অন্তরিন প্রণয় পর্ব-২+৩

0
589

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২

ঘুমন্ত সেহেরিশ হঠাৎ অনুভব করে তার পায়ের কাছ কেউ যেন খোঁচাখুঁচি করছে।তৎক্ষনাৎ সেহেরিশের দুচোখ কুঁচকে দ্রুত খলবলিয়ে উঠে বসে।সামনের দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি রাখতেই আফীফকে দেখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে।কিছু বলতে নিলেই গায়ের মধ্যে অসংখ্যা ফুলের অবস্থান উপলব্ধি করে চমকে যায়।রুমটি ফুলের সুভাসে মম করছে।

– শুভ রজনী ফুলপরি!
– র..রজনী?

আফীফ সযত্নে সেহেরিশের পায়ে চুমু খায়।সঙ্গে সঙ্গে শিহরণ বয়ে যায় সেহেরিশের মাঝে। কিছু বলতে নিলেও গলায় তার কথা আটকে আসছে।

আফীফ সেহেরিশের মুখোমুখি বসে নির্মল দৃষ্টিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।সেহেরিশের ঘাড় ছুঁয়ে থাকা চুলে অসংখ্যা গোলাপের পাপড়ি ভাসমান।চুলে গোজা আছে বেশ কয়েকটি তাজা গোলাপ ফুল ।আর সেই ফুল গুলো দিয়ে আফীফ নিজে সেহেরিশকে সাজিয়ে দিয়েছে।

– তোমায় বড্ড মিষ্টি লাগছে ফুলপরি!চুল গুলো এত ছোট কেন?ছোট চুল আমার মোটেও পছন্দ না।
– আমার চুল ছোট কী বড় তাতে আপনার কী? আমাকে এখানে বন্দি রাখার মানে কী?যেতে দিন আমায়।একে তো আমার কাকাতুয়াকে মেরে অন্যয় করেছেন তার উপর আবার আমায় বন্দি করেছেন।থাকবো না আমি এখানে।

আফীফকে উপেক্ষা করে সেহেরিশ দ্রুত বিছানা থেকে নেমে যায়।গায়ে থাকা কমলা রঙের স্কার্টটা ঠিক করে আশে পাশে দরজা খুঁজতে থাকে কিন্তু একি? কোন দরজা নেই।একটি জানালা ছাড়া পুরো রুমে কোন দরজা নেই। কিন্তু জানালার শার্সিটা বাইরে থেকে দেওয়া পুরো রুমটাই অদ্ভুদ রকমের।
সেহেরিশের বুঝতে বাকি নেই কেন তখন আফীফ এই রুমটাকে গোপন কক্ষ বলেছিল।
সেহেরিশকে চিন্তা মগ্ন দেখে আফীফ একপা দুইপা করে এগিয়ে আসে তার দিকে।

– ফুলপরি পালিয়ে যাওয়ার রাস্ত খুঁজছো বুঝি?
– আমায় যেতে দিন বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না বলে দিচ্ছি।
আফীফ মৃদ্যু মাথা দুলিয়ে হাসে। তার ডানহাতটা দিয়ে সেহেরিশের মাথায় হাত বুলাতে থাকে মুখটা চুলের সামনে নিয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়। তৎক্ষণাৎ সুযোগ বুঝে সেহেরিশ আফীফের হাতে কামড়ে দেয়।কামড়টা এতটাই জোরে ছিল যে চামড়া ছিলে আফীফের ফর্সা হাতে রক্ত ভাসমান। চাপা আর্তনাদে আফীফ কেঁপে উঠতেই সেহেরিশ ছুটে পালিয়ে যেতে নেয়।কিন্তু চারিদিকে দৌড়াদৌড়ি করেও চার দেয়ালের কক্ষে কোন দরজা খুঁজে পেলনা সেহেরিশ।

