাগ কমাবো? ‘
— ‘ রা..গ না..
— ‘ এ্যান্সার মি ড্যাম। ‘

নির্জন কোলাহলমুক্ত রাস্তায় সাদিদের থমথমে গলায় ধমকির শব্দটা বেশ প্রখরভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।
নীলার চোখজোড়াতে মুহূর্তেই অশ্রু কণারা এসে আন্দোলন শুরু করেছে। সে নিজের দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল। কান্না আটকানোর সর্বোচ্চ প্রয়াস। অভিমানে সিক্ত হয়ে মুখফুটে বলতে পারছে না যে সে এটা ভুল করে বলেছে৷ সাদিদ আবারও ফোঁস করে শ্বাস টনলো। নীলার অশ্রুসিক্ত মুখশ্রীটাতে নজর পড়তেই তার বুকের বামপাশে চিনচিন ব্যাথা শুরু হতে লাগলো। ইশশ কি ভয়ানক তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা!
সে এগিয়ে গেল৷ নিজেদের মধ্যকার সবটুকু দুরত্ব মিটিয়ে নীলাকে খুব সাবধানে পাঁজাকোলে তুলে নিলো। নীলা এবার অভিমান ভুলে হকচকিয়ে উঠলো। তার শরীরটা এখন আগের তুলনায় অনেকটাই ভারি। তাছাড়া এই অবস্থায় তাকে সাদিদ কোলেই বা কেন নিলো? তাও আবার এই মাঝরাস্তায়?
সে নিজের মধ্যে প্রশ্ন চেপে না রাখতে পেরে বলেই ফেলল,

— ‘ কোলে নিয়েছেন কেন? ‘
— ‘ সরি কলিজা। ‘

নীলার চোখজোড়া আবারও নোনাজলে ম্লান হলো। সাদিদ তাকে এতো ভালোবাসে অথচ তার থেকে একটু ধমকও তার সহ্য হয় না। বোধহয় বেশি ভালোবাসা পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে বলে এখন সামান্য একটু মান-অভিমানের দুরত্বও সহ্য হয় না। সাদিদ হাঁটা অবস্থাতেই ঝুঁকে এসে নীলার মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ালো। নীলা সাদিদের গলা জড়িয়ে ধরে একদৃষ্টিতে সাদিদের মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। এমন এমন কাজ করলে রাগ বা অভিমান কি ধরে রাখা যায়? ইশশ একদমই যায় না।
অদূরেই তারা যেই পার্কটার উদ্দেশ্য বের হয়েছে তার সীমানা প্রাচীর দেখা যাচ্ছে। তাই সাদিদ একেবারে নীলাকে পার্কের বেঞ্চে নিয়ে বসালো। এই শীতের সকালেও সাদিদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের মুক্তোর ন্যায় কণা দেখা যাচ্ছে। নীলা নিজের গলার স্কার্ফটা দিয়ে সাদিদের কপালটা আলতো করে মুছিয়ে দিতে লাগলো। সাদিদ তাতে মিষ্টি করে হাসলো। পাখিটাকে নিজের সাথে আগলে নিয়ে সামনে নজর দিলো। পার্কের অপর গেইট দিয়ে অনেকের সমাগম চোখে পড়ছে৷ ধীরে ধীরে হয়তো এখনকার এই নীরবতাটুকু সবটাই কোলাহলে পরিপূর্ণ হবে৷ তার আগেই সাদিদ চায়ছে নীলাকে বাসায় নিয়ে চলে যেতে৷ তাই সাদিদ এবার মিহিস্বরে ডাকলো,

— ‘ পাখি। ‘
— ‘ হুম? ‘
— ‘ চলো বাসায় চলে যাই। ‘
— ‘ না, না। মাত্রই এসেছি৷ আরও থাকবো। ‘
— ‘ দেখো কতো লোক এসে জড়ো হচ্ছে। একটুপরেই এখানে মানুষজন গিজগিজ শুরু করবে। তোমার কষ্ট হবে তো জান। তাই আসো চলে যাই। ‘
— ‘ আমার কিছু হবে না। একটু থাকি। আপনিতো নিয়ে আসতেই চান না। তাই আজকে যেহেতু এসেছি এতো তাড়াতাড়ি যাব না। ‘

