অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-৫৫+৫৬

0
770

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৫৫ ❤

নীলার মুখের সামনে চলে আসা এলোমেলো চুলগুলোকে সাদিদ আলতো হাতে কানের পিছনে গুঁজে দিলো। আঙুলের উল্টোপাশ দিয়ে প্রিয়তমার গালে লম্বালম্বি দাগ কাটতেই নীলা মৃদুভাবে কেঁপে উঠল। সাদিদ সেটা দেখে নিঃশব্দে হাসলো। অতঃপর খুবই নমনীয়তায় প্রিয়তমার কপালে ভালোবাসার উষ্ণ চিহ্ন একে দিলো।
নীলা নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখলো সেই ঘোর লাগা আঁখিযুগল। বরাবরই শুনে এসেছে বিয়ের পূর্বে প্রেমিক মনে ভালোবাসার ছড়াছড়ি থাকলেও বিয়ের পরে এসব কেবল নিছক কল্পনা। সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসাগুলোও লবন ছাড়া তরকারির ন্যায় পানসে হতে থাকে। কিন্তু সাদিদ! নীলা কেন তার মধ্যে পানসে মনোভাব দেখে না? বরং মনে হয় দিনকে দিন ছেলেটার ভালোবাসা যেন তার প্রতি উপচে পড়ছে।

— ‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? ‘
— ‘ অনুমতি নেওয়ার কি আছে? আমিই তো। ‘

নীলা তার কথায় মুচকি হাসলো। অতঃপর বলে উঠল,

— ‘ আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা এখনও এতো তীব্র কেন? এমনটাতো হওয়ার কথা নয়। ‘
— ‘ মানে? ‘
— ‘ আপনাকে কি আমার রোগে ধরেছে? ‘
— ‘ এটা কেমন কথা? ‘
— ‘ তাহলে মানে মানে করছেন কেন? ‘

সাদিদ এবার চট করে নীলার কথার অর্থটা বুঝে ফেললো। তাই সে নিচু আওয়াজে হেসে উঠল।

— ‘ বললেন না যে। ‘
— ‘ বলবো কিভাবে ম্যাডাম? আপনার প্রশ্নের অর্থোদ্বারই তো আমি করতে পারেনি। কাইন্ডলি এমন বাঁকা ত্যাড়াভাবে না বলে সোজাভাবে বলা যাবে? ‘
— ‘ না বলবো না। ‘
— ‘ কেন? ‘
— ‘ কারণ আপনি আমার কথাকে বাঁকা-ত্যাড়া বলে অপমান করেছেন। তাই আমি রাগ করেছি। যার ফলে বলা সম্ভব নয়। ‘

সাদিদ কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নীলার মুখপানে তাকিয়ে রইলো। ক্ষীণ সময় অতিবাহিত হতেই সে বাঁকা হাসলো। এলোপাতাড়ি সুড়সুড়ি দিতেই নীলার অবস্থা এবার কাহিল।

— ‘ প্লিজ, প্লিজ বন্ধ করেন। আমি আর পারছি না। বলছি আমি। ‘
— ‘ এইতো লাইনে চলে এসেছো। তোমাকে কিভাবে সোজা করতে হয় সেটা আমার খুব ভালো করেই জানা আছে। ‘
— ‘ আপনি খুব খারাপ। ‘
— ‘ হলেও কিছু করার নেই৷ তোমারই বর। এখন ভালো মেয়ের মতো চুপচাপ বলে দাওতো। ‘

নীলা ঘাড় বাঁকিয়ে একবার সাদিদের মুখশ্রীতে নজর বুলালো। কাত হয়ে এসে সাবধানে সাদিদের বুকে মাথা রাখলো। সাদিদের পরিহিত শার্টের উপরের দুইটা বোতাম খোলা। যার দরুন তার বক্ষরোমগুলো নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশে উঁকি দিচ্ছে। নীলা আপনমনে সেগুলোতে আঙুল চালিয়ে খেলতে খেলতে বলে উঠল,

— ‘ এই জীবনে আমাকে ভুলে যাবার এমনকি ভুল বুঝারও অনেক বিষয় আপনার সামনে এসেছে। যখন সম্পর্কের কোনোরকম নাম ছিলো না তখনও আপনি আমাতে মত্ত ছিলেন। প্রবাসের এতো দীর্ঘ রজনী পার করেও এই আমিটাকেই একমাত্র মনে ধরে রেখেছিলেন। তারপর.. তারপর সম্পর্কের নাম আসার পরও আমাদের মাঝে দূরত্ব এসেছিল। এসেছিল ভুল-ভ্রান্তির অগণিত কারণ। নিজের খুব কাছের মানুষগুলোও আমাকে ভুল বুঝতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু তখনও আপনি কেন এমনটা করলেন? কেন এতো ভালোবাসলেন? কেন সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে এই আমিটাকেই বিশ্বাস করলেন? আমার যে আপনার এই প্রচন্ড ভালোবাসার সামনে ভয় হয়। খুব ভয় হয়। ‘

নীলার কথাগুলো ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছে। সাদিদ নীলার মুখ না দেখেও স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার প্রাণপাখির মায়াবী আঁখিজোড়াতে নোনাজল এসে ভিড় জমিয়েছে। নীলা সাদিদের বুকের শার্ট শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। সাদিদ সযত্নে তার মাথায় হাত বুলিয়ে চুলের ভাঁজে চুমু দিলো। নরম শরীরের প্রাণপাখিটাকে সাবধানে বুক পাঁজরে আঁকড়ে নিয়ে মায়াভরা কন্ঠে বলল,

— ‘ ভালোবাসিতো। আর ভালোবাসায় বিশ্বাস না থাকলে হয়? ‘
— ‘ লোকে বলে সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কের মতো বিশ্বাসেও ফাটল ধরে। ‘
— ‘ হ্যাঁ সেটা হয়তো দেখা যায়। কিন্তু বউ, তাই বলে কি সবাই এক? সবাই কি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়ে যায়? ব্যতিক্রমতো অবশ্যই থাকবে৷ তাই বলে সবাইকে এক পাল্লায় মাপা কোন দিক দিয়ে ঠিক? ‘

নীলা ঘাড় উঁচিয়ে সাদিদের দিকে তাকাতেই সে নিঃশব্দে মৃদু হাসলো। নীলার মনে যে এখনও অগণিত প্রশ্নের আনাগোনারা এসে ভিড় জমাচ্ছে সেটা বুঝতে পেরে তার মুখটা আঁজলাভরে ধরলো। অতঃপর একটু নিচু হয়ে সাদিদ তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে পূণরায় বলল,

— ‘ পৃথিবীটা এখন ক্রমশ আঁধারে তলিয়ে যাচ্ছে। দিনকে দিন অবিশ্বাস, ছলনা, মিথ্যার আড়ালে ভালোবাসার সজীবতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এই ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে বেঁচে থাকা বড্ড যন্ত্রণার। কিন্তু তাই বলে এখনও যে ভালোবাসার সায়য়ের অক্লান্ত প্রেমিক পুরুষের দেখা মিলবে না তেমনটা ভাবা অনুচিত। জানি না আমি কেমন বা কতটুকু তোমার প্রেমে মাতোয়ারা। শুধু এতটুকু জানি তোমার জন্য অনুভূতিগুলো অন্তরাল থেকে উপলব্ধি করি। আর শেষাংশে এসে অনুরাগটা অন্তরালের সর্বোচ্চ গহীনে এসে আপনমনে তৈরি হয়। তাই ভুল বুঝা সম্ভব না বউ। একবারেই সম্ভব নয়। ‘

