অপেক্ষারা পর্ব-১০

0
437

#অপেক্ষারা
১০.
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

চারিদিকে কেমন থমথমে পরিবেশ। মাথার ওপরে ফ্যানটা যে ঘুরছে, তার ভঙ্গিমাও থমথমে। সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে! প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সায়েমকে ডেকে পাঠিয়েছেন। নাজ ভেবে পায় না তার কী এমন অপরাধ ছিল। অপরাধ যদি হয়েই থাকে, কলেজ কর্তৃপক্ষ নিজে থেকে তাদের শাস্তি-টাস্তি দিলেই তো হয়ে যেত। শুধু শুধু গার্জিয়ান ডেকে ঝামেলা বাড়াবার কোনো মানে হয় না।

ওদিকে একটু আগে এসেছিল তুষির মাও। মা এবং প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সামনে অপরাধের কথা অকপটে স্বীকার করে সে বলেছে, “এই কলেজে আমাকে প্রতিনিয়ত অপমান করা হয়। আমাকে অপমান করলে আমি চুপ করে বসে থাকবো কেন?”

তুষিকে কোনো শাস্তি দিয়েছে কিনা কে জানে? নাজ ভেবে পায় না – একটা মেয়ে, দিনের পর দিন ফেল করে যায় আর কলেজে দিনের পর দিন তাকে করা হয় অপমান। আজকের লাইব্রেরির ঘটনা সে সকল অপমানের বিরুদ্ধে তুষির প্রতিশোধের গল্প। যদিও প্রতিশোধ নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরা পড়তে হয় তাকে। এসবের মাঝে নাজের ভূমিকাটা কী? তাকে তো আর অপমান করা হয়নি, লাইব্রেরিতে তেলাপোকা ছেড়ে দেওয়ার আইডিয়াটাও তার ছিল না। সে কেবল তুষিকে পথ দেখিয়ে সাহায্য করেছে। এর জন্যে সায়েমকে ডেকে আনতে হবে?

সায়েম গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে। চোখেমুখে যথেষ্ট স্বাভাবিকতার ছাপ ধরে রাখার চেষ্টা করলেও নাজ ঠিকই বুঝতে পারছে প্রচন্ড রাগে ভেতরে ভেতরে জ্বলে যাচ্ছে সে। নাজ প্রিন্সিপালের ঘরে এক কোণায় গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। সায়েমের সঙ্গে একবার চোখাচোখি হতেই ভয়ে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল অন্যদিকে।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “এভাবে হুট করে ডাকার জন্যে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আশা করি আপনার খুব একটা অসুবিধা হয়নি।”

সায়েম শীতল গলায় বলল, “জি না।”

“আমরা শিক্ষকরা আপনার কাজকে খুবই এপ্রিশিয়েট করি। আমাদের কলেজের বহু মেয়েদের পড়াশোনা শেষ হবার আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের পর আমরা হাজার চেষ্টা করেও তাদের লেখাপড়ায় ফেরাতে পারিনি। আর সেখানে নাজনীনের ঘটনা একেবারেই ব্যতিক্রম। বিয়ের পর আপনি নিজে এসে ওকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেছেন। তাই আমরা চাই না ওর পড়াশোনা নিয়ে আপনাকে খুব একটা বিরক্ত করতে। কিন্তু…”

সায়েম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু ওরি অ্যাবউট দ্যাট। ও কী ঘটিয়েছে সেটা বলুন।”

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বললে বিশ্বাস করবেন না, নিজের চোখেই দেখুন!”

তিনি কম্পিউটারে একটা ভিডিও রেকর্ডিং ছেড়ে দিলেন। নাজ ভালোভাবে লক্ষ করতেই বুঝল, জিনিসটা সিসিটিভি ফুটেজ।

“ছাগল কোথাকার!” – মনে মনে তুষির উদ্দেশ্যে বলল সে। নাজ না হয় নতুন, কিন্তু তুষি? বহুকাল ধরেই তো এই কলেজে তার বিচরণ। এখানে যে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে, মেয়েটা জানে না না-কি?

