অন্তরালে তুমি পর্ব-০৪

0
2520

#অন্তরালে_তুমি
#Part_04
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
চারদিকটা সাদা ও সোনালি রঙের মরিচবাতির আলোয় ঝলমল করে উঠেছে। নিজেকে সাদা গোলাপে মুড়িয়ে সজ্জিত হয়েছে আজকের আনুষ্ঠানিক মহলটি। আগন্তুকদের আনাগোনাও শুরু হয়ে গিয়েছে। সকলের মুখেই এক কৌতূহলী ভাব। থাকার কথাই। হুট করে এইভাবে বিয়ে করার কারণটা তারা খুঁজে পাচ্ছে না। দুইজনকে নিয়ে প্রায় সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে কিন্তু অতঃপর “অন্যের জীবনে নাক গুলিয়ে লাভ কি?” এই উক্তি আদানপ্রদান করে কথাটির ইতি টেনে দিচ্ছে। কেন না ভুল বসত যদি এই সব আরিহার কান অবধি পৌঁছায় তাহলে কেলেঙ্কারি লেগে যাবে। এইখানে সকলেরই আরিহার রাগ সম্পর্কে ধারণা আছে যার জন্য তাদের মনের মধ্যে সর্বদাই এক ভয় ঘাপটি মেরে বসে থাকে।
দেখতে দেখতে সকল আগন্তুকের আগমন হলো। কিন্তু যারা এই অনুষ্ঠানের মূল কেন্দ্রবিন্দু তাদেরই খোঁজ নেই। সকলের চোখ যেন এখন তাদেরকেই খুঁজে চলেছে। বিশেষ করে মেয়েরা তো মরিয়া হয়ে উঠেছে ইহানের এক ঝলক দেখার জন্য। আর হবেই না কেন? ইহান যে সকল রমনীর একমাত্র ড্রিমবয়।
অবশেষে সকলের অপেক্ষার অবসান হলো। গেট দিয়ে চারজন যুবক প্রবেশ করলো। চারজনেরই পরনে ব্ল্যাক ব্লেজার আর প্যান্ট। ভিতরে লাল শার্ট। চুলগুলো ব্রাশ করা। ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি। এরা বরং আর কেউ নয় ইহান, সোহেল, রাহুল, তীব্র।
সকল মেয়েরা যেন রীতিমতো হা হয়ে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে যেন গিলে খাচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটা মেয়ে ছুটে গেল তাদের দিকে সেল্ফি তুলার আশায়। দেখতে দেখতে বেশিরভাগ অনেকেই ঘিরে ধরলো ওদের।
এরই মধ্যে আরিহা এসে প্রবেশ করলো। পিছে পিছে পুষ্পিতা আর নীরাও। আরিহার পরনে হোয়াইট কালারের একটি গাউন। দেখতে কিছুটা লেহেঙ্গার মত হলেও আসলে এইটা গাউন এই। গাউনে উপরের দিকে ছোট সাদা পাথর বসানো আর নিচের দিকটা সোনালী রঙের জরিসুতো দিয়ে কারুকাজ করা। তার উপর সাদা পাথর বসানো। মুখে হাল্কা মেকাপ।
পুষ্পিতা আর নীরার গায়েও সেম ড্রেস কিন্তু তাদের রঙ ভিন্ন। পুষ্পিতা পড়েছে বাদামী আর নীরা পড়েছে নীল। তাদের মুখে হাল্কা মেকাপ।
আরিহা ভিতরে ঢুকতেই তার চোখে সর্বপ্রথম ভীরের মধ্যে থাকা ইহানকেই চোখে পড়ে। সে বাঁকা হেসে ভীরের মধ্যে গিয়ে হুট করে ইহান হাত জরিয়ে ধরে আর মুখে এক মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলে,

— আপনাদের যদি তাহলে কি আমি নিজের বরকে একটু নিয়ে যেতে পারি? নিজের প্রোপার্টিকে পাবলিক প্রোপার্টি হতে দেখে একদম ভালো লাগছে না। কথা অতি মধুর হলেও যারা বুঝতে পেরেছে তাদের জন্য ছিল অতি তিক্ত।

সকলে কথার মর্ম বুঝতে পেরে আস্তে আস্তে কেটে পড়ে আর ইহান আরিহার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। এইভাবেও যে কাউকে অপমান করা যায় তা তার জানা ছিল না।

?

