অলীকডোরের চন্দ্রকথা পর্ব-৬+৭

0
189

#অলীকডোরের চন্দ্রকথা। (পর্ব-৬)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

“বয়স তো কম হইল না, বিয়াশাদী কবে করবা?” উঠোন কোণের রান্নাঘরে বসে সকালে নাস্তা করছিল সৈকত। দূরসম্পর্কের এক দাদী এসে বিয়ের কথা উঠালেন।

মা মাটির চুলোয় পাটিসাপটা পিঠা বানাচ্ছেন। সৈকত মায়ের পাশেই শীতল পাটিতে বসে গরম গরম পাটিসাপটা খাচ্ছে। ওর আরেক পাশে ছোটো ভাই সিফাত বসা। দু’ভাই একসাথে নাস্তা করছে। মা আর ছোটোভাইয়ের সামনে এহেন প্রশ্ন শুনে বিব্রতবোধ করল সৈকত। কারো দিকে মনোযোগ না দিয়ে পাটিসাপটায় চোখ ফেলে ধীরে জবাব দিল,
“এখনো ভাবী নি।”

বৃদ্ধ দাদী মহাচিন্তিত, “বয়স তো পার হইয়্যা যাইতাছে, কবে ভাববা?”

সৈকত উত্তর দিল না। বিয়ে নিয়ে এখনো ওর কোন ভাবাবেগ নেই। একমনে খেয়ে গেল। দাদী থামলেন না, এবার সৈকতের মা সুরমা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন,
” সৈকতের মা, পোলার বিয়া দিবা না? ওর বয়সে আমার নাতি দুই পোলার বাপ হইয়্যা গেছে। ”

মা সৈকতের দিকে তাকালেন। সৈকতের নিচু মাথা আরও নিচু হলো। গ্রামীণ বৃদ্ধাদের বিয়ে ছাড়া কোন টপিক নেই আলোচনা করার? মাকে কিসব বলছে, ভীষণ অস্বস্তি লাগছে ওর। সুরমা এক চিলতে হেসে বললেন,
” অহনো লেহাপড়া শেষ হয়নাই , পরীক্ষা দিতাছে। পরীক্ষায় পাশ কইরা চাকরি পাইলেই সৈকতের বউ ঘরে তুলব। আর কয়ডামাস। দোয়া কইরেন চাচীম্মা।”

সৈকত বিস্মিত চোখে মায়ের দিকে তাকাল। একটা চাকরি হলেই বিয়ে করতে হবে ওকে? আগামী পাঁচ বছরেও বিয়ের করবার পরিকল্পনা নেই ওর। বিয়ে মানেই বাড়তি ঝামেলা। এখন সিঙ্গেল আছে, বিন্দাস আছে। এভাবেই চলুক। বিয়ে টিয়ে করা যাবে না। সৈকত ভাবল, মা হয়ত দাদীকে বুঝ দেবার জন্যই বিয়ের আশ্বাস দিয়েছেন। কদিন বাদেই ভুলে যাবেন। কিন্তু ধারণারা ভুল প্রমাণ হলো খানিক বাদে।

সুরমার উত্তরে দাদী সন্তুষ্ট হলেন না। মুখ কুঁচকে বললেন, ” বয়স খরাইয়্যা পোলা বিয়া দিয়া কী মজা পাও, বুঝিনা বাপু! চারকি পাইয়্যা বিয়া করতে করতে বিয়ার বয়স পার হইয়্যা যাইব। তহন বউ পাইবা না। ”

ভুজংভাজাং করে দাদী চলে গেলেন। দাদী যেতেই এতক্ষণ নিরবতায় গা ঢাকা সিফাত মুখ খুলল,
“দাদী কিন্তু খারাপ বলে নি। ভাবি আনার কথা তোর ভাবা উচিত।”

সিফাতের মুখে কৌতুকের রেশ। ঠোঁট চেপে হাসছে সে। সৈকত ভাইয়ের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল,
“আমার বিয়াতে তোর কী লাভ?”

“তোর জন্য আমার বিয়াশাদীর সিরিয়াল আটকে আছে। ” আনন্দিত গলাতে বলল সিফাত।

অনার্স পড়ুয়া ভাইয়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে অবাকই হলো সৈকত। ভ্রু কুঁচকে বলল,
” দু’দিন হয়নাই ভার্সিটি ভর্তি হইছস, এখনই বিয়ের চিন্তা নিয়ে ঘুরতেছিস!”

সিফাত লাজ লজ্জা নেই। মায়ের সামনেই বলল,
” তোর বিয়ের জন্য পারতেছি, নয়তো আমি এখনই তানিশারে বিয়ে করে ফেলতাম। মাকে বলছিলাম, মা বলছে তোর আগে আমার বিয়াশাদীর নাম নিবে না। আমি সিদ্ধান্ত নিছি তোর বিয়ের পরদিনই বিয়ে করে ফেলব।”

ভাইয়ের অসংলগ্ন কথা শুনে কথা শুনে ধমকে উঠল সৈকত, ” এসব হাবিজাবি ভেবেই তাহলে সেকেন্ড সেমিস্টারে খারাপ করছিলি! থার্ড সেমিস্টারে যদি খারাপ হয় তবে বাবাকে বলে তোর পকেটমানি কেটে নিব , মনে রাখিস। সিরিয়াল বাদে আগামী পাঁচ বছরেও বিয়ে-শাদির নাম ভুলে যা। পড়াশোনায় ফোকাস কর। তারপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ের মানে বুঝে তারপর নাম নিবি। ”

দাদীর কথার ঝাঁজ ভাইয়ের উপর তুলল সৈকত। সিফাতের হাসিমুখ চুপসে গেল। ভাইয়ের অগ্নিদৃষ্টি দেখে বিয়ের শখ মিটে গেছে। ভাইকে ভয় পায় সে। এখানে থাকা বিপদজনক। সিফাত ধীরে উঠে দাঁড়াল। সৈকত সতর্ক করে বলল,
“ফারদার মায়ের সামনে কথা বলতে সাবধানে বলবি। আর আজই সেলুনে গিয়ে বখাটে থেকে ভদ্র হয়ে আসবি।”

