অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো পর্ব-০৯

0
395

#অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো
#পর্ব-৯
#সাবিকুন নাহার নিপা

শিশির আবারও বিন্তীর উপর রাগ দেখালো। বিন্তীকে গিয়ে বলল,

“সব তোমার জন্য হয়েছে। ”

বিন্তী শান্ত গলায় বলল, বাহ! তুমি ই তো এসেছিলে বাঁচাও বাঁচাও করতে!

“এত্তগুলা কথা কী আমি বলতে বলেছিলাম! বলিনি তো৷ ”

“তখন তো খুব বাহবা দিচ্ছিলে। আর এখন ফেঁসে গিয়ে সব দোষ আমার! তোমার নাম আসলে মীরজাফর হওয়া উচিত। ”

“চুপ করো মেয়ে। ঝামেলা পাকিয়ে আবার বড় বড় কথা। ”

দুজনের চূড়ান্তরকম ঝগড়া হলো। শিশিরের ফোনে একের পর এক ফোন আসতে লাগলো। বন্ধুরা আক্ষেপ করছে কেন জানানো হয় নি। আরেকদল বাসায় আসতে চাইছে বিন্তীকে দেখার জন্য। শিশির শেষমেস রেগেমেগে ফোন টা বন্ধ করে রাখলো। কোন কুক্ষনে যে বিন্তীর কাছে সাহায্য চাইতে গেছিলো! সেই ভেবে আরও কিছুক্ষন কপাল চাপড়ালো।

***
তুষার আজ বাসায় ফিরেছে তাড়াতাড়ি। বিন্তী ফোন করেছিল। তখনই টের পেয়েছে আবহাওয়া খারাপ। বাসায় ফিরতেই শিশির একগাদা নালিশ করলো। তুষার বলল,

“তুই ভাবীর সঙ্গে রাগ করছিস কেন? ঝুম্পা না ঝাম্পি কী যেন নাম মেয়েটার! ওই মেয়েটাই তো ফাজিল। ”

শিশির রাগী গলায় বলল, সবচেয়ে ফাজিল ওই ছেমড়িটা। বিন্তী।

বিন্তী সেই সময় হাজির হলো। রুক্ষ গলায় তুষার কে বলল,

“তুষার তোমার ভাইকে বলো সমস্যা যখন আমার জন্য হয়েছে তখন সমাধানও আমিই করব। ”

শিশির বলল,

“তুষার বলে দে যে অনেক হয়েছে। আর লাগবে না। আমারই ভুল। কেন যে মরতে ওর কাছে সাহায্য চাইতে গেছিলাম। ”

বিন্তী দ্বিগুণ রুক্ষ গলায় বলল,

“তুষার ওই লেডি বাবুর নাম্বারে ফোন করো। আমি কথা বলব। ”

শিশির বলল,

“তুষার এরপর বাড়াবাড়ি হলে কিন্তু খুব খারাপ হবে। ”

দুজনের মাঝখানে তুষারের অবস্থা শোচনীয়। একবার এদিকের কথা শুনছে তো অন্যবার ওদিকের কথা শুনছে। শেষমেস বিন্তীর কথায় তুষার ঝুম্পাকে ফোন করলো। শিশির রাগে ফুসতে লাগলো।

ঝুম্পা ফোন ধরে বলল,

“হ্যালো কে বলছেন?”

“আমি বিন্তী বলছি। ”

“বিন্নী কে?”

বিন্তী এমনিতেই রেগে ছিলো। তাই জোরেই বলল,

“তোমার বাবুর বউ। আমার নাম বিন্নী না। আমার নাম বিন্তী। ”

“হোয়াটএভার! ফোন কেন করেছেন?”

“শুনলাম আপনি আপনার ফেসবুক একাউন্টে কীসব হাবিজাবি লিখেছেন?”

“তো?”

“সেগুলো এখনই ডিলিট করুন। ”

ঝুম্পা তীর্যক হেসে বলল,

“থ্রেট দিচ্ছেন?”

“না। নরমালি বলছি। ”

“কিন্তু আপনার কথা তো শুনব না। ”

“সোজা আঙুলে কাজ না হলে আমিও কিন্তু আঙুল বাঁকাবো। ”

ঝুম্পা হো হো করে রাক্ষসীর মতো কিছুক্ষণ হেসে বলল,

“আপনি যাই করেন আমি ডিলিট করব না। বরং এরপর আপনার কথাগুলো পোস্ট করব। অলরেডি সব টা রেকর্ড হয়েছে। ”

শিশিরের চোয়াল ঝুলে পড়লো। পারলে এক্ষুনি লাফিয়ে পড়ে বিন্তীর হাত থেকে মোবাইল টা কেড়ে নেয়।