জানালার শার্সি ধাক্কা দিয়ে জানলা খুলতে চেষ্টা করতেই আফীফ সেহেরিশের হাত টেনে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে নেয়।তার সামনে ঝুকে ফিসফিসিয়ে বলে,
– আমায় সামান্যতম একটা কামড়ে কুপ কাত করবে ভেবেছো?আমায় চিনতে পারো নি তুমি ফুলপরি।আমি সেই ছেলে যে ছেলের ভয়ে সারা গ্রাম তটস্থ থাকে।আমার দাদাজানের শক্র পক্ষের বিনাশ করে আমি আমার তেষ্টা মিটাই।আর তুমি আমায় দূর্বল ভাবছো।

সেহেরিশের ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।সকালে তখন বৃদ্ধার কথা আবারো মনে পড়ে গেলো।সেই বৃদ্ধা বলেছিল আফীফ বড্ড রাগী।

– আ..আমাকে কেন ছাড়ছেন না আপ..আপনি?
আমি ফুফির কাছে যাবো!

– ইসসস, আজকের পর থেকে তোমার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু।মনে করো তোমার শাস্তি এটাই আমার কাছে থাকবে আর সারাজীবন আমার পাশেই থাকবে।আমার কাছ থেকে তোমাকে আলাদা করার সাধ্যে এই বাড়িতে কারো নেই।

সেহেরিশ ধাক্কা দিয়ে আফীফকে সরিয়ে দেয়।দেয়ালে বাম হাতটা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে, জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। সব কেমন উলট পালট লাগছে তার।

আফীফ সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে গাঢ় করে শ্বাস ছাড়লো।মাটির দিকে তার দৃষ্টি নিমজ্জিত করে দু কদম পিছিয়ে গেলো।সেহেরিশের দিকে একপলক তাকিয়ে রুমে থাকা বিশাল আলমারির পেছনে গিয়ে দরজা খুলে নিজের ব্যাক্তিগত রুমে প্রবেশ করলো।দ্রুত বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে এগিয়ে এসে জানলা খুলে দিল।তার রুমের জানলা দিয়ে স্পষ্ট সেহেরিশের সম্পূর্ণ রুম দেখতে পাওয়া যায়।
এতক্ষণ যাবৎ আফীফের কান্ড মোটেও খেয়াল করেনি মেয়েটি।
– তাকিয়া!

নিরিবিলি রুমটায় আফীফের শান্ত কন্ঠ শুনতেই ঘুরে তাকালো সেহেরিশ।কিন্তু জানালার দিকে তাকাতেই থমকে গেলো।তার রুমের বাইরে আরেকটি রুম আর জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আফীফ।মানে কী?আফীফ কি করে রুম থেকে বের হলো?দরজা কোথায়?
সেহেরিশের প্রশ্ন মাখা মুখটি দেখে আফীফ মুচকি হাসলো,

– মাথায় এত চাপ দিওনা,এত কিছু না ভাবলেও তোমার চলবে।এই বাড়িতে থাকবে অতিথি হিসেবে নয়,আপনজন হিসেবে!যেহেতু আমার জীবনে এবং আমার পরিবারে তুমি নতুন তাই স্বাগত চিরকুট তোমার বালিশের পাশেই রাখা আছে।আল্লাহ হাফেজ!

আফীফ সেহেরিশকে আর কোন কথার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত জানলাটা বন্ধ করে দেয়।
সেহেরিশ এক ছুটে বালিশের পাশ থেকে লাল রঙের একটি কাগজের চিরকুটটা বের করে,সেই চিরকুটের দিকে তাকিয়ে শুধালো সেহেরিশ,

“নতুন মুখ নতুন হাসি,
অল্পত্বেই পাশাপাশি!
আবার হয়তো হবে দেখা,
সামান্য সময়ের প্রতীক্ষা!

