অন্তরালে কুয়াশার ধোঁয়া পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
1587

#অন্তরালে_কুয়াশার_ধোঁয়া
#শেষ_পর্ব
Writer:: Shaanj Nahar Sanjida


আমার প্রতিশোধ নিতে আমি যে কারোর জান নিতে পাড়ি(অভ্র রাগে)

এইটা যদি আমিও বলি।আমি প্রতিশোধ নিতে যে কারোর জান নিতে পারি।
সেদিনের ফ্যাক্টরির বোম ব্লাস্টের কারণে যদি আমি ভয়ে ঝুমকে বিদেশ নিয়ে চলে যাই।এইজন্য তুমি আমার সামনে নকল জহির খানকে নিয়ে দাড়া করিয়েছো।যাতে আমি ভাবি যে আমার বাবার খুনি যারা আছে তারা ধরা পড়ে গেছে আর আমার জীবন শান্তিতে কাটতে থাকি,নির্ভয়ে।আর ঝুমকে নিয়ে দেশের বাহিরে না যাই।আর এই ফাঁকে তুমি আমার আর ঝুমের কাছে হিরো হতে পারো।আর তোমার এই প্ল্যানের বলি হয় আমার এক মাত্র বন্ধু মিতালী।এখন তুমি বলতে পারো এতো কিছু জানার পরেও কেনো আমি ওই সব বিশ্বাস করতে গেলাম তাইতো?কারণ আমি ঝিনুক খানের স্বামীকে খুজার জন্য নকল জহির খানের কাছে গিয়েছিলাম।কারণ আমি জানতাম JK গ্রুপের আসল নাম জহির খান গ্রুপ অফ ইন্ড্রাস্টরি না ঝিনুক গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রি।আর এইটা ঝিনুক খানের স্বামী চালায়।আর একমাত্র নকল জহির খানই আমাকে আসল ঝিনুক খানের স্বামীর কাছে নিয়ে যেতে পারবে।তোমার আর আমার মধ্যে পার্থক্য এইটাই যে তুমি জানতে আমি কে?কিন্তু আমি জানতাম না তুমি কে?আমি সত্যিই জানতাম না যে তুমি ঝিনুক খানের স্বামী।যাকে আমি খুঁজেছি তাকেই আমি নিজের মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছি।(আমি অভ্র দিকে তাকিয়ে দাঁত চেপে চেপে)

আমি তোমাকে কোনো দিনই ভালোবাসি নি।আমি শুধু আমার ছেলে ঝুমকে চাই আর আমার স্ত্রীর খুনিকে শাস্তি দিতে চাই।(অভ্র দাত চেপে চেপে)

স্ত্রীর তাই না,তাহলে আমি কি তোমার বলো?(বলেই আমি অভ্রর কলার চেপে ধরলাম)

তুমি আমার স্ত্রীর খুনি!তুমি ওকে এমন সময় মেরেছো,যখন ও প্রেগনেট ছিলো।তুমি ওকে প্রেগনেট অবস্থায় মেরেছো।(অভ্র আমার চোখে ঘৃণায় তাকিয়ে)

আমি ওর কলার ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে হাঁটতে হাঁটতে বললাম,,
বিশ্বাস করো আমি জানতাম না ও প্রেগনেট।আমাকে আরিফ যখন সব কিছু বলেছিলো,তখন ও বলেনি যে ঝিনুক প্রেগনেট ছিলো।হয়তো ও চায়নি আমি জানি যে ওরা একটা প্রেগনেট মেয়েকে মারতে চলেছে।
আমি যদি জানতাম ঝিনুক প্রেগনেট তাহলে কখনই ওকে মারতাম না।আর না ওকে কাউকে মারতে দিতাম।সেদিন যখন আমি ঝিনুককে মারতে দেশে আসি তখন আরিফ আর জয় আমাকে ধরে ফেলে।আমি কোনো মতো ওদের বুঝ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করি।গাড়ি চালিয়ে ওর বনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম।যাতে করে একটা সুযোগ পেলে,গাড়ি থেকে নেমে বনের ভেতর ঢুকতে পারি।আর যেখানে ওরা ঝিনুককে রেখেছিল সেখানে গিয়ে নিজের হাতে ঝিনুককে মারতে পারি।
কিন্তু তার আগেই ঝিনুক আমার গাড়ির সামনে চলে আসে।আর ঝিনুককে দেখে আমার মাথা ঠিক ছিলো না।কিছু বুঝার আগেই আমি ওর উপর গাড়ি চালিয়ে দেই।কিন্তু যখন গাড়ি থেকে নামলাম তখন দেখতে পেলাম ও প্রেগনেট ছিলো।
বিশ্বাস করো তখন নিজের উপর খুব রাগ হলো।অনুতপ্ত হয়ে উঠলো আমার মন।তাই তো ওকে তাড়াতাড়ি আমরা হসপিটালে নিয়ে যাই।
তবে এইটা বলতে পারি ওর মৃত্যুর কারণ আমিই।আমি চাইলে ওকে হয়তো বা বাঁচানো যেতো।