বিন্তী খানিকটা সময় নিয়ে বলল,

“আমিও ফোন টা রেখে সবার আগে আপনার বাড়িতে যাব। আপনার বাবুর সঙ্গে যে রোমান্টিক ম্যাসেজ আদান প্রদান হয়েছে সেগুলো স্ক্যান করে আপনার বাবাকে দেখাব। আর পুরো এলাকার দেয়ালে দেয়ালে লাগাব। এরপর রোমান্টিক ছবিগুলো বিলবোর্ডে টাঙানোর ব্যবস্থা করব। তারপর যাব সেইসব রেস্টুরেন্টে, যেখানে আপনি আর আপনার বাবু গান্ডেপিন্ডে গিলেছেন। সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করে লিখব যে আমার স্বামীর ঘাড় মটকে খাওয়াই আপনার কাজ। এতসব কিছুর পর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার রা তো দূরে থাক সুইপারও পাবেন না বাবু বানানোর জন্য। আর হ্যাঁ ইনস্টাগ্রামের ফলোয়ারও কিন্তু কমে যাবে। ”

ঝুম্পার সব বাতাস বেরিয়ে গেল। চিউ চিউ করে বলল,

“দেখুন… দেখুন…”

“রাখছি। এখন আমি থানায় এসেছি। আপনার নামে মানহানীর মামলা করব। ”

বিন্তী ফোন রেখে দিলো। স্পিকার বাড়ানো থাকায় শিশির আর তুষার সব টা শুনতে পেল। তুষার উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,

“ওয়াও ভাবী ইউ আর গ্রেট!”

শিশির চোরা চোখে তাকাচ্ছে। বিন্তী এখনো থমথমে মুখে বসে আছে। মিনিট খানেকের মধ্যে ঝুম্পা ফোন করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

“পোস্ট ডিলিট করেছি। ”

বিন্তী বলল,

“তবুও আমি এই কাজগুলো করব। ”

ঝুম্পা এবার কেঁদেই ফেলল। বলল, প্লিজ করবেন না। আমি আর কখনো শিশির কে বিরক্ত করব না।

“উঁহু। এসব শুনিয়ে লাভ নেই। ”

“প্লিজ! প্লিইজ!”

বিন্তী শান্ত গলায় বলল,

“বেশ। আরেকটা সুযোগ দিচ্ছি। এক্ষুনি নিজের টাইমলাইনে পোস্ট করুন যে যা লিখেছেন সব মিথ্যে। সব মানে সব, এমনকি শিশিরের বিয়েটাও মিথ্যে। ”

ঝুম্পা আর তর্কে গেল না। বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ এক্ষুনি লিখছি।

বিন্তী ফোন টা রেখে তুষার কে বলল,

“এবার তোমার চিরকুমার ভাইকে বলো ডজনে ডজনে প্রেম করে, যা খুশি করুক কিন্তু আমার কাছে যেন মরতে না আসে। ”

শিশির চোখ নামিয়ে নিলো। বিন্তী চলে গেল। তুষার শিশির কে বলল,

“তুই সব ব্যাপারে এতো অধৈর্য্য হোস কেন বলতো! ভাবীর যে মাথাভর্তি বুদ্ধি সেটা এতদিনেও বুঝলি না। ”

শিশির আমতা আমতা করে বলল, না মানে….

তুষার বলল, সবাই তোর মতো গবেট না এটা মনে রাখিস।

***
বিন্তী রেগেমেগে দরজা লাগিয়ে দিলো। শিরিন বাড়ি ফিরলো রাতে। তখনও বিন্তীর ঘরের দরজা লাগানো। ডেকে দরজা খোলালো। জিজ্ঞেস করলো, কিছু হয়েছে কী না! বিন্তী ঝগড়াঝাটির ব্যাপারে নিজে কিছু বলল না। আর তুষারকেও বলতে বারন করলো।

রাতে খাওয়ার সময় সবাই একসঙ্গে খেতে বসলো। শিশির, তুষার, শিরিন আর বিন্তী। শিশিরের বাবা আগেই খেয়ে নেয়। খেতে বসে শিশির বিন্তীর দিকে আড়চোখে তাকালো বারবার। তুষার সেটা খেয়াল করলো। বিন্তী ফিরেও তাকালো না। বিন্তীর এটেনশন পেতে শিশির বলল,

“ডালের বাটিটা একটু এদিকে দাও তো।”

ডালের বাটি শিরিন আর বিন্তী দুজনের হাতের কাছেই। বিন্তী নড়লো না। চুপচাপ খেতে লাগলো। শিরিন বাটিটা এগিয়ে দিলো।

তুষার ফিসফিস করে বলল,

“প্ল্যান ফেইল হলো। ”

শিশির কটমট চোখে তুষারের দিকে তাকালে তুষার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।

কয়েক মিনিট পর শিশির আবারও বলল,

“আজ তরকারিতে ঝাল কম হয়েছে মনে হয়। ”

শিরিন বলল,

“তুই কবে ঝাল খাওয়া শুরু করলি!”