লাইন গুলো পড়ে সেহেরিশের বেশ রাগ লাগলো যার ফলে চিরকুটটি কুচিকুচি করে উড়িয়ে দেয়।

– দেখা হবে না!দেখা হবে না আমাদের!

শীতের প্রকপে সেহেরিশ ঠান্ডায় জমে গেছে। এতক্ষণ মেঝেতে বসে কান্নার ফলে বিছানায় মাথা রেখে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে তার হুশ নেই।ভোরের আলো ফুটতেই আফীফ তার কক্ষে আরেকবার প্রবেশ করে।সেহেরিশকে বিছানায় তুলে দিয়ে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে আবারো রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

ফজরের নামায’টা আফীফ তার দাদাজানের সাথেই মসজিদে আদায় করে।তাই দুজনে তীব্র কুয়াশার মাঝে গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে মসজিদের উদ্দেশ্য হাটতে শুরু করে,

– তুমি কাজটা ঠিক করছো না আফীফ! তোমার সব সিধান্তে আমি হা তে হা মিলালেও আমি এই সিধান্তে মেলাতে পারছি না।তুমি তাকিয়াকে যেতে দাও!
আহনাফ দেওয়ানের প্রতিবাদী কন্ঠেও টনক নড়লো না আফীফের।সে তার মতো করে হেঁটে যাচ্ছে।
– দাদাজান তোমার সব কথা আমি মানলেও এই কথাটা মানতে পারছি না। দুঃখিত!
আহনাফ চমকে তাকায় আফীফের দিকে।আফীফের চোয়াল শক্ত মুখটা দেখে তিনি দমে যান। সন্তপনে তিনি হেটে যান কুয়াশা ভেদ করে।

চন্দনপুর গ্রামের জমিদার আহনাফ দেওয়ান।পুরো গ্রাম জুড়ে চলে দেওয়ান বংশের রাজত্ব।আর সেই বংশের বর্তমান সাহসী সবচেয়ে তেজি পুত্র আফীফ দেওয়ান।তার দাদাজানের সাথে সমান তালে পুরো গ্রামের মানুষের সাহায্য সহযোগীতায় নিজেকে ব্যস্ত রাখছে।

তার পাশের গ্রামের নাম অনন্তপুর।সেই অনন্তপুরে সেহেরিশের গ্রামের বাড়ি।সেহেরিশের বাবা মা তার দাদা দাদীর মৃত্যুর পর দেশের বাইরে বসবাস শুরু করেন।সেহেরিশের ফুফু মারুফার স্বামী মারা যান প্রায় তিন বছর আগেই এক দূর্ঘটনায়।এই বছর স্বামীর মৃত্যু দিবস উপলক্ষে সুদূর বিদেশ থেকে একা সেহেরিশকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন।এরপর কেটে যায় আরো এক সাপ্তাহ আর গতকাল সকালেই অনন্তপুর গ্রামের সীমানা পেরিয়ে সেহেরিশের কাকাতুয়া যখন চন্দনপুরে প্রবেশ করে তখন কৌতূহলজনক সেহেরিশো এই গ্রামে চলে আসে।

গ্রামের মেঠোপথ হাটতে হাটতে হঠাৎ লক্ষ করে তার কাকাতুয়া পাখিটি তীর বিধেঁ মাটিতে লুটিয়ে আছে।পেছনে ঘুরে তাকাতেই আফীফকে চোখে পরে যার হাতে ধনুক সাদৃশ্যমান।রাগ মেটাতে না পেরে সেহেরিশ ভেজামাটির কাঁদা ছুড়ে মারে আফীফের দিকে যার দরুনে আজ আফীফের কবজায় বন্ধী সেহেরিশ।

কুয়াশা ভেদ করে সূয্যিমামা ফিক করে হেসে উঠেছে।গ্রামের মানুষজন নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত প্রায়।আফীফ তার বাবা মাসুমের সঙ্গে সেহেরিশের ব্যাপারে অনেক্ষন যাবৎ তর্কবির্তকে জড়িয়ে আছে।সহসা একজন দৌবারিক ছুটে আসে আফীফের কাছে।