নয়া নয়া প্রেম, নয়া ভার্সিটি লাইফে সিফাত বেশ আপডেট হচ্ছে। চুল বড়ো রেখেছে, কালার করেছে। কথাবার্তায় চালচলনে পরিবর্তন আসছে। ভাইয়ের সতর্কবাণী শুনে সিফাত পালিয়ে বাঁচল। ও যেতেই সৈকত মাকে বলল,
“মা, তুমি ওকে শাসন করো না কেন! এভাবে চললে তো ওর লাইফ, ক্যারিয়ার সব শেষ হয়ে যাবে। একদম ছাড় দিবে না। বাবা ওকে শাসন করলে তুমি বাধা দিবে না। ”

সুরমা ছেলের মেজাজ দেখে নরম গলায় বললেন, ” ওর কতা বাদ দে। ঠিক হইয়্যা যাইব। ”

থেমে স্বর আরও খাদে নামিয়ে বললেন, ” আমি আর তোর বাবা ও বিয়ার কতা ভাবতাছিলাম। মাইয়্যা দেখা শুরু করি, চাকরি হইলে একটা ঠিক কইরা বিয়ে করাইয়্যা ঘরে তুলন যাইব।’

সৈকত বিস্মিত চোখে মায়ের দিকে তাকাল। মায়ের মুখে তখন গম্ভীরতা। মা বাবা ওর বিয়ের ব্যাপারে সিরিয়াস! দুজনে গুরুতর ভাবছেন! একটা চাকরি হলেই বিয়ে করতে হবে ওকে? ভেতরে ভেতরে আতঙ্কিত হলো সৈকত। গম্ভীর মুখে বলল,
” সেটেল্ড হওয়ার আগে বিয়ে শাদীর নিয়ে ভাবছি না আমি। এসব আপাতত বাদ দাও। ”

ছেলের ওমন কঠোর জবাব শুনে সুরমা দমে গেলেন। রয়েসয়ে প্রশ্ন করলেন,
“মাইয়্যা দেইখ্যা রাখতে সমস্যা কী? তা তোর পছন্দ আছে?”

এই ক্ষণে থমকে গেল সৈকত। পছন্দ আছে ওর? নিজেকে প্রশ্নটা করতেই উত্তর হয়ে মুনের চেহারা ভেসে উঠল ওর চোখে। সৈকত ভীষণ চমকাল, মুন ওর পছন্দ? বিয়ে করার মতো! মাকে কি জনাবে? স্বপ্নে এসে একটা মেয়ে বসে গেছে মনে। তাকে পছন্দ বলা ঠিক হবে? মুনের ভাবনা আবার হানা দিল। অথচ এই মেয়েকে ভাবনা থেকে দূর করতেই তো গ্রামে এসেছে।

সৈকত উদাস হয়ে ভাবছিল। ওর উদাসীনতা দেখে সুরমা ধরে নিলেন ছেলের পছন্দ আছে। কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ হলেন বটে। সেই ক্ষণেই সৈকত বলল,
” চিন্তা করো না, বিয়ের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যাব না আমি। তবে আপাতত সব আলাপ বাদ। বিয়ে নিয়ে কোন পদক্ষেপ নিবে না তোমরা।”

বলে উঠে গেল। সুরমা বুঝতে পারলেন না, ছেলে তাকে হতাশ করে গেল না কি আশ্বাস দিয়ে গেল।

____________

ঘড়ির কাটায় রাত ১টা বেজে ৩২ মিনিট। বাইরে চাঁদনি রাত। মৃদু বাতাস, আর ঝিঝিপোকার ডাকের সুন্দর আবহ। মেলা জানালার দ্বারে বই মেলে বসে আছে সৈকত। কপালে বিরক্তির ভাঁজ। আসবার কালে ব্যাগ ভরে গাদা গাদা বই নিয়ে এসেছে। অথচ পড়ার বেলায় শূন্য। এইবেলা পড়ায় মনোযোগ বসছে না। পড়ার তাল হারিয়ে ফেলেছে। মনটা শূন্য শূন্য লাগছে, অদ্ভুত তৃষ্ণায় কাঁপছে বুক। অনেকদিন যাবাত চোখের সামনে থাকা মানুষ চোখের আড়াল হলে তাকে দেখার তৃষ্ণা যেমন হয়, তেমন অনুভব করছে সৈকত। মুনকে দেখার তৃষ্ণা। ওর মনে হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিস করে ফেলেছে। গ্রামে এলো মেয়েটাকে ভুলতে অথচ গত দু’দিনে ভোলা তো দূর, স্মরণ থেকেই সরাতে পারেনি। পড়াতেও মন বসেনি। মন মুনের খেয়ালেই ডুবেছে। মনে হচ্ছে বহুকাল মেয়েটাকে দেখে না, কথা বলা না। ওর সাথে কথা না বললে, না দেখলে মনটা শান্তি পাবে না। আচ্ছা মেয়েটা কী করছে এখন?

সৈকত আনমনা হলো, আকাশপানে চাইল। তারপর সময়জ্ঞান ভুলে হুট করেই ফোন অন করল। বাড়িতে এসে ফোন বন্ধ করে রেখেছিল। ডায়াল করল মুনের নাম্বারে। দু’বার রিং হতেই ওর সময়জ্ঞান হলো। নিজের উপরই অবাক হলো। এই রাত দুপুরে একটা মেয়েকে কল করার মতো উতলা কবে হলো ও? মুন টের পেলে কী ভাববে? ওকে কি হ্যাংলা ভাববে? ভাবতেই পারে। রাত দুপুরে বন্ধুর বোন কল করা ভদ্রতার কাতারে পড়েনা। সৈকত কল কেটে দেবার মনস্থির করল, রেড বাটন চাপতে যাবার মুহুর্তে চমৎকার হলো। রিসিভ হয়ে গেল। ঘুমজড়ানো এক স্বর ভেসে এলো,
“হ্যালো….

মুনের স্বরটা মাদকের মতো ঠেকল সৈকতের। ঘোর লাগল, হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। কথা বলতে পারল না। মুন হ্যালো হ্যালো করে গেল। তারপর বিড়বিড় করে কী যেন বলতে লাগল। বোধহয় ঘুমের ঘোরে কথা বলার অভ্যাস আছে ওর। সৈকত ফোন কানে দিয়ে রাখল, কাটল। মুনের ভুজুংভাজুং শুনে হাসল আনমনে। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ” পাগলী!”

