অন্তহীন বসন্ত পর্ব-০২

0
319

#অন্তহীন_বসন্ত~২
লিখা- Sidratul Muntaz

কমলা গাউন পরে মেয়েটি আসছে। নিশান্ত খুব অবাক হলো। কারণ মেয়েটি অবন্তী আর অবন্তীর তো এখানে আসার কথা নয়। সে সবিস্ময়ে উচ্চারণ করল,” অবন্তী তুমি?”

অবন্তী কৌশলীর মতো হাসল,” তুমি আমাকে দেখতে চেয়েছিলে তাই চলে এলাম।”

” আমি তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম এই কথা কে বলল?” নিশান্ত আরও অবাক। অবন্তী আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,” কেউ বলেনি। কিন্তু কথাটা মিথ্যা না।”

” তুমি জানলে কি করে? আর এখানেই বা আসলে কি করে? তুমি তো আমাদের বাসাই চেনো না।”

অবন্তী খিলখিল করে হাসল। নিশান্ত খুব বিভ্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু অবন্তীকে দেখে তার খুব ভালোও লাগছে। সে হাত ধরে বলল,” অবন্তী, বসো।”

নিশান্ত অবন্তীকে টেনে এনে নিজের বিছানায় বসালো। এই বিছানায় অসংখ্য সফট টয়েজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সবগুলো বিদেশী। বাঘ, সিংহ, হরিণ, পাখি। নরম তুলো আর রঙিন কাপড় দিয়ে তৈরী এদের গা অতি মসৃণ। অবন্তী সর্বপ্রথম যে পুতুলটি হাতে নিল, সেটি একটি ছোট্ট বানর। নিশান্তর সবচেয়ে প্রিয়। সে ঘুমানোর সময় অবশ্যই বানরটি নিজের কাছে রাখে। অবন্তী বানরটি নিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি।”

নিশান্ত চুপ করে রইল। অথচ এই বানরটির গায়ে কেউ হাত দিলেও সে রেগে যায়। অবন্তী নিশান্তর সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি নিয়ে কি অবলীলায় চলে যাচ্ছে। তাও নিশান্ত তাকে কিছু বলছে না। হাঁ করে সে তাকিয়ে আছে অবন্তীর যাওয়ার পথে। কমলা রঙের গাউনে অবন্তীকে যেন জ্যান্ত পুতুলের মতো লাগছে।

রিমার আদুরে ডাকে ঘুম ভাঙল নিশান্তর। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে সে বলল,” শান্ত! উঠে পড়ো বাবা। আজকে না তোমার বার্থডে! হ্যাপি বার্থডে মাই প্রিন্স! একটু পরেই নানুরা চলে আসবে।”

নিশান্ত চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসল। রিমা জানালার পর্দা সরাতে গেল। হুড়মুড়িয়ে আলো প্রবেশ করছে রুমে। সেই সূর্যের আলোয় নিশান্ত স্পষ্ট দেখল, বানরটি তার বালিশের পাশেই আছে। নিশান্ত একটা অদ্ভুত বিষয় ভাবতে লাগল। নানাবাড়ি থেকে তারা এসেছে অনেকদিন হলো। শাওনের জন্মদিনের পর তো আর সেই বাড়িতে যাওয়া হয়নি। কাজেই অবন্তীর সাথেও দেখা হওয়ার প্রশ্ন আসে না। পড়ালেখার চাপে এমনিতেও ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল সে। নানাবাড়ির সবাইকে আর কাজিনদেরও খুব মিস করছিল। আজ তার জন্মদিন। গতরাতে সবার সাথেই ফোনে কথা হয়েছে। কিন্তু নিশান্ত তাদের কাউকেই স্বপ্নে দেখেনি। শুধু দেখল অবন্তীকে। এমন কেন হলো?

রিমা হাসিমুখে ছেলের কাছে এসে বসল,” কি খাবে ব্রেকফাস্টে? পাউরুটি নাকি পরোটা?”

নিশান্ত অন্যমনস্কভাবে বলল,” আজকে আমার জন্মদিনে কে কে আসবে আম্মু?”