নীলার বন্ধ চোখ বেয়ে পড়া নোনাজলগুলো তার শুকনো গাল ভিজিয়ে দিচ্ছে। এত সুখ সে কিভাবে সহ্য করবে? পারবে তো দীর্ঘ বর্ষ রজনী পেরিয়ে এই ভালোবাসার মানুষটাকে সযত্নে আগলে রাখতে?
নীলা চঞ্চল হরিণীর ন্যায় নিজেও সাদিদের গালে হাত রাখলো। সাদিদ তার কাজকর্ম ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারলো না। তাকে চরম মাত্রায় অবাক করে দিয়ে নীলা নিজের ভেজা অধরযুগল তার শুষ্ক ঠোঁটজোড়াতে মিলিয়ে দিলো৷ কয়েক মুহূর্ত সাদিদ চমকিত ভাবের মধ্যেই থমকে রইলো।
নীলা আগ বাড়িয়ে ভুলেও কখনও আদর দিতে আসে না। তার তো সাদিদের এগিয়ে আসাতেই লজ্জায় মরিমরি অবস্থা হয়। সেই নীলা নাকি আজ তাকে এভাবে অস্থির হয়ে চুমু দিচ্ছে!
সাদিদ আর কালবিলম্ব করলো না। নীলাকে বুকে আগলে নিয়ে সাবধানে বালিশে শুইয়ে দিলো। কিন্তু দুটো মনের তৃষ্ণা নিবারণ তখনও থেমে রইলো না। নীলার এমন আগ্রাসী রূপ সাদিদের নিকট একেবারে নতুন৷ তাই মুহূর্তটাকে সে নিজেও চরম উপভোগ করছে৷ নীলার অস্থিরতা সাদিদের পুরুষ শরীরে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। তাই নীলার বাম হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে নিজের ডান হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। অপরহাতে নীলার চিবুক চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট বিচরণের যেন প্রতিযোগীতা চালালো। কত সময় অতিবাহিত হলো সেটা দুইজনের কারোই খবরে নেই৷ কিন্তু মুখে যখন উষ্ণকোমল তরল পদার্থের উপস্থিতি টের পাওয়া গেল তখনই সাদিদের হুঁশ ফিরলো। কি হচ্ছে দেখার জন্য সে নীলার ঠোঁট ছেড়ে সরে আসলো। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নীলার মুখপানে তাকালো। মেয়েটা ইতিমধ্যে নিঃশব্দে কেঁদে-কেটে চোখ-মুখ লাল করে ফেলেছে। সাদিদ এবার এতক্ষণের ভালোবাসা মিশ্রিত আদর ছেড়ে মৃদুস্বরে ধমকে উঠল,

— ‘ এটা কি হচ্ছে? আদর দিলে কেউ কান্না করে! নাকি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি এভাবে কাঁদবার জন্য? ‘

নীলা দ্রুত গাল-চোখ মুছে সাদিদের সামনে ভালো মেয়ে সাজতে চাইলো৷ সেটা বুঝতে পেরে সাদিদ তার অগোচরে নিঃশব্দে মৃদু হাসলো৷
দরজায় নক হতেই সাদিদ নীলার থেকে সরে এসে বিছানা থেকে নামলো। এগিয়ে যেতে যেতে শার্টের উপরের দুটো বোতাম লাগিয়ে নিলো। নিধি হাতে একটা মিডিয়াম সাইজের ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

— ‘ ভাবীমণি তুমি আসলে কেন? কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে। ‘
— ‘ অবসরই ছিলাম৷ তাই ভাবলাম আমিই নিয়ে যাই। নতুবা তুমি থাকলে তো পিচ্চুর ত্রিসীমাতে কাউকে থাকার প্রয়োজন হয় না। ‘

সাদিদ তার কথায় হালকা হাসলো। অতঃপর দরজা ছেড়ে বলে উঠল,

— ‘ তাহলে তোমাদের আদরের দুলালীকে কষ্ট করে নিজেই খাইয়ে দাও। খাওয়া নিয়ে এই মেয়ে মহা ড্রামাবাজ। ‘

শেষের কথাটা সাদিদ কিছুটা ফিসফিসিয়ে নীলার অগোচরে বললো। নতুবা তার প্রাণপাখির কানে গেলে মুখটা হুতুমপেঁচার মতো করে রাখবে। নিধি ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। তাকে ট্রে নিয়ে বিছানায় বসতে দেখে সাদিদ তোয়ালে কাঁধে নিয়ে আবারও বলল,

— ‘ তাহলে তুমি এই মহারাণীকে খাওয়াতে থাকো। আমি এরমধ্যে গোসলটা সেরে ফেলি। ‘
— ‘ আরে যাও যাও। বউয়ের চিন্তায় বেচারা গোসল করতে গিয়েও শান্তি পাচ্ছে না। ‘

নিধির সামনাসামনি হঠাৎ এমন কথায় নীলা-সাদিদ দুইজনই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সাদিদ বারকয়েক শুকনো কেশে বিনাবাক্য ওয়াসরুমের দিকে পা বাড়ালো।
সাদিদ চলে যেতেই নিধি ট্রেয়ের উপর থেকে ঢাকনা সরালো। সকাল সকাল নিধি তার জন্য হুমমেইড স্যান্ডউইচ, দুটো সেদ্ধ ডিম আর অরেঞ্জ জুস নিয়ে এসেছে। নীলার নজরে সেগুলো পরতেই তার চোখ-মুখ কুঁচকে এলো।

— ‘ আপুনি এসব কি এনেছো? আমি এসব খাবো না। ‘
— ‘ চুপ। প্রতিদিন এক বাহানা করিস। এসব খাবি না তো কি খাবি? ‘
— ‘ আচার নতুবা টক-ঝাল-মিষ্টি টাইপ কিছু নিয়ে আসো। ‘
— ‘ হুম সাদিদ বের হোক। তার কয়েকটা ধমক খেলেই টক-ঝালের স্বাদ একেবারে মিটে যাবে। ‘

নিধির এই কথার পর নীলার মুখটা আরও চুপসে গেল। কেননা সাদিদ এমনটাই করে। প্রতিদিন ধমকিয়ে-টমকিয়ে জোর করে হলেও এসব খাইয়ে ছাড়বে। তাদের হ্যাঁ না এর বাকবিতন্ডায় ইতিমধ্যে সাদিদ গোসল সেরে বেরিয়ে এসেছে। নিধি রুমে আছে বিধায় সে খালি গায়ে বের হয়নি। ট্রিশার্ট আর টাওজার পরে তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসলো। নীলা দরজার খোলার আওয়াজে সেদিকে ফিরে তাকালো। গোসলের পর বরাবরের মতোই সাদিদকে বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। কিন্তু এই স্নিগ্ধ চেহারার ছেলেটা এখন তার কি অবস্থা করবে এটা ভেবেই নীলার আগাম বিরক্তি লাগছে। সে আবারও তীব্র বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে প্লেটের উপর রাখা খাবারগুলোর দিকে তাকালো। নিধি তার অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসলো।

