অলীকডোরের চন্দ্রকথা পর্ব-৮+৯

0
194

#অলীকডোরের চন্দ্রকথা। (পর্ব-৮)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

দূর হতে আমি তারে সাধিব
গোপনে বিরহডোরে বাধিব….

আকাশ পানে চেয়ে গিটারে সুর তুলে বিরহের গান গাইছে সৈকত। বিরহের বিচরণ শুধু গানে নয়, স্বরে, মনে মুখে সবখানে। কাল মুনের আনুষ্ঠানিক বাগদান। পাত্র এসে রিং পরিয়ে যাবে। পাত্রপক্ষের আকস্মিক মতবদলে এই সিদ্ধান্ত। সেদিন মনির সাহেবকে অতসব বলার পর সৈকতের ধারণা ছিল, উনি বিয়ে ভেঙে দিবেন। কিন্তু দিন দুয়েক পেরুলে ও তার পক্ষ থেকে কোন দ্বিরুক্তি আসেনি। রুবাব অপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু মনির সাহেব ছেলেকে কোন কথা বলবার সু্যোগ ও দিচ্ছেন না। সৈকতের মনে হারানোর ভয় ডেবে বসেছে যেন। দিশেহারা লাগছে। এই রাত্রিবেলা পড়ালেখা বাদ দিয়ে বারান্দায় বিরহবিলাস করছে সে।

গিটারের সুর কানে আসতেই পড়া থামিয়ে দিল নাহিদ, অন্তর। অসহায় চোখে তাকাল একে অপরের পানে। আপোষের পদক্ষেপ তো নিয়েছে ওরা। তাতে কাজ না হলে জোরের অপশনে যেতে হবে। কিন্তু অনুভূতি কেবল এক পক্ষীয় হবার কারণে সেটাও করা যাচ্ছে না। মুন যদি ভাইয়ের পক্ষ নেয়! এ জন্য হাত গুটিয়ে বসে বন্ধুর বিরহ দেখছে। কপালে বিরক্তির ভাঁজ টেনে অন্তর বিরস কন্ঠে বলল,
“শা লা, ভালোবাসার লাইগ্যা দুনিয়ায় আর মাইয়্যা পায় নাই, ভালোবাসার । রুবাবের বোনরেই পাইছে। এখন রুবাবের জন্য কিছু করতে ও পারতেছি না।”

বকতে বকতে পা বাড়াল পাশের রুমের দিকে। নাহিদ গেল না। রুমে বসে গভীর ভাবনায় মগ্ন ছিল। অন্তর বন্ধুর মন খারাপের সঙ্গী হলো। বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকল,
“সৈকত?”

সৈকত গান থামাল। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল। অন্তর গিয়ে বন্ধু পাশে বসে বলল,
“আরে, এত প্যারা নিচ্ছিস ক্যান! এসব রিং টিং কী আসে যায়? আসল তো বিয়া। ওইটায় টাইম আছে। ভাইঙা যাইব।”

সৈকতের উদাসীনতা কমল না। আনমনে গিটারে টুংটাং করে গেল। অন্তর বলল, “চল চা খাইয়্যা আসি?”

সৈকত নড়ল, উত্তরও দিল না। নিশ্চুপে অনাগ্রহ প্রকাশ করল কেবল। অন্তর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওদের বিরহডোরের মাঝে হন্তদন্ত হয়ে বারান্দায় এলো নাহিদ। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “গেছে।”

সৈকত নির্বিকার। অন্তর ভ্রু কুঁচকাল, “কী গেছে?”
নাহিদ উত্তেজনায় কথাই বলতে পারল না কিছুক্ষণ।

তারপর ভাঙা গলায় বলল, “বিয়া ভাইঙা গেছে।”

সৈকত বিস্ফোরিত চোখে চাইল। অন্তর হৈ হৈ করে উঠল, ” সত্যি?”
“রুবাব ফোন দিয়ে বলল, আংকেল মানা করে দিছে।” হেসে বলল নাহিদ। অন্তর সৈকতের কাধ চাপড়ে বলল,
” ইদ মোবারক, মামা।”

নাহিদ এসে গিটার টেনে বন্ধুকে দাঁড় করাল, ” বিয়ে ভেঙে গেছে, এইবার বাপ্পারাজের রোল থেইক্যা বাইর হ। ”

