অভিযোগ পর্ব-০১

0
501

#অভিযোগ
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#সূচনা_পর্ব

মেইন রোডের পাশে দাঁড়িয়ে সাগ্রহে সিগারেটে সুখটান দিয়ে নাকেমুখে ধোঁয়া ছাড়ছে রাফিদ। হুট করেই তার গালে নরম হাতের শক্ত একটা চ’ড় পড়লো। আচানক এমন আক্র’মণে ভেতরের লেলিহান আগুনের লাভা দাউদাউ করে উঠলো। জ্বলন্ত নেত্রে সেই হাতের অধিকারিনীর দিকে দৃষ্টি ফেলার সাথে সাথে পরপর আরও দুটো চ’ড় দিয়ে বসলো সেই হাতের মালিক। হতবাক, হতবিহবল চাহনিতে চেয়ে রইলো রাফিদের বন্ধুরা। এই অচেনা মেয়েটি এভাবে তাদের বন্ধুকে আ’ঘা’ত করলো? তাও আবার তাদেরই সামনে?
রাফিদ ঠোঁট দুটো ফাঁক করলো কিছু বলার উদ্দেশ্যে। মেয়েটি রাফিদকে হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিয়ে তিরিক্ষি গলায় বলল,

-“রাস্তায় দাঁড়িয়ে অস’ভ্যের মতো সিগারেট টা’নতে লজ্জা হয়না? ছোট বাচ্চাদের উপর কিরকম প্রভাব পড়ছে সে খেয়াল আছে?”

রাফিদের কলার মুঠো করে সামনে দাঁড় করানো সিএনজির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তারান্নুম।
রাফিদের বন্ধু চ’টে গেলো ভীষণ। অত্যন্ত দু’র্বৃত্ত গলায় বলল,

-“এই মাইয়া, তোমার কি আমরা সিগারেট টা’নলে? নাকি রাস্তায় ছেলে দেখলেই ঢ’লা’ঢ’লি করতে মন চায়। ছাড়ো আমার বন্ধুরে।”

এ পর্যায়ে এসে তারান্নুম প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হলো। অত্যন্ত বেয়া’দব ছেলেদের সাথে ওঠাবসা করছে তার ভাই। ছেলেটিকে কিছুই বললনা। শান্ত চোখে রাফিদের দিকে তাকালো। রাফিদ তার বন্ধুকে শাসিয়ে নাকের পাটায় ঘু’ষি দিয়ে রাগি স্বরে বলল,

-“একদম বা’জে কথা বলবিনা। মুখ সামলে কথা বলবি। ও আমার আপু হয়।”

ছেলেটি চমকে উঠলো। ঢোক গিলে তটস্থ দৃষ্টিতে একবার রাফিদ, একবার তারান্নুমের পানে চাইলো। তারান্নুম টে’নেহিঁ’চড়ে রাফিদকে সিএনজিতে তুললো। রাফিদ একটা শব্দ ও করলোনা। মাথানিচু করে বোনের সাথে সিএনজিতে উঠলো।

সম্পূর্ণ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ইশতিয়াক আহমেদ। কলেজের ক্লাস করিয়ে বাড়ি ফিরছিলো সে। সিএনজিতে পাশাপাশি একটা রমণী ছিলো, অতিপরিচিত হলেও এখন অপরিচিতের মতো। রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ করেই সিএনজি থামিয়ে দাঁড়াতে বলল ড্রাইভারকে। অতঃপর হনহনিয়ে সিগারেট টা’নতে থাকা ছেলেটিকে পরপর চ’ড় দিয়ে বসলো। কি হলো কথাবার্তা কিছু স্পষ্ট কর্ণধারে পৌঁছায় নি ইশতিয়াক এর।
সিএনজিতে বসতে গিয়েই ইশতিয়াক স্যারকে দেখে গলা শুকিয়ে গেলো রাফিদের। কিন্তু ইশতিয়াক আহমেদকে নির্লিপ্ত দেখা গেলো। ইশতিয়াক স্যারের চেহারায় তাকালেই রাফিদের একটা ভাবনাই মাথায় আসে৷ আর সেটা হলো,’স্যার যদি ছেলে না হয়ে মেয়ে হতো তাহলে অনেক আগেই রাফিদ তাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলতো।’
ধারণাটি শুধু রাফিদের নয়, কলেজের প্রায় অর্ধ শতাংশের ও বেশি স্টুডেন্ট এই ধারণা পোষণ করে।
এমন রূপবান ছেলেকে সৃষ্টি করার কি দরকার ছিলো? রূপ হচ্ছে মেয়েদের অলঙ্কার। ছেলেদের কেনো রূপ থাকবে?
আজ স্যার কে দেখে এসব ধারণার বদলে রাফিদের বদনে ভী’তি দেখা গেলো।