সায়েম পুরো ভিডিওটা মনোযোগ দিয়েই দেখলো। তবে ওই বাক্সটার ভেতরে কী ছিল, সম্ভবত বুঝতে পারলো না। তাই লাইব্রেরি থেকে ছেলেমেয়েগুলোকে চিৎকার করে বেরিয়ে আসতে দেখে সায়েম চমকে উঠে বলল, “কী হলো?”

“তেলাপোকা।”

“মানে?”

“আজ সকালে প্রাকটিকাল পরীক্ষার জন্যে কতগুলো তেলাপোকা আমাদের ল্যাবে আনা হয়। তারা দুজন সেই তেলাপোকাগুলোকে লাইব্রেরিতে ছেড়ে দিয়ে আসে।”

সায়েম চরমভাবে হকচকিয়ে গিয়ে নাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন?”

নাজ সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটো নিক্ষেপ করলো মাটির দিকে। তার খুব বলতে ইচ্ছা করছে, “আমি তো শুধু তুষিকে সাহায্য করেছি। আমার কোনো দোষ নেই।” – কিন্তু সাহসের অভাবে মুখটা বন্ধই করে রাখলো।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “দোষটা সম্পূর্ণ ওর একার না। খারাপ সঙ্গ, তাছাড়া নতুন হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব ছিল ওর দিকে আরেকটু মনোযোগ দেওয়া। হয়তো আমরাই সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু ওর যে দোষ নেই তাও নয়। আচ্ছা আপনি বলুন তো, আপনার প্রিয় একজন বন্ধু যদি পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেয়, তবে আপনিও কি তার দেখাদেখি ঝাঁপ দেবেন?”

সায়েম চুপ করে রইলো। প্রচন্ড বিস্ময়ে যেন বাকশক্তিই হারিয়ে ফেলেছে। তার চোখদুটো এখনো কম্পিউটারের দিকেই স্থির হয়ে আছে।

“মিস্টার সায়েম?”

সায়েম সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, “জি?”

“আমি মনে করি নাজনীনের একটা শাস্তি হওয়া উচিৎ। শাস্তি পেলে এমন দুঃসাহস আর দ্বিতীয়বার করতে পারবে না।”

সায়েম গম্ভীর গলায় বলল, “অবশ্যই। আপনার যা ভালো মনে হয়, তাই শাস্তি দিন।”

“আমরা শিক্ষকরা আলোচনা করে দুজনের শাস্তি ঠিক করেছি। ওর বান্ধবীকে ত্রিশ দিনের জন্যে সাসপেন্ড করা হয়েছে, নাজনীনের শাস্তি অতটা দীর্ঘ না হলেও পনেরো দিনের হবে। সাসপেনশন শেষ হবার দুদিন আগে পরীক্ষা শুরু হবে। সেই হিসাবে প্রথম দুটো পরীক্ষায় তাকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না।”

নাজ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। তার ভেতর দিয়ে যে কী সাংঘাতিক ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তার টের এরা কেউ পেল না।

বারান্দার দোলনাটার ওপরে গম্ভীরভাবে বসে আছে সায়েম। তাকে দেখে মনে যেন পাথরের কোনো মূর্তি। এ জীবনে কোনদিন নড়াচড়া করেনি, ভবিষ্যতে করবে সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তার সামনে কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে নাজ। এই মুহূর্তে মানুষটাকে প্রচন্ড ভয় লাগছে তার। ভয়টা কিছুক্ষণ আগেও ছিল না। বাসায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঝেঁকে ধরেছে তীব্র এই ভয়।

সায়েম শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “লাইরেরিতে তেলাপোকা?”

