অবেলায় ভালোবাসি পর্ব-০৪

0
350

#অবেলায়_ভালোবাসি
#লেখনিতে_সাবরিন_জাহান
#পর্ব_০৪

ভার্সিটির গেটে আইসক্রিম হাতে নিয়ে ঢুকছে তিন বান্ধবী।

“আজ প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি আগে এসে পড়লাম তাই না?”(সীমা)

“হুঁ,চল ঘুরি একটু!ফুল ক্যাম্পাস!”

ইভার কথায় আয়ুশী আর সীমা সম্মতি দিলো। অরেঞ্জ ফ্লেভারের এই দশ টাকা দামের আইসক্রিম গুলো আয়ুশীর দারুন পছন্দ!ভার্সিটির তিন তলাতে এসেই স্যারদের কেবিনে উকি মারে ওরা!প্রায় সবাই এসেছে!আয়ুশী চোখ বুলিয়ে আয়ানকে খুঁজতে লাগলো!

“আয়ু,এভাবে বেশি উকি দিস না! স্যাররা দেখলে বকা দিতে পারে!”

সীমার কথাটা বলতে দেরি কিন্তু ফলতে দেরি হলো না।ভিতর থেকে কোনো এক স্যার গম্ভীর গলায় বললেন,”কে ওখানে?”

আওয়াজ পেয়ে তিনজন দিলো দৌড়!প্রত্যেক বারের মত এবারও কলার খোসা পায়ের নিচে পড়াতে পা পিছলে গেল।নিজেকে সামলাতে নিয়েও এবার সামলাতে পারলো না আয়ুশী।ফল স্বরূপ আইসক্রিম হাত থেকে ছিটকে পড়ে যায়,আর আয়ুশী নিচে।এভাবে পড়ে যাওয়ায় বেশ ব্যাথা পেয়েছে! হাতে কুনুই ছিলে গেছে অনেকটাই।সামনে তাকাতেই দেখলো আইসক্রিমটা কারো পায়ের কাছে পড়ে আছে।প্রিয় আইসক্রিম এভাবে পড়ে যাওয়ায় বেশ আফসোস হলো ওর। কার পায়ের কাছে পড়েছে দেখতে গিয়ে মাথা উঠাতেই বিস্মিত হয়ে রইলো।এখন ও কনফিউসড! আইসক্রিম পড়ে যাওয়ায় আফসোস করবে নাকি সামনে থাকা ব্যাক্তির সাদা শার্টের উপর যেই কমলা রঙের দাগ চক চক করছে ওইটা দেখে হাত পা ছড়িয়ে কান্না করবে,নাকি বার বার ওকে বিপদে ফেলা কলার খোসাকে এমন অপরাধ করা উপলক্ষে জেলে দিবে।দাগটা ওর আইসক্রিম এরই।আর সামনের ব্যাক্তিটি স্বয়ং আয়ান!কাঁদো কাঁদো ফেস নিয়ে একবার আইসক্রিম এর দিকে তাকাচ্ছে, তো একবার আয়ান,তো আবার কলার খোসা।আয়ানকে দেখে সীমা আর ইভাও সামনে আসার সুযোগ পাচ্ছে না।আয়ান দীর্ঘশ্বাস নিলো।এই মেয়ে যতবারই আছাড় খাবে,ততবারই আয়ানের সাথে কিছু না কিছু হবে,ঢের বুঝতে পেরেছে।নিজের সাদা শার্টে আইসক্রিম শেপ কমলা রঙের দাগ দেখে আয়ুশীর দিকে তাকালো।কাঁদো কাঁদো ফেস করে একবার কলার খোসা দেখছে,আবার শার্টের দিকে তাকাচ্ছে।সীমা আর ইভার অবস্থা দেখে বুঝলো ওরা এগিয়ে আসবে না এখন।আইসক্রিম কে ঠেলে এক সাইড করলো।আদারওয়াইজ নোংরা হবে জায়গাটা বাজেভাবে।আয়ুশীর দিকে এগিয়ে গেলো ও।আয়ানকে এগিয়ে আসতে দেখে আয়ুশী চট করে নিজের গালে হাত দিলো।না জানি চ’র দেয় সেদিনের মতো।আয়ান বুঝতে পারলো আয়ুশী ওকে ভয় পাচ্ছে।নিজের হাত ওর দিকে এগিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,”উঠো!”