সকলের সাথে পরিচয়পর্ব শেষ করে ইহান গিয়ে জুস কর্নারে বসে। আসার আগেই বন্ধুদের কি যেন একটা ইশারা করে প্রশান্তির হাসি হাসে। জুসের গ্লাস হাতে নিতেই অর্পা এসে হাজির হয়। অর্পিকে দেখার সাথে সাথে ইহানের মুখে থাকা হাসিটা যেন আরও কয়েক’শো গুন বেরে যায়। এইবার সে শুরু করে তার নিজের খেলা।

আরিহা দাঁড়িয়ে কিছু ক্লায়েন্টদের সাথে কথা বলছিল তখনই সেখানে এসে হাজির হয় রাহুল। সাথে আরও অপরিচিত কয়েকজন। মুখে তাদের এক শয়তানি হাসি।
রাহুল অতি উৎফুল্ল সুরে বলে উঠে,

— ভাবি জি!! কিছুটা টান দিয়ে।

আরিহা এইবার কথা বলা বাদ দিয়ে ওদের দিকে ভ্রুকুটি জোড়া করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তারপর কি যেন মনে করে ক্লায়েন্টদের দিকে তাকিয়ে বলে,

— বাকি কথা পরে হবে নে এখন আপনারা পার্টি এনজয় করুন। এক্সকিউজ মি নাও প্লিজ!

ক্লায়েন্টরাও হাসি মুখে অন্যদিকে চলে যায়। আরিহা এইবার ওদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,

— জ্বী বলুন।

রাহুল এইবার কিছুটা দুষ্টুমির সুরে বলে,
— উফফ ভাবি এইভাবে বইলেন না বুকে গিয়ে লাগে তো। আপনার রুপের আগুনে তো এইভাবেই পুড়ছি এখন কি কথার জালে ফেঁসে অতুল সমুদ্রে হাবুডুবু খাব? এত আহত আমাদের কইরেন না গো ভাবি।

আরিহা এইবার রাহুলের দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত গলায় বলে,
— আমার হাতে থাকলে একদম নিহতই করে দিতাম মি. রাহুল।

কথাটা শান্ত ভাবে বলা হলেও কথাটি ছিল অতি তিক্ত। কিন্তু সেইসব তোক্কোয়া না করে দুঃখী দুঃখী একটা ভাব নিয়ে বলে,

— ইশশ! কি যে বলেন না ভাবি। কিন্তু ভাবি যানেন আপনার জন্য না খুব কষ্ট হয়। দেখেন ভাবি ইহান কিভাবে অন্যের সাথে মশগুল হয়ে আছে। আপনার কথা তো ওর মনেই নেই। কেমন ঢলে ঢলে পড়ছে অন্যের গায়ে। ইহানের দিকে ইশারা করে।

আরিহা এইবার সেই দিকে তাকিয়ে দেখে ইহান একটা মেয়ের সাথে খুব হাসাহাসি করে কথা বলছে। মেয়েটি ইহানের খুব কাছাকাছি বসা। কিন্তু তা দেখেও আরিহার মধ্যে তেমন কোন ভাবান্তর দেখা দিল না। সে আগের ন্যায় শান্ত হয়েই দাঁড়িয়ে আছে। রাহুল তা দেখে পৈচাশিক হাসি দিয়ে বলে,

— আপনি এত সুন্দর, হ* আর সে* কিন্তু ইহান আপনার দিকে একবারও ঘুরে তাকায় না। আসলে ইহান হিরার কদরই করতে জানে না। কিন্তু আমরা জানি। তাই তো আপনার একাকিত্ব বুঝে সকলেই আপনার সেবায় হাজির হয়ে পড়লাম। একবার বলে তো দেখেন ভাবি বান্দা হাজির হ্যায়। কখনো নিরাশ হবেন না কথা দিচ্ছি। কিরে সকল ভাবিকে খুশি রাখতে সাহায্য করবি না বল।

সকলেই এক পৈচাশিক হাসি দিয়ে মাথা দুলায়। কিন্তু আরিহার মধ্যে তখনও তেমন কোনো ভাবান্তর বা হেলদোল নেই। সে সর্বদার মতই শান্ত। আরিহা এইবার শান্ত চাহনিতে রাহুলের দিকে তাকায়। তারপর স্মিত হেসে বলে,

— আচ্ছা সবই বুঝলাম। এতই যখন আমার সেবা করতে চান তাহলে দিলাম সুযোগ কিন্তু তার আগে আমার না ছোট একটা প্রশ্ন ছিল আপনার কাছে।

— হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন।

— আজকে কি আপনি আয়নার সামনে গিয়ে নিজের চোখে চোখ রেখে দাড়াতে পারবেন? পারবেন নিজের ওই গতিশীল হৃৎপিণ্ডের উপর হাত রেখে বলতে যে আপনি আপনার মা ও বোনকে সত্যি সম্মান করেন? আচ্ছা আপনার বউ কি আদো আপনার পাশে নিরাপদ থাকবে?

