অভিনয় পর্ব-০২

0
200

#অভিনয়
#পর্ব_২
#মুমতাহিনা_তারিন

রিপা সকাল সকাল পারুর বাড়ি হাজির আগে পাশাপাশি বাড়ি ছিল দুই বাড়ির এক উঠানের মত । রিপাদের মাটির বারান্দায় দাড়ালে পারুদের বারান্দা সহ সব দেখা যেত ।দুইজন মিলে এক উঠানে কত খেলা করেছে ভেবে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে সামনে এগিয়ে গেলো।

পারু বাইরের চুলায় পিঠা ভাজছে মিষ্টি গন্ধে ভরে যাচ্ছে উঠান।কেবল দশটা বাজে টানা রোদে বসে পিঠা বানাচ্ছে পারু আর কাঠ চুলায় ঠেলে দিয়ে নেড়ে চেড়ে দিচ্ছে পিঠাগুলো।

একটা পিঠা উঠাতে গিয়ে একটু আগে হাত পুড়িয়ে ফেলেছে পারু । ফোসকা পড়ে গেছে শ্যাম বর্ণের হাতে ,,,অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল এখন একটু কম হচ্ছে । তবু মন আজকে অনেক ভালো ওর চাচীর ভাঙ্গা ফোনে টাকা থাকে না তেমন ,,এতটা দিন কিভাবে যে কাটিয়েছে ও। একটা কল দিত তিন চারদিন পর । প্রথম প্রথম শাওন শহরে গেলে দিনে ছয় সাত বার কল দিয়ে ও থামতে চাইতো না । তারপর আস্তে আস্তে কল দেওয়ার সংখ্যা কমতে কমতে শূন্য তে এসে ঠেকলো। খুব কষ্ট হতো পারুর । তবে সব অপেক্ষা আজকে শেষ খুশিতে পারুর চোখে যেনো পানি আসছে বার বার । খুশির কান্না যে সত্যি হয় আজকে নিজে বুঝলো।

‘ কিরে তুই ভাইয়ের জন্য পিঠা বানাচ্ছিস! বাহ আমার ভাইয়ের কপাল বড্ড ভালো বলতে হবে ‘

মিটমিট করে হেসে বললো রিপা । রিপা সুযোগ পেলে লজ্জা দিতে এক মুহুর্ত ছাড়ে না। তা অবশ্য একপ্রকার সয়ে গেছে পারুর। শহর থেকে আসার পর ওদের বিয়ের কথা বলবে বলেছিল শাওন যদিও সবাই জানে । শাওনের আম্মা নিজে প্রস্তাব রেখেছিল পারুর চাচী তনুজার কাছে । চাচী ও রাজি হয়ে গিয়েছিল সেইসব কথা পারু রিপা কেউই জানে না । বড়দের কথা বড়দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে ।

‘ কিসব বলিস এমনি একটু বানাচ্ছি ‘
‘ থাক থাক লজ্জায় আর লাল হয়ে হবে না ‘
——-
গত কালের কথা ভেবে বুকের ভিতর হালকা ব্যাথা অনুভব করলো পারু । কত খুশি মনে নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে শাওনের সামনে দাড়িয়েছিল ও। শাওন কি দেখেছিল ওর ভ্রমর লজ্জা পাচ্ছিলো কেমন?কত কষ্ট করে ধানের কাজ করতে করতে পিঠা বানিয়েছিল ও।
চোখের কোণে পানির উপস্থিতি বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি মুছে নিলো। শাওনের কি পিঠা ভালো লাগেনি?
বাসন গুলো ধুয়ে রান্নাঘরে রেখে দৌড়ে ঘরে গেলো পারু । ঘরের তাকের উপর বাড়তি পিঠাগুলো খেয়ে দেখলো একটু । না সব তো ঠিকঠাক আছে তাহলে???
———–
উঠানের মাঝে পাঁচিল। রিপা কত বলেছিল তাহেরা বানুকে পাঁচিল না দিতে । দুইতলা বাড়ি এখন পাঁচিল না দিলে কি হয়! বলে হৈ হৈ করে উঠতো তাহেরা বানু। এখন বাইরে দাড়ালে আর শাওনের উজ্জ্বল মুখটা দেখা যায় না । বাড়ি ধানের কাজ ফেলে ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারছে না পারু ।সকালে চাচিমা রান্না করেছে এখন ছাগল মাঠে বেধে দিতে গেছে ।
একটু পর পা দিয়ে নেড়ে দিতে হচ্ছে ধান । শাওন কেনো আসছে না একবার দেখা করতে । কালকে এসে ক্লান্ত হয়ে গেছে হয়তো নিজের মনে এইসব সান্তনা সুর বির বির করেছে সারাটা দিন । তীব্র অভিমান মনের মাঝে সৃষ্টি হয়ছে পারুর ।