— ‘ কি হয়েছে ভাবীমণি? এতো তাড়াতাড়ি খাওয়ার পর্ব শেষ হয়ে গেল? নাকি আমিই গোসল দেরীতে শেষ করলাম? ‘
— ‘ শেষ কোথায়? এখনওতো শুরুই হয়নি। ‘
— ‘ মানে? ‘
— ‘ মানে হচ্ছে তোমার ধমক আজকাল কিছু মানুষের জন্য হজমির ন্যায় কাজ করে। হজমি এতক্ষণ ছিলো না তাই খাওয়াটা অসমাপ্তই রয়ে গেল। ‘

সাদিদ চোখ বাঁকিয়ে নীলার দিকে তাকাতেই সে মাথা নিচু করে বিছানার চাদর মোচড়ামুচড়ি শুরু করলো। আড়চোখে সাহস করে একবার সাদিদের দিকে তাকাতেই আবারও সেই হালকা রাগের আভাযুক্ত চোখজোড়ার সম্মুখীন হলো। সে দ্রুত নজর সরালো।

— ‘ ভালো কাজ না? তাহলে এটা হবে কিভাবে? তোমার পিচ্চি বোনটা দিনদিন আদর খেয়ে বাঁদর হচ্ছে। ভালো জিনিস এখন তার মুখেই যায় না। তুমি জানো? আজকে এই মেয়ে রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করা ফ্লাস্কে বানিয়ে রাখা রং চা খেয়েছে। তাও আবার চেটেপুটে। অথচ তার শরীরের জন্য ভালো এমন কিছু একটা আমি জোর করেও তাকে খাওয়াতে পারি না। ‘
— ‘ ঠিকই তো পিচ্চু। আমার বেচারা ভাইটাকে এতো জ্বালাস কেন? ‘
— ‘ আমি কোথায় জ্বালালাম? ‘

নীলা মিনমিনিয়ে কথাটা বলেই আবারও আড়চোখে সাদিদের দিকে তাকালো। সে এখনও একদৃষ্টিতে নীলাকেই পরখ করে যাচ্ছে। ইশশ এমন করে তাকায় কেন? নীলার ভয় লাগে না বুঝি?

— ‘ আমাকে দিয়ে হবে না সাদিদ। এই মেয়েকে তুমিই খাইয়ে দাও। ‘

নিধি আর দাঁড়ালো না। যেখানে সাদিদ রয়েছে সেখানে শুধুশুধু থেকে কি লাভ?
সাদিদ এগিয়ে গিয়ে দরজাটা চাপিয়ে আসলো। অতঃপর বিনাবাক্য নীলার পাশে বসে ট্রে থেকে স্যান্ডউইচ হাতে নিলো। নিঃশব্দে সেটা নীলার মুখের সামনে ধরতেই নীলা দৃষ্টি এদিক-সেদিক ঘুরাতে শুরু করলো। সাদিদ কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণ চোখে তার ফাঁকিবাজ বউয়ের কর্মকান্ড দেখলো। অতঃপর গম্ভীরস্বরে বলল,

— ‘ চুপচাপ হা করো। ‘
— ‘ না মানে.. খিদে নেই। ‘

নীলার কন্ঠে অসহায়ত্বের ছাপ। কথাগুলো তীব্র আকুতিভরা। কিন্তু সাদিদ সেসবে বিন্দুমাত্র গললো না। থমথমে গলায় আবারও বলল,

— ‘ খেলেই খিদে লাগবে৷ ‘
— ‘ এটা কেমন লজিক? এসব আজাইরা লজিক মানি না। ‘
— ‘ কানের পিছনে দুই তিনটা পরলে অনায়াসে মানতে বাধ্য হবে৷ এবার চুপচাপ খাবারটা শেষ করো। ‘
— ‘ আমি…
— ‘ পাখি। ‘

নীলা এবার ভদ্র বাঁচার মতো হ্যাঁ করলো। কে বলবে এই ছেলেটা মিনিট বিশেক আগেও তাকে আদরে আদরে ক্লান্ত করেছে! এই ছেলে মুহূর্তে মুহূর্তে গিরগিটির মতো রং পাল্টায়। এই নরম তো এই দাবানলের ন্যায় গরম।
সবকিছু খাইয়ে সাদিদ নীলার মুখটা সন্তপর্ণে মুছিয়ে দিলো। এতক্ষণ গম্ভীরমুখে থাকলেও এখন তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলছে। সাদিদ নীলার গোলুমোলু গালগুলো হালকা করে টেনে দিয়ে কপালে আদরভরা চুমু খেলো। নীলার ঠোঁটের কোণেও কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটে উঠলো। কিন্তু সেটা বেশ একটা দীর্ঘায়িত হলো না।

— ‘ লক্ষ্মি বউ আমার। একটু পর আবারও আবার সাথে নাস্তা করে ফেলবে। একেবারে ফাস্ট ফাস্ট৷ ‘

এমন ভয়াবহ কথা শুনিয়েও সাদিদের মধ্যে কোনোরকম হেলদোল নেই। সে নিজেই ক্লোজেট থেকে অফিসিয়াল ড্রেস বের করে গায়ে জড়াচ্ছে। অপরদিকে নীলার মুখটা একেবারে দেখার মতো হয়েছে। যাকে এককথায় বলে বাংলার পাঁচ।

_____________

শাহেদ আর হাসিবুর রহমান ইতিমধ্যে গাড়িতে বসে ওয়েট করছে। সাদিদ বের হলেই একসঙ্গে যাবে। শাহেদ বারবার ঘড়ির কাটা দেখে যাচ্ছে কিন্তু সাদিদের খবর নেই।

— ‘ আর কতক্ষণ বাবা? লিভিংরুম থেকে এখানে আসতে সর্বোচ্চ দুইমিনিট লাগার কথা। সেখানে পনেরো মিনিট ওভার। ‘
— ‘ আরে অধৈর্য্য হচ্ছিস কেন? এটা নতুন কি? সে আমাদের এগিয়ে যেতে বলে প্রতিদিন নিজের মহৎ কাজ উদ্ধার করে। ‘

বলেই তিনি হেসে ফেললেন। অপরদিকে শাহেদও সিটে শরীর এলিয়ে মৃদুস্বরে হাসলো।

— ‘ মা, আমি না আসা পর্যন্ত প্লিজ ওকে একা থাকতে দিও না। তুমি না হয় ভাবীমণি নতুবা যে কোনো একজন সর্বদা যেন ওর পাশেপাশে থাকে। ‘

শায়লা রহমানের বিরক্তির মাত্রা যেন এবার অতিক্রম করবে। ছেলেটা প্রতিদিন এই এক কথা বলে বলে তার কান রীতিমতো পচিয়ে দিচ্ছে।

