অপেক্ষারা পর্ব-০৩

0
494

#অপেক্ষারা
৩.
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

একে তো প্রচন্ড বাথরুমের চাপ তার ওপরে খুলে যাওয়া শাড়ির কুচি। রাগে, বিরক্তিতে গা জ্বলে যাচ্ছে নাজের। মায়ের সঙ্গে কতো ঘুরে বেরিয়েছে, কখনো তো এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি তাকে। অথচ আজ এই মানুষটার সঙ্গে বের হওয়ার পর থেকেই যত গন্ডগোল।

সায়েম রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “এতক্ষণ বাস থামানোর জন্যে আমাকে পাগল করে দিলে, আর এখন নিজেই নামতে চাইছো না। সমস্যা কী তোমার?”

“আপনি!”

“ওয়াট? আমি?”

নাজ আক্ষেপের সুরে বলল, “হ্যাঁ, আপনি। যখন থেকে আমার জীবনে এসেছেন, তখন থেকে একটার পর একটা সমস্যা লেগেই আছে।”

“শোনো আমি তোমার জীবনে যাইনি, তুমি আমার জীবনে এসেছো।”

“ওই একই কথা! আপনি জানেন আমার বান্ধবীরা আমাকে কী বলে ডাকে?”

“আমার কি জানার কথা?”

“আপনারই তো জানার কথা। কারণ আপনার বোন আমার সবথেকে কাছের বান্ধবী। যাইহোক জানেন না যেহেতু আমিই বলছি। বান্ধবীরা আমাকে গুড লাক কুইন বলে ডাকে। সৌভাগ্যের রাণী! বরাবরই আমার ভাগ্য খুব ভালো।”

“এসব কথা আমাকে বলছো কেন?”

“কারণ আপনি আমার জীবনে আসার পর থেকে আমার জীবনে সৌভাগ্যের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। আপনার জন্যেই এমনটা হলো!”

“কী আবার হয়েছে?”

নাজ রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “কিছু না!”

তারা ঢাকায় এসে পৌঁছালো ছয়টার দিকে। সূর্য ততক্ষণে ডুবে গেছে, চারিদিকে ছড়িয়ে আছে চমৎকার এক লাল আভা। আকাশটায় গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘের ছড়াছড়ি। নাজ জানালার বাইরে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। এই মুহূর্ত থেকে শুরু হলো তার দ্বিতীয় জীবন। সম্পূর্ণ অচেনা একটা মানুষের সঙ্গে সেই জীবনটা কাটাতে এসেছে এই অচেনা শহরে। একটা সময়ে হয়তো মানুষটা তার কাছে আর অচেনা থাকবে না, শহরটাও হয়ে উঠবে চিরচেনা। কিন্তু সে প্রকৃত অর্থে সুখী হতে পারবে?

যাত্রীরা একে একে নামতে শুরু করেছে। নাজ ঠিকই একই ভঙ্গিতে বসে রইল।

সায়েম মাথার ওপরের সেকশন থেকে একেক করে ব্যাগগুলো নামাতে নামাতে বলল, “নামার ইচ্ছা আছে? না-কি এখানেই থেকে যাবে?”

নাজ অসহায় গলায় বলল, “আমি নামতে পারবো না।”

সায়েম অবাক হয়ে লক্ষ করলো মেয়েটা কাঁদছে। নিঃশব্দে তার দুচোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। তার চোখে অশ্রু খুবই বেমানান। যে মেয়েটা সারাক্ষণ উৎফুল্লতায় মেতে থাকে, সে এভাবে কাঁদবে কেন?

সায়েম নাজের পাশে বসে শান্ত গলায় বলল, “তুমি কাঁদছো কেন?”

নাজ চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “আমার শাড়ির কুচিগুলো খুলে গেছে।”

সায়েম ভ্রু কুঁচকে বলল, “এই ছোট্ট একটা বিষয়ের জন্যে কাঁদতে হয়? সবাই নেমে গেলে ঠিক করে নিও।”

“ঠিক করবো কী করে? আমি তো শাড়িই পড়তে পারি না?”

সায়েম হতাশ গলায় বলল, “ওয়াও!মেয়েমানুষ হয়ে শাড়ি পড়তে পারো না?”

“শুনুন! সব মেয়েমানুষের কাছ থেকে সবকিছু আশা করবেন না।”

“বড়ো বড়ো কথা তো ঠিকই বলতে পারো!”

