#অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো
#পর্ব-১০
পরদিন সকালে শিশির বেরিয়ে যেতেই শিরিন এসে বিন্তীকে বলল,
“বিন্তী তুমি আজ থেকে শিশিরের ঘরে গিয়ে থাকবে। ”
বিন্তী অবাক গলায় বলল,
“কেন আন্টি?”
“উঁহু ভুল বলেছি। ওই ঘরটা তোমারও। তুমি তো আর গেস্ট না যে এখানে থাকবে। ”
“কিন্তু আমার তো কোনো সমস্যা হচ্ছিলো না আন্টি। ”
“আমাদের সমস্যা হবে। শিশিরের ফুপু আসছেন গ্রাম থেকে। আগের দিনের মানুষ। মুখে যা আসে বলে ফেলেন। তিনি এই ব্যাপার টা ভালো চোখে দেখবেন না। ”
বিন্তী আর কথা বাড়ালো না। শিশিরের ঘরে জিনিসপত্র নিয়ে শিফট হয়ে গেল। এই ঘরে বিন্তী আগেও এসেছে কিন্তু ভালো করে খেয়াল করে দেখেনি। বিশাল বড় ঘরে আসবাবপত্র বলতে একটা আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, একটা ককম্পিউটার আর খাট। বাকী জায়গাগুলো ফাঁকাই পড়ে আছে। বিন্তীর সুবিধার্থে ঘরে একটা টেবিল আর আলমারি আনানো হলো। শিরিন বলল,
“বাকীসব দুজনে মিলে শেয়ার করে নিও। ”
বিন্তী আমতা আমতা করে বলল,
“আপনি এগুলো এনেছেন চাচী? শিশির তো এই নিয়ে আবার ঝগড়া শুরু করবে। ”
“তুমি আমার কথা বলে দিও। আরেকটা কথা শোনো বিন্তী, তুমি শিশিরের ঝগড়াঝাটি খুব একটা পাত্তা দিও না। চুপচাপ থেকো। কথার পিঠে কথা বললে শয়তান শায়েস্তা হয় না, কিন্তু চুপ করে থাকলে শায়েস্তা হয়। ”
বিন্তী হেসে ফেলল। শিরিন বলল,
“ঘর টা নিজের মতো গুছিয়ে নাও। এটা তোমারও ঘর। তুমি শিশিরের ঘরে থাকছো এমনটা ভেবো না। ”
বিন্তী হাসলো। এই বাড়ির সবাই ই ভালো। তুষার ভালো, চাচা, চাচী দুজনেই ভালো। শুধু যার একটু বেশী ভালো হওয়ার দরকার সে একটু ভিলেনের ক্যারেক্টার প্লে করছে।
ঘরটা মোটামুটি গোছগাছ করে বিন্তী বারান্দায় বসলো। বারান্দাটা একদম খালি। কিছু গাছ লাগালেও তো পারে। এবাড়ির লোকের মনে হয় গাছপালা তেমন পছন্দ না। চাচী যতই বলুক এটা ওর ঘর কিন্তু আরেকজন কী সেটা মানবে! যদি মানে তাহলে ও কিছু গাছ আনবে। কিছু কাঠগোলাপ এনে লাগাবে টবে।
বিন্তীর হাতে কাজ নেই এখন। দুপুরের খাওয়ার পর শিরিন খানিকক্ষন ঘুমায়। এই সময় টা বিন্তীর খুব একা লাগে। পড়াশোনা করতেও ইচ্ছে করে না। বাড়ি থেকে ব্যাগভর্তি করে বই আনলেও এখনো সেগুলো খুলে পর্যন্ত দেখেনি। ইচ্ছেই করে না।
বিন্তী শিশিরের দেয়া ডাইরি টা খুলে বসলো। কলম হাতে নিয়ে লিখতে শুরু করলো,
“শিশির আমাকে শত্রুপক্ষ ভাবছে। সম্পর্কের শুরুটা কিন্তু চমৎকার একটা বন্ধুত্ব থেকেও হতে পারতো। শিশির যদি সুন্দর করে বলতো, বিন্তী তুমি তোমার পথে, আমি আমার পথে। তাহলেই কিন্তু সব টা সহজ হয়ে যেত। ও ব্যাপার টা জটিল করে ফেলল। আমিও সেই সঙ্গে তাল মেলালাম। অদ্ভুত ব্যাপার হলো শিশির পুরোপুরিই আমার মতো। পার্থক্য শুধু একটাই যে ও ওর রাগ টা যখন তখন যেখানে সেখানে দেখাতে পারে। আর আমি পারিনা। ”
এইটুকু লিখে বিন্তী ডায়েরি বন্ধ করে দিলো। কীসব হাবিজাবি লিখছে। বারান্দায় আরও অনেকক্ষন বসে রইলো। কখন যে চোখ টা লেগে গেল টেরও পেল না। ঘুম ভেঙেছে শিশিরের ধাক্কায়।
শিশির ডেকে বলল,
“এই বিন্তী! এখানে ঘুমাচ্ছো কেন!”
