অপরিচিত প্রিয়জন পর্ব-২২+২৩

0
321

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_২২
#এম_এ_নিশী

আয়নার সামনে বসা ফিরোজা রং এর শাড়ি পরিহিতা এক রমনীর রূপসৌন্দর্য্য যেন উপচে পড়ছে। লাজুক দৃষ্টিতে বারবার আয়নায় নিজেকে দেখছে পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে লজ্জামাখা হাসিতে নুইয়ে পড়ছে। পাশে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য অবলোকন করতে করতে মিষ্টি একসময় বলেই বসলো,

–তোর শ্বাশুড়িরা এসেছে তাও এতো লজ্জা, বর আসলে তো খাটের তলাতেই ঢুকে যাবি মনে হচ্ছে।

মিষ্টির কথা শুনে ধুম করে হাসি বন্ধ করে দেয় রূপসী। ফিরে তাকিয়ে বলে,

–তোর হিংসা হচ্ছে?

–হাহ! বয়েই গেছে আমার হিংসা করতে। আচ্ছা বলতো, ওই খারুস লোকটাকে তুই পটালি কি করে?

–পটাইনিরে পাগলা। সে তো নিজে নিজেই পটে গেছে।

–রিয়েলি! আনবিলিভেবল!

ধুপধাপ পা ফেলে সখিনা বেগমের আগমন। এসেই সে রূপসীর দিকে তাকিয়ে নিজের একটা বিনুনি ঝটকা মেরে পেছনে ফেলে দেন। কোমড়ে এক হাত রেখে আরেকহাতে অপর বিনুনি ধরে নাচাতে নাচাতে রূপসীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

–আফা, আপনেরে কলিং।

রূপসী চোখ মুখ কুঁচকে সখিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে থাকে। বোঝার চেষ্টা করে সখিনা বেগম কি বলতে চাইছেন। রূপসীর মুখভঙ্গিমা দেখে সখিনা বেগম বুঝতে পারেন সে কিছুই বোঝেনি। তাই মুখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে তুলে পুনরায় বলেন,

–ওফফ! আপনে লেহাপড়া জানা শিকখিত মাইয়্যা হইয়াও ইংগিরিজি বুজেন না। আমি কইলাম মানে বললাম আপনেরে ডাকতাছে।

রূপসী সব বুঝে ফেলার মতো ভাব নিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে,

–ওওও, আচ্ছা। কি করবো বলো সখিনা বুবু, তোমার মতো এতো জ্ঞান কি আমার আছে? পড়ালেখা করলে কি হবে, তোমার মতো বিজ্ঞ হতে পারলাম কই?

সখিনা বেগম তার ভাবের মুডে চলে যান। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে গর্বভরে বলেন,

–কোনো সমস্যা নাই আফা। আপনেরে আমি টিরেনিং (ট্রেনিং) দিমুনে। আমি মেলা ইংগিরিজি জানি। আপনেরে সব শিখাইয়া দিমু।

ফট করে মিষ্টি বলে উঠে,

–না না, থাক, থাক। তোমার ইংরেজি শিখতে গেলে ইংরেজি সাহিত্যকে ফাঁসিকাঠে চড়িয়ে দিতে হবে।

–আপনে আমারে এইভাবে ইনশাল্ট করলেন মিষ্টি আফা। এইডা কিন্তু ঠিক না। আমি সখিনা বেগম, আমার জ্ঞিয়ানের লেবেল জানেন না আপনে। আমি ইংগিরিজি কইলে আমেরিকার মাইনষে আমারে সালাম ঠুকবো।

মিষ্টি বিরবির করে বলতে থাকে,

–তা আর বলতে। সালাম ঠুকার পর বেহুঁশ না হলেই হয়।

–কিছু কইলেন আফা?

–না বলছিলাম যে, আমি তোমাকে একদম ইনশাল্ট মানে ইনসাল্ট করিনি সখিনা বুবু। মানে আমি বলতে চাইছি যে তোমার উন্নতমানের ইংরেজি শেখার মতো যোগ্যতা আমাদের মতো ছোটোখাটো মানুষদের হবে কি না, হে হে হে!