ফোন রাখবার পর সৈকত টের পেল মনের শূন্যতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। অস্থিরতা সরে শান্তির ছোঁয়া লেগেছে। ভালো লাগছে। সময়টাকে, মনটাকে, মানুষটাকে। পাকাপোক্তভাবে সৈকত টের পেল, পছন্দ নয়, এই মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছে সে। রুবাবের কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হলো। রুবাব জানলে কী হবে..?

রুবাবের কথা ভাবনার মাঝে রুবাবেরই কল এলো। রুবাব কি টের গেছে, মধ্যরাতে ওর বোনকে কল দিয়েছে সৈকত? উদ্ভট চিন্তা এলো। ভয় নিয়েই রিসিভ করল ফোন। রুবাব রাগত স্বরে বলল,
“ওই শা লা তোর মতলব কী?”

সৈকতের ভয় বাড়ল। কারো পরোয়া করে না সে, কিন্তু বন্ধুর কথা আসতেই থেমে যায় ভাবনা। সৈকত আমতাআমতা করল, “কী মতলব?”

” কদিন বাদে পরীক্ষা। পড়ালেখা বাদ দিয়া বলা নাই কওয়া নাই প্রেমিকার মত রাত বিরাতে ব্যাগ ফুটলি বাইন্দা বাসা থেইক্যা পালাইয়্যা গেছস। তারপর কোন খোঁজ নাই। ফোন বন্ধ কইরা বইসা আছস। কাহিনি কী? আছস কই তুই?” রুবাবের স্বরে বিরক্ত, রাগ মিশে একাকার।

সৈকত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক জেনে যায়নি এখনো। সৈকত বলল, ” বাড়িতে আসছি।”

রুবাবের স্বর উদ্বিগ্ন হলো, “হঠাৎ বাড়ি গেলি! আন্টি আংকেল ঠিক আছে?”

“সবাই ঠিক আছে। এমনি অনেকদিন বাড়ি আসি নি। হুট করেই মায়ের জন্য মন কেমন করে উঠল, চলে আসলাম।”

“ফিরবি কবে?”

“জানি না।” দায়সারা উত্তর দিল সৈকত। ফের সৈকত বলল, “তোর অবস্থা বল?”
“অবস্থা হ-য-ব-র-ল। ” ক্লান্তির শ্বাস ফেলল রুবাব।

“কী হইছে?” ভ্রু কুঁচকাল সৈকত। রুবাব বলল,

“বাবা মা গ্রামে গেল না? ওখানে বাবার দুর সম্পর্কে এক বোন ছেলের সমন্ধ আনছে। ছেলে ব্যাংকার। ঢাকাতেই থাকে। ছেলেকে বাবা মায়ের পছন্দ হয়েছে। তারা চাইছেন সম্পর্ক আগাতে।”

আকস্মিক বোধগম্য হলো না সৈকতের। প্রশ্ন করল, “কার বিয়ের কথা বলতেছিস তুই?”

“মুনের।” ছোটো করে উত্তর দিল রুবাব। সৈকত মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। মুনের বিয়ে! ওর এক পক্ষিক অনুভূতি সম্পর্কে সবে বোধগম্য হলো, ওমনি টানতে হলো! সৈকত মানতেই পারল না, শুনতেও পারছে না। কানে তীরের মতো লাগছে। ভীষণ একটা খারাপ লাগা কাজ করছে। কোনমতে বলল,
” তোর কী মত?”

” বাচ্চা একটা মেয়ে, সবে ভার্সিটি উঠল, এখনই বিয়ে দিতে চাইছি না আমি। কিন্তু বাবা মায়ের কথা, এখন রিং পরিয়ে রাখুক, বছর দুয়েক পর বিয়ে হবে। মুনকে আগেই দেখেছেন উনারা। আমরা হ্যাঁ বলে এসে রিং পরিয়ে যাবেন। বুঝতে পারছি না কী করব? কী করি বলতো!”

রুবাব পরামর্শ চাইল বন্ধুর কাছে। পরামর্শ তো দূরে থাক , সৈকত তো কথাই বলতে পারল না। অস্থিরতা বাকরুদ্ধতায় রূপ নিয়েছে। হারিয়ে ফেলার ভয়ে সব এলোমেলো হয়ে গেছে। মন কেবল একটা প্রশ্ন করল, গল্প শুরু হবার আগেই কি ওর অলীকডোরের চন্দ্রকথা মুছে যাবে? অলীকডোরের গল্পটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে?

চলবে….

#অলীকডোরের চন্দ্রকথা। (পর্ব- ৭)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

ভোর ছ’টার বাস ধরেছে সৈকত। মুনের বিয়ের আলাপ শুনে রাতে দুদণ্ড শান্তি পায় নি, অস্থিরতায় ছটপট করেছে। বারবার মুনের চেহারাটা চোখে ভাসছিল। যখনই মনে হচ্ছিল, চন্দ্রকথার চাঁদমাখা মুখটা তার কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে। তখনই নিঃশ্বাস আটকে আসছিল যেন। স্কুল কলেজে প্রেমের অধ্যায় পড়েছে দুয়েকবার। দীর্ঘসময়ের পর অধ্যায়ের ইতি টেনে মেয়েরা তার জীবন থেকে বিদায় ও নিয়েছে, তখনো তো এত কষ্ট হয়নি। এতটা দুর্বিষহ মনে হয়নি। এই ক্ষণে যতটা লাগছে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল, কিছুতেই ঘরে থাকতে পারছিল না। মন ছুটেছে মুনের কাছে, শরীর টানার জোর পাঁয়তারা। সারারাত অস্থিরতায় চটপট করে ভোর হতেই ব্যাগ গুছিয়ে ঢাকার পথে রওনা হয়েছে। ও গিয়ে কী করবে, কিভাবে বিয়ে ভাঙবে, রুবাবকে কিভাবে জানাবে কিছুই জানে না। শুধু জানে ওকে ঢাকা যেতে হবে। এই আশঙ্কিত বিয়ের আলাপ এখানেই থামাতে হবে। মুনকে কিছুতেই পর হতে দেয়া যাবে না। ওর চন্দ্রকথা ওর চোখের সামনে থাকবে।

অস্থৈর্যের পরিমান এত গাঢ় ছিল যে মা থেকে বিদায় নেবার ফুরসত অবধি পায়নি। ভোরের আলো ফুটতেই ছুটে বেরিয়েছে। সিফাত রাত জেগে প্রেমালাপ করছিল ছাদে বসে। ভাইকে ওমন বিধ্বস্ত হয়ে দৌঁড়াতে দেখে বলল, “কী হয়েছে ভাইয়া?”

