অপরিচিত প্রিয়জন পর্ব-১৮+১৯

0
346

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_১৮
#এম_এ_নিশী

আছে আমার হৃদয় আছে ভরে,
এখন তুমি যা খুশি তাই করো।
এমনি যদি বিরাজ’ অন্তরে
বাহির হতে সকলই মোর হরো।
সব পিপাসার যেথায় অবসান
সেথায় যদি পূর্ণ করো প্রাণ,
তাহার পরে মরুপথের মাঝে
উঠে রৌদ্র উঠুক খরতর।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কবিতাখানা আওড়াতে আওড়াতে ধীর পায়ে হেলেদুলে হাঁটছে ইফাদ। তার সামনে সামনে লাজুকলতা রূপে হেঁটে চলেছে রূপসী। তখন ইফাদের ওমন আচরণে হতবিহ্বল দিশেহারা হয়ে রূপসী ছুট লাগিয়েছে। আর কিছু মুহূর্তও যেন সেখানে স্থির থাকা চলছিলো না। তার পিছু পিছু ইফাদও এসেছে। কবিতা শুনিয়ে যাচ্ছে তাকে। মাঝে মাঝে হুট করে করে রূপসীর ওড়না টেনে ধরছে। রূপসী ঘাড় ঘুরিয়ে মেকি রাগ দেখালেও ইফাদের মধ্যে বিন্দু পরিমাণ হেলদোল নেই। সে তার মতোই দুষ্টুমি করে যাচ্ছে। কিছুদূর যেতেই ইফাদ থেমে যায়। রূপসী বুঝতে পেরে পেছনে ফিরে তাকিয়ে বলে,

–কি হলো?

–এদিকে এসো তো আমার সাথে।

রূপসী ইফাদের সাথে সাথে এগোতে থাকে। একটা ছোট্ট খুপরি ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় দুজনে। আশেপাশে দু একটা বাড়ি চোখে পড়লেও মনে হচ্ছে তাতে মানুষজনের বসতি নেই। ইফাদ ভিতরে একবার ঢুঁ মেরে দেখে এসে বলে,

–মনে হচ্ছে আজ রাতটা এখানে থেকেই পার করা যাবে।

–এখানে থাকবো?

–হ্যা, কেন? কোনো সমস্যা?

–না মানে, কেমন ভুতুড়ে ভুতুড়ে না?

–তুমি এখনো ভুতে ভয় পাও?

–ভুতেদের ভয় সারাজীবন ই থাকে।

–গাড়ি নিয়ে একা বেরিয়ে যাচ্ছে এতো সাহসী মেয়ে ভুতে ভয় পায়। ব্যপারটা কি হাস্যকর না!

–কানের কাছে এসে যখন সুরসুরি দিবে তখন বুঝবেন।

–আচ্ছা দেখা যাবে। এখন চলো ভেতরে চলো।

রূপসী ভিতরে ঢুকে দেখে চারপাশে বেড়া দেওয়া হলেও মেঝেটা মাটির। বেশ কিছুটা খড়ের গাদা পড়ে আছে এদিক ওদিক। জানালা বলতে কিছু নেই। শুধুমাত্র একজন মানুষ ঢোকার মতো ছোট্ট একটা বাঁশের দরজা রয়েছে। ইফাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

–আপনি এখানে এভাবে থাকতে পারবেন?

–না পারার কি আছে?

–আপনার তো অভ্যেস নেই, তাই বলছিলাম।

–ব্যপার না, আমি ম্যানেজ করে নেব।

রূপসী গিয়ে খড়ের গাদা গুলো একসাথে করে মোটামুটি বসার একটা জায়গা করলো। ইফাদকে ইশারায় বসতে বলে। ইফাদ মুচকি হেসে বসে পড়ে। তারপর রূপসীকেও টেনে বসিয়ে দেয়। রূপসী একদম ইফাদের গা ঘেঁষে বসে আছে। তার ভিষণ লজ্জা লাগছে। তবুও ইফাদ বসিয়ে দিয়েছে। নড়াচড়া করারও উপায় নেই। বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই নীরব থেকে ইফাদই বলে উঠে,

–জানো রূপসী, যেদিন তোমাদের ওই নারী পাচারকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করলাম সেদিন ওই চক্রের মাথাকে প্রায় ধরেই ফেলেছিলাম। কিন্তু পেছন থেকে অ্যাটাক আসায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। মাথায় আঘাত করেছিলো। একজন ভদ্রলোক দেখে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাই হয়তো বেঁচে গেছি।

