অভিনয় পর্ব-০৩

0
184

#অভিনয়
#পর্ব_৩
#মুমতাহিনা_তারিন

আকাশে হাজারো তারার মেলা । গ্রামের রাত দশটা মানেই অনেক রাত । পারু গভীর ঘুমে মগ্ন টিনের জানালার যত ফাঁক ফোঁকর আছে সব দিক দিয়ে হিম বায়ু প্রবল বেগে প্রবেশ করছে । মোটা কম্বল নিচে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে পারু । শীতকালটা পারুর অনেক পছন্দের সকালে উঠলেই কুয়াশা ,,ঘাসের উপর পড়ে থাকা বিন্দু বিন্দু নিশির শিশির ওকে মুগ্ধ করে বারংবার । হঠাৎ খট খট আওয়াজ তুলে হালকা নড়ে উঠলো টিনের জানলাটা । তার সাথে ভেসে আসলো শাওনের ফিস ফিসানি ডাক ।

‘এই পারু ,,,পারু উঠ ‘

শাওনের ডাকে হুড়মুড় করে উঠে বসলো পারু জলদি করে জানালা খুলে দিলো বিস্ময় ওরে চোখে এই হাড় কাঁপানো শীতে শাওন কেনো আসলো ভেবে পাচ্ছে না । লেপের নিচে তাই ওর কাপুনি উঠে যাচ্ছে । আর শাওন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

‘ এতো রাতে কি হয়েছে? ‘

‘ রাতে বেলী ফুল ফুটেছিলো এতো সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে ভাবলাম দিয়ে যায় সকালে তো আর এত ঘ্রাণ থাকবে না । মালা গেঁথে এনেছি।’

‘তুই কি পাগল!! সকালে দিলেই তো হতো ‘

‘ না হতো না চুল খোল আমি তোরে মাথায় পরিয়ে দি। সবাই খোঁপায় দেয় আমার রাজ্যে তুই রানী রাজাদের মত তো হীরা দেওয়া মুকুট দিতে পারবো না । তাই বেলী ফুলের মালা নিয়ে আসলাম।’

কিছুটা করুন চোঁখে বললো শাওন । শাওনের কথা শেষ হতে না হতেই সুন্দর লম্বা চুল গুলো ছেড়ে দিলো পারু । মাথাটা নিচু করে দিল । শাওনের চোখ দুটো ঝলমলিয়ে উঠলো । জানালার ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে মাথায় পরিয়ে দিল বেলি ফুলের মেলা । বিছানার পাশে রাখা অর্ধ ভাঙা টেবিলের উপর থেকে ছোট আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলে পারু।

‘ আমার কিছু লাগবে না । না টাকা পয়সা তোর শুধু বউ হতে চায় যখন তুই বিল থেকে আসবি আমি হাত পাখা নিয়ে বাতাস দেবো যেমন চাঁচিমা চাচারে দেয় ‘

লজ্জায় অদৃশ্য লাল বর্ণ ধারণ করলো পারুর ফুলে উঠা গাল দুটো । শাওন চাপা হেসে পারুর চোখের দিকে তাকালো । ছোটো ছোটো চোখ দুটো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না হাসার জন্য ।

‘ আমি এতো পড়ছি কি বিলে কাজ করবো তাই? আমি অনেক বড়ো চাকরি করবো তোকে রাজরানী করে রাখব পারু ‘

আগের কথা ভেবে মুচকি হাসলো পারু । কত সুন্দর দিন ছিল শাওন হুট হাট করে চলে আসতো । চমকে উঠতো পারু মনে ভয়ের সঞ্চার হতো ,,কেউ যদি দেখে নেয়! কেউ যদি শুনে নেয়! এই ভয় যে কত ভালোলাগা সৃষ্টি করতো মনে । ঘুমানোর আগে এক বুক ভালো লাগা নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুম পড়লো পারু।
____________

বিকেলের ঘটনায় গভীর দাগ কেটেছে শাওনের মনে । নাহ ও বলতে পারি নি ওমন কঠিন বাক্য । ছোটো থেকে যার চাল চলন বলন সব কিছুকে ও একান্ত নিজের জন্য মনে করেছে । তার চোখের পানিতে যার হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি করে সে কিভাবে বলতো ভালোবাসি না!?অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে পারুকে থামাতে হয়েছে । বারো বছরের ভালোবাসা কি তিন বছরের ব্যবধানে ফ্যাকাশে হয়ে যায়?