সৈকত দ্রুত পা ফেলতে ফেলতে বলল, ” একটা কাজ পড়ে গেছে। আমি ঢাকা ফিরছি। মাকে বলিস।”

সিফাত কিছু বলার সুযোগ পেল না, তার আগেই বাড়ির রাস্তা পেরিয়ে গেছে সৈকত।

______________

দিশেহারা মন নিয়ে পুরো পথ পাড়ি দিল। অন্যসময় বাসে ওঠলেই ঘুমিয়ে পড়ে ও। আজ ঘুমটাও হলো না। চিন্তায়, অস্থিরতায়, নিদ্রাহীনতায় চোখ রক্তিম হলো। এগারোটা নাগাদ গিয়ে পৌঁছল বাসায়। প্রথমবার বেল বাজানোর পর কেউ দরজা খুলল না। অন্যসময় সে একবার বেল চেপে বন্ধদের কল দেয়। আজ অনবরত কলিংবেল বাজিয়ে গেল। বার তিনেকের সময় হেলেদুলে এসে দরজা খুলল নাহিদ। ভেবেছিল রুবাব এসেছে। বিরক্তি নিয়ে বলল,
” বোনের বিয়া তোর লাগছে, তুই যাইয়্যা নাচ, আমাগো ডিস্টার্ব মারোস ক্যা রুবাব! ”

“বোনের বিয়ে লাগছে” শব্দ দুটো শুনে সৈকত ভেবে নিল, বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেছে হয়ত। ওর দুঃখের আগুনে ঘি ঢালল যেন কেউ। এতক্ষণে সৈকতকে খেয়াল হলো নাহিদের। ভূত দেখার মতো চমকাল সে। হকচকিয়ে বলল,
“সৈকত, তুই এত তাড়াতাড়ি ফিরলি? তোর না আরও কদিন বাদে ফেরার কথা!”

সৈকত উত্তর দিলে না। কেবল বন্ধুর পানে করুণ চাহনি দিয়ে পাশ কাটল। নিজের রুমে চলে গেল।

আজ বাসায় রুবাব নেই। অন্তর ঘুমাচ্ছে পাশের রুমে। নাহিদ গেল সৈকতের পিছু পিছু। সৈকত রুমে গিয়ে হাতের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে হতাশ হয়ে বেডে বসে পড়ল। নাহিদ ওর এহেন ভঙ্গিমা দেখে জিজ্ঞেস করল, ” সৈকত, কী হইছে? ”

সৈকত উত্তর দিল না। উত্তর নেই ওর কাছে। কী করে বলবে, বন্ধুর বোনকে মন দিয়ে বসেছি আমি। যাকে আমাদের বোন ভাবার কথা? বলতে পারল না। বেডে বসে মুখে হাত চেপে বসে রইল। ভাবল লাগল, এখন ও কী করবে? কী করলে মুনের বিয়ে ভেঙে যাবে রুবাব ও জানবে না? এমন কি কোন উপায় আছে? কতশত ভাবল। কিন্তু উপায় তো পেল না।

বন্ধুর অবস্থা রেখে চোখের ঘুম উবে গেছে নাহিদের । হতভম্ব হয়ে দেখছে বন্ধুকে। এতবছরের বন্ধুত্বে সৈকতকে কখনো এত হতাশ, বিধ্বস্ত হতে দেখেনি। আজ হঠাৎ কী হলো? পরীক্ষা দেরি আছে, ওটা আঘাত করার কথা না। বাড়িতে কিছু হয়েছে? কাল রাতে সৈকতকে না পেয়ে তার ছোটোভাই সিফাতকে কল দিয়েছিল নাহিদ। কথা হয়েছে, বাড়ির সব ঠিকঠাকই লাগল। তবে কী এমন হলো যা সৈকতকে এতটা আঘাত করল। হুট করে ঢাকা ফিরতে বাধ্য করল? প্রশ্নরা কোন কূল কিনারা পেল না। নাহিদ গম্ভীর হয়ে ভাবল সৈকতকে নিয়ে। সৈকতের বিগত দিনের হাবভাব নিয়ে। হঠাৎ চমকাল। ধীর পায়ে এসে বসল বন্ধুর পাশে। দ্বিধান্বিত স্বরে প্রশ্ন করল,
” তুই কি মুনকে পছন্দ করিস?”

হতাশা লগ্নে নাহিদের কথা শুনে চরম ধাক্কা খেল সৈকত। নাহিদ কিভাবে জানল! ও তো কাউকে বলেনি। সৈকত একরাশ বিস্ময় নিয়ে চোখ তুলে তাকাল। নাহিদ অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে। ওর মুখ থমথমে। বন্ধুর ওমন চাহনির পর অস্বীকার করতে পারল না সৈকত। তবে স্বীকার করল না। কেবল অন্যদিক চোখ ফিরিয়ে নিল। নাহিদ প্রথমে রেগে গেল,
“হাউ ক্যান ইউ ডু দেট?”

সৈকত অপরাধী স্বরে বলল, ” কিভাবে যেন হয়ে গেছে। আমার তো হাত ছিল না।”

” হাত ছিল না। আজাইরা কথা বলবি না। তোরে জোর করছে কেউ! রুবাব জানলে কী হবে ভেবেছিস? আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যাবে।” উঠে দাঁড়িয়ে রাগে চেঁচিয়ে বলল নাহিদ। সৈকত অসহায় চোখে বন্ধুর পানে তাকাল,
“আমি চাইছি ফিলিংস না আনতে। এই জন্যই তো বাড়ি গেছি। কিন্তু কাল ওর বিয়ের কথা শুনে বেসামাল লাগছে। আই কান্ট লিভ হার। ” সরল স্বীকারোক্তি সৈকতের।

সেই ক্ষণে সৈকতটা এতটা অসহায় লাগল যে, নাহিদের মায়া হলো। রাগ পড়ে গেল। আবার বসল বন্ধুর পাশে। ধীরে জিজ্ঞেস করল,
“কবে থেকে?”