সাদিদ মাথা নিচু করে নীলার দিকে তাকালো। নীলা অনবরত হালকা গোলাপি কোমল ঠোঁটযুগল নাড়িয়ে চলছে। তার অন্যদিকে খেয়াল নেই। সে এখন একধ্যানে সামনে তাকিয়ে সাদিদের নামের অভিযোগের ঝুড়ি খুলে বসেছে। সাদিদ নিজের ঠোঁট কামড়ে হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করলো। কিন্তু নীলাকে বাধা দিয়ে আর টু শব্দটি করলো না। সাদিদ তাকে কিভাবে বুঝাবে তার মনে কি ঝড় চলে? উপর দিয়ে নিজেকে শক্ত বানিয়ে রাখলেও ভিতর দিয়ে যে সে একেবারে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আর দিনকে দিন যেন সেটার মাত্রা আরো তীব্র হচ্ছে। শ্বাসটা যেন সবসময় গলায় এসে আটকে থাকে। না পারে স্বস্তিতে নিতে আর না পারে উগলে ফেলতে। সাদিদ আচমকা নীলাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। বাহুবন্ধনী জোরালো হতেই নীলা মৃদু ব্যাথা অনুভব করলো। আজকাল শরীরটা কেমন যেন নাজুক হয়ে যাচ্ছে। অল্প একটু জোর প্রয়োগেই শরীরটা কেমন যেন ভেঙে আসতে চায়। আর সাদিদ সেটা নীলার থেকেও বেশি বুঝতে পারে৷ কিন্তু হঠাৎ তার কি হলো? এমন করছেই বা কেন?
সাদিদকে না ছাড়তে দেখে নীলা জোরে জোরে শ্বাস টানতে থাকলো। নরম শরীরে বেশ ব্যাথা লাগছে৷ তাই নিচুস্বরে বলল,

— ‘ আমি ব্যাথা পাচ্ছি। ‘

সাদিদের এবার হুঁশ ফিরলো। নিজের কৃতকর্মের জন্য সে ভীষণ লজ্জিত। তার পাখিটা ব্যাথা পেয়েছে অথচ সে কি-না খেয়াল রাখতে পারেনি!
সাদিদ আপনমনে নিজেকেই শাসালো। অতঃপর নীলার গালে আলতো করে আঙুল চালিয়ে বলল,

— ‘ বাসায় গিয়ে ঔষধ দিয়ে দিবো। ‘
— ‘ আরে না, না ঔষধ লাগবে না। হালকা একটু…
— ‘ হালকা না ভারি সেটা জানতে চাই না। আমার পাখি ব্যাথা পেয়েছে তাহলে অবশ্যই ব্যাথানাশক দিতে হবে। উষ্ণ উষ্ণ স্পর্শকাতর আদর দিলে ব্যাথা যাবে না জান? নাকি আদরের গভীরতা বৃদ্ধি করতে হবে? ‘

সাদিদের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসিরা ঝিলিক দিচ্ছে। নীলা সেদিকে সরু চোখে তাকিয়ে রয়েছে। সাদিদ ঠোঁট এলিয়ে হাসতেই নীলা এবার লজ্জা পেয়ে অপরদিকে মুখ ফিরালো। সম্পর্কের নাম বৃদ্ধির সাথে সাথে যেন এই ছেলের অসভ্যতার মাত্রাও চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েই চলছে।

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৫৪ ❤

প্রিয়তমার মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পরতেই সাদিদ তাকে সযত্নে টেনে বুকে আনলো। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ প্রাখিটা এখনও এতো লজ্জা পায় কিভাবে? ‘

সাদিদের কথায় নীলার লজ্জা কমলো না উল্টো যেন বৃদ্ধি পেল। সে নিচুস্বরে বিড়বিড় করলো,

— ‘ আর আপনিও দিনদিন এতো অসভ্য হচ্ছেন কিভাবে? ‘

সাদিদ তার নিচুস্বরের কথাটা শুনে ফেলল। আর তাতেই সে হাসতে শুরু করলো। সাদিদের মৃদু আওয়াজের হাসির শব্দে নীলা এবার ঘাড় উঁচু করে তাকালো। দুইজনের দৃষ্টি মিলিত হতেই সাদিদ তার গালটা আস্তে করে টেনে ধরলো,

