অপেক্ষারা পর্ব-০৯

0
426

#অপেক্ষারা
৯.
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

সুবিশাল লাইব্রেরি, যতদূর পর্যন্ত চোখ যায় শুধু বই আর বই! এত বই এর আগে একসঙ্গে দেখেনি নাজ। লাইব্রেরিটা তার কলেজের। ক্লাসসুদ্ধ সবাইকে আনা হয়েছে এখানে। একটু পরেই ম্যাম এসে নতুন অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে আলোচনা করবেন। অ্যাসাইনমেন্টটা সম্ভবত লাইব্রেরি অথবা বইকেন্দ্রিক। ম্যাম আসার আগে সবাই চুপচাপ বসে বই পড়ছে।

লাইব্রেরিতে নিঃশব্দ নিরবতা পালন করতে হয়, এই নিয়ম সকলেরই জানা। তবে জেনেও একপ্রকার অবহেলা করে উচ্চস্বরে গল্প করেই যাচ্ছে তুষি।

“তারপর কী হলো শোন, ভাইয়ার বিয়েতে আমরা প্রায় সত্তরজন বরযাত্রী যাচ্ছি। দুইটা বাস ভাড়া করা হয়েছে। বাসে করে যশোরে যাচ্ছি, ওমা হঠাৎ আমার মাথার ওপরে ঝপ করে শব্দ হলো। আমি চিৎকার দিয়ে উঠতেই সবাই নেমে দেখলো ছাদের ওপর গাছ থেকে একটা কাঁঠাল ভেঙে পড়েছে। চিন্তা করে দেখ! চলন্ত বাসের ওপর কাঁঠাল! তাও আবার ঠিক আমার মাথার ওপরে।”

নাজ খেয়াল করলো, লাইব্রেরিয়ান ম্যাডাম অগ্নিমূর্তি ধারণ করে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। চোখের ইশারায় চুপ করতে বলল তুষিকে। তবে কোনো ইশারাই যেন তার চোখে পড়ছে না। এক মনে কাঁঠালের গল্প করেই যাচ্ছে।

লাইব্রেরিয়ান ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বললেন, “এই মেয়ে! লাইব্রেরিতে কথা বলা নিষেধ তুমি জানো না?”

তুষি হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “সরি ম্যাম।”

“কীসের সরি? কলেজে উঠেছ অথচ এতটুকু আদবকায়দা শেখনি? বাবা-মা কিছু শিখিয়ে পাঠায়নি?”

“ম্যাম বললাম তো সরি। এরমধ্যে বাবা-মাকে টানছেন কেন?”

লাইব্রেরিয়ানের রাগের তেজ এবার যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল, “এত বড় সাহস! আবার মুখে মুখে তর্ক করছে? শোনো তোমার মুখে এত বড় বড় কথায় মানায় না। পরীক্ষায় যা রেজাল্ট করো, পুরো কলেজের জানা আছে।”

সঙ্গে সঙ্গে তুষির মুখটা ছাইবর্ণ হয়ে উঠলো। যতটুকু সময় তারা লাইব্রেরিতে ছিল, বেচারি মুখ গোমড়া করেই রইল। নাজের মনটাও খারাপ হয়ে গেল। তুষির যতটা না অপরাধ তার থেকে বেশি অপমান করা হয়েছে তাকে। কোনো মানে হয়?

লাইব্রেরির কাজ শেষে নাজ ক্লাসে এসে বসলো। আজ একাউন্টিং স্যার আসেনি। তাই তার ক্লাসের সময়টুকু সকলে গল্পগুজব করেই কাটাচ্ছে। নাজ একা একা বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার হাতের নখগুলোর দিকে। নখের দিকে তাকিয়ে থেকে যতটা সময় পার করা যায়! ক্লাসে তুষি ছাড়া নাজের তেমন কোনো বন্ধু নেই। সে থাকলে গল্পে গল্পে সময়টা কখন যে পার হয়ে যেত! তুষি নাজকে বসিয়ে রেখে কোথাও যেন একটা গেছে মিনিট বিশেক হলো। বিশ মিনিট তেমন দীর্ঘ সময় না হলেও নাজের কাছে মনে হচ্ছে যেন অনন্তকাল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নাজের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে, ঠোঁটে চিরচেনা হাসির রেখা টেনে ক্লাসে ঢুকলো তুষি।

পাশে বসতেই নাজ বলে উঠলো, “কী ব্যাপার? খুব খুশি মনে হচ্ছে!”

