অন্তরালে তুমি পর্ব-১৪

0
2655

#অন্তরালে_তুমি
#Part_14
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
এয়ারপোর্টের সামনে দাড়িয়ে আছে এরিনা। সাথে তার আরিহা, ইহান। সোহেল আসতে চেয়েছিল কিন্তু ইহান যদি প্রশ্ন করে বা কিছু মনে করে তখন সে কি বলবে? এই ভেবে আর তার আসা হলো না। কিন্তু ফোনে ঠিকই কথা হয়েছিল।
এরিনা সকলকে বিদায় দিয়ে চলে যায় ভিতরে। ইহান সেইদিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। আরিহা ইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,

— এখন কি বাসায় যাবে? নাকি না।

ইহান একবার আরিহার দিকে তাকিয়ে বলে,
— না এখনই বাসায় যাব। চল!

এই বলে দুইজনে এক সাথে গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। আরিহা ড্রাইভ করছে। ইহান আড়চোখে আরিহাকে দেখছে। কেন যেন আজ আরিহা দেখতে ইচ্ছে করছে। পরন্ত বিকেলের শেষভাগ। গোধূলির শেষ প্রহরে পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়েছে। আকাশে ছড়িয়ে আছে রক্তিম আভাটি। সেই আভাটির হাল্কা আলো এসে পড়ছে আরিহার উপর। এর প্রভাবে সাদা টপসটিও রঙ যেন বদলে ফেলেছে। মুখটা একদম স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাও কোথাও কি যেন কমতি লাগছে। ইহান ভাবতে থাকে সেই কমতিটি কি? অতঃপর একটু ভাবার পরই যে এখন যদি মুখে ছোট একটি হাসি থাকতো তাহলে যেন মেয়েটিকে একদম পুরিপূর্ণ লাগতো। কিন্তু মেয়েটা যে হাসতেই জানে না। এই ভেবেই ইহান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। হুট করেই ইহান আরিহার দিকে এক প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে,

— তুমি এমন কেন?

এমন এক খাপছাড়া প্রশ্ন শুনে আরিহা কিছুটা বিস্মিত হলো। আরিহা একবার ইহানের দিকে তাকায়। বুঝার চেষ্টা করে এমন প্রশ্ন করার পিছনে উদ্দেশ্য কি আর সে কি বুঝাতে চাচ্ছে। কিন্তু কিছু বুঝতে পারলো। এই প্রথম আরিহা কাউকে বুঝতে ব্যর্থ হলো। অবশ্য ইহানের সাথে ঘটা বেশির ভাগ ঘটনাই ওর জীবনে প্রথম অভিজ্ঞতার মধ্যেই পরে। আরিহা এইবার ইহানের দিকে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে,

— এমন বলতে কেমন?

ইহান এইবার আরিহার দিকে ঘুরে বসে বলে,
— এইযে সব সময় একদম সাদা পোশাক পড়। সাদা বাদে অন্য কোন রঙ আজ পর্যন্ত তোমায় পড়তে দেখেছি বলে মনে হয় না। মাঝে দুই তিন বার সাদার সাথে অন্য রঙের মিশ্রণ আছে এমন জামা পড়তে দেখেছি। কিন্তু তাও তো সেই সাদাই ছিল। এমন কেন?
তার উপর এত কঠোর কেন তুমি?

আরিহা তখন আড়চোখে ইহানের দিকে তাকায়। চোখে মুখে তার কৌতূহলের ছাপ স্পষ্ট। আরিহা চোখ ঘুরিয়ে কিছু না বলে ড্রাইভ করায় মনযোগ দেয়। ইহান আবার প্রশ্ন করতে গেলে আরিহা বলে,
— সময় হোক উত্তর পাবে।