এই শান্ত কন্ঠে বলা কথাগুলো যেন রাহুলের বুকে তীরের মত লাগে। বুকটা হুট করেই কেঁপে উঠে তার। কোথ থেকে এক অস্বস্তিকর ভাব এসে হানা দেয় বুকের মাঝে।
তখনই সেখানে তীব্র এসে হাজির হয়। আর আরিহার সামনে তাকিয়ে বলে,

— ভাবি আ’ম সরি। ওদের পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আসলে..

তীব্রকে বলতে না দিয়ে আরিহা বলে উঠে,
— কিছু বলতে হবে না। এইসব যে ইহানের প্লেন আমি জানি। ইহান আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এইসব করেছে তাই তো?
ওর মতে মেয়েদের সবচেয়ে বেশি মূল্যবান তাদের ইজ্জত। যখন সেটাতেই কেউ হাত দেয় তাও তার স্বামীর সামনে আর তার স্বামী যদি তখন কিছু না করে মুখ ঘুরিয়ে বসে থেকে অন্য মেয়ের সাথে আড্ডায় মেতে উঠে তখন এর ভ
চেয়ে বেশি কষ্টের আর কিছু হয় না। এতে সে একদম ভেঙ্গে যায়। তাই আমাকেও ভাঙ্গার জন্য ও এইসব করে তাই তো?
কিন্তু ও ভুলে যাচ্ছে ও কার উপর কোন জিনিস প্রয়োগ করছে৷ বাকি সব মেয়ে আর আমার মধ্যে আকাশ পাতালের তফাৎ আছে। আমি অন্যদের মত চোখ নিচে রেখে কথা বলি না। আমি চোখে চোখ রেখে আঙুল তুলে কথা বলতে জানি। আর এমনেও এইসব লেম টাইপ জিনিস আমার উপর কোন প্রভাবই ফেলে না। সাচ আ লেম থিং।

আরিহা এইবার বাঁকা হেসে বলে,
–এইখানে যদি মি. রাহুলের জায়গায় অন্য কেউ হতো নির্ঘাত আমি এখন সুট আউট করে দিতাম। কিন্তু মি. রাহুলের আচরণে আমি শুধু নাটকীয় ভাব দেখেছি কোন খারাপ উদ্দেশ্য না। চোখে তার কোন লালসা ছিল না। যার জন্য সে বেঁচে গিয়েছে।
আর মি. তীব্র আপনি যে এদের অজস্রবার এইসব করতে বারণ করেছেন তাও জানি। আপনার মন কখনো একটা মেয়েকে অসম্মান করার সম্মতি দেয় না তাই তো।
আমি এইসব কিভাবে জানি তা আপনাদের না জানলেও হবে। এখন শুধু এতটুকুই বলবো ইহানকে গিয়ে বলে দিবেন এইসব লেম ট্রিকস গুলো আমার উপর কাজ করবে না। অন্য মেয়েদের সাথে আমায় না মিলিয়ে আমাকে বুঝে আমার লেভেলের কিছু করতে বলবেন ওকে।

তীব্র মুচকি হেসে বলে,
— তুমি সত্যি ইউনিয়ক আরিহা। সরি করে বলছি কেন তুমি আমার ছোট বোনের সমান।

আরিহা কিছু না বলে মুচকি হাসে। তারপর রাহুলের দিকে তাকিয়ে গাম্ভীর্য কণ্ঠে বলে,

— মি. রাহুল একটা কথা মনে রাখবেন নিজের সম্মান নিজের চোখের মধ্যেই। আপনি যদি নিজের চোখে দিকে কখনো চোখ না রাখতে পারেন তাহলে মনে করে নিবেন আপনি হচ্ছেন এই পৃথিবীর সবচেয়েতে অসম্মানিত ব্যক্তি। তাই অন্যের কথায় নিজেকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসম্মানিত ব্যক্তির তালিকায় নাম লিখবেন না।

এতটুকু বলেই আরিহা সেখান থেকে চলে যায়। আরিহার কথায় রাহুল নিজের করা ভুল বুঝতে পারে। সে যে কতটা নিচুমানের কাজ করে বসেছে এখন সে হারে হারে টের পাচ্ছে। তীব্র রাহুলের কাঁধে হাত রেখে বলে,

— বুঝলি রাহুল এই মেয়ে থেকে ইহান নিস্তার পাবে না। ইহানকে এর প্রেমে পড়তেই হবে। যাকে বলে ভয়ংকর প্রেম।

?

