অবাধ্য বাঁধনে পর্ব-৩+৪

0
289

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৩]
_____________________
৬.
পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ ভঙ্গিমায় বসে আছে ঈশান।তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে আজ বেশ খোশ মেজাজে আছে একটু আগে কি হয়েছে,না হয়েছে এসব ব্যপার-স্যপারে তার কোন মাথা ব্যথা নেই।রাসেল তার সামনে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে পাইচারি করছে।ঈশানের পেছনে দাঁড়িয়ে চারজন কালো পোশাকের গার্ড।হসপিটালে থাকা অনন্য সদস্যরা বেশ অবাক চাহনীতে তাদের পরখ করছে এমন অদ্ভুত কীর্তি হয়তো এর আগে কেউ কখনো দেখেনি।তবে কেউ কেউ ধরে নিয়েছে নিশ্চই ভিআইপি কোন রুগী হসপিটালে এডমিট হয়েছে তাই তো এত গার্ড সিকিউরিটি।
ঈশানের তিন সিট দূরে বসে আছে অনু।মেয়েটা ফ্যাচফ্যাচ শব্দে কাঁদছে তার নাক টানার বিদঘুটে শব্দে মনোযোগ ভঙ্গ হলো ঈশানের।মাথার উপর থাকা কালো সানগ্লাসটা খুলে পাশে রেখে বলে,

” এই মেয়ে নাম কী তোমার?”

ঈশানের রুক্ষ স্বরে চকিতে তাকায় অনু।আজকের কান্ডে ঈশানের প্রতি তার বড্ড ভয় জমা হয়েছে মনে।

” অনু।”

” বাসা কোথায়?”

” ঈশাদের পাশের ফ্লাটে।”

” তোমার ফ্রেন্ড কি মরে গেছে?এমন ভাবে কাঁদছো কেন?”

বেশ গরম চোখে তাকালো ঈশান।ঈশানের ব্যবহারে তেঁতে উঠলো মীরা তবে ভয়ের দরুনে দু’কথা মুখ ফুটে বলার সাহস পেল না।অনু চোখ মুছে নির্বোধ চোখে তাকালো ঈশানের দিকে মানুষটা এমন কেন?একটা পাষাণ নিষ্ঠুর লোক।

” আরেকবার কাঁদলে তোমাকেও ওটিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো।একদম চুপ থাকবে।”

অনু ঘাবড়ানো চোখে তাকালো রাসেলের দিকে।রাসেল বুঝতে পেরে এগিয়ে আসে ঈশানের কাছে।

” ঈশান এত রেগে যাচ্ছিস কেন?চুপ করে বসে থাক।”

” আরে আমি তো চুপ ছিলাম এই মেয়েটা ডিস্ট্রাব করছিল।”

” ঈশান প্লিজ…”

রাসেলের কথার মাঝে নার্স এগিয়ে এলো তাদের জানিয়ে রাখলো ঈশাকে কেবিনে নেওয়া হয়েছে।বান্ধবীর খোঁজ পেয়ে চপল পায়ে ছুটে চলে অনু তার পেছন পেছন চলতে থাকে মীরা।রাসেল ঈশানের হাত টেনে এগিয়ে নেয় ঈশার কেবিনে।

গলার নিচের অংশে ভয়াবহ ভাবে না কাটলেও চামড়াটা বেশ বাজে ভাবে কেটে যায় ঈশার।ড্রেসিং এবং সেলাই শেষে ঈশাকে কেবিনে রাখা হয়।তার পাশে ছিল দিহান ছেলেটার চোখ মুখ কেমন যেন শুকিয়ে গেছে।ডাক্তার ঈশাকে বারণ করেছে অতি প্রয়োজন ছাড়া কথা না বলাই উচিত কেননা গলার চামড়ায় টান লেগে ব্যথা হতে পারে।

অনু ঈশার পাশে বসে হাউমাউ সুর তুলে কেঁদে যাচ্ছে তাকে থামকে ইশারা করে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে ঈশা।এছাড়াও মীরা দিহান অনুকে শান্ত করতে ব্যর্থ হয়ে বিরক্ত মুখে বসে যায় পাশের সিটে।কেবিনের এক কোনে বসে আছে ঈশান সে গেমস্ খেলায় ব্যস্ত তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রাসেল।অনুর কান্নায় এবারো বিরক্ত ঈশান, যখন অনুর কান্না সবাই থামাতে ব্যর্থ সেখানে ঈশানের এক ধমকে চুপসে যায় মেয়েটা।

” স্টপ!তোমার কান্না দেখে মনে হচ্ছে বান্ধবী বেঁচে যাওয়ায় কাঁদছো।অদ্ভুত মেয়ে।বের হও কেভিন থেকে।”

” ঈশাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।”

” না গেলে এখানে চুপচাপ বসে থাকবে আর এত বিরক্ত করছো কেন?”