– আফীফ ভাই একজন মহিলা অনেক্ষন যাবৎ এই বাড়িতে প্রবেশ করতে উঠেপড়ে লাগেছেন। তিনি অনন্তপুর থেকেই এসেছেন।তার ভাই’জি নাকি এখানে বন্ধী!
দৌবারিকের কথা আফীফ বুঝতে পেরে মাথা নুইয়ে নেয়।চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে ফিসফিস করে জবাব দেন,
– তাকে বলো অন্ততপুরে ফিরে যেতে। আমি অবসর হয়ে তার সাথে দেখা করবো কিন্তু তার আগে নয়।

দৌবারিক মাথা দুলিয়ে চলে যায়। আফীফ তার বাবা মাসুমের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলে,
– আব্বা আমায় চন্দনপুর গ্রামের চাচাজানের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিন।খুব শীঘ্রই!

মাসুম আড়চোখে আফীফের দিকে তাকিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।এদিকে আফীফ বাড়ির চারপাশে চোখ বুলিয়ে ঘরে প্রবেশ করে।

কনকনে ঠান্ডায় কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে সেহেরিশের।প্রায় এক ঘন্টা আগে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে চুপচাপ কাঁথা মুড়িয়ে বসে আছে।এদিকে ক্ষিদের জ্বালায় ক্ষুদার্ত বাঘীনির মতো অবস্থা তার।সামনে যা আছে তা গোগ্রাস করে খেতে মন চাইছে।

চোখ বন্ধ করে কাঁথা মুড়িয়ে কাদতে শুরু করে সেহেরিশ।ছোট থেকেই তার ক্ষিদের জ্বালা সহ্য হয় না।আর গতকাল থেকেই সে অনাহারী।

– কি হয়েছে কাদছো কেন তুমি?
পুরুষের কন্ঠে চমকে তাকায় সেহেরিশ।আফীফকে দেখতে পেয়ে সুপ্ত রাগটা আরো মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে।

– কি হলো কথা বলছো না কেন?
– আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তাই আমি বলছি না।
আফীফ চুপচাপ কয়েক মিনিট তাকিয়ে থাকে সেহেরিশের দিকে।রাগে ফোসফোস করতে থাকা সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে বলে,

– তোমার খিদে লেগেছে তাকিয়া?
আফীফের কথায় চমকে তাকায় সে!এই লোকটা বুঝলো কী করে?

– আমি বেশ ভালো করে বুঝতে পারছি তোমার ক্ষিদে পেয়েছে।কিন্তু তোমায় খাওয়ার দেওয়া হবে না তাকিয়া!
– কিন্তু কেন?আপনাদের বাড়ির আসামিকে বুঝি খাওয়ার দেওয়া হয় না?
– উহু’হ খাওয়ার দেওয়া হয় তবে তাদের দেওয়া হয়না যারা খাওয়ার দেখলে নাক ছিটকায় অবমূল্যায়ন করে।
– মানে কী? আমি কী করেছিলাম?
– কাল মর্জিনা যখন তোমায় জানলা দিয়ে খাওয়ার দিয়ে গেছিলো তুমি খাওয়ার টা ছুড়ে মারলে কেন তাকিয়া?আমি নেহাত বাড়ি ছিলাম না তাই তবে তুমি কিচ্ছু টের পাওনি।খাওয়ার নষ্ট করা আমি মোটেও পছন্দ করিনা।

সেহেরিশ মাথাটা নুইয়ে নেয়।এই মূহুর্তে তার ঝাগড়া করার সাধ্যের বাইরে।শরীরটা বার বার অসার হয়ে আসছে।আফীফ তার অবস্থা বুঝতে পেরে নিজের হাতে থালা সাজিয়ে আনে।

