অপেক্ষারা পর্ব-০৫

0
472

#অপেক্ষারা
৫.
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

নতুন কলেজে নাজের প্রথম দিন আজ। রিকশায় বসে অনবরত হাই তুলে যাচ্ছে সে। কলেজে পৌঁছাবার আগেই শুরু হয়ে গেল তার যন্ত্রণা। নাজ আবার সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারে। এখন সকাল সাড়ে সাতটা। কোথায় এই সময়ে তার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার কথা! সে যাচ্ছে পড়ালেখা করতে। এত শান্তির ঘুম বাদ দিয়ে যে পড়ালেখা করা হবে, সেই পড়ালেখা থেকে কী-ই বা অর্জন করবে সে?

শহরটা এখনো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। দু-তিনটা দোকানপাট খুলেছে, হকারও তার সাইকেল নিয়ে বিরক্তমুখে পত্রিকা বিলি করতে বেরিয়েছে। রিকশা চলছে ধীরগতিতে। নাজের পাশে বসে আড়চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে সায়েম। ব্যাপারটা নাজ বুঝতে পারছে কি-না কে জানে।

এক পর্যায়ে সায়েম বলল, “জেগে ওঠো এবার, একদিনেই টিসি পাবে দেখছি।”

নাজ হাই তুলতে তুলতে বলল, “তাহলেই ভালো হয়!”

কলেজে পৌঁছেই প্রচন্ড বিস্ময়ে নাজ ঘুমটুম সব কেটে গেল। ময়মনসিংহে তার কলেজটা ছিল একতলা দালান। কিন্তু এই কলেজটা একটা পাঁচতলা ভবনে। নাজের কাছে মনে হলো এত সুন্দর ভবন সে তার জীবনে দেখেছি। মূল বিল্ডিংয়ের সামনেই প্রকান্ড এক মাঠ। মাঠের কেন্দ্রবিন্দু হলো বিশাল এক কাঠবাদাম গাছ। গাছের প্রশস্ত ডালপালাগুলো এমনভাবে ছড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে যেন কেউ একজন মাঠের ওপরে ছাতা ধরে আছে।

এতক্ষণ নাজের ব্যাগটা সায়েমের কাঁধে দিলো। সে এবার ব্যাগটা নাজের কাঁধে তুলে দিয়ে বলল, “আমি গতকাল এসে হেডমিস্ট্রেসের সঙ্গে কথা বলে গেছি। তুমি নিচতলায় অফিসে একবার তার সঙ্গে দেখা করে ক্লাসে যাও।”

“আবার দেখা করতে হবে কেন?”

“আমি বলেছি, তাই। আর শোনো, যত পারবে কম কথা বলবে। উল্টাপাল্টা কোনো কথা বলবে না।”

নাজ বিরক্ত গলায় বলল, “আপনি দেখি আমার মায়ের মতো শুরু করলেন। মাও কোথাও যাবার আগে আমাকে বারবার বলে উল্টাপাল্টা কথা বলবি না।”

“ঠিকই তো বলে! খবরদার একটাও বাজে কথা বলবে না। এক কাজ করো, তুমি বরং মুখই খুলো না। একদম চুপ করে বসে থাকবে।”

“শেষে উনি যদি আমাকে প্রতিবন্ধী ভাবে?”

“উফ! এত জ্বালাও কেন তুমি? আমি গেলাম। ছুটির পর এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। গেটের বাইরে বের হবে না!”