অনু চুপসে গেল চোখের পানি মুছে তাকালো ঈশার দিকে।ঈশা চোখ ইশারায় থামতে বলছে তাকে।ঈশানের কান্ডে পাশে দাঁড়িয়ে রাসেল নিঃশব্দে ঠোঁট টিপে হাসছে।রাসেলের হাসিতে অপমানে গা জ্বলে উঠলো অনুর তবে ঈশানের ভয়ে দ্বিতীয়বার মুখ খুললো না সে।

ধীরে ধীরে সময় পেরিয়ে গেল সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে।হাতে থাকা স্যানাইল শেষ পর্যায়ে এখন বাড়ি ফিরতে পারবে ঈশা।ঈশানের উপস্থিতিতে তাকে বড্ড বিরক্তিতে ফেলছে। তবে ছেলেটার ধ্যান জ্ঞান মুঠোফোনে সীমাবদ্ধ।নীরবতা মাড়িয়ে মুখ খুললো ঈশান রাসেলকে উদ্দেশ্য করে বলে,

” রাসেল যা লাগে ওষুধপত্র,ফ্রুটস সব কিনে এই উটকো ঝামেলাটাকে বাসায় পাঠিয়ে দে।”

‘উটকো ঝামেলা’ এত বড় অপমান!তীব্র অপমানে দাঁতে দাঁত পিষলো ঈশা।এতক্ষণ যাবৎ চুপচাপ থাকলেও গলায় টান লাগা স্বত্ত্বেও ভাঙা গলায় বলে,

” এই যে আপনি উটকো ঝামেলা কাকে বলছেন?”

” আপনাকে বলছি মিস।উটকো ঝামেলা না হলে কি দুপক্ষের মাঝে আপনার অবস্থান হয়?আমরা দুপক্ষ মিলে সবটা সমাধান করতাম কিন্তু কথায় আছে না অতি চালাকের গলায় দড়ি।সেই দিক থেকে অতি চালাকের গলায় কাটা।”

অপমান!এতো ঘোর অপমান।এই লোকটা তাকে এভাবে পদে পদে অপমান করছে।কাটা স্থানের কাঁচা ঘা নড়াচড়া হতে তীব্র ব্যথা অনুভব হলো ঈশার তবুও তর্কে জয়ী হতে হলে থামা যাবে না।

” উটকো ঝামেলা আপনি।এই যে আমাদের পরিবারে ঢুকে এতটা অশান্তি বাঁধিয়েছেন।এলাকায় আমাদের নামে নিন্দা রটানোর ব্যবস্থা করেছেন।দিহান আর মীরার মাঝে ঢুকে ফাটল ধরাচ্ছেন।এর পরেও নিজেকে ভালো ভাবছেন?আপনি নিম্নশ্রেণির মানুষ আপনার দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হয়।”

হাতে থাকা ফোনটা রাসেলের দিকে ছুড়ে উঠে দাঁড়ায় ঈশান।এই মেয়ের কতটা সাহস হলে ঈশান শাহরিয়ারের মুখে মুখে তর্ক করে।এই দুই দিনেও কি ঈশান শাহরিয়ারের ক্ষমতা সম্পর্কে সে যানে না?তবে তার সাহস কী করে হয় তর্কে জড়ানোর।

” চুপ একদম চুপ।একদম গলা টিপে মে/রে ফেলবো একটা কাক পক্ষিও জানবে না লা/শ কোথায় গুম করেছি।”

” মারবেন?মেরে দেখান তবে।”

ঈশান তেড়ে এলো তবে তার আগে রাসেল তাকে ধরে নেয়।ঈশার সামনে দুই হাত তুলে বাঁধা হয় দিহান।