মিষ্টি কথাটা প্রশংসা করে বললো নাকি খোঁচা মেরে বুঝতে পারেন না সখিনা বেগম। কপাল কুঁচকে ভাবতে থাকেন। তখনই মারিয়ার ডাক আসাতে তিনি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বেরিয়ে যান। সখিনা বেগম চলে যেতেই রূপসী আর মিষ্টি চাপা হাসিতে ফেটে পড়ে।

সোফার ওপর আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে রূপসী। সামনে আফিয়া আর সুমাইয়া। এমন নয় যে সে তার দুই শ্বাশুড়ির মুখোমুখি এই প্রথম। তবে এতোদিনকার সাক্ষাৎ আর আজকের সাক্ষাৎ এর মধ্যে বিস্তর ফারাক বটে। আফিয়া আর সুমাইয়া রূপসীর এমন অবস্থা দেখে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। ঠোঁট টিপে হাসছে দুজনেই। আফিয়া বলে উঠে,

–ইশ মেয়ের লজ্জা দেখেছো? যে মেয়ে দেখামাত্র গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকে সেই মেয়ে আজ ১০০ হাত দূরে মাথা নিচু করে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। ভাবা যায়?

সুমাইয়া হাসতে হাসতে উত্তর দেয়,

–ঠিকই বলেছো ভাবি। মেয়ে আমাদের পর করে দিলো বোধহয়। শ্বাশুড়ি হওয়া মাত্রই যদি এতো পর করে দেয় তাহলে বাড়িতে এলে তো আর ফিরেও তাকাবে না।

এই কথা শুনে রূপসী ঝট করে ফিরে তাকায়। করুণ মুখে টলমলে চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। আফিয়া হেসে বলে,

–আয় মা, কাছে আয়।

রূপসী লাফিয়ে উঠে আফিয়ার পাশে গিয়ে বসে পড়ে। আফিয়ার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে কান্নামাখা কন্ঠে বলতে থাকে,

–কক্ষনো এভাবে বলবে না বুঝলে। তোমরা আমার কত্তো আপন। আমার কষ্ট হয় এমন কথা শুনলে।

রূপসীর কথা শুনে পাশ থেকে সুমাইয়া রূপসীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

–পাগলি মেয়ে একটা। তুইও যে আমাদের কত্তো আপন, জানিস না?

আফিয়ার কান্না পায় ভিষন৷ রূপসীকে দুহাতে আগলে নিয়ে ভাবতে থাকে মেয়েটার সাথে কি অন্যায়টাই না করতে যাচ্ছিলেন তিনি। সেটা ভেবে নিজের কাছে নিজেকেই ছোটো লাগছে তার। তিনি রূপসীর মাথা তুলে থুতনি ধরে বলেন,

–আমার মেয়েটাকে এবার পাকাপাকিভাবে আমার কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করি।

রূপসী প্রতুত্তরে মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দেয়। সুমাইয়া একটা গয়নার বাক্স এগিয়ে দেয়। সেখান থেকে দুটো চুড়ি বের করে রূপসীর হাতে পড়িয়ে দেন আফিয়া।

–চুড়ি দুটো ইফাদের বউ এর জন্যই বানানো। তবে ছেলের টালবাহানা দেখে ভেবেছিলাম এ চুড়ি আর কারো কপালে জুটবে না বোধহয়। কিন্তু আমার এই পাগলি মেয়েটা কিভাবে আমার ছেলের মতি ফিরিয়ে দিলো কে জানে।

রূপসী ভিষণ লজ্জা পেয়ে যায়। লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয় আবার। মিষ্টি তখন দুষ্টুমির সুরে বলে উঠে,

–লাজে রাঙা হলো কনেবউ গো
মালাবদল হবে এই রাতে
আজ মালাবদল হবে এই রাতে।
বড়মা তোমার খারুস ম্যাজিস্ট্রেট পুত্রকে এখুনি ডেকে আনো৷ এখানেই এখনি বিয়ে করিয়ে দেই। কি বলো?