— ‘ বউটা এতো কিউট কেন? ইচ্ছে করে একেবারে খেয়ে ফেলি। ‘

নীলার মুখে লাজুক হাসি ফুটে উঠলো। আর সাদিদ বরাবরের মতোই মুগ্ধ দৃষ্টিতে অবলোকন করলো প্রাণপাখির স্নিগ্ধ সুন্দর রক্তিম মুখশ্রী। অদূরে একজন মধ্যবয়সী লোককে ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে আসতে দেখেই নীলা একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠল,

— ‘ আমি চা খাবো। ‘

সাদিদ তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাতেই বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে নিলো।
লাইক সিরিয়াসলি! তার পাগলীটা এখন এই রাস্তা ঘাটের চা খাবে?
সাদিদ বেশ কড়া গলায় শাসিয়ে উঠল,

— ‘ একদম না। এই পথে-ঘাটের চা কোনোভাবেই খাওয়া যাবে না। চা খেতে ইচ্ছে হলে বাড়িতে গিয়ে খাবে। ‘
— ‘ সবসময় এমন করেন কেন? এটাতে খারাপ কি? ‘
— ‘ পাখি, নো মোর আরগুমেন্স। এসব খেয়ে শরীর খারাপ করবে। আর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে পরবর্তীতে কেঁদে কেটে ভাসাবে। আমি এসব কোনোভাবেই টলারেট করবো না। ‘
— ‘ ইশশ আসছে আমার মুঘল সাম্রাজ্যের লোক। সময়ের পরিবর্তন ঘটেছে। এখন আর আপনাদের শাসনগিরি চলবে না। ‘

নীলা সাদিদকে একটা ভেংচি কেটে সামনে এগিয়ে চললো। সাদিদ নিজেও ততক্ষণে তার পিছু নিয়েছে। মেয়েটা আজকাল বড্ড অবাধ্য হয়ে গিয়েছে। সাদিদ দ্রুত পা ফেলে নীলার হাতটা পিছন থেকে খপ করে ধরলো।

— ‘ তোমার সাহসতো কম না। আমার কথা না শুনে এভাবে কোথায় যাচ্ছো? ‘
— ‘ আপনাকে বলে আসলে কি যেতে দিতেন? ‘
— ‘ অবশ্যই দিতাম না। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে তুমি আমার কথা শুনতে চাও না কেন? ভালো কিছু বললে কি আমি না করি? ‘

নীলা এবার মুখটা একেবারে ছোট করে নিলো। সাদিদ সেদিকে তাকিয়ে একটা হতাশাজনক শ্বাস টানলো। না সম্ভব না। এই মেয়েকে নিয়ে কোনোভাবেই সম্ভব না।

— ‘ আমার না। বাবুর এইমুহূর্তে ঐ চাচার থেকে চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাই না? ‘

বলেই নীলা জামার উপর দিয়ে আলতো করে পেটে হাত বুলালো। সাদিদ একপলক সেদিকে তাকিয়ে চোখজোড়া ছোট ছোট করে ফেললো। সাথে কপালটা হালকা কুঁচকে এসেছে।
মানে আজকাল মায়ের গর্ভের ছোট্ট প্রাণগুলো চায়ের স্বাদও বুঝে গিয়েছে? যুগ ফাস্ট বলে এতোটাই ফাস্ট হয়ে গিয়েছে? বড় চিন্তা বিষয় তো!
সাদিদকে এমন করে তাকাতে দেখে নীলা তৎক্ষনাৎ শুকনো একটা ঢুক গিলে কাচুমাচু করে বলল,

— ‘ না মানে.. ঐ আরকি আমাদের দুইজনেরই খেতে ইচ্ছে করছে। দিন না খেতে। ‘

নীলার মিহিস্বরের আবদারে সাদিদ আর না করতে পারলো না। ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকলো। তা দেখে নীলার ঠোঁটের কোণেও এখন হাসির আভাস প্রকাশ পেল। অর্থাৎ অবশেষে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে বিজয়ের বার্তা।
সাদিদ নীলাকে আর এগিয়ে যেতে না দিয়ে চায়ের মালিককে এদিকে আসতে ডাক দিলো। নীলা খুশিতে দুইহাতের তালু ক্রমাগত ঘষে মুখদিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ করছে। সাদিদ হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারছে না। কে বলে এই মেয়েটার গর্ভে ছয় মাসের একটি শিশু সন্তান বেড়ে উঠছে? সাদিদের নিজেরই তো বিশ্বাস হতে চায় না। আল্লাহই ভালো জানেন সাদিদ এই পিচ্চিকে নিয়ে ভবিষ্যতের পিচ্চিকে কিভাবে সামলাবে!