রাহুল ইহানের সামনে বসে আছে। পাশেই তীব্র, অর্পা, সোহেল। রাহুল সকলকেই একটু আগের ঘটনা খুলে বলে। ওর কথা শেষ হতেই অর্পা তেতে উঠে বলে,

— আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড ইহান। এইসব কি? তুই এত নিচু কিভাবে হতে পারলি? মানছি আরিহাকে তুই পছন্দ করিস না কিন্তু তাই বলে এত জঘন্য একটা কাজ করার কথা ভাবলিও কি করে? তাও আবার আমার অজান্তেই আমাকে ইউসও করলি। ছি!
আর তুমি রাহুল। তুমি বা কিভাবে পারলে ওর কথায় এইসব করতে? এখন যদি এইসব আমার সাথে কেউ করতো তখন? তোমাকে আমি ভালবাসি ভেবেও এখন আমার গা গুলিয়ে আসছে। ঘৃণা হচ্ছে তোমার প্রতি। ছি!

রাহুল তখন অসহায় চোখে অর্পার দিকে তাকায়। আর কাতর কণ্ঠে বলে,
— অর্পা আই প্রমিস এই হারামির কথার শুনে জীবনেও কোন কিছু করবো। তাও ভুল বুঝো না আমায়। আমি বুঝতে পারছি আমি ঠিক কত বড় ভুল করে বসে আছি।

অর্পা এক রাশ ঘৃণা নিয়ে রাহুলের দিকে তাকায়। আর সেখান থেকে চলে যায়। রাহুল এইবার ওর পিছে পিছে ছুটে যায়। তীব্র আর সোহেল তা দেখে দীর্ঘ শ্বাস নেয়। সোহেল তখন বলে,

— ইহান প্রথমে সবকিছু মজার মত নিলেও এখন বুঝছি কাজটা ঠিক হয় নি৷ আরিহা কষ্ট না পেলেও কাজটা অন্যায়মূলক হয়েছে। যার জন্য ইউ সুড বি সরি। আমরা কেউ কখনো কোন মেয়েকে অসম্মান করি নি। আরিহা একটু অন্যরকম কিন্তু তাও ও তো একটা মেয়ে।

ইহান এইবার অপরাধবোধ অনুভব করে। আরিহাকে কষ্ট দিতে গিয়ে যে ভুল পদ্ধতি অবলম্বন করে নিয়েছে তা বুঝতে তার বেগ পেতে হলো না। সে শুধু এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে হাতে থাকা গ্লাসটির দিকে তাকিয়ে থাকে।

?

ক্লাবটির পিছনের দিকের সুইমিংপুলটার মধ্যে পা ভিজিয়ে বসে আছে আরিহা। চোখ দুটো হাল্কা লাল। মুখে ছেঁয়ে আছে গাম্ভীর্যতা। ডান হাতে একটি স্পীডের ক্যান। একটু পর পর সে ক্যানটাতে চুমুক দিচ্ছে আর সুইমিংপুলের থাকা পানির দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। নিচে নীল রঙের টাইলস থাকার ফলে পানিটি নীল রঙ ধারণ করেছে বলে মনে হচ্ছে।
কি যেন ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে সেইদিনের স্মৃতিটা ভেসে উঠে। যেইদিন প্রথম ইহানের সাথে ওর দেখা হয়েছিল।