রিমা হিসেব কষার মতো বলতে লাগল,” নানুবাড়ির সবাই, তোমার স্কুলের বন্ধুরা, দাদুরা, বাবার কলীগ আর আম্মুর কিছু ফ্রেন্ড। এরাই তো… আর পাশের বাসার অরণ্যদের বলবো? তুমি চাইলে ওরাও আসবে।”

” অবন্তীরা আসবে না?”

রিমা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে যথেষ্ট বিস্ময় নিয়ে প্রশ্নটা করল,” অবন্তী আবার কে?”

” আরে অবন্তী….. হেলেন মামীর বোনের মেয়ে। তোমার মনে নেই? শাওনের জন্মদিনে লাল রঙের লেহেঙ্গা পরেছিল যে, লম্বা চুলের ওই মেয়েটা।”

রিমা খুব হকচকিয়ে গেল। একদৃষ্টে ছেলের ঘুমজড়ানো আদুরে মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবতে লাগল, নিশান্তর মাথায় হঠাৎ অবন্তীর কথা আসল কেন? সে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে থমথমে কণ্ঠে বলল,” অবন্তী শাওনের বার্থডেতে লাল রঙের লেহেঙ্গা পরেছিল, এটাও তোর মনে আছে?”

নিশান্ত সাথে সাথেই পাল্টা প্রশ্ন করল,” মনে থাকবে না কেন?” তারপর নরম স্বরে বলল,” তুমি কি রঙের শাড়ি পরেছিলে সেটাও মনে আছে!”

” বলতো!” রিমা আগ্রহী চোখে তাকিয়ে রইল।

নিশান্ত ঢোক গিলল। সে ভাবেনি মা যে জানতে চাইবে। আমতা-আমতা করে বলল,” বেগুণী।”

রিমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হয়নি। সে পরেছিল ক্রিম রঙের একটা শাড়ি। ক্রিম রঙ আর বেগুণী রঙের পার্থক্য অনেক। গুলিয়ে ফেলার প্রশ্নই আসে না। অর্থাৎ নিশান্ত তার শাড়ির রঙ মনে রাখেনি। অথচ কোথাকার কোন অবন্তী, তার লেহেঙ্গার রঙ ঠিকই মনে রেখেছে। ব্যাপারটি রিমাকে সামান্য হতাশ করল। সে শান্ত স্বরে বলল,” ওরা তো আসবে না।”

” কেন আসবে না? ওদের ইনভাইট করোনি?”

রিমা আশ্চর্য কণ্ঠে বলল,” কেন ইনভাইট করব? ওরা কি আমাদের কেউ হয়? অবন্তীর আম্মু তোর মামীর বোন। সে শাওনের কাজিন হয়। শাওনের জন্মদিন হলে আসতো। তোর বার্থডেতে কেন আসবে? ওরা তো তোর কেউ হয় না।”

নিশান্তর মনটা দপ করে খারাপ হয়ে গেল। রিমা ব্যস্ত হয়ে বলল,”হাত-মুখ ধুঁয়ে খেতে আয়।” নিশান্ত গম্ভীর হয়ে টেবিলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেহমান আসতে শুরু করল। অনুষ্ঠান শুরু হবে সন্ধ্যায়। বড় রেস্টুরেন্ট ভাড়া করা হয়েছে। একমাত্র ছেলে হওয়ায় নিশান্ত সবার খুব আদরের। তার জন্মদিনে প্রত্যেকবারই খুব মজা হয়। আজ নানু এসেই নিশান্তর গলা জড়িয়ে ধরে দুইগালে চুমু দিল। ‘আমার নানাভাই, আমার নানাভাই’ বলে বাড়ি মাথায় তুলল। নিশান্তর খালা, মামারা বেশিরভাগই অল্পবয়স্ক। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী। অনেকে তো নিশান্তর সমবয়সী। তারা ঢুকেই নিশান্তকে জড়িয়ে ধরে বার্থডে উইশ করতে লাগল। বাড়িজুড়ে উল্লাস শুরু হলো। কিন্তু নিশান্তর মনখারাপ ভাবটা কাটল না। তার বলতে ইচ্ছে করল, ‘পার্টি ক্যান্সেল। তোমরা সবাই চলে যাও। আমার কিছু ভালো লাগছে না।’ কিন্তু এই কথাগুলো সে বলতে পারল না। পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখার মতো বয়স নিশান্তর হয়েছে।