বিন্তী চোখ কচলে তাকালো। বসা অবস্থায় ঘুমানোর জন্য ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেছে। শিশির বলল,
“এটা কী ঘুমানোর জায়গা?”
“না ওই চোখ টা লেগে গেল আর কী…
শিশির ঘরে আসতে আসতে বলল,
“ঘরে এসে ঘুমাও। ওখানে ঘুমালে আশেপাশের লোকজনের চোখে পড়বে। তারা আবার বলবে যে বিয়ে করে বউকে বারান্দায় থাকতে দিচ্ছি। ”
বিন্তী হাসলো। শিশির মাত্রই ফিরেছে। ঘরের পরিবর্তন দেখেও কোনো প্রশ্ন করলো না। বিন্তী জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি চা খাবে?”
শিশির চোখ কপালে তুলে বলল,
“তুমি চা বানাতে পারো?”
“চিনি কী দুই চামচ?”
“দাও। দেখি কেমন চা বানাও!”
বিন্তী চা বানাতে গেল। শিরিন মাত্র উঠেছে। বেশীক্ষন ঘুমানোর কারনে মাথা ধরেছে। বিন্তী বলল,
“চাচী আপনার জন্যও চা নিয়ে আসি। ”
“আচ্ছা। শিশির কিছু বলল?”
“না। ”
শিরিন নিঃশব্দে হাসলো। শিশির যে কিছু বলবে না সেটা আগেই বুঝেছে। ছেলে যতই ঝগড়া করুক, বউকে মাঝেমধ্যে চোখে হারায় সেটা টের পেয়েছে। এই যেমন আজ ঘরে ঢুকেই আগে জিজ্ঞেস করেছে, বিন্তী কোথায়!
***
বিন্তী শিশির কে চা দিলো। শিশির চা খেয়ে বলল,
“খারাপ না। তুমি সত্যিই রান্না করতে পারো? নাকি শুধু গরম পানি ভালো পারো?”
বিন্তী বলল,
“পারি অল্পবিস্তর। ”
“কী কী রান্না করতে পারো? সবচেয়ে ভালো কী পারো? ডিম সেদ্ধ করতে?”
“তোমার কেন বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি রান্নাবান্না পারি ?”
“না আমি তো জানি মেয়েরা শুধু খেতেই ভালো পারে।”
বিন্তী একটু কর্কশ গলায় বলল, সবাইকে তোমার দেখা ওই একজন ঝাম্পির সঙ্গে তুলনা করা বন্ধ করো শিশির।
“ঝাম্পি না, ঝুম্পা। ”
“সে যাই হোক। ”
শিশির হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া গলায় বলল,
“আচ্ছা একটা কথা। তুমি কী ঝুম্পার প্রতি জেলাস?”
বিন্তী বিস্মিত গলায় বলল,
“আমি জেলাস হবো কোন দুঃখে?”
“তোমাকে দেখে মনে হলো। কাল যেভাবে ঝুম্পার সঙ্গে আমার স্বামী, আমার স্বামী করে চুল ছেড়াছেড়ি করলে!”
বিন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এইজন্যই বলে কারো ভালো করতে নেই। ঢের শিক্ষা হয়েছে।
“পর কোথায়? ছয়ঘন্টা না ঘুমিয়ে, সারারাত জার্নি করে বিয়ে করতে যাওয়া বর আমি তোমার। ”
বিন্তী চোখ কপালে তুলে বলল,
“আচ্ছা!”
