অন্তরালে তুমি পর্ব-১৩

0
2582

#অন্তরালে_তুমি
#Part_13
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
সময় কখনো কাউরো জন্য থেমে থাকে না। সে নিজ গতিতে অতিবাহিত হতেই থাকে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে একের পর এক ঋতুও এসে চলে যায়। পরিবর্তন হয় দিন, মাস, বছরের। সাথেই পরিবর্তন হতে থাকে মানুষের জীবন। কেউ ব্যস্ততায় ঢুবে থাকে তো কেউ কাউরোর স্মৃতির মাঝে। কেউ সুখে থাকে তো কেউ কষ্টে। বড়ই বৈচিত্র মানুষের জীবন ও তাদের জীবনের ধারা।
ইহান এখন বেশ সুস্থ। ডান হাতের প্লাস্টারটাও খুলে ফেলা হয়েছে। মাথার ঘাটাও বেশ শুকিয়ে এসেছে। যার ফলে আরিহাকে এখন আর বাসায় থাকতে হয় না। অফিসে গিয়ে কাজ করতে পারে সে। সামনের সপ্তাহেই রোজা শুরু হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু আরিহা ডিজাইনার সেহেতু রোজার মাসে ওর্ডারগুলো তুলনামূলক বেশিই হয়ে থাকে। এর জন্য ওর অফিসে কাজের চাপও মাত্রাতিরিক্ত বেশি। পুষ্পিতা আর নীরাও নিজেদের কাজে স্থির হয়ে গিয়েছে।
ইহানও কাজে লেগে পড়েছে। রোজার মাস নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কন্টেন্ট তৈরি করার চেষ্টা করছে। মাঝে তার অনেক খানি গ্যাপ হয়ে গিয়েছে তাই ইউটিউবে ভিউসও কমে এসেছে। ভিউস আবার বাড়াতে ইহান, তীব্র, সোহেল, রাতুল আর অর্পা লেগে পড়েছে৷ এই ৫ জনকে নিয়েই তাদের গ্রুপটি। শুরু থেকে ওরা একই সাথে কাজ করে আসছে।
আরিহা আর ইহানের মাঝে সব স্বাভাবিক হলেও কিছু জিনিস অস্বাভাবিকই রয়ে গিয়েছে। যেমনটা তাদের প্রতি তাদের মনোভাব। আরিহা আগের মতই আছে। একদম কঠোর কিন্তু ইহান আরিহার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু সে তা কখনো প্রকাশ করে না। কেন না এখনো অতীতের কিছু পিছুটান রয়েই গিয়েছে। সব ভুলে আগে এগুতে পারছে না সে।
এই কয়েকদিনে ইহান আরিহাকে অনেক কাছ থেকে জেনেছে। মেয়েটা বাকি ৮-১০ টা মেয়ের মত। অল্পতে সে কাঁদে না, অতিরিক্তেও কাঁদে না। বলতে গেলে মেয়েটা কাঁদতেই জানে না। প্রাণভরা হাসি তো মুখে দেখাই যায় না। দূর্লভ বস্তু প্রায়। রাগটা একটু বেশি। তার দৃষ্টি অতি সুক্ষ্ম। চট করেই সব বলে ফেলতে পারে। সাথে ওর সিক্স সেন্সও বেশ প্রখর। কষ্ট সহ্য করার অসীম ক্ষমতা আছে মেয়েটার মধ্যে। সবসময় শান্ত থাকবে অথবা বিরক্ত থাকবে। কিন্তু আপনজনদের খেয়াল রাখতে জানে। ইহানের মনের এইবার আরিহাকে ভালো করে জানার জন্য এক অজানা কৌতূহল জাগ্রত হয়েছে। মনের মধ্যে কি বয়ে বেরাচ্ছে মেয়েটা। কি এমন কষ্ট তার।

দিন শেষে ওর মনে একটা কথাই মস্তিষ্কে ঘুরে বেরায়।
“আরিহা কি আদো তাকে ভালবাসে? নাকি সে যা করেছে এইসবই তার শাস্তি মাত্র।”
কিন্তু উত্তরের কোটা তার প্রতিবারই শূন্য থাকে।

?

