অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-৫৭+৫৮

0
852

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৫৭

রাতের দ্বিতীয় প্রহর চলছে। একটু পরেই ঘড়ির কাটার পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রহরেরও পরিবর্তন ঘটবে। তৃতীয় প্রহরকে বরণ করে নিতে আকাশের অর্ধচন্দ্রটা বরাবরের মতোই অঘুমন্ত থেকে নিজের জায়গায় প্রস্তুত। তার সাথে আজ নীলাও হাজির হয়েছে। নীলার শারীরিক কন্ডিশনের পরিবর্তন হচ্ছে বিধায় সাদিদ কয়েক দিন আগেই নীলার জন্য এসব ঢিলেঢালা ম্যাক্সি কিনে নিয়ে এসেছে। যদিও এখন এসবের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু সাদিদের জেদের সামনে তাকে হার মানতে হয়েছে। এই মুহূর্তে তেমনই একটা হালকা গোলাপি রঙের ম্যাক্সি পরে খোলা চুলে সে রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় রেলিঙের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এখন সাদিদ উপস্থিত থাকলে এই কাজ করা তার পক্ষে কোনো কালেই সম্ভব ছিল না। এতো পুঁথিগত বিদ্যা অর্জনের পরও সাদিদ আজকাল এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে যাচ্ছে। এককথায় নীলার ক্ষেত্রে সে ওয়ান পারসেন্ট চান্সও নিতে প্রস্তুত নয়। তাইতো সময় অসময়ে তাকে বারান্দায় আসতে দেয় না। খোলা চুল রাখলে ধমকা-ধমকি শুরু করে। এমন আরও পাগলামিতে নীলা আজকাল অভ্যস্ত। সাদিদের এহেন আচরণে নীলার রাগ বা বিরক্ত লাগে না। সাদিদের যেমন ভয় হয় নীলার তেমনিভাবে কষ্ট হয়। সাদিদ কখনও স্বীকার না করলেও নীলাতো বুঝে মানুষটা ভিতর থেকে তাকে নিয়ে কতটা ভয়ে রয়েছে। তাইতো প্রিয়জনকে সর্বদা এমন অস্থিরতায় জর্জরিত দেখলে নীলার মন কাঁদে।
নীলা তখন ওড়নাটা রুমেই রেখে এসেছিল। আবহাওয়াতে এখন বৃষ্টির পূর্বেকার শীতল হাওয়া বয়ে চলেছে। বোধহয় খানিকবাদেই প্রকৃতি বৃষ্টির নিজস্ব ঝনঝনিয়ে রিনিঝিনি আওয়াজে মুগ্ধ হবে।
শীতলতায় নীলার গায়ের লোমকূপ দাড়িয়ে যাওয়া স্বত্বেও সে এই মুহূর্তে নিজের অবস্থানে স্থির। নিজের ভিতরকার অনুভূতিগুলো যেন ফিকে পরেছে। কষ্টের সাথে অভিমান জমে পাহাড়ের উচ্চতায় পৌঁছেছে।

— ‘ এতো রাগ তার? সারাদিনে একটাবার খোঁজ পর্যন্ত নিলো না? এমনকি এতো গভীর রাগ পর্যন্ত নিজের রাগ-ক্ষোভ বজায় রাখতে অফিসে বসে রয়েছে? ‘

নীলার মনের অব্যক্ত কথাগুলো জবান হয়ে বের হলো না। শুধু বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো। উঁচু পেটটার উপর ডানহাতটা রেখে সে নির্নিমেষ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
খনিকবাদেই তার হাতের উপর আরেকটা বলিষ্ঠ শক্ত হাতের উপস্থিতি অনুভব করতেই নীলা চকিত হলো। কিন্তু পিছনের মানুষটার সামনে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। পূর্বেকার ন্যায় ভাবলেশহীনভাবে ঠাঁই দাড়িয়ে রইলো।
সাদিদ নীলার হাতটা সহ তার কোমড় পেঁচিয়ে ধরলো। অপরহাতটি বুকের উপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে উন্মুক্ত ঘাড়ে মুখ গোঁজল।
নীলা মৃদুভাবে কেঁপে উঠে আঁখিযুগল বন্ধ করে নিলো। প্রিয়তমের শরীরী উষ্ণতায় আর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির আঘাতে নীলার কোমল শরীরে শিহরণ বয়ছে। সাদিদ ঘাড়ে মুখ ঘষে ছোট্ট ছোট্ট চুমু খেতেই নীলার বন্ধ চোখ বেয়ে নিঃশব্দের নোনাজল বেড়িয়ে আসতে লাগলো। যা ক্রমশ নীলার মলিন মুখটাকে সিক্ত করে তুলছে।

— ‘ সরি। ‘

নীলা কোনো উত্তর দিলো না। আসলে গলা দিয়ে শব্দেগুলো বের হতে পারলো না। কেমন যেন কাঁটার মতো আটকে রয়েছে।
সাদিদ তার নীরবতা দেখে দুইহাতের বাঁধন আরও জোরালো করলো। বুকের সাথে নীলার পিঠ ঠেকিয়ে অভিমানিনী প্রিয়তমার ঘাড়ে এবার দৃঢ় চুমু খেলো। অতঃপর অপরাধী স্বরে আবারও বলল,

— ‘ সরি তো। ভুল হয়ে গিয়েছে। তখন রাগটা কন্ট্রোল করতে পারিনি। ‘

নীলা পেটের উপর রাখা সাদিদের হাতটা নিজেও চেপে ধরলো। চোখ বন্ধ করেই নিচুস্বরে বলে উঠল,

— ‘ ক্ষমা চায়তে হবে না। আমি কিছু মনে করিনি। ‘
— ‘ আমাকে তোমার বোকা মনে হয়? ‘

সাদিদের এই প্রতিউত্তরের পর নীলা আর কিছু বলতে পারলো না। মাথা নুইয়ে কেবল দাড়িয়ে রইলো। অপরদিকে প্রিয়তমার মন জয় করতে পাগল প্রেমিক দিশেহারা। পিছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে অভিমান ভাঙাতে আদুরে স্বরে ডেকে উঠল,

— ‘ বউ। ‘

নীলা এবারও উত্তর দিলো না। তাই সাদিদ আবারও ডাকলো। এমনকি ভিন্ন ভিন্ন নামে অনবরত ডাকতেই লাগলো,