— ‘ সাদি, তুই কিন্তু এই বয়সে এসেও অনায়াসে আমার হাতের কয়েকটা থাপ্পড়-টাপ্পড় খেয়ে ফেলতে পারিস। প্রতিদিন এসব বলার কোনো মানে হয়? ‘

তার কন্ঠে প্রচন্ড বিরক্তির ছাপ। সাদিদ সেটা দেখে মুখটা লটকিয়ে ফেললো। মায়ের হাতটা দুইহাতে চেপে ধরে উল্টোপাশে ঠোঁট ছুঁইয়ে নরম গলায় বলে উঠল,

— ‘ কি করবো মা? শান্তি পাই না তো। তাই নিজের একটু প্রশান্তির জন্য বারবার এমনকরে বলে যাই। ‘

শায়লা রহমানের মুখে তৎক্ষনাৎ বিরক্তি কাটিয়ে মায়া এসে ভর করলো। তার ছেলেটা যে কাউকে এমন করে ভালোবাসতে পারে এটা তার নিকট স্বপ্নের মতো। ছেলেটাকে কোনোসময় এইসব প্রেম-ভালোবাসায় জড়াতে দেখেনি৷ সবসময় পড়াশোনা, পরিবারের সদস্য আর বাকি সময়টুকু বন্ধুদের সাথেই কাটিয়েছে। আর আজ কি-না এই ছেলেটাই একটা মেয়েকে চোখে হারায়! প্রতিদিন মায়ের নিকট তাকে নিয়ে কতো আকুতি-মিনুতি করে! তিনি ছেলের কপালে স্নেহের চুম্বন করে সযত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

— ‘ একদম চিন্তা করবি না। এরা দুইবোন আমার কাছে ছেলের বউ নয়। বরং দুইটা মেয়ে। তাই নিজের মেয়েকে দেখা নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না৷ ‘

সাদিদ একগাল প্রশান্তির শ্বাস টেনে হাসলো। অতঃপর মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে অদূরে সোফায় বসা নীলার দিকে এগিয়ে আসলো। তার পাগলী বউটা ভাগিনার সাথে বসে সিএন চ্যানেলে ওগি কার্টুন দেখছে। আর একটু পর পরই দুইজনের হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। সাদিদ সেটা দেখে নিজেও ঠোঁট চেপে খানিকটা হাসলো। তারপর এগিয়ে গিয়ে নীলার পাশে বসে শাদকে টেনে নিজের কোলে আনলো। গালে ঠেসে চুমু দিতেই শাদ বিরক্তির সুর তুলে গাল ঘষতে ঘষতে নীলার নিকট অভিযোগ তুললো,

— ‘ খালামণি, পাপু পঁপা। গাল খেয়ে ফেলে। ‘

নীলা হেসে ফেললো তার অভিযোগ মাখা কথা শুনে। সাদিদ তাকে হাসতে দেখে দুষ্টু হেসে নীলার হাসি বন্ধ করার টেকনিক অবলম্বন করে বলল,

— ‘ খালামণি আর কি বলবে? খালামণিরই তো আরও অনেককিছু খেয়ে ফেলি। গাল, নাক, ঠোঁ..
— ‘ আল্লাহরওয়াস্তে চুপ করেন। অসভ্য লোক একটা। ‘

শেষোক্ত কথাটা নীলা বেশ বিড়বিড়িয়ে সাদিদের অগোচরে নিচুস্বরে বলে উঠল। সাদিদ বুঝতে পেরেও এখনকার মতো ছেড়ে দিলো। অলরেডি অফিসের জন্য অনেক লেইট হয়ে গিয়েছে। তাই ঝটপট শাদের চোখের উপর হাত ধরে নীলার মাথায় গাঢ় চুমু খেলো।

— ‘ ইশশ সরাও সরাও। অন্ধকার লাগে। ‘
— ‘ বিচ্ছু একটা। চাচি মণির সাথে একদম দৌড়াদৌড়ি করবে না। তাহলে কিন্তু চাচ্চু খুব রাগ করবো। মনে থাকবে? ‘

শাদ একেবারে সব বুঝে গিয়েছে এমন একটা ভাব টেনে দ্রুত মাথা উপর নিচ করলো। কিন্তু তার ছোট্ট মস্তিষ্ক বরাবরই সাদিদের চাচি মণি আর নীলার খালা মণি ডাক নিয়ে মারাত্মক ঝামেলা পাকিয়ে বসে থাকে। কিন্তু সে প্রতিবারই নির্বাক শ্রোতা। সাদিদ নিজের অনাগত স্নেহের টুকরোটাকেসহ খালামণি এবং ভাগিনাকে আদর দিয়ে অফিসের জন্য বের হয়ে গেল।
গাড়ির সামনে আসতেই শাহেদ রসিকতা মিশ্রিত স্বরে বলে উঠল,

— ‘ ভাগ্যিস এসেছিস। নতুবা আমি আর বাবা ভেবেছিলাম একটা ঘুম দিয়ে দিবো। ‘

সাদিদ তার কথার সারমর্ম বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে হাসলো৷ অতঃপর বিনাবাক্য দরজা খোলে ফ্রন্ট সিটে বসে পড়ল। শাহেদ আর দেরি না করে দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিলো। কিছুদূর যাওয়ার পরই গাড়ির মিররে চোখ পরতেই সাদিদের বুক বোধহয় কেঁপে উঠল। সে উত্তেজিত কন্ঠে শুধু বলল,

— ‘ ভাইয়া প্লিজ গাড়ি থামাও। ‘

শাহেদ এককথাতেই গাড়ির ব্রেক চাপলো। কিন্তু কি জন্য সাদিদ ব্রেক করতে বলেছে সেটা আর জিজ্ঞেস করতে পারলো না। কেননা সাদিদ ইতিমধ্যে হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছে।

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৫৬

নীলা মোজাইক পাথরের মেঝেতে নিচু হয়ে বসে স্যান্ডেলের ভিতরে চলে আসা ছোট নুড়ি পাথরটা বের করে নিলো। অসমান ধারালো তীক্ষ্ণ ছিলো বলে পায়ের তালুতে একটুখানি লেগেছে। সে এতক্ষণ এটা পরখ করতেই ব্যস্ত ছিলো। এরিমধ্যে আচমকা কেউ একজন ঝড়ের গতিতে এসে তাকে নিজের বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিয়ে বুক পাঁজরে আঁকড়ে ধরলো। তাকে আঁকড়ে ধরা মানুষটার হৃদ স্পন্দন অস্বাভাবিক হারে চলছে। নীলাকে এতটাই শক্ত করে ধরেছে যে সে মাথা উপরে তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। কিন্তু ব্যক্তির মুখশ্রী নজরে না এলেও নীলার বুঝতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হচ্ছে না মানুষটি কে?
কেননা তার স্পর্শ যে নীলার রক্তকণিকাগুলোর পর্যন্ত মুখস্থ। তার আদরমাথা ভালোবাসাগুলো নীলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে রয়েছে। প্রেমিক পুরুষের এই মাতালকরা গায়ের গন্ধে নীলা চোখ বন্ধ করেই দূর থেকে বহুদূর পাড়ি দিতে পারবে।