হেডমিস্ট্রেসের অফিসে প্রায় মিনিট দশেক ধরে বসে রয়েছে নাজ। ভদ্রমহিলার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। চেহারায় রাগের ভাব স্পষ্ট। নাজের তো মনে হচ্ছে মানুষটা আসলে রাগী নয়, হেডমিস্ট্রেস হবার খাতিরে রাগী ভাবটা ধরে রাখতে হয়। সেই তখন নাজকে বসিয়ে রেখে কী সব কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করছে। নাজের একবার ইচ্ছা হলো বলতে, “আমাকে অযথা বসিয়ে রেখেছেন কেন? আপনার কাগজ ঘাটাঘাটির দৃশ্য দেখার কোনো আগ্রহ আমার নেই। আমাকে ছেড়ে দিন, আমি ক্লাসে যাই।”

একটা মেয়ে জোরে জোরে পা ফেলে অফিসের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল।

হেডমিস্ট্রেস তার উদ্দেশ্যে উঁচু গলায় ডাকলেন, “তুষি! এই তুষি! এখানে এসো।”

তুষি নামের মেয়েটা অফিসের ভেতরে প্রবেশ করলো। তার চোখেমুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে ভয়ের ছাপ।

হেডমিস্ট্রেস গম্ভীর গলায় বলল, “ঘোরাঘুরি করছো কেন? তোমার ক্লাস নেই?”

“সরি ম্যাম।”

কথাটা বলেই তুষি চট করে বাইরে যাবার জন্যে পা বাড়ালো।

হেডমিস্ট্রেস হুংকার দিয়ে বললেন, “কোথায় যাচ্ছ? আমি কি তোমাকে যেতে বলেছি?”

তুষি এবার যেন পাথরের মতো জমে গেল।

হেডমিস্ট্রেস নাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “শোনো নাজনীন, আমাদের কলেজের একটা মান আছে। এমনিতেই বছরের মাঝামাঝিতে নতুন আমরা ছাত্র-ছাত্রী নেই না। তোমার জন্যে বিশেষ সুপারিশ ছিল বলে নিয়েছি।”

নাজ ভেবে পেল না তার জন্যে বিশেষ সুপারিশটা আবার করলো কে? সায়েম? কিন্তু তিনিই বা কী এমন মন্ত্রী-মিনিষ্টার যে তার এক কথায় নাজকে ভর্তি করে নিয়েছে।

হেডমিস্ট্রেস আবারও বললেন, “আশা করি তুমি আমাদের কলেজের মান বজায় রাখবে। এমন কোনো কাজ করবে না যাতে আমাদের সন্মান ক্ষুণ্ণ হয়।”

নাজ ঘাড় করে সায় দিলো। এই মহিলার সঙ্গে কথায় যাবার প্রশ্নই ওঠে না।

“তুষি তুমি ওকে আমাদের কলেজটা ঘুরে দেখাও, স্যার-ম্যাডামদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও, নিয়ম-কানুনগুলো জানিয়ে দাও। আজ আর তোমাকে ক্লাস করতে হবে না। অবশ্য এমনিতেও ক্লাস করো না!”

অফিস থেকে বেরিয়ে তুষি বিড়বিড় করে বলল, “ডাইনোসর একটা!”

নাজ অবাক গলায় বলল, “কে? আমি?”

তুষি হেসে ফেলে বলল, “না, না! তুমি কেন হবে? উনি। আমরা আড়ালে ওনাকে ডাইনোসর ম্যাম ডাকি।”

নাজ খিলখিল করে হেসে উঠলো।

তুষি বলল, “ডাইনোসর ম্যাডাম আমাকে দেখতেই পারে না জানো। আমি কি কোনো দোষ করেছি? দোষের মধ্যে শুধুমাত্র একবার ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করেছি। এই কারণে উনি আমাকে সহ্যই করতে পারেন না।”

নাজ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল তুষির দিকে। পৃথিবীতে যে তার থেকেও খারাপ ছাত্রী থাকতে পারে, এটা নাজের ধারণার বাইরে ছিল। সেদিন জিপিএ তিন পয়েন্ট পনেরোর জন্যে কতগুলো কথা শুনিয়ে দিলো সায়েম। অথচ কতো মানুষ যে পাশই করতে পারে না, এটা তার জানা নেই।

“বাই দা ওয়ে, আমি তুষি। তোমার নাম নাজনীন তাই না?”

