অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-৫৯+৬০

0
873

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৫৯

ডক্টরের চেম্বারে মুখোমুখি বসে রয়েছে সাদিদ আর ডক্টর ফারজানা করিম। সাদিদের পাশের চেয়ারেই নীলা জড়সড় হয়ে বসে অনবরত হাতের নখ খুঁটে যাচ্ছে। ভাবটা এমন যেন খুব বড় কোনো অন্যায় করে সেটা ধামাচাপা দেবার সর্বোচ্চ প্রয়াস।

— ‘ কেমন দেখলে ওকে? সবকিছু ঠিক আছে তো? ‘

ডক্টর একবার নীলার দিকে তাকালো৷ নীলার মুখে ভীষণ অসহায়ত্বের ছাপ। যেন নিঃশব্দে তার নিকট কত আকুতি-মিনুতি করছে।

— ‘ সেটা তোমার বউকেই জিজ্ঞেস করো। ‘

সাদিদ এবার কিছুটা চমকিত দৃষ্টিতে নীলার মুখপানে তাকালো। নীলার দৃষ্টি ভয়াতুর, প্রচন্ড এলেমেলো। ‘
— ‘ নীলাঞ্জনা? ওকে কি জিজ্ঞেস করবো? চেক-আপ তো তুমি করলে! ‘
— ‘ সাদিদ…

ডক্টরকে তার বাক্য সমাপ্ত করতে না দিয়ে নীলা দ্রুত বলে উঠল,

— ‘ প্লিজ আপনি একটু বাহিরে যান। উনার সাথে আমার কিছু পারসোনাল কথা রয়েছে। ‘

সাদিদ যেন এবার আকাশ থেকে পরলো। সেই চমকিত ভাবটা নিয়েই সে বলল,

— ‘ মানে কি? তোমার পারসোনাল আর আমার পারসোনাল তো একই কথা৷ আমার সামনে কিসের সংকোচ? ‘
— ‘ প্লিজ একটু যান। প্রয়োজন বিধায় বলেই আপনাকে বলছি। ‘

সাদিদের চোখে-মুখে রাজ্যের বিরক্তি মিশ্রিত হালকা রাগের আভাস। কিন্তু ডক্টরের সামনে সে নিজেদের ব্যক্তিগত বিষয় তোলে ধরতে চায় না। তাই আরও একবার নীলার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে বাহিরে বেড়িয়ে আসলো।
সাদিদকে চলে যেতে দেখে নীলা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু ডক্টর সাথেসাথেই তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

— ‘ এটা তুমি ঠিক করোনি নীলা। আমি তোমাকে দুইদিন আগেই বিষয়টা জানিয়েছি। কিন্তু সাদিদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে সে এখনও কিছুই জানে না। এসবের মানে কি? ‘
— ‘ আমি এতকিছু জানি না ডক্টর। শুধু জানি উনাকে কিছুতেই এই সত্য জানানো যাবে না। তাহলে আমি তাকে সামলাতে পারবো না। ‘
— ‘ তুমি যতটা সহজে এই কথাটা বললে বিষয়টা কিন্তু এতটা সহজ নয়। আর তুমি হাজার চেয়েও এটাকে গোপন করে রাখতে পারবে না। যেমনটা গতকাল রাতে তোমার হয়েছিল এমনটা এখন থেকে প্রায়ই হবে৷ কতবার তুমি সাদিদের থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখবে? একবার-দুইবার তারপর? তুমি পারবে না। কেননা সাদিদের মতো বিচক্ষণ ব্যক্তি তোমার শারীরিক অবস্থা দেখেই বুঝে নিবে তুমি ঠিক নেই। তখন কি করবে? ‘
— ‘ আমি জানি না ডক্টর। আমি কিছু জানি না। শুধু জানি উনাকে আমি আর কষ্টে দেখতে পারবো না। এমনিতেই আমার জন্য উনাকে কম কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। ‘
— ‘ নীলা বোকার মতো কথা বলো না৷ সাদিদ তোমার স্বামী। তোমার প্রতি তার কেয়ার থাকাটা স্বাভাবিক। তাই বলে তার কষ্ট হবে সেই চিন্তা করে এমন একটা বিষয় তার নিকট হতে গোপন করা কোনোদিক দিয়েই উচিত হবে না। ‘

নীলা এই প্রশ্নের কোনোরূপ উত্তর দিতে পারলো না। কেবলমাত্র বিনাবাক্য মাথা নিচু করে রাখলো। ডক্টর ফারজানা করিম একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে আবার বলল,

— ‘ দেখো নীলা, তুমি আমার ছোট্ট বোনের মতো। আর সাদিদ আমার খুব কাছের একজন। তুমি হয়তো জানো না কলেজ লাইফে এই ছেলেটাকে আমি তিন তিনবার প্রপোজ করেছিলাম। ‘

এমন ভয়ানক একটা শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই নীলা গোল গোল চোখ করে তার দিনে দৃষ্টি দিলো। নীলার বিম্ময়ভরা দৃষ্টি দেখে ডক্টর মুচকি হাসলেন। অতঃপর বেশ আরাম করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রাশভারি কন্ঠে আবারও বলল,

— ‘ ঠিকই শুনেছ। সাদিদ ইবনে শাহরিয়ার উরফে তোমার হাসবেন্ডকে এই ডক্টর তিনবার কলেজ লাইফে প্রপোজ করেছে। কিন্তু আমার পোড়া কপাল। তোমার ঘাড়ত্যাড়া স্বামী আমার আশাভরসায় বরাবরই পানি ঢেলেছে। শুধু আমি নই। তার ব্যক্তিত্ব এবং সুদর্শন গুণের কারণে কলেজের অনেক মেয়েই তার পিছনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকত।
কিন্তু সে বরাবরই এসব বেশ বিচক্ষণতার সাথে এড়িয়ে গিয়েছে।
কিন্তু জানো? সাদিদের এই রিজেকশন নিয়ে আজ আমার কোনো আফসোস নেই। বরং স্বামী সংসার নিয়ে বেশ সুখে আছি।
কিন্তু একটা হাসির বিষয় কি জানো? তোমাদের ভাইয়া কিন্তু সাদিদের সিনিয়র। আর সাদিদকে সে ভীষণ স্নেহ করতো। বলতে পারো তার সাথে আমার মেলবন্ধনের সবটার কৃত্বিতই কিন্তু সাদিদের। থাক সেটার বিস্তারিত না হয় আজ না বলি। কিন্তু যেটা বলতে এতগুলো কথা বললাম সেটা শুনবে না? যেদিন সাদিদ সর্বপ্রথম তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসে, মিথ্যা বলবো না কিন্তু পেসেন্টের শারীরিক অবস্থার থেকে ঐদিন সাদিদের পাগলামিগুলোই আমি বেশি খেয়াল করেছি। এমনটা বলছি বিধায় রাগ করো না প্লিজ। কিন্তু সত্য বললে সেদিন এমনটাই হয়েছিল।
যাকে কখনও মেয়েদের আশেপাশে ঘেঁষতে দেখিনি। কলেজের সবাই যাকে আইন্সটাইনের দ্বিতীয় ভাই বলে খেপাতো তাকে কোনো মেয়ের প্রতি এতটা পাগলামি করতে দেখে সত্যিই আমি বেশ অবাক হয়েছি।
এখন বুঝতে পারছি এক জীবনের সবটুকু ভালোবাসা সে তোমার জন্যই বরাদ্দ করে রেখেছিল। তাইতো সেই অংশে কাউকে ভাগ বসাতে দেয়নি। অতি যত্নে হৃদমাঝারে সংরক্ষণ করে রেখেছিল।
আর তুমি কি-না এমন একজন ভালোবাসার মানুষ থেকে এই সত্যটা গোপন করতে চাও? সে এটা জানতে পারলে কতটুকু কষ্ট পাবে সেই সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে? ‘