এই বলে আবার ড্রাইভ করতে থাকে। ইহান এইবার বেকুবের মত তাকিয়ে থাকে। কিছু দূর যেতেই সিগ্ন্যালের জ্যাম পড়ে। ঢাকা শহরে এই সিগ্ন্যালের জ্যাম ঠিক কত দীর্ঘ হয় তা শুধু মাত্র ঢাকায় যাতায়াত করা পথিকরাই জানতে পারে। আর এদের সকলের কাছে যেন এই সিগ্ন্যালের জ্যাম মস্ত বিরাট এক অসহ্য বয়ে আনে তাদের মাঝে। কেন না এই জ্যাম ঠিক কখন ছুটে তার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। কখনো এই জ্যাম চোখের পলকে ছুটে যায় তো কখনো ঘন্টার পর ঘন্টা স্থির হয়ে বসে পার করতে হয়। যানবাহনের হর্ণ, নিকৃষ্ট কালো ধোঁয়া তাদের মধ্যে ছেয়ে যায় এক রাশ তিক্ততা আর বিরক্তিকর ভাব। দূর গন্তব্যকারী মানুষদের জন্য আতঙ্কের আরেক নাম এই সিগ্ন্যাল জ্যাম।
আরিহা ভালো করেই যানে এই জ্যাম সহজে ছুটবে না। আর এইটা মোক্ষম সময় ইহানের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার। তাই আরিহা ইহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

— আপনার প্রথম প্রশ্ন আমি কেন সাদা রঙ বাদে অন্য কোন রঙ পরিধান করি না। তাই তো?

ইহান এইবার মাথা দুলাই। আরিহা এইবার নিজের সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
— রঙ-তুলি চিনেন? চিনেন অবশ্যই। রঙ- তুলির মধ্যে থাকা সাদা রঙটার ম্যাজিক দেখেছেন কখনো? হয়তো না।

“সাদা রঙটি সবসময় নিরব আর শান্ত। সে একটি জায়গায় চুপ করে বসে থাকে। যেন তার এইখানে কোন কাজই নেই। কিন্তু আমরা সকলেই জানি তার গুরুত্ব ঠিক কতটুকু। এর ক্ষমতা যে অসীম।
সাদা রঙ থেকেই কিন্তু সকল রঙের উৎপত্তি। সকল বর্ণের জন্মদাতা সে। আমরা খালি চোখে না দেখলেও তার অস্তিত্ব কিন্তু ঠিকই রয়ে গেছে। সাদা সকল রঙের অস্তিত্ব ঠিকই কিন্তু তার অস্তিত্ব কেউ না।”

আমিও এই সাদা রঙের মতই। সকলের জীবনে নতুন এক রঙ তৈরি করে দিয়ে নিজের অস্তিত্ব তাদের মধ্যে ছেয়ে দেই। আর তারা উপলব্ধি পর্যন্ত করতে পারে না। কিন্তু একসময় ঠিকই তারা এই অস্তিত্বটা খুঁজে পাবে কিন্তু তখন যে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

এই বলে বাঁকা হাসে আরিহা। ইহান অবাক চোখে আরিহার দিকে তাকিয়ে আছে। কোথ থেকে আরিহা কোথায় গেল সে। আরিহা ইহানের অবস্থা বুঝতে পেরে বলে,
— জানি হয়তো কিছুই বুঝেন নি। অবশ্য আমার কথাগুলো এখন না বুঝলেও কোন এক সময় ঠিকই বুঝবেন। কিন্তু হয়তো তখন আমি থাকবো না। আপাতত এতটুকু জেনে নেন,

আমার জীবন সাদা আলোর মত। আর এর তিক্ততা প্রখর। এই তিক্ত আলো মানুষকে ভস্ম করার মত ক্ষমতা বহন করে আবার মানুষকে গড়তেও সাহায্য করে। তাই তো নিজেকে সবসময় সাদার আলোর বেড়াজালে আবদ্ধ করে রাখি। আর এর জন্যই আমি এত শক্ত। আশা করি এখন আপনি আপনার উত্তর পেয়ে গেছেন।
ইহান আর কিছু বলতে যাবে তখনই সিগ্ন্যালের জ্যাম ছেড়ে দেয় আর আরিহা মুচকি হাসে। যার অর্থ এই, “প্রশ্ন করা আর উত্তর দেওয়ার সময় এইখানেই সমাপ্ত।”

?