— ‘ বউপাখি। ‘
— ‘ বাবাইয়ের আম্মু। ‘
— ‘ প্রিন্সেসের আম্মি? ‘
— ‘ কলিজা…
— ‘ চুপ করবেন আপনি? ‘

নীলার কন্ঠে খানিকটা বিরক্তির ছাপ। সাদিদ এতক্ষণে ঠোঁট এলিয়ে নিঃশব্দে হাসলো। প্রিয়তমার রাগ খানিকটা পরেছে সেটা উপলব্ধি করে চোখের পলকেই তাকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো। নীলা আকষ্মিক এমন কান্ডে হকচকিয়ে গেল। দ্রুত সাদিদের কাঁধ চেপে ধরে ভয় পাওয়া কন্ঠেই বলে উঠল,

— ‘ এসব কি? ‘
— ‘ ভালোবাসা। ‘
— ‘ কচুর ভালোবাসা। ‘
— ‘ খারাপ না। হেব্বি টেস্ট। ‘

নীলার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপেক্ষা করে সাদিদ তাকে সযত্নে বিছানায় হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো। খোলা চুলগুলোকে খালি হাতে একপাশ করে দিয়ে গায়ে কম্বল টেনে দিলো।

— ‘ আমার না থাকার এডভান্টেজ নিচ্ছিলে? গরম কাপড় ছাড়া বারান্দায় কেন গিয়েছিল? আর সেটার থেকেও বড় কথা এই সময়ে তুমি বারান্দায় কি করছিলে? আমি না করিনি? ‘

নীলা তার এতগুলো প্রশ্নের একটারও প্রতিউত্তর দিলো না। মুখ ফুলিয়ে কেবল অপরপাশে তাকিয়ে রইলো। সাদিদ কয়েক সেকেন্ড স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার কার্যকালাপ পরখ করলো। তখনকার মতো নয় বরং ধীরে সুস্থে নীলার কোলে মাথা রাখলো। নীলা এতেও নির্বাক। যেন সে আজ মৌনব্রত পালন করার তীব্র বাসনা প্রকাশ করেছে। সাদিদ কয়েক সেকেন্ড তার মুখপানে তাকিয়ে থেকে কাত হয়ে পেটে মুখ গোঁজল। এতে নীলা মৃদু কেঁপে উঠতেই সাদিদ দুষ্টু হাসলো। বারকয়েক পেটে ঠোঁটের অবাধ বিচরণ ঘটিয়ে অনাগত বাচ্চাটার সাথে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলো,

— ‘ বাবাই, একেবারে নো নড়ন-চড়ন। মা এইমুহূর্তে রেগে ফায়ার হয়ে আছে। নড়লেই বাবার মতো তোমার সাথেও রাগ দেখাবে। ‘

নীলা একপলক বাপ-বেটির কথা শুনে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিলো৷ মুখে তার চাপা হাসি।

— ‘ বাবা ভীষণ কষ্টে আছি রে প্রিন্সেস। তোমার মা, ধরতে গেলে তোমার থেকেও অবুঝ। এই যে তুমি বাবার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছো? মা কিন্তু একেবারে শুনে না। তোমার মা ভীষণ অবাধ্য। একেবারে অবুঝ। বাচ্চাদের ন্যায়…
— ‘ মা, এই মা। আপনার ছেলের মুখটা এসে সুচ দিয়ে সেলাই করে দিয়ে যান তো। বড্ড বেশি চলে। ‘
— ‘ দেখলে প্রিন্সেস তোমার মা কি অবুঝ? রাত বারোটার সময় স্বামী রুমে থাকা সত্বেও শাশুড়িকে ডাকছে! এতে বাবার কতটা লজ্জা লাগছে বুঝতে পারছো তুমি? ‘
— ‘ এই মা জলদি আসুন। বাবাকেও সাথে নিয়ে আসুন। আমার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। ‘
— ‘ সর্বনাশ প্রিন্সেস। মা এবার তোমার দাদাভাইকেও ডাকছে। এখন বাবা কি করবে? আমার কথাতো শুনে না। তুমিই তোমার অবুঝ মাকে বলে দাও। ‘

নীলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাদিদের মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। আর সাদিদ একেবারে নিষ্পাপ বাচ্চার মতো মুখ করে তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে। ঠোঁটের কোণে তার ঈষৎ লোকায়িত হাসির রেশ।
ক্ষীণ মুহূর্ত অতিবাহিত হতেই নীলা এবার ফিক করে হেসে উঠল। সাদিদের ঠোঁটের কোণও এবার বিস্তৃত হলো।

— ‘ আমাকে হাসাতে এসব ইচ্ছে করে করেছেন। তাইনা? ‘
— ‘ তাই না-কি? কই, আমিতো জানি না। তুমি জানো বুঝি? ‘

নীলা এবার আর রাগ দেখালো না। সাদিদের মুখটাতে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। পরনে এখনও অফিসের শার্ট। গলার টাইটা হালকা লুজ হয়ে আছে। চুলগুলো বড্ড এলেমেলো।
নীলা আলতো হাতে স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে দিলো। শার্টের বোতামের উপর হাত দিতেই সাদিদ খপ করে তার হাত ধরে ফেললো। সচকিত হয়ে বলল,

— ‘ একি করছো তুমি? এখন এইসব? এই অবস্থায় তুমি সহ্য করতে পারবে? ‘

নীলা ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে সাদিদের মুখপানে তাকিয়ে রইল। কি বললো সাদিদ?
একটু সময় লাগলেও নীলা অবশেষে কথাটার অর্থোদ্বার করতে সক্ষম হলো। আর তাতেই এলোপাতাড়ি সাদিদের বুকে কিল বসালো।

— ‘ আরে, আরে কি করো? ব্যাথা পাই তো। ‘
— ‘ সে নাকি ব্যাথা পায়? হাসতে হাসতে কুটিকুটি। ‘
— ‘ আচ্ছা আর হাসবো না। সত্যিই এবার ব্যাথা পাচ্ছি। ‘

নীলা হাত থামিয়ে দিলো। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। সাদিদ এবার দুষ্টুমি ছেড়ে উঠে বসলো। পাশ থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে সেটা নীলার মুখের কাছে ধরলো। নীলা নিঃশব্দে পানিটুকু শেষ করে সাদিদের বুকে হেলে পড়ল। সাদিদ পরম যত্নে তাকে নিজের বুকে আঁকড়ে নিয়ে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। খানিক বাদে নীলা স্বাভাবিক হয়ে উঠতেই সাদিদ আদুরে স্বরে বলে উঠল,

