অবেলায় ভালোবাসি পর্ব-০৫

0
314

#অবেলায়_ভালোবাসি
#লেখনিতে_সাবরিন_জাহান
#পর্ব_০৫

চোখের কার্নিশে জল এসে জমা হলো সীমার…আর কয়েকটা বছরের অপেক্ষা!তখনই কেউ টিস্যু এগিয়ে দিলো ওর দিকে।টিস্যু নিয়ে চোখে জমে থাকা জল টুকু মুছে ফেললো।অপরজন পানি এগিয়ে দিল। ও জানে এরা কে!মুখে হাসি ফুটলো ওর।এরা থাকতে ওর কাঁদতে মানা!নিজেকে সামলে বললো,”তোরা দুইজন এমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছিস কেনো?”

“তোর রূপ গজিয়েছে তো তাই!”(আয়ুশী)

ইভা ফিক করে হেসে দিল।সীমা আস্তে করে আয়ুশীর পিঠে কি’ল বসালো।

ওরা তিনজনই এক গ্রামের বাসিন্দা।ছোট থেকেই একসাথে থেকে এসেছে ওরা।কিন্তু স্কুল জীবন শেষে আয়ুশী ভালো কলেজে অ্যাডমিশন এর জন্য শহরে এসে পড়লেও ,সীমা আর ইভা পারেনি!কিন্তু ভার্সিটিতে ঠিকই পেরেছে। আয়ুশীও চায় নি,কিন্তু বাবার আশা ফেলতে পারেনি!

সীমা এবার দুষ্টু হেসে বললো,”আয়ু! স্যার যেনো কেমন?”

আয়ুশী ভরকে গেল।ভেবেছিলো এদের মাথা থেকে কথাটা হাওয়া হয়ে গেছে।কিন্তু ও তো ভুলেই গেছে।এরা বিচ্ছু বাহিনী!

“বল ,বল!”(ইভা)

“আব..কেমন আবার।ভালোই তো! কত দায়িত্ব নিয়ে পড়ায়!বেলাল স্যার এর মত!”

“উনারই তো ছেলে ,ভালো তো পড়াবেই!”(ইভা)

“তুই চুপ কর(ইভাকে উদ্দেশ্য করে),আর আয়ু তুই বল!সামথিং সামথিং?”(সীমা)

“এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে!উনি আমাদের টিচার!রেসপেক্ট হিম!”

বলেই উঠে হাঁটতে লাগলো।সীমা পিছন পিছন যেতে যেতে বলল,”ও হ্যাল্লো!পার্মানেন্ট টিচার নয়..সাময়িক!আর না বুড়ো ,না বিবাহিত!আর তোদের তো যাবেও ভালো।তুই শুধু উনার সামনে আছার খাবি!আমি জানিস তোদের জন্য একটা ফিল্ম বানাবো।নাম হবে ,’নায়কের আছার খাওয়া নায়িকা!’,যেখানে নায়িকা নায়কের সামনেই দিন রাত আছার খায়!নায়ক তো আয়ান স্যার,নায়িকা তুই! সাইড ক্যারেকটার আমি আর ইভা!আর ভিলেন …. উম!ভিলেন কাকে দেয়া যায় ,বল তো?বেলাল স্যার?না না..উনি তো ভালো মানুষ!”

মাঝেই ইভা বলে উঠলো,”ভিলেন দে কলার খোসা কে!যেটা অলওয়েজ ওকে আছার খেতে সাহায্য করে!”

“পারফেক্ট!জোস হবে না আয়ু?”

আয়ুশী রাগে ফুলছে। আশে পাশে খুঁজে একটু মিডিয়াম পাথরের কণা উঠিয়ে ওদের দিকে ছুঁড়ে মা’র’লো…

“তোরা আর তোদের ফিল্ম,সেই সাথে তোদের ভাবনা নিয়ে জা’হা’ন্না’মে যা! অ’স’ভ্যে’র দল!”

বলেই আরো জোড়ে হাঁটা লাগালো।সীমা আর ইভা মুখ চেপে হাসতে লাগলো। অতঃপর হাসি থামিয়ে ছুটলো আয়ুশীর রাগ ভাঙাতে!

_________________________________

নিজের কেবিনে সবে মাত্র গা এলিয়ে বসলো ফাহিন!একটু আগেই একটা অপারেশন করে এসেছে।রোগীর অবস্থা ক্রিটিক্যাল থাকলেও ,আল্লাহর রহমতে সফল হয়েছে।ক্লান্ত শরীর নিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলো ও।কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে ফোন হাতে নিয়ে গ্যালারিতে ঢুকলো ও!এক হাস্যজ্বল রমণীর প্রতিচ্ছবি বের করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ও! রমণীটিকে যতই দেখে ততই মুগ্ধ হয় ও।আনমনেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,”আমার মায়াবতী!”