_________
অবন্তী বার-বার নিজেকে আয়নায় দেখছে আর লজ্জায় মিশে যাচ্ছে। তার মাথাটা যেন ধু ধু প্রান্তর। একটাও চুল নেই। গরমের কারণে বাবা সেলুনে নিয়ে মাথা কামিয়ে দিয়েছে। অবন্তী সেলুনে যাওয়ার আগে জানতো না যে তাকে এই কাজের জন্য নেওয়া হচ্ছে। পুরো সময় সে বাবার ফোনে মগ্ন হয়ে গেমস খেলছিল। হঠাৎ আয়নায় চোখ পড়তেই দেখল তার মাথায় অর্ধেক চুল আছে, অর্ধেক নেই। অবন্তী ভীষণ জোরে একটা চিৎকার দিয়েই কান্না শুরু করল। সেই কান্না এখনও থামেনি। মা রান্নাঘরে কাজ করছেন। ভীষণ সুঘ্রাণে ভরে উঠেছে ঘর। অবন্তী রান্নাঘরে ঢুকে দেখল মা পোলাও করছেন। রোস্টের সাইজে মুরগী কে-টে রাখা। বড় ইলিশ মাছ ভাজা হচ্ছে। খাসির মাংস, গরুর মাংস, চিংড়ী মাছ। এতো খাবার দেখে অবন্তীর চোখ ছানাবড়া। তাদের বাড়িতে কদাচিৎ এমন রান্না হয়৷ কান্না থামিয়ে সে রান্না দেখায় মনোযোগী হলো। খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,” এতোকিছু কেন রাঁধছো মা?”

বিলকিস মিষ্টি হেসে বলল,” আজকে আমার মেয়ের চুল কা-টা দিবস। এজন্য রান্না করে সেলিব্রেশন হবে।”

মায়ের পাশে দাঁড়ানো লতা আন্টি হাসলেন। অবন্তীরা ফ্ল্যাটে সাবলেট থাকে। তাদের ঘরের পাশেই অন্য পরিবার। রান্নাঘরটা শেয়ার করতে হয়। অবন্তী মুখ গোঁজ করে মাথায় কাপড় টেনে নিল। সে তার চুলহীন কুৎসিৎ চেহারা কাউকে দেখাতে চায় না। লতা আন্টি যদি লজ্জা দেয়! সে অবশ্য এই নিয়ে কিছু বলল না। বিলকিস বলল,” আজকে তোর হেলেন আন্টি আর জাকির আঙ্কেল আমাদের বাসায় আসবে। হেলেনের শ্বাশুড়ীও আসবে।”

” আচ্ছা, তাই নাকি?” অবন্তীর চোখ ঝলমল করে উঠল। বাড়িতে মেহমান এলে তার খুব আনন্দ হয়।

” কখন আসবে ওরা?” তুমুল উৎসাহে জানতে চাইল অবন্তী। বিলকিস মাংস ম্যারিনেট করতে করতে জানাল,” গাড়িতে আছে। যে-কোনো সময় এসে কলিংবেল বাজাবে।”

অবন্তীর ইচ্ছে করল দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। কিন্তু লজ্জা লাগছে। জাকির আঙ্কেল সবসময় হাতভর্তি জিনিস নিয়ে বেড়াতে আসেন। আইসক্রিম, চিপস, চকলেটের অভাব হয় না। আর হেলেন আন্টিও অবন্তীর জন্য কিছু না কিছু কিনেই আনে। অবন্তীর খুব আনন্দ লাগছে। চুল কা-টার দুঃখ সে নিমেষেই ভুলে গেল। প্রবল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, কখন আসবে সবাই? কিন্তু একঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কেউ এলো না। অবন্তী রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, মা ফোনে কথা বলছে। ফোন রাখতেই জিজ্ঞেস করল অবন্তী,” ওরা কখন আসবে, মা?”