— ‘ চাচা ওয়ানটাইম কাপ আছে না? ‘
— ‘ জ্বি বাজান আছে। ‘
— ‘ তাহলে কষ্ট করে সেগুলোতে দিন। এইকাপে দিবেন না৷ ‘
— ‘ আচ্ছা। ‘

চাওয়ালা সাদিদের কথামতো ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের কাপে রং চা প্রস্তুত করতে থাকলো। মূলত সাদিদ বাহিরের এসব জিনিসে ঘৃণা বা নাক কুঁচকায় না। সে নিজেও বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজিতে বহুবার এসব টুকিটাকি জিনিস খেয়েছে। কিন্তু তার সমস্ত চিন্তা হচ্ছে নীলাকে নিয়ে৷ বাহিরের এসব জিনিস মজাদার হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যকর নয়। আর নীলাকে নিয়ে সে ওয়ান পারসেন্টও রিক্স নিতে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু এই পাগলী মেয়েটাকি সাদিদের এই অস্থিরতাটা বুঝে?
চাওয়ালা কাপ এগিয়ে দিতেই নীলা খুশিমনে সেটা হাতে নিলো। আনন্দে ঠোঁটের কাছে নিতেই হঠাৎ সে থেমে গেল। পাশে দাঁড়ানো সাদিদের দিকে কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

— ‘ আপনি আগে খান। ‘

ভালোবাসা প্রকাশে সবসময় বড় কিছুর প্রয়োজন হয় না। এই যে নীলার এই ছোট্ট কেয়ার বা মায়া হোক সাদিদ এটাতেই চরম খুশি। তার চোখে-মুখে চরম খুশির রেশ। সে হাসিমুখেই কাপটা নীলার মুখে ধরে বলল,

— ‘ আমি খাব না। তুমিই খাও। ‘
— ‘ রাগ করে খাবেন না? ‘
— ‘ ধুর বোকা মেয়ে! রাগ করলে কি আর তোমাকে চা খেতে দিতাম? আমি এমনিতেই খাব না। তুমি খাও। ‘

নীলা কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সাদিদের ভাবভঙ্গি খেয়াল করলো৷ পুরোপুরি নিশ্চিত হতেই সে চায়ের কাপে চুমুক বসালো।
নরমালি নীলা রং চা খেতে নাক কুঁচকায়। জোর করেও সাদিদ তাকে এই অখাদ্য খাওয়াতে পারে না। কিন্তু আজ কি-না এই মেয়ে যেচে গিয়ে রং চা খাচ্ছে? আসলে মেয়েদের প্রেগন্যান্সির এই মুহূর্তটাতে তারা নানারকম অদ্ভুত কাজকর্ম করে থাকে। সেটা হোক হরমোন জনিত কারণ বা অন্যকিছু। পূর্বে কখনও এমন কিছু না করলেও হুট করে এই মুহূর্তটাতে তারা নানারকম আশ্চর্যজনক কাজ করে। যেমনটা নীলার ক্ষেত্রে হচ্ছে। আগে যেটা দেখলে দশ হাত দুরত্ব বজায় রাখতো এখন সেটাই কিভাবে খুশিমনে টেনে টেনে খাচ্ছে!
নীলা আবারও আদা চায়ে কাঁচা লেবুর ঘ্রাণটা টেনে নিজের উৎফুল্লতা প্রকাশ করলো। হাসিমুখে আবারও সাদিদের উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ একটু খান। খুব মজা হয়েছে। চাচা খুব ভালো চা বানায়। ‘