আমার কথা শুনেই অভ্র আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চোখে তাকিয়ে রইল,,

আমি ওর দিকে চোখে চোখ রেখে বলতে শুরু করলাম
যখন আরিফ আর জয় ঔষুধ আনতে আর ফোনে কথা বলতে বেস্ত ছিলো তখন ডক্টর আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে বলছিলো যে উনি যে কোনো একজনকে বাঁচাতে পারবে।তখন আমি ঝিনুককে নয় ঝুমকে বেছে নিয়েছি।বলতে গেলে আমিই কোনো না কোনোভাবে ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী।

বেয়াহার মত স্বীকার করছো।লজ্জা করছে না তোমার।(অভ্র চিৎকার করে)

আমি তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে
তুমি জানো যখন জহির খান আমার মাকে মেরেছিল তখন আমার মাও সাত মাসের প্রেগনেট ছিলো।আমার মায়ের গর্ভেও ছিলো আমার ছোটো ভাই বা বোন। তবুও তারা তাকে মেরেছে।

অভ্র আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো

আর শুধু ঝিনুক না।আমি দেশে এসেছিলাম তোমাকে আর ঝিনুককে একসাথে মারতে।কিন্তু যখন ঝিনুক মারা গেলো তখন তুমি আমার মামাকে মেরে ফেললে।
আমি বুঝতে পারছিলাম তুমি কোনো সাধারণ মানুষ না।তোমার কোনো ইনফর্মেশন আমি পাইনি।এমনকি ছবিও না।তোমাকে মারা সহজ হবে না সেটা আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম।আর তখন দেশে থাকলে তুমি আমাকেও খুঁজে বের করে মেরে ফেলতে।তখন আমার বদলা অসম্পূর্ণ থেকে যেতো।তাই বাধ্য হয়ে আমি দেশ ছেড়ে চলে যাই।

যাওয়ার আগে আমার ছেলেকে কেনো নিয়ে গেছো?আমার ছেলে তার মার খুনির কাছে বড়ো হয়েছে।তুমি ওকে নিজের সুরক্ষার জন্য রাখতে চেয়েছিলে তাই না?যাতে আমি তোমাকে না খুন করি।(অভ্র)

না।আমি ঝুমকে কেন্দ্র করে কোনো খেল খেলি নি।ওকে আমি নিয়ে গেছি কারণ ও ছিল একা।ঠিক আমার মতো।তাই ওকে আমার সাথে রেখেছি।ওর মধ্যে নিজের একা সত্তা দেখতে পেতাম।ওকে আমি এমন ভাবে মানুষ করতে চেয়েছিলাম যাতে ও প্রতিশোধ পরায়ন না হয়।ভুলেও যেনো আমার আর তোমার মত না হয়।আর ঝিনুককে আমি প্রমিজ করছি ঝুমকে প্রতিশোধ পরায়ন করবো না। ভুলে যেও না আমি ডক্টরের কাছে ঝুমকে চেয়েছিলাম।(আমি মুচকি হেসে)

তোমার ঐ খুনি মুখে আমি আর একটা কথাও শুনতে চাই না।
বলেই যেই অভ্র আমার দিকে তেড়ে আসতে লাগবে তখনই ওর হাত পা অবশ হয়ে ও নিচে লুটিয়ে পড়লো।