“হুঁ, তবে আমি নাজনীন নামটা শুনে অভ্যস্ত না। সবাই আমাকে নাজ বলেই ডাকে।”

তুষি সিড়িতে পা রেখে বলল, “বাহ্! তাহলে চলো নাজ, তোমাকে আমাদের মহান কলেজ ঘুরে দেখাই।”

নাজ তুষির পিছু পিছু সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলল, “শুনেছি এই কলেজটা না-কি অনেক ভালো, জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা এখান থেকে পাশ করে বেরিয়েছে। আসলেই কি এমন কিছু?”

“মোটেই না! কলেজের অবস্থা বলতে গেলে ওপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট টাইপ। আর দুদিন পরপরই এরা হাজির হয় একেকটা টেস্ট নিয়ে। শর্ট টেস্ট, ক্লাস টেস্ট, মডেল টেস্ট, ফাইনাল টেস্ট! এত টেস্ট দিলে মানুষ পড়বে কখন?”

তুষি নাজকে তিনতলাটা ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে। এখানে কলেজের ক্লাস হয় না। ডে শিফটে স্কুলের বাচ্চাটা এখানে পড়ে। ছোটো ছোটো বাচ্চারা কী সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে ক্লাসরুমগুলোকে। একটা ক্লাসরুমের দেয়ালে
বিশাল এক ছবি। বোঝাই যাচ্ছে ছবিটা ক্লাসের সকলে মিলে এঁকেছে। ছবিতে মহাচারী খোঁজ পেয়েছে নতুন এক গ্রহের। নাজের মহাকাশ নিয়ে বরাবরই প্রবল আগ্রহ।

ঠিকই তখনই ক্লাসরুমের বাইরে দিয়ে যাচ্ছিলেন এক স্যার। লোকটা মধ্যবয়স্ক, চোখেমুখে বিরক্তির ভাব স্পষ্ট। তার মুখের ভঙ্গিমা যেন জানান দিচ্ছে কলেজের প্রতিটা ছাত্রছাত্রীর ওপর তিনি অসম্ভব বিরক্ত।

তুষি নিচু গলায় বলল, “ওই দেখো! শেখর স্যার। আমরা আড়ালে ডাকি সাত্রী স্যার।”

“ছাত্রী স্যার?”

“ছাত্রী না, সাত্রী!”

“মানে?”

“একটু পরেই টের পাবে।”

তুষি নাজকে নিয়ে শেখর স্যারের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “গুড মর্নিং স্যার।”

স্যার ভ্রু কুঁচকে বলল, “এখানে কী করো? তোমার ক্লাস নাই?”

“এই আমাদের নতুন ছাত্রী স্যার। ওকে কলেজটা ঘুরে দেখাচ্ছি।”

শেখর স্যার একবার ভ্রু কুঁচকে নাজের দিকে তাকালেন। আবারও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তুষির দিকে নিক্ষেপ করে বললেন, “ক্লাসে তো তোমার দেখাই পাওয়া যায় না। সারাদিন শুধু ঘোরাঘুরি!”

তুষি বলল, “প্রিন্সিপাল ম্যাম আমাকে বলেছেন ওকে ঘুরে দেখাতে।”

“প্রিন্সিপাল ম্যাম তোমাকে ক্লাস বাদ দিয়ে ঘুরতে বলেছেন?”

“জি স্যার!”

“বেয়াদপ কোথাকার! শিক্ষকদের নিয়ে মিথ্যা কথা বলে! পড়াশোনা কিছু করো না-কি তাও ফাঁকিতে পড়ে গেছে?”