তারান্নুমের আকাশচুম্বী ধমকে সিএনজিতে উঠে বসলো রাফিদ। মাথা নিচু করে বলল,
-“সরি আপু! প্লিজ বাবা কে কিছু বলোনা।”

তারান্নুমের কাছ থেকে ঝাঁঝালো উত্তর এলো,
-“কেনো? অপ’কর্ম করার আগে মনে থাকেনা বাড়িতে বাবা মা আছে। তাদের অবাধ্য হচ্ছিস।
আমার কানে অনেকবার খবর পৌঁছেছে তোর সিগারেট খাওয়া, দুর্বৃত্ত ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব করা। আজ নিজ চোখে দেখেও নিলাম। টাকার জন্য মায়ের সাথে উচ্চবাক্য করিস, ঘরে জিনিসপত্র ভাংচুর করিস। তুই কি ভেবেছিস আমি কিছু জানিনা? এখন থেকে তো বাড়িতেই থাকবো। আমিও দেখতে চাই তুই কতোবড় হয়েছিস।
এসব তো ভালোই চলে। তো পড়ালেখা কেমন চলে?”

মাথানিচু করে রইলো রাফিদ। পাশ থেকে ইশতিয়াক পরখ করছিলো ব্যাপারগুলো। বেশ উপভোগ করছে। ছেলেটা বোনকে খুব ভ’য় পায় দেখছি। অথচ ক্লাসে ঠিকমতো পড়া দেয়না। বেশিরভাগ সময়ই ক্যাম্পাসের বাইরে ঘোরাঘুরি করতে দেখে কিন্তু ক্লাসে দেখা যায়না।

রাফিদ ভ’য় পাচ্ছে স্যারকে নিয়ে। যদি স্যার নালিশ করে আপুর কাছে?

ইশতিয়াক গলা পরিষ্কার করে আন্তরিকতার সহিত বেশ ভদ্রভাবেই বলল,
-“আরেকটু কড়ানজরে রাখবেন নিজের ভাইকে। ক্লাসেও ঠিকমতো পাওয়া যায়না।”

কান ধাঁধিয়ে গেলো তারান্নুমের। রাশভারী ধাঁচের কন্ঠস্বর শুনে পাশ ফিরে তাকালো। বয়স প্রায় ত্রিশের উর্ধ্বে, দেখতে চোখ ধাঁধানো সুদর্শন এমন একজন ভদ্রলোককে দেখতে পেলো। তার রূপের যাদু কয়েকবছর আগেই সম্মোহিত করলো তারান্নুমকে। খানিক সময় ঘোরের মাঝে তাকিয়ে রইলো। এমন রূপবান পুরুষ তার জন্য নয়। পরক্ষণেই আত্মসম্মানের দাপটে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ‘চোখ সব সময় সুন্দর জিনিসকেই আকর্ষণ করে। আর মন সুন্দর চরিত্রকে আকর্ষণ করে’।

তারান্নুমের দৃষ্টি দেখে দুর্বোধ্য হাসলো ইশতিয়াখ। বছর কয়েক আগে কতশত বার এমন করে দৃষ্টি বিনিময় হতো। এখন আর সেসব হয়না, সবই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এবার বোধহয় আগের সময় টুকু ফিরিয়ে আনা উচিত।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বেশ সাবলীল,শান্ত গলায় শুধালো তারান্নুম,
-“ক্লাসে পাওয়া যায়না মানে? আপনি কে?”

