অপেক্ষারা পর্ব-০৪

0
493

#অপেক্ষারা
৪.
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

“এই মেয়ে, তোমার এসএসসির সার্টিফিকেটটা দাও তো!”, ব্যস্ত গলায় বলল সায়েম।

নাজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “আমার সার্টিফিকেট দিয়ে কী করবেন, এই ছেলে?”

“তুমি আমাকে কী ডাকলে?”

“আপনি আমাকে যা ডেকেছেন তা-ই। মানুষের কাছ থেকে সম্মান পেতে চাইলে, মানুষকেও সম্মান করতে হয়।”

রাগে সমস্ত শরীর জ্বলছে সায়েমের। সকাল সকাল অফিস থেকে ফোন এসেছে। দেশের বিশাল এক মাল্টিন্যাশাল কোম্পানিতে চাকরি করে সে। তার কাজটা হলো রাজ্যের সব বিদেশি ক্লাইন্টদের সঙ্গে ডিল করা, তাদের কাছে বিজনেস আইডিয়াগুলোর প্রেজেন্টেশন করা। অফিসের সবথেকে হ্যান্ডসাম আর স্মার্ট ছেলে হিসেবে এই কাজটা অবশ্য তাকেই মানায়।

আজ হুট করে বিদেশি ক্লাইন্ট চলে এসেছে, এদের সামনে আজ প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। বিয়ের এই ঝামেলার কারণে বেচারা কোনো প্রস্তুতিই নিতে পারেনি। কী যে প্রেজেন্টেশন দেবে কে জানে। একদিকে দুশ্চিন্তায় মাথা ধরে যাচ্ছে আরেকদিকে এই মেয়েটা চালু করে দিয়েছে তার এফএম রেডিও। কোনো মানে হয়?

নাজ বলল, “আমার এসএসসির সার্টিফিকেট দিয়ে কী করবেন?”

“কলেজে ভর্তি হতে হবে না?”

নাজ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “কী? মানে আমাকে পড়াশোনা করতে হবে?”

“অবশ্যই পড়াশোনা করতে হবে।”

“তাহলে বিয়ে করে লাভ কী হলো?”

সায়েমের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির আভা ফুটে উঠলো।

“কেন? তুমি কী ভেবেছিলে? বিয়ে হয়ে গেছে বলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে?”

“হ্যাঁ!”

“তাহলে সেই স্বপ্ন পানি ঢেলে দাও। বিকজ দ্যাট ইজ নট হ্যাপেনিং।”

নাজ অসহায় গলায় বলল, “কিন্তু আমি পড়াশোনা করে কী করবো?”

“মানুষ পড়াশোনা করে যা করে, তুমিও তাই করবে। যাও, সার্টিফিকেট নিয়ে এসো।”

নাজের মনটাই ভেঙে গেল। ভেবেছিল সকলের জোরাজুরি বিয়ে করে একটা লাভ অন্তত হয়েছে, পড়াশোনা নামক জেলখানা থেকে আজীবনের জন্যে মুক্তি। কিন্তু তার সে স্বপ্নে কী অবলীলায় পানি ঢেলে দিলো ছেলেটা!

নাজ তার ঘর থেকে সার্টিফিকেট এনে টেবিলের ওপর রাখলো।

সায়েম সেটাতে একবার চোখ বুলিয়ে অবাক স্বরে বলল, “জিপিএ তিন পয়েন্ট পনেরো! আনবিলিভেবেল! এত খারাপ রেজাল্টও মানুষ করতে পারে?”

নাজ থমথমে গলায় বলল, “এই শুনুন! আমার রেজাল্ট নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। পড়াশোনা থেকে আমি সারাজীবন দশ হাত দূরে থেকেছি। তারপরও তিন পয়েন্ট পনেরো। আমার বাবা তো রীতিমত পুরো এলাকাকে মিষ্টি খাইয়েছে।”

“আমার বিশ্বাসই হচ্ছে এমন জঘন্য একজন ছাত্রীর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। তুমি জানো
এসএসসিতে আমার রেজাল্ট কী ছিল? পুরো বোর্ডে চতুর্থ! আর সেখানে তুমি?”

“হয়েছে, হয়েছে। আপনার যুগে তো আর সৃজনশীল প্রশ্ন আসতো না। বড়ো বড়ো প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করে লিখে দিয়ে আসতেন। এ আর এমন কী?”