নীলা এতটুকু শুনেই আচমকা টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তার নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। কি করবে সে? তার এই মুহূর্তে কি করা উচিত?

— ‘ আমি কিছু জানি না ডক্টর। প্লিজ আমাকে এই অবস্থা থেকে বের হতে সাহায্য করুন। এসব ভাবলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ উনি.. উনি আমাকে ছাড়া কিছু বুঝতে চায় না।
অপরদিকে আমি যে মা। আমাদের ভালোবাসার অংশটাকে এই ছয়টা মাস ধরে নিজের মধ্যে আগলে রেখেছি। উনিও এই নতুন অতিথির আগমনী বার্তায় ভীষণ খুশি। রোজ রাতে তো এই ছোট্ট প্রাণটার সাথে কথা না বললে নাকি তার ঘুমই আসে না। সারাদিন কানের কাছে প্রিন্সেস বলে বলে হয়রানি করতে থাকে।
এখন আমি কি করতে পারি? একটা না একটা তো ছাড়তেই হবে৷ তাই আমার সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে নিয়েছি। যদি আমার অবস্থা খুব বেশি খারাপের দিকে চলে যায় আপনারা আর কিছু নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকবেন না৷ আমি বাঁচি আর নাই বা বাঁচি, কিন্তু আমার বাচ্চাটাকে আপনাদের বাঁচাতেই হবে ডক্টর। আমার জীবনের চিন্তা করে ওর যেন কিছু না হয়। ওর কোনো ক্ষতি আমি সহ্য করতে পারবো না। ওকে বাঁচতে হবে ডক্টর। ওর জন্মদাতার জন্য হলেও ওকে বাঁচতে হবে। নতুবা ওর বাবাকে কেউ সামলাতে পারবে না ডক্টর। কেউ না। ‘

নীলার কথা বলতে বলতে হেঁচকি উঠে গিয়েছে। কিন্তু ডক্টর ফারজানা নির্বাক। সে কেবল চোখে-মুখে ভয়ার্তের ছাপ নিয়ে দরজার পাণে তাকিয়ে রয়েছে। সে শুকনো একটা ঢুক গিলে একবার নীলার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার সাদিদের দিকে।
সাদিদের হাবভাব বুঝা যাচ্ছে না। কেবল নীলার দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে থমথমে গলায় বলল,

— ‘ উঠো। ‘

নীলার কান্না মুহূর্তেই যেন থেমে গেল। সে নিজেও ভয়াতুর চোখে সাদিদের মুখপানে তাকালো। বুঝার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে সাদিদ কিছু শুনে ফেলেনি তো?
নীলাকে ঠাঁই বসে থাকতে দেখে সাদিদ এবার তার বাহু চেপে ধরে নিজেই দাঁড় করালো।
হালকা ব্যাথায় নীলা চোখ-মুখ কুঁচকে নিয়েছে। কিন্তু সাদিদ সেদিকে না দেখে ডক্টরের উদ্দেশ্য আসছি বলে নীলাকে একপ্রকার জোরপূর্বক ই কেবিন থেকে বাহির করলো। বিনাবাক্য লম্বা লম্বা পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। এই অবস্থায় সাদিদের পায়ের সাথে পা মিলিয়ে চলতে নীলা হাঁপিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রচন্ড ভয়ে মুখ দিয়ে একটা টু শব্দ বের হলো না।
সাদিদ নীলাকে নিয়ে সোজা পার্কিং এড়িয়াতে আসলো। ফ্রন্টসিটের দরজা খোলে দিয়ে তাকে সীটে বসিয়ে দিলো৷ নীলা এবার সাহস করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সাদিদ গাড়ির দরজা লক করে যেদিক দিয়ে এসেছিলো হনহনিয়ে সে দিকে চলে গেল। নীলা কেবল গ্লাসের ভিতর থেকে ভয়ার্ত চোখে তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মন না চায়তেও বারবার কু ডাকছে৷ আল্লাহই জানে সাদিদ কিছু টের পেয়েছে কি-না?

.

ডক্টর ফারজানা করিমের দরজাটা ধিরিম করে খোলে যেতেই ওয়ার্ড বয়রা সেদিকে দৌড়ে আসলো৷ ডক্টর ফারজানাও এমন আওয়াজে চমকে উঠল। পরমুহূর্তেই দরজার সম্মুখে সাদিদকে দাড়ানো দেখতে পেয়ে সবার উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ উনি আমার পরিবারের লোক। আপনারা এখন যেতে পারেন। ‘

সাদিদ দ্রুত পায়ে তার মুখোমুখি হয়ে বসলো। কোনো বণিতা না করে সোজাসাপটা প্রশ্ন ছুঁড়ল।

— নীলাঞ্জনার কি হয়েছে? আমি এ টু যেড জানতে চাই। ‘
— ‘ দেখো সাদিদ…
— ‘ আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু হেয়ার এনিথিং। আই জাস্ট ওয়ান্ট টু নো এবাউট নীলাঞ্জনা’স ফিজিক্যাল কন্ডিশন। সো টেল ইট ফাস্ট। ‘

সাদিদের এমন রাগী গম্ভীর কন্ঠের পরে ডক্টর ফারজানা আর বনিতা করতে পারলো না। একনাগাড়ে বলতে থাকলো,