_____________________________

সবে মাত্রই ফ্রেশ হয়ে বসলো আয়ান!বারান্দায় তার প্রিয় সাদা শার্টটি রোদে দিয়েছে!ধোয়ার পরেও দাগ সেভাবে যায়নি! শার্টের কথা ভেবেই হাসি পেলো ওর।সাদা শার্টে কমলা রঙের নতুন ডিজাইন !স্টাইল হিসেবে পড়া যাবে!নিজের ভাবনায় নিজেই আবার অবাক হলো।এসব কি ভাবছে ও?বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো ও!মুহূর্তেই ভেসে উঠলো আয়ুশীর চোখ মুখ কুচকানো প্রতিচ্ছবি! ঝট করে চোখ খুলে ফেললো ও। কার কথা ভাবছে ও?ফোন হাতে নিয়ে একজনের ছবি বের করলো ও!নিজের মনে নিজেই আওড়ালো,”আমার মন মস্তিষ্ক জুড়ে কেবল তোমার আনাগোনা হবে!আর কারোর না!একদমই না!”

________________________
হোস্টেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিলো সীমা,ইভা!সীমার টিউশনি আছে।তাই একটু পরেই বের হবে।ইভা বাড়ির খোজ নেয়ার জন্য ছোট ভাই মিতাফের ফোনে কল দিল।মিতাফ এবার এইচ এস সি দিলো।ভার্সিটি এডমিশনের প্রিপারেশন নিচ্ছে।ফোন ধরতে না ধরতেই মায়ের আওয়াজ শুনলো ও।চোখ মুখ কুচকে গেলো ওর।এমনটা নয় মায়ের আওয়াজ শুনতে বিরক্ত লেগে।কিন্তু ও জানে এখন ঠিক কি কি বলবে।

“কিরে ইভা!কেমন আছিস?আমি ফোন দিলে ফোন ধরিস না কেনো?”

“তুমি জানোই মা,কেনো ধরি না!”

“দেখ ছেলেটা ভালো।সরকারি চাকরি করে।একবার দেখা করবি এতে তোর সমস্যা কোথায়?”

“সরকারি চাকরি করে ,তাহলে যৌতুকের দাবি কেনো রাখে মা?”

“তুই কিভাবে….”

“আমি কিভাবে জানলাম সেটা বড় কথা নয়,যারা উচ্চবিত্ত হয়েও ভিক্ষুকের মতো মেয়ের বাড়িতে আগেই যৌতুক দাবি করে ,তাদের আর যাই হোক আমি মানুষ ভাবি না!”

“যৌতুক ছাড়া কেউ বিয়ে করবে নাকি তোকে?”

“করবে!আর এমনটা তো না তোমরা কিছুই দিতে না!দিতে তো ঠিকই।কিন্তু চেয়ে কেনো নিবে?যৌতুক দেয়া বা নেয়া উভয়ই অপরাধ!”

ইভার মা মলিন গলায় বললেন,”মেয়ের সুখ চাওয়া আমাদের অপরাধ রে মা?”

নিমিষেই নুয়ে গেলো ও।মায়ের কাতর কণ্ঠ কোনোকালেই সইতে পারে না ও!
“মা প্লিজ!”

“আমাদেরই ভুল,হয়তো একটু বেশি ই আশা করেছিলাম!”

ইভা চুপ রইলো।কিছুক্ষণ পরে বললো,”কোথায় দেখা করতে হবে?”

ফোনের অপর প্রান্তে ইভার মা বাঁকা হাসলেন!
“আমি অ্যাড্রেস মিতাফ দিয়ে পাঠাচ্ছি!”

আরো টুকটাক কথা বলে রেখে দিলেন উনি। মিতাফ মায়ের হাসি দেখে বললো,”ইমোশনাল কথা বার্তা উরফে ব্ল্যাক’মেইল কেউ তোমার থেকে শিখুক মা!”

মিতাফের হাতে ফোন দিয়ে বললেন,”তোর বোনের জন্যই করা!ওকে একটা ভালো পরিবারে দিতে পারলেই শান্তি!আর উনারা ভালো মানুষ!আমার মেয়ে ভালো থাকবে!”

মিতাফ হাসলো।বোনের কথা সেও ভাবে।কিন্তু বাবা মায়ের মত হয়তো এতটাও ভাবতে পারেনি ও!

__________________________________

বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছে আয়ুশী।সীমা টিউশনি শেষে পার্কে থাকবে বলে জানিয়েছে।আর ইভাকেও আসতে বলেছে।যদিও এই নিয়ে মাকে অনেক বলে কয়ে রাজি করিয়েছে।পার্কে ঢুকে একটা বেঞ্চিতে বসলো ও।ছোট ছোট বাচ্চারা কি সুন্দর মজা করছে।বাচ্চাদের দেখতে এতই বিভোর যে পাশে কেউ এসে বসেছে টেরই পেলো না।

“বাচ্চা ভালো লাগে?”

“প্রচুর!”

উত্তর দিলেও প্রশ্নদাতাকে দেখতে ঘাড় ঘুরালো আয়ুশী। ফাহিন মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

“আরে ডাক্তার যে!”

“জি মিস!বাট আমার একটা নামও আছে!”