ইফাদের কথা শুনে রূপসী করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। সেদিন তো তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে সে ই বাঁচিয়েছিলো। কিন্তু উনি তা জানেন না। এটা ভেবেই রূপসীর মন খারাপ হয়ে যায়। চুপ করে বসে থাকে। ইফাদ আড়চোখে তাকায়। মৃদু হেসে আবার বলে,

–সেদিন আবছা আবছা ভাবে একটা মিষ্টি মায়াবী মুখ দেখেছিলাম। ভিষণ ভালো লেগে গেছিলো দেখেই। তবে জ্ঞান ফেরার পর ভাবলাম হয়তো ঘোরে ভুলভাল দেখেছি। পরবর্তীতে একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে দেখা। তাকে দেখেই মনে হয়েছিলো বোধহয় কোথাও দেখেছি। কিন্তু মনে করতে পারিনি। সেই বাচ্চা মেয়েটার কত কত পাগলামি সহ্য করেছি। কত যে জ্বালিয়েছে, হিসেব নেই। বিরক্ত হয়েছি ভিষণ। তবে যখন তাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম তখন ভিষণভাবে অনুভব করলাম তাকে, তার বাচ্চামি, পাগলামিগুলোকে মিস করতে শুরু করেছি। ফিরে গেলাম আবার তার কাছে। তারপর পরিস্থিতির কারণে বলো বা মনের সংগোপনে লুকিয়ে থাকা কিছু একটার টানেই বলো তাকে আমি সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে আমার করে নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। যদিও তাকে একলা করে দিয়ে চলে গিয়েছিলাম। তারপর….

–তারপর? তারপর কি? থেমে গেলেন কেন?

–তারপর আর কিছু নেই। শেষ।

–ওমা এমনভাবে শেষ হতেই পারেনা। আরো কিছু আছে।

–তুমি নিজের মতো একটা বানিয়ে নাও।

রূপসীর রাগ হয়। বলা ভালো অভিমানে মুখ ফুলে যায়। সে উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে গিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ শীতল স্রোত অনুভূত হয় তার। সারা শরীরে শিহরণ খেলে যায়। বুক কেঁপে ওঠে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। কারণ কাঁধে ইফাদের গরম নিঃশ্বাসের উপস্থিতি। দুহাতে তার কোমর জড়িয়ে কাঁধে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে সে। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রূপসী। নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে সে। নড়াচড়া করারও শক্তি নেই তার। ধীরে ধীরে ইফাদ মুখ তুলে। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে কানের কাছে মোহগ্রস্ত কন্ঠে বলতে থাকে,

–তাকে ছেড়ে গিয়ে যে আর আমার ভালো থাকা হয়নি। প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে তার স্মৃতি আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল। খুব ইচ্ছে করতো তার কাছে ছুটে আসতে, তাকে এক নজর দেখার জন্য ছটফট করতো মন। তবে চাইলেও সম্ভব হয়নি। সেই অসময়ে নিজের আবেগের নিয়ন্ত্রণ হারালে তাকে বড় বিপদে ফেলা হতো। তাই ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করলাম। ঠিক সময়মতো ফিরে এলাম।

একটু থেমে কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠে ইফাদ,

–ফিরে এলাম আমার “বাচ্চা বউ” এর কাছে।

অদ্ভুত আবেগ, ভালোলাগার অনুভূতিতে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে রূপসীর। তারপর ইফাদের পরবর্তী কথাটা যখন কানে লাগে,

–সেদিন আমাকে বাঁচিয়ে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া মানুষটা, সেই মায়াবী মুখের অধিকারী ছিলো। যাকে আবছা আবছা ভাবে দেখেছিলাম। ওই মায়াবিনী তো আর কেউ নয়। ছিলো আমার এই বাচ্চা বউ টা।

কথাটা শেষ করেই কানের লতিতে আলতো করে চুমো দিয়ে সরে আসে ইফাদ। রূপসীর চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করতে থাকে। কিন্তু কেন? পরম ভালোলাগা, পরম আবেশ, পরম পাওয়া….