মারিয়া ধমকে বলে উঠে,

–চুপ থাক। বেশি পাকনামি করিস না।

আফিয়া, সুমাইয়া দুজনেই হাসতে থাকে। তখনি কলিং বেলের শব্দে সকলের দৃষ্টি যায় মেইন দরজার দিকে। মিষ্টি গিয়ে দরজা খুলেই চোখ বড় বড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। মুখখানা তার বিশাল হা আকার ধারণ করে আছে। বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করে,

–আপনি?

সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তি বেশ বিব্রতবোধ করে। যদিও সে ভেবেছিলো এখন এখানে এভাবে আসাটা ঠিক হবে না। তবে না এসেও পারলো না। পেছন থেকে মারিয়ার কন্ঠস্বর শোনা গেলো,

–ইফাদ, তুই এখন, এখানে?

ইফাদ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বোকা বোকা হাসি দিয়ে ভাবতে থাকে কি বলা যায়। তারপরই ধুম করে বলে বসে,

–ওহহ! আপু এটা তোমার বাসা। আমি বুঝতে পারিনি। হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি।

–কিহহ! তুই একটা বিল্ডিং এ দোতলায় হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিস। তাও আবার বড় বোনের বাসায়। অথচ বলছিস বুঝতে পারিসনি। মাথায় কি বারি খেয়ে এসেছিস নাকি।

ইফাদের মুখটা চুপসে গিয়েছে। কি বিপদেই না পড়েছে সে। ভিতরে মা, ছোটো মা রয়েছে। সবাই কি ভাববে এখন। নাহ! এখন এখান থেকে কেটে পড়াই ভালো। ভাবতে ভাবতে ইফাদ চলে যাচ্ছিলো পেছন থেকে মারিয়া ডেকে বলে,

–ভাই চলে যাচ্ছিস কেন? ভিতরে আয়।

–না আপু কাজ আছে পরে আসবো।

ইফাদ ছুটে চলে যায়। এদিকে ভিতরে সবার মধ্যে অট্টহাসির রোল পড়ে যায়। আর রূপসী লজ্জা আর রাগের সংমিশ্রণ নিয়ে মনে মনে তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে ঝাড়তে থাকে।

আফিয়া, সুমাইয়া চলে যাওয়ার পরপরই রূপসীর ফোনে ম্যাসেজ আসে ইফাদের, “বাইরে এসো।”
রূপসী মারিয়াকে বলে বেরিয়ে এলো। ইফাদকে দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে ধোলাই শুরু করে,

–আপনার কি আক্কেল জ্ঞান বলতে কিছু নেই। বলা নেই কওয়া নেই ওরকম সময়ে হাজির হয়ে গেলেন। সবাই তো আপনাকে বউ পাগলা ভাববে।

–ভুল তো ভাববে না। আমি তো সত্যি বউ পাগলা।

–আমার ভিষণ মাথা গরম হচ্ছে। আপনি এমন করেন কেন বলেন তো?

রূপসীর কথা শুনে ইফাদ কাছে এগিয়ে আসে। রূপসীর মুখভঙ্গিমা পাল্টে যায়। রাগ সরে গিয়ে ভীতি দেখা দেয় তার মুখে। পিছিয়ে যাওয়ার আগেই ইফাদ রূপসীর কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে আনে। ইফাদের স্পর্শে রূপসী কেঁপে ওঠে। বিরবির করে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না। ইফাদ কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠে,

–করো না বউ আরো বেশি মাথা গরম করো। আমি আছি তে ঠান্ডা করার জন্য।

–কি করছেন কি? এটা রাস্তা। ছাড়েন না প্লিজ।

ইফাদ ছেড়ে দেয়। মৃদু হেসে বলে,

–এইতো মাথা ঠান্ডা হয়ে গেছে। এখন স্বাভাবিক।

রূপসী জবাব দেয় না। দৃষ্টি অন্যদিকে। ইফাদ পুনরায় বলে উঠে,

–চলো।

–কোথায়?