“হু। এমন ডেঞ্জারাস জিনিস আমি ছাড়া আর কেউ বিয়ে করতো?”
“আমিও তাই ভাবি। এমন ইবলিশ আমি ছাড়া আর কেউ সহ্য করতো। ”
শিশির ঠান্ডা গলায় বলল,
“আমাদের কনভার্সেশন কিন্তু ঝগড়ার দিকে যাচ্ছে বিন্তী। ”
বিন্তী সচেতন হলো। ঠান্ডা গলায় বলল,
“সরি। ”
শিশির বলল,
“চলো আমরা একটা চুক্তি করি। ”
“কী চুক্তি?”
“আমরা কেউই ঝগড়াঝাটি করব না। তুমি উল্টাপাল্টা কথা বলবে না। আমিও আর তোমাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলব না। ”
“আচ্ছা। ”
“আরেকটা ব্যাপার। ”
“কী?”
“আমার ঘরে থাকতে এসেছো তাতে কোনো সমস্যা নেই। আমার কোনো ব্যাপারে নাক গলাবে না। ”
“আমার অতো ইচ্ছেও নেই।”
“ধরো আমি রাত জেগে বান্ধবীদের সঙ্গে কথা বলতে পারি। তুমি কিন্তু তখন জেলাস হতে পারবে না। ”
বিন্তী শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল,
“ভাবখানা এমন যে আমি তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। ”
“হতেও তো পারে। এরেঞ্জ ম্যারেজে প্রেম ভালোবাসা তো বিয়ের পর একটু একটু করেই হয়। ”
“সেটা অন্যদের ক্ষেত্রে হতে পারে। তোমার আমার হবে না শিওর থাকো। ”
“ওকে নিশ্চিন্ত হলাম। বাই দ্য ওয়ে চা’টা ভালো ছিলো। তুমি এমনিতে নাগা মরিচ হলেও চা কিন্তু বেশ মিষ্টি ছিলো। ”
কথাটা বলে শিশির হাসলো। বিন্তী রাগতে গিয়েও হেসে ফেলল।
***
রাতে ঘুমাতে গিয়ে মাঝখানে বালিশ রাখা হলো। শিশির বলল,
“না রাখলেও হতো। ঘুমের ব্যাপারে তুমি ভালো মেয়ে। আই লাইক ইট। ”
বিন্তী কোনো কথা বলল না। চুপচাপ শুয়ে পড়লো। শিশির লাইট নিভিয়ে দিয়ে বলল,
“বিন্তী! ”
“বলো। ”
“তুমি যে বললে আমাদের কোনোদিন প্রেম হবে না। এটা কীভাবে শিওর হলে?”
“তুমি আমি দুই মেরুর লোক। তুমি উত্তর মেরু আর আমি দক্ষিন মেরু। ”
শিশির হেসে বলল,
“আচ্ছা। ”
বিন্তী কৌতুক করে বলল,
“কেন বলোতো? তুমি আবার প্রেমে টেমে পড়ে গেলে। ”
“নাহ। তবে একটা কথা কী জানো?”
“কাল কী হবে সেটা আমরা কেউ জানিনা। ঢাকা থেকে ডেকে নিয়ে বাবা যে আমার কপালে তোমাকে জুটিয়ে দিবে সেটা কিন্তু আমি জানতাম না। জানলে জীবনেও যেতাম না। তুমিও নিশ্চয়ই গায়ে হলুদের আগের রাতে জানতে না যে তোমার প্রেমিকের সঙ্গে তোমার বিয়েটা হবে না। জানলে নিশ্চয়ই সেই রাতে তোমার ঘুম হতো না।
জীবন টা এমনই বিন্তী। কালকের খবর আমরা কী আর জানি? কে জানে পাশাপাশি থেকে, ঝগড়াঝাটি করে, চলতে চলতে একজন আরেকজনকে ভালোবেসে ফেললাম!”
বিন্তী তন্ময় হয়ে শুনছিল। শিশির মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে বিন্তীকে দেখে হেসে ফেলল। বলল,
“ঝগড়াঝাটি থেকে মান, অভিমান হয়। আবার রাগ থেকেই তো অনুরাগ আসে। ”
শেষ কথাটা বলে শিশির একটা চোখ টিপে বলল,
“গুড নাইট। ”
চলবে…..