” রাসেল এই উটকো ঝামেলাকে থামতে বল।আমার মাথায় কিন্তু রক্ত উঠে যাচ্ছে।এই ঝামেলাটাকে চোখের সামনে থেকে সরা।”

” একবছর পর আর একবছর পর মুখোমুখি হবো আপনার।সুধে আসলে সব টাকা ফেরত দিবো।”

” কি করে টাকা দেও আমিও দেখবো।”

” টাকা তো দিবই তবে তার আগে আমাদের জানলা যে ভেঙ্গেছেন সেই টাকার শোধ তুলে ছাড়বো।”

” রাগের মাথায় কাল তো জানলা ভেঙ্গেছি,আগামীতে তোমার হাড্ডিগুড্ডি সব ভেঙ্গে ফেলবো।এটা এই ঈশান শাহরিয়ারের চ্যালেঞ্জ।”

দুজনের চ্যাঁচামেচিতে দরজায় এসে উপস্থিত হয় নার্স সহ অনন্য স্টাফরা।কিন্তু তাদের ঝগড়া চলমান রইলো। রাসেল,অনু,দিহান কেউ তাদের থামাতে পারলো না তারা যেন একাই একশ।

৭.
কক্ষে উপস্থিত তিনজন মানব তবুও কক্ষ জুড়ে নিরবতা কারো মুখে রা নেই।ঈশানের পায়ের কাছে বসে আছে রাজীব, রাসেল পাশে বসে মোবাইল স্ক্রুলে ব্যস্ত তার কাছে আপাতত এই বিষয়টির গুরুত্ব নেই তাই তো সে নিজের মতো করে চলছে।চোখের কোনে তর্জনী এবং বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্যে মর্দন করে নিজেকে স্থির করলো ঈশান।মেজাজটা আজ বড্ড চটে আছে ঈশানের নিরবতায় ফোড়ন কাটলো রাজীব।

” ভাই এবারের মতো মাফ…”

রাজীব থেমে গেল তবে হাত চলতে থাকলো ঈশানের।চড়ের ঠাস ঠাস শব্দে ফোনের স্কিন থেকে চোখ তুলে তাকায় রাসেল।এক চড়ে যেখানে গালের অবস্থা করুন সেখানে আরেকটা চড় পড়া মানে ডান পাটির দাঁত বাম পাটিতে চলে আসা।নিজেকে বাঁচাতে দ্রুত সরে এলো রাজীব।ঈশান ততক্ষণেও দমেনি কোমড়ে থাকা বেল্ট খুলে হাতে নিতে দ্রুত এগিয়ে আসে রাসেল।

” ভাই থাম আর মারিস না।”

” ওঁরে জিজ্ঞেস কর এত বড় সাহস তাকে কে দিয়েছে?ওঁর হাতে এন্টিকাটার এলো কোথা থেকে?”

রাজীব খানিকটা সাহস পেয়ে এগিয়ে এলো জড়িয়ে ধরলো ঈশানের পা।

” ভাই আমি বুঝতে পারিনি মেয়েটা হঠাৎ এসে যাবে।”

” মেয়েটার সাবজেক্ট বাদ তুই আমাকে বল দিহানের বিষয়ে যেখানে আমি সুরাহা করতে গেলাম সেখানে তুই এত হাতাহাতি করতে গেলি কেন?নিজেকে বড্ড লায়েক ভাবিস?ফয়দা তুলতে গেছিলি নাকি?”

” ন…না ভাই আমার কথাটা শু…”

” চুপ কর।মীরার সাথে তোর বিয়ে তো দূরের কথা মেয়েটার আশেপাশে দেখলে তোর কি যে করবো আমি চামড়া তুলে ঝুলিয়ে রাখবো।”
.

ঈশা বাসায় ফেরার পর থেকে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়েছেন মুজাহিদ হাসান এবং সুলতানা।ঈশা বাড়ি ফিরে তাদের মিথ্যা বলে যে এটা একটা এক্সিডেন।
কিন্তু তারা কিছুতেই মেনে নিতে চাইছেন না এক্সিডেন্টের কথা।মনের মাঝে যে সন্দেহ তাদের দানা বেধেছে এই সন্দেহ হয়তো কিছুতেই কমবে না।ঈশার ক্ষতির পেছনে ঈশান শাহরিয়ারের হাত নেই তো?