— ‘ এখন ঠিক লাগছে পাখি? ‘
— ‘ হুম। এখন ভালো লাগছে। আমার দিন বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে। অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যাই। আমি না থাকলে…

আচমকা গালে সজোরে থাপ্পড় পড়তেই নীলার কথাতে বিগ্ন ঘটলো। নীলা গালে হাত দিয়ে নির্নিমেষ সাদিদের মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। অপরদিকে সাদিদ রাগের তোপে থরথর করে কাঁপছে। ফর্সা কপালে ইতিমধ্যে নীল রগগুলো ভেসে উঠেছে।
নীলা অশ্রুসিক্ত চোখে সাদিদের দিকে তাকাতেই সে শক্ত হাতে বাহু চেপে ধরলো। রাগের বশে জোরে চেপে ধরাতে নীলা বেশ ব্যাথা পাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে সাদিদের এখন বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে এখন এই বেয়াদব মেয়েটাকে শায়েস্তা করতে ব্যস্ত।

— ‘ আজকে যদি প্রিন্সেস এখানে না থাকতো তাহলে তোকে আমি কি করতাম আমি নিজেও জানি না। খুব মরার শখ তাই না? খুব শখ? আমার বাঁচা মরা নিয়ে তোর কিছু আসে যায় না। তাই না? এই আমিটা যে একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে যাব এটাতে তোর দয়া হয় না? এতোটা পাষাণ তুই! বল পাখি। বল এমন খুনি কিভাবে হতে পারিস তুই? আমি..

সাদিদের কন্ঠ লেগে আসছে। সে নীলাকে ঝাড়ি মেরে ছেড়ে দিয়ে উল্টো ফিরে বসলো। দুইহাতে মাথার চুল টেনে ধরে নিজের মধ্যকার আগুনটা নেভানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
নীলা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ভেজা গাল মুছে নিলো। অতঃপর আস্তে ধীরে সাদিদের পিঠে হাত রাখলো। সাদিদ রেগে কাঁধ ঝাঁকি দিতেই নীলার হাতটা ছিটকে পড়ল। সে আবারও রাখলো এবং সাদিদ পূনরায় একি কাজ করলো। এবার নীলা সাদিদের রাগের পরোয়া না করে পিঠে মাথা এলিয়ে বুকে শক্ত করে হাত চেপে ধরলো।
সাদিদ কয়েকবার হালকাভাবে সরাতে চাইলো। কিন্তু নীলাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখতে দেখে আর চেষ্টা করলো না। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে নীলার হাতের উপর নিজের হাতটা রেখে সাদিদ ঘাড় ফিরিয়ে বলল,

— ‘ তখনকার জন্য সরি বলেছি বলে ভেবো না এখনকার জন্যও সরি বলবো। তুমি এটার প্রাপ্য ছিলে। তাই নিজের ভাগটা বুঝিয়ে দিলাম। বাট আই ওয়ার্ন ইউ বেবি, নেক্সট টাইম এমন হলে ছেড়ে দিবো না। একদম খবর করে ছাড়বো। ‘
— ‘ কয়টার খবর? ‘

সাদিদের এমন গুরুগম্ভীর কথার বিপরীতে নীলার এমন রসিকতায় পরিপূর্ণ কথা শুনে সাদিদ ভ্রুজোড়া বাঁকিয়ে নিলো। সে কপাল কুঁচকে নীলার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। অপরদিকে নীলার ঠোঁটের কোণে দুষ্টু-মিষ্টি হাসি।
সাদিদ কয়েকপলক স্থির থেকে আচমকা নীলার বাহুতে ধরে তাকে বালিশে শুইয়ে দিলো। নীলার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে শার্টের বোতামগুলো পরপর খোলে নিতেই নীলা কিছুটা হকচকিয়ে গেল। দ্রুত মাথা উঁচিয়ে উঠতে নিতেই সাদিদ শার্টটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নীলার উপর ভর না দিয়ে উপুড় হলো। নীলা কেবল গোল গোল চোখ করে সাদিদের কাজকর্ম দেখছে। অস্থিরতা চেপে না রাখতে পেরে অবশেষে বলেই উঠলো,

— ‘ কি.. কি কর..ছেন? ‘
— ‘ বারে, তুমিইতো বললে কয়টার খবর? তাই এবার বারোটার খবরের আপডেট জানাচ্ছি। ‘
— ‘ আমার কোনো আপডেট-টাপডেট লাগবে না। উঠুন বলছি। ‘
— ‘ কেন? কেন উঠবো? আমিতো নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। আজকে খবরের আপডেট তৈরি করে তবেই দম নিবো। ‘
— ‘ প্লিজ উঠুন৷ আপনার গায়ের ঘামের গন্ধে আমার গা গুলাচ্ছে। ‘
— ‘ তাই? ‘

দুষ্টু সাদিদ নিজের দুষ্টুমি তো কমালোই না উল্টো নিজের উন্মুক্ত বুক নীলার নাকের উপর নিয়ে গেল। অপরদিকে নীলা ছটফটানি শুরু করে দিয়েছে। সাদিদ তাকে আচ্ছামত জ্বালিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

— ‘ গা গুলাচ্ছে না-কি উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছো না সেটা কি আমি জানি না ভেবেছো? আমার গায়ের গন্ধ যে তুমি নাক টেনে টেনে শুঁকে নাও, এটার প্রমাণ কিন্তু দার্জিলিং-শ্রীমঙ্গলের আবহাওয়াগুলো পর্যন্ত জানে। ‘

কথাটুকু বলেই সাদিদ আবারও বাঁকা হাসলো। এবং নীলাকে আরেকদফা লজ্জায় ফেলতে চোখ টিপ দিলো।
নীলা ঘাড় ফিরিয়ে ঘন ঘন শ্বাস টানছে। এমন লজ্জাবাণে নীলার দম প্রায় আটকে আসছে। সে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে দুষ্টুটা কোন দিকে ইংগিত করে কথাগুলো বলেছে। সে অপরপাশে মুখ ফিরিয়েই মিনিমিনিয়ে বলল,

