অন্তহীন বসন্ত পর্ব-০৮

0
202

#অন্তহীন_বসন্ত~৮
লিখা- Sidratul Muntaz

সন্ধ্যার আঁধারে ঢেকে গেল প্রকৃতি। বাগানের মাঝেই ইয়া বড় একটা করম চায়ের গাছ। সাথে আরও বিভিন্ন ফুলগাছ। বারান্দা থেকেও মিষ্টি সুঘ্রাণ নাকে লাগছে। অতিরিক্ত গাছ-পালার কারণে জায়গাটা খুব সুনসান আর অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। হলদে টিমটিমে আলো জ্বলছে বারান্দায়। গ্রিলের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অবন্তী। তার বিষণ্ণ চোখজোড়া বাইরে নিবদ্ধ। হঠাৎ কেউ পেছন থেকে ডাকল,” অবন্তী।”

আচমকা হৃৎপিন্ডের সংকোচন-প্রসারণ ত্বরান্বিত হলো। অবন্তী পেছনে ঘুরে বিনীত ভঙ্গিতে বলল,” জ্বী!”

নিশান্তর বামহাত প্যান্টের পকেটে। ডানহাতে ফোন। ফোনের স্ক্রিন জ্বলছে। মনে হয় ফোনে কিছু করছিল সে।

” এখানে একা দাঁড়িয়ে কি করছো?”

অবন্তী অপ্রস্তুত গলায় বলল,” জ্বী, কিছু না।”

অবন্তীর ভাব-ভঙ্গি দেখে নিশান্ত হেসে ফেলল। অবন্তীও লজ্জা পেয়ে গেল। তাকে আরও অস্বস্তিতে ফেলতেই যেন নিশান্ত বলে বসল,” এমনভাবে জ্বী, জ্বী করছো যেন আমি তোমার টিচার!”

অবন্তী কি উত্তর দিবে ভেবে পেল না। হেসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালালো। লাভ হলো না। নিজের কাছেই নিজেকে বোকা মনে হচ্ছে। নিশান্ত হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল,” মাঝখানে তোমরা এই বাড়িতে আসা একদম ছেড়ে দিয়েছিলে, তাই না?”

অবন্তী মাথা নিচু করল। আজকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি তাকে অনেকবার হতে হয়েছে। সে প্রত্যেকবারই এড়িয়ে যাওয়ার স্বরে জবাব দিয়েছে। এবারও তাই করল। ছোট করে শুধু বলল,” হুম।”

নিশান্ত সরাসরি এবং স্পষ্টভাবে প্রশ্ন করল,” কেন?”

প্রশ্নটা করেই সে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানতে চাইছে। জানাটা খুবই দরকার। অবন্তী খুব হকচকিয়ে গেল। কিছু বলার চেষ্টা করেও বলতে পারল না। নিশান্ত কিছুক্ষণ চুপ থেকে অভিযোগের স্বরে বলল,” কানাডা যাওয়ার আগে আমরা একটা ‘গুডবাই’ পার্টি রেখেছিলাম৷ সেই পার্টিতেও তো তোমরা আসোনি!”

অবন্তী অবাক হয়ে বলল,” জানলে তো আসবো! আমরা তো জানতামই না কোনো পার্টির কথা।”

” সত্যিই কি জানতে না।”

অবন্তী দুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” উহুম। তোমরা চলে গেছো এই খবরটাই তো পেয়েছি দুইবছর পর।”

নিশান্ত এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন অবন্তীর কোনো কথাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,” আজকে আমরা সবাই ডিনারে যাচ্ছি। তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো।”

” কয়জন যাচ্ছো?”

” এইতো পলি আন্টি, সানজিদা আন্টি, নিয়ন মামা.. ঈশিতা, তামিম, শাওন।”

অবন্তী সাবধানী কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” সানভী আঙ্কেলও কি যাবে?”