বিলকিস খুব জরুরী গলায় বলল,” আজকে নিশান্তর জন্মদিন। এজন্যই দেরি হচ্ছে। ওরা নাকি বেশিক্ষণ থাকবেও না। দুপুরে খাবেও না। এদিকে ওদের কি কাজ ছিল এজন্য আসছে। ধূর, আগে জানলে আমি এতোকিছু রান্না করতাম না।”

মাকে খুব বিরক্ত দেখাচ্ছে। অবন্তীর খুব মনখারাপ হলো। নিশান্তর জন্মদিন, অথচ এই কথা সে জানেই না! আচ্ছা, তারা কেন জন্মদিনের দাওয়াত পেল না? অবন্তীর খুব আফসোস হতে লাগল। ইশিতাও নিশ্চয়ই নিশান্তর জন্মদিনে গিয়েছে। তারা অবশ্যই অনেক মজা করছে। তারা একসাথে হলেই অনেক মজা করে। অবন্তী সবকিছু মিস করছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্যমনস্ক হয়ে এসবই চিন্তা করছিল সে। হঠাৎ তার চোখ কপালে উঠল। বারান্দার রাস্তায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বড় একটা গাড়ি এসে থামল। সেই গাড়ি থেকে সবার প্রথমে নামল নিশান্ত। তার চোখে সানগ্লাস। গায়ে লাল-টিশার্ট, কালো জিন্স। খুব উৎফুল্ল ভঙ্গিতে সে ঢুকছে। হেলেন আন্টি নামলেন শাওনকে কোলে নিয়ে। তিনি বিরক্ত ভঙ্গিতে জাকির আঙ্কেলের কোলে শাওনকে গছিয়ে দিলেন। তারপর হাসি-হাসি মুখে নামল নানু। হেলেন আন্টির শাশুড়ীকে অবন্তী নানু বলেই ডাকে। সে মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগল। নিশান্ত তাদের বাড়িতে আসায় সে মোটেও খুশি হয়নি। তার খুব কান্না পাচ্ছে। কোথাও লুকিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। সে বিরবির করে বলল,” আল্লাহ, আমি অদৃশ্য হতে চাই।”

কলিংবেলের তীক্ষ্ণ শব্দ বাজল। অবন্তী নিজেকে লুকাতে ব্যস্ত হলো। কিন্তু কোথায় লুকাবে সে? তাদের একটাই রুম। বাথরুম বাইরে। রুম থেকে বের হয়ে বাথরুমে ঢোকা সম্ভব নয়। দরজা ইতোমধ্যে খোলা হয়ে গেছে। নিশান্তর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে,” আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”

বিলকিস সবিস্ময়ে বলল,” তোমার না আজকে জন্মদিন?”

নানু বলল,” জন্মদিন হলেও ও এখানে আসার জন্য পাগল হয়ে গেছে। কোনোদিন আসে নাই তো, তাই ভাবলাম নিয়ে আসি।”

বিলকিস আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল,” খুব ভালো করেছেন খালাম্মা!”

” অবন্তী কোথায়? অবন্তীর জন্যই ও এসেছে।”

” অবন্তী ঘরেই আছে।”

বারান্দায় নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে ফেলতে লাগল অবন্তী। প্রাণপণে দোয়া করতে লাগল, এই বারান্দায় যাতে কেউ না আসে। কিন্তু অবন্তীর সমস্ত ভাবনায় জল ঢেলে নিশান্ত ফট করে ঢুকে পড়ল। অবন্তী বিকট একটা চিৎকার দিয়ে মেঝেতে বসল। ভাগ্যিস বারান্দার দড়িতে একটা চাদর ঝুলছিল। সে চাদরেই লুকিয়ে ফেলল ন্যাড়া মাথা। নিশান্ত হাসতে হাসতে বারান্দা থেকে বের হলো। সবাই অবাক এবং বিব্রত। অবন্তীর এভাবে চিৎকার করার কারণ কি? নিশান্ত বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলল,” ও চুল কে-টে একদম টাক্কু হয়ে গেছে নানু।”

লজ্জায় অবন্তীর সমস্ত শরীর ভেঙে কান্না এলো। সে আর কখনও নিশান্তর সামনে যাবে না ঠিক করল।

চলবে