আয়ুশী একের পর এক ঢোক গিলছে।আয়ান একটু ধমকের মতো করেই বললো,”কি হলো? উঠো!”

আয়ুশী আস্তে করে আয়ানের হাত ধরে উঠে দাড়ালো।হাত অনেকটাই ছিলে গেছে।সীমা আর ইভাকে উদ্দেশ্য করে বললো,”ওকে ধরো!”

আদেশ পাওয়া মাত্রই ওকে ধরলো ওরা।পায়ে হালকা চোটও পেয়েছে।এমনিও পূর্বের ব্যাথা কিছুটা ছিলো।আয়ান কেবিনের দিকে গেলো।ওদের ধারণা আয়ান আর আসবে না।তাই আয়ুশীকে নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলো ক্লাসের উদ্দেশ্যে! তখনই আয়ানের ডাক পড়লো।ওদের কেবিনের দিকে ডাকছে।ভয়ে চুপসে গেলো ওরা।না জানি ওই স্যার ওদের উঁকি ঝুঁকি দেয়ার জন্য আয়ানকে বিচার দিয়েছে।তাও ওরা ওদিকে গেলো।কেবিন ফাকা।সম্ভবত সব ক্লাসে গিয়েছে।আয়ান একটা চেোয়ার টেনে আয়ুশীকে বললো,”বসো!”

আয়ুশী অবাক হয়ে বললো,”জী স্যার?”
“তোমায় বসতে বলেছি!”

আয়ুশী তবুও দাড়িয়ে।এবার আয়ান ধমকে বললো,”ধমক ছাড়া কথা শুনো না?”

তড়িঘড়ি বসে পড়লো ও।আয়ান একটা তুলায় কিছুটা হেক্সিসল ঢেলে ওকে লাগিয়ে দেও।সীমা ঢোক গিললো।ওর এসব করতে হাত কাঁপে।তাও স্যার বলেছে করতে তো হবেই।কাঁপা কাঁপা হাতে নিতে গেলেই আয়ান বললো,”এনি প্রবলেম?”

সীমা মেকি হেসে বললো,”আসলে স্যার আমার এগুলো করতে নার্ভাস লাগে।তাইতো মেডিকেলে পড়িনি!”

আয়ান ইভার দিকে তাকাতেই বুঝলো সেও সেম।উপায় না পেয়ে নিজেই হাঁটু গেড়ে বসলো আয়ুশীর কাছে।কুনুইয়ের দিক খেয়াল করতেই দেখলো বেশ ময়লা লেগে আছে।পকেট থেকে রুমাল বের করে তার এক কোণা পানিতে ভিজিয়ে পরিষ্কার করতে লাগলো।ছোটবেলায় মাকেও এভাবেই করতে দেখেছে যখন ও ব্যাথা পেতো।পানি লাগার ফলে চিন চিন ব্যাথা অনুভব করলেও কোনো শব্দ করলো না ও।হেক্সিসলে ভেজানো তুলা হাতে লাগাতেই মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো আয়ুশী!এই প্রথম আয়ুশীর দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টি দিলো আয়ান।ব্যাথায় চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে ও।চোখের কোণে পানি লক্ষ করতেই হাতে হাল্কা করে ফুঁ দিলো ও।মৃদু কেঁপে উঠলো আয়ুশী।আস্তে আস্তে চোখ খুললো ও।আয়ান যত্ন নিয়ে ফু দিয়ে মেডিসন লাগিয়ে দিচ্ছে।ব্যাথার কথা বেমালুম ভুলে গেলো ও।এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো ও।এভাবে তাকিয়ে থাকতে ওর বেশ ভালো লাগছে।কিন্তু ওর মুডের বারোটা বাজিয়ে আয়ান বলে উঠলো,”সারাদিন আছার খাওয়া ছাড়া তোমার কোনো কাজ নাই?”

আয়ুশীর ঠিক বোধগম্য হলো না।তাই বললো,”জী?”