বিকেলে সূর্যের তাপ যখন মিয়ে পড়েছে তখন পারু উঠানের এক পাশের লাগানো নয়নতারা পানি দিতে ব্যাস্ত রাস্তায় লোক সমাগম একেবারে কম । নরম মিহি কণ্ঠের ঝঙ্কার তোলা হাসির শব্দে রাস্তার দিকে তাকায় পারু । গতকালকের দেখা সেই সুন্দর মেয়েটা আজও কত পরিপাটি ভাবে দাড়িয়ে আছে রীপাদের গেটের সামনে স্মার্ট ফোন কানে তুলে কথা বলছে আর হেসে যাচ্ছে। ভিতর থেকে শাওন এসে দাড়ালো পাশে গায়ে সবুজ রঙের টি শার্ট তার সাথে রিপা ও।সবুজ রংটা পারুর খুব পছন্দের । রিপা পারুকে দেখে চেঁচিয়ে কাছে ডাকলো ।

‘ এই পারুভাবি এইদিকে আয় ‘

রিপার ডাকে রান্নার প্রস্তুতি নেওয়া চাচী মা ও রাস্তার দিকে তাকালো । পারু কে কাছে ডেকে ওদের সাথে যেতে বললো চাচী । পারু বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো । এমন না তার মনে ভয় নেই শাওনকে নিয়ে । শাওনকে পারু অনেক বিশ্বাস করে । শাওন যে পারুর বিশ্বাস ভাঙবে না সেই বিশ্বাস টা পারুর আছে ।

মলিন নীলচে রঙের থ্রি পিস গায়ে জড়ানো পারুর । দীঘল কালো চুলগুলো ঢাকা পড়েছে উড়নার নিচে । শাওনের চোখে পারুকে বড্ড বেমানান লাগলো । তবুও মুখ বুঁজে সাভাবিক ভাব টা ধরে রেখেছে ।

পারু একেবারে সামনে আসে দাড়ালো রিপার । একবার শাওনের দিকে তাকিয়ে খুব সহজেই বুঝে গেলো ওর উপস্থিতি শাওনের ভালো লাগছে না । পারু নিজেকে প্রশ্ন করে ও কি কিছু করেছে? অভিমান হয়েছে নাকি শাওনের!

‘আমাদের সাথে চল ‘
‘ হ্যাঁ ‘

রিপা ও খেয়াল করেছে শাওনের হাব ভাব । নিজের কাছে বড্ড খারাপ লাগতেসে পারুর জন্য কেউ না জানুক রিপা ঠিক জানে পারু শাওনকে অনেক ভালোবাসে । শাওন নিজেই তো পারুকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছিল । ও যে কালো এই ভেবে নিজেকে কত গুটিয়ে রাখতো কিন্তু শাওনের কাছে পারু ছিল খোলা একটা বই ।চোখের ভাষা মুখের ভাব ভঙ্গি দেখেই বুঝে ফেলত পারু কি চায় । এখন কেনো এমন হচ্ছে? মা আর ভাইয়ের পরিবর্তন দেখতে দেখতে ক্লান্ত রিপা।

রাস্তার পাশে বড়ো একটা তেতুল গাছ । এই গাছটার সাথে পারু রিপা শাওনের শৈশব কেটেছে । সামনে একটা খেলার মাঠ । মাঠ টা দেখে শাওনের চোখে ছোট্ট পারুর মুখশ্রী ভেসে উঠলো । তেল চকচকে শরীর এ একটা গেঞ্জি গায় ছোট ছোট চুল গুলো দুপাশে বেঁধে রাখতো পারু শীতের দিনে গোসল করবে না বলে কত কান্নাকাটি করতো দৌড়ে শাওনকে ধরত চাচীর থেকে বাঁচার জন্য । একটু তাকালো মলিন মুখের পারুর দিকে । বুকে সূক্ষ্ম একটা ব্যাথা অনুভব হলো শাওনের ।

রিপা নয়নের হাত চেপে ধরে সামনে এগোতে এগোতে বললো একটা চমৎকার জিনিস দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে । পিছনে ফেলে রেখে গেলো শাওন আর পারুকে । ও চাই দুজন একটু কথা বলুক । শাওনের সাথে আশা মেয়েটার নামই নয়ন ।

পারু হুট করে কেঁদে দিল । মনে লুকিয়ে থাকা সকল বেদনা আর চাপাতে পারলো না পারু ।

‘ কি হয়ছে তোর? আমি কি কিছু করছি তুই তো এমন না । কেনো এমন ব্যাবহার করছিস? ‘

কি বলবে শাওন পারুর হুট করে কেঁদে দেওয়াই নিজে কিছুটা হতভম্ব অবস্থায় আছে। বলে দেবে কি পারু তোকে আমার আর ভালো লাগে না ….

চলবে?