?
পুষ্পিতা আর নীরাকে লন্ডনের ফ্লাইটে উঠিয়ে দিয়ে আরিহা গাড়ি নিয়ে ছুটে চলে মানিকগঞ্জের দিকে। আশুলিয়ার হাইওয়ে দিয়ে দ্রুত বেগে ছুটে চলেছে গাড়িটি। আরিহা ফোনের স্পিকার অন করে মেনেজারের সাথে কিছু কথা বলছিল। আজকে মানিকগঞ্জে একটি ইম্পোর্টেন্ট মিটিং আছে সেটা নিয়েই মূলত তাদের কথাবার্তা।
ঠিক তখনই পিছন থেকে দ্রুত বেগে কেউ হর্ণ চাপতে শুরু করে। যা ক্রমাগত অসহ্যকর হয়ে উঠছিল। আরিহা এইবার ফোনটা কেটে পিছে তাকায়। কে এমন করছে ঠিক জানার জন্য। আরিহা দেখতে পায় একটি লাল গাড়ি ওর পিছে থেকে অনাবরত হর্ণ বাজিয়ে চলেছে। আরিহা কিছু বলতে যাবে তার আগেই গাড়িটি আরিহার গাড়ির পিছে একটা বারি দিয়ে ওর গাড়ির সাথে একদম ঘেষে ওভারটেক করে চলে যায়। যার ফলে আরিহার ডান পাশের লুকিং মিরোরটি ভেঙে যায়।
আরিহা এইবার ধৈর্যের সকল বাঁধ ভেঙে যায়। রাগটা যেন অষ্টম আকাশে পৌঁছে যায়। গাড়িটার এক্সেলেটর জোরে চেঁপে ধরে দ্রুত গতিতে গাড়িটা টান দিয়ে ওই গাড়ির সামনে নিয়ে যায়। চোখের পলকেই ওই গাড়িকে ওভারটেক করে খানিকটা সামনে গিয়ে গাড়িটা মাঝ রাস্তায় আড়া – আড়িভাবে দাড় করায়। যার ফলে সেই গাড়িটা আরিহার গাড়ির সামনে আসতেই থেমে যায়। আরিহা এইবার একটা ভাব নিয়ে বেড়িয়ে আসে গাড়ির ভিতর থেকে। সাথে সাথে সেই লাল গাড়িটি থেকেই একজন যুবক বেরিয়ে আসে।
পরনে লাল শার্ট আর সাদা জিন্স। চুলগুলো কপালে এসে পড়েছে। চোখে মুখে বিরক্তিকর একটা ভাব। সে একটা ভাব নিয়ে আরিহার সামনে এসে দাড়ায়। কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরিহা ডান সেই যুবকটির গালে কোষে চড় বসিয়ে দেয়। যুবকটি বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে আরিহার দিকে তাকিয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই বিষ্ময়কর দৃষ্টি রাগান্বিত দৃষ্টিতে পরিনত হয়। সাদা গালে থাপ্পড় পড়ার ফলে গালে রক্তিম আভা ফুটে উঠে। চোখ মুখ রাগের ফলে লালবর্ণ ধারণ করে।
আরিহা কিছু বুঝে উঠার আগেই সেই যুবকটি আরিহার ডান গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। এইবার চেঁচিয়ে বলে উঠে,

— হাও ডেয়ার ইউ? আমাকে! ইহান মাহমুদকে থাপ্পড় মারার সাহস হয় কিভাবে??

আরিহা ইহানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

— “চোরের মায়ের বড় গলা”- প্রবাদটি আপনার জন্য একদম প্রযোজ্য। আর আপনার সাহস তো দেখছি বড্ড বেশি। আমাকে থাপ্পড় মারার মত দুঃসাহস দেখিয়েছেন।

— আমার সাহস মূলত বেশিই। আর বিনা দোষে থাপ্পড় খেয়ে আমি ভদ্র ছেলের মত দাড়িয়ে থাকার মত স্বভাব আমার নেই। আমি বলার চেয়ে সুদে আসলে সবকিছু ফেরত দিতে বেশি ভালো জানি।

আরিহা এইবার বাঁকা হেসে বলে,
— তাহলে তো আমাকেও মুখে না বলে সুদে আসলেই ফেরত দেওয়া উচিৎ। তা আপনার কাছে লাইটার বা ম্যাচ আছে?

এমন কথায় ইহান কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। একবার ভালো করে আরিহাকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে নেয়। পড়নে তার অতি সাধারণের মধ্যে কারুকাজ করা একটি সাদা কামিজ। চোখে চিকন ফ্রেমের সিলভার কালারের একটি চশমা। বাঁকা হাসার ফলে এক গালে টোল পড়ে আছে। দেখতে তো ভদ্র বলে মনে হচ্ছে। ইহান এইবার কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠে,

— আমার কাছে এইসব চাওয়ার মানে?