— ‘ অসভ্য একটা। ‘

সাদিদ বরাবরের মতো এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে ঠোঁট এলিয়ে হাসতে পারলো না। বরং তার মুখে যেন নিকষ কালো অন্ধকার ছেয়ে গিয়েছে। তখন রাগের বশে এই কাজটা করাতে এখন নিজের গালেই থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে হচ্ছে।
হালকা আলোতে প্রিয়তমার গৌর বর্ণের মুখশ্রীতে আঙুলের আঘাতের লালচে দাগটা যেন চকচক করছে। সাদিদ দুই আঙুলে সেখানে স্পর্শ করতেই ব্যাথায় জায়গাটা টনটনিয়ে উঠল। নীলা মৃদুস্বরে আহ্ করে উঠতেই সাদিদ দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। ক্রমশ অস্থিরতাভরা কন্ঠে অপরাধীর স্বরে বলে উঠল,

— ‘ না, না আর ধরবো না। আর ব্যাথা পাবে না। এই যে হাত সরিয়ে নিলাম। ‘

নীলা অশ্রুসিক্ত চোখে সাদিদের মুখপানে তাকিয়ে হাতটা টেনে আবারও গালে রাখলো। চোখ বন্ধ করে বারকয়েক সাদিদের হাতটা তার গালে বুলিয়ে সিক্ত কন্ঠে বলল,

— ‘ ইনশাআল্লাহ আপনার ছোঁয়ায় এই দেহ কখনও ব্যাথায় জর্জরিত হবে না। ‘

একটামাত্র বাক্য, কিন্তু সাদিদের নিকট একটন সুখের সমান। সে পরম আদরে নীলাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে কপালে ভালোবাসার দীর্ঘ উষ্ণ চুম্বন এঁকে দিলো।
অতঃপর দুইজনেই নীরবতার চাদর গায়ে দিয়ে কেবল একে-অপরের হৃদকম্পন শুনে যাচ্ছে। নীরবতার আচ্ছাদন ছেদ করে নীলাই বলল,

— ‘ ফ্রেস হবেন না? দেখেতো মনে হচ্ছে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত হয়নি। ‘
— ‘ হুম হবো। এখন একটু বউটাকে আদর করে নেই৷ তারপর বাদবাকি সব। ‘
— ‘ ইশশ না৷ যান তো। রাত অনেক হয়েছে। পরে শরীর খারাপ করবে৷ ‘
— ‘ তুমি আছো কি করতে? আমার মন প্লাস শরীর ভালো করার মেডিসিন থাকতে অসুস্থতা নিয়ে আমার কিসের চিন্তা? ‘

সাদিদের ঠোঁটের কোণে বরাবরের মতোই সেই মিষ্টি হাসিটা লেগে আছে। নীলা নিজেও নিঃশব্দে হেসে আলতো হাতে কপালে পরে থাকা সাদিদের সিল্কি চুলগুলো সরিয়ে দিলো। অতঃপর ঝুঁকে এসে সন্তপর্ণে নিজেও প্রিয়তমের কপালে কোমল অধরযুগলের উষ্ণ পরশ দিলো।
সাদিদ প্রশান্তির হাসি হেসে নীলাকে বুক পাঁজরে আঁকড়ে নিলো। মাথায় নিজের থুতনি ঠেকিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য চোখজোড়াকে বিশ্রাম দিলো।
কিন্তু নীলার বুকের ভেতরকার ছটফটানিটা এখনও যায়নি।
সে এতোটা অবুঝ নয় যে সাদিদের রাগের আড়ালের ভালোবাসাটা বুঝে উঠতে পারবে না। সে বুঝতে পারে। খুব বেশি ভালো করেই বুঝতে পারে। আর এইজন্যই তার যত চিন্তা। অবুঝ হলে হয়তো খানিকটা সময়ের জন্য এই দুশ্চিন্তাগুলো থেকে মুক্তি পেতে পারতো। কিন্তু এখন যে এটা সম্ভব নয়। আর না সম্ভব সাদিদকে সত্যটা জানানো। তাহলে হয়তো সে পাগলই হয়ে যাবে।
এমনিতেই নীলার সামান্য একটা আঘাতেই আজ এই পাগল ছেলেটা কি কান্ডটাই না করেছে! যদি কোনোদিন এই সত্যটা জানতে পারে তখন নীলা কি করবে? কিভাবে এই পাগলটাকে সামলাবে?
নীলা সামান্য ঘাড় উঁচিয়ে সাদিদের দিকে তাকাতেই দুইজোড়া আঁখির মিলন ঘটলো। কেননা সাদিদ একদৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। নীলা পূণরায় মাথা নিচু করে সাদিদের বুকে মুখ গোঁজল। তার অগোচরে চোখের জলটা সন্তপর্ণে মুছিয়ে নিলো।
না তাকে দুর্বল হলে চলবে না। সে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। যত যায় হয়ে যাক না কেন সৃষ্টিকর্তার নিকট নীলার কেবল এখন একটাই চাওয়া। সে থাকুক আর নাই বা থাকুক, তার কলিজার টুকরাটাকে যেন তার বাবার নিকট নীলা সহিসালামত পৌঁছে দিতে পারে। আর সেটা যে নীলাকে পারতেই হবে। নতুবা এই পাগলাটাকে যে নীলা বাঁচাতে পারবে না। নীলার সাথে হয়তো এই পাগলটাও নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে বসবে।

— ‘ তোর উপর অনেক বড় দায়িত্ব রে। মাকে ভুল বুঝিস না। ভাবিস না তোর ছোট্ট কাঁধে এতবড় দায়িত্ব মা কেন চাপিয়ে গেলাম। মায়ের আর কোনো উপায় ছিল না রে। মাকে পারলে ক্ষমা করে দিস। আর.. আর তোর পাগল বাবাটাকে সবসময় আগলে রাখিস। তুই ছাড়া তাকে যে আর কেউ সামলাতে পারবে না। একদমই পারবে না। ‘

নিজ মনের অব্যক্ত শব্দগুলো নীলা অন্তরালেই লোকায়িত রাখলো। মুখে জোর পূর্বক কৃত্রিম হাসি টেনে প্রিয়তমের বুকে যত্নে হাত বুলিয়ে দিলো। জীবনটা আরেকটু ভালোবাসাময় হলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে? আরও কয়েক বর্ষ হাতে হাত ধরে চললে কি খুব বড় অপরাধের অন্তর্ভুক্ত হবে?
নীলা তার কাঙ্ক্ষিত উত্তর খোঁজে পায় না। পায় কেবল নিঃশব্দের দীর্ঘশ্বাস।