— ‘ কলিজা, পেইন হচ্ছে তোমার? খুব বেশি ব্যাথা হচ্ছে? ‘

সাদিদের কন্ঠস্বর ক্রমশ কেঁপে কেঁপে উঠছে। সাথে যুক্ত হয়েছে চোখে-মুখে মারাত্মক ভয়। কিন্তু নীলা এসবের কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারছে না। কি পেইন? কিসের ব্যাথা?
নীলা দ্বিধাজড়িত কন্ঠেই জিজ্ঞেস করলো,

— ‘ কিসের পেইন? আমি আবার কখন ব্যাথা পেলাম? ‘

সাদিদের কাঁপুনিভাব এখনও যায়নি। সে তার গালে নিজের কাঁপা ডান হাতটা রেখে ভয়ার্ত কন্ঠেই আবার বললো,

— ‘ তোমাকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসতে দেখলাম। কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ তুমি নিচে বসে পড়লে৷ আমি মিররে স্পষ্ট তোমার ব্যাথাজনিত মুখশ্রী দেখেছি। প্রিন্সেসের আগমনের তো আরও সময় বাকি আছে। এতো তাড়াতাড়ি পেইন উঠে গেল! আসো কোলে নেই। আমরা এখনই হসপিটাল চলে যাব। ‘

নীলা এই মুহূর্তে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। সে হাসবে না কাঁদবে এটাই এখন বুঝে উঠতে পারছে না। মূলত এককথায় সে নিজের অনুভূতিই বুঝতে এইমুহূর্তে অক্ষম। তাই সে কেবল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে সাদিদের অস্বস্তিভরা মুখশ্রীতে তাকিয়ে রয়েছে। এরিমধ্যে শাহেদরা গাড়ি থেকে নেমে চলে এসেছে। এদের দুইজনকে এই অবস্থায় দেখে তারাও চিন্তায় পরে গেল। শাহেদ দুশ্চিন্তাগ্রস্তে বলে উঠল,

— ‘ কি হয়েছে ভাই? তুই এভাবে দৌড়ে আসলি! নীলা ঠিক আছে তো? তুই ওকে এভাবে ধরে আছিস কেন? কি হয়েছে নীলা? তোমার শরীর কি খারাপ লাগছে? ‘
— ‘ হ্যাঁ রে মা। তুই ঠিক আছিস? শাহেদের মা, এই শাহেদের মা তাড়াতাড়ি বের হও। দেখো মেয়েটার শরীর খারাপ করেছে। ‘

এতক্ষণ বোধহয় এতটুকুরই অভাব ছিলো৷ যা এই পাগলাটে প্রেমিকের কৃপায় ষোলোআনায় পরিপূর্ণ হয়েছে। নীলাকে আরও একদফা অবাক করে দিয়ে বাড়ির ভিতর থেকে হুড়মুড়িয়ে শায়লা রহমান, নিধি এবং কাজের মেয়েগুলো পর্যন্ত বেরিয়ে আসলো। মাকে দেখে যেমন সব সন্তানেরা নরম হয়ে যায় সাদিদেরও তেমনটাই হলো। তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে না পরলেও চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে আসলো। সে ধরা গলায় শায়লা রহমানের উদ্দেশ্য বলে উঠল,

— ‘ মা.. মা আমার পাখির কষ্ট হচ্ছে। ‘

ছেলের এমন অসহায় মুখশ্রী দেখে মায়ের মনটা নিঃশব্দে যেন ডুকরে কেঁদে উঠলো। তিনি আলতো হাতে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে স্বান্তনার স্বরুপ প্রবল আত্মবিশ্বাসের কন্ঠে বললেন,

— ‘ শান্ত হো বাবা। ওর কিছু হবে না। আমরা সবাই আছিতো। এখনই হসপিটাল চলে যাবো। কই গো শুনছো? জলদি এমারজেন্সিতে কল দিয়ে হসপিটালে সিট বুক করো। আমরা আর এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট করবো না। ‘

নীলার চোখজোড়া এখনও গোলগোল হয়ে আছে। কি হচ্ছে এসব? দয়া করে কেউ কি তাকে কষ্ট করে একটু বলবে?
সাদিদ নীলাকে এতক্ষণ নিজের বুকেই চেপে ধরে রেখেছিল। এখন তাকে কোলে তুলে নিতে গেলেই নীলার ভাবনায় ছেদ পরলো। সে এই ছেলের কর্মকান্ডে এখন মারাত্মকভাবে বিরক্ত। তাই সাদিদকে থামিয়ে বিরক্তিমাথা কন্ঠে বলল,

— ‘ ছাড়ুন বলছি। একদম কাছে আসবেন না? ‘
— ‘ এমন করে বলে না পাখি৷ তোমার কষ্ট হচ্ছে তো। আসো এখনই হসপিটালে নিয়ে যাব। ‘
— ‘ চুপ থাকুন তো। আমি কি একবারও আপনাকে বলেছি যে, আমার কোনো জায়গায় ব্যাথা হচ্ছে?
আমি উত্তর দিচ্ছি। বলিনি। তাহলে এসব পাগলামির মানে কি? ‘
— ‘ পাগলামি কোথায় করলাম? আমি স্পষ্ট তোমার চোখে-মুখে ব্যাথার ছাপ দেখেছি। ‘

নীলা ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললো। না এই পাগলকে বুঝানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে একপলক বাকি সবার দিকে তাকালো। সাদিদের পাগলামিতে তারাও চিন্তায় পরে গিয়েছে। তাই সকলের চিন্তার অবসান ঘটাতে সে পাশে পরে থাকা ছোট্ট নুড়ি পাথরটা হাতে নিলো। হাত বাড়িয়ে সেটা সবার দৃষ্টির সামনে এনে সকলের উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ এই যে পাথরটা দেখছেন? এটা পায়ে লেগে একটু ব্যাথা পেয়েছিলাম৷ আর সেটা দেখেই পুরো ঘটনা বিস্তারিত না শুনেই এই পাগল মানুষ নিজেও চিন্তায় পরেছে এবং সাথেসাথে আপনাদের সবাইকেও দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। ‘

সবাই তার কথা শুনে বিস্মিত হলো। অপরদিকে সাদিদ তীক্ষ্ণ চোখে নীলার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। নীলা সেটা দেখেও পাত্তা দিলো না। হুহ, সে নিজেই পাগল আবার এখন আসছে নীলার দিকে চোখ বড় করে তাকাতে। তাকাবেই না সে।
সবাই কয়েক মুহূর্ত একে-অপরের মুখপানে তাকিয়ে থেকে এবার সশব্দে হেসে উঠল। শাহেদ হাসতে হাসতেই বলতে থাকলো,

— ‘ লাইক সিরিয়াসলি ভাই? তুই সব না শুনেই এতদূর চিন্তা করে নিলি? সত্যিই আমার হাসি থামছে না৷ ‘