শান্ত ভঙ্গিতে কথাটা বললেও তার গলার স্বরে কোথাও যেন একটা থমথমে ভাব ছিল। সেটা আর কেউ না বুঝলেও নাজ বেশ বুঝতে পারছে।

নাজ ইতস্তত করে বলল, “শুনুন…”

সায়েম ধমক দিয়ে বলল, “কী আর শোনাবে? কম কথা তো শুনতে হলো না তোমার জন্যে।”

নাজ চুপ করে রইলো। ভয়ে তার গলার থাকে আওয়াজ পর্যন্ত বের হচ্ছে না। এই মানুষটাকে হুট করে এত ভয় কবে থেকে পেতে শুরু করলো সে?

সায়েম বলল, “ওয়াট ডিড আই টেল ইউ? বলেছিলাম না তোমার ছোট থেকে বড় সব প্রয়োজনগুলোর খেয়াল আমি রাখবো, তোমার যা যা ইচ্ছা সব আমি পূরণ করবো? তুমি শুধু মনোযোগ দিয়ে লেখা পড়া করবে!”

“জি।”

“তাহলে? অবশ্য আমি জিজ্ঞেসই বা করছি কাকে? আগেই বোঝা উচিত ছিল পৃথিবীতে কাউকে তুমি তোয়াক্কা করো না। একটা ব্যাপারই আমার মাথায় ঢুকছে না, এত বড় দুঃসাহস কোথা থেকে আসে তোমার।”

নাজ ভীত গলায় বলল, “বিশ্বাস করুন আমি বুঝতে পারিনি এত বড় ঝামেলা বেঁধে যাবে।”

সায়েম ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “হোয়াট ডু ইউ মিন? এতে বোঝারই বা কী আছে? একটা মানুষের বিবেকেই তো থাকে, এমন কাজ করা উচিত কি উচিত না। ওহ! তোমার মধ্যে তো আবার বিবেক বলতে কিছু নেই। থাকলে কেউ কলেজের লাইব্রেরিতে তেলাপোকা ছেড়ে দেয়? তুমি কী ভেবেছিলে? চুপচাপ তেলাপোকা ছেড়ে দিয়ে আসবে আর কেউ কিচ্ছু টের পাবে না?”

সায়েম তাকিয়ে রয়েছে নাজের দিকে। তার চোখে জিজ্ঞেসা। যে উত্তরের আশা সে করছে সেই উত্তর নাজ দিতে চাইছে, তবে পারছে না। গলা ভেঙে কান্না আসছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রেখেছে সে। এই মুহূর্তে কিছুতেই ওই মানুষটাকে তার চোখের জল দেখতে দেওয়া যাবে না।

সায়েম আবারও বলল, “খুব ফুর্তি হয়েছে তাই না? কিন্তু তাতে কী? শেষ রক্ষা তো আর কোনো না। পুরো কলেজের সামনে মুখ দেখাতে পারবে এর পরে? আমার মতে, পনের দিনের সাসপেনশনে তোমার মতো মানুষের কিছুই হবে না। তোমার জন্যে দরকার ছিল কঠিন কোনো শাস্তির।”

প্রাণপণ চেষ্টা করেও কান্নাটা আর চেপে রাখতে পারলো না নাজ। তার চোখদুটো বেয়ে নিঃশব্দে বেয়ে পড়ছে অশ্রুধারা।

সায়েম প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বলল, “এই মেয়ে! ন্যাকামি বন্ধ করো। খবরদার কাঁদবে না!”

নাজ দুই হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “আপনি সব সময় আমার সঙ্গে এমন করেন। আমি কী ক্ষতি করেছিলাম আপনার? আমাকে যদি একেবারেই সহ্য না করতে পারেন তাহলে বাড়িতে রেখে আসুন। আমি থাকবো না এখানে।”

“চুপ ব্লাডি ইডিয়ট! কিছু বললেই একটাই কথা – বাড়িতে দিয়ে আসুন। শোনো, বিয়ে করেছি। তোমার সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার আমার আছে। কোথাও যাচ্ছ না তুমি। এখানেই থাকবে আর আমার ইচ্ছা অনুযায়ী চলবে।”

কথাগুলো বলেই সায়েম লম্বা লম্বা পা ফেলে ফেলে চলে গেল। নাজ বসে পড়লো দোলনায়। তার শিশুসুলভ অসংখ্য স্বভাবের একটি হলো, বকাঝকা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। কেউ একজন কঠিন গলায় বকলেই তার সারা শরীর কাঁপতে থাকে, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হয়।

নাজ দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। কেন যে এই মানুষটার সঙ্গে তার বিয়ে হতে গেল! ইচ্ছা করছে ছুটে পালিয়ে যেতে। তা কি একেবারেই অসম্ভব?