শিশির থেমে গেল। তুষার আবারও ফিসফিস করে বলল,

“গাধা এভাবে কাজ হবে না। নাম ধরে বল। ”

শিশির গলা খাকারি দিয়ে বলল, বিন্তী একটা কাঁচা মরিচ নিয়ে আসো তো।

বিন্তী শিশিরের দিকে না তাকিয়েই উঠতে যাচ্ছিলো। শিরিন বলল,

“তুই গিয়ে নিয়ে আয়। তুইও যেমন খাচ্ছিস, ও তো খাচ্ছে। ”

শিশির দাঁতে দাঁত চেপে মরিচ আনতে গেল। মরিচ নিয়ে এসে প্লেটের পাশে রেখে বাকী ভাতটুকু খেয়ে উঠলো চুপচাপ।

***

বিন্তীর রাগ টা কিছুতেই কমছে না। যত ভাবে শিশিরের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি, ঝামেলা করবে না। তত যেন ঝামেলা লেগেই থাকে। আর শিশিরও কম না, একটু কিছু হলেই কথা শোনাতে শুরু করে। রাগ কমাতে বিন্তী একটা সাদা খাতায় শিশিরের কার্টুন মার্কা ছবি আঁকতে শুরু করলো। মাথায় দুটো শিং দিলো, পেছনে একটা লেজ দিলো। আঁকা শেষ হতে নিচে বড় বড় করে শিশিরের নাম লিখলো। এবার রাগ টা একটু কম হচ্ছে। নিজের আঁকা ছবি দেখে বিন্তী নিজেই হেসে ফেলল। এই ছবি যদি শিশির দেখতে পায় তাহলে ওর আর রক্ষে নেই। একদম খুন করে ফেলবে।

শিশির অবশ্য দেখতে এতো পঁচা না। দেখতে মোটামুটি ভালোই। গায়ের রং টা ফর্সা না হলেও শ্যামলা। চুলগুলো বড় বড়। কোনো কাট দেয়া নেই তবুও ভালো লাগে। গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। ক্লিন শেভ করেনা সেটাও ভালো। তাহলে দেখতে ছিলা মুরগীর মতো লাগতো।

নিজের ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হলো বিন্তী। শিশির কে নিয়ে এতো হাবিজাবি কেন ই বা ভাবতে যাচ্ছে ও! এই ছেলেটা ঝগড়া না করে শান্তি পায় না, আর ও কী না তার কথা ভেবে মরছে। বিন্তী মনে মনে বলল,

“না বিন্তী একদম না। শিশিরের কথা একদম ভাববি না। ”

সেইসম দরজায় খটখট আওয়াজ হলো। বিন্তী ভাবলো শিরিন এসেছে। তাই তাড়াতাড়ি শিশিরের আঁকা ছবিটা লুকিয়ে ফেলল। দরজা খুলে দেখলো শিরিন না শিশির দাঁড়িয়ে আছে। বিন্তী ও’কে দেখে ভেতরে চলে এলো। শিশির ঘরে ঢুকে বলল,

“স্যরি বিন্তী।”

বিন্তী চুপ করে রইলো। ও কিছু বলবেই না।

শিশির বলল, রেগে গেলে আমারও তোমার মতো মাথার ঠিক থাকে না।

বিন্তী মনে মনে বলল, তোর তো সারাদিন আমার সঙ্গেই রাগ থাকে। আর বাইরের মেয়েরা তো বাবু, সোনা!”

শিশির বলল,

“তোমার জন্য একটা চকলেট এনেছি। এটা খেলে রাগ কমে যাবে। ”

বিন্তী আবারও মনে মনে বলল,

“তোর চকলেট তুই খা। আর তোর ওই গাধী বাবুকে খাওয়া। ”

শিশির বলল,

“মৌনব্রত পালন করছ?”

বিন্তী চুপ করে রইলো। শিশির হাই তুলে বলল,

“ওকে। বুঝেছি। ”

শিশির চকলেট টা খাটের উপর রেখে বলল,

“গুডনাইট বিনী। ”

বিন্তী তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলল,

“আমার নাম বিন্তী। ”

শিশির হেসে ফেলল। বলল,

“বাহ! এই তো নিজের ফর্মে চলে এসেছো। তবে এখন থেকে আমি তোমাকে বিনী বলেই ডাকব। বি- নী! কিউট না!”

বিন্তী দাঁড়িয়ে গেল। শিশির দরজার কাছেই ছিলো। বিন্তীকে দাঁড়াতে দেখে ও সরে গেল। এই সুযোগে বিন্তী দরজাটা লাগিয়ে দিলো।

শিশির হেসে ফেলল। বিন্তীর ঘর থেকে ডাইনিং পেরিয়ে নিজের ঘরে আসার সময় শিরিনের সঙ্গে দেখা হলো। শিরিন বলল,

“বিন্তীকে কাল নিজের ঘরে নিয়ে যাস। সেখানে যত খুশি ঝগড়া করিস দরজা বন্ধ করে। ”

শিশির অপ্রস্তুত হলো। খানিকটা লজ্জাও পেল। কী আশ্চর্য! ওর কেন লজ্জা লাগছে! মা যা ভাবছে সেরকম কিছু তো না! ও তো গিয়েছিল বিন্তীর রাগ ভাঙাতে।

চলবে…