– নাও এবার খেয়ে নাও!
– খাবো না আমি।খাবার নিয়ে আপনি আমায় খোটা দিয়েছেন।আমার পাপার কুকুর গুলোকেও আরো যত্ন করা হয় কিন্তু কাল সকাল থেকে আপনি আমার সাথে অবিচার করছেন।

সেহেরিশের কথায় আফীফের ভীষন রাগ লাগলো তবুও নিজেকে দমিয়ে রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
– আমার হাতে একদম সময় নেই।যা বলেছি তাই করো খাওয়ারটা খেয়ে নাও।শাস্তি তোমায় এখনো দেওয়া হয় নি তাকিয়া।একশত ঘা চাবুকে বারি তোমায় শাস্তি সরূপ দেওয়া হলে তখন কি বলতে তুমি?আমায় উগ্র করে না তুলে চুপচাপ খাওয়ারটা শেষ করো।

আফীফের কথায় সেহেরিশ দ্রুত খাওয়ারের থালা হাতে তুলে নেয় আর গোগ্রাসে খেতে থাকে।আফীফ সেদিকে তাকিয়ে আরক্ত নয়নে বলে,

– মেয়ে মানুষের রাগ আমার মোটেও পছন্দ না।তোমরা মেয়ে জাতী কোমল থাকবে, এইসব রাগ জেদ তোমাদের জন্য না।ভালো ব্যবহার করছি তোমার সাথে এটাই অনেক।ইঁচড়েপাকা মেয়ের এত রাগ কিসের?

শেষ কথাটি আফীফ ধমকের সুরে বলে উঠলে চোখ খিচে বন্ধ করে নেয় মেয়েটি।এই মূহুর্তে তর্ক করার মোটেও ইচ্ছে নেই তার, আগে পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি।
#চলবে….

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৩

অচেনা অজানা একজন মানুষের হাতে হাত রেখে চলতে দ্বিধা সংকোচে নুইয়ে যাচ্ছে বার বার সেহেরিশ।তবুও একশত ঘা চাবুকের ভয়ে মুখ ফুটে কিচ্ছু বলার সাহস হচ্ছে না তার।দীর্ঘ একদিন পর সেই গুপ্ত কক্ষ থেকে আফীফের হাতে হাত রেখে বের হয়েছে সে।আফীফ তার তাকিয়াকে হাতে হাত রেখে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে।সেহেরিশো কিছু সময়ে বুঝে গেছে এটা যেন বাড়ি নয় রাজপ্রাসাদ!দোতলায় বেশ কয়েকটি কক্ষ।নিচতলায় বৃহৎ বসার ঘরের ব্যবস্তা।তার কল্পলোকে রাজাদের যেমন বাড়ি থাকতো আজ বাস্তবে সে অনুভব করছে তার ভাবনার অধিকাংশ যেন সত্যি!জমিদারের বাড়ি বলে কথা, সারবত্তা না হয়ে পারে!

– এমন চমকে তুমি কি দেখছো তাকিয়া?
আফীফের প্রশ্নে সৎবিৎ ফিরে আসে তার।গলা খাকিয়ে “কিছু না” বলে আবার হাটতে থাকে সমান তালে!সেহেরিশের বিরোধাভাস বুঝতে পেরে আফীফ তিলার্ধেক হাসে।

– তোমার পরিবারে কে কে আছে তাকিয়া?
– কেন আপনি জানেন না?
– না।তুমি না বললে আমি তোমার বিষয়ে জানবো কী করে?তোমার ফুফি যে তোমায় ছেড়ে শহরে চলে গেছে তুমি কী জানো?
– কি? ফুফি আমায় ছেড়ে কেন গেলে?তবে আমি ফিরবো কী করে!
– তোমায় বন্দি করার অপরাধে এলাকার থানায় আমার নামে অভিযোগ করেছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি তাই শহরের বড় অফিসারের কাছে নালিশ নিয়ে গেছে।দেখি কী করতে পারে।

সেহেরিশের চিন্তিত মুখ দেখে আফীফ কথা কাটিয়ে নেয়।
– তোমার বাড়িতে কে কে আছে?