–তোমাকে আজ একটা বিশেষ জায়গায় নিয়ে যাবো। তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটা দিবো আজকে।

–কি উপহার?

–সারপ্রাইজ! চলো উঠে পড়ো গাড়িতে।

রূপসীকে নিয়ে ইফাদ একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। সেমিপাকা বাড়ি। উপরে টিনের ছাউনি। বাইরে টিনের দরজা দেওয়া। দরজায় দুবার টোকা দিতেই ভেতর থেকে কেউ একজন দরজা খুলে দেয়। রূপসী আশপাশ দেখতে ব্যস্ত ছিলো। ইফাদ তাকে এখানে কেন এনেছে বুঝতে পারছে না। বেখেয়ালে সামনে তাকিয়ে দরজা খুলে দেওয়া ব্যক্তিটির ওপর চোখ পড়তেই থমকে যায় সে। কিছু মুহুর্তের জন্য যেন তার দুনিয়া, তার চারপাশ সবকিছু থমকে আছে। বুকে যেন ব্যথা অনুভুত হচ্ছে তার। চোখ উপচে পড়া অশ্রুফোটা গুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে গেছে সেই কখন। রূপসী একহাত সামনে বাড়িয়ে বহুকষ্টে উচ্চারণ করে একটাই শব্দ,

–আ..ম..আম্মা!

চলবে….

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_২৩
#এম_এ_নিশী

দু দুটো বছর পর চোখের সামনে নিজের মাকে দেখছে রূপসী। বিস্ময়ে হতবাক, অতি আনন্দে নির্বাক হয়ে রয়েছে যেন। চাইলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না তার। তবে চোখ দুটো দিয়ে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। মরিয়ম বিবি রূপসীকে দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। “আমার আম্মাজান” বলেই ছুটে এসে জাপটে ধরে রূপসীকে। এতোদিন পর সেই মমতাময়ী স্পর্শ, মায়ের ঘ্রাণ পেয়ে রূপসীও ডুকরে উঠে। মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সশব্দে কেঁদে দেয়। মায়ের চিৎকার শুনে মৌটুসীও বাইরে বেরিয়ে আসে। রূপসীকে দেখে “বুবু” বলে ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়ে। তিন মা মেয়ের এই কান্না মুখরিত দৃশ্য দেখে ইফাদের ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। কারণ সে জানে এই কান্না কষ্টের নয়, হারিয়ে ফেলা আপনজনদের ফিরে পাওয়ার আনন্দে কান্না।

ঘরের ভাঙা চৌকিটার ওপর ইফাদকে বসতে দেওয়া হয়েছে। ইফাদের কোনো অসুবিধা না হলেও মরিয়ম বিবি বেশ বিব্রত বোধ করছেন। মেয়ে জামাইকে বসতে দেওয়ার মতো একটা ভালো জায়গাও নেই। ইফাদ মরিয়ম বিবির অস্বস্তি বুঝতে পেরে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,

–আমার কিন্তু বেশ ভালোই লাগছে নিজের শ্বশুর বাড়িতে এসে। যেমন আরাম পাচ্ছি তেমন মজাও পাচ্ছি।

মরিয়ম বিবি বুঝতে পারেন ইফাদ তার অস্বস্তি দূর করতেই এমন কথা বলেছে। তাই তিনিও সৌজন্যমূলক হাসি দেন ইফাদের কথার প্রতুত্তরে। রূপসী এদিক ওদিক ঘুরে এসে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

–আম্মা, আব্বা কই?

রূপসীর প্রশ্নে মুহূর্তেই সকলের হাসি মিলিয়ে গেলো। মরিয়ম বিবির চোখ উপচে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। মৌটুসী মায়ের কাঁধে হাত রেখে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে তবে তার চোখেও অশ্রু টলমল। রূপসী এর কারণ বুঝতে পারে না। তাই পুনরায় জানতে চায়,

–কও না ক্যান আম্মা। আব্বা কইই?