— ‘ তুমি যখন নীলাকে গত সপ্তাহে চেক-আপের জন্য নিয়ে এসেছিলে তখনই তার শারীরিক অবস্থা দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু রিপোর্ট হাতে পাওয়া অব্দি কিছু বলতে পারছিলাম না। কিন্তু দুইদিন আগে আমার সন্দেহটাই সঠিক প্রমাণিত হলো।
নীলার শারীরিক লক্ষণগুলো একত্রে প্রি-এক্লাম্পসিয়াকে নির্দেশ করে। ‘

সাদিদ এতক্ষণ থমথমে ভাব নিয়ে থাকলেও এখন যেন মুহূর্তেই মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। সে মেডিকেল স্টুডেন্ট না হলেও লাইফের খুব কাছের এক অবিজ্ঞতায় এটা সম্পর্কে অবগত। সাদিদের চোখজোড়া ক্রমশ লাল হয়ে আসছে। সে শুকনো একটা ঢুক গিলে খানিকটা কাঁপাস্বরে প্রশ্ন করলো,

— ‘ তুমি হান্ড্রেড পারসেন্ট শিউর? ‘
— ‘ রিপোর্ট এমনটাই বলছে সাদিদ। ‘

সাদিদ মুহূর্তেই মাথা নামিয়ে ফেললো। নিজের অশ্রুসিক্ত চোখগুলো যে কাউকে দেখাতে চায় না। কয়েক মিনিট নীরবতায় কেটে যাওয়ার পর সাদিদ পুনরায় নিজের গম্ভীর স্বভাবে ফিরে আসলো৷ খানিকটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে ডক্টরের উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ এটা আমাকে আগে জানাওনি কেন? তার থেকেও বড় কথা তুমি পাখিকেই কেন সবার আগে জানাতে গেলে? এইজন্যই ঢাকার এতো এতো ডক্টরের ভিড়ে তাকে আমি তোমার কাছে নিয়ে এসেছিলাম? বলো এই জন্যই, যেন আমার থেকে কথা গোপন রাখতে পারো? ‘
— ‘ প্লিজ সাদিদ, আমাকে ভুল বুঝো না। আসলে চেকআপের প্রথম দিন থেকেই দেখছি নীলাকে নিয়ে তুমি বড্ড নার্ভাস। মুখে প্রকাশ না করলে তোমার কথাবার্তায় এটা পরিস্কার ছিলো৷ অপরদিকে নীলাকে কিন্তু প্রথম থেকেই আমি বেশ স্বাভাবিক দেখেছি। তাই আমি তাকেই সর্ব প্রথম এটা বলি। কিন্তু নীলাও যে এমনভাবে ভেঙে পরবে সেটা আমি বুঝতে পারিনি। ‘

সাদিদ একপলক ডক্টরের মুখপানে তাকিয়ে হতাশাজনক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাথাটা কেমন যেন ভনভন করছে। সত্যটা এমন তিক্ত লাগছে কেন? সহ্য হচ্ছে না যে।
সাদিদ হঠাৎ প্রাণহীন কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আমার পাখিটাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। না নিজের কলিজার টুকরোটার সাথে বাবা হয়ে বেঈমানী করতে পারবো। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে ফারজানা। আমার কি কিছু করার নেই? ‘

ডক্টর ফারজানার এই মুহূর্তে নিজের ডক্টরী বিদ্যার উপরে যেন বড্ড ক্ষোভ জন্মাচ্ছে। এই একটা ক্ষেত্রে সে কতগুলো প্রাণের আহাজারি শুনেছে। কতশত হাসিখুশি পরিবারকে চোখের সামনে ভেঙে যেতে দেখেছে।
কিন্তু পরমুহূর্তেই সে নিজেকে শক্ত করলো৷ কিছুসময় পূর্বের ক্ষোভটাকে আনন্দে রূপান্তরিত করলো। কেননা যেমন প্রিয়জন হারানোর আর্তনাদ শুনেছে তেমনি নতুন প্রাণ সুষ্ঠুভাবে ভূমিষ্ঠ হবার পর তাদের চোখে বাঁধহারা আনন্দও দেখেছে। তাই সে সাদিদের মনোবল দৃঢ় করার প্রয়াসে বন্ধুত্বসুলভ আচরণে বলল,

— ‘ সাদিদ, উপরে যিনি আছেন তার কাছে ঘাটতি আছে এমন কোনো জিনিস নেই। রোগ যেমন আছে তেমনিভাবে তার প্রতিকারও আছে। প্রি-এক্লাম্পসিয়া মূলত উচ্চ রক্তচাপ জনিত একটি সমস্যা যা শুধুমাত্র গর্ভবতী মায়েদের হয়ে থাকে। শতকরা ৫-১৫ ভাগ নারী গর্ভাবস্থায় এই সমস্যায় ভুগতে পারেন। গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহের পর যদি কারো উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে এবং ইউরিনের সাথে প্রোটিন বা এলবুমিন যায় তবে এই উপসর্গকে প্রি-এক্লাম্পসিয়া বলা হয়। এতে শরীরে অতিরিক্ত পানি আসা থেকে শুরু করে পেটে অসহ্য ব্যথা, মাথার যন্ত্রণা অথবা চোখে ঝাপসা দেখার মতো সমস্যার উদ্রেক ঘটতে পারে। প্রথমবার গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রেই সাধারণত প্রি-এক্লাম্পসিয়া বেশি হয়। কিন্তু পূর্বের প্রেগনেনসিতে যাদের প্রি-এক্লাম্পসিয়া হয়েছিল তাদের ২৫ ভাগ ক্ষেত্রে পুনরায় প্রি-এক্লাম্পসিয়া হতে পারে।
গর্ভবতীর এরকম সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে সুচিকিৎসা না করলে পরে তারা এক্লাম্পসিয়া নামক এ বিভীষিকাময় রোগের শিকার হতে পারে। তাছাড়া এ থেকে গর্ভপাত পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।
এখন যদি নীলার কেইসটা ধরি তাহলে বলতে হবে, প্রি-এক্লাম্পসিয়া দুই ধরনের হয়। মাইল্ড বা মৃদু প্রি-এক্লাম্পসিয়ার ক্ষেত্রে রক্তচাপ ১৪০/৯০ মিঃ মারকারির এর বেশি থাকে কিন্তু ১৬০/১১০মিঃ মারকারির এর কম থাকে। আরকটা হচ্ছে সিভিয়ার বা মারাত্বক প্রি-এক্লাম্পসিয়া। এক্ষেত্রে রক্তচাপ ১৬০/১১০ মিঃ মারকারি এর বেশি থাকে। নীলাকে আপাতত মধ্যম সারীতে রাখতে হচ্ছে। তার অবস্থা মাইন্ড প্রি-এক্লাম্পসিয়া থেকে একটু গুরুতর। কেননা তার রক্তচাপ ক্রমশ উঠানামা করলেও সিভিয়ার প্রি-এক্লাম্পসিয়ার কিছু লক্ষণ তার মধ্যে পরিলক্ষিত। তন্মধ্যে তার প্রচন্ড মাথা ব্যাথাসহ, পেটে ব্যাথা এবং চোখে ঝাপসা দেখার মতো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। তাই বিষয়টা একটু জটিল।
গর্ভাবস্থায় মায়ের প্রি-এক্লাম্পসিয়া থাকলে এটি একটি ঝুঁকিপূর্ন প্রেগনেন্সি। প্রি-এক্লাম্পসিয়া মারাত্বক পর্যায়ে গেলে এক্লাম্পসিয়া বা খিচুনি হয়, যা মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর একটি বড় কারণ। কম ওজনের শিশু জন্মদান, সময়ের আগে ডেলিভারি হওয়া, মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যু, এন্টি পারটাম হেমোরেজ ইত্যাদি সমস্যাগুলো প্রি-এক্লাম্পসিয়া আক্রান্ত মায়েদের ক্ষেত্রে সচরাচর ঘটে থাকে। সঠিক সময়ে এ রোগের চিকিৎসা না হলে এর জটিলতা থেকে কিডনী ফেইলর, লিভার ফেইলর কিংবা ব্রেন হিমোরেজও হতে পারে। ‘