সায়েম পকেট থেকে ফোনটা বের করে কী যেন করছে।

নাজ বলল, “কী করছেন?”

সায়েম ধমক দিয়ে বলল, “এক সেকেন্ডের জন্যে একটু চুপ করে থাকবে প্লিজ?”

নাজ খেয়াল করলো সায়েম ইউটিউবে শাড়ি পড়ানোর টিউটোরিয়াল দেখছে। কী সাংঘাতিক! সে কি এখন নাজকে শাড়ি পড়িয়ে দেবে? ভয় এবং লজ্জামিশ্রিত এক অনুভূতি ঘিরে ধরলো তাকে। এতক্ষণে বাসের সকলে নেমে গেছে।

ভিডিওটা দেখা শেষ করে সায়েম বলল, “উঠে দাঁড়াও!”

নাজ অস্পষ্ট স্বরে বলল, “কেন?”

“আমি বলেছি তাই।”

নাজ উঠে দাঁড়াতেই সায়েম তার শাড়ির কুচিগুলো ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নাজের সারা শরীর জুড়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। লজ্জায় বন্ধ হয়ে এল তার দুচোখ। তার উন্মুক্ত কোমর বারবার আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে।

সায়েম বিরক্ত গলায় বলল, “নড়ছো কেন?”

নাজ জবাব দিলো না। পাথরে মতো জমে দাঁড়িয়ে রইলো। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সায়েম কুচিগুলো ঠিক করে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “গুজে নাও। না-কি সেটাও পারো না?”

নাজ আঁতকে উঠে বলল, “পারবো না কেন?”

কী সুন্দর করে কুচিগুলো করছে সায়েম! নাজ চিরকাল তার মাকে শাড়ি পড়তে দেখেছে, বান্ধবীদের দেখেছে। এতকাল দেখে দেখেও সে যা ছিল পারলো না, তা এই মানুষইটা কয়েক মিনিটের ভিডিও দেখেই শিখে গেল! নাহ্, বলতেই হয়! গুণ আছে লোকটার!

বাসস্টেশন থেকে বাসায় পৌঁছাতে ঘন্টাখানিক লাগলো। ঢাকার চিরচেনা যানজটে সায়েম অতিষ্ট হয়ে গেলেও, নাজ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে চারপাশটা। রাস্তায় কতো মানুষ, কতো ধরনের মানুষ! সকলেরই রয়েছে নিজস্ব ব্যস্ততা, নিজস্ব গন্তব্য। প্রত্যেকটা মানুষের জীবন একে অপরের থেকে কতো আলাদা!

বাসায় ঢুকে রীতিমত অবাক হয়ে গেল নাজ। পুরো বাসাটা ছিমছাম গোছানো। নাজ তো ভেবেই রেখেছিল বাসায় ঢুকে দেখবে ফ্লোরে ভাঙ্গা প্লেট পড়ে আছে, চেয়ারের ওপরে ময়লা কাপড় ঝুলছে। তবে এখন মনে হচ্ছে এর থেকে গোছানো বাসা সে তার জীবনে দেখেনি। মেয়েমানুষ হলেই শাড়ি পড়তে জানতে হবে এমনটা যেমন কোথাও লেখা নেই, ছেলেমানুষ মাত্রই অগোছালো এই ধারণাও সঠিক নয়।

নাজ ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখা। বসার ঘরের দেয়াল জুড়ে ছোটো ছোটো ফ্রেমে অনেকগুলো ছবি। সবাই সায়েমের ছোটবেলার। কোনো ছবিতে প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার জিতেছে, আবার কোনো ছবিতে মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছে।

বাসায় ঢুকেই সায়েম রান্নাঘরে ঢুকে কী নিয়ে যেন ব্যস্ত হয়ে গেল। বসার ঘরটা এমন জায়গায়, যেখান থেকে খুব সহজেই দেখা যায় রান্নাঘরটা।

তাই নাজ বসার ঘর থেকেই সায়েমের উদ্দেশ্যে উঁচু গলায় বলল, “এত বড়ো বাসায় আপনি একা থাকেন?”

“হুঁ।”

“আমার তো কয়েক মিনিট একা থাকলেই কেমন দমবন্ধ লাগে। সারাক্ষণ একা একা থাকেন কী করে আপনি?”