“বেশি দেরি না। ” ধীরে জবাব দিল সৈকত। নাহিদ প্রশ্ন করল, ” প্রেম চলছে তোদের?”
সৈকত মাথা নাড়াল, “না, শুধু আমার পক্ষ থেকে।”
“মুন জানে?”
“না।”

“তুই প্রেমে পড়েছিস। মুনকে জানাসনি, আমাদের ও জানাস নি, রুবাবকেও জানাসনি। নিজের মধ্যে রেখেছিস, রুবাব বোন বিয়ে দিচ্ছে। শুনে সব অনুভূতি রাগ ব্যাগের উপর উঠাচ্ছিস। তাই তো?” হেয়ালী করল নাহিদ। সৈকত দিশেহারা স্বরে উত্তর দিল,
“কী করব মাথায় আসছে না আমার।”

নাহিদ ভীত স্বরে বলল, ” রুবাব জানলে কী রিয়েক্ট করে আল্লাহ জানে। ভেবেই ভয় লাগছে। কী করা যায় মাথায় আমার ও আসছে না। ”

ভাবুক হলো সে। আকস্মিক বলল, “অনেস্টলি বল, মুনকে নিয়ে তোর ভাবনা কী? বিয়েশাদি করবি না কি প্রেম হলেই শ্যাষ?”

সৈকত বিড়বিড় করে বলল, ” এতকিছু জানি না। জাস্ট এটা জানি, ওকে আমার লাগবে। ফর লাইফটাইম।”

নাহিদ বন্ধুর পিঠে চাপড় মেরে বলল, “শা লা বন্ধুর বোনকে বোন ভাবার জায়গায় বউ ভেবে বসে আছিস। কী কাজটা করলি, বলতো! এখন বিয়ে ভাঙার আশা টাশা আছে না কি হাতে মেন্দি দিয়ে চান্না মেরিয়া মেরিয়া গাইবার আশা নিয়ে বসে আছিস?”

নাহিদের মাঝে আগের রাগটি নেই। ওকে এখন সুপ্রতিভ লাগছে। বন্ধুর সঙ্গ এত তাড়াতাড়ি ছাড়ছে না নাহিদ। পাশে পাবে বন্ধুকে তা ঢের বুঝতে পারল সৈকত। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর রাগের ভান করে বলল,
” মজা নিবি না শালা।”

নাহিদ হুঁশিয়ার করে বলল, ” আমারে শা লা ডাকবি না। রুবাবরে শা লা ডাইক্কাই তো ওর বোনের দিকে নজর দিছস।”

সৈকত এতক্ষণে একটু হাসল, “রুবাবের বোনকে পেলে আর কারো বোনের দিকে নজর দেয়ার ফুরসত হবে না। ”

নাহিদ বন্ধুর অনুভূতি স্পর্শ করতে পারল। মনে মনে বলল, “এই ব্যাটা তো দেখি ভালোই ডুবছে। এবার রুবাব মানলেই হয়। ” সে ফোন তুলে নিয়ে রুবাবকে কল দিল।
সৈকত আতঙ্কিত হয়ে বলল, “রুবাবকে কল দিচ্ছিস কেন? তুই কিন্ত ওকে কিছু বলবি না।”

নাহিদ বলল, ” তুই চাইছিসটা কি?”

সৈকত খানিক ভেবে দৃঢ় স্বরে বলল, ” আপাতত বিয়েটা ভাঙুক। পরে সময় বুঝে ব্যাপারটা আমি রুবাবকে জানাব। অন্য কারো থেকে শুনলে খারাপ দেখাবে।”

ফোন কাটবার আগে রিসিভ করল রুবাব। নাহিদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, “উঠেছিস তোরা? আমি সবেই তোকে ফোন দিতে নিছিলাম। অন্তরকে নিয়ে একটু বাসায় আয় তো!”
“কেন?”
“আয়, বলতেছি।” বলেই ফোন রেখে দিল রুবাব। ফোন রেখে নাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আবার কী কাহিনি বাঁধছে আল্লাহ জানে।”

মুনকে দেখার সুযোগ দেখে হাতছাড়া করতে চাইল না সৈকত। চঞ্চল স্বরে বলল, “চল, গিয়া দেখি।”

নাহিদ গোয়েন্দা চোখে চেয়ে বলল, “তুই কোন ধান্ধায় যাচ্ছিস?”

সৈকত সে কথার উত্তর দিল না। উদাস চোখে চাইল। আকস্মিক বলল, “বিয়েটা ভাঙবে তো?”

নাহিদ তড়িৎ বন্ধুর ভরসা হলো, “আরে ভাঙবে, আমরা আছি না! রুবাব তোকে মানলে বাকিসব ক্লিয়ার করার দায়িত্ব আমাদের।”

এই ভরসাটুকুর খুব দরকার ছিল সৈকতের। এখানে আসার আগে ওর মনে হয়েছিল ওর পাশে কেউ নেই। এখন মনে হচ্ছে, আছে, ওর পাশে ওর বন্ধু নামক ছায়া আছে। যে কখনো ওর গায়ে রোদ লাগতে দিবে না। সৈকত স্মিত হাসল। নাহিদ আবার কাধ চাপড়াল,
” একবারে বিরহে পাগলের বেশে ঘুরছিস। ফ্রেশ হয়ে মানুষ হ। আমি অন্তরকে জাগাই।”

________

তিনবন্ধু ভরদুপুরে গিয়ে পৌঁছল শেখবাড়ির দরজায়। গেইট লক করা। কয়েকবার কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে গেল। অপাশে দেখা গেল এক নারী অবয়ব। যে অবয়ব প্রজ্জ্বলিত করল সৈকতের চোয়াল। নাহিদ চট করেই তাকাল বন্ধুর পানে। সৈকত স্থান কাল পাত্র ভুলে অন্তর্ভেদী চোখে চেয়ে আছে মুনের পানে। লেমন কালারের একটা থ্রি-পিস পরেছে মুন। মাথায় ওড়না নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এলোকেশ। চোখমুখে বিষন্নতার ছায়া। রক্তলাল নাক, ফোলা চোখ, খানিক পরপর নাক টানছে। ওকে দেখে আন্দাজ করা যায়, কষ্টরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ওর মাঝে। অজান্তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল সৈকতের।

উঠোনে রুবাবের মা তারিনাকে দেখা যাচ্ছে। কাপড় মেলছেন। সৈকতের অমন ড্যাবড্যাব করে তাকানো না চোখে পড়ে যায় তার, এই ভয়ে বন্ধুকে কনুই দিয়ে গুতো দিল নাহিদ। ক্ষীণ স্বরে বলল, “আন্টি আছে।”

সৈকত সংযত হলো। নাহিদ মুনকে জিজ্ঞেস করল, “ভালো আছো পিচ্চি?”