সাদিদ ক্রমশ উশখুশ করছে। নিজেকে প্রচন্ড ছন্নছাড়া লাগছে। ভাষার ভান্ডারে শব্দের বড্ড অভাব অনুভব করছে। কি বলবে সেটাই যেন বুঝে উঠতে পারছে না। তার অস্থিরতা দেখে ডক্টর আবার বলা শুরু করলো,

— ‘ কিন্তু এটাতো বিশ্বাস করো, সবকিছুর উর্ধ্বে যে সৃষ্টিকর্তা? তিনি যদি চান ইনশাআল্লাহ মা এবং বাচ্চা দুইজনই সুস্থতার সহিত তোমার চোখের সামনে থাকবে। ‘

এতক্ষণে যেন সাদিদের প্রাণটা নিজের কাছে ফিরে এসেছে। তার অশ্রুসিক্ত চোখজোড়াতে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখে ডক্টরের বড্ড মায়া হলো। ছেলেটা যে মেয়েটাকে চোখে হারায় এটা আর বুঝার বাকি নেই৷ তারপরও যেন আজ আবারও নতুন করে এই প্রেমিকযুগলের ভালোবাসা দেখে সে মুগ্ধ হলো।
সাদিদ এতক্ষণেের বিষন্নতা একপাশে রেখে সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্য জানতে চাইলো,

— ‘ তাহলে এখন আমার করণীয় কি? ‘
— ‘ তার প্রতি যত্ন নেওয়ার কথা বলে নিজেকে নির্বোধ প্রমাণ করতে চাই না৷ শুধু বলবো এখনও তো অনেকটা সময় বাকি রয়েছে। তাই ডেলিভারি ডেইটের মিনিয়াম একমাস আগে থেকে তাকে সর্বক্ষণিক হসপিটালে রাখার নির্দেশ দিব। কিন্তু এর মধ্যে নিয়মিত ডাক্তারের চেকআপের প্রয়োজন হবে। আপাতত মাসখানেক বাসায় যত্ন নিতে পারো। আর বাদবাকি সবকিছু আমি ফাইলে চার্ট আকারে বুঝিয়ে দিব৷ ‘

.

সাদিদ নীলার ফাইল এবং যাবতীয় সব জিনিসপত্র বুঝে নিয়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
নীলা এতক্ষণ প্রচন্ড অস্থিরতায় গাড়ির ভেতরে ছটফট করেছে। কিন্তু বাহিরে যাবার রাস্তা বন্ধ।
এতক্ষণ পর সাদিদের দেখা পেয়ে খুশি হতে চেয়েও এখন পারছে না। কেননা সাদিদের রক্তলাল চোখজোড়া যে তার সম্মুখে।
সাদিদ ডাইভিং সিটে বসে নীলার সাথে কোনোরকম কথা না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো। অনেকটা পথ নিঃশব্দে আসার পর নীলা সাহস জুগিয়ে মিনমিনিয়ে বলতে চাইল,

— ‘ এতক্ষণ ডক্টরের…

তাকে নিজের বাক্যটা অসমাপ্তই রাখতে হলো। কেননা সাদিদ সেটা পূর্ণ করতে দিলো না। চোখের পলকে নিজের সিটবেল্ট খোলে নীলার দিয়ে এগিয়ে গেল। নীলার ঘাড়ের পিছনে দুইহাত দিয়ে তাকে খানিকটা কাছে টেনে নিলো। অতঃপর নিজের অধরযুগল নীলার অধরে শক্ত করে চেপে ধরলো।
বিনা মেঘের বজ্রপাতের ন্যায় আকষ্মিক এমন কান্ডে নীলা কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কিন্তু পরমুহূর্তেই ব্যাথায় কাতর হয়ে সে মৃদু চিৎকার করতে চাইল। কিন্তু সম্ভব হলো না। কেননা সাদিদ যে তার কোমল ঠোঁটগুলোকে নিজের মধ্যে পুড়ে নিয়ে ক্রমাগত কামড়াচ্ছে।
নীলা এবার সহ্য করতে না পেরে নিজেকে ছাড়াতে সাদিদের বুকে মৃদুভাবে আঘাত করতে লাগলো। কিন্তু সাদিদ ছাড়লো না। উল্টো এতে যেন আরও ক্ষেপে গিয়ে নীলার গলায় মুখ গোঁজে সেখানে শক্তভাবে নিজের দাঁতের ছাপ বসালো৷
নীলার মুখ ফুটে ব্যাথায় জর্জরিত একটা আর্তনাদ বেড়িয়ে আসলো। কিন্তু বন্ধ গাড়িতে সেটা বাহিরে যাবার ক্ষমতা লাভ করলো না। বরং বারবার যেন গাড়ির ভিতরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।
সাদিদ তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস টানছে। অপরদিকে নীলা অভিমানে সিক্ত হয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এমনিতেই কতটা কষ্টের মধ্যে রয়েছে। তারউপর সাদিদের এমন আচরণ! নীলা যেন কোনোভাবেই সেটা মেনে নিতে পারছে না।