“আমার যুগ মানে? আমি কি বাবর-আকবরের যুগে পরীক্ষা দিয়েছি?”

নাজ চুপ করে রইল।

সায়েম বলল, “আগে যা করেছ, করেছ। কিন্তু এখানে ওসব চলবে না।”

“মানে?”

“মানে হলো এখন থেকে মন দিয়ে লেখাপড়া করতে হবে তোমাকে। আমার সঙ্গে থেকে পরীক্ষায় যদি পাও জিপিএ তিন, তাহলে আমারই মান-সম্মান নিয়েই টানাটানি লেগে যাবে।”

নাজ আহত গলায় বলল, “জিপিএ তিন নয়, তিন পয়েন্ট পনেরো!”

“ওই একই কথা। রেজাল্টের যে অবস্থা, মনে তো হচ্ছে না ভালো কোনো কলেজে চান্স পাবে। তবুও আমি চেষ্টা করবো। আর আমাকে এখন অফিসে যেতে হবে। তুমি একা থাকতে পারবে তো?”

নাজ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “হুঁ। এই শুনুন না! আমাকে কলেজে ভর্তি না করলে হয় না?”

“না, হয় না। মেয়েরা লেখাপড়া না শিখে, ঘরে বসে থাকবে – ব্যাপারটা আমার একদমই পছন্দ নয়।”

নাজ চুপ করে রইলো।

সায়েম বলল, “দারোয়ান একটু পর একটা বুয়া নিয়ে আসবে। কথাবার্তা বলে দেখ, পছন্দ হলে কাজে রেখে ফেলবে।”

“আচ্ছা।”

“আর একা একা বাইরে যাবার দরকার নেই। এখনকার রাস্তাঘাট এখনো তোমার কাছে অপরিচিত।”

“আচ্ছা।”

“কী ব্যাপার? হঠাৎ করে তোমার এফএম রেডিও বন্ধ হয়ে গেল কেন?”

“পড়াশোনার নাম শুনলেই আমার কথা বন্ধ হয়ে যায়।”

সায়েম বিড়বিড় করে বলল, “তাহলে তো এখন থেকে বই দিয়েই বসিয়ে রাখতে হবে।”

“কিছু বললেন?”

“কই না তো!”

একা থাকলেই দমবন্ধ লাগে নাজের, মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা শুরু হয়। তবে আজ সেসব কিছুই হচ্ছে না। কারণ আজ তার মস্তিক আগে থেকেই বিরাট এক দুশ্চিন্তায় ডুবে আছে। আচ্ছা, নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত প্রমাণ করতে মানুষকে পড়াশোনাই কেন করতে হয়? অন্যভাবেও তো তা প্রমাণ করা যায়! যে ব্যাটা পড়াশোনা আবিষ্কার করেছে তাকে এভারেস্টের চূড়ায় নিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে ইচ্ছা করছে।

স্কুলে পরপর ছয় বছর অংকে সবথেকে কম নম্বর পাবার রেকর্ড আছে নাজের। এ এমনই এক রেকর্ড যা যেকোনো শিক্ষার্থীর পক্ষেই ভাঙা কষ্টসাধ্য। এখন এই নতুন শহরের নতুন কলেজে নতুন কী রেকর্ড সে গড়বে কে জানে।

নাজের সাতপাঁচ ভাবনায় ছেদ পড়লো কলিংবেলের শব্দে। দারোয়ান এসেছে নতুন কাজের মেয়েকে নিয়ে। দুজনের মুখ হাসৌজ্জ্বল, সবগুলো দাঁত যেন জ্বলজ্বল করছে।

দারোয়ান বলল, “আফা, এরে নিয়া আসছি। আমগো বিল্ডিংয়ের বেশির ভাগ বাড়িত কাম করে।”

কথাগুলো বলেই দারোয়ানটা ঝড়ের গতিতে চলে গেল। মেয়েটা আগের ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে রইল। তার বয়স নিশ্চয়ই নাজের থেকে বেশিই হবে, তবে খুব একটা বেশি নয়। গাত্রবর্ন কুচকুচে কালো হলেও সেই কালোর আছে এক নিজস্ব উজ্জ্বলতা।

নাজ বলল, “আপনি ভেতরে আসুন।”

মেয়েটা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “ও আল্লা! আফনে আমারে আপনি আপনি ডাকতেছেন কেন? আমারে আপনি ডাকা লাগবো না।”

“তাহলে তুমি ডাকবো? আপনি কিছু মনে করবেন না?”