—–

এলোমেলো ভাবে বাইক চালাচ্ছে ওয়াহাব। ফাঁকা রাস্তা। সুনসান নীরবতা চারিদিকে। তার বুকটা ভার হয়ে আছে মুনমুনের সাথে দেখা করে আসার পর থেকে। মুনমুন বারবার করে বলেছে যেন কাল সকালেই তার বাবার সাথে গিয়ে কথা বলে। এদিকে ইফাদ, রূপসীর খবরও পাওয়া গেলো না এখনো পর্যন্ত। এরমাঝে সে কিভাবে মুনমুনের বাবার সাথে কথা বলতে যাবে। সবদিকের চাপ যেন তার মাথায় উঠে বসেছে। আচমকা সামনে তাকিয়ে বাইকের ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ে ওয়াহাব। বাইক থেকে নেমে দ্রুত এগিয়ে যায়। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখতে পায় এটা তার গাড়ি। রাস্তার একপাশে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চাকা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। একটু দূরেই ইফাদের গাড়িও নজরে আসে তার। তাড়াহুড়ো করে চারিদিক দেখতে থাকে সে। দু একবার ইফাদ আর রূপসীর নাম ধরে ডাক ও ছাড়ে। তবে তারই ডাকের প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কোনো প্রতিত্তোর পেলো না সে। চারপাশ আরো একবার ভালোভাবে দেখে নিয়ে ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করে ওয়াহিদকে। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই ব্যতিগ্রস্ত হয়ে বলে উঠে,

–ভাইয়া, গাড়িগুলো পাওয়া গিয়েছে? তবে ইফাদ বা রূপসী কেউই নেই ওরা এখনো গায়েব।

ওয়াহাবের কথা শুনে তার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে পুলিশদের সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ওয়াহিদ।

—-

পূর্ণিমার চাঁদের আলো উজার করে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। নীরব পরিবেশে থেকে থেকে ঝিঁঝিঁ ডাকার আওয়াজ আসছে। খুপরি ঘরটিতে বেড়ার দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে ইফাদ। এক হাতে রূপসীকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। রূপসী যেন পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের বুকে। শান্ত পরিবেশে খচখচ শব্দ কানে আসতেই ইফাদের চোখ খুলে যায়। তটস্থ হয়ে যায় সে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করে কিসের আওয়াজ। একবার রূপসীর দিকে তাকিয়ে দেখে সে তখনো গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। মেয়েটাকে জাগাতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। এদিকে আওয়াজ তীব্র হচ্ছে। আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নেয়। রূপসীর কাছ থেকে বাঁধন আলগা করে তাকে ধীরে ধীরে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে শুইয়ে দেয় ইফাদ। তারপর অতি সন্তর্পণে দরজার কাছে এসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর বুলাতে থাকে। ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে। নাহ! কাওকে দেখা যাচ্ছে না। তীব্র এক আওয়াজ কানে আসতেই ঝট করে পেছনে ফেরে ইফাদ। রূপসীর খুব কাছেই কেউ একজন ধারালো ছুরি বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ভাগ্যক্রমে রূপসীর পাশ ঘেঁষে যাওয়ায় ওর গায়ে লাগেনি। আরো একবার ছুরির আঘত আসতে দেখে ইফাদ ছুটে এসে এক ঝটকায় রূপসীকে সরিয়ে এনে বুকে আগলে নেয়। তবে ছুরির আঘাত থেকে বাঁচতে পারে না ইফাদ। তার হাতের বাহুতে লেগে মুহূর্তে রক্তাক্ত হয়ে যায় সে।

চলবে……

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_১৯
#এম_এ_নিশী

ঘুমের মধ্যে হেঁচকা টান অনুভব হতেই ধরপড়িয়ে ওঠে রূপসী। নিজেকে ইফাদের শক্ত বাঁধনের মধ্যে আবিষ্কার করে। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে ইফাদ চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে যেন খুব আঘাত পেয়েছে। রূপসীর এক হাত ইফাদের বাহুর ওপর যেতেই ভেজা অনুভূত হয় সে চকিতে ফিরে দেখে রক্ত। ছ্যাঁত করে ওঠে বুকটা। গোঙিয়ে উঠে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,

–র..র..রক্ত! রক্ত কেন?

ইফাদ রূপসীর মাথা বুকে চেপে ধরে বলে,

–হিশশ! কিচ্ছু হয়নি আমার। ঠিক আছি আমি একদম। শান্ত হও!

