অন্যরকম প্রেমানুভূতী পর্ব-০৬

0
773

#গল্পঃ_অন্যরকম_প্রেমানুভূতী
#Maisha_jannat_nura(লেখিকা)
#পর্ব_৬

একটুপর তৃপ্তি আর আমজাদ চৌধুরী তীব্রের কেবিনে প্রবেশ করে, তৃপ্তি দরজার পাশেই দাড়িয়ে থাকে। চোখ বন্ধ করে মাথার উপর একহাত রেখে শুয়ে আছে তীব্র, আমজাদ চৌধুরী তীব্রের কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখে। হঠাৎ কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে তীব্র চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখে আমজাদ চৌধুরী দাড়িয়ে আছে, তীব্র তাকে উদ্দেশ্য করে বলে…

-দাদু তুমি এখানে, আমাকে হাসপাতালে এডমিট করালে কিভাবে?
আমজাদ চৌধুরী তীব্রের বেডের পাশে রাখা চেয়ার টেনে বসে পড়ে আর শান্তগলায় বলেন..

-দাদুভাই তোকে কারা যেন খুব মেরে রাস্তার ফেলে রেখে গিয়েছিলো আর সেখানে থেকে ঐ দিদি ভাইয়ের (তৃপ্তির দিকে আঙুল উঠিয়ে ইশারা করে) মাধ্যমে আমি তোর খবর পাই, গার্ডদের নিয়ে সেখানে গিয়ে দেখি তোর সম্পূর্ণ শরীর রক্তে মাখা তখনি তোকে হাসপাতালে আনা হয় আর বেশ কিছুক্ষণ আগে তোর একটা মেজর অপারেশন ও করা হয়েছে।

আমজাদ চৌধুরীর ইশারায় তীব্র একনজর তৃপ্তিকে দেখে নিজের দৃষ্টি অন্যত্র ঘুরিয়ে নেয়। আমজাদ চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলে..

-আমাকে সুস্থ হতে দাও, পুরো হিসেব আমি তারপর নিবো (রাগে দাঁতে দাঁত পিষে বলে)

তীব্রের রাগ যে কতোটা ভয়ংকর তা সম্পর্কে আমজাদ চৌধুরীর ভালোভাবেই ধারনা আছে, যারা ওর এই অবস্থা করেছে তাদের জন্য যে কতোটা নির্মম শাস্তি অপেক্ষা করছে তা ভেবেই আমজাদ চৌধুরীর ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন..

-দাদুভাই তুমি ভেবো না, যারা তোমার এমন অবস্থা করেছে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা আমি করবো।

-নো নো দাদু, তীব্র চৌধুরীর গায়ে হাত দেওয়ার শাস্তি ঠিক কেমন হতে পারে তা আমি নিজে ওদের বোঝাবো এএ বিষয়ে আর একটা কথাও আমি শুনতে রাজি নই।

আমজাদ চৌধুরী তীব্রের এমন কঠিন গলায় কথাগুলো শুনে আর কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারেন নি। কিছুসময়পর একজন নার্স তীব্রের কেবিনে প্রবেশ করে আর বলে..

-এখন ওনার খাওয়ার সময় হয়ে গেছে আর ঔষধ ও দিতে হবে আপনারা বাহিরে যান।

তীব্র নিজের দৃষ্টি নিচে রেখেই থমথমে কন্ঠে বলে উঠে..
-দাদু তুমি আর নার্স কেবিন থেকে চলে যাও আর ঐ মেয়েটাকে থেকে যেতে বলো।

তীব্রের এমন কথায় তৃপ্তি চোখ বড়বড় করে তীব্রের দিকে তাকিয়ে আছে আর বিরবির করে বলছে..

-আমি এখানে থেকে যাবো মানে, আমি থেকে কি করবো?

আমজাদ চৌধুরী খুব ভালো করেই জানে তীব্র যখন যেটা করবে বলে ঠিক করে তখন সেটাই করে তাই তিনি আর ২য় বাক্য উচ্চারণ না করে চেয়ার থেকে উঠে নার্সকে খাবার আর ঔষধ তৃপ্তিকে বুঝিয়ে দিতে বলে,
চলে যান সেখান থেকে।নার্স তৃপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে..