অনু আজ নিজের বাসায় ফেরার জন্য আগ্রহ দেখালো না।অসুস্থ ঈশার পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে সে থেকেই গেল।রাত প্রায় এগারোটার কাছাকাছি গলায় আরাম অনুভবের তাগিদে বিছানায় হেলান দিয়ে কফি নিয়ে বসলো ঈশা।তার পাশে বসে খোশগল্পে মেতে ছিল অনু। সে বিরতিহীন ঈশান শাহরিয়ারের গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলছে।তাদের গল্পের মাঝে ঈশার ফোন আসে।নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি তিনটা বাচ্চাকে পড়ায় ঈশা এতে মাসের শেষে নিজের হাত খরচ হিসেবে টিউশনের টাকাটা কাজে আসে হঠাৎ পরপর তিনজনে ফোন করে ঈশাকে পরের দিন থেকে আসতে বারণ করে তারা জানিয়ে দেয় ঈশার কাছে আর বাচ্চা পড়াবে না।পুরোনো টিউশনি হারিয়ে ঈশা যেন বড়সড় ধাক্কা খেল।তার মাথার উপর বড় ঋণের বোঝা।এই মুহুর্তে টিউশনি হারানো মানে সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে পড়া।

ফোনটা রেখে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে উঠে ঈশা।অনু বোঝানোর পরেও মেয়েটার কান্না থামার নাম নেই।

” ঈশা আমি যা ধারণা করছি সেটাই ঠিক ঈশান শাহরিয়ার তোর এমন ক্ষতিটা করেছে।”

” তিনি জানবেন কীভাবে আমি সেই বাচ্চাদের পড়াই।”

” তুই বোকা নাকি?আজকে সে কি বললো মনে নাই?তোকে চ্যালেঞ্জ করেছে একবছরে কীভাবে টাকা পরিশোধ করিস সে দেখবে।”
.

বারান্দায় বসে গুনগুন সুরে গান গাইছে ঈশান।তার আনন্দেরা যেন আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে আছে।

” রাসেল আমার কাজ শেষ এবার একটা আরামের ঘুমের প্রয়োজন।”

” আমি বুঝলাম না আর্থিক ভাবে ঈশাদের ক্ষতি করে তোর লাভ কী?ঈশা যদি টিউশনির টাকা জমিয়ে তোর টাকার ব্যবস্থা করতে পারে এতে তোর ভালো নিজের টাকা অতি সহজে পাবি।কিন্তু তুই তাদের ইনকাম সোর্সটা এভাবে বন্ধ করছিস কেন?”

রাসেলের কড়া জবাবে কপাল কুচকালো ঈশান।ঠোঁটে থাকা সিগারেট হাতে নিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে দিল রাসেলের মুখে।

” কিছু কিছু বিষয়ে নিজের লাভ ভাবতে নেই।আরেকটা কথা বলে রাখি ওই মেয়েটার ব্যপারে তোর কোন মতামত আমি শুনতে চাই না।”
#চলবে___

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৪]
_____________________
৮.
” এখানে কেন এসেছি আমরা?”

” মজা দেখতে।”

রাসেলের প্রশ্নে ঈশানের এমন উত্তর আশা করা যায় না।ছেলেটা কি ভালো ভাবে কথা বলতে পারে না নাকি রাসেলের উপর ক্ষেপে আছে।ঈশানের প্রত্যুত্তরে রুষ্ট হলো রাসেল তবে তা বাহ্যিক ভাবে প্রকাশ করলো না।গাড়ির জানলার বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে একদল ছেলে মেয়েকে তারা ভার্সিটির গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি কিনছে।কারো হাতে ঝালমুড়ির ঠোঙা সাদৃশ্যমান কেউ বা অপেক্ষা করছে কখন মামা ঝালমুড়ি নামক অমৃত তাদের হাতে তুলে দেবে।ঈশানের ভিডিও কলে আছেন তার মা মাহমুদা।এতক্ষণ যাবৎ হাসিখুশি মা ছেলে কথা বললেও সাদা আকাশে যেমন হুটহাট মেঘের সঞ্চার হয় ঠিক তেমনি দমে গেলেন মাহমুদা।ধরা গলায় ঈশানকে বলেন,

