অবাধ্য বাঁধনে পর্ব-১+২

0
399

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১]

১.
” ধারের টাকা দিতে না পারলে মেয়ে বউকে বিক্রি করে দে।আমরাই কিনে নিব।”

একজীবনে এতটা অপমান কখনোই হননি মুজাহিদ হাসান।এই মুহুর্তে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে মন চাইছে তার।নত মস্তকে ঢোক গিলে দ্রুত চোখ বুঝলেন।চোখটা কেমন জ্বালা করছে বাচ্চাদের মতো হামাগুড়ি দিয়ে কাঁদতে পারলে বোধহয় একটু শান্তি পাওয়া যেত।

” কিরে টাকা দিবি?নাকি তোর মেয়ে বউকে নিয়ে যাব?”

চোখ তুলে তাকালেন মুজাহিদ হাসান।মাথা ঘুরাতে ভেতরের কক্ষের পর্দার আড়ালে উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীর চোখে চোখ রাখতে লজ্জায় চোখ ঘুরিয়ে নিলেন তিনি।

” আমাকে আর কয়েকটা মাস সময় দিন।স্যারের সাথে আমি যোগাযোগ করবো।”

“টাকা দিবি বলে দেড় বছর সময় পার করলি আমাদের টাকা চাই মানে এই সাপ্তাহেই চাই।”

” কিন্তু…”

” কোন কিন্তু না।তুই টাকা দিবি।না হলে তোর মেয়ে বউকে দে তাদের আমরাই বেঁচে টাকা নিয়ে…”

এতক্ষণ যাবৎ নোংরা কথায় লিপ্ত থাকা লোকটি সহসা চুপসে যায়।গালের তীব্র জ্বালায় পাশ ফিরে তাকাতে রোষানলে চেয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,

” তোর সাহস কতখানি তুই আমার গালে চড় দিস।”

” এখান থেকে না গেলে হাত পা ভেঙ্গে ফেলবো।”

” কু**বাচ্চা তোর এত দেমাক।তোরে বেচার ব্যবস্থা আমি করবো।”

মুজাহিদ হাসান মেয়ের এমন দুঃসাহস দেখে অবাক হলেন।আসন্ন বিপদের কথা মাথায় আসতে দ্রুত হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসেন মেয়েকে।

” ঈশু মা তুই ভেতরে যা।”

” এরা কারা বাবা?এত খারাপ খারাপ কথা বলছে আর তুমি সহ্য করে নিচ্ছো?”

” আমার ব্যপার আমি বুঝবো তুই যা।”

” আমি যাব না।”

ঈশার দৃঢ় কথায় তেঁতে উঠলেন মুজাহিদ হাসান।কিন্তু তার আগেই ঈশার হাত ধরে নেয় রাগান্বিত লোকটি।

” কই যাস তুই?তোরে আমি দেখতাছি।”

এমন বিদঘুটে পরিস্থিতিতে একটুও ঘাবড়ালো না ঈশা।বরং মেয়েটার মাঝে জেদ যেন উপড়ে পড়ছে।পায়ে থাকা জুতা দ্রুত হাতে তুলে লোকটির গালে তৎক্ষণাৎ বেশ কয়েক ঘা লাগিয়ে দেয়।আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের দল দ্রুত ধরে নেয় ঈশার হাত।

” এখান থেকে চলে যান।”

” কু*বাচ্চা, পাওনা আশি লক্ষ টাকা আর তোরে দুইটাইরেই নিয়া যামু।বেশি সাহস দেখাইসত এই সাহসের দাম দিবি তুই।”

অতিদ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় লোকগুলো।ঈশা ততক্ষণে সোফায় বসে যায়।প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে মুজাহিদ হাসানকে বলে,

” আশি লক্ষ টাকা!এসবের মানে কি বাবা?”

পর্দার আড়াল ছেড়ে ততক্ষণে বেরিয়ে আসেন ঈশার মা সুলতানা।মেয়ের এমন অসংগত সাহসে তিনি বড্ড ঘাবড়ে গেছেন।

” এসব তোর জানতে হবে না।তুই এমনটা কেন করেছিস ঈশু?এবার তোর নিরাপত্তা কে দিবে ?তোর কিছু হয়ে গেলে…”

” আমি যা জানতে চাই তা বলো।বাবা আশি লক্ষ টাকা কেন নিয়েছেন?”