-ম্যাম এদিকে আসুন, স্যার কে এখন এই খাবার আর এই ঔষধগুলো দিবেন।

তৃপ্তি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়, নার্স সেখানে থেকে চলে যায়।

তীব্র একদৃষ্টিতে তৃপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে, নিজের দৃষ্টি একবারের জন্যও অন্যত্র সড়ায় নি। তীব্রের এভাবে তাকানোর জন্য তৃপ্তির খুব অস্বস্তিবোধ হচ্ছে মনে মনে বলে..

-এই খচ্চর বেড়া এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন, কি চলছে এর মনে! আল্লাহ তুমি আমায় এ কোথায় নিয়ে আসলে।

তীব্র তৃপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে..
-আমাকে মনে মনে বকা দেওয়া শেষ হলে খাবার আর ঔষধ গুলো খাওয়ায় দাও।

তৃপ্তি পুরো হা হয়ে গেছে চোখ বড়বড় করে তীব্রের দিকে তাকিয়ে আছে।

-এখন কি নিজের চোখ দিয়েই আমাকে গিলে খাওয়ার চিন্তা করছো নাকি, মুখটা বন্ধ করো নয়তো মুখের ভিতর পোকামাকড় প্রবেশ করবে।

তীব্রের কথায় তৃপ্তি বেশ লজ্জা পায় মুখ বন্ধ করে নিজের মাথা নিচু করে নেয় আর মনেমনে ভাবে কেমন বেশরমের মতো একজন ছেলের দিকে সে তাকিয়ে ছিলো।

-আবারও ভাবনায় নিজেকে ডুবাচ্ছো যে
আমাকে কি এখন না খেয়ে থাকতে হবে?(তীব্র)

তৃপ্তি আর দেড়ি না করে তীব্রের কাছে যায় আর ওকে উঠে বসায়, তারপর খাবার খাওয়ানো শেষ করে ঔষধ দিয়ে তীব্রকে আবারও শুয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে আসতে নিলেই তীব্র উচ্চস্বরে বলে উঠে..

-আমি কি তোমাকে যেতে বলেছি?
তীব্রের কথায় তৃপ্তির পা থেমে যায় পিছনঘুরে আস্তে করে বলে..

-না।
-তাহলে যাচ্ছো কেন? (তীব্র)

-আপনাকে খাওয়ানোর কাজ তো শেষ, এখন আপনি রেস্ট করুন আমি এখানে থেকে কি করবো? (তৃপ্তি)

-চুপচাপ আমার পাশে এসে বসো, তোমাকে শুধু আমাকে খাওয়ানোর জন্যই এখানে থেকে যেতে বলি নি। (তীব্র)

তৃপ্তি কিছু বলতে নিবে তার আগেই তীব্র তৃপ্তিকে থামিয়ে একটু রাগী কন্ঠে বলে উঠে..

-আমার কথার উপর কেও কোনো কথা বলে সেটা আমার মোটেও পছন্দনীয় নয়।

তীব্রের রাগী কন্ঠে বলা কথা শুনে তৃপ্তি ভয়ে আর কিছু বলার সাহস পায় না, ধীরপায়ে এগিয়ে এসে তীব্রের বেডের পাশে রাখা চেয়ার টেনে মাথানিচু করে বসে পড়ে, তীব্র নিজের দৃষ্টি তৃপ্তির দিকে স্থির করে বললো..

-আমাকে মারার সময় তুমি ওখানে ছিলে?

-হুম (তৃপ্তি)

-ওদের দেখলে চিনতে পারবে? (তীব্র)

-হুম পারবো, কিন্তু কেন? (উৎসুক দৃষ্টিতে তীব্রের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নসিক্ত কন্ঠে বললো তৃপ্তি)

-উল্টো প্রশ্ন পছন্দনীয় না (তীব্র)

তৃপ্তি ওর দৃষ্টি তীব্রের থেকে সরিয়ে বিরবির করে বললো..
-বজ্জাত বেডা।

-আমি বজ্জাত তাই না? (তীব্র)

-না মানে, ইয়ে.. (ভয়ে তৃপ্তির গলায় কোন সব কথা আটকে আসছে)

-হুম বলো (তীব্র)
-আ আমি সেভাবে বলতে চাই নি, আসলে (তৃপ্তি)
-বলতে চাও নি, কিন্তু বলেছো তো (তীব্র)

তৃপ্তি মাথা নিচু করে নিশ্চুপ হয়ে আছে..
-আমি যতোদিন পর্যন্ত পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছি না ততোদিন তুমি আমার সেবা করবে আমার বজ্জাত বলেছো তো, এটা তোমার শাস্তি (তীব্র)

তৃপ্তি যেন পুরো শকড হয়ে গেছে তীব্রের কথায়, কিছু বলতে নিবে তখনি তীব্র তৃপ্তিকে থামিয়ে আবার ও বলে উঠে..