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৫৮

সাদিদের চোখে-মুখে প্রচন্ড বিরক্তির ছাপ৷ সাথে যুক্ত রয়েছে হালকা রাগের আভা। কিন্তু নীলা এই মুহূর্তে শাশুড়ি বোনকে পেয়ে নিজের মধ্যকার ভয়টাকে সাদিদের সম্মুখে আসতে দিতে চায়ছে না।

— ‘ আমি কিন্তু এবার লাস্ট বার বলছি। এরপর কথা নয় ডিরেক্ট একশনে যাব। ‘
— ‘ মা দেখছেন, আপনার বজ্জাত ছেলে কি বলছে? আপনাদের সামনেই আমাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছে। ‘
— ‘ হে রে সাদি, সত্যিই তো। তুই আমার মেয়েটার পিছনে এমন হাত ধুয়ে লেগেছিস কেন? ‘
— ‘ তাহলে আর কি করবো? তোমাদের আদরের দুলালী আমার একটা কথা শুনতে চায়? ‘
— ‘ এমন কথা বলেন কি জন্য? সেগুলো মানা যায় না? ‘

সাদিদ পুনরায় একবার নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নীলার উপর ফেলে তাকে নিঃশব্দে শাসালো। কিন্তু নীলা সেসবের তোয়াক্কাই করলো না। সে যাবে মানে যাবেই। তার বেস্টুর বিয়ে বলে কথা। নীলার না গেলে কি হয়!

— ‘ দেখ সাদি, তুই কিন্তু এবার বেশি বেশি করছিস। সবাই গেলে নীলার কেন বারণ? ‘
— ‘ কেননা গতরাতেও তার শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না। এখন শান্তাদের বাসায় না যাওয়ার হলে এখনই ডক্টরের কাছে চেকাপের জন্য নিয়ে যেতাম। যেহেতু এখন যাচ্ছি না তাই ফিরে এসেই প্রথমে তাকে চেকআপের জন্য নিয়ে যাব। আর আমি চাই না অসুস্থ শরীর নিয়ে সে বারবার এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি করুক। ‘
— ‘ সে যেতে ইচ্ছুক। এমন করছিস কেন? ‘
— ‘ সে বহুত কিছু করতেই ইচ্ছুক। সেসবে আমার কান দিলে হবে না। ‘

নীলার সাদিদের এমন কথার পরিবর্তে সাদিদের অগোচরে ভেঙচি কাটলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত নীলার কার্যকলাপ সাদিদের নজরে পড়ে গেল। তাই তো আরও একদফা নীলা তার ভষ্মকারী দৃষ্টির সম্মুখীন হলো।
অবশেষে এতো আকুুতি মিনুতি করেও সাদিদের মন পাওয়া গেল না। সে নীলাকে নিয়ে গেল না যে নিয়ে গেলোই না৷ তার সেখানে উপস্থিত হওয়াটা প্রয়োজন বিধায় তাকে যেতে হয়েছে। নতুবা নীলার মন যেহেতু খারাপ ছিলো তাই আর যেত না৷
কিন্তু আফসোস। কি আর করার? থাক পরে ডাবল আনন্দ দিয়ে পুষিয়ে নিবে।

.

শান্তদের বসার ঘরে সাদিদ, তানবীর অর্ণবসহ হাসিবুর রহমান, শায়লা রহমান এবং শাহেদ বসা রয়েছে। সবার মুখ থমথমে। কেননা এই ছেলেটার হাসিমাখা মুখের পিছনে যে এতটা কষ্ট লোকায়িত ছিলো তারা কেউ সেটা বুঝে উঠতে পারেনি৷
আচ্ছা এই ছেলেটা না হয় তাদের আপন মনে করে বলেনি। কিন্তু পেটের ছেলেটা!
সে কিভাবে এত বড় সত্য তাদের থেকে গোপন করে গিয়েছে! কিন্তু তারা অবাক হলেও শান্তর বাবা কামাল শেখ এসবে বড্ড বিরক্ত। প্রথম দিকে ছেলের আর্থিক অবস্থা এবং প্রশংসা শুনে মনে মনে বেশ আনন্দ পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন বেশ বিরক্তির রেশ তার চোখে-মুখে।

— ‘ তাহলে এখন আপনারা কি চাচ্ছেন? আমি আমার মেয়ের এতো ভালো সমন্ধ ভেঙে দিয়ে এই রকম একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিব? আগেই বলে দিলাম আমার থেকে ভুলক্রমেও এমনটা আশা করবেন না। কেননা এটা কখনও হবার নয়। ‘

এমনিতে এই প্রসঙ্গটা উঠলে তানবীরের মুখটা মলিন হয়ে যায়। কিন্তু কামাল শেখের এমনভাবে বলাতে তার চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। সে হাতের মুঠি শক্ত করে রাগের বশে কিছু বলে উঠতে গেলেই সাদিদ তার ডানহাত চেপে ধরলো। তাকে কথা বলতে আটকে দিয়ে চোখের পলকে ইশারা করে নিজেই বলল,

— ‘ আঙ্কেল, আমরা আপনাকে আপন ভেবে সবটা সত্য জানিয়েছি। আপনাদের আগে কিন্তু আমার ফ্যামিলির লোকজনও সেটা জানতে পারেনি। আজকে এটা বলার খুব প্রয়োজন অনুভব করায় আমরাই আপনাদেরকে বলে দিয়েছি৷ যদি আমরা সেটা গোপন রাখতে চাইতাম হলফ করে বলতে পারি আপনাদের কখনও জানা সম্ভব হতো না। কিন্তু আমরা সেটা করিনি৷ কেননা নতুন একটা সম্পর্ক কখনও মিথ্যার আশ্রয়ে তৈরি করা উচিত নয়। সেটা ভেবেই আমরা আপনাদেরকে তানবীরের কৈশোরের বিয়ের কথাটা জানিয়েছি৷ শুধু আপনারা নন। শান্তাও এটা অনেক আগে থেকেই জানে৷ আর সে সবটা সত্য জেনেই তানবীরকে আপন করে নিতে চায়। এখন আপনিই বলুন মেয়ের খুশি বেশি না-কি আপনার অহংকার?
দেখুন আমাদের জীবনের এক সেকেন্ডের ভরসা নেই। আগামিকাল কি হবে সেটা আমরা কেউ জানি না৷ আল্লাহ না করুন আজকে আপনি শান্তার খুশির পরোয়া না করে আপনার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন৷ আর আমি এটাও জানি শান্তার মতো মেয়ে কখনও বাবার সিদ্ধান্তের বাহিরে যাবে না। সবই হলো। কিন্তু আজ বাদে কাল গিয়ে ঐ ছেলেটাই অপর নারীতে আসক্ত হয়ে যাক৷ বিয়ে করে ঘরে তোলে আনুক তার অপর বউকে। তখন কি মেয়ের মুখে হাসি দেখতে পাবেন? নাকি যেই সুখের জন্য মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে দিলেন সেই সুখ দেখতে পারবেন?
আমি বলছি না এমনটাই হবে। কিন্তু ভবিষ্যৎ আমরা কে বলতে পারি? তাই আঙ্কেল, প্লিজ একটাবার অহংকার, রাগ, জেদ, তানবীরের অতীতের কালো স্মৃতি এগুলো সাইডে রেখে মেয়ের সুখের কথা ভাবুন। মনে শান্তি না থাকলে পৃথিবীর অন্য কোনো কিছুতে শান্তি পাওয়া যায় না৷ তাই প্লিজ একটাবার সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে তাদের একে-অপরের প্রতি ভালোবাসাটা দেখুন। আমার বন্ধুটা জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। অবশেষে আপনার মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরে একটু সুখে বাঁচতে চায়। প্লিজ তার থেকে এই সুখটা কেঁড়ে নিয়েন না। আমি হলফ করে বলতে পারবো আমার ভাইয়ের থেকে বেশি ভালো আপনার মেয়েকে আর কেউ বাসতে পারবে না। প্লিজ আঙ্কেল একটাবার গভীরভাবে ভেবে দেখুন। ‘