“গরীব মাইনসের আর মনে করাকরি।”

“বেশ, বসো তুমি।”

সে ফ্লোরে বসতে গেলে নাজ আচমকা বলে উঠলো, “নিচে বসছো কেন? সোফায় বসো!”

মেয়েটা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে সোফায় বসলো। মনে মনে নিশ্চয়ই সে বেশ অবাক হচ্ছে। শুরুতে আপনি ডাকছিল, এখন আবার সোফায় বসতে বলছে! এমনটা সম্মান তো কোনো বাড়িতেই মেলে না!

নাজ আরেকটা সোফায় বসতে বসতে বলল, “কী নাম তোমার?”

“জরিনা।”

“তুমি রান্না করতে পারো?”

“এইডা কোনো কথা কইলেন আফা! মাইয়ামানুষ হইয়া রান্না করতে পারমু না। আমার তো আবার চেহারাসুরত ভালো না, গায়ের রং মাইয়া। তয় আমার শাশুড়ি আমার হাতের রান্না খাইয়া আর চেহারার দিকে তাকায় নাই, একদিনের মধ্যে ঘরের বউ করছে।”

“আমি আবার মেয়েমানুষ হয়ে রান্না করতে পারি না। আমাদের বাসার রান্নার দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে।”

“আফনে কোনো টেনশন করবেন না আফা। মোগলাই, আফগানি, চাইনিজ, বাঙালি – যা খাইতে চান টেবিলে হাজির করবো।”

“আপাতত বাঙালি হলেই চলবে। আর শোনো জরিনা, ঘর গোছানো, কাপড় ধোয়া, থালাবাসন ধোয়া এসবও তোমাকে করতে হবে।”

“আচ্ছা আফা। তা আফনেরা বাসায় কয়জন থাকেন?”

“দুইজন। আমি আর আমার হাসবেন্ড।”

‘হাসবেন্ড’ শব্দটা উচ্চারণ করতে নাজের গা বেয়ে অন্যরকম হওয়া বয়ে গেল। কী অদ্ভুতভাবেই কয়েক দিনের ব্যবধানে খুব দূরের একটা মানুষের নাম তার নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে আজীবনের জন্যে।

জরিনা বলল, “আফা হিসাব কইরা দেখলাম আফনের এইখানে চাইর কাম পড়ে। চাইর কামের জন্যে আমারে তো চাইর দেওয়া লাগে।”

“চার কী?”

“চাইর হাজার।”

নাজের চোখ যেন কপালে উঠে গেল। তাদের ময়মনসিংহে দেড় হাজার টাকায় দুনিয়ার কাজ করে দেয় কাজের মেয়েরা। আর এ কি-না চাইছে চার হাজার!

নাজ ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল, “বসো, আমি আসছি।”

নাজ চলে এল তার ঘরে। চার হাজার টাকা নিশ্চয়ই যে দেবে তাকে একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করা উচিত। গত রাতেই সায়েম তার ফোন নম্বর নজকে দিয়ে রেখেছে। যেকোনো সমস্যায় ফোন দিতে বলেছে। এটা তো বিরাট এক সমস্যা, ফোন না দিয়ে উপায় কী?

ফোন তুলেই গম্ভীর গলায় সায়েম বলল, “বলো।”

“বুয়া তো চার হাজার চাইছে!”

“চাইবেই তো! যা কাজ করবে তার তুলনায় কমই চেয়েছে।”

“তো রেখে ফেলবে?”

“না রাখলে এতগুলো কাজ করবে কে? তুমি?শোনো আমি একটু পর মিটিংয়ে ঢুকবো, ডোন্ট ডিস্টার্ব মি!”

নাজ জবাব না দিয়েই ফোন কেটে দিলো। এখানে অযথা বিরক্ত কোথায় করা হলো। প্রয়োজন ছিল বলেই তো তাকে ফোন করেছিল নাজ!

নাজ ফিরে এসে জরিনাকে বলল, “তোমার চাকরি কনফার্ম। কবে জয়েন করবে বলো!”

জরিনা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “আইজ থেইক্কাই! দেরি কইরা লাভ কী?”

(চলবে)