রূপসী ফুঁপিয়ে উঠে। তখনই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে ৪ জন কালো মুখোশধারী লোক। প্রত্যেকের হাতেই ধারালো অস্ত্র। ইফাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। রূপসী ভয়ে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ইফাদকে। ইফাদ ভরসার হাত বুলিয়ে দেয় রূপসীর মাথায়। সেই সাথে বলে উঠে,

–ভয় পেও না, একদম ভয় পেও না। কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো। আমি থাকতে তোমার কিচ্ছু হতে দেব না।

৩ জন লোকই এগিয়ে আসতে থাকে। তাদের মধ্যে একজন সামনে আসতেই ইফাদ তার পা বরাবর সজোরে লাথি মেরে বসে। লোকটি ছিটকে পড়ে যায়। ইফাদ রূপসীকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রূপসীকে পেছনে আড়াল করে দিয়ে হাতের কাছে থাকা লম্বা বাঁশটা তুলে নেয়। অতঃপর কাওকে ধাতস্থ হওয়ার সুযোগ না দিয়েই এলোপাতাড়ি ভাবে মেরে চললো চারজনকে। মার্শাল আর্টে পারদর্শী ইফাদের তীব্র বেগে চলা লাঠির আঘাতের সাথে পেরে উঠছে না ৩ জনের কেউই। তিনজনেই যখন ঘায়েল তখনই পেছন থেকে আরো ২ জন এসে শক্ত করে চেপে ধরে ইফাদকে। এরা আড়ালে থাকায় ইফাদ বুঝতেই পারেনি মোক্ষম সময়ে আঘাত আসতে পারে তার ওপর। সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরো একজন। ইফাদকে শক্ত করে ধরে রাখা লোক দুটোর একজন সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিকে কঠোর স্বরে আদেশ করে,

–ওই যা, মাইয়্যাটারে লইয়্যা আন।

ইফাদ চেঁচিয়ে বলে উঠে,

–ওর গায়ে হাত দেওয়ার দুঃসাহস করবি না। ওই হাত আমি খুলে নেব।

–আগে নিজের হাত খান ছুডা তারপর বুলি ঝাড়িস।

বলেই একজন তাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে বসিয়ে দেয়। হাত পিছমোড়া করে শক্ত করে বেঁধে দেয়। ইফাদ চাইলেও ছুটতে পারছে না। শুধু চেঁচিয়ে একটা কথাই বলে যাচ্ছে,

–রূপসীকে ছুঁবি না একদম। ছুঁবি না। ছেড়ে দে। নইলে আমি ছাড়া পেলে আসলটা তো পাবি সঙ্গে সুদের ভারটা অনেক হয়ে যাবে। ছাআআআআআড়ড়!

রূপসী ঘরের এক কোণায় গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিলো। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে সে। হুট করে একটা লোক ঘরে ঢুকে যাওয়ায় রূপসী ভয়ে আরো গুটিয়ে যায়। অনবরত কেঁদে যাচ্ছে সে। এমন ভয়াবহ বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার পথ খুঁজে চলেছে। লোকটা এগিয়ে আসতে থাকে তবে রূপসী আর পিছিয়ে যেতে পারছে না। সে তো শেষমাথায় ঠেকে আছে। লোকটা এবার একদম তার কাছাকাছি চলে আসে। রূপসী তাকে ধাক্কা দিয়ে ছুটে পালাতে যায়। তবে লোকটার সামনে এগিয়ে দেওয়া পায়ের সাথে লেগে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো সে। এবার লোকটা ঝট করে তার দিকে ঘুরে মুখ চেপে ধরে। চোখে ভয়ংকর রাগের আগুন। নিজের মুখ থেকে লোকটার হাত সরানোর জন্য ধস্তাধস্তি করতে থাকে রূপসী। এই ধস্তাধস্তির ফলস্বরূপ লোকটার মুখের কাপড়টা সরে যায়। স্পষ্ট হয় তার চেহারা। সেদিকে তাকিয়েই রূপসীর চোখ বড় বড় হয়ে যায়। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে এক আঙুল উঁচিয়ে বলতে থাকে,

–আ..আ..আজমল…ভাই!