” বাবা এবার অন্তত আমাদের কাছে আয়।রাগ করে বাংলাদেশে গেলি চার বছর হয়ে গেল তোকে সামনাসামনি দেখিনা চার বছর অথচ আমার মনে হয় চার যুগ।”

মায়ের কান্নায় মন গলেনি ঈশানের।নিজের জেদ বজায় রেখে দৃঢ় গলায় বলে,

” সরি মা আমি আগেও বলেছি এখনো বলছি আমি কানাডায় আর ফিরবো না।তুমি চাইলেই এখানে আসতে পারো যখন ইচ্ছে চলে আসবে আমি তোমায় সাদরে গ্রহণ করবো।”

” তোদের বাবা ছেলের রাগ কবে পড়বে?আমি যে শেষ হয়ে যাচ্ছি তা তোরা বুঝিস না।আমি তো যে কেউ একজনকে নিতে চাই না আমি আমার স্বামী সন্তান দুজনকে চাই। ”

” তবে তুমি থাকো সেখানে আমি ফিরবো না।যে বাবা তার সন্তানকে বিশ্বাস করে না বাইরের কারো কথার সূত্র ধরে ছেলেকে শায়েস্তা করে সে বাবার ঘরে আমি ফিরবো না মা।”

” ঈশান বাবা শোন, তোর বাবা অনুতপ্ত তুই…”

মায়ের কথায় গা লাগালো না ঈশান বরং কথা ঘুরিয়ে বলে,

” আমি রাখছি পরে কথা হবে ভালো থেকো।”

ফোনটা রেখে ভারী শ্বাস ছাড়লো ঈশান।গাড়ির জানলায় হাত ঠেকিয়ে আঙুলের সাহায্যে চুল ব্রাশ করতে থাকে হয়তো এভাবে তার চাপা কষ্টটাকে বিদায় জানাচ্ছে।তাকে দেখে বড্ড চিন্তিত মনে হলো রাসেলের।ঈশানের দিকে নরম চোখে তাকালো রাসেল।

” ঈশান আমার মনে হয় তোর আন্টির কাছে ফিরে যাওয়া উচিত।আঙ্কেল যদি তার ভুল বুঝতে পারে তাহলে…. ”

” তুই চুপ করবি?ইদানীং বেশি কথা বলিস।তোর যদি যাওয়ার হয় তুই যা আমাকে বলছিস কেন?”

” আমি বুঝিনা ঈশান ভালো কথা বললে তুই আজকাল এত রেগে যাস কেন?”

দুজনের কথা কাটাকাটির মাঝে থেমে যায় ঈশান।ভার্সিটির গেটের দিকে তাকিয়ে ক্রূর হাসলো সে।তার চোখে মুখে হঠাৎ ছুঁয়ে গেছে পৈশাচিক আনন্দ।দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটি বড় ট্রাক সেদিকে তাকিয়ে হাসলো ঈশান।
.
ক্লাস শেষে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে পড়েছে ঈশা অনু।গলায় চোট পাওয়া স্থান এখন শুকিয়ে উঠেছে এর মাঝে চলে গেল বেশ কয়দিন।ততদিনে অবশ্য ঈশানের মুখোমুখি হতে হয়নি তাকে।ঈশান নামক আপদ্’টা মাথা থেকে নেমে গেছে ভেবে স্বস্তি পেল কিন্তু সে তো জানে না ঈশান শাহরিয়ারের কাঁঠালের আঠা যার সাথে একবার লেগে যায় ফায়দা তোলা পর্যন্ত সে পিছু ছাড়ে না।