সোফায় আরিহা ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেয়। মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। সাদা কামিজটি লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। চুল গুলো ছাড়া। চোখ দুটি ক্লান্তিতে ভরে এসেছে। ঠোঁটটা একদম শুষ্ক। চোখের নিচে কালিও পড়তে শুরু করেছে। মাথাটা যেন ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে। সাথে কেমন মাথা ঘুরাচ্ছে আর বমি বমি ভাব হচ্ছে। কিন্তু সেই দিকে আরিহার কোন হেলদোল নেই। সে শান্ত হয়ে বসে আছে।
আরিহা এইবার কিছু না ভেবে চট জলদি দাড়িয়ে পড়ে আর এগিয়ে যায় রুমের দিকে। এইভাবে আলসেমি করে বসে থাকলে হবে। ফ্রেশ হয়ে আবার কিছু ফাইল দেখতে হবে তার।

রাতে খাবারের টেবিলে বসে আছে সবাই। আরিহা খাচ্ছে আর ফোনে কিছু ইনফরমেশন দেখছে। ইহান এরিনাকে খায়িয়ে দিচ্ছে। ২ দিনের মাঝেই এরিনা ব্যাক করছে। তার ছুটি যে ফুড়িয়ে এসেছে। তাই তো ইচ্ছে মত ভাইয়ের আদর কুড়িয়ে নিচ্ছে।
আরিহা এইবার ফোন থেকে চোখ সরিয়ে এরিনার দিকে তাকায়। তারপর স্মিত হেসে বলে,

— এরিনা সব কিছু প্যাক করে ফেলেছো তো? কোন কিছুর দরকার হলে বলো আমি এনে দিব নে।

এরিনা তখন মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,
— না ভাবি আর কিছু লাগবে না। সব কিছুই প্যাক করা হয়ে গিয়েছে।

ইহান তখন একটু অভিমানী সুরে বলে,
— আর একটা মাস থেকে যেতে পারলি না? একবারে ঈদটা আমাদের সাথে করেই যেতে পারতি।

এরিনা এইবার মুখ ফুলিয়ে বলে,
— হ্যাঁ পড়া গুলো তো গোল্লায় যাবে তাই না? তুমি অসুস্থ বলে ১ মাসের ছুটি নিয়ে এসেছিলাম। তা না হলে এই সময়ে আসা সম্ভবই ছিল না। কতটা পিছিয়ে গিয়েছি জানো? লুনা প্রতিদিন নোট গুলো দেয় বলে কিছুটা হলেও কাভারাপ করতে পারছি। আবার বলছো আরও ১ মাস থাকতে। ইম্পসিবল!

ইহান এইবার আহত সুরে বলে,
— তো কি করবো বল? ওইখানে তুই একা ঈদ করবি ভাবলেই তো কেমন লাগে। তোর ইচ্ছে ছিল বাইরে পড়ার তাই তোকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাইরে পাঠিয়েছিলাম আমি। তা না হলে নিজের থেকে এত দূরে কখনো পাঠাতাম না তোকে।

এরিনা এইবার মুচকি হেসে বলে,
— আর একটা বছর সহ্য করো ভাই। গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট হতে আর মাত্র ১ টা বছর বাকি। তারপর একবারে পার্মানেন্টলি তোর কাছে এসে পড়বো নে কেমন?

ইহান মুচকি হেসে বলে,
— হুম। ফ্লাইট কখন তোর?

এরিনা বলে,
— কাল রাত ১ টায়।

খাওয়া শেষে সকলেই যার যার রুমে চলে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পর আরিহা এরিনার রুমে ৪ টা প্যাকেট নিয়ে আসে। সেগুলো এগিয়ে দিয়ে এরিনাকে বলে,

— আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য কিছু উপহার ননদিনী।

এরিনা প্যাকেটগুলো খুলতেই দেখে দুইটা খুব সুন্দর ডিজাইনার ড্রেস সাথে এক জোড়া হিল জুতা। আর ডাইমোন্ডের দুটো চুড়ি।
এরিনা অবাক চোখে আরিহার দিকে তাকায়। তারপর বলে,

— ভাবি এইগুলা তো জাস্ট ওয়াও। এত সুন্দর গিফট দেওয়ার জন্য এতগুলো ভালবাসা।

আরিহা এইবার হেসে বলে,
— তোমাকেও এতগুলা ভালবাসা৷

?