—-

চারপাশে চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছে একদল পুলিশ। উদ্দেশ্য ইফাদ এবং রূপসীকে খুঁজে বের করা। একটু দূরেই চিন্তিত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াহাব, ওয়াহিদ দুজনেই। আশপাশ নজর বুলাতে বুলাতে ওয়াহিদ বলে উঠে,

–গাড়ি এখানে এভাবে পড়ে আছে। অথচ দুজনের একজনও এখানে নেই। ব্যপারটা বুঝে আসছে না।

–কিছু একটা সমস্যা তো হয়েছেই ভাইয়া। আমার তো মনে হচ্ছে ওরা কোনো বিপদে পড়েছে। গাড়ির চাকাগুলো খেয়াল করে দেখেছো। বোঝা যাচ্ছে গুলি লাগার ফলে নষ্ট হয়েছে।

ওয়াহিদও চিন্তিত ভঙ্গিতে সেদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে,

–হুম! হয়তো তুই ঠিকই বলেছিস। তবে এখন ওদের কোথায় খুঁজবো বল তো?

ওয়াহাবও ভাবনায় পড়ে যায় ভিষণ। একসাথে দু দুটো চাপ মাথার ওপর বসে আছে তার। কিভাবে কি সামাল দেবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। তবে আপাতত খুব করে চাচ্ছে ইফাদ, রূপসী সেফ থাকুক আর খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসুক।

—–

আজমলকে দেখে রূপসী তখনও হতভম্ব হয়ে রয়েছে। বিস্ময়ের ঘোর কাটলো তার আজমলের চাপা চিৎকারে।

–খবরদার বেশি তেড়িবেড়ি করবি না। তোর অনেক চর্বি। আইজ তোর সব চর্বি ছুটামু।

বলতে বলতে আজমল তার মুখের কাপড়টা ভালোভাবে বেঁধে নিলো। তারপর রূপসীর হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে এলো। রূপসীকে ওভাবে আনা দেখে ইফাদের রক্ত টগবগ করতে শুরু করে। সে শুধু ভাবছে একবার এই বাঁধন খুলুক সবকটাকে কুকুরের মতো মারবে। কাওকে ছাড়বে না সে। কাওকে না।
আজমল রূপসীকে মাটিতে ফেলে দেয়। ইফাদের বুক যেন ঝাঁঝরা হয়ে গেলো। সে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রূপসীর দিকে। তার উপস্থিতি তার রূপসীর জন্য কোনো কাজে আসছে না ভেবে নিজেকে নিজেরই ক্ষতবিক্ষত করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
মুখোশধারীরা রূপসীর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একজন তো বলেই ফেললো,

–হইবো নাকি একবার?

বাকি সবাই সায় দিয়ে আনন্দধ্বনি করতে থাকে। ইফাদের রাগ চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলেও এবার সে আর চেঁচায় না। নিজেকে শান্ত করে নেয়। অতঃপর ঠান্ডা গলায় রূপসীকে বলে,

–রূপসী, তাকাও আমার দিকে।

রূপসী শব্দ করে কেঁদে যাচ্ছিলো। ইফাদের ডাকে তার দিকে ফিরে তাকায়। কান্নার শব্দ থেমে গেলেও অশ্রু গড়ানো বন্ধ হয়নি। ইফাদ আবার বলে উঠে,

–শোনো রূপসী, কখনো কখনো নিজের প্রয়োজনে নিজের রূপ বদলাতে হয়। নিজেকে একদম ভীতু ভাববে না। কারণ তুমি নিজেকে ভীতু ভাবলে বাকিরা তোমাকে তার দ্বিগুণ ভীতু ভাববে। তারপর তোমার ক্ষতি করে তোমাকে নিঃস্ব করে দিবে। তখন? কি করবে তুমি? আফসোস হবে না একবারো? নিজেকে বদলাতে না পারার আফসোস? আই নো ইউ আর অ্যা ভেরি স্ট্রং গার্ল রূপসী। তবে সেটা তুমি মানো না বা মানতে চাও না। তাই তো দূর্বল হয়ে বসে বসে কাঁদছো। ওয়েক আপ, রূপসী! জাগাও নিজের ভিতরের সত্তাকে। জাগাও নিজের নারী শক্তিকে। তুমি পারবে। আমি জানি তুমি পারবে। ওঠো রূপসী, ওঠোওওওও!