আমি ওর মাথার কাছে বসে ওর মাথা নিজের কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলাম,,
যাকে মারতে এসেছিলাম আট বছর আগে।তাকে ভালোবেসে ফেলেছি।আর তাকেই বিয়েই করেছি।কি ভাগ্য আমার!আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি অভ্র।আগে যদি হতো তোমার হাতে নিজের জান দিয়ে দিতাম।কিন্তু এখন দিতে পারবো না।কারণ এখন আমার মধ্যে বেড়ে উঠছে আরেকটা প্রাণ।

অভ্র অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো,,

হুম।তোমার প্রতিশোধের আগুন আমার গর্ভে।তাই আমি মরতে পারবো না।এছাড়া আরো একটা কারণ আছে।আর তা হলো ঝুম।আমি চাইনা ঝুম আমাকে ঘৃনা করুক।জানো যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকে কেউ আমাকে ভালোবাসে নি।মা সব সময় বাবার জন্য অপেক্ষা করতো আর কাদতঁ।আমার জন্য তার কোনো ভালোবাসাই ছিলো না।আর বাবা,উনার কথা তো সবই জানো।মামা ছিলো প্রতিশোধ পরায়ন।আমাকে কেউ কোনো দিন ভালোবাসেনি।
আর তুমি,তুমিও কোনো দিন আমাকে ভালোবাসো নি।শুধু নাটক ছিলো তোমার ভালোবাসায়।সবই মিথ্যা।
কিন্তু জানো একমাত্র ঝুম আমাকে মন থেকে ভালোবেসেছে।ওর মাকে ও খুব ভালোবাসে।আমি ওর এই ভালোবাসা হারাতে চাই না।ওর এই ভালোবাসা আমি সারাজীবন পেতে চাই।আর এই জন্য তোমাকে মরতে হবে।না হলে আজ না হয় কাল তুমি আমাকে মেরে ফেলবে।

অভ্র অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

তোমার কফিতে পেরালাইজের ঔষুধ মেলানো ছিলো। বারো ঘণ্টা পর্যন্ত তুমি এই অবস্থায় থাকবে।কিছুক্ষণ পর এই পুরো বাগান বাড়ি ব্লাস্ট হয়ে যাবে।কালকে খবরে বের হবে গ্যাস সিলন্ডারের বিস্ফোরিত হয়ে অভ্র আহমেদ ওরফে অভ্র শিকদার ইন্তেকাল করেছেন।
আর তুমি একটুও চিন্তা করবে না।ঝুম আর আমার অনাগত সন্তানকে আমি আমার বুকে আগলে রাখবো।আর সারাজীবন তোমাকেই ভালোবেসে কাটিয়ে দেবো।কিন্তু তোমার সাথে কাটাতে পারবো না।ভালোবাসতে পারলেই কারো সাথে কাটানো সম্ভব হয় না।

বলেই অভ্রর কপালে চুমু দিয়ে বেলী ফুলের মালাদুটোর উপরে ওর মাথা রেখে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পেরালাইজ হওয়ার কারণে ওর মুখ থেকে টু শব্দও বের হচ্ছে না।আর পেছন ফিরে তাকালাম না।জানি তাকালেই দুর্বল হয়ে পড়বো।


বের হতেই
খুব বড়ো একটা বিস্ফোরন হলো।আমি গাড়িতে উঠে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।আজকে আবার নিজে ড্রাইভ করতে লাগলাম।আরিফকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।


চলিশ দিন পর
আজকে আমি আর ঝুম দেশ ছেড়ে বিদেশ চলে যাচ্ছি।এই দেশে আর আমাদের জন্য কিছু নেই। ভালোবাসার মানুষগুলো আজ নেই,,প্রতিশোধ নেয়ার মত মানুষও এখন শেষ। ঝুমও এই দেশে থাকতে চায় না।অভ্রর চলে যাওয়ায় ঝুম খুব কষ্ট পেয়েছে।যদিও ও কিছু জানে না।কিন্তু ও তো অভ্রর ছেলেই ছিলো।বাবার মৃত্যু একটু হলেও ওর উপর প্রভাব ফেলেছে।ছেলেটা নিজের জন্মদিনেই মা বাবাকে হারিয়েছে।আর আমিই ওর বাবা মাকে মেরেছি।
ভেবেই আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলাম।

ম্যাম চলুন।(আরিফ)

হুম।(বলেই আমি চলতে শুরু করলাম)