তুষি বলল, “মনে হলেও আমার মনটা প্রচন্ড খারাপ। রাগে সমস্ত শরীর জ্বলছে।”

“তাহলে হাসছিস কেন?”

তুষি ঠোঁটের কোণে বিচিত্র হাসির আভা ফুটিয়ে তুলে বলল, “সেটা একটু পরেই টের পারি!”

“মানে?”

“আমি একা মানুষ একটু কথা বলায় ওই মহিলা এমন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। এবার যদি লাইব্রেরিতে সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠে, তখন কী করবো সে?”

নাজ উৎফুল্ল গলায় বলল, “তুষি? সত্যি করে বল তো কী চলছে তোর মাথায়?”

তুষি নিচু গলায় বলল, “সায়েন্সের পণ্ডিতগুলোর জন্যে আজ বিশেষ গিফট এসেছে।”

“কী গিফট?”

“চল দেখাই তোকে!”

তুষি নাজকে সঙ্গে নিয়ে চলে এলো বায়োলজি ল্যাবে। এই কলেজের সবগুলো ল্যাবই বিশাল ফুটবল মাঠের আকৃতির। তবে এই বায়োলজি ল্যাবটার বিশেষত্ব হলো এর সৌন্দর্য। খুব সুন্দর করে ছবি-টবি দিয়ে সাজানো হয়েছে জায়গাটাকে।

ল্যাবে কমার্সের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রবেশ নিষেধ হলেও তুষি আর নাজ প্রায়ই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সকলের অগোচরে এখানে এসে ঘুরে বেড়ায়।
দুজনে পা টিপে টিপে চলে গেল ল্যাবটার একেবারে কোণায়।

যেতে যেতে তুষি ফিসফিস করে বলল, “একটা মজার জিনিস দেখবি?”

“কী?”

তুষি আঙুল উঁচিয়ে একটা টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই দেখ!”

চোখদুটো একটু কুঁচকে নাজ যা দেখতে পেল, তাতে হার হীম হয়ে উঠল তার। রক্তবর্ণ ধারণ করলো তার চোখমুখ। দুটো ছোট ছোট স্বচ্ছ কাঁচের বাক্স। বাক্সদুটো জুড়ে আনাগোনা করছে কতগুলো নিরীহ প্রাণী। প্রাণীগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও, নাজের কাছে তারা ভয়ংকর। তেলাপোকা! একসঙ্গে এতগুলো তেলাপোকাকে একসঙ্গে চলাফেরা করতে দেখে শিউরে উঠলো নাজ।

আতঙ্কিত গলায় বলল, “এ কী? আমি গেলাম ভাই!”

তুষি নাজের চট করে নাজের হাতটা ধরে ফেলে বলল, “কোথায় যাচ্ছিস?”

“তেলাপোকা আমি প্রচন্ড ভয় পাই, তাও আবার এতগুলো একসঙ্গে! এখানে যদি আর এক সেকেন্ডও থাকি, আমি বোধ হয় মরেই যাবো।”

তুষি বিরক্ত গলায় বলল, “সামান্য তেলাপোকাকে এত ভয় পাওয়ার কী আছে? ওরা তো আর তোকে খেয়ে ফেলতে পারবে না, বরং তুই ওদের খেতে পারবি।”

“ছি! তোর তেলাপোকা তুই-ই খা, আমি গেলাম।”

“যাবি মানে? মজা তো এখনো শুরুই হলো না।”

“আবার কীসের মজা?”

“একবার ভেবে দেখ নাজ, লাইব্রেরিতে সবাই চুপচাপ বসে থাকে। যাকে বলে পিন ড্রপ সাইলেন্স। কিন্তু এই সুন্দর তেলাপোকারা যদি একসঙ্গে লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়ে, তখন কি আর পিন ড্রপ সাইলেন্স বজায় থাকবে?”

নাজ কিছুটা সময় চুপ করে রইলো। বুঝতে চেষ্টা করলো মেয়েটার মাথার প্যাঁচ। তুষির মাথায় সর্বক্ষণ কোনো না কোনো প্যাঁচ ঘুরতেই থাকে। এটা আবার কোন প্যাঁচ কে জানে?