-প্রথমেই বলেছি আমার কথার উপর কারোর কথা বলা আমার পছন্দনীয় নয় আর সেটা তুমি কখনও ভুলে যেও না, তা না হলে এর থেকে অনেক কঠিন শাস্তি তোমাকে পেতে হবে যা তোমার সহ্য ক্ষমতার বাহিরে।

তৃপ্তি আর কিছু বলে নি, কারণ ও বুঝতে পেরেছে তীব্রের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। কিছুসময় পর ডাক্তার তীব্রের কেবিনে প্রবেশ করেন তীব্র কে চেক-আপ করতে, তৃপ্তি তখনও তীব্রের পাশেই বসে ছিলো। ডাক্তার তৃপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে..

-ম্যাম, আপনার হাসবেন্ড এর শারীরিক অবস্থা আগের থেকে অনেক বেটার হয়েছে, একটু চিন্তার কারণ থাকলেও এখন আপনি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আর কোনো চিন্তার কারণ নেই।

ডাক্তারের মুখে আবারও ও তীব্রকে তৃপ্তির হাসবেন্ড বলায় তৃপ্তি এবার রাগী দৃষ্টিতে ভ্রু দু’টো কুঁচকে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে, এদিকে তীব্র মিটিমিটি হাসছে। তৃপ্তি ডাক্তারকে কিছু বলতে নিবে তখনি তীব্র তৃপ্তিকে থামিয়ে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলে..

-ডাক্তার আমার ঔষধ আর খাবার দেওয়ার জন্য যে নার্সকে ঠিক করে রেখেছেন তাকে বলে দিবেন তৃপ্তি কে যেন সবকিছু বুঝিয়ে দেন আমি যতোদিন পর্যন্ত সুস্থ না হচ্ছি আমার দেখাশুনার সম্পূর্ণ ভার তৃপ্তির উপর দিয়েছি আমি।

-জ্বি স্যার অবশ্যই (ডাক্তার)

চেক-আপ শেষ করে ডাক্তার কেবিন থেকে চলে গেলেন, তৃপ্তি এবার রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে নিজের দৃষ্টি তীব্রের দিকে স্থির করে তীব্র কে উদ্দেশ্য করে বলে..

-ঐ মি, বজ্জাত… আমি আপনার বউ নাকি যে আমি আপনার সব কাজ করবো?

তীব্র ভাবলেশহীন ভাবেই বললো..
-কেন বউ হতে চাও বুঝি?

তীব্রের এমন প্রশ্নে তৃপ্তির রাগ যেন আকাশচুম্বী হয়েছে, কিছু বলতে নেওয়ার আগে তীব্র বলে উঠে..

-বি কুল, ডোন্ট সিরিয়াস। আবরার চৌধুরী তীব্র কাওকে নিয়ে এতো বেশি সিরিয়াস হয় না, হাজার হাজার মেয়ে আমার পিছনে লাইন লাগিয়ে বসে আছে কিন্তু আমি তাদের দিকে ফিরেও দেখি না।

তীব্রের কথায় তৃপ্তি একটা ভেংচি কেটে চেয়ার থেকে উঠে ওয়াশরুমের চলে যায়।
.
.
পরেরদিন সকালে তীব্রের বাড়ির সবাই তীব্র কে দেখতে হাসপাতালে এসেছে, তৃপ্তি ওদের থেকে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে ছিলো আর দেখছিলো সকলের কতো ভালোবাসা তীব্রের প্রতি। একটা সময় তার ও একটা ভালোবাসায় ভরা ছোট্ট পরিবার ছিলো যা এখন আর নেই ভাবতেই তৃপ্তির চোখ ভিজে যায়, সবার আড়ালে চোখের পানি মুছে কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায় তৃপ্তি। পরিবারের সকলের সাথে টুকিটাকি কথা বলে নেয় তীব্র কেন যেন তার খুব ছটফট লাগছে, চোখদুটো যেন কাওকে খুঁজছে কিন্তু সে কিছুতেই তীব্রের নিকট ধরা দিচ্ছে না যার জন্য তীব্রের ভিতর অস্থিরতা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বেড়েই চলেছে।

একটু পর তীরের কেবিন থেকে সবাই বেড়িয়ে গেলেন শুধু ভিতরে ছিলেন তীরের কাজিন তূর্য চৌধুরী। সে তীব্র কে উদ্দেশ্য করে বলে..