সাদিদ এবার আর না করলো না। নীলার হাতটা টেনে তার হাত ধরেই কাপে চুমুক দিলো। দুইজনের চা খাওয়া শেষ হতেই সাদিদ বিল মিটিয়ে নীলাকে নিয়ে পার্ক থেকে বেড়িয়ে আসলো।
নীলার কপালে-মুখে ততক্ষণে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা দেখা যাচ্ছে। আজকাল মেয়েটা অল্পতেই হাঁপিয়ে যায়। কিন্তু বলার সময় এমন একটা ভাব করবে যেন তার কাছে এসব ওয়ান-টুর ব্যাপার। নীলার পায়ের গতিও ততক্ষণে কমে এসেছে। সাদিদ সেটা বুঝতে পেরে আলগোছে নীলার কাঁধে হাত রাখল। নীলার এতক্ষণ এনার্জি লেবেল হাই থাকলেও এবার জিরোতে এসে থেমেছে। সাদিদ আদুরে স্বরে বলে উঠল,

— ‘ আমার পাখিটার কষ্ট হচ্ছে? ‘
— ‘ না। ‘

নীলার দুর্বল কন্ঠে মিথ্যা কথা শুনে সাদিদ চোখ রাঙালো। মুহূর্তেই নীলা ধরা পরে গিয়েছে বলে মাথা নিচু করলো। আর মিনমিনিয়ে বলল,

— ‘ একটু হচ্ছে, বেশি না। আপনি আবার এই জন্য ধমকা ধমকি শুরু করবেন না কিন্তু। ‘
— ‘ কেন করবো না? অবশ্যই করা উচিত। আমার একটা কথা আজকাল তুমি শুনো? দেখেছো, এখন এতোটা দূর এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছো? ‘

নীলা আর উত্তর দিলো না৷ শরীরটা সত্যিই ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। সে উঁচু পেটটা ধরে ধীরে ধীরে রাস্তার পাশে ফুটপাতেই বসে পড়লো। সাদিদ মুহূর্তেই সবকিছু ভুলে গিয়ে নীলাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

— ‘ লক্ষ্মি পাখি আমার খুব কষ্ট হচ্ছে? ডক্টরের কাছে যাবো? ‘
— ‘ না। ‘

নীলা দুর্বল গলায় মাথা নাড়িয়ে না করতে থাকলো। নীলার দুর্বলতাটার সাথে সাথে সাদিদের নিজের ভিতরকার অস্থিরতাটা ক্রমশ পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো। সে নিজেও নীলার পাশে বসে তার মাথাটা বুকে চেপে ধরলো। একহাতে আলতো করে জড়িয়ে নিয়ে ক্রমাগত মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। নীলার হাস ফাঁস লাগছে বিধায় সাদিদ নিজেই তার গলার স্কার্ফটা খুলে দিলো৷ জ্যাকেটের উপরের দুটো বোতাম খুলে দিয়ে ক্রমাগত মুখের সাহায্য ফুঁ দিয়ে নীলার চোখে-মুখে বাতাশ করতে লাগলো।

— ‘ পাখি, এই পাখি এখনও খারাপ লাগছে? ‘

নীলা কোনো উত্তর দিতে পারলো না। শুধু সাদিদের বুকে মুখ গোঁজে ঘন ঘন শ্বাস টানতে লাগলো। নীলার নীরবতাটুকু যেন সাদিদকে এই মুহূর্তে পাগল করে তুলছে। তাই সে আবারও অস্থির কন্ঠে বলতে লাগলো,

— ‘ একটু ছাড়ো তো জান। আমরা এখনই হসপিটাল যাবো। সব ঠিক হয়ে যাবে৷ একদম ভয় পাবে না৷ ‘

নীলা এবার মৃদু স্বরে হেসে ফেললো। সে চোখ তুলে সাদিদের রক্তিম মুখটার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। নীলাকে বলছে ভয় না পেতে। অথচ সাদিদকে এই মুহূর্তে কেউ দেখলে নিরদ্বিধায় বলে দিতে পারবে এই ছেলে নিজেই এখন ভয়ে জড়সড়।
নীলাকে হাসতে দেখে সাদিদের কপাল কুঁচকে এলো৷ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে জানতে চাইলো,

— ‘ হাসো কেন? ‘
— ‘ আপনি এতো ভালোবাসেন কেন? ‘
— ‘ এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়। ‘
— ‘ তাহলে এটা আমারও প্রশ্নের উত্তর নয়। ‘

কথাটুকু শেষ করে একেঅপরের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে দুইজনেই এবার ফিক করে হেসে দিলো। সাদিদ নীলার মাথাটা আবারও বুকে চেপে ধরে আলতো করে চুলে আঙুল চালিয়ে বলল,