“তাতে কি?আপনাকে আমি ডাক্তারই ডাকবো।”

“আচ্ছা বেশ,তো একা বসে যে?”

“সীমা আর ইভা এক্ষুনি এসে পড়বে!আপনি এখানে?”

“এ সময় সাধারণত বাসায় ফিরি।কিন্তু আজকে মন চাচ্ছে না।তাই একটু সময় কাটাতে এলাম!”

“একা একা ?”

“একা একা ছিলাম, তবে এখন তো তুমি আছো!”

“আচ্ছা,বুঝলাম!”

ততক্ষণে সীমা আর ইভাও চলে এসেছে।

“আরে ফাহিন ভাইয়া,আপনি?কেমন আছেন?”

” এইতো তোমরা?”

এইভাবেই চার জন আড্ডা জমালো।একটু ঘুরাঘুরি করলো।

“আয়ু,এখন যাওয়া উচিত!হোস্টেলে সন্ধ্যার আগে ঢুকতে হবে আমাদের!”(ইভা)

“হুমম,সন্ধ্যা হয়ে গেছে!তোরা যা।আমিও যাই!”(আয়ুশী)

“তুমি একা যাবে?”(ফাহিন)

“ওদের হোস্টেলের আমার বাড়ির বিপরীতের রাস্তা!তাই একাই যেতে হবে!”(আয়ুশী)

“চলো আমি ড্রপ করে দেই!”

“আপনার গাড়ি আছে?”

“গাড়িতেই কি শুধু ড্রপ করা যায় নাকি?হেঁটে হেঁটেও তো করা যায়..”

আয়ুশী হাসলো।লোকটা ভীষণ মজার!

“তাহলে আয়ু তুই ভাইয়ার সাথে যা,আমরাও যাই! টাটা…”

“টাটা!”

বলেই সকলে নিজেদের গন্তব্যের দিকে গেলো।

আজান পড়েছে একটু আগেই।আরো আগে যাওয়া উচিত ছিল বলেই মনে হচ্ছে আয়ুশীর।ওদের বাড়ির রাস্তা অনেকটাই শুনশান!প্রথমে এত কিছু না ভাবলেও,এখন ভাবতে হচ্ছে।এভাবে হুট করে মাত্র দুইদিনের আলাপে পরিচিত হওয়া ব্যাক্তির সাথে এমন শুনশান রাস্তায় একা আসা ওর মোটেও ঠিক হয়নি!হালকা ভয় করছে ওর!যতই হোক!পুরুষ মানুষ….সহজে বিশ্বাস আজকাল কার যুগে কেই বা করে।আয়ুশীর অবস্থা হয়তো অনেকটা বুঝতে পেরেছে ফাহিন।

“আচ্ছা তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে ?”

এমন প্রশ্নে বেশ ভরকে গেলো ও।তাও জবাব দিল,”না!”

“কাউকে পছন্দ করো নিশ্চয়ই?”

পছন্দের কথা শুনতেই আয়ানের কথা মাথায় এলো সর্ব প্রথম!অদ্ভুত ভালো লাগে ওই লোকটাকে নিয়ে ভাবতে ওর!

“কল্পনা জল্পনা পরে করো,আপাতত আমায় বলো কে সে?”

আয়ুশী নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,”না,ভেবে দেখছিলাম! তেমন কেউ নেই এখনও!”

“সিরিয়াসলি?”

“হুমম,আপনি করেন কাউকে পছন্দ?”

“হুমম করি তো!”

“কাকে?”

“তোমাকে!”

থমকে গেলো আয়ুশীর পা! ঢোক গিলতে লাগলো ও!ভয় করছে এখন ভীষণ!

“আরে আরে রিল্যাক্স,আমি মজা করছিলাম!”

আয়ুশী শান্ত হলো।মৃদু রেগে বলল,”আমার এমন মজা মোটেও পছন্দ না!”

“আচ্ছা সরি!আমি কাউকে পছন্দ করি না!বাট…”

“বাট?”

“ভালোবাসি!”

“কে সে?”

“তার অনুভূতি আগে জানি,তারপর তোমায় বলবো তার কথা!”

“বেশ,তবে আমার একটা প্রশ্ন!”

“কি?”

“আপনি এত সহজ ভাবে নিজের পারসোনাল কথা শেয়ার করছেন কিভাবে আমার সাথে?”

“বলতে পারো,আমরা এখন ভালো বন্ধু হয়ে গেছি!তাই…যদিও এর উত্তর আমারও জানা নেই!”

“আমার বাসা এসে গেছে!”

“ওহ,ওকে বাই!আবার কখনো দেখা হলে কথা হবে!”

“বাই!”

আয়ুশী চলে গেলো। ফাহিন মুচকি হেসে ফোন বের করলো। ফোনের স্ক্রিনে থাকা রমণীর হাস্যজ্বল মুখশ্রী দেখে ওর হাসি আরো প্রসারিত হলো। বিরবির করে বললো,”ভালোবাসি মায়াবতী!”

#চলবে…