“করি স্যার।”

“সাত্রীর বাহার! পরীক্ষার খাতায়ই টের পাওয়া যায় সাত্রীর নমুনা।”

কথাগুলো বলেই শেখর স্যারে হনহন করে হেঁটে এগিয়ে গেলেন। তার প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে তারা দুজনে খিলখিল করে হেসে উঠলো।

তুষি হাসতে হাসতেই বলল, “সাত্রীর বাহার! এটা স্যারের কমন ডায়লগ।”

এবার তুষি নাজকে নিয়ে গেল তার ক্লাসরুমে। তার ক্লাসরুমটা পাঁচতলায়। নাজ তো আগেই ভেবেছিল, ঢাকা শহরের ছেলেমেয়েরা হয়তো প্রচন্ড অহংকারী। অহংকারে তাদের মাটিতে পা-ই পড়বে না। কেউ হয়তো তার দিকে ফিরেও তাকাবে, মফস্বল থেকে এসেছে বলে তাকে বিয়ে হাসি-ঠাট্টা করবে। কিন্তু বাস্তবে সেসব কিছুই হলো না। ক্লাসের সবাই যথেষ্ট আন্তরিক। এদের আন্তরিকতা যেন নাজকে মুগ্ধ করে তুলল।

সকলে হাসিমুখেই নাজের সঙ্গে পরিচিত হলো। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল নাজের কাঁধে হাত রেখে বলল, “কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে!”

নাজ তুষিকে বলল, “তোমাদের কলজের সবাই কত ভালো! আমি তো ভেবেছিলাম এখানে সবাই অহংকারী।”

তুষি বলল, “তুমি কী ভেবেছো? এখানে অহংকারী মানুষ নেই? অহংকার যে কী জিনিস সেটা আমি শিখেছিই এই কলেজে এসে।”

“তাই নাকি?”

“হুঁ! আসো, তোমাকে নিজ চোখে অহংকারীর
দর্শন করাই।”

দুজনে চলে গেল অন্য পাশের ক্লাসটায়। ক্লাসরুমের সামনেই দুটো মেয়ে হাত নেড়ে নেড়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে কথা বলছে। দুজনের চোখেই ভারী চশমা।

তুষি বলল, “এরা হলো সায়েন্সের স্টুডেন্ট। এমন একটা ভাব যেন সায়েন্স নিয়ে আকাশের চাঁদ ছুঁয়ে ফেলেছে। আমাদের মতো কমার্সের স্টুডেন্টদের সঙ্গে এরা কথা পর্যন্ত বলবে না।”

নাজ অবাক গলায় বলল, “বলো কী?”

“বিশ্বাস হয় না? দাঁড়াও দেখাচ্ছি!”

তুষি ওই মেয়ে দুটোর মধ্যে একজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কিরে ইলমা! কী করে খবর?”

ইলমা নামের মেয়েটি তার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন সবেমাত্র আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো এলিয়েনকে দেখছে। তারা তুষি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আবারও ব্যস্ত হয়ে গেল নিজেদের কথোপকথনে।

তীব্র রাগের স্রোত বয়ে গেল নাজের সমস্ত শরীর বেয়ে। সায়েন্সের স্টুডেন্ট বলে কমার্সের স্টুডেন্টের সঙ্গে কথা বলবে না? আরে বাবা সায়েন্স নেওয়া মানেই কি তুই আইনস্টাইন-নিউটন টাইপ কেউ হয়ে গেছিস?

নাজ উঁচু স্বরে ওই দুজনকে শুনিয়ে বলল, “ছি তুষি! এমন মহামান্য বিভাগের ছাত্রীকে তুমি কিনা বলছো কিরে? তোমার মধ্যে কী এতটুকুও বুদ্ধি নেই, যে এই সেকশনের মেয়েদের তুই ডাকা যায় না? তুই কেন, তাদের তো তুমি ডাকাও অন্যায়। চলো আমরা বরং এক কাজ করি, সবাই মিলে প্রিন্সিপাল ম্যামের কাছে আবেদন করি, যেন সায়েন্সের স্টুডেন্টদের আপনি ডাকা বাধ্যতামূলক করা হয়।”

সায়েন্সের ছাত্রী দুজন হতভম্ব হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। অতঃপর লজ্জিত ভঙ্গিতে চলে গেল তাদের ক্লাসে।
নাজ আর তুষি একসঙ্গে ফিক করে হেসে উঠলো।

(চলবে)