পুষ্পিতা পার্কের বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছে। মনের মধ্যে জমে আছে আকাশ সমতুল্য মেঘ। মাঝে মধ্যে গর্জে উঠছে মেঘগুলো। যখন তখন বর্ষণ হতে পারে।
কিন্তু কেন? এর মোক্ষম কারণ হচ্ছে তীব্র নামক ছেলেটি। ছেলেটি তিন যাবৎ ধরে উধাও৷ না কোন কল, না কোন মেসেজ কোন কিছুই করে নি সে। প্রথমদিন পুষ্পিতা এইসব গায়ে না নিলেও দ্বিতীয় দিন থেকে মনটা যেন ছটফট করতে থাকে। ভয়ানক ধরনের মিস করা শুরু করে তাকে। সারাদিন ফোনের স্ক্রিনের পানে তাকিয়ে দিন কাটায় সে। এই বুঝি তীব্র একটা দুষ্টুমিপূর্ণ মেসেজ এলো। এই বুঝি ওকে জ্বালানোর জন্য ফোন এলো। কিন্তু প্রতিবারই সে নিরাশ হয়েছে।
তৃতীয় দিনে তো সে পাগল প্রায় হয়ে যায়। তখন সে উপলব্ধি করতে পারে যে এই এক মাসে তীব্র তার এক ভয়ংকর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। যা এখন চেয়েও সে বদলাতে পারবে না। তীব্রের পাগলামো যে ওর মনে গেধে গেছে। ওর প্রতি যে সে দূর্বল হয়ে পড়েছে।

পুষ্পিতার হুট করেই ভয় পেতে শুরু করে। এত অবহেলা ও অপমানের পড়ে কি তীব্র এখন নিজের পরাজয় মেনে নিয়েছে? পিছ পা হয়ে গিয়েছে সে? সে কি এখন তাকে ভুলার চেষ্টা করছে? তার প্রতি ভালবাসার দাবী ছেড়ে দিয়েছে?
এইসব ভেবেই পুষ্পিতার ভিতরে এক অজানা ভয় বাসা বাঁধতে শুরু করে। তীব্রকে হারিয়ে ফেলার ভয়। সে এখন কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। প্রচন্ড রকমের কান্না পাচ্ছে তার। কিন্তু কান্না করতেও পারছে না। কি অবস্থা!
সে মাথা নিচু করে তার পায়ের বৃদ্ধা আঙ্গুলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর নিজেকে শান্ত করা চেষ্টা করছে। এমন কোথ থেকে এক কন্ঠ ভেসে আসে তার কানে,

— কি গো পুষ্পরানী? আমার সঙ্গ রেখে এইখানে নিঃসঙ্গ হয়ে বসে আছো কেন?

কণ্ঠটা কানে আসতেই পুষ্পিতা কণ্ঠের মালিককে চিনে যায়। সাথে সাথে সে চোখ তুলে তাকায়৷ তীব্রকে দেখার সাথে সাথে ওর মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে আর কিছু না ভেবে উঠে দাড়িয়ে পড়ে আর তীব্রের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পুষ্পিতার এমন কাজে তীব্র হতভম্ব হয়ে যায়। পুষ্পিতা যে এমন কিছু করতে পারে তা তার ভাবনা থেকে শত মাইল দূরে ছিল। কিন্তু অতঃপর নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে নেয়। পুষ্পিতার এমন করার কারণটা কিছুটা ধারণা করতে পেরে মুখে এক চিলিক হাসি ফুটে উঠে। আর সে পুষ্পিতার কানে ফিসফিস করে বলতে থাকে,

— প্রিয় তুমি একা হলে
আমায় দিও ডাক
তোমার সাথে গল্প করবো
আমি সারা রাত।

#চলবে