— ‘ তোমার গায়ে হাত তুলে নিজে অনুশোচনায় ভুগবার ইচ্ছে নেই৷ এমনিতেই গতবারের জন্য এখনও অনুশোচনা হয়।
কিন্তু তাই বলে কি অন্যায় করে পার পেয়ে যাবে?
কখনও না। এই সাদিদ ইবনে শাহরিয়ার এতটা জনদরদি নয়। তাই অপরাধ যেহেতু করেছো শাস্তি ভোগ অবশ্যই করতে হবে। ‘
— ‘ কি করেছি আমি? কিসের জন্য এমন হিংস্রতা! ব্যাথায় আমি কথা বলতে পারছি না। ‘

সাদিদ একপলক নীলার দিকে তাকালো। প্রিয়তমার সিক্ত মায়াবী চোখজোড়াতে তাকিয়ে থাকলে সে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়বে৷ অথচ সেটা হতে দেওয়া বারণ। তাই দ্রুত নীলার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বাজখাঁই গলায় বলে উঠল,

— ‘ প্রিন্সেস, তোমার মাকে বলো বাবার সাথে যেন যেচে পড়ে কথা বলতে না আসে। সে কথা কম বলে ঠোঁটের ব্যাথা যেন নিরাময় করে। কিন্তু ভুলেও যেন বাবার জন্য তার মুখ থেকে একটা শব্দ বের না হয়। বাবা এই মুহূর্তে রেগে আছি। ভীষণ রেগে আছি। এই রাগ অন্ততপক্ষে এক সপ্তাহের কমে নিচে নামবে না৷ তাই সে যেন ততদিন নিজের কাজকর্মে বাবাকে বিরক্ত না করে। বাবা অভদ্র-বেয়াদব মহিলাদের সঙ্গে কম কথা বলি। ‘

নিজের মহান বক্তব্য শেষ করেই সাদিদ পুনরায় গাড়ি স্টার্ট দিলো। কিন্তু নীলা এখনও একধ্যানে তার দিকেই তাকিয়ে। বিষয়টা আসলে কি হলো সে এটাই বুঝে উঠতে পারছে না!

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৬০ 💛❤💛

একসপ্তাহের ব্যবধানে সাদিদ নীলার জীবনে যেন বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। যেমন বেড়েছে সাদিদের অতিরিক্ত ভালোবাসার পাগলামি। তেমনিভাবে নীলা তাতে অতিষ্ঠ হয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে সাদিদের সাথে রাগারাগি। কিন্তু সাদিদের তাতে বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং সে নিজের কার্যসিদ্ধিতে সমানতালে ব্যস্ত। এমনকি মহা ব্যস্ত। খুনসুটিতে মেতে থাকা এই দম্পতির সাথে সাথে অপর দুইটি মানুষের জীবনেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগার মাত্র অপেক্ষা। যেই পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে আরও মাস দুইয়েক সময়ের অপেক্ষা ছিল, সাদিদের পাগলামিতে এখন এটা কেবল সময়ের অপেক্ষা।
কেননা আজকে তানবীর আর শান্তর হলুদ ছোঁয়া। আর
আজকে গায়েহলুদের কার্যক্রম শেষ হতেই কাল তারা বিয়ের মতো পবিত্র একটা বন্ধনে আবদ্ধ হবে।
শান্তদের পরিবারের কিছু কারণবশত সমস্যায় তারা বিয়ের ডেইটটা আরও মাস তিনেক পরে ঠিক করেছিল। কিন্তু সেইদিন ডক্টরের কাছ থেকে আসার পর সাদিদ নিজ দায়িত্বে এটাকে এগিয়ে এনেছে।
বলা যায় সাদিদ এককথায় ডক্টরের কথাকে উল্টে সেটা নিজের মনমতন সাজিয়ে নিয়েছে। কেননা ডক্টর নীলার শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করে তাকে ডেলিভারির একমাস আগে থেকে হসপিটালে এডমিট হতে বলেছিল। কিন্তু সাদিদের কথামতো সে নীলাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র রিক্স নিতে রাজি নয়। তাই সে ডেলিভারির একমাস আগে নয় বরং বাড়িতে আর বড়জোর নীলাকে একমাস রাখবে। তারপর বেবির আগমনের আগ পর্যন্ত পুরোটা সময় নীলাকে হসপিটালে রেখে সার্বক্ষনিক ডক্টরদের চেকআপের আন্ডারে রাখবে।
তাই তিনমাসের সময় কমিয়ে তাদের বিয়েটা এখনই সমাপ্ত করে নেওয়া। নতুবা তাদের বিয়ের টাইমে নীলা উপস্থিত থাকতে পারবে না৷
এটা বললে অবশ্য ভুল হবে। সে আসতে পারবে। কিন্তু কথা হচ্ছে সাদিদ তখন নীলাকে নিয়ে একপাসেন্টও রিক্স নিবে না। এমনকি এখনও নীলার উপর তার ভয়ানক ভয়ানক সব নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে ৷ এইরকম ঘাড়ত্যাড়া জামাইয়ের জন্য নিজের বেস্টুর বিয়েটা নীলার জন্য এমন পানসেভাবে শেষ হচ্ছে। সবার এতো এতো আনন্দের মধ্যে কেবলমাত্র নীলার চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ। কেননা সর্বক্ষণ রুমে বসে তাকে একপ্রকার বন্দিজীবন কাটাতে হচ্ছে। বিয়ের মতো এমন একটা আনন্দ উৎসবে সে কেবলমাত্র নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

— ‘ কোথায় হারালে? হা করো। ‘

সাদিদের মৃদু ধমকে নীলা ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসলো। পুনরায় নিজের অবস্থান চিন্তা করেই সে তেতে উঠল,

— ‘ সমস্যা কি আপনার? এভাবে খাইয়ে খাইয়ে আমাকে পেটুক বানাতে চান? আর খাব না আমি। ‘

বলেই সে মুখ ঘুরিয়ে নিলো৷ রাগে ফুলো গালগুলো আরও খানিকটা ফুলে উঠে লাল হয়ে গিয়েছে। সাদিদ তার কান্ডে ঠোঁট চেপে হাসলো। কিন্তু সেটা নীলাকে বুঝতে দিলো না। নতুবা এই মেয়ে একটু আদর পেয়ে শেষে মাথায় উঠে বসবে৷ তাই সে গম্ভীর স্বরেই বলল,