বর্ষার মৌসুম একদম ঝেঁকে ধরেছে। হুট হাট বৃষ্টি যেন এখন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। যেমন হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। ভোর হতে ধুমসে শুরু হয়েছিল ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ৯ টার দিকে এসে বৃষ্টিটা থামে। হিম শীতল বায়ু বইছে বাইরে। ঘাসের উপর রয়েছে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোঁটা। গাছের পাতার ফাঁকে এখনো চুয়ে চুয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সতিজ হয়ে উঠেছে কাঠগোলালের পাপড়ি গুলো। ভেজা মাটি আর ভেজা ফুলের গন্ধে চারদিক মৌ মৌ করছে। রাস্তার ফাঁকে বৃষ্টির পানিগুলো জমে আছে। দ্রুত বেগে গাড়ি ছুটে যাওয়ার ফলে পানিগুলো ছিটকে আসছে।
ধানমন্ডির লেকে বসে আছে এরিনা। পাশেই মলিন মুখে বসে আছে সোহেল। এরিনা আড় চোখে সোহেলের দিকে তাকিয়ে আছে। চুল গুলো উষ্কখুষ্ক। মুখটা একদম মলিন। পড়নে সাদা কালো চ্যাক শার্টটির প্রথম দুইটি বোতাম খুলা। এরিনা আজ চলে যাবে শুনার পরপরই মুখটা একদম মলিন হয়ে যায়। এরিনার এখন অসহায় চোখে সোহেলের দিকে তাকায়। এই কয়েকদিনে সোহেলের প্রতি তার বেশ একটা মায়া জমে গিয়েছে। ভাললাগার এক সুপ্ত অনুভূতি নাড়া দিয়েছে ওর মনে। সোহেলকে ছেড়ে যেতে ওর বেশ খারাপ লাগছে কিন্তু কিছু করার নেই। সোহেল এইবার শান্ত কন্ঠে বলে,

— আজকে চলে যাচ্ছো তাই তো?

এরিনা ছোট করে বলে,
— হুম।

সোহেল এইবার কিছু না বলে উঠে দাড়ায় আর সামনের দিকে হাঁটা ধরে। সোহেলের এমন কাজে এরিনা বিস্মিত চোখে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। কি থেকে কি হলো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। অতঃপর মন খারাপ করে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে থাকে। চোখ বেয়ে হয়তো এখনই দুই ফোটা জল গড়িয়ে পড়বে। ঠিক এমন সময় কেউ ওর সামনে হাটু গেড়ে বসে। এরিনা মাথা তুলে দেখে সোহেল৷ সোহেলের হাতে চারটে রক্তগোলাপ। মুখে এক মিষ্টি হাসি। সোহেল এইবার বলে,

— কিভাবে মনের কথা বলতে হয় জানি না। আসলে কখনো এই মনের কথাগুলো বলার মত মানুষকেই খুঁজেই পাই নি। তাই আজ হয়তো সব গুলিয়ে ফেলছি। আমি এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে পারি না যার জন্য সরাসরি বলছি তোমায়,
ভালবাসি তোমায়। খুব বেশি ভালবাসি। তোমার এই মায়ার জ্বালে ফেঁসে গিয়েছি আমি মায়াবতী। তোমার জন্য এই প্রেমরোগে আক্রান্ত আমি এখন। যার কোন নিরাময় নেই। তাই আমি চাচ্ছি তোমায়ও এই প্রেমরোগে আক্রান্ত করতে। আমার মধ্যে তোমায় আবদ্ধ করতে। কথা দিচ্ছি সবসময়ে আমার অন্তরালে তুমি এই থাকবে। এখন তুমি কি আমায় অনুমতি দিবে তোমার অন্তরালে আমিটা হতে? হবে কি তুমি আমার?

সব শুনে এরিনার চোখ বেয়ে দুই ফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। কষ্টের না বরং খুশির। সে মুখে এক প্রশান্তির হাসি ঝুলিয়ে হাতটা এগিয়ে ফুলগুলো নিয়ে নেয় আর অস্পষ্ট সুরে বলে,
— হ্যাঁ।

#চলবে