মুন জোর করে মুখে হাসি টানল, “আছি। আসুন ভেতরে আসুন।”

বলে দরজা থেকে সরে ভেতরের দিকে হাঁটা দিল। সৈকত ধীরে বলল,
” ও বোধহয় বিয়েতে রাজি নেই। কেমন কেঁদেছে দেখেছিস!”
অন্তর বলল, ” অন্য কোন পছন্দ ও থাকতে পারে।”

সৈকত দৃঢ়তার সাথে জবাব দিল, “নেই।”

“তুই কিভাবে জানিস?” ভ্রু কুঁচকাল অন্তর। সৈকত মাথা চুলকে বলল, “আমি খোঁজ নিয়েছি।”

বলে সামনে এগিয়ে গেল। অন্তর হতভম্ব হয়ে বলল, “মুনের বয়ফ্রেন্ড আছে কি নেই সেটা সৈকত খোঁজ নিয়েছে কেন!”

নাহিদ বলল, “এই শা লা গেছে।”

“মানে!”

নাহিদ অন্তরকে সবটা জানাল। অন্তরকে ও আতঙ্কিত দেখাল, “রুবাব!”
“চল বুঝাই।”

রুবাবের ঘরে যেতেই দেখল রুবাব শাওয়ারে। বন্ধুদের উপস্থিতি টের পেয়ে তড়িঘড়ি করে বেরুলো। সৈকতকে দেখে অবাক হলো। হঠাৎ ওর আসা, চেহারা বিধ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন করল। কথা এড়াল অন্তর।
” ওসব আলাপ পরে করিস। আগে ক, কী জন্য আমার আরামের ঘুম হারাম কইরা টাইন্যা আনছস বাসায়? কাহিনি কী?”

রুবাব মাথা না মুছে গম্ভীরমুখে বসল বিনব্যাগে। বলল, ” বাবা মা মুনের বিয়ে নিয়ে তোড়জোড় শুরু করে দিছেন। আমার সাথে কোন আলাপ না করেই ছেলেপক্ষকে কথা দিয়ে ফেলেছেন। ছেলেপক্ষ চাইছে আগামী শুক্রবারই আকদ করে ফেলতে, মুনের পড়াশোনা শেষ হলে সংসারে তুলবে। বাবা মা তাতেও রাজি। তাদের নিয়ন্ত্রণ জানিয়ে ফেলেছেন, আমি আগে নিষেধ করায়, আমাকে জানায়নি অবধি। সকালে জানাচ্ছে। আমি চোখে সর্ষে ফুল দেখতেছি।”

রুবাব অতিরিক্ত গম্ভীর হলে গড়গড় করে শুদ্ধ বলে। এমনি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। ” শুক্রবার মুনের আকদ” কথাটা শুনার পরেই নাহিদ আর অন্তর চট করে তাকাল সৈকতের দিকে। সৈকতের মুখে আষাঢ়ে মেঘ নেমেছে যেন। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। শ্বাস টাস ও ফেলছে না। আটকে আসতে চাইছে বোধহয়। চোখ দুটো বড্ড করুণ। ভেতরটা লণ্ডভণ্ড হবার আঁচ পেল দুই বন্ধু। মুখখানা করুণ হলো তাদের ও। অন্তর রয়েসয়ে বলল,
“মুন বিয়েতে রাজি?”

রুবাবের স্বর এবার গম্ভীর থেকে করুণ হলো, “প্রথমে আমি জানাতেই দিইনি, ভেবেছি, এখন বিয়ে যেহেতু দিব না, শুধু শুধু মেয়েটাকে জানিয়ে কষ্ট দেয়া ঠিক হবে না। কিন্তু বাবা মা দু’দিন আগে জানিয়ে দিয়েছে। শুনে কেঁদে অস্থির। ওর মত নেই এখন বিয়ে করার। ও গ্রাজুয়েশনের পর বিয়ে করবে, কিন্তু বাবা মায়ের কথা, পড়া বিয়ের পর করা যাবে। এরপর মুনের মতের তোয়াক্কা না করে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দিয়েছে। কাল ওকে জানিয়েছে শুক্রবার তোর বিয়ে। শুনে নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে কেঁদেকেটে একাকার। আমি এসব জানিইনা। সকালে কত কী বলে দরজা খুলিয়েছি। কী পরিমাণ কাঁদছিল মেয়েটা, যদি দেখতি। বাবা মা নাছোড়বান্দা। কেন যে এত পাগলামো করছেন!আমার দিশেহারা লাগছে, কী করব বল তো?”

লম্বা কথা বলে থামল রুবাব। “মুনের মত নেই” কথাটা আশার আলোর মতো কাজ করল দুই বন্ধুর মাঝে। ওরা সতর্ক চোখে সৈকতের দিকে তাকাল। কেমন মলিন মুখে বসে আছে! দেখেই মায়া হলো ওদের। নাহিদ বলল,
” করার এখন একটাই কাজ, তা হলো বিয়ে ভেঙে দেয়া। একে তো বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে দিতে চাচ্ছিস, তার উপর ওর মতের বিরুদ্ধে, এটা তো রীতিমতো অন্যায়। এভাবে মেয়েকে কাঁদিয়ে ধরে বেঁধে বিয়ে দেয়ার মানে হয়না। আন্টি আংকেলকে বুঝা। যেভাবেই হোক আজকের মধ্যেই বিয়ের আলাপ শেষ কর। ”

রুবাব হতাশ সুরে বলল, “অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাবা মা আমার কথা কানেই তুলছেন না। হুলুস্থুল কান্ড বাধিয়ে দিয়েছে।”

অন্তর বিরক্তি নিয়ে বলল, ” বিয়েটা যেহেতু মুনের, ছেলেটার সাথে সারাজীবন কাটাবে মুন, তাহলে ওর অপছন্দেভ, অমতে বিয়ের কথা আগালে ও মানতে পারবে? সুখে হতে পারবে?অনেক বাবা মা মনে করেন, কোনভাবে বিয়ে হয়ে গেলে, আপনাআপনি সব ঠিক হয়ে যাবে। তাই জোর করে মেয়ের অমতে বিয়ে দেন। ভাগ্য ভালো হলে বনিবনা হয়, না হয় অনেকাংশে বনিবনা অভাবে ডিভোর্স অবধি গড়ায়। বাবা মায়ের জন্য পুরো জীবন সাফার করে মেয়েটা। আন্টি আংকেল না হয় আগেরকার ছেলে, তারা বুঝছেন না, তুই আজ-কাল ছেলে, তুই অন্তত বুঝ। মেয়েটাকে বিপদে ঠেলে দিস না। তুই কী করবি জানি না, তবে আমার উপস্থিতি আমার বোনের বিয়ে আমি হতে দিতাম না।”