সৈকত নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। ওর মুখে এখন বিরহের লেশ নেই, আছে কেবল বিস্ময়। বিস্ময়, অবিশ্বাস নিয়ে অসাড় দাঁড়িয়ে রইল। তারপর, আকস্মিক হেসে ফেলল। ঝট করে নাহিদকে জড়িয়ে ধরল। ওকে এত পরিমাণ খুশি দেখাল! ওর খুশি দেখে বন্ধুরা যেন প্রাণ ফিরে পেল। নাহিদ হেসে বলল,
” চান্না মেরিয়া গাওয়া থেইক্ক্যা বাঁচছস, এবার ট্রিট দে।”

সৈকত খুশিতে ফেটে পড়ল। উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল, “আমি মুনরে বিয়ে করব।”

এই খুশির সময় রুবাবের প্রসঙ্গ টানল না বন্ধুরা। অন্তর প্রশ্রয়ের সুরে বলল, “আচ্ছা করিস। আমি আগেই বলে দিচ্ছি, আমি কিন্তু কনেপক্ষ। কনেপক্ষ হলে আয় রোজকার ভালো হয়। দুলাভাই দুলাভাই বলে গেইট ধরব। টাকা বেশি দিবি। নইলে বোন দিব না। ”

সৈকত প্রসন্ন হাসল। দৃঢ় স্বরে বলল, ” আমি কালই রুবাবের সাথে কথা বলব।”

বন্ধুরা আতঙ্ক নিয়ে তাকাল একে অপরের দিকে। নাহিদ বলল,
” যারে জন্য এত পাগলামি তারে আগে জানা। বিবি রাজি না হলে মিয়া আর কাজি কিছু করতে পারবে না।”

সৈকতকে চিন্তিত দেখাল। অন্তর প্রসঙ্গ ঘুরাতে বলল, “ওসব পরে ভাবিস, এখন বাইরে চল। আইসা আবার পড়তে বসতে হবে। তোর এই বাপ্পারাজের ফর্মের জন্য আজ পড়া হয়নি।”

তিনবন্ধু বেরুলো। ডিনারে বসল। খাওয়ার মাঝে রুবাব জানাল, সে আসছে। অনেক কসরতের পর বিয়ে ভাঙার খুশি উৎযাপন করবার মনস্থির তারও। বন্ধুরা তাদের ঠিকানা বলল। রুবাব এসে বলল,
“আজ পড়ালেখা বাদ দিয়ে সবাই বাইরে খেতে এলি! কোন উপলক্ষে? ”
“আজ সৈকত ট্রিট দিচ্ছে।” ধীরে বলল নাহিদ।

রুবাব সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিরে কাহিনি কী? কিসের ট্রিট? বাড়ি যাইয়্যা বিয়া শাদী কইরা আসোস নাই তো!”

অন্তর আর নাহিদ ঠোঁট চেপে হেসে সৈকতের দিকে তাকাল, “বল, বল কিসের ট্রিট দিচ্ছিস?”

সৈকত রুবাবের দিকে চোরা চোখে তাকাল। তারপর চোখ ফিরিয়ে বলল, ” এমনিই বাইরে খাইতে মন চাইছে। ”

“এমনিই!” অন্তর আর নাহিদ ভ্রু নাড়াল। রুবাব সন্দিহান চোখে তাকাল,
“পরে যদি গ্রাম থেইক্যা বাচ্চা আইনা কোলে দিয়া কস, এইটা তোমার চাচা। তহন কিন্তু রক্ষা নাই তোর, সৈকত।”

সৈকত হেসে ফেলল, “আচ্ছা, যা চাচা না মামা কমু তোরে। এখন চুপচাপ খা শা লা।”

নাহিদ অন্তর বহু কষ্টে হাসি চেপে রাখল। রুবাব কথার মর্মার্থ ধরতে পারল না। সে স্বভাবগত বলল, “শা লা ডাকবি না! তোর কাছে আমার বোন বিয়া দিব না।”
সৈকত মাছি তাড়ানোর মতো করে বলল, “তোর বোনেরে বিয়ে করার জন্য কানতেছি আমি?”