ইফাদ উঠে দাঁড়ায়। রূপসীকে বলে,

–চলো তো একটু বাইরে যাই।

–বাইরে কেন যাব? আগে আব্বার সাথে দেখা করি?

–আহহা! রূপসী চলো তো।

এই বলে ইফাদ রূপসীকে ঠেলে ঠেলে বাইরে নিয়ে গেলো। বাইরে এসে রূপসী জিজ্ঞেস করে,

–কি হলো? আপনি আমাকে এভাবে বাইরে কেন নিয়ে এলেন? আব্বার সাথে দেখা করতে দিচ্ছেন না কেন আমায়?

ইফাদ রূপসীর দুকাধে হাত রেখে মুখোমুখি দাঁড় করায়। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে রূপসীর চোখে চোখ রেখে বলে,

–বি স্ট্রং রূপসী!

কথাটা রূপসীর বোধগম্য না হওয়ায় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। ইফাদ একটু থেমে বলে,

–তোমার বাবা আর বেঁচে নেই।

রূপসী ছিটকে দু পা পিছিয়ে যায়। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ইফাদের দিকে। ইফাদ আবার বলে উঠে,

–ছয় মাস আগে তোমার বাবা অসুস্থ হয়ে মারা যান। তারপর থেকে তোমার মা গার্মেন্টসে কাজ করতেন আর মৌটুসী দু একটা টিউশন করে নিজেদের দিন পার করছিলো। একটা কেসের ব্যপারে তদন্ত করতে এসে আমি একটু সমস্যায় পড়ি। তখন তোমার মা আমাকে সাহায্য করেন। আশ্রয় দেন। কথায় কথায় উনার কাছে আমি তোমার কথা জানতে পারি। যখন উনি তোমার নাম আর হারিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দিলেন বুঝে গেলাম ইনিই তোমার মা। আমিও তাকে সবটা খুলে বললাম। তারপর তোমাকে নিয়ে এলাম এখানে।

রূপসী হু হু করে কেঁদে উঠে। ইফাদ রূপসীকে বুকে আগলে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

–শান্ত হও, প্লিজ। সামলাও নিজেকে।

রূপসী ফুঁপিয়ে বলে যাচ্ছে,

–আব্বাকে শেষবারের মতোও দেখতে পেলাম না আমি, ম্যাজিস্ট্রেট স্যার।

ইফাদের চোখেও জল চলে এলো। তবে সে তা আড়াল করে নিজেকে সামলে নিলো। রূপসীকে শান্ত করে বলে,

–এখন থেকে মা আর বোন আমাদের সাথেই থাকবে। সব ঠিক হয়ে যাবে তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি আছি তো।

ইফাদ রূপসীকে খেতে বসিয়ে দিয়েছেন মরিয়ম বিবি। খাবারের আইটেম দেখে রূপসীর মন কিছুটা ভালো হলো। রূপসীর পছন্দের গরম ভাত সঙ্গে গরুর মাংসের ভুনা। রূপসী বলে ওঠে,

–আম্মা,আমার পছন্দের তরকারি রানছো তুমি?

–হ রে মা। সেদিন তো তোর লাইগা রাইন্ধা রাখছিলাম। কিন্তু তুই আর আইলি না তোরে খাওয়াইতেও পারলাম না। তোর আব্বা তো..