নাজ বলল, “না, থাকবে না। তুই বরং তেলাপোকাদের লাইব্রেরিতে যাওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে দে। ওরা গিয়ে একসঙ্গে হামলা করুক।”

তুষি বিরক্ত গলায় বলল, “সেটা করতে পারলে কি আর আমি এতক্ষণ হাত গুটিয়ে বসে থাকি?”

“তোর মতলব কিন্তু আমার মোটেও ভালো ঠেকছে না।”

“ঠেকছে না, কারণ আমার মতলব ভালো নয়। আমার মতলব হলো এই বাক্সভর্তি তেলাপোকাগুলোকে লাইব্রেরিতে ছেড়ে দেওয়া।”

নাজ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো তুষির দিকে।

বিস্মিত গলায়ই বলল, “পাগল-টাগল হয়ে গেলি না-কি তুই?”

তুষি রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “পাগল হবো কেন? রাগে আমার সারা শরীর জ্বলছে। প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ আমাকে অপমান করে যাচ্ছে। আজ পুরো কলেজ টের পাবে আমাকে অপমান করার পরিণাম। তুই কিন্তু আমাকে হেল্প করবি!”

“কোনো হেল্পের মধ্যে নাই আমি।”

তুষি অসহায় গলায় বলল, “হেল্প করবি না? তুই না আমার বেস্টি?”

“ওসব বেস্টি-ফেস্টি বুঝিনা।”

“এরকম করিস না দোস্ত, একটু পরেই তো পন্ডিতরা এসে এগুলো কাটাকাটি শুরু করে দেবে।”

“দেখ তুষি, তোর এসব পাগলামির মধ্যে আমি নেই। আমি আমার এই হাত দিয়ে কিছুতেই ওই তেলাপোকার বক্স ধরতে পারবো না, লাইব্রেরিতে নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা।”

তুষি ধমক দিয়ে বললো, “আরে গাধা, তোকে বক্স ধরতে কে বলেছে? আমিই এটা নিয়ে যাবো, তুই শুধু দেখবি সামনে থেকে কেউ আসছে কিনা।”

নাজ সংবিৎ ফিরে পেয়ে কিছুটা শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “ওহ! আগে বলবি না?”

লাইব্রেরীটা দোতলায় আর বায়োলজি ল্যাব নিচতলায়। এখন থেকে লাইব্রেরিতে যেতে খুব একটা বেশি সময় লাগবে না। পথে কারোর দেখা না পেলেই হলো। ছোট ছোট পা এগিয়ে গেল তুষি। তার সামনেই নাজ। নাজ দরজার বাইরে উঁকি পরিস্থিতিটা বুঝতে চেষ্টা করছে। নাহ্! আশেপাশে কেউ নেই। থাকার কথাও অবশ্য নয়। এই সময় ক্লাস চলে, সবাই তো আর তাদের মতো ঘুরে বেড়ায় না।

নাজ নিচু গলায় বলল, “কেউ নেই, আয়!”

দুজনে সিড়ির গোড়ায় পৌঁছালে নাজ আবার ভালো করে দেখে নিলো কেউ আসছে কিনা। কেউ আসছে না, এই আশ্বাসে যখন সিড়িতে পা রাখতে যাবে তখনই কোত্থেকে যেন চলে এল কলেজের এক আয়া। ভাগ্যিস সিড়ির গোড়ার ফাঁকা জায়গায় পুরনো কাগজের স্তূপ আছে। তুষি চট করে বাক্সটাকে সেই স্তূপের আড়ালে রেখে দিল।

আয়া পান চিবোতে চিবোতে বলল, “ক্লাসে যাও!”
নাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, “ক্লাসেই তো যাচ্ছি!”

দুজনকে বাধ্য হয়েই সেই আয়ার পিছু পিছু তিন তলা পর্যন্ত উঠতে হয়। আয়া নিজের কাজে চলে গেলেই তারা পুনরায় নিচে নেমে বাক্সটা নিয়ে উপরে উঠতে থাকে।

কিছুদূর উঠে যাওয়ার পর তুষি ফিসফিস করে বলল, “তখন একটা পুরনো কাগজ সাথে আনলে ভালো হতো। কাগজ দিয়ে বাক্সটা ঢেকে রাখতাম।”

“চুপ কর তো! অর্ধেক পথ চলে এসেছি, এখন এই কথা বলছিস?”