— ‘ এতোসব বুঝতে চাই না। চুপচাপ হা করো। নতুবা কিন্তু ফাংশনে নিয়ে যাব না৷ ‘

নীলা এবার অসহায় মুখ করে সাদিদের দিকে তাকালো। অপরদিকে সাদিদ ভাবলেশহীনভাবে ভুনাখিচুড়ি চামচে তুলতে ব্যস্ত।

— ‘ এতগুলো খাবার আমি শেষ করতে পারবো! ঘণ্টা দুইয়েক আগেই না ঠেসেঠুসে চাউমিন খাওয়ালেন। ‘
— ‘ ঠিক তাই। দুই ঘণ্টা আগে। এতক্ষণে সেটা পেটে থাকার কথা নয়। তাই ঝটপট হা করে পটাপট শেষ করো। ‘
— ‘ এমন করেন কেন? পেটে একটুও জায়গা নেই। ‘
— ‘ তোমার পেটে নাই থাকুক কিন্তু আমার প্রিন্সেসের পেট খালি। তার এই মুহূর্তে অনেক খিদে পেয়েছে। তাই চুপচাপ তাকে খেতে দাও। ‘

বলেই সাদিদ মুরগির মাংসের সাথে ভুনাখিচুড়ি চামচে তুলে সেটা নীলার মুখে তুলে দিলো। নীলাকেও অসহায়ের মতো শেষমেশ খেতে হয়েছে। নতুবা এই ছেলে বহুত ত্যাড়া। কথার জালে নীলাকে ফাসিয়ে নিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করে নেবে এটা তার খুব ভালো করেই জানা আছে।
সাদিদ প্লেটের খাবার শেষ করে নীলার মুখ যত্নে টিস্যু পেপার দিয়ে মুছিয়ে দিলো। অতঃপর কাভার্ড থেকে নীলার জন্য গায়ে হলুদের জন্য বরাদ্দকৃত ড্রেস বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলো।

— ‘ এখন রেডি হতে পারো। ‘

নীলার মুখে তৎক্ষনাৎ হাসির রেখা ফুটে উঠল। সে সময় নষ্ট না করে দ্রুত পায়ে ওয়াসরুমের দিকে ছুটতে গেলেই সাদিদ তার কব্জি টেনে ধরল। হালকা শাসানোর স্বরে বলে উঠল,

— ‘ এমন দৌড়াদৌড়ি কেন? পরে যাও যদি? তোমাকে নিয়ে আমি আর পারি না। ওয়াসরুমে যেতে হবে না। চুপচাপ দরজা লক করে রুমে চেইঞ্জ করে নাও। শুধু সারাক্ষণ লাফালাফির ধান্দায় থাকে। ‘

সাদিদ নিচুস্বরে আরও কিছু বলে কয়ে নিজে ওয়াসরুমের দিকে পা বাড়ালো। নীলা আর কোনো দিকে খেয়াল না করে দরজা লক করে রেডি হতে থাকলো। এতক্ষণে সাদিদের এসব অতিরিক্ত জ্বালাময়ি টর্চার থেকে রক্ষা পেয়ে খুশি যেন তার আর ধরছে না।
সাদিদ ওয়াসরুম থেকে একেবারে শাওয়ার নিয়ে ড্রেস চেইঞ্জ করে এসেছে। ভেজা চুলগুলো শুকনো টাওয়েল দিতে মুছতে মুছতেই সে ওয়াসরুম থেকে বের হলো।
কিন্তু সম্মুখে দৃষ্টি পরতেই তার ভ্রজোড়া তৎক্ষনাৎ কুঁচকে এলো।
নীলাকে এমন আয়নার সামনে পেটে হাত দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সে হাতের তোয়ালেটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে দ্রুত পায়ে নীলার দিকে এগিয়ে গেল। অস্থিরতাভরা কন্ঠে বলল,

— ‘ কি হয়েছে পাখি? পেটে আবারও ব্যাথা হচ্ছে? ঠোঁট এমন উল্টিয়ে রেখেছো কেন? ‘

নীলা নিজের অবস্থান থেকেই ঘাড় ফিরিয়ে সাদিদের দিকে তাকালো। ভীষণ মনঃক্ষুণ্ন স্বরে বলল,

— ‘ আমি দেখতে অনেক পঁচা হয়ে গিয়েছি তাই না? ‘

সাদিদের কুঞ্চিত ভ্রুযুগল আরও খানিকটা কুঁচকে এলো৷ সে না বুঝতে পেরে কন্ঠে উৎকন্ঠা ভাব নিয়েই বলল,

— ‘ মানে? ‘
— ‘ নিজেকে কেমন মোটা-মোটা লাগছে। মুখ-টুখও ফুলে-ফেঁপে একাকার। ভীষণ বিশ্রী লাগে দেখতে। আমাকে আপনার আর ভালো লাগে না, তাই না? ‘

সাদিদ নীলার এমন কথার পরিবর্তে খানিকটা সময় স্তব্ধ হয়ে রইল। কিন্তু ধীরে ধীরে তার ভাবভঙ্গির পরিবর্তন হতে
লাগল। তার এই মুহূর্তে ভীষণ হাসি পাচ্ছে। যে মেয়েটাকে সে প্রতি মুহূর্তে চোখে হারায় তাকে না-কি সাদিদের কাছে আর ভালো লাগবে না! এমনটাও কি সম্ভব?
কিন্তু সাদিদ নীলার বর্তমান অবস্থাটা বেশ ভালোই বুঝতে পারে। যেমন এই রাগ তো একটু পরেই আবার কান্না। নীলার মুডের এই ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তনের সাথে সাদিদ বেশ ভালোই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে৷ আর পারবে নাই বা কেন?
ভালোবাসে যে। তার পাখিটাকে সাদিদ সীমাহীন ভালোাবাসে।
সাদিদ এবার নিচু হয়ে নীলার উল্টানো ঠোটজোড়াতে ছোট্ট করে চুমু দিলো। অতঃপর তাকে ঘুরিয়ে নিয়ে পিছন থেকে কোমড় জড়িয়ে ধরে পেটে হাত রাখলো। নীলার কাঁধে নিজের থুতনি রেখে আয়নায় নিজেদের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল,