” তার কথা জিজ্ঞেস করছো কেন? ”

” এমনি। মা মনে হয় আমাকে যেতে দিবে না।”

নিশান্ত ঠান্ডা গলায় বলল,” সানভী আঙ্কেল যাচ্ছে না।”

” আচ্ছা আমি মায়ের থেকে অনুমতি নিয়ে তোমাকে জানাব।”

” ওকে।” নিশান্ত চলে গেল। অবন্তী হাঁফ ছাড়ল। সে একটা বিষয় খেয়াল করেছে। নিশান্ত আর আগের মতো নেই। কেমন যেন বদলে গেছে। বড় রসকষহীন দেখায় তাকে। যেন খুব মেপে মেপে কথা বলে।

_________
” আম্মু, আমাদের যাওয়ার আগে যে পার্টি হয়েছিল সেখানে কি অবন্তীদের ইনভাইট করা হয়নি?”

হঠাৎ নিশান্তর মুখে এই প্রশ্ন শুনে রিমা চমকে উঠল। সামান্য বিব্রত হয়ে বলল,” হঠাৎ এই কথা কেন?”

” এমনি জিজ্ঞেস করছি। বলো না!”

” আমি তো হেলেনকে বলেছিলাম ওদের যেন ইনভাইট করে। তারপর ওরাই আসতে রাজি হয়নি।”

” ওরা রাজি হবে না কেন? আমাদের বিদায় জানাতে আসবে, এতে রাজি না হওয়ার কি আছে?”

” সেটা আমি জানব কি করে? ওদের ইগো প্রবলেম। তাছাড়া ওরা তো আমাদের ফ্যামিলির কেউ না। ফ্যামিলি গেট টুগেদারে ওদের আসতেই হবে এমন কোনো কথাও নেই। আর তুই হঠাৎ তিনবছর আগের প্রসঙ্গ নিয়ে পড়লি কেন?”

নিশান্ত চোয়াল শক্ত করে বলল,” আমি আজকে অবন্তীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ সে বলল তারা নাকি আমাদের যাওয়ার খবর জানতোই না!”

রিমা একটু থমকালো। তারপর ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলল,” কিসের জানতো না? অবশ্যই জানতো। আর তিনবছর আগের কথা আমার ঠিকভাবে মনে পড়ছে না। হেলেন হয়তো বলতেই ভুলে গেছিল।”

নিশান্ত কঠিন স্বরে বলল,” তুমি মিথ্যা বলেছিলে তাই না আম্মু? অবন্তীদের কাছে আসলে ইনভাইটেশন পাঠানোই হয়নি।”

রিমা দরাজ গলায় বলল,” হয়তো হয়নি৷ কাজের চাপে ভুলে গেছিলাম। তাতে হয়েছেটা কি? এখন কি এই জন্য দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে?”

নিশান্তর নাক লাল হয়ে উঠল। রিমা বিরক্তিভরা কণ্ঠে বলল,” ওরা বাইরের মানুষ, আউটসাইডার। আমাদের সবধরণের ফ্যামিলি ফাংশানে ওরা থাকবে এটা কেমন কথা? কি আজব!”

” তুমি ওদের পছন্দ করো না কেন?”

রিমা ত্যাড়া গলায় বলল,” আমি পছন্দ করি না এটা আমার ব্যাপার। তোর এতো পছন্দ হলে যা গিয়ে পূজো কর।”

নিশান্ত আর কথা বাড়াল না। ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তার কিছুক্ষণ পরেই অবন্তী এসে ঢুকল। তার মুখ হাসি-খুশি। মা ডিনারে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। এই কথাটা নিশান্তকে জানানোর জন্যই এসেছিল। কিন্তু নিশান্ত এখানে নেই৷ তার ঘরে বসে আছে রিমা। অবন্তী হাসিমুখে বলল,” আন্টি, আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন?”