— ‘ শরীরটা ভালো লাগছে এখন? ‘
— ‘ হুম। একেবারে ঠিকঠাক। ‘

সাদিদ জোরপূর্বক হাসলো। মেয়েটার একটু কষ্টও সাদিদের সহ্য হয় না। আর প্রেগন্যান্সির এই সময়টাতে মেয়েটা কতটাই না কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছে। ইশশ মায়েদের এই কষ্টটুকু কমানোর যদি কোনোরকম উপায় থাকতো। যদি পুরুষ তার শক্তির বলে অল্প একটু হলেও এই কষ্টের ভাগিদার হতে পারতো। সাদিদের বড্ড জানতে ইচ্ছে করে৷ তাহলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত?

___________________

বাড়ির পার্কিং এড়িয়াতে ডাইভার গাড়িটা পার্ক করতেই শায়লা রহমানসহ নিধি আর বাকিরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো। শায়লা রহমান নীলার শরীরে আদুরেভাবে হাত বুলিয়ে অস্থিরতা মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ মা আমার, খুব বেশি খারাপ লাগছে? সাদি তুই এমন বোকার মতো কাজ কিভাবে করিস? হসপিটালে না নিয়ে বাড়িতে কেন নিয়ে এলি? ‘
— ‘ ইশশ মা আমি পুরোপুরি ঠিক আছি। আপনার ছেলেকে আমিই বলেছি বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য। ঐসব হসপিটালে গেলে আমার আরও বেশি শরীর খারাপ লাগে। ‘
— ‘ তুই বললেই ওকে শুনতে হবে? এমন ভাবসাব যেন তোর সব কথা সে শুনে! ‘

শায়লা রহমানের কথায় তীব্র রাগ। নীলা তাকে সযত্নে আগলে ধরে শান্ত করতে চাইলো,

— ‘ মা, বললাম তো আমি ঠিক আছি৷ তাই এখন চিন্তা ছাড়ুন। শুধুশুধু আমাকে নিয়ে আপনাদের এতো টেনশন আমার একটুও ভালো লাগে না৷ ‘
— ‘ ঠাটিয়ে দিবো এক থাপ্পড়। খুব বেশি বড় হয়ে গিয়েছো তাই না? তোমাদের নিয়ে টেনশন না করলে কি এলাকার বাকি ছেলেপুলেদের নিয়ে করবো? ‘
— ‘ আচ্ছা আমার ভুল হয়েছে। ইচ্ছে মতো বেশি বেশি টেনশন করবেন৷ এবার খুশি? ‘

নীলার দুষ্টুমিস্বরের কথা শুনে শায়লা রহমান তার কানের লতিটা আলতো করে টেনে দিলো৷ নীলা খিলখিল করে হেসে উঠল। কিন্তু নিধি এসে সত্যি সত্যিই মারলো এক থাপ্পড়। নীলা পিঠে হাত বুলাতে বুলাতেই চোখ ছোট ছোট করে নিধির দিকে তাকালো,

— ‘ এভাবে তাকাস কেন? তাকালেও কোনো লাভ হবে না৷ জানিস মাসুদ যখন গাড়ি নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বের হচ্ছিলো আমাদের তখন কি অবস্থা হয়েছিল? সাদিদততো কিছুই বলেনি৷ যখন শুনলাম মাসুদকে সে তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে যেতে বলেছে কারণ তোর নাকি শরীরটা হঠাৎ করে খারাপ করেছে। তখন বুঝতে পারিস আমাদের উপর দিয়ে কি গিয়েছে? এমন পাগলামি কেন করিস পিচ্চু? এতো সকালে হাঁটতে না গেলে কি হতো? ‘
— ‘ সরি আপুনি৷ খুব ইচ্ছে হয়েছিল। তাই..
— ‘ আচ্ছা হয়েছে তোর আর বলতে হবে না। যতসব দুষ্টুর আখড়া। চোখ-মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে৷ সাদিদ ওকে নিয়ে রুমে যাও তো। আমি হালকা কিছু খাবার নিয়ে আসছি। ‘

