অন্তহীন বসন্ত পর্ব-০১

0
485

#অন্তহীন_বসন্ত~১
লিখা- Sidratul Muntaz

উচ্চৈঃস্বরে গান বাজছে বাড়ি জুড়ে। নিশান্তের মেজাজ খারাপ। আগামীকাল যে তার পরীক্ষা এই ব্যাপারটি কেউ মনে রাখেনি। এমনকি মা-ও না। দিব্যি সাজ-গোজ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিশান্তকে পড়তে বসতে দেখে রিমা কান মলা দিয়ে বলল,” এই গর্ধব, নানীবাড়িতে কি তুই পড়তে এসেছিস? আজ তোর মামাতো ভাইয়ের জন্মদিন৷ তুই দরজা আটকে পড়ছিস শুনলে ও মনখারাপ করবে না?”

নিশান্ত বেজায় বিরক্ত হলো। মামাতো ভাইয়ের বয়স মাত্র দু’বছর৷ সে জন্মদিনের কিছু বুঝে নাকি? দেখা গেল জ্বলন্ত মোমবাতিতে ফুঁ দেওয়ার বদলে তীব্র উচ্ছ্বাস নিয়ে আগুন ছুঁতে যাবে। এই বয়সে এতো হুলুস্থুল করে জন্মদিন পালন করার কি প্রয়োজন সেটাও নিশান্ত বোঝে না। তার তো বড় হওয়ার পর কিছু মনে থাকবে না। সে তার জন্মদিনের ছবি-ভিডিও দেখে নিশান্তর মতোই আফসোস করবে৷ ইশ, এখন কেন তার জন্মদিন এভাবে হয় না? নিশান্তও আফসোস করে৷ তার জন্মদিন সবচেয়ে আয়োজন করে পালিত হয়েছিল কানাডায়। এক নয়নাভিরাম বাগানে। চেরি ব্লোসম হচ্ছিল চারদিকে। জন্মসূত্রে সে কানাডিয়ান। সেসব কিছুই নিশান্তর মনে নেই। এখন তার জন্মদিনে এতো হল্লা হয় না৷ কারণ এখন সে বড় হয়েছে। নিশান্ত বলল,

” আগামীকাল আমার পরীক্ষা। তুমি কি ভুলে গেছো আম্মু?”

রিমা রেগে-মেগে বলল,” ক্লাস টেস্ট আবার কি এমন সিরিয়াস পরীক্ষা রে? এমন ভাব করছিস যেন ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা তোর!”

” ক্লাস টেস্টের মার্কস ইয়ার ফাইনালেও যোগ হবে। তাই এই পরীক্ষা এভয়েড করার কিছু না।”

রিমা একটু চিন্তিত হলো। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে সন্তোষজনক কণ্ঠে উৎসাহ দিল,” আচ্ছা বাবা, তুই পড়। কেক কাটার সময় দশমিনিটের জন্য অন্তত আসিস। নইলে তোর মামা রাগ করবে। আমি দরজা বন্ধ করে যাচ্ছি।”

অবন্তী আজ লেহেঙ্গা পরেছে। কিন্তু লেহেঙ্গার স্কার্ট সাইজে বড় হয়ে গেছে। বেশ আগলে হাঁটতে হচ্ছে। এই লেহেঙ্গা তার নিজের নয়। খালামণির দেওয়া উপহার। কিন্তু এই উপহার খালামণি তার জন্য কেনেনি। কিনেছিল জা-এর মেয়ের জন্য। কোনো কারণে উপহারটা সে গ্রহণ করেনি৷ তাই ঘুরে-ফিরে এটি অবন্তীর কাছেই এসেছে। অবন্তীর মনে হচ্ছে যেকোনো সময় পায়ের সাথে বেজে সে পড়ে যেতে পারে। কিন্তু কিছু করার নেই। এই লেহেঙ্গা পরেই তাকে থাকতে হবে। আজ তার ছোট্ট খালাতো ভাইয়ের জন্মদিন। অথচ অবন্তীর এতোবড় অনুষ্ঠানে পরার মতো উপযুক্ত কোনো পোশাক নেই। ব্যাপারটা দুঃখজনক। সাতবছরের অবন্তীর লম্বা চুল, গায়ের রঙ ফরসা, দেখতে অসম্ভব মিষ্টি। যে কেউ দেখলে আদর করে গাল টিপে দিবে। কিন্তু এই বয়সেও সে বুঝতে পারে অনেকেই তাকে পছন্দ করে না। আবার কেউ কেউ আছে যাদের অবন্তী নিজেই পছন্দ করে না।
রান্নাঘর পেরিয়ে যাওয়ার সময় সানভি আঙ্কেল ডাকল,” কি ব্যাপার অবন্তী? এদিকে এসো।”