রিমার মেজাজটা আগেই খিঁচড়ে ছিল। অবন্তীকে দেখে যেন আগুনে ঘি পড়ল। সে জবাব না দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে স্যুটকেস গোছাতে লাগল। যেন অবন্তীর কথা সে শুনতেই পায়নি। কাজের মেয়ে কুলসুম এলো রিমাকে চা দেওয়ার জন্য। অবন্তীর দিকে চেয়ে একবার হাসল সে। প্রথম প্রশ্নের উত্তর না পেয়েও দমে গেল না অবন্তী। তুমুল উৎসাহে দ্বিতীয় প্রশ্নটা করল,” আন্টি, নিশান্ত কোথায়?”

রিমা ছ্যাঁত করে বলে উঠল,” নিশান্ত কোথায় মানে? এক চড় মেরে দাঁত ফেলে দিবো। ও তোমার কয়বছরের বড়? তুমি ওকে নাম ধরে ডাকছো কোন সাহসে? ”

অবন্তী থতমত খেল। চেহারা ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করল। অপমানের লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ল মুখজুড়ে। কুলসুম পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে এইভাবে বলার মানে কি? রিমা থামল না। গজগজ করে আরও বলল,” বেয়াদবির একটা লিমিট থাকে। এখন থেকে নিশান্ত ভাইয়া বলে ডাকবে। আমি যেন আর কখনও ওর নাম ধরে ডাকতে না শুনি তোমাকে।”

অবন্তী মাথা নিচু করে ফেলল। কুলসুম একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রিমা চায়ে চুমুক দিয়ে কর্কশ গলায় বলল,” খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকবে না মেয়ে।চোখের সামনে থেকে যাও।”

অবন্তী দ্রুত সরে পড়ল। চোখ বেয়ে নামল জলের ধারা। এই মানুষটা তাকে আজও সহ্য করতে পারে না। আচ্ছা, তার কি দোষ?

সবাই ডিনারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে নেমেছে। শুধু ছোটরাই যাচ্ছে। বড়দের মধ্যে আছে নিয়ন আর বর্ষা। নিশান্ত বের হওয়ার সময় বলল,” অবন্তী আসেনি?”

ঈশিতা বলল,” আমি ডাকতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ও নাকি যাবে না।”

” কেন যাবে না?”

” আমি ঠিক জানি না।”

নিশান্ত আবার ভেতরে ঢুকল। দুইতলায় উঠে যাওয়া সিঁড়িঘরের কাছেই অবন্তীকে পাওয়া গেল। অন্ধকারে বসে আছে চুপচাপ। নিশান্তকে দেখেই সে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো। নিশান্ত জিজ্ঞেস করল,” যাবে না তুমি?”

অবন্তী নিচু গলায় বলল,” মা অনুমতি দেয়নি। কি করে যাব?”

নিশান্ত অবাক হলো। অবন্তী মিথ্যা কথা বলছে। একটু আগেই তো বিলকিসের সাথে কথা হলো নিশান্তর। বিলকিস বলছিল,” অবন্তীকে চোখে চোখে রেখো বাবা। আমার মেয়েটা বোকা ধরণের। হারিয়ে-‌টারিয়ে যেতে পারে। তোমাদের ভরসায় ওকে পাঠাচ্ছি।” অথচ অবন্তী এখন বলছে ভিন্ন কথা। সমস্যা তার মায়ের নয়, সমস্যা তার নিজের। সে নিজেই যেতে চাইছে না। নিশান্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” আচ্ছা ঠিকাছে। তুমি তাহলে থাকো। বাই।”

” বাই।”

অবন্তী দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে গেল। ভাগ্যিস অন্ধকার ছিল, তাই নিশান্ত অবন্তীর চোখের পানি দেখেনি। অবন্তীর মনে হলো, বড় হয়ে যাওয়াটা অনেক বাজে ব্যাপার। তারা যখন ছোট ছিল তখন জীবনটা কতই না সুন্দর ছিল। যত বড় হচ্ছে ততই যেন জীবন জটিল হয়ে উঠছে। অদৃশ্য একটা প্রাচীরে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে তারা।

চলবে