ইফাদ বুঝতে পারে পরিবেশ আবার বিষাদের দিকে এগোচ্ছে। তাই সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে লাফিয়ে উঠে বলে,

–কই আম্মা আমাকেও দেন। আমিও খাই আমার বউ এর পছন্দের তরকারি।

ইফাদের কথা শুনে রূপসী লজ্জা পেয়ে যায়। কিছু না বলে চুপচাপ খেতে থাকে। এদিকে বউ আর শ্বাশুড়িকে খুশি করতে ইফাদ নিজের বারোটা বাজিয়ে দিলো। গরুর মাংসে তার অ্যালার্জি। খাওয়াদাওয়া শেষে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার শরীরে র্যাশ বেরিয়ে যায়। অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় মরিয়ম বিবি অস্থির হয়ে পড়েন। মৌটুসীকে দিয়ে কাছের ফার্মেসি থেকে ইফাদের বলা ওষুধ এনে দেয়। সেটা খেয়ে কিছুটা সুস্থবোধ করে সে। রূপসী রাগ নিয়ে তেজী কন্ঠে প্রশ্ন করে,

–আপনার গরুর মাংসে অ্যালার্জি তা আমাকে বলেননি কেন? আর অ্যালার্জি হওয়া সত্ত্বেও খেলেনই বা কেন?

–কারণ বউ এর পছন্দ বলে কথা।

মুহুর্তেই রূপসীর চোখমুখ থেকে রাগ উধাও হয়ে যায়। তবে তাতে দেখা দেয় বিষন্নতা। সে ইফাদের কাছ ঘেঁষে বসে বলে,

–এতোটা ভালোবাসবেন না ম্যাজিস্ট্রেট স্যার যা শেষ পর্যন্ত আমাকেই কষ্ট দিবে।

–তুমিও পাল্টা ভালোবাসা দ্বিগুন করে দিও। শোধবোধ হয়ে যাবে।

রূপসী মেকি রাগ দেখিয়ে তাকায় ইফাদের দিকে।ইফাদ খিক খিক করে হাসতে থাকে।

বাড়িতে ফেরার পথে সন্ধ্যা নেমে এলো চারদিকে। রূপসী কেমন যেন মনমরা হয়ে গিয়েছে। হয়তো বাবা নেই ব্যপারটা এখনো সহজভাবে নিতে পারছে না। হঠাৎ গাড়ি থেমে যাওয়ায় রূপসী ফিরে তাকায়। ইফাদ গাড়ি থেকে নামতে নামতে রূপসীর উদ্দেশ্যে বলে,

–নেমে এসো।

রূপসী নেমে দেখতে পায় তারা একটা বই মেলার সামনে দাঁড়িয়ে। রূপসী জিজ্ঞেস করে,

–এখানে কেন?

–তুমি তো বই পড়তে পছন্দ করো। মেলায় চলো। ইচ্ছেমতো বই কিনো। যা যা তোমার পছন্দ।

মুহুর্তেই রূপসীর মন ভালো হয়ে যায়। সে খুশি হয়ে বলে,

–সত্যি। আমি আমার পছন্দ মতো বই নিতে পারবো।

–হুম অবশ্যই পারবে।

–চলুন তাহলে।

–চলো চলো।

রূপসী এক স্টল থেকে আরেক স্টল ঘুরে ঘুরে বই দেখছে। যেটা যেটা ভালো লাগছে কিনছে। এভাবে বেশ অনেকটা সময় ঘুরে ঘুরে বই কেনা শেষে রূপসী ইফাদের সাথে বেরিয়ে আসে। হাঁটতে হাঁটতে বলে,

–বইগুলো কিনে মনটা ফ্রেশ লাগছে।

–এবার আরো ফ্রেশ হয়ে যাবে। ওয়েট।

–কোথায় যাচ্ছেন?

–আসছি।

ইফাদ কোথাও একটা চলে গেলো। একটুপরই ফিরে এসে রূপসীকে বললো,

–এই যে ম্যাডাম আপনার আরো একটি পছন্দের জিনিস। আপনার প্রিয় টুকটুকি ফুল।

রূপসী অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,

–আপনার মনে আছে?

–ভুলে যাওয়ারই বা কি ছিলো?