অন্তর বিড়বিড় করল, “ওটাই শুধু বাদ রাখছস। ”

কথাটা রুবাব শুনল না, সৈকত শুনে গেল। রাগ নিয়ে চাইল অন্তরের দিকে।

_______________________

ভার্সিটি চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে তিন যুবক। তারমধ্যে দুই যুবকের মাঝে বিশেষ একটা ভাবাবেগ নেই। তারা দেয়ালে হেলান আপনমনে গল্প করছে। তৎপর কেবল এক পুরুষপ্রাণ। তার আপেক্ষিক দৃষ্টি দূর পথে। চোখ মুখে চাপা কৌতুহল। মেয়েটা আসছে না কেন? উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“নাহিদ, তুই শিওর, ও আজ ভার্সিটি আসছে?”

নাহিদ হেয়ালি সুরে বলল, ” তোর ও এর ভাই বলেছে, তোর ও ভার্সিটি এসেছে। এখন তোর ও তোর বিরহে ভার্সিটি থেকে বনবাসের পথ ধরেছে কি না আমি জানি না।”

সৈকত বন্ধুর দিকে বিরক্ত চাহনি দিয়ে হাত ঘড়িতে সময় দেখল। আধঘন্টা হয়ে গেছে।

অন্তর হো হো হেসে ফেলল। তারপর বিরক্তি নিয়ে বলল, “কত কথা আসছে মনে। মুনেরে ছোটোবোনের নজরে দেখি বলে কিছু বলতে ও পারতেছি না। শালা,কাজটা ঠিক করলি না।”

তখনই দূর থেকে আসতে দেখা গেল মুনকে। নাহিদ হাফ ছাড়ল, “ওই তো আসতেছে। আজ কিন্তু বলে দিবি। ”

সৈকত চঞ্চল হয়ে উঠল। ওর চেহারা আকস্মিক ঝলমল করল যেন। মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল দূরপথের মেয়েটাকে। পরপরই ভীষণ নার্ভাস লাগল ওর। যত সামনে এলো তত হৃদস্পন্দ বাড়ল ক্রমশ। নড়ে-চড়ে দাঁড়াল। মুন ওদের খেয়াল না করে পাশ কাটছিল। নাহিদ ডাকল, ” মুন? ”

মুন ফিরে তাকিয়ে ওদের দেখে অবাক হলো। উৎফুল্ল স্বরে বলল, “ভাইয়ারা, আপনারা সবাই এখানে?”

“এসেছিলাম একটু কাজে। তা তোমার কী অবস্থা? ”

মুনকে বেশ হাস্যজ্বল দেখাল,” ভালো।”
“শুনলাম বিয়ে ভেঙে গেছে। অনুভূতি কেমন?”

মুন কৃতজ্ঞভরে প্রাণবন্ত হেসে বলল, ” ভাইয়া আপনাদের ধন্যবাদ। আপনাদের কথা ভেবেই বাবা শেষ মুহুর্ত বিয়ে ভেঙেছেন।”

সৈকত গভীর চোখে ওর হাসি দেখল। মুনের কথায় মনোযোগ নেই ওর। নাহিদ কথা বলছে মুনের সাথে,
“ভাইদের ধন্যবাদ দিতে হয়না। এবার পড়ালেখায় মনোযোগ দাও।”

অন্তর চাপড়ে বাস্তবে ফিরল সৈকত। মুন তখন প্রসন্ন স্বরে বলল,
“আপনাদের মতো তিনটা ভাই পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। আমার ভাগ্য ভালো। এভাবে ভাই হয়ে থাকবেন সবসময়। ”

ওর ভাগ্যের বাহ্বাজনক কথা সুন্দর হলেও আকস্মিক কেশে উঠল সৈকত।
তাতেই শব্দ করে হেসে উঠল নাহিদ অন্তর। ওদের আকস্মিক ভাবভঙ্গিতে হকচকিয়ে গেল মুন। অবাক চোখে চাইল,
“কী হয়েছে ভাইয়া?”

বিপরীতে অন্তর হাসতে হাসতে বলল, “তিন না দুই।”

মুন বিভ্রান্ত হলো, “কী?”

অন্তর আর নাহিদ হেসে এগিয়ে গেল। রয়ে গেল বিভ্রান্ত মুন আর বিব্রত সৈকত। মুন ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ” উনারা হাসল কেন? আর কী বলে গেল?”