“বললাম সারাদিন আছার খাওয়া ছাড়া তোমার কোনো কাজ নাই?আর যখনই খাও হয় আমার উপরে পড় নয়তো কিছু ফেলো!কোনো রোগ নাকি এটা?”

আয়ুশী ফোঁস করে শ্বাস নিলো।যাই একটু ক্রাশ খেলো বাট এই খারুসের তেঁতো কথায় তা হাওয়া।গাল ফুলিয়ে বসে রইলো ও।আয়ান ওর পায়েও ব্যাথার স্প্রে করে ফার্স্ট এইড কিডটা গুছিয়ে রাখলো।দ্বিতীয় ক্লাসের ঘন্টা পড়তেই বললো,”নেও শেষ,এবার ক্লাসে যাও তোমরা!”

এখন আয়ানেরই ক্লাস ওদের সাথে সীমা, ইভা আয়ুশীকে ধরে নিতে চাইলে ও জানায় ও নিজেই পারবে।ওরা বের হয়ে গেলেও আয়ুশী বের না হয়ে আবার আয়ানের সামনে দাড়ালো।আয়ান তাকাতেই বললো,”সরি স্যার,এই কয়দিনের সব কিছুর জন্য!আর ওই দিন আপনাকে ফল বিক্রেতা ভাবার জন্য!আসলে আমি বুঝতে পারিনি যে আপনি উনি নন!তাই আরকি….”

আয়ুশীর কথার মাঝেই আয়ান বলে উঠলো,”সিরিয়াসলি?ভুল কি আদো ছিলো?”

আয়ুশী হাত কচলাতে লাগলো।
“আমি বাচ্চা না যে তুমি যা খুশি বুঝাবে!সরি বলতে আসলে,তাও মিথ্যে বলে!সরি মানে নিজের দোষ স্বীকার করা। তুমি এক দোষ স্বীকার করতে গিয়ে আরেকটা দোষ ক্রিয়েট করলে!”

আয়ুশী এবার শুরু থেকে সবটা বলে আবার সরি বললো।
“ইটস ওকে,ইউ মে লিভ!”
“আপনি ক্ষমা করেছেন তো স্যার?”
“কেও ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হলে তার উপর রাগ করে থাকতে নেই।”

আয়ুশী মুচকি হেসে বেরিয়ে যেতে লাগলো।দরজার কাছে যেতেই আয়ান ওকে ডাক দিলো,”আয়ুশী!”

থমকে গেলো ওর পা!আগেও তো কতজন এভাবে ডেকেছে।কই এত মিষ্টি তো লাগেনি।নিজেকে সামলে ঘুরে তাকালো ও।আয়ান আমতা আমতা করে বললো,”সরি!”

“কেনো স্যার?”

“রাগের বসে তোমার গায়ে একদমই হাত তুলা উচিত হয় নি!আসলে রাগ উঠলে নিজের মাঝে থাকি না আমি!”

“রাগাটা স্বাভাবিক স্যার!আমি কিছু মনে করিনি…”

“তাও সরি!”

“ইটস ওকে স্যার!”

বলেই বেরিয়ে গেলো।

ক্লাস শেষে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা লাগালো আয়ুশীরা।আয়ুশী মুখে মুচকি হাসি বিদ্যমান।এতে ইভা আর সীমা বেশ ভাবুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।দ্বিতীয় ক্লাস থেকেই আয়ুশী কেমন আনমনা হয়ে হাসছে, তো আবার নিজে নিজেই বিরবির করছে।সীমা এবার আয়ুশীর কাছে গিয়ে ওকে ডাক দিলো।

“আয়ু!”

“আয়ান স্যার কি কিউট তাই না?”

দু জন চোখ ছোট ছোট করে তাকালো।ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই এক সাথে সমস্বরে টেনে বললো,”ওহো!”

আয়ুশীর এতক্ষণে হুস হলো।মুখ ফসকে কি বলে ফেলেছে।পরিস্থিতি সামলাতে বলে উঠলো,”ইয়ে মানে,কত ভালো ক্লাস করায়।কি সুন্দর সব বুঝিয়ে দেয়।কতটা দায়িত্ববান মানুষ…কিউট না?”