রূপসী হেসে হাওয়ায় মিঠাইটি হাতে নিয়ে খেতে শুরু করে।

ইফাদ রূপসীকে আরেক জায়গায় নিয়ে গিয়ে গাড়ি থামায়। রূপসী ভাবছে কিছুক্ষণ পর পর তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যার তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে রূপসী দেখতে পায় এটা সেই ফ্লাইওভার। যেখানে প্রথমবার তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের সাথে রাতের শহর দেখেছে সে। সেই একই জায়গায় এসে দাঁড়ায় দুজনে। রূপসী সেই প্রথম দিনের মতোই মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে রাতের শহরের সৌন্দর্য। একটুপর ইফাদের ডাকে সে চমকে ফিরে তাকায়। ইফাদ তার পাশে নেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে সে দেখতে পাই ইফাদ সেই রোড ডিভাইডারের ওপর একই ভঙ্গিতে হেলেদুলে হাঁটছে যেমনটা সেদিন রূপসী করেছিলো। রূপসী আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ইফাদের এ কি কর্মকান্ড! তার মতো একজন ম্যাজিস্ট্রেট এমন বাচ্চামি কান্ড করছে দেখেই রূপসীর হাসি পেয়ে যায়। সে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। রূপসীর হাসি শুনে ইফাদ নেমে আসে। রূপসীর পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে তার প্রাণখোলা হাসি। রূপসী বহু কষ্টে হাসি থামাতেই ইফাদ বলে উঠে,

–কালই আমরা বিয়ে করব।

রূপসী বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,

–কিইইই? কালই?

–হ্যা। আমি আর দেরি করতে চাইনা। বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হোক। সকালে গিয়ে আমি আম্মা আর মৌটুসীকে নিয়ে আসবো আমাদের বাড়িতে। মারিয়া আপুদের সাথে তুমিও চলে আসবে। বিয়েটা আমাদের বাড়িতেই হবে। সন্ধ্যার পরপরই। ব্যস! আর নো ঝামেলা।

–কিন্তু এভাবে..

ইফাদ রূপসীর এক হাত ধরে কাছে টেনে এনে বলে,

–আমার বা আমাদের শত্রুর অভাব নেই রূপসী। তোমাকে হারাতে চাইনা। যতদ্রুত সম্ভব পাকাপাকি ও পরিপূর্ণ ভাবে তোমাকে আমার করে ফেলতে চাই।

ইফাদের ঘোরলাগা দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে রূপসী মিষ্টি হেসে উত্তর দেয়,

–তবে তাই হোক। আমিও আমার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে আমার করে পাই, জলদিইইই!

পরদিন সকাল থেকেই খন্দকার বাড়িতে উৎসবের আমেজ শুরু হয়। রূপসীকে সাজানোর জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা মিষ্টির প্রয়াস চলছে। রূপসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও মিষ্টির চাপাচাপিতে সে কিছুই করে উঠতে পারছে না। অন্যদিকে মৌটুসীও যোগ দিয়েছে মিষ্টির সাথে। এদের জ্বালায় রূপসী পাগলপ্রায়। সবার মধ্যেই আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এই আনন্দেই ভাটা পড়তে কিনা সন্ধ্যার একটু আগেই বাড়িতে হাজির হয় পুলিশসহ তদন্ত কমিটির কয়েকজন সদস্য। সরাসরি ইফাদের উদ্দেশ্যে ছোঁড়া প্রধান কর্মকর্তার কথাটি রূপসীর ধরা দেওয়া সুখখানা ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো যেন। কথাটি ছিলো,

–মি. খন্দকার ইফাদ আহমেদ, আপনাকে থানায় যেতে হবে। আপনার ওপর বাল্যবিবাহের মতো দণ্ডনীয় অপরাধের অভিযোগ আছে যা আজ থেকে দুইবছর আগে ঘটিয়ে আপনি গোপন রেখেছিলেন। সেই সাথে আপনাকে ম্যাজিস্ট্রেট পদ থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে।

সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া অবস্থা হলেও দূরে দাঁড়িয়ে তখন ইফাদের চাচা খন্দকার ইদরীস আহমেদ ক্রুর হাসি হাসছেন।

চলবে……