সৈকত চাপা স্বরে বলল,
“বুঝবেনা তুমি।”
“কেন বুঝব না? আমি সব বুঝি।”

সৈকতের চেহারা প্রসন্ন হলো, “আচ্ছা! তবে এটাও বুঝে নাও যে, এখানে সবাই তোমার ভাই নয়। কেউ ভিন্ন মনোভাব ও রাখতে পারে।”

সৈকত দু’কদম এগিয়ে গেল। মুন হেঁটে এসে পাশাপাশি হলো। ওকে ভীষণ বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। সৈকত ক্ষীণ স্বরে বলল,
” তোমার মনের চোখ খোলা উচিত, চন্দ্রকথা।”

মুনের ধারণা, চন্দ্রকথা সৈকতের প্রেমিকা। মুন বলল, ” ভাইয়া, আমি মুন। আপনি ভুলে আজকেও আমার চন্দ্রকথা ডাকছেন।”

সৈকত চমৎকার হেসে বলল, “আমার চন্দ্রকথার সাথে তোমার বেশ মিল আছে, তাই দেখলে গুলিয়ে ফেলি। ”

মুন অবাক হলো, ” দেখতে আমার মতো?”
সৈকত মনে মনে উত্তর দিল, “তোমার মতো না, তুমিই।” সে কথা চেপে কেবল হাসল।

মুনকে বেশ কৌতুহলী দেখাল, ” আমার তো এখন আপনার গার্লফ্রেন্ডকে দেখতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা, আপনার চন্দ্রকথা কি আমাদের ভার্সিটির স্টুডেন্ট?”

সৈকত শব্দ করে হেসে ফেলল, “হ্যাঁ। ”
“কোন ডিপার্টমেন্ট? পুরো নাম কী? আমি পরিচিত হবো।”

সৈকত হাসির জন্য উত্তর দিতে পারল না। মেয়েটা যদি জানত, চন্দ্রকথা সে নিজেই, তবে কেমন হতো! হাসি থামিয়ে গভীর চোখে চাইল সৈকত। মোহ নিয়ে বলল,
“শীঘ্রই পরিচয় করিয়ে দিব।”

____________________

বাহানার সাক্ষাতের সুন্দর সংলাপ কাটবার পরেই মুখোমুখি হলো দুই বন্ধু। এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ। সৈকত বন্ধুত্ব ছাড়িয়ে ভালোবাসার কথা মেলে ধরল ভালোবাসার মানুষের ভাইয়ের কাছে।

অপরদিকে নাহিদ অন্তর শ্বাস আটকে বসা। রুবাবের মনোভাব কেমন হবে, এই ভয় কুঁড়ে খাচ্ছে ওদের। যদি না মানে তবে কি বন্ধুত্ব শেষ?

চলবে…….

অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-৯)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

ইউনিভার্সিটি লাইফে পা রাখবার পর বদলি হাওয়ায় সবারই মনোযোগ সরে যায় বই থেকে। নিয়ে ঠেকায় প্রেমে, আড্ডায়, ঘুরাঘুরিতে। জীবনের লক্ষ্য নড়বড়ে হয়ে যায়। এই হাওয়াবদলে বসন্ত নেমেছিল রুবাব, অন্তর, নাহিদের মনে ও। প্রেম, বন্ধুদের আড্ডায় পড়ালেখা লাইনচ্যুত হয়ে পড়েছিল। অভিভাবকহীন এই শহরে বন্ধুদের সাথে থাকাটা যেন অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিল, কোন কিছুতে বাধা নেই। সারাদিন মজা মাস্তি করে রাত করে বাসায় ফেরা, কদিন বাদে একটা ট্যুর দেয়া এসবে দিন পার হয়েছে। দুই এই সেমিস্টারে রি-টেইকের চৌকাঠে ও দাঁড়াতে হয়েছে।

বলা হয়, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। এই কথাটা এখানে যেন ভুল হলো। বন্ধুদের অতি উৎফুল্ল জীবনে থেকেও একটুখানি লাইনচ্যুত হয়নি সৈকত। সে নিজের জীবনের লক্ষ্যে এগিয়েছিল নিজের মতো। এই হাসি আড্ডায় পড়াশোনা থেকে তার মনোযোগে বিঘ্ন হয়নি কিঞ্চিৎ । সেই শুরু থেকে ওর একটাই লক্ষ্য ছিল, বিসিএস দিবে। বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে। প্রেমের সাগরে ডুবেনি সে, বন্ধুদের আড্ডায় মজেনি। রুমে আড্ডা বসলে সে আড্ডা ছেড়ে পাশের রুমের টেবিলে বসেছে। বন্ধুরা রাত জেগে মুভি দেখলে সে ডুবেছে বইয়ে। একটা ক্লাস ও মিস দেয়নি। কড়া নাড়তে হয়নি রি-টেইকের দরজায়। সিজিপিএতে ভাটা পড়েনি। ওকে দেখে যে কেউ বলে দিতে পারতো বন্ধুদের মাঝে তুখোড় মেধাবী আর বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে সৈকত। এই ছেলে ভবিষ্যত উজ্জ্বল, বড়ো কিছু হবে।