অবন্তী গেল না। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পড়ল। এক দৌড়ে অন্য একটা ঘরে ঢুকে পড়ল। লোকটিকে ভয় পাওয়ার একটা কারণ আছে। অবন্তী এখনও কারণটা কাউকে বলতে পারেনি। কিছুদিন আগে সবাই বাইরে ঘুরতে বের হয়েছিল। অবন্তীর মা বোনের বাড়িতে এলেই নানা কাজে-কর্মে ব্যস্ত থাকে। অবন্তীকে দেখে রাখার সময় পায় না। বেড়াতে যাওয়ার সময় সবাই যখন মাইক্রোতে উঠবে, তখন দেখা গেল অবন্তীর বসার জায়গা হচ্ছে না। সানভি আগ্রহের সাথে অবন্তীকে কোলে নিয়েছিল। অবন্তী ভেবেছিল মানুষটা তাকে আদর করে। কিন্তু তার মতলব ছিল প্রচন্ড বিশ্রী। অবন্তী মাঝপথে কাঁদতে কাঁদতে নেমে গিয়ে বলেছে, সে কোথাও ঘুরতে যাবে না, শুধু মায়ের কাছে যাবে। তাকে কুসুমের সাথে রিকশায় করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এই কারণে মায়ের কাছে সে বকাও খেয়েছে একচোট। মা বিরক্তস্বরে বলেছে,” তুই আবার কবে থেকে এতো আহ্লাদী হয়ে গেলি অবন্তী?”

অবন্তী এইবার সানভীর কাছে যাওয়ার মতো ভুল করল না। দৌড়ে একটি ঘরে ঢুকে পড়ল। রিমা সেখানে শাড়ি ঠিক করছিল। অবন্তীকে দেখে সে একটু ভয় পেল। অবন্তী বিছানায় পা তুলে বসতেই রিমা ধমক দিয়ে বলল,” এসব কি? নামো, নামো। বিছানায় পা উঠিয়ে বসছো কেন? তোমার পায়ে কত নোংরা! যাও, পা ধুঁয়ে এসো। ছি!”

এই ভদ্রমহিলা অবন্তীকে মোটেও পছন্দ করে না। সারাক্ষণ তার সঙ্গে ধমক দিয়ে কথা বলে। তার আচরণে মনে হয় অবন্তী যেন এই বাড়ির কাজের লোকের মেয়ে। অবন্তী অবশ্য এই বয়সেও কারণটা বোঝে। তার বাবার দারিদ্র্যতাই এর পেছনে মুখ্য। তার মা এই বাড়িতে এলে দিন-রাত কাজ করে। কিন্তু অবন্তী কখনও খালামণিকে তাদের বাড়ি গিয়ে জল গড়িয়েও খেতে দেখেনি। এর কারণ তার খালুর গাড়ি আছে। কিন্তু অবন্তীর বাবার গাড়ি নেই।
খুব মনখারাপ করে গুঁটি গুঁটি পায়ে হাঁটছিল অবন্তী। ভেতরের ঘর থেকে কর্কশ কণ্ঠে কেউ ডাকল,” এই লাল বস্তা, এদিকে! ”

অবন্তী চোখে মুছে পেছনে তাকায়। মুখ না দেখেও বুঝতে পারে, নিশান্ত! সে এগিয়ে গেল৷ নিশান্ত কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে হেসে উঠল। অবন্তী সরল কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” হাসছো কেন?”

” এগুলো কি পরেছো তুমি? বস্তা বস্তা লাগছে।”

” তুমি এখনও তৈরী হওনি কেন? বাইরে যাবে না?”

” না। আমার পড়া আছে।”

” আচ্ছা। ”

অবন্তী বের হয়ে যেতে নিলেই নিশান্ত ডাকল,” আরে শোনো, চলে যাচ্ছো কেন? কি জন্য ডেকেছি সেটা শুনবে না?”

” ও আচ্ছা। বলো।”

” চুপচাপ এইখানে দাঁড়িয়ে থাকো।”

” শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকব কেন?”

” শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকবে কে বলল? পাহারা দাও। এখানে কেউ আসছে নাকি দেখো। যদি আসে, তাহলে বলবে আমি পড়ছি। আমার পড়ায় যাতে ডিস্টার্ব না হয়।”

অবন্তী এই কথায় খুব রেগে গেল৷ কট্টর স্বরে বলল,” আমাকে কি তোমার চাকর মনে হয়? আমি পারব না।”

অবন্তী গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেল। নিশান্ত অবাক! মেয়েটার কি হলো হঠাৎ? সে এতোকিছু ভেবে বলেনি। শুধু চেয়েছিল অবন্তী এই ঘরে থাকুক। কিন্তু এই মেয়ে তো ব্যাপারটা বুঝলই না। উল্টো রেগে চলে গেল।