“না মানে, বলছি যে হলে ভালো হতো।”

“ভালো হওয়ার দরকার নেই। কোনোমতে লাইব্রেরির কাছে যেতে পারলে বাঁচি।”

ওদের লাইব্রেরির দুটো দরজা। একটা সামনের দরজা আরেকটা পেছনের। পেছনের দরজা দিয়ে মানুষ খুব একটা যাতায়াত করে না বললেই চলে। দুজনে ওই দরজাটার পেছনে গিয়ে বসলো। তুষি একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিল, বেশ অনেকগুলো ছেলেমেয়ে বইয়ে মুখ গুজে পড়ছে। আর লাইব্রেরিয়ান ম্যাডাম ওদিকে ফিরে সেলফে কী যেন খুঁজছেন। কারোর দৃষ্টিই এদিকে নেই।

তুষি আস্তে করে বাক্সটাকে লাইব্রেরি ঘরের ভেতরে রাখলো। ওদিকে নাজ বহুকষ্টে হাসি চেপে রেখেছে, তুষির মুখও হাসি হাসি। সাবধানে মুখটা খুলে দিতেই বেরিয়ে এল তেলাপোকাদের সেনা। বেশি নয়, প্রায় সাত-আটটা তেলাপোকা হবে। গুটি গুটি পায়ে ছড়িয়ে পড়লো পুরো লাইব্রেরিতে।

নাজ আর তুষি এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে দৌড়ে পালিয়ে কিছুদূর দিয়ে দাঁড়ালো। বইয়ে ডুবে থাকা পাঠক-পাঠিকাদের দৃষ্টি বোধ হয় তখনও আকর্ষণ করতে পারনি তেলাপোকা বাহিনী। কিছুটা সময় পরই, বিকট এক চিৎকার ভেসে এলো লাইব্রেরি থেকে। পুরো কলেজ যেন কেঁপে উঠলো সেই চিৎকার। মনোযোগী ছেলেমেয়েগুলো আর্তনাদ করতে করতে বেরিয়ে এল। তাদের পেছনে ছুটতে ছুটতে বের হলেন লাইব্রেরিয়ান। দেখার মতো একটা দৃশ্য।

ওরা দুজনে দেখেই আর অপেক্ষা করলো না। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে উপরে উঠে এল। তাদের হাসি যেন থামছেই না। হাসতে হাসতে সিড়িতেই গড়াগড়ি খাচ্ছে। নাজ কিছুটা একটা বলছে চেষ্টা করছে, তবে কথাগুলো তার খিলখিল হাসির আড়ালেই চাপা পড়ে গেল।

তুষি হাসতে হাসতে বলল, “উনার চেহারাটা দেখেছিলি?”

নাজ কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলল, “মনে হয় যেন ভূত দেখেছে!”

দুজনে আবারও খিলখিল করে হেসে উঠলো। কিছুটা সময় পর নিজেদের শান্ত করে ফিরে গেল ক্লাসে। স্যার বোর্ডে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংক দেখাচ্ছেন। দুজনেই মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু কীসের কী? হাসি যেন থামছেই না। মুখ চেপে হেসেই যাচ্ছে তারা।

স্যার রাগী কণ্ঠে বললেন, “এই তোমরা হাসছো কেন?”

তুষি বহুকষ্টে গলায় স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, “কিছু না স্যার।”

তুষির কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই নাজ ফিক করে হেসে ফেলল। নাজের দেখাদেখি সেও আর হাসিটা চেপে রাখতে পারলো না।

স্যার কঠিন গলায় বলল, “কী ফাজিল মেয়ে! বেরিয়ে যাও, তোমাদের মতো ছাত্রীর প্রয়োজন নেই ক্লাসে।”

নাজ মুখে হাত চেপে বলল, “সরি স্যার।”

আরও দুটো ক্লাস চলে গেল কিন্তু তাদের উচ্ছাস আর কমে না। দুজনের এই চাপা খিলখিল হাসির রহস্য ক্লাসের কেউই পারলো উদ্ধার করতে। অবশেষে সমস্ত উচ্ছাস শেষ হতেই হলো।

ক্লাসে একজন পিয়ন এসে বললেন, “তুষি আর নাজনীন! তোমাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ডাকে।”

সঙ্গে সঙ্গে রক্তবর্ণ ধারণ করলো নাজের চোখমুখ। কেউ কি তাহলে কিছু বুঝে গেল?

(চলবে)