পাশে দাঁড়িয়ে নিধিও নিঃশব্দে মুখ টিপে টিপে হাসছে৷ সে শাহেদের কাঁধে হাসি থামাতে মৃদুভাবে ধাক্কা দিলো। নিধির ইশারা বুঝতে পেরে সে প্রাণপণে হাসি থামাবার চেষ্টায় রয়েছে। কিন্তু হাসি যেন থামার নামই নিচ্ছে না। রহমান দম্পতিও ছেলেকে বউয়ের প্রতি এমন পাগল দেখে মুখ টিপে হেসে যাচ্ছে। সাদিদ এবার নীলার ন্যায় সকলের দিকে একপলক বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে তাকালো। অতঃপর নীলার দিকে তাকিয়ে ভ্রযুগল কুঁচকে গম্ভীর থমথমে স্বরে বলে উঠল,

— ‘ তুমি তাহলে বাহিরে কেন এলে? আর তোমার মধ্যে এতো তাড়াহুড়োই বা কেন ছিলো? ‘

নীলার এতক্ষণের পূর্ববর্তী বিরক্তির আভাস সম্পূর্ণ মিলিয়ে গিয়ে মুখটা চুপসে গেল। সাদিদ এতক্ষণ দুশ্চিন্তায় পাগল থাকলেও এখন নীলাকে ঠাটিয়ে দুইটা লাগাতে পিছুপা হবে না। তাই সে আমতা আমতা করে নিচুস্বরে বলল,

— ‘ আপনার ফোনটা ভুলে রেখে এসেছিলেন। ‘
— ‘ সিরিয়াসলি! তুমি সামান্য একটা ফোন দেওয়ার জন্য এমনভাবে বেরিয়ে আসবে? তোমাকে নিয়ে আমি কি করবো? এতটুকু বুঝ শক্তি কি তোমার মধ্যে এখনও হয়নি? তোমাকে ব্যাথায় কাতর হয়ে নিচে বসতে দেখে আমার অনুভূতি কেমন হয়েছিল সেটা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে? কেন এসেছো বাহিরে? ‘

শেষোক্ত কথাটা সাদিদ উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বললো৷ নীলা আচমকা এমন ধমকে ভয় পেয়ে কেঁপে উঠল। সাদিদ তারপরও থামলো না। সকলের সামনেই নীলার কাঁধ চেপে তার শরীর মৃদুভাবে ঝাঁকিয়ে আবারও ঝাঁঝালো স্বরে বলল,

— ‘ মেরে ফেলবি আমাকে? কতটুকু কষ্ট হয় বুঝিস না তুই? এতটা পাষাণ কিভাবে হতে পারিস? একটুও দয়ামায়া কি তোর মধ্যে নেই? ‘

সাদিদ মৃদু ধাক্কা দিয়ে নীলার কাঁধ ছেড়ে দিলো। নীলার চোখজোড়াতে ভালোবাসার মানুষ থেকে এমন তিক্ত বাক্য শুনে ইতিমধ্যে অবাধ্য অশ্রুকণারা এসে ভিড় জমিয়েছে। সে অশ্রুসিক্ত আঁখিযুগলে আড়চোখে একবার উপস্থিত সবার দিকে তাকালো।
সাদিদ কখনোই নিজেদের ভেতরকার রাগ-ক্ষোভ অন্যকারো সামনে প্রকাশ করে না। কিন্তু আজ হঠাৎ সকলের সামনে এমন করাতে কষ্টের সাথে সাথে নীলার ভীষণ লজ্জাও লাগছে৷ সে বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব বেশি বিব্রতবোধ করছে। সাদিদ এখন নিজের মধ্যে না থাকলেও নীলার অবস্থাটা বাকি সবাই বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। তাই শাহেদই গম্ভীরস্বরে বলল,

— ‘ সাদি, বিহেভ ইউরসেলফ। ওর সাথে তুইতোকারি করছিস কেন? নীলার এখানে কি দোষ! তুই নিজেইতো উল্টো পাল্টা ভেবে নিয়ে এমন একটা সিচুয়েশন তৈরি করেছিস। ‘
— ‘ কি বললে তুমি? দোষ নেই? ‘

সাদিদ এতটাই রেগে গিয়েছে যে পাশের একটা ডালিয়া ফুলের টবে সজোরে লাথি দিলো৷ টব ভাঙার বিকট আওয়াজে নীলার এবার নিঃশব্দের কান্না ফুঁপানিতে রূপ নিলো। নিধি তাকে সামলানোর জন্য দ্রুত বাহুজড়িয়ে আগলে ধরলো৷

— ‘ চুপ। একদম কাঁদবি না। একটা টু শব্দ যেন না হয়৷ তোর কান্নার আওয়াজ আমার কাছে বিষের ন্যায় মনে হচ্ছে। ‘
— ‘ চুপ কর সাদি। কখন থেকে মেয়েটার সাথে রাগারাগি করে যাচ্ছিস। ভুলে যাস না তোর মা-বাবা, ভাই-ভাবীসহ অনেকেই এই মুহূর্তে তোদের সাথে উপস্থিত। তাই নিজেদের রুমের বিষয় বাইরে এনে মেয়েটাকে আর বিব্রতবোধ করাস না। ‘

সাদিদ কোনোভাবেই নিজের রাগটাকে যেন কমিয়ে আনতে পারছে না। সে রক্তিম চোখজোড়া নিয়ে আবারও একপলক নীলার অশ্রুসিক্ত মুখশ্রীতে নজর বুলিয়ে হনহনিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। এলেমেলোভাবে গেইট পেরিয়ে তার গাড়িটি বের হতেই শায়লা রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলার দিকে এগিয়ে গেলেন। মেয়েটার চোখ-মুখ ইতিমধ্যে ফুলে গিয়েছে। তিনি সযত্নে গাল মুছিয়ে দিয়ে তাকে স্বান্তনা দিতে বলে উঠলেন,

— ‘ কাঁদিস না মা। জানিস তো ছেলেটা আমার তুই বলতে পাগল। চোখে হারায় তোকে। তাইতো তোর এমন ছেলেমানুষী সহ্য করতে পারে না। ছেলেটা প্রচন্ড ভয় পায় তোকে নিয়ে। ওর এমন আচরণে কষ্ট পাবি না৷ দেখ গিয়ে, হয়তো বা তোকে ধমকিয়ে সে নিজেও এখন শান্তি পাচ্ছে না৷ ‘
— ‘ আমি জানি মা। আমি উনার সবটুকুই জানি৷ কিন্তু আমিও যে সহ্য করতে পারছি না। আমার কষ্ট হচ্ছে মা। খুব কষ্ট হচ্ছে। ‘

নীলা শায়লা রহমানের বুকে মুখ চেপে নিজের ভেতরকার কষ্টের সাগরটা কমাতে চাচ্ছে। কিন্তু না৷
অতিরিক্ত ভালোবাসা দিয়ে দিয়ে সাদিদ তাকে আজ পুরোপুরি ভালোবাসার কাঙাল বানিয়ে ছেড়েছে৷ তাই এখন আর একবিন্দু কষ্ট তার দ্বারা সহ্য হয় না। মন যে কেবল সুখ চায়। বড্ড বেশি ভালোবাসার সুখ।