ইফাদের কথা শেষ হতে না হতেই তার মুখ বরাবর সজোরে আঘাত করে মুখোশধারী লোক। আঁতকে ওঠে রূপসী। ভিতরটা কষ্টে ভরে ওঠে। তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের মার খাওয়া যেন তার সহ্য হলো না। হুট করে তার ভিতর থেকে কেউ একজন বলে উঠলো, “এবার সবকিছু তোর হাতে। তুই কি করবি ভেবে দেখ। এভাবে ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে মার খেতে দেখবি? নাকি নিজে কিছু করবি?”
মুহুর্তেই চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে রূপসী। কান্না মুছে নিজেই নিজেকে জবাব দেয়, “আমার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে কিছুতেই এভাবে মার খেতে দিব না আমি, কিছুতেই না।”
ভালোবাসার মানুষের ওপর আঁচ আসলে দুর্বলচিত্তের মানুষেরাও কতোটা ভয়ানক হয়ে ওঠে, কতোটা কঠোর, কতোটা শক্তিশালী হতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে রূপসী।
পায়ের কাছে পড়ে থাকা লাঠিটা তুলে নেয়। চোখে স্ফূলিঙ্গ, মুখে দৃঢ়ভাব। হাতের লাঠিটি কয়েকবার ঘুরিয়ে নিজেকে পজিশনে দাঁড় করিয়ে নেয় রূপসী। ইফাদ মার্শাল আর্টে পারদর্শী জেনেছিলো সে তাই নিজেও শিখেছিল এই আর্ট। কিন্তু ভাবতে পারেনি যার জন্য শেখা একদিন তার জন্যই কাজে লেগে যাবে। মুখোশধারী লোকেরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। যেন রূপসীকে এই রূপে দেখে তারা ভিষণ মজা পেয়েছে। একজন তো হাসিতে ঢলতে ঢলতে রূপসীর কাছে এসে তাকে ছুঁয়ে দিতে যায়। পরপর বেশ কয়েকটা লাঠির আঘাতে আধা মরার মতো পড়ে থাকে মাটিতে। রূপসীর লাঠি চালনা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ইফাদ। বেশ দক্ষ কৌশল তার। বোঝায় যাচ্ছে সে ও খুব একটা কম যায় না এই মার্শাল আর্টে। একজনকে ঘায়েল হওয়া দেখে বাকিরা সাবধান হয়ে যায়। একটা মেয়ের কাছে হারবে তারা, কিছুতেই তা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে তারা জানেনা আজ এই রণমুর্তি ধারণকারী নারীর সাথে পেরে ওঠা তাদের পক্ষে অসম্ভব। রূপসীর প্রতিটি কৌশল ঠিকঠাক জায়গামতো গিয়ে লাগে। কেও আর পাল্টা আক্রমণের সুযোগই করে উঠতে পারে না। নিজের সমস্ত শক্তি খরচ করে ক্রমাগত ভাবে মেরে গেছে সবকটাকে রূপসী। এরপর সুযোগ বুঝে ইফাদের হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে আর এক মুহূর্ত ও অপেক্ষা করে না। ছুটতে থাকে দুজন।

একটু পর ভোরের আলো ফুটতে শুরু করে। এক চায়ের দোকান নজরে পড়তেই দোকানীর কাছ থেকে ফোনটা চেয়ে নিলো ইফাদ। যদিও একটু মিথ্যে বলা লাগলো। আসল সত্যি জানালে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় বলতে হলো তাদের গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছে আর ফোনটাও বন্ধ। দোকানী তাই বিশ্বাস করে ফোনটা দেয়। ইফাদ ফোন নিয়েই কল করে ওয়াহিদকে। জানায় তারা ফিরে আসছে। চিন্তা না করতে। এর বেশি বিস্তারিত বলে না। ফোন রেখে দেয়। দোকানীকে ফোনটা ফেরত দিয়ে রূপসীর হাত ধরে হাঁটতে থাকে। তারা এখন বড় রাস্তায় এসে পড়েছে। ক্লান্ত শ্রান্ত দেহখানা টেনে নিয়ে যাচ্ছে দুজনে। তবে শক্ত হাতে ধরে রেখেছে ইফাদ তার বাচ্চা বউটাকে। কি বিশাল কান্ডটাই না করেছে সে। কেন? নিজের জন্য? উঁহু! ভালোবাসার জন্য। ইফাদের জন্য। হুম! তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের জন্য।

চলবে…..