সায়েম রান্নাঘর থেকে চায়ের কাপ দুটো চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। একটা কাপ নাজের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “একচুয়ালি আগে আমি আমার এক বন্ধুর সঙ্গে থাকতাম। বিয়ে ঠিক হবার পর এই বাসাটা নিয়েছি।”

নাজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “এত বড়ো বাসাটা সামলে রাখতে কষ্ট হয়না আপনার?”

“আগে হতো, এখন আর হবে না।”

“কেন?”

“এখন তুমি সামলে রাখবে।”

নাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, “শুনুন! আমি কোনো সামলে টামলে রাখতে পারবো না। এসব কাজ আমি কখনো করিনি আর করতে পারবোও না। আর আগেই বলে দিচ্ছি – আমি কিন্তু রান্নাবান্না করতে পারি না। কাজেই আপনি আবার আশা করবেন না আমি লক্ষ্মী বউয়ের তিনবেলা রান্না করবো।”

সায়েম শান্ত গলায় বলল, “ও আচ্ছা! তা আর কী কী পারো না তুমি? এক কাজ করো, যা যা পারো না তার একটা লিস্ট বানিয়ে দাও আমাকে। না! তার থেকে বরং যা পারো তার একটা লিস্ট বানাও। তোমার না পারার লিস্টের থেকে পারার লিস্টটাই নিশ্চয়ই ছোটো হবে, তাই না?”

নাজ আহত গলায় বলল, “ঠাট্টা করছেন আমার সঙ্গে?”

“তোমার সঙ্গে আমার ঠাট্টা করার সম্পর্ক নয়। আমি কি একবারও বলেছি যে লক্ষ্মী বউয়ের মতো তিনবেলা রান্না করতে হবে তোমাকে? যেমন অতিরিক্ত কথা বলো, তেমনই অতিরিক্ত বোঝো!”

নাজ চুপ করে রইলো।

সায়েম আঙুল তাক করে দেখিয়ে বলল, “ওই ঘরটায় আমি থাকবো, আর পাশের ঘরটায় তুমি থাকবে। কারো সঙ্গে রুম শেয়ার করা আমার পক্ষে ইম্পসিবল। আর যত পারো কম বিরক্ত করবে আমাকে।”

দুজনের জন্যে দুটো আলাদা ঘর দেখে মনে মনে ভালোই হকচকিয়ে গেল নাজ।

তবে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “যাক! ভালোই হয়েছে। আমি তো ভেবেছিলাম আপনার সঙ্গে একই ঘরে থাকতে হবে। আমি আবার কারো সঙ্গে বিছানা শেয়ার করতে পারি না। শেয়ার করলে রাতে ঘুমের মধ্যে পাশের মানুষের লাথি মেরে ফেলে দিই। কী একটা অবস্থা, বলুন তো!”

সায়েম কঠিন গলায় বলল, “এই তুমি কথা কম বলতে পারো না? এক দিনই মাথা ধরিয়ে দিয়েছ আমার।”

নাজ উত্তর দিলো না। ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। শোবার ঘর দুটো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে আবারও ফিরে এলো সায়েমের কাছে।

“এই শুনুন!”

“আবার কী হলো?”

“বড়ো ঘরটায় আপনি থাকবেন কেন?”

“কারণ শুরু থেকেই ওটা আমার ঘর।”

“গতকাল আপনি একটা ম্যাজিকাল ওয়ার্ড বলেছিলেন, মনে আছে?”

“কোন ম্যাজিকাল ওয়ার্ড?”

“কবুল! যেই মুহুর্তে এই শব্দটা বলেছেন, সেই মুহূর্ত থেকে আপনার কোনো কিছুই আর আপনার নেই। সবকিছুতে আমার ভাগ বসে গেছে।”

“অন্য সবকিছুতে ভাগ বসলেও ঘর আমি কারো আমার ঘরের কোনো ভাগাভাগি হবে না।”

“এক কাজ করি চলুন, কয়েন টস! যে জিতবে বড়ো ঘরটা তার। আপনার কাছে কয়েন আছে। দাঁড়ান, আমার কাছেই আছে।”

সায়েম কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হ্যান্ডব্যাগ থেকে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করলো নাজ।

“হেড না-কি টেইল?”

সায়েম রাগী কণ্ঠে বলল, “ছেলেমানুষী বন্ধ করো!”

সায়েমের রাগী কণ্ঠকে অগ্রাহ্য করে নাজ বলল, “আমি হেড নিলাম।”

অতঃপর কয়েন টসে হেরে সাধের বড়ো ঘরটা ছেড়েই দিতে হলো সায়েমকে।

(চলবে)