সাদিদ এতক্ষণ নীরব ছিলো৷ পাশে দাঁড়িয়ে মা-ভাবীর শাসনের আড়ালে যত্নটুকু মন দিয়ে দেখেছে। এখন নিধির কথায় সে নীলাকে নিয়ে রুমের দিকে গেল। রুমে এসেই নীলা বাহিরের জামাকাপড় নিয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। সাদিদ বুকে হাত বেঁধে বিছানায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে থাকা নীলার দিকে তাকালো। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও রুমে সাদিদের নড়নচড়ন অনুভব না করে নীলা ধীরে ধীরে চোখজোড়া খুললো। সাদিদকে তার সামনে এভাবে বুকে হাত ভাজ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে জোরপূর্বক হাসলো৷ কিন্তু তাতেও সাদিদের মধ্যে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। তাই নীলা জোর পূর্বক হাসতে হাসতেই বলল,

— ‘ একটু শুয়েছিলাম আরকি৷ এখনই উঠে যাব। আমি একেবারে ঠিক আছি কিন্তু। ‘
— ‘ কতটুকু ঠিক আছো সেটা আমি বেশ ভালোভাবেই দেখতে পারছি৷ আমার একটা কথাতো তুমি শুনতে চাও না। এখন কষ্টটা কে পাচ্ছে? ‘
— ‘ আরে কষ্ট কিসের? ‘
— ‘ চুপ। একটা কথা নয়। কতো করে বললাম এই অবস্থায় এতো সকালে হাঁটতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই৷ শুনলে না আমার কথাটা। ‘

সাদিদের গম্ভীর থমথমে কন্ঠ শুনে নীলা আর প্রতিউত্তর দেওয়ার সাহস পেল না৷ সাদিদ গম্ভীর মুখেই বিছানার দিকে এগিয়ে আসলো৷ নীলার সাথে কোনোরকম কথা না বলেই গায়ে পরিহিত শীতের জামাটা খুলে দিলো৷ ওয়াশরুমে গিয়ে একটা টাওয়েল হালকা ভিজিয়ে এনে নীলার গলায়-কপালের ঘাম সযত্নে মুছিয়ে দিলো। অতঃপর এসির পাওয়ারটা একটু কমিয়ে দিয়ে নীলার শরীরে ভালোভাবে কম্বলটা দিয়ে দিলো। এই পুরো সময়টা সাদিদ একেবারে নির্বাক ছিলো। নীলারও সাহসে কুলিয়ে উঠেনি তার সাথে কথা বলে যেচে গিয়ে ধমক খাওয়ার। কেননা তার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে একপ্রকার অতিষ্ঠ হয়ে সাদিদ গতকাল রাতে বাহিরে হাঁটতে যেতে রাজি হয়েছিল। নতুবা ডক্টরের ঐ কথার পর নীলা একপা বাড়ির বাহিরে রাখবে এটা শুনলে সাদিদ বাড়িঘর উল্টিয়ে ফেলবে৷ কিন্তু সেই সাদিদই গতকাল প্রাণপাখির কান্নামাখা মুখটা দেখে রাজি হয়েছিল। আর নীলা হাজারবার বলুক সকালে এতটাপথ হাঁটতে গিয়ে তার শরীর খারাপ করেনি। কিন্তু সে নিজেতো জানে তার আচমকা এইজন্যই এতটা খারাপ লাগছিলো৷ তার সাথে সাদিদও এই কথাটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। কিন্তু রাগ বা অভিমানের বশে হোক এটা নিয়ে নীলাকে আপাতত ধমক দিচ্ছে না। সাদিদ বিছানা ছেড়ে উঠে চলে যেতে নিলেই নীলা দুর্বল হাতে তার কব্জি চেপে ধরলো। তার হাতের কম্পনই বলে দিচ্ছে সাদিদকে এই মুহূর্তে সে বড্ড ভয় পাচ্ছে। সাদিদ চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস টানলো৷ না এই মেয়েটা তাকে পুরোপুরি ডুবিয়ে ছেড়েছে। ধমকটা পর্যন্ত দেওয়ার সুযোগ দেয় না। এমন করলে হবে?
সাদিদ নিঃশব্দে নীলার শরীরে জড়ানো কম্বলের নিচে আসলো। পেটটা উঁচু হওয়ার দরুন নীলা আর এখন বুকে আসতে পারে না। আসলেও যে তার কষ্ট হয় সেটা ভেবেই সাদিদ তাকে বুকে টানে না। তাই সে কাত হয়ে নীলার মাথাটা তার বাহুর উপর রাখলো। বুকে না জড়িয়েই আষ্টেপৃষ্ঠে নিজের শরীরের সাথে প্রিয়তমার ছোট্ট শরীরটা মিশিয়ে নিলো। দুইজনেই নির্বাক। যেন নীরবতাতেই প্রবল ভালোবাসা আর হাজারো অভিমানের লেনা-দেনা চলছে। নীলার চোখজোড়া ম্লান হচ্ছে। আজকাল শরীরটা খারাপ হলেই তার নিজের মনেও ভয় জাগে। এই বুঝি ভালোবাসার মানুষটা থেকে ছিন্ন হয়ে যাবে। এই বুঝি নিজের কলিজার টুকরোটাকে একপলক দর্শন করার আগেই অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে। এমন হাজারো আজেবাজে চিন্তারা এসে মাথায় ক্রমাগত ভিড় জমাতে চায়। কিন্তু নীলার মন কষ্টে জর্জরিত হলেও সাদিদের নিকট সেটা প্রকাশ করে না। নতুবা এই ছেলেটা যে শেষ হয়ে যাবে। একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে।
নিজের বাহুতে ঠান্ডা পানির অস্তিত্বে অনুভব হতেই সাদিদ খানিকটা নিচু হলো। নীলার থুতনিতে হাতটা রেখে মুখটা উঁচু করতেই নীলার অশ্রুসিক্ত আঁখিপল্লবগুলো নজরে আসলো।