দুই বান্ধবী কথা বলতে বলতে বেশ অনেকটা রাস্তা এগিয়ে যায়।বাস ধরতে হলে তাদের রাস্তার অপর পাড়ে যেতে হবে।তাই তো রাস্তা পার করার জন্য ঈশা অনু ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় রাস্তার মাঝামাঝিতে আসতে দ্রুত গতিকে থাকা একটি ট্রাক ঈশার মুখোমুখি এসে মোড় কাটিয়ে চলে যায়।হঠাৎ ট্রাকটি কাছাকাছি আসতে ভয়ে কুঁকড়ে যায় ঈশা।ঈশা অনু দুজনে এতটাই ভয় পায় রাস্তার মাঝে বসেই ডুকরে উঠে।আশেপাশে আমজনতা অবাক চোখে তাদের দেখছিল।কেউ কেউ ট্রাক ডাইভারের দোষ দিয়ে যায় কেউ বা তাদের দোষারোপ কর‍তে শুরু করে।পুরো ঘটনাটা ছিল পরিকল্পিত এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ঈশানের প্লানিং সাকসেচফুল হয়।
ড্রাইভিং সিটে বসে ঈশানের ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে হাসির রেখা।রাসেল অবাক হয়ে সবটা দেখছিল এসব যে ঈশানের কারসাজি তার বুঝতে সময় লাগলো না।তবে এই মুহুর্তে ঈশানকে ঘাটানো উচিত হবে না ভেবে চুপচাপ রইলো।

ঈশা অনু যখন দাঁড়িয়ে রাস্তা পার করে নেয়।সেই মুহুর্তে তাদের সামনে একটি গাড়ি স্লো স্প্রিডে এগিয়ে আসে গাড়ির জানলা নামানো ছিল তাই সহজে ঈশা এবং ঈশানের চোখাচোখি হয়ে যায়।ঈশানের ঠোঁটের কোনে ছিল তাচ্ছিল্য হাসি।বৃদ্ধা আঙুল নামিয়ে ঈশাকে দেখিয়ে দিল সে পদে পদে হেরে যাবে।এতক্ষণ যাবৎ ঘটে যাওয়া ঘটনার সূত্রপাত খুঁজে পেল ঈশা। ঝাপসা চোখে সে শুধু তাকিয়ে রইলো কালো গাড়িটির দিকে যেটি তার চোখের সামনে দিয়ে তাকে হারিয়ে চলে গেল।

” এসব ঈশান শাহরিয়ারের কাজ ছিল।”

অনুর কথায় মাথা দুলালো ঈশা।

” তুই আমার সাথে থাকিস না অনু।এই লোকটা যেকোন সময় আমার ক্ষতি করতে পারে আমার কারণে তোর ক্ষতি হোক সেটা আমি চাই না।”

” এসব কথা তুই এখন রাখবি?বাসায় চল এখানে আর এক মুহুর্ত না।”

৯.
ভয়ার্ত ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে যখন বাসায় ফিরে ঈশা দরজা খুলতে সেই ক্লান্তিরা এক নিমিষে পাখা মেলে উড়ে যায়।মনে, দেহে ভর করে আনন্দেরা দরজার সাথে শরীর হেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঈশার ফুফাতো ভাই ‘হাসিন’।চাকরির সুবাধে তাকে শহর ছেড়ে দূরে থাকতে হয়।প্রায় চার মাস পর হাসিনকে দেখে বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে উঠে হাসিনের গলা জড়িয়ে ধরে ঈশা।বোনের আনন্দে শব্দ করে হেসে ফেললো হাসিন।দুহাত আঁকড়ে ধরে নিলো ঈশাকে।

” আমার ঈশামনি কেমন আছে?”

” তোমার ঈশামনি ভালো আছে।এবার বলো আমার হাসিন ভাইয়া কেমন আছে।”

” তোমার হাসিন ভাইয়া ভালো ছিল না তবে তোমায় দেখে বেশ ভালো হয়ে গেছে।”

ঈশা গলা ছেড়ে নেমে দাঁড়ালো কাঁধে থাকা ব্যাগটা এগিয়ে দিল সুলতানাকে।ঈশার গলার কাঁটা দাগ সাদৃশ্য হতে নজরে আসে হাসিনের মুহুর্তে তার চোখে মুখে ভর করে বিষণ্ণরা।

” তুই বলছিস সামান্য অথচ কতখানি কেটে গেছে সবধানে চলতে পারিস না?”

” ওসব বাদ দাও আমি ঠিক হয়ে গেছি।”

হাসিনের হাত টেনে সোফায় বসালো ঈশা তবে হাসিনের চোখে মুখে বিষণ্ণরা এখনো খেলা করছে।

” তুই আমার একমাত্র বোন তোর কিছু হয়ে গেলে আমার কী হবে সেসব তুই ভেবে দেখিস না তাই না?”