ঝুমকে কোলে নিয়ে জয় চলতে শুরু করলো।জয় আর আরিফও আমার সাথে দেশে ছাড়বে।সেদিন আমার আর অভ্রর মধ্যে কি হয়েছে?আরিফ আর জয় কিছুই জানতে চায়নি।যেহেতু এখন কেউ নেই তাই ওরা আমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়ে আছে।আমি যদিও ওদের মানা করেছি তবুও ওরা শুনতে চাইল না।ছোটো থেকে মামাই ওদের নিজের ছেলের মত বড়ো করেছে।আর আমার মাও ওদের অনেক আদর করেছে।তাইতো আমার মার জন্য ওরা এতো প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে গেছিলো।কিন্তু আমি চাইনা ঝুম প্রতিশোধ পরায়ন হোক।এই জন্য আমার যা করার করবো।ঘৃণায় কখনও ঝুম বাচবে না।ওর মনে যাতে ঘৃনা না জন্ম হয় সেই জন্য যদি হাজারটা কথা নিজের মধ্যে মাটি চাপা দিতে হয় তবে আমি সেই হাজারটা কথা মাটি চাপা দিতে পারি।


প্লেনে বসে আছে
ঝুম আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে।আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।কারণটা অভ্র।কারণ আমি তো ওকে অনেক ভালোবাসি।আর আমিই ওকে মেরে ফেলেছি।যাকে ভালোবাসি তাকে মেরে ফেলতে অনেক সাহসের প্রয়োজন হয়।কিন্তু ঠিকই ততটাই কষ্ট হয়।যা না বলা যায়,না বুঝানো যায়,আর না সহ্য করা যায়।


কয়েক মাস পর
আমার কোলে একটা মেয়ে আসে।আমার আর অভ্রর মেয়ে।কেনো জানি মেয়েটাকে কোলে নিয়েই আমি ওর নাম নেই ঝিনুক।এক ঝিনুককে আমি মেরেছি আরেক ঝিনুককে আমি জন্ম দিয়েছি।ঝুম তো অনেক খুশি ও বড়ো ভাই হয়েছে।আমি বেডে শুয়ে আছি আর আমার পাশে ঝিনুক।তখনই জয় ঝুমকে নিয়ে রুমে ঢুকলো,,

আম্মু। বেবিটার নাম কি?(ঝুম ওর ছোটো ছোট হাত গুলো ধরে)

ঝিনুক!(আমি মুচকি হেসে)

ঝিনুক?(ঝুম ঝিনুকের সাথে খেলতে খেলতে)

হুম।পছন্দ হয়েছে তোমার?(আমি)

হুম।আম্মু বোন একদম আমার মত হয়েছে তাই না?আমি এমন কিউট ছিলাম না।ছোটো থাকার সময়।(ঝুম)

আমি শুয়া থেকে উঠে ঝুমকে কাছে টেনে ওর মাথায় চুমু দিয়ে বললাম,,
তুমি ওর থেকে বেশি কিউট ছিলে বাবা।

আম্মু।এখন আব্বু থাকলে বোনকে কোলে নিয়ে অনেক আনন্দ করতো,তাই না?(ঝুম আমাকে জড়িয়ে ধরে)

আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম
আব্বু নেই তো কি হয়েছে?তুমি তো আছো। বড়ো ভাই তো বাবারই মতো।আমরা দুজন মিলে ওকে আগলে রাখবো।ঠিক আছে?

ওকে।
বলেই আবার ঝুম ঝিনুকের কাছে গেলো।

ঝুম ঝিনুকের সাথে খেলছে আর খিলখিল করে হাসছে।আর আমার পিচ্ছিটাও খিলখিলিয়ে হেসে যাচ্ছে।

আমি বসে বসে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি।অভ্র দেখো আজ আমাদের,তোমার,আমার আর ঝিনুকের সন্তান কতো সুন্দর করে হাসছে।এই হাসি যেনো আমি রাখতে পারি অভ্র।আর এই হাসি রক্ষা করতে করতে একদিন যেনো আমি তোমার কাছে ফিরে আসতে পারি।তখন কি আমায় গ্রহণ করবে?নাকি অভিমান করে দূরে সরিয়ে দেবে?
আচ্ছা থাক।বলতে হবে না
Confusion is better than conclusion,,,
এই কনফিউসন আমার অনেক ভালো লাগে।

……………….#THE_END…………