” তোর বাবা এই টাকা নেয়নিরে মা।”

” তাহলে?”

” তোর চাচা ধার করেছে।সাক্ষি হিসেবে তোর বাবা উপস্থিত ছিল।তোর চাচা পাওনা টাকা শোধ করতে না পেরে পালিয়ে যান।”

ঈশা অবাক চোখে তাকায় তার বাবার দিকে।মুজাহিদ হাসান কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছেন।

” বাবা, এসব কি বলছে মা?

” আমি জানতাম না তোর চাচা এত টাকা ধার করেছে।আমি জানতাম ব্যবসার কাজে সে পঁচিশ লক্ষ টাকা নেবে কিন্তু আমাকে বোকা বানিয়ে এভাবে ফাঁসিয়ে দিল।সে তো পালিয়েছে এবার সব দায় আমার ঘাড়ে।”

২.

হাতে থাকা পাজেলটা বেশ কায়দা করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এক করতে ব্যস্ত ঈশান।তার সামনে একের পর এক অভিযোগ জানিয়ে যাচ্ছে ইসমাইল নামক ব্যক্তিটি।তার অভিযোগ পাওনা টাকা চাওয়ায় মুজাহিদ হাসানের মেয়ে তাকে জুতা মে/রেছে, গালে চড় মে/রেছে।কতটা সাহস এই মেয়ের ভাবা যায়!ঈশানের হাভ ভাবে মনে হচ্ছে এসব কথা সে কিছুই কানে তুলছে না অথচ ভেতর থেকে সে ক্রোধটাকে দমন করার চেষ্টায় আছে।

” মিস্টার ইসমাইল আপনার উচিত ছিল মুজাহিদ সাহেবকে তুলে আনা।আমি শেষ সময় তাকে আজকেই দিয়েছিলাম অথচ তিনি আজকেও আমার টাকা পরিশোধ কর‍তে ব্যর্থ।”

” মাত্র ছয় লক্ষ টাকা আমার হাতে দিয়ে বলেন বাকিটা পরে দেবেন।এবার আপনি বলুন স্যার আমি কি কর‍তে পারি?এরপর যখন গরম হয়ে গেলাম তখন ওঁনার মেয়ে এসে তামাশা করে গেল।স্যার আপনি কি করবেন জানি না তবে এই মেয়ের জীবন আমি শেষ করেই ছাড়বো।”

” আপনার বর্ননা শুনে মনে হচ্ছে মেয়েটা ডেঞ্জারাস তবে এই ঈশান শাহরিয়ারের থেকে বেশি ডেঞ্জারাস নয়।রাসেল গাড়ি বের কর।”

ঈশান শাহরিয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার বন্ধু রাসেল আদেশ পেয়ে ছুটে যায়।

ঈশাদের ফ্লাটের বাইরে বাদ বাকি ফ্লাটের সদস্যদের কানাঘুষা চলছে।গুন্ডাদের হুমকি দামকি সকলেই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পরখ করেছে।এখন প্রতিবেশিদের একটাই কাজ আলোচনা সমালোচনা করা।ঈশার মা সুলতানা দরজা খুলতেও দ্বিধায় আছেন পাশের ফ্লাটের ভাবীদের নানান কথার সম্মুখে পড়লে তিনি কি জবাব দেবেন ভেবে পাননা।

ঘরের ভেতরে বসে সবাই যখন চিন্তায় মগ্ন ঠিক সেই সময় পরপর বেশ কয়েকবার বেজে উঠে ডোর বেল।মুজাহিদ হাসান ভয়ার্ত চোখে তাকালেন সুলতানার দিকে।মেয়ের ক্ষতি হওয়ার ভয়ে তিনি যেন দিশাহীন হয়ে পড়েছেন।

” ঈশা মা তুই এখান থেকে যা।তোর রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে রাখ।প্রয়োজনে আলমারির পেছনে লুকিয়ে পড়।এরা গুন্ডা,সন্ত্রাস তোর ক্ষতি করতে ছাড়বে না।”

” বাবার ক্ষতি করবেনা?আমি কোথাও যাব না মা।”

” তোমার মা যা বলছে তা শুনো ঈশা।”