-দাভাই, কাল রাতে তোকে কারা মেরেছিলো সে সম্পর্কে কিছু আইডিয়া করতে পেরেছিস।

তীব্র নিজের দৃষ্টি নিচে রেখেই বলে..
-হুম বেশ কিছুটা বুঝতে পেরেছি আর প্রমাণ ও আমার কাছে আছে, শুধু আমাকে সুস্থ হতে দে তারপর ওদের হিসাব আমি নিবো।

-হুম আচ্ছা।

ওদের কথপোকথন এর মাঝেই তৃপ্তি তীব্রের কেবিনে প্রবেশ করে, তৃপ্তিকে প্রবেশ করতে দেখে তীব্রের মনের অজানা অস্থিরতা যেন বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ একজন অচেনা মেয়েকে কেবিনে প্রবেশ করতে দেখে তূর্য নিজের ভ্রু কুঁচকে নেয়, আর তৃপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে..

-এই মেয়ে, কে তুৃমি আর এখানে কি করছো?

তীব্র স্বাভাবিক ভাবেই বলে উঠে..
-তোর ভাবী, ভাবী বলে ডাক।

তীব্রের কথায় তূর্য যেন অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, চোখ দুটো বড়বড় করে তীব্রের দিকে তাকিয়ে বলে..

-ভা আ ভাবী.. মানে?
-হুম তোর ভাবী মানে আমার বউ (তীব্র)
-হাউ ইজ ইট পসিবল? (তূর্য)

তীব্রের এমন কথায় তৃপ্তির চোখ গুলো রসগোল্লার মতো বড় আকার ধারণ করেছে এখনি যেন চোখের কোটর থেকে বেড়িয়ে আসবে, তৃপ্তি উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠে..

-নাআআআ… আ আব আমি ওনার বউ নই, উনি মজা করছেন আমি শুধু ওনার দেখাশোনা করার জন্য রয়ে গেছি।

তূর্য খুব ভালো করেই জানে তীব্রকে, তীব্র চৌধুরী কখনও মজা করে কিছু বলে না যা বলে বা করে তার পিছনে যথেষ্ট কারণ থাকে, তাই সে তৃপ্তিকে কিছু না বলে তীব্রের দিকে লক্ষ করে, তীব্র স্বাভাবিক ভাবেই বসে ছিলো তখনও তৃপ্তির কথায় যেন ওর কোনো হেলদোল হলো না। তীব্র তূর্যকে উদ্দেশ্য করে বলে..

-তুই এখন যা, আমি পরে তোকে ডেকে নিবো, এই কয়দিন অফিসের দিকটা দেখাশোনা কর ঠিকভাবে।

তীব্রের এমন কথায় তূর্য সন্দেহ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, নিজের মনের ভিতর যেন একরাশ প্রশ্ন জমে আছে যা একটার সাথে অন্যটি পেচিয়ে যাচ্ছে কোনোভাবে ভেবেই তার সমাধান করতে সক্ষম হচ্ছে না তূর্য।

-এতো ভাবা ছেড়ে যা এখন (তীব্র)
-আচ্ছা (তূর্য)

এই বলে তূর্য উঠে চলে যেতে নিয়েও দরজার কাছে গিয়ে থেমে যায় আর তৃপ্তি কে উদ্দেশ্য করে বলে..

-ভাবী, দাভাইয়ের ভালো করে খেয়াল রেখো আমি আসছি।

বলেই তৃপ্তিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তূর্য সেখান থেকে চলে যায়। কি হচ্ছে সব যেন তৃপ্তির মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না, তৃপ্তিকে অন্যমনস্ক হয়ে থাকতে দেখে তীব্র তৃপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে..

-এতো চিন্তার জগতে ডুবে না থেকে আমাকে খাওয়ায় দাও ক্ষুধা লেগেছে।

তৃপ্তি আর তীব্রের সাথে কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শেষ করিয়ে ঔষধ খাইয়ে দেয়।

কয়েকদিন পর…….

#চলবে……..