ইউনিভার্সিটি লাইফের সেই মনোযোগী ছেলেটা আজকাল বড্ডো উদাসীন। পড়তে বসলেও অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবে। ওর চোখে আজকাল হতাশা, চিন্তা ভাসে। চোখমুখ অন্যরকম লাগে। অথচ আর কিছু সময় বাদেই ওর বহুকাঙ্ক্ষিত বিসিএস পরীক্ষা শুরু হবে। এখন ওর রাত দিন পড়ার টেবিলে থাকার কথা, চোখে শুধু স্বপ্ন থাকার কথা, একনিষ্ঠ মনোযোগ বইয়ে থাকার কথা। সেই ছেলের এমন উদাসীনতা মানা দুষ্কর। কদিন ধরে রুবাব খেয়াল করছে বন্ধুকে। সৈকতকে একদম অচেনা লাগছে ওর। অবাক হচ্ছে। কী হয়েছে ছেলেটার? এমন হলো কেন?

সৈকত চেয়ারে বসা, টেবিলে বই মেলা। অথচ সে অন্যমনষ্ক। পেছনে বিনব্যাগে বসে ওকে পরখ করছে রুবাব। বন্ধুর মতিগতি বুঝার চেষ্টা করছে। ওরা তো বন্ধুরা কেউ কারো থেকে কথা লুকায়না। কিছু হলে সৈকত জানাতো না? না কি এমন কিছু হয়েছে যা জানানো যাবে না। কোন বড়ো বিপদ? মনে আতঙ্ক বিরাজ করল রুবাবের। এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করে ফেলল,
“এ্যাই সৈকত, কী হইছে তোর?”

অন্যমনস্ক সৈকতের কানে যায়নি সে কথা। উত্তর দিল না। রুবাব ভ্রু কুঁচকাল। উঠে টেবিলের কাছে গিয়ে জোরে চাপড় দিল সৈকতের পিঠে,
“এই শা লা ডাকতেছি না তোরে? ”

বাস্তবে ফিরল সৈকত। হকচকিয়ে বলল, “হ্যাঁ! ”
“কী হইছে তোর?”

সৈকত শূন্য চোখে চাইল। রুবাবকে কিভাবে জানাবে তা নিয়েই ভয় ওর। সে ধীরে বলল, “কী হবে আমার? কিছু হয়নি।”

রুবাব সন্দিহান, ” এতবছর ধরে বিসিএসের অপেক্ষায় ছিলি, এখন যখন পরীক্ষা কাছে এলো তখন পড়া বাদ দিয়া সারাদিন কী ভাবোস এত? ”

সৈকত নিশ্চুপ রইল, আবার উদাস হলো। রুবাব রাগ নিয়ে বলল,
“আমাদের বন্ধুদের মাঝে কোন লুকোচুরি নেই। আমরা সব সুখ দুঃখ একে অপরের সাথে শেয়ার করি। তুই করতেছিস না। কী লুকাচ্ছিস? কাহিনি কী?”

এক প্রকার চেপে ধরল রুবাব। সৈকতের মুখটা রক্তশূণ্য হয়ে গেল যেন। ততক্ষণে নাহিদ অন্তর ও পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে এসেছে। রুবাবের কথা শুনেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ল ওরা। সৈকত চোখ তুলে একবার চাইল ওদের দিকে। ওরা ইশারা করল, এখনো জানাস না, আরও কদিন সময় নে। মুনকে জানা। তারপর রুবাবকে জানাস। সৈকত চোখ ফিরিয়ে চাপা শ্বাস ফেলল। উদাস হয়ে ভাবল কিয়ৎক্ষণ। বন্ধু থেকে কথা লুকানোটা ওর খারাপ লাগছে। সৈকত স্পষ্টভাষী, লুকোচুরির অভ্যেস নেই ওর। প্রেম সাগরে ডুবে বন্ধুর আড়ালে এই লুকোচুরি খেলা চালাতে গিয়ে নিজেকে খুব নগন্য লাগছে। সত্য কখনো ঢাকা থাকে না। এই কথাটাও থাকবে না, রুবাবের কানে কোন না কোনভাবে চলে যাবে। রুবাব যদি অন্য কারো কাছে শুনে তবে ঘটনা আরও খারাপ হবে। তারচেয়ে ভালো ওর কাছেই শুনুক। একদিন যেহেতু বলতেই হবে, তবে আজই বলুক। অন্তত মনের বোঝা হালকা হোক।
হাজার ভাবনায় মত্ত সৈকত। রুবাব এবার নরম সুরে বলল,
“কীরে বল কী হইছে? সিরিয়াস কিছু? যতই সিরিয়াস কেস হোক, আমি থাকব তোর পাশে।”

সৈকত বন্ধুর চোখে তাকাল,
“পাশে থাকবি?”

রুবাব বিরক্ত স্বরে বলল, ” না, আমার বাপ থাকবে। নাটক বাদ দিয়া বল কী হইছে তোর? তুই তো অঘটন ঘটানোর মানুষ না। গ্রামে কিছু হইছে? জাস্ট একবার কাহিনি ক, বাকিটা আমি দেখব।”

রুবাব ভীষণ উদ্ধিগ্ন হয়ে ওঠল বন্ধুর চিন্তায়। কপালে ভাঁজ, স্বরে ভীষণ ভরসা। মনে হয় যে, বন্ধুর জন্য জীবন ও দিয়ে দিতে পারবে। ওর কথায় ভরসা পেল সৈকত। নাহিদ অন্তরকে ইশারা করল। ওরা রুম ছাড়ল। দুই বন্ধু একা হয়ে পড়ল। মাঝে দাঁড়াল নিরবতা। রয়েসয়ে সৈকত বলল,
” পুরো কথা না শুনে রিয়েক্ট করবি না, ঠিক আছে?”

রুবাব ভয় পেল,
“বেশি খারাপ কিছু হইছে? ”
“সেটা তুই কিভাবে রিয়েক্ট করবি তার উপর ডিপেন্ড করবে।”

রুবাব ভ্রু কুঁচকাল, “আমার উপর ক্যান ডিপেন্ড করবে? ঝেড়ে কাশ। ”
” শা লা, আমাকে বলতে তো দিবি?”

সিরিয়াস মুহুর্তেও রুবাব মজা ছাড়ল না, “শালা ডাকবি না। আমার বোন বিয়া দিব না তোর কাছে।”

অবচেতন মনেই সৈকত বলল, কাতর চোখে চেয়ে “দিয়া দে। ট্রাস্ট মি, আমি ওরে খুব ভালো রাখব।”

রুবাব ভাবল সৈকত মজা করছে। রাগ নিয়ে চাইল, “বোন নিয়া মজা করবি না! ”

সৈকতে গম্ভীরমুখে বলল, ” আমি মজা করছি না, আমি সিরিয়াস। ”
“কোন ব্যাপারে সিরিয়াস তুই?” সন্দিহান চোখে তাকাল রুবাব।
সৈকত ক্ষীণ স্বরে বলল, “মুনের ব্যাপারে।”

বোনের নাম শুনেই রুবাবের চোয়াল গম্ভীর হয়ে গেল, “এখানে মুনের কথা আসছে কেন? তোর কাহিনি বল।”

সৈকত নিচের দিকে তাকিয়ে নমনীয় স্বরে বলল, “মুনের প্রতি আমার ফিলিংস হয়ে গেছে।”

রুবাব মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল, এত অবাক হলো। খানিকক্ষণ কথাই বলতে পারব না। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল। খানিক বাদে কিছুটা জোরেই বলল,
“হোয়াট? মাথা ঠিক আছে তোর?”

এবার বন্ধুর চোখে চোখ রাখল সৈকত। দৃঢ় স্বরে বলল, “আমি সজ্ঞানে বলছি, আমি মুনকে ভালোবাসি, ওকে বিয়ে করতে চাই।”

প্রসঙ্গ যখন মুন হয়, তখন বাকিসব বাদ হয়। বোন অন্তপ্রাণ রুবাব বোনের কথা আসতেই সব ভুলে যায়, ভাবনা এলোমেলো হয়। বোনকে নিয়ে একটা কটু কথা শুনতে পারেনা। বোনের দিকে বন্ধুর নজর দেয়া মেনে নিতে পারেনা। সবসময় বোন বোন বলে শেষে এ নজরে দেখা! বিষয়টা নিতে পারল না রুবাব। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে বন্ধুর কলার ধরে ফেলল,
“আমার বোনের দিকে নজর দেয়ার সাহস কিভাবে হয় তোর? ওর সাথে কী সম্পর্ক তোর? আমার অগোচরে তুই আমার বোনের সাথে….ছিঃ! ভাবতেই রাগ লাগছে। ”

চেঁচিয়ে উঠল রুবাব। ওর চোখে বন্ধুর জন্য বিতৃষ্ণা স্পষ্ট। সৈকতের বুকে কাঁপন ধরল। সে শান্ত স্বরে আত্মপক্ষ সমর্থনে বলল,
” তুই ভুল বুঝতেছিস। ফিলিংসটা জাস্ট ওয়ান সাইডেড। মুন জানে না। শুধুমাত্র বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে আমি আমার সব ফিলিংস দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমি শেষ অবধি মনের সাথে জিততে পারিনি। মুনের জন্য ফিলিংস হয়ে গেছে। ট্রাস্ট মি!”

ওত কৈফিয়ত শোনবার অবস্থায় নেই রুবাব। সে রাগে গরগর করছে। কিছুতেই মানতে পারছে না ব্যাপারটা। সৈকত বসা ছিল চেয়ারে। টেনে দাঁড় করিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
” তুই বন্ধুত্বের এই প্রতিদান দিলি!”

ওর চেঁচামেচিতে ভয়ে দৌড়ে এলো নাহিদ অন্তর। রুবাবের হাতে তখন সৈকতের শার্টের কলার। দেখেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। তড়িঘড়ি করে ছাড়াল। নাহিদ ধমকে উঠল,
“রুবাব! কী করছিস? পাগল হয়ে গেলি!”

রুবাব রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল, “আমি না, এই শা লা পাগল হয়ে গেছে। ওর সাহস কী করে হয় আমার বোনের সম্পর্কে এমন কিছু ভাবার? ”

রুবাব আবার তেড়ে এলো। অন্তর সৈকতের সামনে এসে বলল, “মাথা ঠান্ডা কর, বসে কথা বলি।”

রুবাব হুংকার ছুঁড়ল, “এই শা লার সাথে আজকের পর থেকে আমার কোন কথা নেই। শেষ। ”

সৈকত নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল। নাহিদ রুবাবকে অন্যদিকে টেনে নিল, ” রুবাব শান্ত হ। এই ছোটো বিষয়ে আমাদের এত বছরের বন্ধুত্ব শেষ করবি না।”

রুবাব শান্ত হলো না। আবার চেঁচিয়ে উঠল,
” যে বন্ধুর কাছে আমার বোন সেইফ না, সেই বন্ধুর দরকার নেই আমার। ”

পরপরই সৈকতের দিকে তাকিয়ে ক্রুর চোখে শাসাল,
“আমার বোনের থেকে দূরে থাকবি। আর কখনো এমন কথা নিয়ে আমার সামনে আসবি না, আমি জীবিত থাকতে তোর কাছে আমার বোন বিয়ে দিব না। ”

খানিক আগে সৈকতের পাশে থাকার বুলি আওড়ানো বন্ধুটা ওকে নিঃসঙ্গ করে হনহন করে বেরিয়ে গেল। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সৈকত। নাহিদ অন্তর চোখে সর্ষে ফুল দেখল যেন। কাকে কিভাবে বুঝাবে! যাই হোক, ওদের বন্ধুত্বে ভাঙন ধরানো যাবে না। দুইজন বেঁকে গেছে, ওরা তো ঠিক আছে, ওরা ঠিক করবে সব। নাহিদ অন্তরকে বলল,
“তুই সৈকতকে দেখ, আমি রুবাবকে দেখছি।”

নাহিদ দৌড়ে রুবাবের পিছু নিল, অন্তর সান্ত্বনার বুলি হাতে বসল সৈকতের পাশে। সৈকতের দেহ তখন হারানোর ভয়ে অসাড়। চোখে ভাসছে মুনের মুখখানা। কানে বাজছে হৃদয় আর বন্ধুত্ব ভাঙার গান।

চলবে……..