” বাবা তোমরা যখন মাসের পর মাস এই সত্যিটা আমার কাছে আড়াল করেছো তখন তোমাদের কোন কথা শোনার ইচ্ছে আমার নেই।”

” তোর এত কথা শোনার সময় এখন নয়।”

সুলতানা হাত টেনে ভেতরের কক্ষে নিয়ে যান ঈশাকে।এতক্ষণ আলোচনার মাঝে বিরতিহীন বেল ডোর বেজেই চলেছে।ঈশার ত্যাড় কথা হেরে গিয়ে ভয়ে ভয়ে দরজা খুলতে এগিয়ে যান মুজাহিদ।।দরজা খুলতে মুখোমুখি হয়ে পড়েন ঈশান শাহরিয়ারের।ছেলেটা ফিচেল হেসে হাতে থাকা পিস্তল ঠেকে ধরেন মুজাহিদ হাসানের কপালে।ঈশান ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে যায় মুজাহিদ হাসান তত পিছিয়ে যায়।ঈশানের পেছন পেছন হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করে একদল গার্ড।

” চোরের মায়ের বড় গলা কথাটা শুনেছেন মুজাহিদ সাহেব?”

” জ..জি স্যার।”

” আপনার কাহিনী ঠিক সেটাই হয়েছে।আমার টাকা না দিয়ে আমার লোকের গায়ে হাত।”

” ভু..ভুল হয়ে গেছে স্যার মাফ করে দিন।”

” কাজটা করার আগে মাথায় ছিল না ঈশান শাহরিয়ারের কথা?”

মুজাহিদ হাসান নড়তে পারলেন না।কেননা তার মাথায় ঈশানের পিস্তল ঠেকে আছে।

” আপনার ভাই বেঈমানি করেছে আমার টাকা পরিশোধ না করে পালিয়েছে আপনিও কী পালাতে চান?”

” ন..না স্যার।”

” আপনি পালাতেও পারবেন না মুজাহিদ সাহেব।পালানোর রাস্তা যে বন্ধ করে দিয়েছি।আপনার মেয়ে কই?”

বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো মুজাহিদের।ঈশার ক্ষতির কথা ভেবে দ্রুত বলেন,

” আমার মেয়ে এখানে নেই স্যার সে চলে গেছে।”

” চলে গেছে মানে?কোথায় গেছে?”

মুজাহিদ হাসান মুখ খুললেন না।ভয়ার্ত চোখে চেয়ে রইলেন ঈশানের দিকে।

” কথা বলছেন না কেন?মেয়েকে কোথায় পাঠিয়েছেন?”

” জানি না।”

” জানি না মানে?”

ঈশানের ধমকে কেঁপে উঠলেন মুজাহিদ।ঈশান ততক্ষণে দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত।

” আমার মেয়ের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি স্যার।সে ছোট মানুষ একটা ভুল করে ফেলেছে।”

” কতটা ছোট সে আমি দেখতে চাই।কতটা ছোট হলে সে ঈশান শাহরিয়ারের লোকের গায়ে হাত তুলে আমি দেখতে চাই।”

ঈশানের গর্জনে ঘাবড়ে গেলেন মুজাহিদ।মেয়ের বিপদের কথা ভেবে প্রচন্ড দূর্বল হয়ে পড়ছেন তিনি।ঈশানের হাতে থাকা পিস্তল সরিয়ে দেয়ালে থাকা টিভিতে শ্যুট কর‍তে বিকট শব্দে ভেঙ্গে চুরে কাঁচ ছড়িয়ে যায়।ভেতরের কক্ষ থেকে গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠে ঈশা।বাবার ভয়ে সুলতানার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটে চলে যায় সামনের কক্ষে।ততক্ষণে ঈশান মুজাহিদ হাসানের শার্টের কলার চেপে ধরেছে।

এমন পরিস্থিতি নিজের চোখে দেখে বাবার অপমান মোটেও সইতে পারলো না ঈশা।তৎক্ষণাৎ সে নিজের সবটা শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ঈশানকে।
আকস্মিক ধাক্কা গার্ডদের গায়ে ছিটকে পড়লো ঈশান।ততক্ষণে তার চোখে সামনে ভেসে উঠেছে রণমত্ত ন্যায় রোষানলে জ্বলতে থাকা এক রমণীর প্রতিচ্ছবি।যার রক্তিম চোখের কোণে ঝলকে পড়ছে নোনা জল।

” আপনার টাকা আমার বাবা ধার নেয়নি যে তাকে এত হয়রানি করবেন।যে টাকা নিয়েছে তাকে খুঁজে বের করুন।মানলাম আমার বাবা সাক্ষী ছিলেন কিন্তু তাই বলে এতগুলো টাকা এত অল্প সময়ে শোধ কর‍তে পারবে এটা কেমন ধারণা আপনাদের?বাড়িতে গুন্ডা পাঠিয়ে কি প্রমাণ করতে চাইছেন টাকা আমরা লুকিয়ে রেখেছি?গুন্ডা পাঠালে ভয়ে টাকা বের করে দিব?”

“মেয়ে তুমি কার গায়ে হাত দিয়েছো চেনো না তুমি আমায়।”

ঈশানের রাগি কথার সুরে তাচ্ছিল্য হাসলো ঈশা।

” চিনি না আপনাকে।আর চিনতেও চাই না।কে আপনি?”

” আমি ঈশান শাহরিয়ার অক্ষরে অক্ষরে চিনিয়ে ছাড়বো আমি কে।”

” এতটা সময় আমার কাছে নেই।শুনে রাখুন এক বছর সময় নিলাম, এই এক বছরে আপনার সম্পূর্ণ পাওনা টাকা শোধ করে দিব।এখন আসতে পারুন।”

ঈশার কথায় রীতিমতো অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো ঈশান।সেই অবাকের সাথে মিশে আছে রাগ জেদ তীব্র অপমানের আভাস।রাসেল পাশ থেকে দাঁড়িয়ে চুপচাপ পরখ করছিলো ঈশানকে।ঈশান শাহরিয়ার নামক আপদ্’টাকে হয়তো মেয়েটা চিনে না জানে না।

ঈশান কপট হেঁসে নড়ে চড়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো ঈশার।তাদের মাঝে কিঞ্চিৎ দূরত্ব সাদৃশ্যমান।মুজাহিদ হাসান মেয়ের হাত টেনে দ্রুত সরিয়ে হাত জোর করে ক্ষমা সুরে ঈশানকে বলেন

” আমার মেয়েটাকে ক্ষমা করুন স্যার।মেয়েটা না বুঝে আপনার সাথে বেয়াদবি করেছে।”

” ক্ষমা?আপনার মেয়ে যখন সময় নিয়েছে তখন আমিও দেখতে চাই এক বছরে সে কি কি করে।অল দা বেস্ট আশা করি আপনার আগামীর দিন শুভ হবে।”
#চলবে___

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২]
___________________
” ঈশা মা তুমি যা করেছো কাজটা মোটেও ভালো করোনি।এতটা সাহস দেখাতে তোমায় কেউ বলেছে?”

” যা করেছি বেশ করেছি বাবা।গুন্ডা বদমাইশ গুলো যদি তোমার ক্ষতি করে দিত?”

” কখনোই করতো না।”

” এতটা বিশ্বাস?”

ঈশার প্রশ্নে চুপ হয়ে যান মুজাহিদ হাসান।পাইচারি থামিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে এক গ্লাস পানি তুলেন মুখ।পাশে বসে বিড়বিড় শব্দে কাঁদছেন সুলতানা।ঈশার এমন দুঃসাহসিক কাজের মূল্য চুকাতে হবে তাকে,হয়তো আজকের পর থেকে তাদের জীবনে আরো করুন দশা নেমে আসবে।মেয়ের বিপদজনক ভবিষ্যতের কথা ভেবে ক্রমশ কান্না বাড়ছে সুলতানার।

” বাবা চাচা পালিয়েছেন তাও এত টাকা নিয়ে তুমি এত কথা আমায় আগে জানাওনি কেন?”

” তুমি এসব জেনে কি করবে?তোমার কাজ নিজেকে নিয়ে ভাববে এর বাইরে তোমার ভাবা উচিত নয়।”

” আমি তোমাদের কেউ না বাবা?তোমাদের নিয়ে ভাবার কি অধিকার আমার নেই?”