আরিহা এইবার শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
— কারণ আপনি যে সিগারেট খান তা স্পষ্ট। কেন না আপনার ঠোঁট কিছুটা কালছে রঙের। বা হাতের ফাঁকে কিছুটা পোড়া দাগ দেখা যাচ্ছে। আর বাম সাইডের পকেটে সিগারেটের প্যাকেটের একটি অংশ দেখা যাচ্ছে। তাই ভাবলাম আপনার কাছে লাইটার থাকা কথা। এখন বলেন আছে কি না? থাকলে দিন।

ইহান এইবার অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এতটুকু সময়ে মেয়েটা এত কিছু খেয়াল করে ফেলেছে। ইহান এইবার কথা না বারিয়ে নিজের ডাম পকেট থেকে একটা লাইটার বের করে আরিহার হাতে দিয়ে দেয়।
আরিহা এইবার মুচকি হেসে গাড়ির পিছন থেকে পেট্রোলের বোতলটা বের করে আনে। তারপর কিছু বুঝে উঠার আগেই ইহানের গাড়ির উপর ঢেলে দেয়। ইহান এইবার চেঁচিয়ে উঠে,

— এইসব কি হচ্ছে? আর ইউ মেড ওর হোয়াট?

আরিহা কিছু না বলে মুচকি হেসে লাইটার জ্বালিয়ে গাড়ির উপর ছুঁড়ে মারে। সাথে সাথে গাড়িটা ধাউ ধাউ করে জ্বলে উঠে। কড়া ফাটা রোদের মধ্যে আগুনে জ্বলতে থাকা গাড়িটা যেন প্রবল বেগে উত্তাপ বাড়াতে থাকে।সাথে ইহানের রাগের মাত্রাটাও।
আরিহা এইবার বাঁকা হেসে বলে,

— সব কিছু সুদে আসলে ফেরত দিলাম। সুদটা তুলনামূলক বেশি এই দিলাম। একটু যেই গাড়িকে ওভারটেক করেছিলেন সেটা আমারই গাড়ি ছিল। এইবার হয়তো নিশ্চয়ই বুঝেছেন যে আমি কোন সুদ আসলের কথা বলছি।

ইহান এইবার তেড়ে এসে বলে,
— তোমাকে তো আমিইইইইইই!!!

এর আগেই আরিহা একটা ক্রেডিট কার্ড ইহানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
— আপনার ক্ষতিপূরণ হতে বেশ টাকা এইটাতে আছে। এইবার কোন অভিযোগ থাকলে একা একা করতে থাকেন।

এই বলে আরিহা আর এক মিনিটও সেখানে না দাড়িয়ে গাড়িতে বসে দ্রুত বেগে গাড়িটিকে ছুটিয়ে চলে যায়। আর ইহান সেইদিকে তাকিয়ে কটমট করতে করতে বলে,

— আই উইল নোট স্পেয়ার ইউ। হেট দিস শিট।

?

কাঁধে কাউরো ছোঁয়া পেতেই আরিহা অতীতের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। পাশে তাকাতেই ইহানকে দেখে সে ইহানের দিকে শান্ত এক চাহনি নিক্ষেপ করে।
ইহান এইবার জুতো খুলে পেন্টটা উপরে গুজিয়ে নিয়ে পানিতে পা ভিজিয়ে ওর পাশে বসে পড়ে। আরিহা কিছু না বলে চুপচাপ আগের ন্যায় পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। ইহান তা দেখে বলে,

— কিছু কি ভাবছিলে?

আরিহা এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,
— অতীতের কিছু তিক্ত স্মৃতি মনে পড়ছিল। হোয়াট এভার! তুমি এখানে এইটা বলো।

ইহান এইবার এক দীর্ঘ শাস নিয়ে অস্পষ্ট সুরে বলে উঠে,
— আ’ম সরি। আমার এইসব করা ঠিক হয় নি।

আরিহা বাঁকা হেসে বলে,
— দ্যা ইহান মাহমুদ আমাকে সরি বলছে দ্যাট ইজ স্ট্রেঞ্জ। বাই এনি চান্স সত্যি আমাকে ভালবাসতে শুরু করতে নাকি?

ইহান এইবার তেতে উঠে বলে,
— হোয়াট রাবিস! ভুল করেছি বলে সরি বলছি। এর বেশি কিছু না। আই হেট ইউ এন্ড আই উইল ওলোয়েস হেট ইউ।

আরিহা এইবার হো হো করে হেসে উঠে। যার মধ্যে ছিল এক চাঁপা কষ্ট, আর্তনাদ যা কখনোই ইহানের অন্তরের ত্রিসীমানা পর্যন্ত পৌঁছাবে না। ইহান এইবার একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে যেতে নিতেই পানির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে। কেন না পানিতে…

#চলবে