আফীফের প্রশ্নে সেহেরিশ আড় চোখে তাকায় তার দিকে।এই মূহুর্তে তার আসল পরিচয় কিছুতেই দেওয়া যাবে না।একদিক দিয়ে আফীফ যে তার পুরো নামটা জানেনা তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছে সেহেরিশ।

– আমার কেউ নেই ফুফি আর আমি একাই থাকি।
– অন্ততপুরের কোন এলাকায় থাকো?
– আ..অন্তত পুরে থাকি না আমি। শহরে ফুফির বাড়িতে থাকি।
ঝটপট উওর দিয়ে হাফ ছেড়ে বাচঁলো সেহেরিশ। আফীফের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে আবারো দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।এদিকে আফীফ সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে নিলো তার তাকিয়া এতিম!এতে যেন মেয়েটার প্রতি মায়া আরো একশত গুন বেড়ে গেছে তার।

আর কোন কথা না বাড়িয়ে আফীফ সেহেরিশের হাত টেনে তার দাদীজানের রুমে নিয়ে গেলো।আফীফের দাদীজান ফাতেমা, আফীফের সবচেয়ে কাছের এবং বিশ্বস্ত মানুষ।মায়ের পরে কোন নারীকে ভালোবাসলে আফীফ তার দাদীজানকেই ভালোবাসে।
– দাদীজান দেখো কাকে নিয়ে এসেছি!

আফীফের কন্ঠে মাথা তুলে তাকান ফাতেমা। সেহেরিশে দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছু মূহুর্ত নির্মল নয়নে।
– এই বাচ্চা মেয়েটাকে তুই শাস্তি দিচ্ছিস আফীফ!তোর কি রাগ,জেদ,উগ্রতা কোন দিন কমবেনা?
ফাতেমার কথায় কান দিলোনা আফীফ। বরং সেহেরিশের উদ্দেশ্য করে বলে,

– দেখো সেহেরিশ উনি আমার দাদীজান।তুমি দাদী বলেই ডাকবে।
-দাদী মানে গ্র‍্যান্ডমাদার?
সেহেরিশের কথা ভ্রু কুচকে যায় ফাতেমার।চোখের চশমাটা নাকের ডগায় এনে সেহেরিশের দিকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
– গ্যারেনমাদার মানে?কি কও তুমি পিচ্চি মাইয়া?

ফাতেমার কথায় আফীফ নিঃশব্দে হাসে।
– দাদীজান এতশত বুঝতে হবে না। আর আমার সাথে যেমন সদা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলো, তাকিয়ার সাথেও একই ভাবে বলবে।তোমার আঞ্চলিক ভাষা তোমার কাছেই রাখো।
আফীফের কথা শেষ করতেই রুমে প্রবেশ করে ফাতেমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী পারভিন।পারভিন বেশির ভাগ সময় এই বাড়িতে থাকেন ফাতেমাকে সাহায্য করার জন্য।

পারভিনের দিকে তাকিয়ে আফীফ সেহেরিশকে শুধালো,
– ওনাকে আন্টি বলে ডাকবে।এসো বাদবাকি সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি।

বাড়ির প্রত্যাকটা সদস্যর সঙ্গে সেহেরিশ পরিচিত হয়ে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলো এই বাড়িতে আহনাফ দেওয়ানের পরে রাজত্ব চলে আফীফ দেওয়ানের।