বারান্দার কাছে আসতেই অবন্তীর মনে পড়ল, সে তার ওরনা নিশান্তর ঘরেই ফেলে এসেছে। আবার গিয়ে কি ওরনাটা আনবে? কিন্তু ইচ্ছে করছে না৷ তার নিশান্তর মুখোমুখি হতেই আর ইচ্ছে করছে না৷ তার মনে হয়, নিশান্তও তার মায়ের মতো হয়েছে। নাহলে কি অবন্তীকে ওইভাবে বলতে পারতো? সে পড়াশুনা করলে অবন্তীকে কেন দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে হবে? বাড়িতে আরও কত মানুষ আছে! কাজের মেয়ে কুসুম আপুও আছে। তাকে না বলে অবন্তীকে বলার মানে কি? ইশিতা অবন্তীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত নাড়ল। সে অবন্তীর সমবয়সী। কিন্তু স্বাস্থ্যে আর লম্বায় অবন্তীর চেয়ে বেশি। অবন্তী এই মুহূর্তে যে লেহেঙ্গাটি পরে আছে সেটি ইশিতার জন্যই কেনা হয়েছিল৷ ইশিতা হাতের ইশারায় বোঝালো, অবন্তীকে সুন্দর লাগছে। অবন্তী একটু লজ্জা পেল। ইশিতা তার খুব ভালো বন্ধু।

” এখানে কি করো অবন্তী? তোমার ওরনা কই? ওইটা মাথায় ঘোমটার মতো দিলে আরও সুন্দর লাগতো।”

” আমি ওরনাটা হারিয়ে ফেলেছি।”

ইশিতা মাথায় হাত দিল,” আল্লাহ, কি বলো? চাচী জানতে পারলে অনেক বকা দিবে।”

” মনে হয় নিশান্তর ঘরে আছে। তুমি একটু খুঁজে আনবে?”

” তুমি গেলেই তো হয়!”

” আমি যাবো না ওর ঘরে।”

ইশিতার মুখে একটি দুষ্টমি হাসি খেলে গেল,” নিশান্ত কি আবার তোমাকে ভয় দেখিয়েছে?”

” একদম না। আমি এখন আর আগের মতো বোকা না যে আমাকে ভয় দেখাতে পারবে।”

ছোটবেলায় একবার নিশান্তকে ছাদের দেয়ালে উঠে হাঁটতে দেখেছিল অবন্তী৷ নিশান্তের একটা গেঁজ দাঁত আছে। হাসলে ঠিক ভ্যাম্পায়ারের মতো লাগে। সে অবন্তীকে বলেছিল, ‘আমি ভ্যাম্পায়ার। এখনি তোমার রক্ত চুষে খাবো। ‘এই কথা বলে সে এমন ভাব করল যেন এখনি ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়বে অবন্তীর উপর। অবন্তী প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছিল৷ তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ আর নিশান্তর এগারো। দুই বছর কেটে গেছে। এখন আর অবন্তী নিশান্তকে ভয় পায় না।নিশান্তও আগের মতো তাকে ভয় দেখায় না। কিন্তু খুব পেছনে লাগে।

ইশিতা ওরনা আনতে নিশান্তর ঘরে একাই গেল৷ কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এসে বলল,” স্যরি অবন্তী, পারলাম না। নিশু ভাইয়া ওরনা দিচ্ছে না। বলেছে যার ওরনা তার কাছেই দিবে।”

অবন্তী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিশান্ত এতো সহজে ছাড়বে না এটা সে জানতো। এখন গিয়ে ওরনাটা পেলেই হয়। অবন্তী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল শুধু,” ওরনাটা দাও।”

” উহুম৷ ভেতরে এসে নিয়ে যাও।”
অবন্তী বাধ্য হয়ে ভেতরে ঢুকল। নিশান্ত বলল,” স্যরি।”

অবন্তীর মন একটু নরম হলো। সে আবার বেশিক্ষণ কারো সাথে রেগে থাকতে পারে না। নরম স্বরে বলল,” ঠিকাছে। ওরনা দাও।”

নিশান্ত এবার দুষ্টমি স্বরে বলল,” খুঁজো।”

” মানে?”

” ওরনা এই ঘরেই আছে। খুঁজে বের কর‍তে পারলে ওরনা তোমার৷ আর না পারলে আমি যা বলব তাই শুনতে হবে।”

অবন্তী ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তার এতো বিরক্ত লাগছে! নিশান্ত আড়চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,” রাজি?”

অবন্তী নিঃসাড় কণ্ঠে বলল,” আমার ওরনা লাগবে না। গেলাম।”

সে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরেও নিশান্ত তাকে ডাকল না। মা ওরনা হারানোর খবর শুনলে খুব রেগে যাবে। তাই বাধ্য হয়েই ফিরে এসে বলল,” আচ্ছা, আমি রাজি।”

নিশান্ত বই পড়তে পড়তে হাসল। সে জানতো অবন্তী আসবেই।

চলবে