বেশ কয়েকদিন কেটে গেল ওই ঘটনার। নাজের বেশির ভাগ সময় এখন কাটছে বাড়িতে বসে লেখাপড়া করেই। এক সপ্তাহ পর সাসপেনশন কেটে গেলেই পরীক্ষা। নাজ ঠিক করে রেখেছে, এই পরীক্ষায় ভালো করে সায়েমের মুখ বন্ধ করে দেবে।

মানুষটা ভয়ানক রেগে গেছে। এই কয়েকদিনেও তার রাগের লেশমাত্র কমেনি। নাজের সঙ্গে কথা বলছে না, নাজ নিজে থেকে কথা বলতে গেলেও এড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষটার অবহেলা প্রচন্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে। কয়েকদিন আগেও সায়েমকে সহ্য হতো না নাজের। একটু পর পর তার রাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যেত। তবে এখন কেন সেই একই মানুষের অবহেলা সহ্য করতে পারছে না নাজ?

আজ সকালে অফিসে যাওয়ার আগে সায়েম যখন জুতার ফিতা বাঁধছে, তখন নাজ তার সামনে গিয়ে অসহায় গলায় বলল, “আপনি এখনো আমার ওপরে রেগে আছেন?”

সায়েম তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “রেগে আছি তোমাকে কে বলল?”

“তাহলে কথা বলছেন না কেন আমার সঙ্গে?”

“তোমার সঙ্গে খেজুরে আলাপ করার তো কিছু নেই! যাও, নিজের কাজে যাও।”

আবারও গলা পর্যন্ত কান্না এসে গেল। নাজ বহুকষ্টে চোখের জল চেপে রেখে আড়ালে চলে এল। আচ্ছা এই মানুষটা কি জানে না, তার এই রাগ কতটা কষ্ট দিচ্ছে নাজকে। নির্ঘাত জানে, জানে বলেই এতটা কষ্ট দিচ্ছে তাকে।

নাজদের বারান্দা থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায়। আজ বহু বছর পর নাজ সূর্যাস্ত দেখল। কী অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য! মানুষ প্রকৃতির কাছাকাছি থেকেও প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্যগুলোকে দূরে ঠেলে দেয়।

চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসতেই ঘরের ভেতরে চলে এল নাজ। আর ঠিক তখনি এমন এক ঘটনা ঘটলো, যা তার সমস্ত অন্তরাত্মাকে
কাপিয়ে তুলল। প্রচন্ড ভয়ে পাথরের মতো জমে দাঁড়িয়ে আছে নাজ। এক চুল নড়ার ক্ষমতা তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে, অনবরত ঘামছে সে। এতটা ভয় এ জীবনে কোনদিন পায়নি সে।

সামনে এগিয়ে যাওয়ার মতো সাহস নেই তার মাঝে। তবুও বহুকষ্টে এগিয়ে গিয়ে সোফা থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিল। কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়াল করলো সায়েমের নম্বর।

দুটো রিং বাজতেই অপরপ্রান্ত থেকে ফোনটা কেটে দিল সায়েম। কোনো মানে হয়? যত রাগ সব এই মুহূর্তেই প্রকাশ করতে হবে মানুষটাকে?

নাজ আবারও ডায়াল করলো। এবার ফোনটা রিসিভ করে বিরক্ত গলায় সায়েম বলল, “কী সমস্যা তোমার?”

নাজ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আপনি এক্ষুনি বাসায় আসুন! আপনি না এলে আমি মরেই যাবো।”

(চলবে)