কেটে গেলো আরো দুটিদিন তবে এই বাড়ি ছেড়ে পালানোর কোন রাস্তা পেলো না সেহেরিশ।যতক্ষণ আফীফ বাড়িতে থাকে ঠিক ততক্ষণ সেই রুম থেকে বের হওয়ার সুযোগ থাকে তার না হলে বাকিটা সময় ওই রুমেই বন্ধী থাকে। তবে এই বাড়ির সবার মাঝে সবচেয়ে বেশি ভাব জমেছে পারভিনের সাথে।আর পারভিন তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে করেই হোক এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দেবে তার। তাই সব চেষ্টা ধাতস্ত রেখে পারভিনের উদ্দেশ্য দিন গুনছে সে।

রাত একটা ছুঁই ছুঁই বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। কিন্তু ঘুম নেই সেহেরিশের চোখে।গায়ের চাদরটা ভালো ভাবে জড়িয়ে নিয়ে সারা রুম জুড়ে পাইচারি করছে।তার জীবন থেকে তিনটে দিন পার হয়ে গেলো এই বন্ধী দশায়।পালানোর ফাঁদ খুঁজতে গিয়েও পেলোনা কোন উপায়।এদিকে পারভিনের কোন খবর নেই।বিরস মুখ নিয়ে আলমারির পেছনে থাকা দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে আস্তেধীরে খুলতে গেলে আশ্চর্যের শেষ সীমানায় পৌছে যায় সে!একি দরজাটা খোলা।

সেহেরিশ গুটি গুটি পায়ে ধীরে ধীরে আফীফের রুমে প্রবেশ করে।বিছানার দিকে তাকাতেই ড্রিম লাইটের আলোয় আফীফের কাঁথা জড়ানো মুখটা সাদৃশ্যমান। সেদিকে তাকিয়ে সেহেরিশ নিজেকে ধাতস্ত করে।পীল পীল পায়ে রুমের দরজা খুলে আফীফের রুম থেকে বেরিয়ে সোজা সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকে।চারিদিকে চোখ বুলিয়ে পুরো বাড়িটা ফাঁকা দেখে সস্তির শ্বাস ছাড়ে সে।

সবটা ভালোয় ভালোয় মিটলেও বাড়ির সদর দরজার ছিটকিনি খুলতে যত বাধা বিপত্তি লেগে যায়।ছোট্ট সেহেরিশের হাতে কিছুতেই ছিটকিনি নাগালে আসছেনা। তিন চারবার লাফানোর পরেও কোন মতেই ছিটকিনি তার হাতের নাগাল পর্যন্ত এলো না।বিরক্ত হয়ে মেঝেতে হাটু মুড়িয়ে বসে শ্বাস নিতে থাকে জোরে জোরে যে করেই হোক আজ তাকে পালাতে হবে।

– দরজা খুলতে পারছো না আমি খুলে দেবো তাকিয়া?

পেছন থেকে পুরুষের কন্ঠে তড়াক করে তাকায় সে।আফীফকে দেখে নির্বাক ভঙ্গিতে ঢোক গিলে।

– কি হলো ছিটকিনি খুলে দেবো?
আফীফের কথায় সেহেরিশ কোন প্রত্যুত্তর করলো না।আফীফ তার অবস্থা বুঝতে পেরে চুপচাপ দরজার ছিটকিনি খুলে দেয়।

– এবার যাও কোথায় যাবে তুমি?
– আ..আমি
– হ্যা তুমি কোথায় যাবে?
আফীফের শান্ত কন্ঠে সেহেরিশের ভয় যেন আরো দিগুন বেড়ে গেলো।তবুও বাজখাঁই গলায় রাগ দেয়ে বলে,

– আমি চলে যাবো।আমি এই গ্রামে থাকতে চাইনা। আর আপনি যে অন্যায় করেছেন তার জন্য আমি ক্ষমা করে দিলাম।জানেন আপনি আমার কাকাতুয়াকে আমি ঠিক কতটা ভালোবাসি?আমার কাকাতুয়া আমার দাদাজানের শেষ স্মৃতি।আর একটা নিষ্পাপ পাখিকে আপনি মেরে দিলেন তবুও ক্ষমা করলাম আপনায়। এবার ছেড়ে দিন আমায়।
– কিন্তু আমি তো তোমায় ক্ষমা করিনি তাকিয়া!তবে?
– দেখুন আমি চলে যাবো। আমার ফুফি আমার জন্য অপেক্ষা করছে।এতটা বেহায়া কেন আপনি?কতবার বললে আমায় জেতে দেবেন?