______________________

ধানমন্ডির একটা আভিজাত্যপূর্ণ রেস্টুরেন্টের কর্ণারের টেবিলে শান্ত মাথানিচু করে বসে রয়েছে। প্রাইভেসির জন্যই মূলত এখানে বসা। অতিথির সুবিধার জন্য এখানে কেবিন সিস্টেম করা আছে। আর শান্ত আপাতত তেমনই একটা কেবিনে রয়েছে। সে একা নয়। তার সামনের চেয়ারেই তানবীর একধ্যানে ফোন স্ক্রলিংয়ে ব্যস্ত। যেন এমন একটা ভাব, এই মুহূর্তে ফোনের নিউজফিডের উর্ধ্বে তার কাছে আর কিছু নেই৷ শান্ত আবারও আড়চোখে একবার তার দিকে তাকিয়ে মিনিমিনিয়ে বলল,

— ‘ আমি আগে থেকে কিছু জানতাম না। আর না এই সম্পর্কে কোনো আইডিয়া ছিলো। হঠাৎ করেই এতসব..
— ‘ ইট’স ওকে ডিয়ার। তুমি এমন ভয়ার্ত স্বরে এক্সপ্লেইন করছো কেন? এখানে ভয় পাওয়ার মতো কি আছে? এনগেজমেন্ট হয়েছে, সো কংগ্রাচুলেশনস। ‘

তানবীরের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা। শান্তর বুকের বাম পাশটা আচমকা তীক্ষ্ণ ব্যাথায় যেন জর্জরিত হয়ে গেল। তানবীর তাকে তুমি বলে সম্বোধন করছে? এই ছেলেটা তো সবসময় তাকে বলতো আপন মানুষদের সে তুমি করে বলতে পারে না। কেমন পরপর লাগে। শান্ত এই নিয়ে কতসময় রাগ দেখিয়েছে অথচ তানবীরের ভাষা শুধরাতে পারেনি। সে হাসিমুখে তখন আরও বেশি করে তুইতোকারি করতো। পূর্বে এটাতে বিরক্তবোধ করলেও আজকে যেন এটা না করাতেই তানবীরের শব্দগুলো তার নিকট অসহ্যনীয় তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার ন্যায় অনুভব হচ্ছে।
তার এমন এলেমেলো অবস্থা দেখে তানবীর যেন আরও বেশি মজা পেল। তাই টেবিলের উপর থেকে শান্তর বামহাতটা আচমকা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। অতঃপর অনামিকাতে চকচক করা সাদা পাথরের ছোট্ট ডায়মন্ডের আংটিটা বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো।

— ‘ বাহ্। খুব সুন্দরতো। বর তাহলে পয়সাওয়ালা? এনগেজমেন্টেই এতো দামি ডায়মন্ডের আংটি দিলে বিয়ের সময়তো শরীর ভরে গহনা পরিয়ে দিবে৷ আঙ্কেল-আন্টি নিশ্চয়ই খুব খুশি? ‘
— ‘ আপনি এমন করছেন কেন? ‘
— ‘ আরে আমার কথা ছাড়ো। তোমাদের কথা বলো৷ পরিবারের সবাইতো নিশ্চয়ই অনেক বেশিই খুশি? শতহলেও কানাডার মাটিতে সেটেল হওয়া ছেলে। ভালো পরিবার, টাকা-পয়সা অঢেল। তারউপর ছেলে দেখতে শুনতেও হিরোর থেকে কম না৷ মেয়ে জামাই হিসেবে আর কি চায়? এমনটাই তো? ‘
— ‘ প্লিজ আমার কথাটা বুঝার চেষ্টা করুন৷ আপনাকে আমার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। ‘
— ‘ ইশশ সুইটহার্ট। আ’ম টোটালি ফাইন। তাছাড়া সামনে বড়সড় একটা বিয়ের দাওয়াত পাবো৷ ঠিক না থেকে কি পারা যায়? ‘

তানবীর হাসিমুখেই সবটা কথা শেষ করলো। শান্ত মনে কষ্ট নিয়ে তানবীরের মুখপানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তানবীরের হাসিমুখটা ধীরে ধীরে থমথমে রূপে পরিণত হতে লাগলো। যেমনটা গ্রহণের সময়ে চন্দ্র-সূর্যের হয়ে থাকে। হাসিমাখা মুখটাতে মুহূর্তেই নিকষ কালে অন্ধকার যেন ছেয়ে গেল। আর এই সবটাই একেবারে সামনে বসে শান্ত স্বচোখে দেখে গেল। আচমকা শান্তর বামহাতটা তানবীর শক্ত হাতে চেপে ধরলো।
শান্ত মৃদুভাবে ব্যাথা পাচ্ছে। অপরদিকে তানবীর সেটা দেখেও পুরোপুরি ভাবলেশহীন। শান্ত এবার সহ্য করতে না পেরে দুর্বলস্বরে বলে উঠল,

— ‘ আমি খুব ব্যাথা পাচ্ছি। ‘
— ‘ ওহ্ রিয়েলি? আমারতো মনে হচ্ছে না। বিয়ের সুখের সামনে তো এসব নিছক ধরাছোঁয়ার বাহিরে। তাই না হটি? ‘
— ‘ প্লিজ এসব বলবেন না। আপনি নিজের মধ্যে নেই। ‘
— ‘ তাই নাকি? ‘

তানবীরের শান্ত স্বর নিমিষেই পাল্টে গেল। সে একটানে শান্তর অনামিকা আঙুল থেকে বাগদানের রিংটা টেনে খোলে নিলো। দিকবিদিকশুন্য হয়ে সেটা কোথাও পরতেই শান্ত চমকিত দৃষ্টিতে তানবীরের মুখপানে তাকালো। নিজের মধ্যেকার উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল,

— ‘ কি করেছেন এটা আপনি? কোথায় ফেলেছেন রিংটা? এটা খুঁজে না পেলে বাবা আমাকে জীবিত কবর দিয়ে দিবে। ‘