নয়ন আজকে চলে যাবে । শহরের যে ফ্ল্যাটে শাওনরা থাকতো তার মালিকের মেয়ে নয়ন । বলার অপেক্ষা রাখে না অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে । আসতে যেতে প্রায় দেখা হতো নয়নের সাথে কিন্তু কথা হতো না । যখনই নয়নকে দেখতো পারুর হাস্যজ্জ্বল মুখ ভেসে উঠতো। তাই কিছুটা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যেত শাওন । শহরে যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে ভালো চাকরি হয়ে গেলো ওর ,,হবেই বা না কেনো! শাওন যথেষ্ট মেধাবী । তার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরিটা একেবারে পারফেক্ট ।

চাকরি হওয়ার মিষ্টি কিনে ফ্ল্যাটের সবাইকে দিয়ে এসেছিল ওর সাথে থাকা বন্ধু ইমরান আর নাহিন । ইমরানের সাথে শাওনের শহরে গিয়েই পরিচয় নাহিন গ্রামের ছেলে যেমনটা শাওন ছিল। নয়ন দের ফ্ল্যাটে গিয়ে প্রথমবার নয়নের সাথে কথা হয় শাওনের যেমন সৌন্দর্য তেমন ব্যাবহার নয়নের কত গোছালো কথা!

ফ্ল্যাটে এসে ইমরান তো একপ্রকার লজ্জা দিয়েই শেষ করে দিচ্ছিল শাওনকে । নয়ন তার সাথে কথা বলেছে মানে অনেক কিছু ! । ধীরে নয়নের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে শাওনের নয়নের আরেক বান্ধবী আছে তুলি তার সাথে ও দেখা সাক্ষাৎ হতো। ধীরে ধীরে পারুর কাছে কল দেওয়া কমে গেলো । যখন ও একটু ফ্রি হতো তখন ইমরান নাহিন অথবা নয়নের সাথে সময় পার করতে লাগলো । যখন পারু কল দিত নয়ন দেখলেই চোখ উল্টাতো,,ইমরান ও অনেকটা বিরক্ত হতো। ওদের সামনে নিজেকে ছোটো লাগতো শাওনের ব্যাস্ত আছি বলেই কল কেটে দিত শাওন ।

ইমরান নাহিন দুইদিন আগেই চলে গেছে । নয়ন শুধু ছিল গ্রাম দেখবে তাই আর পারুকে । পারুর মাঝে মাঝে কল দেওয়াই একটু সন্দেহ ছিল নয়নের মনে । নয়নের থেকে সুন্দর কিনা পারু,, তাই দেখার জন্যই পড়ে ছিল । নয়ন হিংসুটে অহংকারী এমন না। কিন্ত ভালোবাসার মানুষের পাশে ও যে অন্য মেয়েকে সহ্য করতে পারবে না । সাদা টি শার্ট পরা ফর্সা বর্ণের শাওনকে ছাদে কাপড় নাড়তে প্রথম দেখেছিল নয়ন। মুখের সাথে সবসময়ই হাসি লেগে থাকে । আর সবথেকে আশ্চর্য হয়েছিল শাওনের ব্যাবহারে ওকে এড়িয়ে চলাটা যেনো নয়ন কে আরো কাছে নিয়ে গেলো শাওনের । ক্লাসে হাজারো ছেলের ক্রাশ হাওয়া মেয়েটাকে এইভাবে কোনো গ্রামের ছেলে ইগনোর করছে বিষয়টা ইন্টারেস্টিং লেগেছিল ।

‘বাবু তোরে নয়ন ছাদে ডাকছে ‘

‘ কখন আম্মা?’

‘ একটু আগে যা দেখা করে আয় মেয়েটা আজকে চলে যাবে ‘

শাওন সকালে বেরিয়ে ছিল বাজারে । নয়ন চলে যাবে তাই ভালো বাজার করতে । শাওনের বাবা নেই । শাওনের মাকে রেখে আরেক জায়গায় বিয়ে বসিয়েছে শাওন তখন মাত্র ছয় বছরের । হাত মুখ ধুয়ে ছাদে চলে গেলো শাওন।
__________

সকালে নিত্য দিনের মতোই কাজ শেষ করেছে পারু । চাচীর সাথে বসে তরকারী বেছে দিচ্ছিল । রিপা শাওনের ব্যালকনি তে দাড়িয়ে পারুকে ডাক দিল ।

‘ এই পারুভাবি আমাদের বাড়ি আসবি একটু পর । নয়ন আপু চলে যাবে ‘

রিপার দিকে তাকিয়ে হেসে সম্মতি দিল পারু।

রান্না বসিয়ে চাচী রিপাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিল পারুকে।
______________

সোফায় বসে খাবার বাড়ছেন টেবিলে তাহেরা বানু। হাতে হাতে সাহায্য করছে রিপা ।

‘ খালা কেমন আছেন?’

‘ তুই চলে আসছিস এতো দেরি লাগে আসতে !’