পরিস্থিতিটা যেন ক্রমশ ঘোলাটে থেকে ঘোলাটেতে পরিণত হচ্ছে। শান্তর মা-বাবা একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। অপরদিকে শায়লা রহমান হাসিবুর রহমানও তাদের থেকে প্রত্যাশিত উত্তর পেতে মুখিয়ে আছেন। তাদের ছোট ছেলেটা মা-বাবার হয়ে যেন সবটাই খুব বিচক্ষণতার সহিত তোলে ধরেছে৷ তাদের জন্য একটা শব্দও যেন বাকি নেই। তারপরও গুরুজন হিসেবে দায়িত্ব পালনে শায়লা রহমান বিনয়ের সাথে বললেন,

— ‘ দেখেন ভাই সাহেব, হয়তো বা ছেলেটা আমার পেট থেকে জন্ম নেয়নি। কিন্তু আমি কখনও আমার দুই ছেলের থেকে এই দুইজনকে কম দেখেনি৷ তানবীরটা তো আরও কাছের। সব সময় নিজের দুষ্টুমিতে ঘরটা ভরিয়ে রাখতো। কিন্তু কেবলমাত্র থাকার ঘরটাই আলাদা ছিল। নতুবা সর্বদা ঘরের ছেলের মতোই থাকতো। আর আমি যদি ঘুনাক্ষরে এই ঘটনার টের পেতাম তাহলে কিছুতেই তাকে নিজের থেকে আলাদা রাখতাম না। কিন্তু কি করবো বলেন? এই পাঁজিদুটো এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরও আমাদের কিছু জানতে দেয়নি। আজকে এখানে উপস্থিত না থাকলে তো আমরা কখনও এটা জানতেই পারতাম না। তাই ভাইসাহেব, আপনি যেটাই সিদ্ধান্ত নেন না কেন এই ছেলেটার অতীত বিবেচনা করে নিয়েন না। ছেলেটা আমার লাখে এক। আপনার মেয়েটাকে সবসময় খুশিতে রাখবে৷ ‘
— ‘ হ্যাঁ আঙ্কেল। আপনার মেয়ের হাতটা খুশিমনে আমার ভাইটার হাতে তোলে দিন। ইনশাআল্লাহ কখনও আফসোস করার সুযোগ পাবেন না। ‘

তাদের সবার এতো আবদার অনুরোধের পর কামাল শেখের মনটাও ক্রমশ নরম হয়ে আসতে চায়ল। তিনি একপলক নিজের মেয়ের দিকে তাকালেন৷ সব সময় দুষ্টুমিতে মেতে থাকা মেয়েটা আজ কেমন ভয়ে চুপসে গিয়েছে। তিনি আদুরেস্বরে মেয়েকে কাছে ডাকলেন,

— ‘ মা, কাছে আয়। ‘

শান্ত গুটিগুটি পায়ে বাবার পাশে এসে দাড়ালো। কামাল শেখ তাকে বসতে বলতেই সে মাথা নিচু করে সোফায় বসে পড়ল।

— ‘ তোর সাথে জুলহাজের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। সামনেই বিয়ের ডেইট। আমারই ভুল হয়েছে মেয়ের থেকে কোনোরকম ইচ্ছা অনিচ্ছা জানতে চাইনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বড্ড ভুল করে ফেলেছি রে মা৷ তোর মুখে যে হাসি দেখতে জুলহাজের সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছিলাম, সেই হাসিটার লেশমাত্র তোর মুখে নেই। তোর বাবাতো এতটা খারাপ নয়। কেন তখন তানবীরের কথা আমাদের জানাসনি? বল কেন? ‘

শান্ত এবার ভয় ভুলে বাবার বুকে মাথা দিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠল। কান্না মিশ্রিত ভাঙা গলায় বলে উঠল,

— ‘ আমি ভয় পেয়েছিলাম বাবা। সত্যিই খুব ভয় পেয়েছিলাম৷ তোমরা হঠাৎ করে এতসব করে ফেলেছিলে যে আমি কিছু বুঝার সুযোগ অব্দি পাইনি। ‘

কামাল শেখ মেয়ের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিলেন। অতঃপর মায়া নিয়ে বললেন,

— ‘ এখন তুই কি চাস বল? তোর সিদ্ধান্তই শেষ সিদ্ধান্ত। তুই যদি তানবীরের অতীত মেনে নিয়ে সুখী হতে চাস আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমরা যে কেবল তোর সুখটাই চায়। সেইজন্যই সবথেকে ভালো ছেলেটার হাতেই আদরের মেয়েটাকে তুলে দিতে চাই। বল মা, তুই কি চাস বল। ‘