আবার ও খানিক হাসলো ইশতিয়াখ। চিনতে পারছেনা? আসলেই কি চিনতে পারছেনা নাকি অভিমান দেয়াল তৈরি করে রেখেছে।
-“টিচার, রাফিদের কলেজ টিচার ইশতিয়াখ আহমেদ।”

রাফিদ এই ভ’য়টাই পাচ্ছিলো। দুজনের মাঝখানে পড়ে তার অবস্থা এখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’।

রাফিদের দিকে একবার কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফের ইশতিয়াকের দিকে তাকালো তারান্নুম। দাঁতে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-“একদম ছাড় দেবেন না। ক্লাসের বাইরে যেখানেই দেখবেন মা’রের উপর রাখবেন। যদি বেয়া’দবির শিক্ষা হয় আরকি। বাসায় বেয়া’দবি করে, আবার নিজের শিক্ষকের সাথেও বেয়াদবি?”

তওহিদকে ধমক দিয়ে বলল,
-“পাশে যে তোর স্যার বসে আছে সালাম দিয়েছিস? নাকি ভদ্রতার সহিত আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিস?”

তারান্নুম ক্ষণে ক্ষণে বুঝিয়ে দিচ্ছে ইশতিয়াখ আর সে কতটা অপরিচিত। কতটা স্বভাবিক তার ব্যবহার। অথচ এককালে এই মেয়েটার কতটাই না পা’গলাটে আচরণ ছিলো তার জন্য।

কথা বললোনা রাফিদ। কথা বললেই বি’পদ। মাত্র তো হালকা বাতাস বইছে। বাসায় গেলে দমকা হওয়ায় তান্ডব চলবে। সে তো ভেবেছে স্যারকে আপু চেনে। কাছাকাছি বাসা তাদের। কিন্তু রাফিদ এটা ভুলে বসে আছে তারা নতুন বাসায় উঠার পর থেকে আপু এখানে ছিলোনা। মাঝেসাঝে আসতো। ফুফুর বাসা থেকে ভার্সিটি কাছে বলে বাসা পরিবর্তন করার পর সেখানেই ছিলো তারান্নুম। মায়ের কাছে ভাইয়ের কীর্তি শুনে ঠিক করলো দেরি হোক ভার্সিটি যেতে, এখন থেকে ভাইকে টাইট দিতে হলে তাকে বাসাতেই থাকতে হবে। রাফিদ বড় আপুকে যেমন ভালোবাসে, তেমন ভ’য় ও পায়। সেজন্যই মা তারান্নুমকে খবর দিলেন।

বাড়ি আসার পূর্বে মেইন রোডে সিএনজি থামিয়ে নেমে পড়লো ইশতিয়াক। কিছু জিনিস কেনার আছে। বাকি দু’মিনিটের পথ হেঁটেই যেতে পারবে। তারান্নুম রাফিদকে নিয়ে বাসার কাছেই নামলো। আপাতত বাসার কাউকে কিছু জানালোনা তারান্নুম। রাফিদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

গোধূলী লগ্নে ভাঁটা পড়ালো সূর্যের তেজ। সকালের মতো মিষ্টি রোদ্দুর, রক্তিম আভায় নীলাম্বর রঙিন। মৃদু ছন্দে বাতাসের দোল স্পর্শ করছে পাতা ভর্তি ডালে ডালে। রক্তিমা আভায় মনে হচ্ছে আকাশে গোলাবর্ষণ হচ্ছে। চারপাশে যতদূর চোখ যায় ছোট-বড় বিল্ডিং এর সমাহার। বাসায় আসলেই একছুটে ছাদে চলে আসে তারান্নুম। দুপুরে খাবার খেয়ে ভাতঘুম দেওয়া তার অভ্যেসে নেই। কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে সূর্যের উত্তপ্ত দাপট কমার অপেক্ষায় ছিলো। অবসান ঘটিয়ে চলে আসলো ছাদে।
পড়ালেখা আর চাকরি জীবন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত সময় পার করে যে বিকেল টুকু উপভোগ করার সময় হয়না। ছোটবোন তাবিয়া পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। খোলা হাওয়ায় নিজেকে বিলীন করে দেয়ার অভিলাষ জাগলো মনে। “ইশ! যদি আমার দুটো ডানা থাকতো, তবে ডানা মেলে আকাশে উড়ে বেড়াতাম। চিনে নিতাম পৃথিবীর আনাচকানাচে।”
পাশের ছাদে চোখ যেতেই চমকে উঠলো তারান্নুম। ইশতিয়াক আহমেদ পাশের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। উনার বাসা কি এখানে? তার চোখে চোখ পড়তেই মসৃণ হাসলো লোকটি। তবে কথা বললোনা। হয়তো সৌজন্যতার খাতিরেই ঠোঁট প্রসারিত করলো।

প্রত্যুত্তরে চোখ ফিরিয়ে নিলো তারান্নুম। এতক্ষণ যাবত নিজেকে স্বাধীন মনে হলেও এখন তেমন মনে হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে সে ক্রমশ আড়ষ্ট হচ্ছে। এমন হওয়ার কারণ হয়তো পাশের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি। এখন তো চাইলেও নিজের মতো করে বিকেলটা উপভোগ করা যাবেনা। নিজের কাছে নিজেকে যতটা স্বাধীনভাবে উপস্থাপন করা যায় সেটা অন্যকারো সামনে যায়না। নতুন বাসা নেওয়ার পর তারান্নুম চার-পাঁচ বার বাসায় এসেছে, ছাদে ও উঠেছে কিন্তু লোকটিকে দেখেছে বলে মনে হয়না। বেশিক্ষণ আর ছাদে টিকতে পারলোনা তারান্নুম। নেমে পড়লো সিঁড়ি বেয়ে।

ইশতিয়াক তার অবসর সময়টুকু ইদানীং ছাদে কাটিয়ে দেয়। সবসময় ছাদে আসা হয়না। কিন্তু ইদানীং ছাদে এসে বসে থাকে। সকাল থেকেই কোলাহল সহ্য করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে মন একটু খোলা, ঠান্ডা পরিবেশ প্রত্যাশা করে। ছাদে এসে তারান্নুমকে দেখে অবাক হলোনা ইশতিয়াক। সে জানে এই বাসাটা তার ছাত্র রাফিদের। তারান্নুম যেহেতু রাফিদের বড়বোন সেহেতু তারান্নুম এখানে থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। বরং তাকে এতগুলো দিন না দেখাই অস্বাভাবিক। তারান্নুমের যাওয়ার পথে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো ইশতিয়াখ। আর বেশি দেরি নয়।

বাসায় আসলো দুদিন হয়েছে। এরমাঝেই নাকি বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। বিরক্ত হলো তারান্নুম। বাসায় আসলে মা ও বিয়ে বিয়ে করে জীবন দিয়ে দেয়। মা বললেন,
-“ভালো সমন্ধ। ছেলের ছবি দেখে নিস। আমি রেখে গেলাম। বিয়েতো একদিন করতেই হবে মা। তোর ছোটটা ও তো উপযুক্ত হয়ে উঠছে।”

মা চলে যাওয়ার পর তারান্নুম ছবিটি হাতে নিলো। আর যাইহোক অন্যদের মতো নিজের পছন্দ ছাড়া, না দেখেই বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করাটা তার দ্বারা সম্ভব নয়। বিয়ে কি পরিবারের সাথে হবে? বিয়ে দুটি মানুষের মধ্যাকার বন্ধন। ছেলে পছন্দ না হলে সে বিয়ে করবেনা। ছবিটির দিকে তাকাতেই ভারী অবাক হলো তারান্নুম।আশ্চর্য ভঙ্গিমায় ওলটপালট করে দেখলো ছবিটি। চমকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলো। অষ্পষ্ট সুরে ক্ষো’ভ মেশানো গলায় বলল,

-“ইশতিয়াখ আহমেদ। কারো হৃদয়ে বসবাসকারী ব্যক্তি। কিন্তু তার জীবনে আপনার জায়গা নেই, কোনো জায়গা নেই।”

#চলবে….