অন্তরের রাগত স্বরে বলা কথা গুলো ভীষণ তিক্ত হলো বুকে লাগল রুবাবের। “ডিভোর্স” শব্দটা কানে বাজল খুব। এই বিয়ের পর যদি মুন মানিয়ে নিতে না পারে? তবে কতটা দুর্বিষহ হবে ওর জীবন? সারাজীবন গুটেগুটে মরবে। নাহ্! এই বিয়ে হতে দেয়া যায় না। ওর আদরের বোন যে কষ্ট না পায়। রুবাব গূঢ় হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল,
“বাবা মা তো আমার কথা শুনছেন না, তোরা একটু কথা বল, না?”

নাহিদ খুশিমনে বলল, ” আচ্ছা, আমরা আংকেলের সাথে কথা বলব। চিন্তা করিস না, বিয়েটা হতে দিব না, আমরা।” বলল রুবাবকে। অথচ হাত ধরল সৈকতের।

আংকেলের সাথে কথা বলতে যাওয়া লাগেনি, তিনি নিজেই এসেছেন।

ছেলের বন্ধুদের বাড়িতে দেখে বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছেন মনির শেখ। বেশ স্নেহ করেন ছেলের বন্ধুদের। ঘরে ঢুকতে অবাক হয়ে চাইল সবাই। সালাম দিল। মনির শেখ হেসে বললেন,
“তোমাদের একটা দাওয়াত দিতে এসেছি।”

নাহিদ কৌতুহলী হবার ভান করল, “কিসের দাওয়াত আংকেল? ”

“মুনের বিয়ে ঠিক করেছি। ছেলে ব্যাংকার দেখতে শুনতে ভালোই। আগামী শুক্রবার এসে আকদ করিয়ে যাবেন। তোমরা সবার দাওয়াত। ” হেসে উৎফুল্ল স্বরে বললেন মনির সাহেব।

বন্ধু এবং বাবা দুইপক্ষের উপস্থিতি দেখে সময় অপচয় করল না রুবাব। কথার কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে পৌঁছল। ” মুন কাঁদছে বাবা। ওর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে দেয়া ঠিক হচ্ছে, বাবা?”

” বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ” উৎফুল্ল মুখে বিরক্তির লেশ টেনে বললেন মনির শেখ। অন্তর বলল,
“যদি ঠিক না হয়?”

মনির শেখ আন্দাজ করলেন ছেলে দলবল নিয়ে এসেছে তাকে বুঝাতে। এ পর্যায়ে তিনি গম্ভীর হলেন,
” ছেলে ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ অফিসার। ভালো সেলারি পায়, দেখতে শুনতে ভালো। অর্থবিত্ত ঢের, ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাটে থাকে। ঠিক থাকার জন্য এগুলো যথেষ্ট নয়?”

নাহিদ বলল, ” ছেলের অর্থবিত্ত রূপ সৌন্দর্য দেখেও যেহেতু মুন প্রলুব্ধ হচ্ছে না। তবে আপনি কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন, ভবিষ্যতে এগুলো ওর ঠিকের কারণ হবে? ও যদি ছেলেটাকে মানতে না পারে!”

“আমার মন এবং অভিজ্ঞতা বলছে পারবে।” মনির শেখের দৃঢ় স্বর। বন্ধুরা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করলেও এতক্ষণ নিশ্চুপ বসে আছে সৈকত। এই ক্ষণে সে মুখ খুলল,
” আপনার মন আর অভিজ্ঞতা যদি ভুল হয়, তবে সাফার কিন্তু মুনকে করতে হবে। ছোট্টো একটা জীবনকে কেন রিস্কে ফেলছেন আংকেল?”

এরপর অন্তর খানিক আগে রুবাবকে বলা ডিভোর্স থিসিস মনির শেখের উপর এপ্লাই করল। তবুও তিনি দমলেন না। গম্ভীরমুখে বললেন,
” আমি আমার মেয়ের বিয়ে এখানেই দিব। ”

বলে উঠে দাঁড়ালেন। স্পষ্ট অগ্রাহ্য। পা বাড়িয়ে বললেন, “তোমার দাওয়াত, এসো।”

নাহিদ তড়িঘড়ি করে বলল, ” আমাদের এলাকায় একটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেয়ার সময় মেয়েটা সুইসাইড করেছিল। মুনের কান্না দেখে আমার ওর জন্য ভয় লাগছে। আপনার মেয়ে, আপনি বিয়ে দিতেই পারেন। তবে একটু খেয়াল রাখবেন আংকেল। আবার না পরে পস্তাতে হয়।”

মনির শেখের চলতি পা থেমে গেল। ভয়ে কাঁপল বুক। ভয় নিয়ে চাইলেন নাহিদের পানে। ভয় শুধু মনির শেখের চোখে দেখা গেল না, তার সাথে আরও দুই পুরুষের চোখে দেখা গেল। কারো শ্বাস আটকে এলো, কারো স্বর। রুবাব বাবার কাছে গেল। আকুতি নিয়ে বলল,
“কাল সকাল থেকে এক ঢোক পানি ও মুখে তুলে নি মেয়েটা। অনবরত কাঁদছে। এভাবে নাওয়া খাওয়া ছাড়লে এমনি অসুস্থ হয়ে যাবে। প্রচন্ড মানুষিক চাপে আছে। ও খুব চাপা কাউকে কিছু বলবে না। নিরবে সইবে। যদি সইতে না পেরে কিছু করে ফেলে?
আমার একটাই বোন, ওর কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচব না। তুমি ওকে কষ্ট দিও না। বিয়ের ব্যাপারটা এখানেই শেষ করে দাও। ”

মনির শেখের মন কাঁপলেও মুখ কাঁপল না। ভাটা পড়ল না গম্ভীর্যে, ” বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে। ”

“যদি ঠিক না হয়, বনিবনা না হয়! কতটা কষ্ট পাবে আমার বোনটা। আমার একটাই বোন, ওর কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচব না। তুমি ওকে কষ্ট দিও না। বিয়ের ব্যাপারটা এখানেই শেষ করে দাও। প্লিজ বাবা!” অনুরোধের সুরে বলল রুবাব। রুবাবের সাথে নাহিদ অন্তর ও যোগ হলো,
“মেয়েটা পড়তে চাইছে, পড়ুক। বিয়ের ব্যাপার ওর গ্রাজুয়েশনের পর ভাবতে পারবেন।”

মনির শেখ বললেন, ” এমন সুপাত্র সবসময় হাতে আসে না। পরে যদি না পাই?”