” আমি ঠিক আছি।এতদিন পর এসেও আমাকে বকবে?”

” মামা বলেছে তুই গুন্ডাদের সাথে তর্ক করেছিস এটা কী সত্যি?”

” হ..হ্যা।”

” কেন করেছিস?ঈশান শাহরিয়ারের সম্পর্কে আমি খোঁজ খবর নিয়েছে এক রেখার জেদি মানুষ।তুই যে তাকে রাগিয়ে দিয়েছিস এবার কী হবে?ওর বিরুদ্ধে আমাদের কিছু করারো থাকবে না।তার ক্ষমতা অনেক দূর।”

” এসব ছেড়ে দাও ভাইয়া।ফুফু কেমন আছে সেটা বলো।”

” ছেড়ে দেওয়ার মতো বিষয় এটা না ঈশু।বাবার সাথে আমি কথা বলেছি সব মিলিয়ে চার লক্ষ টাকা মেনেজ হয়েছে তোদের আর আমাদেরটা মিলিয়ে মোট এগারো লক্ষ টাকা হয়েছে।বাকিটা দেখবি ধীরে ধীরে জোগাড় হয়ে যাবে।”

ঈশা নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো হাসিনের দিকে।কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া এক্সিডেন্টের ঘটনা যদি হাসিনের সামনে বলা হয় তবে তো আর রক্ষে রইবে না।সবটা ভেবে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো ঈশা এই ঝামেলা থেকে কবে তাদের নিস্তার হবে।

১০.
পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা ঈশার ছিল এবং আছে।নিজের ছোট ছোট শখ গুলোকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজেকে একটু একটু করে তৈরি করছে।ছোট থেকে আঁকিবুঁকির প্রতি বেশ দক্ষ ছিল ঈশা সেই দিক থেকে ধীরে ধীরে মেহেদী ডিজাইনেও পারাদর্শী হয়ে উঠে।মেহেদী লাগানোর দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে অনলাইনে নিজের নামে পেইজ খুলেছে।অনুর দেওয়া মনোবলে কখনো পিছিয়ে যায়নি ঈশা।একটু একটু করে নিজের প্রচারণা চালিয়েছে অনলাইনে।মেহেদী আর্টিস্ট হিসেবে এখন সে বেশ পরিচিত বলা চলে।বেশিভাগ সময় ক্লায়েন্টদের বাড়ি গিয়ে তাকে মেহেদী দিয়ে দিতে হয়।আজকেও তার ব্যতিক্রম নয় রুমা নামের মেয়েটি ঈশার বেশ পুরোনো ক্লায়েন্ট বলা চলে।এর আগেও বেশ কয়েকবার তার বাড়ি গিয়ে মেহেদী পড়িয়েছে সে।রুমার আট বছর বয়সী মেয়ের নাম রুদবা।
ছোট ছোট দুই হাত ভরিয়ে মেয়েটাকে মেহেদী দিয়ে স্থির হলো ঈশা।মেয়েটাও ভীষণ আদুরে ঈশার সাথে এতক্ষণ খোশগল্পে পূর্ণ ছিল।

“রুদবা তোমার মেহেদী পছন্দ হয়েছে?”

ঈশার প্রশ্নে এক গাল হেসে দিল রুদবা।ছোট ছোট হাতগুলো চোখের সামনে পরখ করে বলে,

” ঈশামনি তুমি খুব ভালো মেহেদী দাও।আজকে আমার জন্মদিনে তোমাকে থাকতে হবে।”

মেয়েটার আবদারে ঠোঁট কুচকালো ঈশা।মন খারাপের সুরে বলে,

” সরি রুদবামনি আমি যে থাকতে পারবো না।আমার বাবা আমায় বকবে।”

ঈশার কথার মাঝে উপস্থিত হয় রুমা।ঈশার কথা কানে যেতে গরম চোখে তাকালেন তিনি।

” ঈশা তোমায় বলেছি না আজ কিছুতেই যেতে দিব না।আজ রুদবার জন্মদিন সেখানে যে করে হোক তোমাকে থাকতে হবে।”

” বাবা বকবে আপু।আমি থাকতে পারবো না।”

” আঙ্কেলে নাম্বারটা আমায় দাও আমি কথা বলে নিচ্ছি।”

” বাসা থেকে রেডি হয়ে আসতে অনেকটা সময় কিছু মনে করো না আপু আমি বরং চলে যাই।”

ঈশার যাওয়ার কথা শুনে হাত ধরে বসিয়ে রাখলো রুমা।অনুরোধের সুরে বলে,

” আমার শাড়ি পড়বে তুমি, আমি তোমাকে তৈরি করে দিব।রুদবাও কষ্ট পাবে যেওনা।আঙ্কেলের নাম্বারটা দাও আমি যোগাযোগ করছি।”
.
ফেইরি লাইটের সাহায্যে বাড়ির ছাদ এবং ঘরের ভেতরের ডেকোরেশন খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।ধীরে ধীরে মেহমান আসতে শুরু করেছে।রুমার দেওয়া খয়েরী রঙের শাড়িতে নিজেকে বেশ দারুন ভাবে সাজিয়ে তুলেছে ঈশা।এতক্ষণ যাবৎ রুদবার সাথে কক্ষে বসে রুদবার ফ্রেন্ডরা সহ গল্প করছিল।তাদের সাথে ঈশাও ছিল।ঈশার মনগড়া রাজারানীর গল্প সবাই কৌতূহল নিয়ে শুনছি।হঠাৎ কক্ষে উপস্থিত হয় এক ব্যক্তি। ব্লাক ব্লেজারে মানুষটাকে বেশ সুর্দশ লাগছিল।দরজায় চোখ পড়তে রুদবা চেচিয়ে ছুটে চলে যায় সামনে।সঙ্গে সঙ্গে তাকে কোলে নিয়ে আদর কর‍তে থাকে মানুষটি।

” আম্মু মামা এসেছে।”

রুদবার চিৎকারে কক্ষে ছুটে আসেন রুমা।বাচ্চাদের পেছনে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত চোখে ঈশানকে দেখছিল ঈশা।রুদবার মামা হয় ঈশান!কলিজাটা সঙ্গে সঙ্গে ছ্যাত করে উঠলো তার।এখানে ঈশার পরিচিত কেউ নেই, যে মানুষটা তাকে ট্রাক চাপা দিয়ে মারতে যায় সে মানুষটা তাকে এখানে মারবে না তার গ্যারান্টি কী?

বাচ্চারা একে একে কক্ষের বাইরে বেরিয়ে গেলো সেখানে একমাত্র উপস্থিত ঈশা।ঈশানের কাছে কিছুতেই নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে চায় না সে তাইতো বিছানায় উলটো দিকে মুখ করে বসে আছে।এতে অন্তত ঈশান দেখবে না এই ভেবে।

রুদবাকে কোলে নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে বিছানায় চোখ পড়লো ঈশানের।একটি মেয়ে জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় বসে আছে।গায়ে থাকা শাড়িটিও তার বেশ পরিচিত।আরে এই শাড়িতো ঈশান রুমাকে গিফট করেছিল কয়েকমাস আগে।ভাবনার মাঝে ভ্রু কুচকে এলো ঈশানের রুমা বুঝতে পেরে ঈশাকে উদ্দেশ্য করে ঈশানকে বলে,

” ও ঈশা আমার দূর সম্পর্কের ছোট বোন।”

” ঈশা!”

আপনাআপনি মুখ থেকে নামটি বেরিয়ে এলো ঈশানের।ঈশার তখন যায় যায় অবস্থা কোথায় পালাবে ভেবে কুল পেলনা সে তার আগেই রুমা তার হাত টেনে ঈশানের সম্মুখে দাঁড় করায়।

” ঈশা ও হলো ঈশান আমার কাজিন রুদবার মামা।”

হাসিখুশি ছেলেটার চোখের পলকে শক্ত হয়ে এলো চোয়াল।ভেতরে ভেতরে রাগের সঞ্চার হয়েছে তার। মনে মনে ঈশান আবিষ্কার করলো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুশ্রী কন্যাটির প্রতি তার একটুও মায়া কাজ করছে না।ভেতরটায় কড়া নাড়ছে প্রখর জেদ এই মেয়েটাকে শায়েস্তা কর‍তে পারলে তার আনন্দ লাগে বড্ড বেশি আনন্দ।
#চলবে___