শেষ কথাটা বেশি রাগ দেখিয়ে বললো সেহেরিশ।কিন্তু তার কোন প্রত্যুত্তর করলোনা আফীফ।সে ধীরে সুস্থে এগিয়ে এসে বাড়ির সদর দরজা খুলে দেয়। সেহেরিশকে ইশারা করে বলে,

– তোমার কাছে একটা সুযোগ আছে তুমি চলে যাও।বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে তুমি যদি যদি এক পা’য়ো ফিরে আসো তবে সারাজীবনের জন্য এই বাড়িতে বন্ধী থাকতে হবে তোমায়!রাজি?

আরাফের বিধিবদ্ধা নিয়ম লুফে নেয় মেয়েটি।একবার যখন সুযোগ এসেছে তখন যে কোরেই হোক এই বাড়ির গেট থেকে আগে তাকে বের হতে হবে বাকিটা পরে দেখা যাবে।

– বেশ আমি রাজি।
– তবে দেরি কিসের এখনি বেরিয়ে যাও!
সেহেরিশ ঠোঁট বাকিয়ে বেরিয়ে যায় দ্রুত বড় বড় পা ফেলে।
তার পেছন পেছন আফীফ ধীর পায়ে এগিয়ে আসে।বাড়ির বিশাল উঠানটা মাড়িয়ে যখন গেটের সামনে দাড়ায় তখনি আফীফের পালিত সাতটি কুকুর সেহেরিশের দিকে তেড়ে আসে।তাদের ঘেউঘেউ শব্দে পুরো এলাকার মানুষ সহ সবাই জেগে উঠে।একসঙ্গে এতগুলো কুকুর তেড়ে আসতে দেখে সেহেরিশ আহাম্মোক বনে যায়।ডানে বামে না তাকিয়ে বিকট শব্দে চিৎকার দিয়ে পেছনে ছুটতে থাকে।হাতের নাগালে আফীফকে পেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

সেহেরিশের অবস্থায় আফীফ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালোনা চুপচাপ সে দাঁড়িয়ে রইলো একই অঙ্গভঙ্গীতে।চারজন দৌবারিক ছুটে এলে আফীফ তাদের ইশারা করে চলে যাওয়ার জন্য।কিন্তু কুকুর গুলো এখনো সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে ঘেউঘেউ করছে।কনকনে ডিসেম্বর মাসের শীতেও ঘেমে একাকার সেহেরিশ।আফীফের গায়ে থাকা গেঞ্জিটি আঁকড়ে ধরে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।ইতিমধ্যে বাড়ির সকলেই সদর দরজার সামনে উপস্থিত। সেহেরিশের অবস্থা দেখে বাড়ির সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।সেদিকে আফীফ পাত্তা না দিয়ে সেহেরিশের কানে ফিসফিস করে বলে,

– সে দূরে যেতে চেয়েও কাছে চলে আসে।আমি ঘৃণা করতে চেয়েও ভালোবেসে ফেলি।তবে এত চনমনিয়ে লাভ নেই সে আমার অন্তরিন প্রণয় হয়েই থাক!আমার বিরান বক্ষে সে সুখের রসদ হয়েই থাক।আমার কল্পলোকের সম্রাজী হোক!

আফীফের কথা গুলো সেহেরিশের কর্ণধারে পৌছলো কী না কে জানে?তবে এখনো গুটয়ে আছে আফীফের বক্ষপিঞ্জিরায় একরাশ ভয় নি।

#চলবে…..