— ‘ তুমি মোটা না বরং গোলুমোলু হয়ে গিয়েছো। ‘

নীলা ঘাড় কাত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাদিদের দিকে তাকালো। ভাবটা এমন যে মোটা আর গোলুমোলুর মধ্যেকার তফাট টা-কি সেটার বুঝার সর্বোচ্চ প্রয়াস।
তার এমন মুখভঙ্গি দেখে সাদিদ আর নিজের এতক্ষণের হাসিটা চেপে রাখতে পারলো না। শব্দ করেই হেসে উঠল।
নীলা যেন নিজের উত্তর পেয়ে গিয়েছে। মন কুঠরে জমা হয়েছে ভীষণ কষ্ট। সে দেখতে বিশ্রী হয়ে গিয়েছে। সাদিদের সাথে এখন তাকে বেমানান লাগে। এসব হাজারো অর্থহীন ভাবনায় সে মনঃক্ষুণ্ন হলো। মনে ভীষণ কষ্ট নিয়েই সে সাদিদের থেকে সরে আসতে চায়ল। কিন্তু সাদিদ এত সহজে তাকে ছাড়লে তো?
সাদিদ তাকে নিজের সাথে আরেকটু আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে কাঁধে পরপর নিজের উষ্ণছোঁয়া দিলো। নীলা তাতে কেঁপে উঠে পেটের উপর সাদিদের হাতটা খামচে ধরলো। সাদিদ প্রিয়তমার কানের লতিতে হালকা করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে মোহনীয় স্বরে আবারও বলল,

— ‘ সে কি জানে না, আমি তাকে ভালোবাসি? একটু নয় বরং অনেকটা বেশি? তারপরও এতো সংকোচ কেন? মনে এতো হীনম্মন্যতা কেন? সে মোটা হোক বা বিশ্রী, আমার নিকট সে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা রূপসী রমনী। তার প্রেমেতে আমি বারংবার মাতোয়ারা। তার পাগল করা রূপে আমি ক্ষণে ক্ষণে দিশেহারা। ‘

নীলা এবার লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো। অতঃপর সম্পূর্ণ ভাবনাহীনতা থেকে একটা ভুল বাক্য উচ্চারণ করে বসলো।

— ‘ শুধু আপনার চোখে হলে কি হবে? বাকি সবার কাছে তো নই। ‘

নীলার চোখে-মুখে অসহায়ত্ব প্রকাশ পেলেও
সাদিদের মুখশ্রীতে হালকা রাগের আভাস প্রতিফলিত হলো। সে নীলার কাঁধ থেকে মাথা তুলে তাকে নিজের দিকে ফিরালো। খানিকটা ঝাঁঝ মিশ্রিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

— ‘ মানে কি? তোমার কয়জনের চোখে সুন্দর হওয়া লাগবে? ‘

এতো সোজা কথার বিপরীতে সাদিদের এমন বাঁকা-ত্যাড়া প্রতিউত্তর শুনে নীলা দ্রুত তার মুখপানে তাকালো। সাদিদের এহেন দৃষ্টি দেখে কিছুটা ভরকে গেলেও পরমুহূর্তেই মাথায় দুষ্টু শয়তানি বুদ্ধি চেপে বসলো। সে সাদিদের গলায় ঝুলে ফিচেল কন্ঠে বলল,

— ‘ আর ইউ জেলাস মিস্টার শাহরিয়ার? ‘
— ‘ অবভিয়াসলি আই এম। নতুবা কি? ‘

সাদিদের থেকে এমন স্পষ্ট উত্তর নীলা আশা করেনি। তাই খানিকটা হকচকিয়ে গিয়ে বলল,

— ‘ তাহলে সেটা আপনার প্রবলেম। এখানে আমি কি করতে পারি? ‘
— ‘ তুমি কি করতে পারো? আদর করতে পারো। খুব আদর। আসো, আদর খাব। ‘
— ‘ একদম না। দূরে যান বলছি। ‘
— ‘ কিছুতেই না৷ আদর তো আমি খেয়েই ছাড়বো। হয় আঙুল বাঁকিয়ে নতুবা ঘি’য়ের ডিব্বা উল্টিয়ে। ‘

বলেই সাদিদ খপ করে নীলার হাত ধরে তাকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো। কয়েককদম এগিয়ে গিয়ে সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দিতেই নীলা মিনুতির স্বরে বলল,

— ‘ কি করছেন? সেন্টারে কখন যাব? ‘
— ‘ আদর খেয়ে। ‘
— ‘ কি কখন থেকে আদর আদর শুরু করেছেন? আপনার জন্য এমনিতেই অনেক লেইট হয়ে গেল। বাসার সবাই আমাদের রেখেই সেখানে চলে গিয়েছে। ‘
— ‘ তাতে আমি কি করতে পারি? রাইট নাও আই ওয়ান্ট এ কিস। নট এ ফাঁকিবাজি মার্কা চুমু। দৃঢ়তার সহিত শক্ত পোক্ত একটা দীর্ঘ চুমু। ‘

নীলা নিজের রাগী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সাদিদের উপর ফেলতেই সে টুপ করে প্রিয়তমার রাগে ফুলে উঠা নাকে চুমু খেয়ে বসল। কয়েক মুহূর্ত নীলা তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থাকলেও পরমুহূর্তেই মাথা নিচু করে লাজুক হাসলো। আলতো হাতে সাদিদের কপালের ভেজা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে শব্দ করে কপালে চুমু দিলো।
সাদিদ মৃদু হেসে বাচ্চাদের মতো নিজের ডান গালও এগিয়ে দিলো। নীলা সেখানেও চুমু দিলো। অতঃপর একইভাবে বামগালেও। কিন্তু দুষ্টু সাদিদ ঠোঁট এগিয়ে দিতেই নীলা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে, সাদিদের বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে তাকে উপর থেকে সরিয়ে উঠে বসলো। সময় বিলম্ব না করে বিছানা ছেড়ে উঠে চলে যেতেই পিছন থেকে সাদিদের রাসভারি কন্ঠস্বর কানে আসলো,

— ‘ এখনের মতো ছেড়ে দিলাম। কিন্তু পরে কিন্তু ছাড়ছি না মিসেস। জরিমানা হিসেবে ডাবল দিয়ে পুষিয়ে দিতে হবে। ‘

নীলা সাদিদের দিকে আর ফিরে তাকালো না। চুপচাপ মাথায় ওড়না টেনে ঠিক করতে লাগলো। কিন্তু ঠোঁটের কোণে তার ঈষৎ চাপা হাসি।