__________________

নীলা বারবার দেয়াল ঘড়িটা দেখে যাচ্ছে। সাদিদের সাথে অভিমান করে তাকে কল দেয়নি। কিন্তু বাদবাকি কাউকে কল দিতে সে বাকি রাখেনি৷ কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কেউ তার কল রিসিভ করছে না। সেইজন্য নীলা তাদের সকলের প্রতি খানিকটা বিরক্ত। আর সাদিদের উপরতো বিরক্তির কোনো মাত্রা-সীমানা নেই। একমাত্র এই মানুষটার জন্যই নীলাকে এই অস্থিরতায় ডুবে থাকতে হচ্ছে। নতুবা নিজেই সেখানে উপস্থিত থাকতে পারতো।

— ‘ হুহ। আমার বেস্টুর বিয়ের কথা হচ্ছে অথচ আমিই না-কি থাকতে পারবো না৷ এই জন্যই বলা হয় মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। যতসব আধিখ্যেতা ‘
— ‘ আর তোমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়া-পড়শির ঘুম নাই। ‘

নীলা আগত শব্দের উৎসের দিকে ফিরে তাকালো। সাদিদসহ সদরদরজায় সবাই দাড়িয়ে রয়েছে। নিধি একটু আগেই বাড়ির পিছনের সবজি বাগান থেকে গ্রিন ক্যাপসিকাম আনতে গিয়েছে। তাই দরজাটা খোলাই ছিলো। তাই ভেতরে প্রবেশ করতে তাদের আর বেল বাজাতে হয়নি। এবং এখন নীলাকে উদ্দেশ্য করে এই অপমানসূচক বাক্যটা সাদিদের মুখ থেকেই বের হয়েছে। সে সবাইকে দেখে উত্তেজনায় হাঁসফাঁস করলেও সাদিদের সামনে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না। বড্ড অভিমান যে জন্মেছে৷
হাসিবুর রহমান আর শাহেদ শান্তদের বাসা থেকে ডিরেক্ট অফিসে চলে গিয়েছে। নীলার ডক্টরের কাছে এপয়েন্টমেন্ট আছে বিধায় সাদিদ আর যায়নি। তাই এখন তার সাথে শায়লা রহমানসহ কেবল তানবীর আর অর্ণবই রয়েছে।
নীলার ক্রমশ অস্থিরতাপূর্ণ মুখশ্রী কারো নজরে এড়ালো না। তাই তাদের মধ্যে থেকে অর্ণবই রসিকতার স্বরে বলে উঠল,

— ‘ সব সম্পর্ক একত্রিত হয়ে যে বিশাল প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে। প্রথম ছিলে বোন। এখন ভাবি। আবার এখন হিসেব করলে দেখা যায় বিয়াইন। কোনটা ডাকবো? ‘
— মানে? ‘

নীলা গোল গোল চোখ করে অর্ণবের মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। বিষয়টা তার মাথাতে ঢুকেনি। নীলার এমন মুখখানা দেখলে সাদিদের বরাবরই হাসি পায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। সে হাসিমুখেই সোফায় এসে নীলার পাশে বসলো। অর্ণব তার জন্য সহজ করতে আবার বলল,

— ‘ মানে হচ্ছে ভাইয়ের বউয়ের বান্ধবীরদের তো বেয়াইন সাহেবাই ডাকতে হয়। কিরে জামাই মিয়া, ঠিক বললাম তো? ‘
— ‘ আবার জিগায়। তা শালিকা সাহেবা জিজুর সেবাযত্ন না করে তাকাইয়া আছো ক্যান? যাও যাও৷ ঠান্ডা-টান্ডার ব্যবস্থা করো। মাথা এমনিতেই আমার ভীষণ গরম। শশুরমশাই হেব্বি ডেঞ্জেরাস৷ গরম গরম কথা কইয়া আমার ঠান্ডা মাথা রীতিমতো গরম কইয়া দিছে। ফিলিং সো হট শালিকা। ‘

বলেই সে দুষ্টুমি করে নীলাকে চোখ টিপলো। এতক্ষণে সবকিছু বুঝে উঠতে পেরে নীলার খুশি আর দেখে কে। সে যে ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা এটা ভুলে গিয়ে লাফিয়ে উঠল। আর তাতেই সাদিদের ফ্রিতে ধমক।

— ‘ এই মেয়ে, জ্ঞান বুদ্ধি কি দিনদিন লোপ পাচ্ছে? এমন অবস্থায় কেউ লাফ দেয়? বিয়ে কি তোমার নাকি? ‘
— ‘ ইশশ সাদি মেয়েটাকে শুধুশুধু ধমকাস কেন? আদর করে বললেই তো বুঝে যায়। ‘
— ‘ শুধুশুধু মানে কি? এই মেয়েকে তো দিনরাত মাইরের উপরে রাখা উচিত। আর আদর! এমনিতেই বাঁদর হয়ে অনবরত আমার ঘাড়ে চেপে নাচছে। ‘

এমন অপমান বাক্য শুনে নীলার অভিমানের পাহাড়ের চূড়া যেন আরও দীর্ঘায়িত হলো। তাই সে মুখটা লটকিয়ে নিঃশব্দে রুমের দিকে পা বাড়ালো। তার খুশি এই ব্যক্তির কোনো কালেই হজম হয় না। নীলার সুখের সাথে এই ছেলের অদৃশ্য এক শত্রুতা রয়েছে।
অপরদিকে নীলার যাওয়ার পাণে তাকিয়ে থেকে সবাই মুখ টিপে হাসছে। দুইজনের ভালোবাসার গভীরতাটুকু কারও কাছে আর অজানা নয়। তারপরও সবসময় কেমন খুনসুটিতে মেতে থাকে!
সাদিদ নীলার গমনপথের দিকে তাকিয়ে নিজেও রুমের দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু যাওয়ার আগে তানবীরের দিকে তাকিয়ে শাসানোর স্বরে বলে গেল,

— ‘ ভাবী। বুঝেছিস? অনলি ভাবী। আরও ভালো হয় ভাবী মা ডাকলে। নো শালিকা-টালিকা। এসব সম্বোধন তার স্বামী একদম টলারেট করবে না। ‘

বলেই সে হনহনিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। অপরদিকে তানবীর ভয়াতুর ভঙ্গিতে বুকে থুথু ছিটিয়ে নিচুস্বরে মিনমিনিয়ে বলল,

— ‘ শালা হারামি, বউ প্রেগন্যান্ট তারপরও হেতের ভাবভঙ্গি এমন যেন হের গার্লফ্রেন্ডের লগে লাইন মারতে আইছি। ‘