ঈশার অভিমান হলো চপল পায়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল কক্ষ ছেড়ে।মুখের কথায় একটা বছর সময় নিয়েছে ঠিকি তবে এই একবছর বেশি কিছু সময় নয়।আশি লক্ষ টাকা তাদের মতো সাধারণ পরিবারের জন্য আকাশকুসুম কল্পনা বলা চলে।তবুও তাকে কিছু কর‍তে হবে ঈশান শাহরিয়ারের মুখের উপর ছুড়ে মারতে হবে সেই টাকা।

৩.
অন্ধকার কক্ষে ফোন স্ত্রুল করতে করতে ঝিমিয়ে উঠছে ঈশান।হাত পা টান টান করে বিছানায় বসতে অন্ধকার কক্ষে আলোর ফালি নিয়ে আসে রাসেল।দরজা খুলতে আলোর ফালি যখন কক্ষে প্রবেশ করে তখন বিরক্তে মুখ কুচকায় ঈশান।রাসেল নিশ্চুপে এগিয়ে যায় ঈশানের কাছে।বিছানার এক কোনে হাটু ভেঙ্গে বসে বলে,

” রেগে আছিস? ”

” রেগে থাকবো কেন?”

” ঈশা মেয়েটার কারণে।”

” ঈশা কে?”

বিরক্তে মুখটা কুচকে ফেললো রাসেল।ঈশান যে এই বিষয়টা আড়াল করতে চাইছে তা বেশ ভালো ভাবেই বোঝা যাচ্ছে।

” অন্ধকার রুম মানেই তুই রেগে আছিস।”

” কেন এসেছিস এখানে সেটা বল।”

” আঙ্কেল আন্টি ফোন করেছে তুই নাকি বারবার তাদের কল কেটে দিচ্ছিস।”

“ভালো লাগছে না তাই।”

রাসেল উঠে এলো, কক্ষের আলো জ্বালাতে চোখে এলো ঈশানের রক্তিম মুখ।দুচোখ কেমন লাল হয়ে আছে ছেলেটা যে ভয়াবহ রেগে আছে তা আর বুঝতে বাকি নেই তার।

” কন্ট্রোল কন্ট্রোল এত রেগে যাচ্ছিস কেন?”

” তুই এখানে কেন এলি?আমি আমার মতো ঠিক ছিলাম।”

” আমি কিছু কথা বলতে এসেছি।তুই ঈশা মেয়েটার ব্যপারে কি ভাবেছিস?”

” কি ভাববো?”

” তুই যে রিভেঞ্জ নিতে পছন্দ করিস তা আমি জানি এত ঝামেলার পরেও তুই এই বিষয়ে চুপ ব্যপারটা কেমন না?”

ঈশান উঠে দাড়ালো আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে চুল ব্রাশ করে রাসেলকে ঈশারা করে তার সাথে আসতে।

শহরের অলিতে গলিতে ঝাপিয়ে নেমেছে অন্ধকার।কালো আকাশের মাঝে চিকচিক করছে তারাদের দল।মুক্ত আকাশের দিকে চোখ রেখে কিঞ্চিৎ ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো ঈশান।আকাশের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চোখ রাখলো বহুতল ভবনের দিকে।তিন রাস্তার মোড়ের ঈশাদের ফ্লাট। ঈশান দাঁড়িয়ে আছে বামে মোড় নেওয়া রাস্তার গলিতে।

” এখানে আমরা কি করছি?”

রাসেলের প্রশ্নের প্রত্যুত্তর করলো না ঈশান।বরং তার সাথে থাকা দুজন গার্ডকে ঈশারা করলো সঙ্গে সঙ্গে দুজন গার্ড ভারি ভারি ভাঙ্গা ইটের টুকরো নিয়ে ছুড়ে ফেললো ঈশাদের জানলায়।তাদের নিশানা একদম সঠিক পর্যায়ে ছিল।চোখের পলকে ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গে গেল কাঁচের জানলা দ্রুত গাড়িতে উঠে এলাকা প্রস্থান করলো ঈশান সহ বাকি সদস্যরা।

” ওহ গড তুই এটা কি করলি ঈশান!”

” কি করেছি?”

” তুই ওদের জানলা ভেঙ্গে দিলি?এসব ছাড় ঈশান একবছর সময় যখন নিয়েছে তখন নিশ্চয়ই টাকা ফেরত দেবে।”

রাসেলের কথায় অতিদ্রুত ব্রেক কষালো ঈশান দাঁতে দাঁত চেপে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো জানলার বাইরে।

” মেয়েটার জন্য এত দরদ কেন তোর?মেয়েটার মাঝে কি অন্য কিছু খুঁজে পেয়েছিস?”

” ঈশান লিমিট ক্রস করিস না।”

” লিমিট ক্রস তুই করছিস।আর একটা কথা বলবি না আমার সামনে।”
.

মধ্য রাতে যখন সকল চিন্তার অবসান ঘটিয়ে ঘুম নামলো সবার চোখে ঠিক সেই মুহুর্তে বিকট ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গে গেল ঈশার কক্ষের জানলার কাচ।ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে বসে রইলো সে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার মস্তিষ্ক যেন অচল হয়ে পড়েছে ততক্ষণে তার কক্ষে প্রবেশ করেন মুজাহিদ এবং সুলতানা।

” ঈশু তুই ঠিক আছিস।”

” হ্যা আম্মু।জানলার কাঁচ ভাঙলো কে?”

মুজাহিদ হাসান চারিদিকে সর্তক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।নিসন্দেহে তিনি ভেবেই নিয়েছেন এমন কাজ ঈশান শাহরিয়ারের লোক করেছে।

” মাত্র তো জানলার কাঁচ ভাঙ্গলো এরপর গিয়ে দেখ আরো কী কী করে।”

মুজাহিদ হাসানের ভয়ার্ত কণ্ঠে ঢোক গিলে তাকায় ঈশা এই মুহুর্তে তার সত্যি ভয় করছে আগের মতো সাহস কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

৪.
ঈশাদের ফ্লাটের সামনে অস্থির পায়ে পাইচারি করছে তার বন্ধু অনু।মেয়েটার সাথে ঈশার ছোট বেলার বন্ধুত্ব, যার রেশ টিকে আছে এখনো।অনুর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে উপস্থিত হয় ঈশা।

” এতটা দেরি করলি কেন?”

” সরি সরি আসলে ঘুম থেকে দেরিতে উঠেছিলাম।”

” ঈশা গতকাল ঠিক কি হয়েছে?এলাকার সবাই তোদের নিয়ে বলাবলি করছে।”

” কি বলছে সবাই?”

” সে সব ছাড় হয়েছে কী সেটা বল।”

ঈশা যেতে যেতে অনুর কাছে সবটা খুলে বলে।তাদের কথার মাঝে পছন্দের রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে।

” আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আঙ্কেল আন্টির কথা ঠিক তোর ওদের সাথে তর্ক করা উচিত হয়নি।”

” তুই ও একই কথা বলছিস অনু।তোর কাছে আমি এমন কথা আশা করতে পারিনা।”

ঈশার রেগে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বাড়ায় না অনু।অর্ডার দেওয়া খাবার টেবিলে আসতে দুজনে চুপচাপ খেতে শুরু করে।
বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ পাশে বসে থাকা একটি ছেলের কার্যক্রমে চোখ আটকে যায় অনুর।ছেলেটার হাভ ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে ঈশার বহু পরিচিত কেউ।

“ঈশুরে এই ঈশু পাশে তাকা ছেলেটাকে তুই চিনিস?”

অনুর উবিগ্ন প্রশ্নের কোন জবাব মেলেনা ঈশার দিক থেকে।মেয়েটার বাম হাতে থাকা ফোন স্ক্রুল করতে ব্যস্ত এবং ডান হাতে থাকা পিৎজার স্লাইসে কামড় বসাতে নজরে আসে অনুর রাগান্বিত মুখ।

” কি হয়েছে অনু?”

” তোকে আমি কি বলেছি?”

” কী?”

অনুর মেজাজ খানিকটা গলে এলো মাথা এগিয়ে ঈশার কাছে এসে বলে,

” পাশে তাকা দেখ ছেলেটা তোর দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে ”

সন্দিহান চোখে পাশে তাকালো ঈশা।সুঠাম দেহের অধিকারী একজন যুবক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।মানুষটার বাম হাতে থাকা ছুরিটা তার দিকেই তাক করে আছে।রমরমা আনন্দপূর্ণ সময়ে মুহুর্তেই ঘাবড়ে গেল ঈশা।এই মানুষটাকে সে চেনে এককথায় যাকে বলা যায় ত্যাজি,উন্মাদ বড্ড জেদি পুরুষ।সেদিন ঘটে যাওয়া নিরলস স্মৃতি স্মরণে আসতে উঠে দাঁড়ালো সে।চটজলদি ভ্যানেটি ব্যাগ হাতে তুলে এলোমেলো পায়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো রেস্টুরেন্ট থেকে।অনু অবাক হয়ে চটজলদি দাঁড়িয়ে পড়ে।ঈশার অদ্ভুত আচরণের কারণটা সে মোটেও জানে না।
পাশে বসে থাকা ছেলেটি এবার উঠে দাঁড়ালো ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এলো অনুর কাছে।

” হ্যালো আমি ঈশান শাহরিয়ার।”

” হ…হ্যা!”

অনু ঘাবড়ে গেল ছেলেটার ক্রূর হাসি হয়তো তার ঘাবড়ে যাওয়ার দ্বিগুণ কারণ।

” অতি সাহসি মেডাম কোথায় গেলন?”

“মেডাম?”

” আমি ইশার কথা বলছি।”

” আপনি ঈশার কী হন?”

দাঁতের সাহায্যে কিঞ্চিৎ ঠোঁট কাঁমড়ে পকেটে হাত পুরলেন ঈশান।অনুর চোখে প্রবল আগ্রহের আভাস পেয়ে বলেন,

” আমি ঈশার কেউ না।তবে ইশা আমার কেউ…”

” কেউ?”

” শত্রু নাকি মিত্র সে তো সময় বলে দেবে।”

.
বড় বড় পা ফেলে পিচ ঢালা রাস্তা মাড়িয়ে ছুটে চলছে ঈশা।সূর্যের প্রখর রোদ না থাকলেও ভ্যাপসা গরমে জনজীবন অস্থির হয়ে উঠেছে।ঈশানকে দেখে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা বিষয়টি হয়তো সবাই রাগ জেদ ভাবলেও মূলত ভয়ের কারণে ঈশা ছুটে বেরিয়ে আসে।এই মুহুর্তে সে একা, ঈশান যদি তার ক্ষতি করে বসে তাহলে কে বাঁচাবে তাকে?যতই নিজেকে সাহসী ভাবুক না কেন গত রাতের পর ভয়ে বার বার কুঁকড়ে উঠছে সে।

” এই ঈশু দাঁড়ানা।এই বেডি এই।”

অনুর চিৎকারে ঘুরে তাকালো সে রেস্টুরেন্ট থেকে সে এখন অনেকটা দূরে আছে।অনু দৌড়ে এসে খপ করে ধরে নেয় ঈশার হাত।

” এত ছুটছিস কেন?এটা সেই ঈশান শাহরিয়ার দেখতে তো মনে হয় কিছুই বুঝে না তুই কি ভয় পেয়ে পালিয়েছিস?”

অনুর ঠোঁট বাঁকায়, ঈশা বড় বড় পা ফেলে সামনের দিকে আগ্রসর হতে হতে বলে,

” ভয় পাইনি ওনাকে দেখেলে ঘৃণা লাগে আমার।”
৫.
ঈশার বন্ধু তালিকায় যদি বিশস্ত আরেক নামের কথা তুলতে হয় তবে দিহানের কথা অনায়াসে বলা চলে।ঈশা-অনু-দিহান তিনজনের বন্ধুত্বের বন্ধন চলছে বছরের পর বছর।কলেজ জীবন থেকে মীরা নামের মেয়েটিকে প্রতি ভালোলাগা কাজ করতো দিহানের তবে তা কখনোই বলা হয়ে উঠেনি।দিহানের হাভ ভাবে মীরা বুঝলেও কখনো ধরা দেয়নি বরং তাদের ভালোলাগা ইশারা ইঙ্গিতের আদান প্রদানে সীমাবদ্ধ রইলো।

ভার্সিটিতে উঠার পর দিহান সিদ্ধান্ত নিলো মীরা ভালোবাসার কথা জানাবে।তার এই সিদ্ধান্তে সম্মতি জানায় ঈশা অনু।

দুপুরের পর তিন বন্ধু মিলে ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল যদিও তাদের সাথে মীরাও থাকবে।তবে মীরা এবং দিহান আগে থেকেই কাঙ্ক্ষিত স্থানে উপস্থিত হয় ঈশা অনুর আসতে দেরি দেখে তারা নিজেদের মাঝে সময় কাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
.

” সাদা শার্টের ছেলেটা?”

” হ্যা বড় ভাই এই ছেলেটার কারণে আমার মীরা আমাকে ইগ্নোর করছে।”

রাজিবের সম্মতি পেয়ে শার্টের কলার তুললো ঈশান।অনেক্ষণ যাবৎ তারা একটি ছেলে এবং মেয়েকে অনুসরণ করছে।ঈশানের দলের সর্বদা ঈশানের প্রতি অনুগত থাকে রাজীব।ছেলেটা বেশ কয়েকমাস মীরা নামের মেয়েটিকে পছন্দ করে।এছাড়াও রাজিবের পরিবার থেকে মীরাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়। তবে বেশ কয়েকদিন যাবৎ দিহান আর মীরার চলাফেরা নজরে আসতে ঈশানের মাধ্যমে দিহানকে শায়েস্তা করাবে ভেবে নেয়।

” সত্যি ভালোবাসিস?”

“আপনার সাথে কোনদিন আমি মিথ্য বলেছি ঈশান ভাই?আমি চাই আপনি শুধু দিহানকে আলাদা করবেন বাকিটা আমি সামলে নিব।”

রাসেল ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো ঈশানের দিকে প্রেম নামক জটিল কেস এর আগে কখনো হ্যান্ডেল করেনি ঈশান তবে এবার কি করবে সে?

দিহান এবং মীরা একদল ছেলেকে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ভড়কে যায়।ঈশানের পিছু পিছু কালো পোষাকের মানুষগুলো দেখে ধারণা হয়ে যায় এরা বড় কোন গ্যাং।

” তোমার নাম দিহান?”

ঈশানের প্রশ্নে মাথা দুলালো সে।

” জি আমি দিহান।”

” মীরাকে কতদিন যাবৎ চেনো?”

” তিন বছর।”

“একে অপরের সাথে তোমাদের সম্পর্ক কী?”

থমকে গেল দিহান এই সম্পর্কের নাম এখনো হয়নি।মীরাকে এখনো বলা হয়ে উঠেনি কতটা ভালোবাসে সে।ঈশানের পাশে রাজীবকে দেখে পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে নেয় মীরা তাই দুই চার না ভেবে দিহানের হাত ধরে বলে,

” আমরা একে অপরকে ভালোবাসি।”

ঈশান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয় মীরা এবং দিহানের হাতের দিকে।

” দিহান তোমাকে সাফ সাফ একটা কথা জানিয়ে রাখছি নিজের ভালো চাইলে মীরাকে ছেড়ে দাও।এই যে রাজীবকে দেখছো আমার ছোট ভাই মীরার সাথে তার বিয়ের কথা চলছে।পথের কাঁটা হয়ে থেকো না। ”

” অদ্ভুত কথা বলছেন আপনি।পথের কাঁটা আমি নই রাজীব নিজে।”

” আমার মুখে মুখে কেউ তর্ক করে না দিহান, তুমি হয়তো আমায় চেনো না তাই বেশি বলছো।”

” আমার কাউকে চেনার প্রয়োজন নেই মীরার ব্যপারে নো সেক্রিফাইস।”

ঈশান বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ দিহানের সাথে তর্কে লেগে থাকে। রাসেল চেয়েছিল বিষয়টা শান্ত ভাবে সমাধান করবে কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না একটা পর্যায়ে রাজীব উত্তেজিত হয়ে পড়লো।দিহানকে বেদমে প্রহার করতে থাকলো।দলের মাঝে তৈরি হলো বিশৃঙ্খলা।

দূর থেকে দিহানকে মার খেতে দেখে এগিয়ে এলো ঈশা অনু।ভীড়ের মাঝে দিহানকে ধরতে গিয়ে রাজীবের হাতে থাকা ধারালো এন্টিকাটারের সাহায্যে গলদেশের নিম্ন ভাগে অসংলগ্নে গভীর ভাবে কেটে যায় ঈশার।আকস্মিক যন্ত্রণায় রক্তাক্ত গলা ধরে ছিটকে পিছিয়ে যায় ঈশা।পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ঈশানের বুকে ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ার আগে তার বাহু ধরে রাখে ঈশান।গোলমাল পরিস্থিতিতে ঈশাকে দেখতে পেয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো ঈশান।
#চলবে__
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