মেকি রাগ করে বললো রিপা । তাহেরা বানু পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করছে পারুর ।

‘ ভালো । হা রে পারু তোর কি বোধ নেই? বাড়ি মেহমান এমন হুটহাট আসলে কেমন দেখায়? আর আসিস তো রংচটা কাপড় পরে মানুষ কি ভাবে দেখলে ‘

হাসি হাসি মুখটা মুহূর্তই আঁধার নামলো পারুর । খালা এমন বলবে ও বুঝতে পারেনি । জামাটা সত্যি একটু রংচটা কিন্তু কি করবে । ও থাকে চাচী বাড়ি নতুন নতুন জামা কাপড় পরার মত সামর্থ্য ওর নেই । চাচীমা এমনি ও ওকে যা দেয় তা যথেষ্ট । নিজের আব্বা আম্মা থাকলে এমনই দিত । যতক্ষণ না জামা ছিড়ে যায় ততক্ষন ভালোভাবেই চালায় পারু । ও তো আরো চেষ্টা করে যাতে জামা কাপড় কম ছেড়ে ।

‘ আম্মা কেমন কথা কও!!! ঠিক ই তো আছে আর ও বেড়াতে আসেনি । আর এইডা তো ওর নতুন কোনো আত্মীয় বাড়ি না যে ঝা চকচকে জামা পরে আসতে হবে। চল তো পারু আম্মা বুড়ো হয়ে গেছে মাথা আওলাই গেছে একেবারে ‘

‘ বেয়াদপ হচ্ছো দিন দিন কানের নিচে দুটো দেবো । ‘

তাহেরা বানুর কথা শেষ হওয়ার আগেই পারুর হাত ধরে ছাদের দিকে হাটা ধরলো রিপা ।
—————
ছাদে হালকা বাতাস হচ্ছে । নয়নের সিল্কী চুল গুলো বাতাসে যেনো একটু বেশি উড়াউড়ি করছে লাল সবুজের মেশানো একটা গোল জমা পরে দাড়িয়ে কথা বলছে শাওনের সাথে ।

‘ তুমি কবে ফিরবে শহরে ?’

‘ দেখি তো গ্রাম থেকে তো এখন অফিস করা যাবে । আম্মা তো একা থাকে আর হয়তো শহরে যাওয়া হবে না ‘

ছল ছল করে উঠলো নয়নের মোহনীয় চোখ দুটো । গলা কেপে উঠছে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছে ।

‘ আমাকে মনে পড়বে আর?’

‘ তোমার যখন আমাকে মনে পড়বে আমাকে কল দিয়ো আমি যাবো । বন্ধুর মত পাশে পাবে আমাকে ‘

স্মিত হেসে শাওন বলে উঠলো । সকল বাধ ভেঙে নয়ন আচমকা জড়িয়ে ধরলো শাওনকে ।

‘ আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি শাওন । অনেক ভালোবাসি । কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে তোমার সাথে কাটাতে চাই সারাটাজীবন। মনে আছে তোমার আমরা ঘুরতে গেছিলাম । তুমি আমার হাত ধরে রাস্তা পর করে দিয়েছিল সেইদিন ঠিক করেছিলাম আমার তোমাকে চায় ‘

জীবনে প্রথমবার কোনো নারী তার এতো কাছে আসলো । শাওন কিংকতব্যবিমূঢ়। কি করবে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না । পারুর হাত পর্যন্ত ধরে নি ও। পারুকে সবসময় পবিত্র রূপে দেখতে চেয়েছে শাওন । নয়নের জায়গায় পারু থাকলে ওকে ও হাত ধরেই পার করতো । নিজেকে সাভাবিক রেখে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে শাওন ।

হটাৎ ছাদের দরজা খুলে ছাদে পা রাখলো। ওর উড়না তে কাচা তেতুল । রিপা লবণ নিয়ে আসতেছে পারুকে ও দাড়াতে বললো কিন্তু শাওন ছাদে আছে শুনে পারু আর দাড়ায়নি । পার নিচে কি যেনো ফুটলো পা সরিয়ে একটা দামী কানের দুল উঠালো পারু একটু সামনে এগোতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো । নিজের সারামুখটা হঠাৎ করে কেমন গরম হয়ে গেলো ।চোখ জ্বলতে শুরু করলো বুকে অসহ্য ব্যাথা অনুভব করলো পারু ।

‘ তোকে বললাম দাড়াতে আমাকে একা রেখেই চলে আসছিস তুই’
রিপার কথা শুনে শাওন সামনে তাকালো । তখনও নয়ন শাওনকে জাপটে ধরে আছে । নয়নের হুশ নেই প্রিয় মানুষের বুকে শান্তি খুঁজতে ব্যাস্ত । চোখাচোখি হলো শাওনের সাথে পারুর । এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো চোখের কার্নিশ বেয়ে। রিপা পারুকে অনড় অবস্থায় দেখে দুই সিড়ি উপরে উঠলো পারুর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকালো রিপা । সূক্ষ্ম একটা ব্যাথা ছুঁয়ে গেলো ওর বুকে ও।
শাওনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রিপার দিকে তাকালো পারু ।

‘ রিপা আমি না যায় । কাপড় গুলো ভেজাতে হবে ।পড়ে আসবো ‘

খুব সাভাবিক ভাবেই পারু বললো চোখে জল টলমল করা পানি নিয়ে । রিপার কিছু বলার আগেই ধির পায় সিড়ি ভেঙে নিচে নামার উদ্দেশে পা বাড়ালো ।

চলবে?