তানবীর যেন আর সহ্য করতে পারলো না। চোখের পলকে শান্তর হাতে টান দিয়ে চেয়ার থেকে তুলে নিলো। শান্ত কিছু বুঝে উঠার আগেই টেবিল ঘুরিয়ে তাকে নিজের পাশে টেনে জোর প্রয়োগ করে নিজের উরুর উপর বসিয়ে দিলো। শান্ত হয়তো অবাক হয়ে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু তানবীর সেটা হতে দিলো না। ক্ষিপ্তভাবে তার ঠোঁট কামড়ে ধরলো।
শান্তর কয়েক মুহূর্ত লাগলো পুরোপুরি বিষয়টা বুঝে উঠতে। আর যখন বুঝতে পারলো কি হচ্ছে এটা, তখন মেয়েলি লজ্জায় সে কুঁকড়ে গেল। কিন্তু সেটা দীর্ঘায়িত হলো না। কেননা ধারালো দাঁতের হিংস্র কামড়ে ঠোঁটজোড়া বোধহয় কেটে যাচ্ছে। তানবীরের এমন আক্রমণে শান্ত কোনোরকম বাক্য উচ্চারণ করার পরিস্থিতিতে নেই। আর সে চায় ও না। যেহেতু অন্যায় সে করেছে তাই এখন শাস্তি ভোগ করতেই হবে৷ নিজের সহ্যশক্তি ক্রমশ নিচে নেমে আসছে৷ ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে সমস্ত মুখমণ্ডল। কিন্তু শান্ত নির্বাক। তানবীরের পিঠের শার্ট আঁকড়ে ধরে সে নিজেকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে৷ আর অপরদিকে নিঃশব্দের নোনাজলে তার শুষ্ক গাল ভিজে সিক্ত হচ্ছে।
কতক্ষণ এই হিংস্র ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু ভালোবাসার ভিন্ন রূপের দীর্ঘ যন্ত্রণার পাঠ চুকিয়ে ব্যাথাযুক্ত ঠোঁটযুগলের ব্যাথা নিরাময়ে এবার প্রেমিক পুরুষ কোমল আদরে প্রেয়সিতে মত্ত হলো। গাঢ় থেকে তীব্র গাঢ় হতে থাকলো অধরযুগলের বিচরণ। শান্তর কোমড় পেঁচিয়ে তাকে নিজের সাথে তানবীর আরেকটু ঘনিষ্ঠ করে তুললো৷ শান্ত বাধা দেওয়ার শক্তি খুঁজে পেল না। শুধু অনুভব করতে পারলো ভীষণ লজ্জা এবং ব্যাখাহীন ভালোলাগার এক তীব্র শিহরণ। নিজের রাগ, ক্ষোভ, ভালোবাসা সবকিছু মিটিয়ে নিয়ে প্রেমিক এবার ধীরে ধীরে প্রেয়সির ঠোঁট থেকে নিজের ঠোঁটযুগল আলাদা করলো। কিন্তু নিজেকে পুরোপুরি নয়। কপালে কপাল ঠেকিয়ে তানবীর ঘন ঘন শ্বাস টেনে বলে উঠল,

— ‘ তুই কি ভাবিস, তোর এমন অর্থহীন এনগেজমেন্টের কথা শুনে এই তানবীর তোকে ছেড়ে দিবে? হতে দিবে অন্যকারো ঘরনি? এমনটা ভেবে থাকলে তুই ভুলের দুনিয়ায় বসবাস করছিস৷
ভেবেছিলাম তোর অনার্স শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবো৷ তাই তোর বাপের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাইনি। কিন্তু শশুরমশাইয়ের দেখি আমার বউকে অন্যকারো ঘরে তুলে দেবার বহুত তাড়া। তাই এবার আমারও তাড়া লাগছে। এখনই বিয়া হইবো। অপেক্ষার পাঠ চুকিয়ে এখন সময় বিয়ের পাঠ পূর্ণ করার। ‘

শান্তর গলার স্বর আটকে গিয়েছে। কি থেকে কি হচ্ছে সবকিছুই যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না। কিন্তু সেটা হলেও পারা যেত। ভুল যায়গায় ভুল কথা বলার থেকে নীরব থাকা বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু শান্ত যেন এখন এই অবুঝের কাজটাই করে বসলো।

— ‘ আংটিটা? ‘

তানবীর মুহূর্তেই কপাল সরিয়ে শান্তর গাল চেপে ধরলো। এমনভাবে ধরেছে যেন এখনই গাল ভেদ করে দাঁতে আঙুল লেগে যাবে।

— ‘ এমন আজাইরা পটপট করবি তো মুখটা একেবারে সেলাই করে দিবো৷ আংটি? তাই না? ভুল করেও আর একটা আংটি বিষয়ক কথা বললে আংটির সাথে সাথে তোকেও ছুঁড়ে ফেলবো৷
কিন্তু ছুঁড়বো বলেছি বলে এটা ভাবিস না যে তোকে ছেড়ে দিব। এই তানবীরের থেকে ছাড়া পাওয়া এতো সোজা না জান। একবার যেহেতু হাত আঁকড়ে ধরেছি সেটা আমৃত্যু পর্যন্ত ছাড়ছি না। তুই ছাড়তে চাইলেও ছাড়বো না। এটা মগজে প্লাস শরীরের সব অঙ্গে ভালোভাবে গেঁথে রাখ৷ ‘

গালটা এতক্ষণ পর ছাড়া পেতেই যেন শান্ত জান হাতে ফিরে পেল। ব্যাথায় সেখানটা টনটন করছে। কিন্তু মুখফোটে কিছু বলার সাহস নেই৷ যেই পরিমাণ রেগে আছে দুই চারটা চর-থাপ্পড় অনায়াসে ফ্রিতে খেয়ে নিতে পারে। তাই চুপ থাকায় শ্রেয়৷ কিন্তু আচমকা তানবীরের ঠোঁটের কোণে চোখ পরতেই শান্ত লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। সে আজকে হালকা পিংক কালারের একটা লিপস্টিপ দিয়ে ছিলো৷ আর তখনকার তানবীরের এরূপ পাগলামির জন্য তার ঠোঁটে এখন শান্তর ঠোঁট হতে সেটা জায়গাবদল করেছে। সেটা দেখেই শান্তর ভিষণ লজ্জা লাগছে।
তাকে এমন লাজুকলতা হয়ে হাসতে দেখে তানবীরের রাগের পরিমাণ যেন আরও দ্বিগুণ হলো। সে বিষয় না বুঝে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠল,

— ‘ হাসছিস কেন? আমি এখানে হাসির মতন কি বললাম? ‘
— ‘ না মানে.. আপনার ঠোঁটে লিপস্টিক। ‘

বলেই শান্ত উল্টো ঘুরে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো৷ ইশশ কি লজ্জাজনক ব্যাপার।
তানবীরের কয়েক সেকেন্ড লাগলো বিষয়টা বুঝে উঠতে। বিষয়বস্তু ঠাহর হতেই সে রাগ ভুলে নিঃশব্দে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। কয়েক কদম এগিয়ে এসে শান্তর একেবারে পিঠ ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে দাড়ালো। অতঃপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

— ‘ ঠিক জায়গায়ই তো রয়েছে। তোর ঠোঁটের এই মিষ্টি তো আমার ঠোঁটেই লেগে থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এটা ভাবিস না বিয়ের আগেই মিষ্টিতে ভাগ বসিয়েছি বলে সরি-টরি কিছু বলবো। তোর বুঝার সুবিধার্থে আবারও বলে দিচ্ছি যে এমনটা আমি ভুল করেও করবো না। হয়তো বা কাজটা তোর ছাগলামিতে আগেই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জায়গা ঠিকই আছে৷ তাই অযথা লজ্জা না পেয়ে এখন থেকেই অভ্যাসে পরিণত করতে শিখ৷ কেননা পরবর্তীতে হুটহাট এই অংশে আমাকে খুঁজে পাবি৷ খুব একান্ত গরিষ্ঠতার সাথেই পাবি। ‘

শান্তর যেন দম আটকে আসার উপক্রম। জীবনে প্রথমবার এমন অনুভূতিতে পুরো শরীর জমে বরফ শীতল হয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্কের প্রত্যেকটা নিউরন যেন অচল হয়ে শান্তকে পুরোপুরি নিশ্চল বানিয়ে ছেড়েছে।

#চলবে…