অর্ণব নিধি তার নাটকীয়তা দেখে সশব্দেই হেসে উঠল। শায়লা রহমান আর এসব ঠোঁটকাটা ছেলেপুলের সামনে থাকতে চান না৷ তাই নিজ সম্মান বাঁচিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।
সাদিদ রুমে এসে দেখলো নীলা মুখ ফুলিয়ে ডেসিং টেবিলের সামনে বসে চুলে চিরুনি করছে৷ সে সেইদিকে না গিয়ে গম্ভীরস্বরেই বলল,

— ‘ ডক্টরের কাছে যেতে হবে৷ দ্রুত রেডি হয়ে নাও। ‘
— ‘ যাব না আমি। ‘
— ‘ কি বললে আবার বলো। ‘

নিচুস্বরের এমন গম্ভীর ধমকিতে নীলা এতক্ষণের নিজের জমানো জেদ ছাড়তে বাধ্য হলো। এই ছেলেটা খারাপ। খুব বেশিই খারাপ। নীলা তার সামনে রাগ-ক্ষোভ কিছু দেখাতে পারে না। তাই সে মিনমিনিয়েই বলল,

— ‘ না মানে বললাম রেডি হচ্ছি৷ ‘
— ‘ এমনটাই বলেছিলে? ‘
— ‘ জ্বি। ‘

বলেই নীলা মাথা নিচু করলো। সাদিদ ঠোঁট চেপে নিজের হাসি আটকিয়ে এগিয়ে গেল। নীলার একেবারে মুখোমুখি দাড়িয়ে নীলার কোমড়ে দুইহাত রেখে তাকে কাছে টেনে নিলো। মুখে মৃদু ফুঁ দিতেই নীলার চোখের পাতা বার কয়েক কেঁপে উঠল। সাদিদ মুখ এগিয়ে তার সেই কাঁপা চোখের পাতায় চুমু খেতেই নীলা তার কাঁধ চেপে ধরলো। সাদিদ ঘাড় বাঁকিয়ে একবার নিজের কাঁধের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। দেরী হয়ে যাচ্ছে বিধায় এখন দুষ্টুমির মনোভাব বর্জন করলো। নীলার হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেই বাকি চুলগুলো চিরুনি করে দিলো৷ তারপর খুব যত্নে বিনুনি করে দিলো। নীলার এই অবস্থায় সাদিদ এটা খুব ভালোভাবেই রপ্ত করেছে। নীলা আয়নাতে নিজেদের প্রতিববিম্বের উপরে তাকিয়ে প্রশান্তির হাসি হাসলো। সাদিদ তাকে আপনমনে হাসতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,

— ‘ হাসো কেন? ‘
— ‘ না এমনি। আচ্ছা বিয়ের ডেট কবে? তেমন কিছু কি ফিক্সড করা হয়েছে? ‘
— ‘ হ্যাঁ ফিক্সড তো করা হয়েছে। কিন্তু শান্তাদের পারিবারিক কিছু জটিলতার জন্য একটু পিছিয়ে গিয়েছে। একেবারে তোমার ডেলিভারির ডেটের কাছাকাছি। বউ, আমারতো এখনই চিন্তা হচ্ছে। তখন তোমাকে একা রেখে আমি কিভাবে দায়িত্ব সামলাবো? আমার যে এখন থেকেই ধম আটকে যাবার জোগাড়। ‘

সাদিদের অস্থিরতাটুকু দেখে নীলার এতক্ষণের নিজের মধ্যকার সুপ্ত অস্থিরতাটা বের হয়ে আসতে চায়ছে৷ কিন্তু সে জোরপূর্বক সেটা উপচে ফেলে দিয়ে উঠে দাড়িয়ে সাদিদের বুকে মাথা রাখলো। চোখ বন্ধ করে সাদিদের পিঠে আলতো করে হাত চেপে ধরলো।
সাদিদ তার কাজে নিঃশব্দে মৃদু হেসে নীলার চুলের ভাঁজে চুমু খেল। মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে নীলার চুলে যত্নে হাত বুলিয়ে দিলো। আদরমাখা কন্ঠে ডাকলো,

— ‘ পাখি৷ ‘
— ‘ হুম? ‘
— ‘ ডক্টরের কাছে যাবে না। ‘
— ‘ উহু। ‘
— ‘ সেটা কেমন কথা? না গেলে হবে? চুপচাপ আসো। ‘
— ‘ ইশশ না৷ ‘
— ‘ তাহলে কি? ‘

নীলা উত্তর দিলো না। শুধু চুপ করে সাদিদের বুকে মাথা চেপে রাখলো। সাদিদ সেটা দেখে দুষ্টুমির ফন্দি আটলো। নিচু হয়ে নীলাার কানের কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে উঠল,

— ‘ বউটা কি আদর চাচ্ছে? একটু বেশিই আদর? ‘

নীলা চমকিত দৃষ্টিতে মাথা উঁচিয়ে সাদিদের মুখপানে তাকালো। সাদিদের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। তাই সে আলতো করে সাদিদের বুকে একটা কামড় বসিয়ে দিলো৷ সরে যেতে যেতে নিচুস্বরে বলল,

— ‘ বদের হাড্ডি। ‘

কিন্তু এই বদের হাড্ডি সাদিদ তাকে যেতে দিলে তো? সে পিছন থেকে নীলার পেট জড়িয়ে ধরলো। বারকয়েক উঁচু পেটে আদুরেভাবে হাত বুলাতেই নীলার শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠল। সাদিদ সেটা বেশ ভালোভাবেই অনুভব করতে পারলো৷ অতঃপর মোহনীয় স্বরে বলল,

— ‘ সাথে ভালোবাসার কাঙাল। তোমার প্রেমেতে উন্মাদ। তাইতো প্রিয়তমা তোমাতে মিশে আমি লেখতে চাই ভালোবাসার শত উপন্যাস। গড়তে চাই হাজারো স্বপ্নের দুনিয়া। বুনতে চাই আমাদের ভালোবাসায় রঞ্জিত কারও কোমল মুখশ্রী। ‘

এহেন প্রেমময়ী বাক্যে নীলার শিরদাঁড়া দিয়ে ক্রমশ ঠাণ্ডা স্রোত বেয়ে চলছে। এমন আদরমাখা বুলি শুনলে কি আর স্বাভাবিক থাকা যায়? মন যে বলে যায় না। বুকে যেন কেমন অস্থিরতা বিরাজ করছে। নিজেকে একেবারেই উল্টো পাল্টে দেবার ক্ষমতাধারী অস্থিরতা।

#চলবে…