ওরা দুইজন তাও চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে।আয়ুশী মেকি হাসলো।

“কি চলে আয়ু বেবি?”(সীমা)

” কই কি?”(আয়ুশী)

“বুঝি তো বেবস!” (ইভা)

আয়ুশী কিছু বলবে তার আগেই সীমার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে বাবা নামটা জ্বল জ্বল। হাসি মুখে রিসিভ করলো ফোনটা।সালাম দিতেই সীমার বাবা এক গাল হেসে তার উত্তর নিলেন।

“কেমন আছিস মা?”

“আলহামদুলিল্লাহ ,তুমি?”

“ভালো রে!বাড়ি আসবি না এবার?”

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সীমার!কতদিন বাবাকে দেখে না ও।কথা বলতে বলতে রাস্তার ফুটপাতের উপর বসলো ও।

“বন্ধ পেলেই আসবো বাবা!এই মাসে ডাক্তার দেখিয়েছো?”

“হ্যাঁ রে মা!”

আবারও দীর্ঘশ্বাস নিলো ও।

“মিথ্যা বললে আমি বুঝে ফেলি এটা জানো না?”

ওই পাশে কোনো আওয়াজ এলো না।হুট করেই ভেসে এলো কারো কর্কশ আওয়াজ!

“আমার ফোনের সব টাকা শেষ করে ফেললো এই বুড়ো!বলি তোমার কি আক্কেল জ্ঞান নেই? কার সাথে কথা বলছো? নিশ্চয়ই ওই মাইয়ার লগে!দাড়াও।”

বলেই ফোন কেড়ে নিলো।সীমার বাবা বাঁধা দিতে গিয়েও দিতে পারলো না।

“কিরে,গিয়েও শান্তি দেস নাই?তোর জন্য আমার ফোনের সব টাকা শেষ করছে।এগুলো কি তুই দিবি?তোর প’ঙ্গু বাপরে যে রাখছি এটাই অনেক!শহরে কোন না’গ’রে’র লগে ঘুরস যে সময় মতো টাকা পাঠাস না!তোর বাপের খরচ কি আমি দিমু নাকি?”

চোখ বন্ধ করে রইলো সীমা!এখন কিছু বললে বাবার উপর এর প্রভাব পড়বে।শান্ত গলায় বললো,”এই মাসের টিউশনির টাকা এখনও পাইনি।পাওয়ার সাথে সাথেই পাঠিয়ে দিবো!”

“মনে থাকে যেনো!”

বলেই ফোন রেখে দিলেন সীমার সৎ মা।যখন ওর পাঁচ বছর বয়স তখন মা মা’রা যায়!তখন ও মায়ের আবদার করতো বাবার কাছে।”বাবা আমাকে একটা মা দেও!”,বলে কি কান্নাটাই না করতো!তখন মেয়ের জন্য আবারও বিয়ে করেন তিনি।শুরু দিকে সব ভালোই ছিল।উনাদের কোল আলো করে আসে আরেক ছেলে।তখনও ওদের সম্পর্কের পরিবর্তন হয়নি!কিন্তু পরিবর্তন তখন হলো যখন ওর বাবা দু’র্ঘ’ট’না’য় নিজের পা হারান!নিজের বাড়ির কু মন্ত্রণায় শুরু করে অস্বাভাবিক ব্যাবহার!ভার্সিটি ওর পড়া হতো না যদি না ওর মামা ওকে পড়াশোনার সুযোগ দিতেন।তিনি ই এখানে ভর্তি করান আর খরচ চালান।এতে সৎ মা আরো ক্ষেপে জানান উনি বাবার কোনো দায়িত্ব নিতে পারবে না।যেখানে উনার সম্পত্তির অভাব নেই।তার বাবার খরচ চালাতে টিউশনি করে মাসে দশ হাজার টাকা দেয়।কিন্তু এতে দেরি হলেই বাবাকে শুনতে হয় অনেক কথা।পড়াশোনাটা শেষ করেই একটা চাকরি খুঁজবে।তারপর বাবাকে নিয়ে আসবে ও।ওই নরকে রাখবে না,যেখানে প্রতি নিয়ত শুনতে হয় সে প’ঙ্গু!দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো আবারও।জীবন কি অদ্ভুত!এত কষ্টের আড়ালেও হাসি মুখে দিব্বি আছে ও।

#চলবে