_______________

গায়ে হলুদের জমজমাট আয়োজনে গুলশানের এই বিলাসবহুল কনভেনশন সেন্টারটা মুখরিত। নরমালি গায়ে হলুদের আয়োজন ছেলে-মেয়ের নিজ নিজ বাসভবনে হলেও শান্ত আর তানবীরেরটা হচ্ছে কনভেনশন সেন্টারে। কারণ হিসেবে শান্তর পরিবারের থেকে অনেকজন থাকলেও তানবীরের সেক্ষেত্রে হাতেগোনা মানুষ। হাজার সাদিদের পরিবার তাকে ছেলের মতো আদর করুক কিন্তু সত্যটা তো কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না। তাই তানবীরকে এতো বুঝানোর পরও পদ্মলয়ায় সে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য রাজি হয়নি। তাই সাদিদকে বাধ্য হয়ে কনভেনশন সেন্টারেই তাদের দুইজনের একসাথে হলুদের আয়োজন করতে হয়েছে। এতে তানবীরের মনেও কোনোরকম আক্ষেপ বা কষ্ট থাকবে না। আর না অপরদিকে হলুদের অনুষ্ঠানে কোনোরকম সমস্যা হবে৷
তাই সাদিদরা সবাই এখন সেখানেই উপস্থিত। ইতিমধ্যে সবাই এখানে চলে এসেছে৷ শুধু সাদিদ আর নীলাই সবার পরে এসেছে। এই নিয়ে শান্ত-তানবীরও তাদের উপর ক্ষেপে রয়েছে। আর অপরদিকে নীলা এক্সাট্রাভাবে সাদিদের উপরে ক্ষেপে আছে। কেননা যত নষ্টের গোঁড়া হলো এই বজ্জাত মার্কা সাদিদ ইবনে শাহরিয়ার। নীলার ভাষ্যমতে খাঁটি বজ্জাতের কারখানা।

— ‘ শালার বিয়া করতে এমন বাল-ছাল পরন লাগে? গরমে কলিজা পর্যন্ত জ্বইল্লা যাইতাসে। ‘

শান্ত ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে বসা তানবীরের দিকে তাকালো। হলদে-সাদা পাঞ্জাবিতে সে একপ্রকার বর বাবু সেজে বসে রয়েছে। এখনও তাদেরকে হলুদ লাগানো হয়নি। কেবলমাত্র স্টেজে বসিয়ে হলুদের আগের ফটোসেশন হয়েছে। তাই খুব একটা সময় তারা বসেও থাকেনি। তারউপর পুরো কনভেনশন সেন্টারটা এসিযুক্ত। তাই গরম লাগার বিন্দুমাত্র কোনো ফাঁকফোকর নেই। তাহলে এই ছেলের এতো গরম কই থেকে আসে?
শান্তর তাই বিরক্ত লাগলো। বিরক্তিমাখা কন্ঠেই সে বলল,

— ‘ মুখের কি শ্রী! এতগুলো মানুষের সামনে এসব ভাষায় কথা বলতে লজ্জা লাগে না? ‘
— ‘ আইছে আমার লজ্জাবতী লাজুকলতা। রাখ তোর লজ্জা-ফজ্জা। আমি এই মুহূর্তে পাঞ্জাবি প্যান্ট খুলতাসি। ‘
— ‘ ছিঃ ছিঃ। আপনি তো দেখছি মহা নির্লজ্জ। সবার সামনে এভাবে উইথ আউট ক্লোথে থাকবেন? ‘

তানবীর বেশ জোরেই শান্তর মাথায় ঠাউয়া দিলো। শান্ত বিস্ফোরিত চোখে তানবীরের দিকে একপলক তাকিয়ে আড়চোখে বাকি সবার দিকে তাকালো। তারা স্টেজে বিধায় খুব সহজেই সবার দৃষ্টির মধ্যমণি। তাই শান্তর মতো সকলেই চোখ বড় বড় করে তাদের দুইজনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এটা দেখে শান্ত যেন দ্বিগুণ তেতে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে সে চিবিয়ে বলল,

— ‘ পাগল হয়ে গিয়েছেন? সবার সামনে এসব কি আচরণ? ‘

তানবীর তার কথার পরোয়া তো করলোই না বরং আগের থেকে দ্বিগুণ জোরে আরেকটা ঠাউয়া দিলো। শান্ত এবারের ধাক্কাটা সময় থাকতে সামলে উঠতে পারলো না। তাই চেয়ার থেকে মেঝেতে বিছানো কার্পেটের উপরই পড়ে গেল।
এতক্ষণ অবাক হলেও এবার শান্ত রাগে দুঃখে পরনের শাড়ি ঠিক করে উঠে দাঁড়ালো। এবং ঝড়ের বেগে গিয়ে তানবীরের বুকে সজোরে নিজেও একটা ধাক্কা দিলো। রাগের বশে এতোটাই জোরে দিয়েছে যে তানবীর বেচারা চেয়ারসহ-ই উল্টে গিয়ে পড়ল।
উপস্থিত এতগুলো মানুষ বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। চোখজোড়া তাদের প্রায় জায়গা থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম।
সারাজীবন দেখে এসেছে হবু দম্পতি গায়ে গা ঘেঁষে প্রেমআলাপ করে। অথচ এখানে তারা দেখছে দুইজনে একেবারে হাতাহাতিতে লেগে গিয়েছে!
কেউ চুল টেনে ধরছে তো কেউ পাঞ্জাবির বোতাম টেনে ছিড়ে ফেলছে। দুই পরিবারের লোকজন এসেও হবু বর-কনের ঝগড়াঝাটি থামাতে পারছে না।

— ‘ ভাই ছাড়ো। এই মাইয়ারে তুইল্লা আইজ্জকা আছাড় দিয়া ভূতের আছর ছাড়ামো। ‘
— ‘ ভাই চুপ থাক। এই মাইয়া, এই মাইয়া কি কস! তোর হবু বউ হয়। ‘
— ‘ একদম না। এই হনুমানকে বিয়ে করা জাস্ট ইম্পসিবল। লাইফ হেল করে ছাড়বে। ‘
— ‘ তুই কোন জান্নাতের হুরপরী? ‘
— ‘ সেটা না হই। কিন্তু কোনো পটলতোলা ঘাটের দারোয়ান নই। ‘
— ‘ এই কি কস? কি কস! কারে কি কস? ‘
— ‘ পাগল কি অবশেষে আমিই হয়ে গেলাম? এক কথা তিন তিনবার শুনি ক্যান? ‘
— ‘ থাপড়াইয়া দাঁতের কপাটিসুদ্ধ খোলে ফেলব শান্তর বাচ্চা। ‘
— ‘ আমি তোর মুখই খোলে ফেলব হনুমানের চামচা। ‘

#চলবে…