— ‘ এতক্ষণ মাইর থেকে বঞ্চিত থাকলেও এখন কিন্তু সুদে-আসলে পইপই করে হিসেব তুলে মাইর দিবো। ‘
— ‘ ভালোবাসি। ‘

সাদিদ চোখ বাঁকিয়ে তাকালো। নীলা ভাবলেশহীন। সাদিদ কয়েক মুহূর্ত স্থির থেকে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে তুললো। নীলার কপালের মাঝ বরাবর সশব্দে উষ্ণ চুম্বন করলো। অতঃপর আবারও বুকে জড়িয়ে জড়ানো গলায় বলে উঠল,

— ‘ পাখিটাকি জানে? সে যে ভীষণ পাঁজি? অন্যায় করে অথচ রাগ দেখানোর সুযোগ দেয় না। এসব বললে রাগ দেখানো যায়? ‘
— ‘ সবসময় রাগ দেখাতে হয় না। ‘
— ‘ তাহলে কি করতে হয়? ‘
— ‘ খুব খুব ভালোবাসতে হয়। ‘
— ‘ ভালোবাসা কি কম হচ্ছে ? এই যে এখানে যিনি এসেছেন তিনি কি এমনি এমনি হাওয়া খেয়ে এসেছে? ‘

নীলা পেটের উপর রাখা সাদিদের হাতের উপরে নিজের হাতটা সন্তপর্ণে রাখলো। অতঃপর দৃষ্টি মিলিত করে কথাটার অর্থ বুঝার চেষ্টায় রইলো। নীলাকে এমনকরে প্রশ্নোউত্তর দৃষ্টি তাকিয়ে থাকতে দেখে সাদিদ দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। অতঃপর ঝুঁকে এসে নীলার কানের লতিতে ঠোঁট স্পর্শ করে নেশাজড়ানো কন্ঠে আওড়ালো,

— ‘ প্রবল ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তোমার গর্ভে এই ছোট্ট প্রাণটি বেড়ে উঠছে। তাহলে ভালোবাসা কম কিভাবে হলো? উল্টো বলতে হবে সময়ে-অসময়ে অতিরিক্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। ‘

ইশশ কি ঠোঁটকাটা এই ছেলে! নীলার তুলতুলে গালগুলো লজ্জায় লালাভ রূপে পরিপূর্ণ হয়েছে। যেন একটু টুকা দিলেই গাল ভেদ করে তাজা রক্ত ফিনকি দিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইবে৷ অপরদিকে সাদিদ পুরোপুরি স্বাভাবিক। বরং নিজের অধরযুগলের নিয়ন্ত্রণহীন উষ্ণ পরশে নীলাকেই ক্রমশ অস্বাভাবিক করে তুলছে।

#চলবে…