নাহিদ দৃঢ় স্বরে বলল, ” মুনের সমান আমার ও একটা বোন আছে। আমি আমার বোনের বিয়ে নিয়ে অন্তত আগামী তিনবছর ও ভাবব না। ও পড়তে চাইছে পড়ুক। পরে সুযোগ্য পাত্র দেখে বিয়ে দিব। মুনকে আমি আমার বোনের মতোই দেখি। আজ আপনি বিয়েটা ভেঙে দিন, কথা দিচ্ছি মুনের জন্য এরচেয়ে ভালো পাত্র আমি এনে হাজির করব। ”

অন্তর তাল মেলাল, ” রুবাবের বোন মানে মুন আমাদের ও বোন। মুনের ভাইরা থাকতে পাত্র নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। মুনের পড়াশোনা শেষ করার আগে সুযোগ্য পাত্র এনে হাজির করার দায়িত্ব আমাদের। ”

নাহিদ অন্তরের কন্ঠস্বরে একটা ভাতৃত্ব ফুটে উঠল। একজন ভাইয়ের মতো দৃঢ়তা প্রকাশ পেল। যা মনির শেখকে আলোড়িত করল। সৈকতকে চুপ থাকতে দেখে মনির শেখ তাকালেন ওর দিকে। ভাইজনক কনসেপ্টে সৈকত নিজেকে জড়াবে না বলেই নিশ্চুপ আছে। এ পর্যায়ে সে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
” সময় দিন আংকেল। সব ঠিক করে দিব।”

মনির শেখ ভেবেছেন সৈকত যোগ্য পাত্র আনার সময় চাইছে, অথচ তিনি ঘূর্ণাক্ষরেও জানলেন না, সৈকত নিজেকে যোগ্য করার সময় চাইছে।

মনির শেখ কিছু না বলে বিদায় নিলেন। ওরা উত্তরের অপেক্ষায় রইল।
__________

বিকেল অবধি উত্তর না এলে যাবার পথ ধরল। সিড়িতে আতর্কিত সাক্ষাৎ হয়ে গেল মুনের সাথে। চোখ মুছতে মুছতে উপরে আসছে। পাত্রের সাথে দেখা করতে যেতে রাজি না হওয়ায় মা খুব কঠিন কঠিন কথা শুনিয়েছেন। কান্না এরই রেশ ধরে। ভাইয়ের বন্ধুদের দেখে কাচুমাচু করে উঠল। নাহিদ অন্তর সৈকতের দিকে তাকাল। সৈকত ইশারা করল। নাহিদ অন্তত রুমে ফিরে গেল।। সেঁজুতির ফোন আসায় উপরে রয়ে গেছে রুবাব। কথা শেষ করে আসবে। যাতে রুবাব আসার সময় সঙ্কেত দিতে পারে।

নাহিদ অন্তরের নিরব প্রস্থানের পর পাশ কাটতে নিল মুন। সৈকত গভীর চোখে তাকাল ওর দিকে। ডাকল মৃদু স্বরে, “শুনো?”

মুন থেমে গেল। কী ভেবে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। ওর বর্ষামুখর চাহনির বিপরীতে সৈকত শীতল স্বরে বলল,
” কান্নাকাটির পর্বের ইতি টানো। বিয়েটা হচ্ছে না।”

অবাক, অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল মুন। সৈকত ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” নিশ্চিন্তে থাকো, আমি থাকতে….

থেমে কেশে বলল, “মানে আমরা থাকতে তোমাদের মতের বিরুদ্ধে বিয়ে হতে দিব না। আমরা আংকেলের সাথে কথা বলেছি। বিয়ের ব্যাপার এখানেই শেষ হবে। ”

মুন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। খানিক বাদে চোখে কান্না মুখে হাসি নিয়ে বলল, “সত্যি?”

ওর হাসি দেখে রুবাবের বুকে পাথর চাপা অস্থিরতা তড়িৎ সরে গেল যেন। হাসি ফুটল ঠোঁটে। হেসেই বলল, ” একদম সত্যি। এ যাত্রায় তোমার বিয়ে হচ্ছে না নিশ্চিত থাকো। ”

মুনকে এত খুশি দেখাল, যেন একটা চাঁদ আরেকটা চাঁদ পেয়েছে। সৈকতের কথা বিশ্বাসযোগ্য হবার কারণ, বাবাকে ভাইয়ের ঘরে যেতে দেখেছে মুন। খুশিতে গদগদ হয়ে গেল সে। সৈকত কাছ থেকে খুব করে তা পরখ করল। একটা হৃদস্পর্শী দৃশ্যখানা মানসপটে ধারণ করে কোমল স্বরে বলল,
‘এভাবে হাসিখুশি থাকবে সবসময়। কান্নাকাটি করো না আর। বিয়েশাদীর ভাঙাজোড়ার চিন্তা আমরা নিব। তুমি শুধু চিল করো।”

সুন্দর কথা শুনে ঠোঁটে সুন্দর হাসি ফুটল মুনের। প্রাণবন্ত হেসে বলল, “থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ। আমি আপনাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।”

বলে চলে গেল। ভাইয়ের বন্ধুদের উপর বেজায় সন্তুষ্ট সে। তারা ভীষণ ভালো। বিশেষ করে সৈকত ভাইয়া।

এদিকে মুন যেতেই সৈকত বিড়বিড় করল, ” একেই বলে যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর। আমি বউ বানানোর জন্য বিয়ে ভাঙার কসরত করছি, আর ওদিকে সে ‘ভাইয়া ভাইয়া’ ডেকে মুখে ফেনা তুলছে। নাহ্, এসব ভাইয়া টাইয়া ডাক আর নেয়া যাচ্ছে না। এবার রুবাবকে বলে সাইয়্যা হবার ব্যবস্থা করতে হবে।”

চলবে….

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা