অলীকডোরের চন্দ্রকথা পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
204

#অলীকডোরের চন্দ্রকথা। (পর্ব-১৩)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

ছেলের বন্ধুদের বেশ স্নেহ করেন মনির শেখ এবং তারিনা। ভদ্র নম্র, সভ্য স্বাভাবের ছেলেগুলোর আচার ব্যবহারে মুগ্ধ হন, স্নেহটা আপনাআপনি এসে যায় । আসে কৃতজ্ঞতা বোধ ও। সাধারণত, খারাপ বন্ধুদের সঙ্গ অনেক ছেলের বিপথে যাবার কারণ হয়, এ ক্ষেত্রে বাবা মা’রা ছেলের বন্ধুদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে অপছন্দ করেন, ছেলেকেও দূরে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু মনির শেখের একমাত্র ছেলে রুবাব বন্ধুদের সাথে থাকলে তিনি নিশ্চিন্ত থাকেন। মনে হয়, নাহ, ছেলেটা খারাপ পথে যাবে না। বন্ধুরা যেতেই দিবেনা। সবার থেকে তাদের ছেলের ক্ষেত্রেটা ভিন্ন। তাদের বাউণ্ডুলে, ছন্নছাড়া ছেলেটা বিপথ থেকে বরং সুপথে এসেছে বন্ধুদের কল্যাণে। এই তিন বন্ধুর প্রভাবে তার মাঝে ভদ্রতা, নম্রতা, জীবনের প্রতি গম্ভীরতা এসেছে। পড়াশোনায় হেলা করা ছেলেটা বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বিসিএস দেবার মনস্থির করেছে, আজকাল তাকে খুব পড়তেও দেখা যায়। ব্যাপারটায় বাবা-মায়ের বিস্ময় আকাশচুম্বী। এই চমৎকারের জন্য তারা ছেলেদের বন্ধুদেরই দায়ী করেন। কৃতজ্ঞতায় ভাসেন। তাদের ছেলের বিপদ আপদে তাদের আগে ছেলের বন্ধুরাই ছুটে আসে। ওদের আন্তরিকতায় বরাবরই মুগ্ধ হন।
অভিভাবকহীন একলা শহরে বাস করা এই ছেলেদের জন্য মায়া হয় তাদের। বাসায় ভালোমন্দ রান্না হলেই ছেলেকে বলেন, বন্ধুদের ডেকে নে। নয়তো তারিনা খাবার প্যাকিং করে হাতে ধরিয়ে দেন।
আজ যখন ছেলের বন্ধুর মর্মান্তিক অবস্থার কথা শুনলেন, তখন অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠেছিল দুজনারই। তারিনা তো জোহরের নামাজে খুব দোয়া করেছিলেন। ঢাকা নিয়ে আসার অপেক্ষায় ছিলেন। ঢাকা এসে পৌঁছানোর পরেই স্ত্রী সমেত হাজির হয়েছেন হাসপাতালে। একা বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে রেখে আসার সাহস না থাকায় মেয়েকেও সঙ্গে এনেছেন। এখন সৈকতের পাশেই বসে আছেন। এন্টিবায়োটিকের প্রভাবে চোখে ঘুম ধরেছে সৈকতের। চন্দ্রকথার আগমনের টেরটি পায়নি।

মনির শেখ, তারিনা আর মুনের দৃষ্টি কেবল সৈকতের পানে। বাদবাকি সবার দৃষ্টি মুনের মুখপানে। সবাই সুক্ষ্মদর্শীতে যাচাই করতে চাইছে সৈকতের অসুস্থতায় মুনের প্রতিক্রিয়া। রুবাব অন্তর্ভেদী চোখে পরখ করছে বোনকে। সহানুভূতি নিয়ে সৈকত দেখছে মুন। ওর চোয়ালে প্রেমিকার মতো দুঃখ নেই। কেবল সহানুভূতি আছে। চোখে জল নেই। তবে মুখে কিঞ্চিৎ গুমোট ভাব আছে। মেয়েটা ধরতে পারেনা, নিজের অজান্তেই সৈকতের জন্য ওর খারাপ লাগছে। সকালে মুনের অস্থিরতা দেখে যে সন্দেহ প্রকট হয়েছিল তা বিলীন হয়েছে এই ক্ষণে।

দুর্বল নেত্র থেকে ঘুমের লেশ ছুটতেই কানে সুরলা এক নারী কণ্ঠ ভেসে এলো। চোখ বন্ধ করেই ভ্রু কুঁচকাল সৈকত। তারপর নিভু নিভু চোখে তাকাল। সম্মুখে থাকা মানুষটাকে দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। নিভু চোখ পুরো মেলে গেল। চেহারায় ভর করল রাজ্যের বিস্ময়। স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। ওর হৃদয় আন্দোলিত হলো অপ্রত্যাশিত মুখ দর্শনে। চন্দ্রকথা!

আকস্মিক পরিবর্তিত সৈকতের মুখভঙ্গি চোখ এড়াল না বন্ধু, ভাই কারোরই। তারা যেন দূর থেকেই সৈকতের উত্তেজিত ভাবনা টের পেল। মুনকে দেখার পর চোখের চেহারায় হুট করেই একটা ঝলক দেখা গেল, বিস্ময়ের সাথে প্রশান্তি, প্রেম আর সুখবোধ খেলে যাচ্ছিল। ওরা স্পষ্ট দেখল। কেবিনে এতগুলো মানুষ, অথচ সৈকতের খেয়াল কেবলই মুনের দিকে। অন্য কারো উপস্থিতি টেরই পায়নি। মুনের কাছাকাছি আছে ওর বাবা মা। সৈকতের আচরণ তারা ভালো চোখে নাও দেখতে পারেন।

রুবাব সুক্ষ্মচোখে বন্ধুর সুখ দেখে গলা খাঁকারি দিল। জানান দিল, কেবিনে শুধু মুন নয় আরও অনেকে আছে। নাহিদ জোরে জোরে বলে উঠল,
” একটু বেটার ফিল করছিস সৈকত?”

সৈকত তাকাল বন্ধুর পানে। নাহিদ মুনের বাবা মায়ের দিকে ইশারা করল। এতক্ষণে সৈকতের দৃষ্টিগোচর হলো তারা। চোখাচোখি হলো রুবাবের সাথে। সে সংযত হলো। কিছুটা লজ্জাও পেল বোধহয়। বন্ধুর বিব্রত মুখখানা দেখে কেন যেন হাসি পেল রুবাবের। মুনের জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে এ নিয়ে বেশ মজা নিত সে। কিন্তু বন্ধুর প্রেয়সী নিজেরই বোন বলে মজা তো দূরে থাক, হাসিটাকেও লাই দিতে পারছে না। অন্যদিকে ফিরে গেল সে।
সৈকত গলা ঝেড়ে মনির শেখের উদ্দেশ্যে সালাম দিল,
“আসসালামু আলাইকুম, আংকেল।”

রুগ্ন অবস্থায় ও সৈকতের ভদ্রতার বালাই দেখে প্রসন্ন হাসলেন মনির শেখ। স্নেহের সুরে বললেন, ” এখন কেমন লাগছে, বাবা?”

সৈকত নম্র সুরেই উত্তর দিল, ” আলহামদুলিল্লাহ। ”

তারিনা দাঁড়িয়ে ছিলেন। সৈকত বলল, “আন্টি বসুন। কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন! আমি ঠিক আছি।”

তারিনা কোমলতা নিয়ে বললেন, ” কী বলো বাবা! ছেলের কাছে আসতে মায়ের কষ্ট হয়? তোমার এক্সিডেন্টের কথা শুনে এত মন কেঁদেছে আমার! পথ জানা থাকলে আমি তখনই ছুটে যেতাম। ”

সৈকত প্রশ্রয়ের হাসি দিল। এ কথা সত্য যে তারিনা তাদের সন্তানের মতো স্নেহ করে। এক্স-রে করা হয়েছে। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বলেছে, চিন্তার কিছু নেই। হাতে ফ্র‍্যাকচার হয়নি। কেটেছেই কেবল। কাল রিলিজ দেয়া হবে। সে প্রসঙ্গে তারিনা বললেন,
“শুনলাম, কাল রিলিজ দিবে তোমাকে। তুমি কিন্তু হাসপাতাল থেকে শেখ বাড়িতে যাবে। তোমার মা যেহেতু এখানে নেই, তবে এই মায়ের কাছেই থেকো।”

কী সুন্দর কথা! মনটাই ভালো হয়ে গেল সৈকতের। ওর মা থাকলেও এমনই করতো। তারিনার আবদারে না করতে পারল না। সে তার মনোভাব জানাল, নাহিদের পানে চেয়েই। কেবল এক পলক তাকাল। তাতেই নাহিদ বুঝে গেল, সৈকত শেখ বাড়িতে যেতে চাইছেনা। নাহিদ অন্তর আর রুবাবের এক পলকে চোখাচোখি হলো, চোখেই কথা হলো। অন্তর মুখ খুলল,
“সে না হয়, থাকা যাবে, কিন্তু আন্টি এখন থেকে আপনাদের বাসা তো অনেক দূর। কাল রিলিজ দিলেও চেকাপে থাকতে হবে। ডাক্তার এখন জার্নি করতে মানা করেছেন। কদিন ফুল বেডরেস্ট। ”

তাল মেলাল নাহিদ , “হ্যাঁ, ওদিক থেকে আসতে যা ট্রাফিক পড়ে, একবার আটকে গেলে কয়েকঘন্টায় বের হওয়া যাবে না। এতে আরও অসুস্থ হয়ে যাবে। আমাদের বাসাটা তো কাছেই, ওখানেই নিয়ে যাই বরং?”

তারিনা বললেন, “কিন্তু ওখানে কে দেখভাল করবে ওর? ছেলেটা অসুস্থ, দেখাশোনা জন্য তো মানুষ লাগবে। ”

এবার মুখ খুলল রুবাব, দৃঢ় স্বরে, “আমরা আছি না! আমরা খেয়াল রাখব ওর। হাসপাতাল থেকে আমি ও বাসায় উঠব। আমি, নাহিদ, অন্তর তিন তিনটা বন্ধু থাকতে সৈকতের দেখার জন্য আরও মানুষ লাগবে?”

রুবাবের স্বরে, মনে চোয়ালে সবটায় বন্ধুত্বের প্রগাঢ় ছোঁয়া। ঠিক আগেকার মতো। মাঝের সময়টায় হওয়া আকাশ পাতাল ঘটনা মাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বন্ধুত্বটা। সৈকত আনমনে হাসল। এইক্ষণে ওর মনে হচ্ছে, ওর বন্ধুকে ফিরে পেয়েছে ও। সায় জানাল,
” আমি এমনিই ঠিক হয়ে যাব। এত ব্যতিব্যস্ত হবেন না, আন্টি।”

সবার একসুরের কথার উপর কথা বাড়ালেন না তারিনা। বললেন, ” বাসায় নাইবা গেলে, কিন্তু আমি খাবার পাঠাব প্রতিদিন। তাতে আপত্তি করতে পারবে না।”

সৈকত মুনের দিকে চাইল এক পলক। তারপর স্মিত হেসে সায় দিল।

মনির শেখের ফোন আসায় কথা বলতে বলতে বাইরে গেছেন। তারিনা টুকটাক কথা বলছিলেন। এক পর্যায়ে রুবাব উঠে বলল,
“মা একটু বাইরে আসো তো।”

মাকে ডেকে নিয়ে গেল বাইরে। বাদবাকি রইল নাহিদ অন্তর, মুন আর সৈকত। সিফাত বাইরে। মুন এক কোণে নিশ্চুপ বসে আছে। জানালার বাইরে চোখ ফেলে রাতের আকাশ দেখছে। খানিক পর পর দৃষ্টি ফেলে ওকেই দেখছে সৈকত।

নাহিদ ফোন দেখছিল। অন্তর বলল, ” সিফাত গেছে কই! এখনো এলো না। ”

নাহিদ চোখ তুলে ইশারা বুঝে বলল, “চল দেখে আসি।”

অন্তর মুনের উদ্দেশ্যে বলল, “পিচ্চি, তুমি একটু বসো। আমরা বাইরেই আছি। কেমন?”

মুন সায় জানাল। নাহিদ অন্তর সবে ওঠে হাঁটা ধরেছে, ওমন সময় সিফাত এসে ঢুকল কেবিনে। অন্তর মুখ কুঁচকে ফেলল। এই ছেলে আসার আর সময় পেল না। বিরক্তির রেশ কাটবার আগেই আরেক গলদ করে বসল। নিশ্চুপ বসা মেয়েটার পানে চেয়ে বলল,
“হাই ভাবি!”

অন্যমনস্ক মুন চমকে উঠল। আকস্মিক ‘ভাবি’ সম্বোধনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। বিস্ময় নিয়ে চাইল। ভাবল হয়তো অন্য কাউকে বলছে। কিন্তু আগন্তুক ওর দিকেই তাকিয়ে আছে, হাসি হাসি মুখে। মুন ভ্রু কুঁচকাল, “আমাকে বলছেন!”

সিফাত সরল মনে বলল, ” অবশ্যই আপনাকে বলছি। আপনিই তো আমার একমাত্র ভাইয়ের একমাত্র ব…

কথার মাঝে আকস্মিক কেশে উঠল সৈকত। ক্রর চোখে তাকাল ভাইয়ের দিকে। এই ছেলে শুরু হবার আগেই সব শেষ করে দিবে। সিফাত কথা সম্পন্ন করতে চাইল, নাহিদ এসে টেনে নিয়ে গেল। অন্তর ওকে থামিয়ে ধীরে বলল,
“তোমার ভাবির ভাই আর তোমার ভাইয়ের সেটিং হইছে, ভাই-ভাবির হয়নি।”

সিফাতকে টেনে নিয়ে যেতেই হাঁফ ছাড়ল সৈকত। মুনের দিকে চাইতেই দেখল মুন প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ওর পানে। চোখাচোখি হতেই প্রশ্ন করল,
“এই ছেলেটা কে? আমাকে ভাবি কেন ডাকল?”

সিফাতকে না চেনায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সৈকত। হেসে বলল,
” ছেলেটা বোধহয় তোমাকে ওর ভাইয়ের জন্য পছন্দ করেছে। ”

মুন অবাক হলো, “ওর ভাই কে? ”

সৈকত হাসল। উত্তর দিল না। মুন বিরক্তি নিয়ে বলল, “অদ্ভুত!”
“কী অদ্ভুত?”
“ছেলেটা।”

” ছেলেটার ভাই কিন্তু ভালো আছে। তুমি তাকে বিয়ে করতেই পারো।” মুখ চেপে হাসল সৈকত। নিজের ঢোল নিজে পে টা তে গিয়ে হাসি পাচ্ছে। মুন অবাক হলো, “আপনি চিনেন?”

সৈকত চাপা হেসে সায় জানাল। মুন জানতে চাইল, “কে?”

“আমার কেবল বুঝানোর দায়, বুঝে নেয়ার দায়টা তোমার। ” রহস্য করে বলল সৈকত। মুন বুঝল না। বিরক্ত নিয়ে বলল, “আপনি এত রহস্য করেন কেন!”

সৈকত আবার হাসল, “এই রহস্যের জট যেদিন খুলতে পারবে সেদিন আমার চোখে চোখ মেলাতে দ্বিধা হবে তোমার।”

কেন দ্বিধা হবে? আশ্চর্য! এত খুঁজে ও মানে বুঝল না মুন। নিরবতার চাদরে ঢাকল গা। আকাশ পানে চাইল। সৈকত মুনের দিকে চেয়ে বলল,
“আজকের চাঁদটা সুন্দর।”

আকাশে টিমটিমে আলোর হাজারো তারা। কিন্তু চাঁদের চিহ্ন অবধি নেই। মুন আকাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
“চাঁদ পেলেন কোথায়? আমি তো কোন চাঁদ দেখতে পারছি না।”
“আমি তো একটি চাঁদ দেখতে পাচ্ছি।”

মুন ইতিউতি করে খুঁজল চাঁদ। দেখা না পেয়ে উঠে এলো। সৈকতের দিকে এসে চোখ ফেলল জানালায়। এখন থেকে দেখা যাচ্ছে কি না। না দেখে বলল,
“আপনার এখান থেকেও তো দেখা যাচ্ছে না। ”

“চাঁদ তোমার চোখে যায় না দেখা
অথচ
আমার চোখে সর্বত্রই চাঁদের আভা।
আমি আকাশ দেখিনি
কিন্তু চাঁদ দেখেছি।
একখানা চাঁদ নিজের হলে
চাঁদ ভাসতে আকাশ লাগে..?”
বিড়বিড় করল সৈকত। মুন শুনল না। বুঝল না, জানল না সম্মুখে থাকা মানুষটার প্রেমের আখ্যান।

________

মুন আকাশ দেখছিল। সৈকত দেখছিল ওকেই। এই মেয়েটাকে আপন করবার অনুমতি পেয়ে গেছে ও। প্রেমের আখ্যান পড়াতে চাইছে। কিন্তু মেয়েতো বোকার রানী, অবুঝপনায় মত্ত। সৈকত বলল,
“শুনো?”
মুন চাইল। সৈকত বলল,
” সমুদ্র কেমন লাগে তোমার?”

মুনের স্বর চঞ্চল হলো, ” সমুদ্র আমার ভীষণ ভালো লাগে।”

সৈকত চমৎকার হাসল, “তাই?”
“হ্যাঁ। আপনার কী ভালো লাগে?”

মুনের চোখে চোখ রেখে সৈকত বলল, “আমার চাঁদ ভালো লাগে। ”

সৈকতের একেকটা কথার গভীরতা অনেক। সুক্ষ্ম মনে তীক্ষ্ণ করে ভাবলেই বোধগম্য হবে সমুদ্র মানে সৈকত নিজেকে বুঝিয়েছে আর চাঁদ মানে মুনকে বুঝিয়েছে। এই ব্যাপারটা না ভেবে কৌতুক করল মুন, ” এই জন্যই সবখানে চাঁদ দেখেন?”

সৈকত হাসতে হাসতে বলল, ” তুমি বড্ডো বোকা।”

মুন প্রতিবাদ করল, “মোটেও না।”
” আমি তোমাকে চালাক হওয়ার এত উপায় বলে দিচ্ছি, তবুও তুমি চালাক হচ্ছো না। বোকাই রয়ে গেলে।”

” ভাইয়া বলেছে আমি বোকা, আপনি ও বলছেন আমি বোকা। আমি কী বোকামি করেছি! আশ্চর্য! ” প্রশ্নবিদ্ধ মনে জানতে চাইল মুন। সৈকত ঠোঁট কামড়ে হাসল। রহস্য জাল খুলল না।
সেইক্ষণে অন্তর ফিরে আসল। এসে আকস্মিক সৈকতের পাশে বসে গেল। সৈকত ভ্রু কুঁচকাল। এমন হন্তদন্ত হয়ে নাহিদের আগমনের কারণ ধরতে পারল না। খানিক বাদে যখন রুবাব বাবা মাকে নিয়ে রুমে ঢুকল তখন বোধগম্য হলো। বন্ধুর পানে কৃতজ্ঞের চাহনি দিল।

_________________

তিনদিন বাদে বাড়ি এসেছে রুবাব। সৈকতকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নেয়ার পর আর ফেরা হয়নি। আজ ফিরে সর্বপ্রথম শাওয়ার নিয়েছে। ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই দেখল মুন এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। ওকে দেখে বলল,
“চা দিব ভাইয়া?”
“দে।” চুল মুছতে মুছতে রুমে এলো রুবাব। মুন ফিরে যাচ্ছিল। আকস্মিক ডাকল রুবাব,
“মুন? ”

মুন ফিরে বলল, “জ্বি ভাইয়া?”

পরবর্তী কথা বলার আগে সময় নিল রুবাব। রয়েসয়ে বলল, “তোর কোন পছন্দ আছে?”

ভাইয়ের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন পেয়ে থমকে গেল মুন। খানিকক্ষণ কথা বলতে পারল না। নিজেকে ধাতস্থ করে মাথা নাড়াল। রুবাব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর কোমল স্বরে বলল,
“আমি যদি তোর জন্য কাউকে পছন্দ করি তোর আপত্তি থাকবে?”

_____

ভাই ওর জন্য কাকে পছন্দ করে এই রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে চাঁদ সমুদ্রের সমীকরণ মিলে গেল।

চলবে….

#অলীকডোরের চন্দ্রকথা। (পর্ব-১৪)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

বসন্তের পড়ন্ত বিকেলের চঞ্চল হাওয়া যেন সবেই ছুঁয়ে গেল মুনের মন। রুবাবের রহস্যকথার রহস্য উদঘাটন করতে গিয়েই সামনে এলো অপ্রত্যাশিত অপ্রকাশ্য এক ধ্রুব সত্য। আর ধ্রুব সত্যের সার হলো, সৈকত ওকে ভালোবাসে। সৈকতের চন্দ্রকথার জায়গায় নিজেকে দেখে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। সৈকত….ওকে ভা..লো…. ভাবতে গেলেই ভাবনারা তালগোল পাকিয়ে বসে। কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। সৈকতের সাথে নিজেকে মেলাতে গেলেই লাজুকতার দল কাবু করছে। সমীকরণ মিললেও নিজেরা মিলছে না। সৈকত আর ও…এটা হয় না কি!

মানসপটে ভাসছে কেবল কিছু স্মৃতি কিছু কথা। ভার্সিটি গেইটে সৈকতের দাঁড়িয়ে থাকার কথা, রিক্সা ঠিক করে দেয়া, বৃষ্টিতে ছাতা দেয়া। তারপর যখন ওর বিয়ে ভাঙল তারপর একদিন ভার্সিটি দেখা হওয়া, মুন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে যখন বলল,
“আপনাদের মতো তিনটা ভাই পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। আমার ভাগ্য ভালো। এভাবে ভাই হয়ে থাকবেন সবসময়। ”

তখন আকস্মিক সৈকতের কেশে ওঠা। তাতে নাহিদ অন্তরের হেসে উঠা, মুন কারণ জিজ্ঞেস করলে সৈকতের এড়িয়ে যাওয়া,
“উনারা হাসল কেন?”
“বুঝবেনা তুমি।”
“কেন বুঝব না? আমি সব বুঝি।”
“আচ্ছা! তবে এটাও বুঝে নাও যে, এখানে সবাই তোমার ভাই নয়। কেউ ভিন্ন মনোভাব ও রাখতে পারে।”

কদিন আগের বলা কথা, “বুঝানোর দায় আমার, বুঝার দায় তোমার।”

কানে বাজছে, ওকে দেখবার পর হাস্যমুখের, ‘চন্দ্রকথা’ সম্বোধনটা। মুন যখন সৈকতের চন্দ্রকথাকে নিয়ে প্রশ্ন করতো তখন সৈকতের চাপা হাসি, সেই সাথে বলা, ‘তুমি ভীষণ বোকা।’
তখন ব্যাপারগুলো স্বাভাবিকভাবে নিলেও আজ অস্বাভাবিক লাগল বটে। এবং প্রতিটি ঘটনার রহস্য বেরুলো। হাসপাতালে সেদিন সৈকত আকাশের চাঁদ নয়, ওর রূপের প্রশংসা করেছিল।

মুন সবার মতো নিজের চোখে ও বোকাটে বনে গেল। যে মানুষটাকে দেখার জন্য ও ব্যাকুল হয়ে ছিল, সে মানুষটা মুন নিজেই। সৈকতের চন্দ্রকথা। কত প্রশ্ন করেছে, আমি উনাকে দেখব বলে বায়না ধরেছে! না বুঝে সৈকতকে করা প্রশ্ন আর সৈকতের মনোভাব মনে পড়তেই ভীষণ লজ্জা পেল মুন। কী বোকামি করেছে সে! এখন সৈকতের সামনে পড়বে কিভাবে! ওর কানে ভাজল, সৈকতের প্রগাঢ় স্বরে কথা,
“আজকের চাঁদটা সুন্দর। ”

ধুরন্ধর লোকটা কৌশলে ওর থেকে কথাও আদায় করে নিয়েছে।
‘সমুদ্র কেমন লাগে তোমার?’বোকাটে মুন না বুঝেই বলে দিয়েছিল, ভীষণ ভালো লাগে তার। তারপর কী যে খুশি হলো সৈকত। তখন অতখুশির মানে না বুঝলেও এখন বুঝল। নিজের বোকামোতে নিজেই পাতালপুরীতে লুকাতে ইচ্ছে করছে! ইশ! এতটা বোকা সে হলো কিভাবে! নিজের নাম নিয়ে একটু ভাবলেই বেরিয়ে আসতো, মুন মানে চাঁদ, চন্দ্র মানে ও চাঁদ।
নিজের মাথায় বাড়ি দিল নিজেই।

অস্বস্তিতে পণ করেছে আর কখনো সৈকতের সামনে যাবে না। প্রতিশ্রুতির রেশ ধরে দু’দিন গেল না। ভার্সিটি গেল না, ঘরে দোর আটকে নিজের বোকামির জন্য নিজেকে শাসিয়ে গেল। এখন ভাইয়ের সামনে যেতেও লজ্জা লাগছে। ভাইয়া অবধি বুঝে গেছে, অথচ সেই বুঝেনি।

_________

প্রতিশ্রুতির জলাঞ্জলি হলো বেলা গড়াতেই। মুনের আজ প্রেজেন্টেশন আছে। না গেলেই নয়। সকাল সকাল ওঠে টুকটাক প্রস্তুতি নিল। প্রেজেন্টেশনে ফরমাল ড্রেসআপ পরে যেতে হয়। মুন সবসময় শাড়িই পরে যায়। আজও সাদা কালো মিশেলের একটা সুতি শাড়ি পড়েছে। এ অবধি ঠিক ছিল, বিপত্তি হলো বেরুবার সময়। যখন মা একটা খাবারের ব্যাগ এনে বললেন,
“যাওয়ার পথে দিয়ে যাস।”
“কোথায়?”
” সৈকতদের বাসায়। ”

সৈকতদের বাসায় সৈকত থাকবে নিশ্চয়ই। মুন হকচকিয়ে গেল, “নাহ, আমি যাব না।”
“কেন যাবি না। ওখানে রুবাব আছে তো। বাসায় যেতে হবে না। বাসার নিচে দাঁড়িয়ে রুবাবকে ফোন দিবি। রুবাব এসে নিয়ে যাবে।”

“প্রতিদিন তো অফিস যাবার সময় বাবা দিয়ে আসে। আজ আমি কেন!”
“কারণ তোর বাবা আজ ভোরেই বেরিয়ে গেছে। কথা বাড়াস না, ছেলেগুলো না খেয়ে আছে। নিয়ে যা।”

মুন কোনভাবেই রাজি হলো না। “ভাইয়াকে বলো। এসে নিয়ে যাক। আমি যাব না।”

তারিনা নাছোড়বান্দা। খাবারগুলো মুনের হাতে দিয়েই ছাড়বেন। বাসায় যাবার হলে জোর করতেন না। যেহেতু বাসার সামনে থেকে রুবাব এসে নিয়ে যাবে, সেহেতু সমস্যা কোথায়? রাত জেগে পড়ছে ছেলেরা। এখন কি অভুক্ত রাখবেন? এক প্রকার জোর করেই দিলেন। মায়ের জোরাজোরিতে মুন বাধ্য হয়ে টিফিনবাক্সের ব্যাগ হাতে নিল। ভাবল, বাসার ত্রিসীমানায় যাবে না। দূরে দাঁড়িয়ে ভাইয়ার হাতে টিফিন ব্যাগ দিয়ে ছুট দিবে। সে ভেবেই রওনা হলো। মাকে বলে গেল,
“আমি বেরুচ্ছি। তুমি ভাইয়াকে কল করে নিচে থাকতে বলো।”

তারিনা নাখোশ হয়ে বললেন, ” রাত জেগে পড়ে ভোরে ঘুমিয়েছে ছেলেটা। এত তাড়াতাড়ি জাগানো ঠিক হবে না। ঘুমাক এখন। কাছাকাছি গেলে তুই কল দিয়ে ডেকে নিস।”

মায়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে মুন সৈকতদের এলাকায় ডুকে সৈকতকে ফোন দিল। ফোন বেজে কেটে গেল। কেউ তুলল না। একবার দুবার তিনবার। রুবাব উঠাল না। বিরক্তির শ্বাস ফেলল মুন। নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে। কম্ভকর্ণের মতো ঘুমায় রুবাব। গভীর ঘুমে থাকলে কেউ তুলে পানিতে ফেললেও টের পায়না।

ভাইকে ডজনখানেক কল দিয়ে ও পেল না। এখন এই টিফিন বক্স নিয়ে কী করবে! বাসায় নিয়ে যাবে! যদি সৈকতের সামনে পড়ে! অসম্ভব! যাবে না।
এদিকে প্রেজেন্টেশনের সময় হয়ে আসছে। দশমিনিটের মাঝে ভার্সিটিতে থাকতে হবে। এই টিফিন বক্সটা তো আর ভার্সিটি নেয়া যাবে না। ওর কাছে এখন কেবল দুটো অপশন। এক, বক্সটা ফেলে দিয়ে ভার্সিটির পথ ধরা।
দুই, টিফিন নিয়ে বাসায় যাওয়া।

প্রথম অপশন বেছে নিলে মা কষ্ট পাবে। এত কষ্ট করে সেই সকাল থেকে রান্না করেছেন ওদের খাবার পাঠাবেন বলে। খাওয়া পাঠানো সত্ত্বেও ছেলেরা যদি উপোস থাকে তবে মায়ের মন খারাপ হবে। মুনের উপর ও অসন্তোষ হবেন। আর টিফিন ফেলে দিতে মুনের বিবেকেও বাধছে। বাসার কাছে এসে টিফিন না দিয়ে ফেলে দিবে!
অগত্যা বিবেক আর মায়ের কথা ভেবে বেছে নিল দ্বিতীয় অপশন।

সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে মনে মনে দোয়া করল। দরজা যেন রুবাব, নাহিদ, অন্তর কেউ একজন খুলুক। দরজা থেকে টিফিন দিয়ে চলে আসবে। ভেতরে যাবেই না। ভয় নিয়ে কলিংবেল চাপলো। প্রথমবারে খুলল না। দ্বিতীয়বার চাপল। এবার ভেতর থেকে নাহিদের স্বর ভেসে এলো। মুন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। দরজা বোধহয় নাহিদ খুলবে। যাক, নিশ্চিন্ত হলো মুন। তখনই দরজা খুলে গেল। মুন প্রসন্ন হেসে সালাম দিতে গেল..
“আসসালা…..

সালামের মাঝে তাকাতেই সম্মুখে দাঁড়ানো অপ্রত্যাশিত মুখদর্শনের পর কথা আপনাআপনি থেমে গেল। যার সামনে না পড়ার জন্য এত বাহানা, এসে পড়ল তারই সামনে। অস্বস্তিতে ছেয়ে গেল মুখ। সৈকত বলেছিল,
” এই রহস্যের জট যেদিন খুলতে পারবে সেদিন আমার চোখে চোখ মেলাতে দ্বিধা হবে তোমার”

সত্যিই আজ মুনের দ্বিধা হচ্ছে। এই প্রথম ভাইয়ের বন্ধুটির দিকে তাকাতেও তার অস্বস্তি হলো। নিজের বোকামোর কথা স্মরণে আসতেই লজ্জা পেল। অস্বস্তি আর লজ্জার পরিমাণ এত বেশি হলো যে, মুন ভড়কে গেল। আকস্মিক মুখ কুঁচকে অন্যদিকে ঘুরে গেল।

দরজায় দাঁড়ানো যুবকটি ভ্রু কুঁচকাল। নিজের দিকে তাকাল একবার। ওর পরনে ফোর কোয়ার্টার প্যান্ট, আর টি-শার্ট। ওকে তো অশালীন লাগছে না। তবে মেয়েটা ওকে দেখে ওমন অন্যদিকে ফিরে গেল কেন! দ্বিধা নিয়ে বলতে গেল,
” চন..
পরপরই কেশে বলল, ” মুন! কোন সমস্যা? ওভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

গলার কাছে অবরুদ্ধ হয়ে রইল ‘চন্দ্রকথা ‘শব্দটা। বোকা মেয়েটার সামনে হুটহাট উচ্চারণ করা যায়না। অবুঝ মেয়েটা বুঝেই না। আবার না কোথাকার কোন মেয়েকে ধরে বসবে।

সৈকতের স্বাভাবিক স্বর শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হলো মুন। তবে ফেরবার ইচ্ছে হলো না। সৈকত আবার বলল, “কোন দরকারে এসেছো? রুবাবকে ডেকে দিব?”

স্নেহের সুর সৈকতের। ঠিক যেমনটা পুর্বে ছিল। সৈকতের অপরিবর্তিত মনোভাবে প্রসন্ন হলো মুন। ভরসা পেল, বোধহয় অস্বস্তিদায়ক বিষয়টা ওর আড়ালে রাখবে, সামনে তুলব না। মুন দ্বিধান্বিত মনে সামনে ঘুরল। সৈকতের দিকে তাকাল না। নিচের দিকে তাকিয়ে টিফিন বক্স বাড়িয়ে দিল। ক্ষীণ স্বরে বলল,
“ব্রেকফাস্ট দিতে এসেছিলাম।”

সৈকত প্রথমে মুনের বাড়ানো বক্সের দিকে তাকাল। পরপরই চোখ ফেলল মুনের পানে। শাড়িতে মুনকে চমৎকার লাগে। অনন্য এক মায়া ঘিরে ধরে। সৈকত মায়ায় আটকে যায়। চোখ ফেরাতে পারে না। আজও পারল না। স্থির চোখে চেয়ে রইল। অন্তর্ভেদী চোখে পরখ করল ওকে। ওর মুখভঙ্গিতে নজর ঠেকবার মাঝেই আকস্মিক বিস্ময়ে ভ্রু উঁচু হয়ে গেল। থমকে রইল খানিকক্ষণ। বুক আন্দোলিত হলো খুশিতে। চোখমুখে ঝিলিক দিয়ে উঠল। অবাক চোখে চেয়ে রইল। সেই তাকানোর মাঝে একবারে হুট করে হেসে ফেলল। শব্দহীন প্রাণবন্ত হাসি। খুশিতে দোলা খেলা ওর উৎফুল্ল স্বর বলে উঠল,
“এই চমৎকারটা হলো কিভাবে?”

সেই কখন থেকে টিফিন বাড়িয়ে ধরেছে। অথচ নেবার খবরই নেই। হাত ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে। টিফিন না নিয়ে অদ্ভুত প্রশ্ন করছে লোকটা। বিরক্ত হলো মুন, “কী!”

” বোকাটে চন্দ্রকথা হুট করে চালাক হয়ে গেল কিভাবে?” সৈকতের ঠোঁটের কোণের হাসিটা বাড়ল। এতক্ষণের আটকে রাখা ডাকটাকে উন্মুক্ত করল।

মুনের পিলে চমকে গেল। সে যে রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছে কিভাবে জানল লোকটা? যাদুটাদু জানে না কি! এবার কী হবে! মুনের চেহারা অস্বস্তিতে নীল হলো। ক্ষণিকেই যে সৈকতের কাছে ধরা পড়ে যাবে ভাবে নি। মুনের থুতনি বুকের সাথে লেগে গেল যেন। ওর অস্বস্তিভরা মুখখানা প্রথম দেখল সৈকত। মুনের বোকাটে প্রশ্নের পর প্রতিবারই ও সৈকতের ইচ্ছে জেগেছে, সত্য জানার পর মুনের মুখভঙ্গি দেখার। ইচ্ছেটা পূরণ হলো অবশেষে। অনুভূতিটা চমৎকার। অবশেষে সেই মহেন্দ্রক্ষণ এসেই গেল। আড়ালে আবড়ালে নয়। এবার সরাসরি প্রগাঢ় অনুভূতি নিয়ে চেয়ে সৈকত বলল,
“আজকের চাঁদটাও সুন্দর। ”

একবারে ঝড়ের মতো হুট করেই বদলে গেল যেন সৈকতের মনের আবহাওয়া, ভাবের প্রকাশ, স্বর, কথা। খানিক আগের স্নেহ সরে গিয়ে জুড়ে ভসেছে প্রেম। অবচেতন মনে আগে শুনলেও খেয়ালটা এই প্রথমই হলো। এতদিন শ্রদ্ধার চোখে দেখা ভাইয়ের বন্ধুটি হঠাৎ বদলে গেল। আগে ঠিকঠাক ছিল, যেই টের পেল মুন ওর মনের ভাব জেনে গেছে তখনই রূপ বদলে ফেলল। প্রেমিকের স্বরূপে হাজির হলো। তার এই বদলটাই কাবু করল মুনকে। বিস্ময়ে পিলে চমকে গেল। কথার স্বরে হৃদপিণ্ডে রক্ত ছলকে উঠল। অস্বস্তিতে নুয়ে পড়ল ভেতর বাহির সবটা। ইচ্ছে হলো ছুটে পালাতে। কিন্তু
সে পারল না। পা নড়লই না।

সৈকত ন্যানোসেকেন্ডের জন্য ও চোখের পলক ফেলছে না। চাহনি মুনের পানে তাক করা। দরজা ঘিরে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ছিল। নিজের অবস্থার পরিবর্তন করে দরজার সাথে হেলান দিয়ে বুকের উপর হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো এবার। ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
” সব বুঝেও আমার সামনে আসাকে হ্যাঁ ধরে নিব?”

সম্মুখে দাঁড়ানো মানুষ, তার কথা, স্বর সবটাই অপরিচিত লাগছে মুনের। সৈকতকে সে ঘৃণা করে না, আবার অতি মাত্রায় অনুভব ও করে না। যা করে তা হলো সম্মান। এই মানুষটাকে সর্বদা সম্মানের চোখেই দেখে এসেছে। বিপরীত দিক থেকেও সবসময় সম্মান আর স্নেহই এসেছে। রুবাবের সাথে পরিচয় হবার পর থেকে ভাইয়ের এই তিন বন্ধু ওর সাথে ভাইয়ের মতোই ব্যবহার করতো। তিনজনের মাঝে নাহিদ অন্তর বেশি আন্তরিক। ‘পিচ্চি’ ডেকে আগবাড়িয়ে কথা বলতো। ওদের ব্যবহারে বিন্দুমাত্র অসম্মান দেখেনি। সৈকত চাপা স্বভাবের মানুষ। কম কথা বলতো। সামনে পড়ে গেলে, কিংবা অতি প্রয়োজনে দুই একটা কথা বলেছে সবসময়। হুট করে কী এমন হলো কে জানে? স্নেহ না কি ভালোবাসায় রূপ নিল। ভাই আবার বিয়েও ঠিক করে ফেলেছে। বিষয়টা এখনো ঠিকঠাক হজম করতে পারছে না মুন। তারউপর সৈকতের এই স্বরূপ। মুন যেন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। পালাতে ইচ্ছে করছে। এত লজ্জা লাগছে, না তাকাতে পারছে, আর না যেতে পারছে। গলা দিয়েও কথা বেরুচ্ছে না। সৈকতের অতিব ভাবনা ভুল প্রমাণ করতে বহুকষ্টে বলল,

“আমি স্বেচ্ছায় আসিনি। মা খাবার পাঠিয়েছেন।”

সৈকতের হাসিতে আজ ভাটা পড়ল না। তরঙ্গ সঞ্চার হলো একের পর এক,
“অনিচ্ছা হলে বাহানায় মানা করা যেত নিশ্চয়ই ! ইচ্ছে ছিল তবে!”

সৈকত বারবার কথার প্যাঁচে আটকে ধরল মুনকে। মুন চলে যাবার জন্য উদ্যত হয়ে বলল,
“আমার ভার্সিটি দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”

সৈকত ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তো? আমাকে দিয়ে আসতে বলছো?”

মুন হকচকিয়ে গেল, ” না, না।”
সৈকত প্রশ্রয়ের সুরে বলল, “বলতেই পারো। অধিকার টধিকার পেয়ে গেছো কি না! ”

মুন আবার টফিন বক্স বাড়িয়ে ধরল, “এটা নিন। ”

সৈকত এবারও নিল না , ‘ আমাকে স্মরণে রেখে, ভালোবেসে খাবার এনেছো, না খাইয়ে চলে যাবে! নতুন অধ্যায়ের প্রথম যাত্রা একসাথে হওয়া উচিত। বাসায় চলো।’ দরজা থেকে সরে দাঁড়াল সৈকত।

মুন ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। নড়ল না। ভেতরের যাবার আগ্রহ দেখা গেল না তার মাঝে। অন্যদিকে ফিরে বলল,
“আমি বাসায় যাব না।”

সৈকত তার কৌতুক ভাবনা দমিয়ে কোমল স্বরে বলল,
“এ বাসায় আমার নিজস্ব বলতে আমি ছাড়া কিছুই নেই। আমার একটা বেডরুম ও নেই। পুরো বাসা এবং বাসার প্রতিটা জিনিস তোমার ভাইকূলের দখলে। সো, ভয় পেও না। আসো।” সৈকত ভরসা দিল। তবে সে ভরসায় কাজ হলো না। মুন বাসায় পা রাখল না। হাত ঘড়িতে সময় দেখল কেবল।

সৈকত খানিকক্ষণ ওর পানে চেয়ে রইল। তারপর রুবাবকে ডাকল। রুবাব? এ্যাই রুবাব! এদিকে আয় তো!

আকস্মিক সৈকতের ওমন ডেকে ওঠায় মুন হকচকিয়ে গেল। অস্বাভাবিক লাগল ওর। কোথাও ভাইয়ের সামনে কথা তোলার ফন্দি আঁটছে না তো! তেমন হলে লজ্জায় ম রেই যাবে মুন। সে কাঁপা স্বরে বলল,
“ভাইয়াকে ডাকছেন কেন!”

মুনের ভয় দেখে সৈকত শব্দ করে হেসে ফেলল। কৌতুক ভাবনা ফিরিয়ে এনে বলল,
“শালাবাবুকে জানাতে হবে, তার বোন আমার ভালোবাসায় সায় জানিয়ে শাড়ি টাড়ি পরে হাজির হয়েছে। কাজি ডাকার মোক্ষম সময় এখনই। ”

মুন অসাড় হয়ে দাঁড়াল। ওকে ভীষণ অপ্রতিভ আর ভীত দেখাল। ভাইয়ের জন্য এত ভয়! সৈকত হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক হলো। পূর্বাকার শীতল স্বরে আশ্বস্ত করল, ” মজা করছিলাম। একটু অপেক্ষা করো। রুবাবকে পাঠাচ্ছি।”

হাঁটা ধরল সৈকত। মুন হাঁফ ছাড়ল। ক্ষণেই আবার ওর শ্বাস রুদ্ধ করে হাজির হলো সৈকত। দুষ্টু হেসে বলল, “তুমি একটু স্বাভাবিক হও। তোমার এত লজ্জা দেখে রুবাব অন্য কিছু ভাবতে পারে। এমনিতেই রুবাব সন্দেহ করছে তোমার আমার মাঝে গভীর প্রেম আছে। ”

চোখের পলকে আবার উধাও হয়ে গেল। সৈকত চোখের আড়াল হলেও মুনের শ্বাস প্রশ্বাস স্থির হলো। ভাইয়ের শান্তশিষ্ট বন্ধুর এমন চঞ্চল প্রেমিক রূপ দেখে ভেতরটা অশান্ত হলো। এই ছেলেটা এসে হুট করে যেন সব এলোমেলো করে দিল।

_________________

সৈকত রুবাবের কাছে গেল। রুবাব ঘুমাচ্ছে। সৈকত রুবাবকে ডাকল, “এ্যাই, রুবাব। উঠ!”

রুবাবের ঘুমের ঘোর কাটল না। সৈকত ঘুমের মাঝেই টেনে বসিয়ে দিল, ” এই শা লা উঠ!”

কাঁচা ঘুম ভাঙায় রুবাব মহা বিরক্ত, “কী হইছে শা লা? সকাল সকাল কী প্যাঁচাল লাগাইছিস?”
সৈকত শুধরে দিল, ” আমি না, তুই আমার শালা। এখন উঠ। যা।”

“কই যাব?
“দরজায়।”
“ক্যাডা আইছে।
“মুন এসেছে। ”

বোনের নাম শুনে রুবাব নড়েচড়ে উঠল। পুরো চোখ মেলল। ঘুম কাটিয়ে বলল,
“দরজা খুলিস নি?”
“খুলেছি। কিন্তু মুন বাসায় আসছে না। তুই গিয়ে নিয়ে আয়।”

রুবাব বিস্ময় নিয়ে বলল,
“আসছে না কেন?”

সৈকত অন্যদিকে চাইল। ক্ষীণ স্বরে বলল, “আমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে।”

রুবাব ভ্রু কুঁচকে তাকাল বন্ধুর দিকে। সৈকতের চোখেমুখে উজ্জ্বল আভা। ছেলেটা লজ্জা পাচ্ছে না কি! আকস্মিক রুবাবের কপালের ভাঁজ মিলিয়ে গেল। গলা ঝেড়ে কেশে উঠল। তারপর চট করে উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা পা ফেলল। যেন পালাতে চাইল। অস্বস্তি বোধহয় রুবাবের ও হচ্ছে।

_______________

মুনকে ভার্সিটি পৌঁছে দিয়েই এলো রুবাব। সৈকত আর সামনে যায়নি। প্রথমদিন এত ধাক্কা নিতে পারবে না মেয়েটা। এমনিতেই অস্বস্তিতে কাবু। আর অস্বস্তি বাড়াতে চাইল না। তবে মনস্থির করল, রাতে ফোন দিবে। দুটো কথা প্রেম উড়াবে। প্রথম প্রেমের ভ্রমর এসে জুড়েছে ওর উপর। সেও যেন উড়ছে।

রাতের খাবার শেষে বারান্দায় গেল সৈকত। ফোনটা তুলে ডায়াল করল প্রেয়সীর নাম্বারে। রিং হবার আগেই পিছু থেকে ডাক এলো,
“সৈকত!”

চট করে পিছু ফিরল সৈকত। পিছনে রুবাব দাঁড়ানো। থমথমে, গম্ভীর মুখভঙ্গি ওর । এসে দাঁড়াল বন্ধুর পাশে। সৈকত কল কেটে দিল। সুক্ষ্ম চোখে তা পরখ করল রুবাব। তার শান্ত স্বরে বলল,
” কিছু কথা বলি তোকে। মনোযোগ দিয়ে শুনবি।”

রুবাবের ভাবভঙ্গিমা বন্ধুসুলভ নয়। সৈকতের ভয় হলো। আবার কী বলবে? ভয় চেপে কৌতুহলী হয়ে বলল, “হ্যাঁ, বল!”

“এই কথা গুলো আমি আরও আগে বলব ভাবছিলাম, কিন্তু তোর অসুস্থতার জন্য বলতে পারিনি। আমার মনে এখন বলা উচিত। ” রুবাবের দৃষ্টি সামনের দিকে। সৈকতের চোখে প্রশ্ন খেলে গেল। বিরক্তি নিয়ে বলল,
“ভূমিকা, উপসংহার বাদ দিয়ে, সোজা বল।”

পরবর্তী কথা বলার আগে সময় নিল রুবাব। খানিক বাদে রাশভারী গলায় বলল,
“আমি চাইছিনা, তুই মুনের সাথে কোনপ্রকার সম্পর্ক রাখ। আমার মনে হয়, তোদের যোগাযোগের ইতি এখানেই টানা উচিত। ”

ভয়ে বুক কাঁপল সৈকত। শুরু হয়েও সব শেষ এখানেই….! তবে কি এতদিন রুবাব অভিনয় করেছিল? সব মেনে নেয়ার ঢং!

চলবে…..

#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-১৫)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

“আমি চাইছিনা, তুই মুনের সাথে কোন সম্পর্ক রাখ। আমার মনে হয় তোদের যোগাযোগের ইতি এখানেই টানা উচিত।” গুরুগম্ভীর ভাবের সাথে বলল রুবাব। ওরা তখন বারান্দায়। গ্রীল পেরিয়ে হিমেল বাতাস আসছে। তবুও এই কথার পরে যেন আকস্মিক বারান্দার আবহাওয়া গুমোট হয়ে গেল।

বন্ধুর কথায় সৈকত কিংকর্তব্যবিমুঢ়। বিস্ময়ের পরিসরে পলক ফেলতেও ভুলে গেছে। হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল বন্ধুর পানে। রুবাব কি মজা করছে ওর সাথে? দিন তিনেক আগেই তো নিজে নিজে সম্পর্কটা মেনে নিয়েছে। হঠাৎ কী হলো! ঝড়ের মতো সব বদলে গেল! তবে কি সেদিনের কথা, ভাব সবটাই অভিনয় ছিল? মেনে নেয়ার ঢং মাত্র? মুনের সাথে সদ্য শুরু হওয়া সম্পর্ক শেষ এখানেই! রুবাবের বিপক্ষে গিয়ে মুনকে পাওয়া সম্ভব না। পক্ষে তো রুবাব নয়, তবে কি মুনকে চিরতরে হারাবে! এই তো সকালে কত সুন্দর ভাবের আদান প্রদান হলো। সৈকতের অবচেতন মনের ধারণা, মুন ওকে অপছন্দ করে না, কিছুদিনের মাঝে হয়তো পছন্দ করে ফেলব, ভালো লাগায় সৈকতের নাম উঠে যাবে। এমতাবস্থায় এসে মুনকে হারাবে! হারানোর ভয়ে আবার বুক কাঁপল সৈকতের। হৃদপিণ্ড যেন গলার কাছে চলে এলো। প্রতিবাদ করবার মতো কথা বেরুলো না। অনেকক্ষণ চুপ রইল। তারপর মৃদুস্বরে বলল,
” মেনে যদি নাই নিবি, তবে সেদিন আশা দিলি কেন! কিসের শোধ নিচ্ছিস তুই!”

রুবাব ভ্রু কুঁচকাল, “তোর সাথে আমার শোধ নেয়ার সম্পর্ক!”

সৈকত ক্রুদ্ধ হয়ে গেল আকস্মিক। ক্ষোভ নিয়ে বলল, “আগে কখনো মনে হয়নি। আজ মনে হচ্ছে। ”

রুবাব গম্ভীরমুখে বলল, “যা মনে হয় তোর। তবে একটা কথা শুনে রাখ, মুন আমার বোন। আমি চাইছি না, ও এখন তোর সাথে কোন প্রকার সম্পর্কে জড়াক।”

সৈকত শূন্য চোখে চেয়ে বলল, ” একদিন নিজে এসে বলবি, বোন বিয়ে দিবি, আরেকদিন বোন বিয়ে দিবি না। মানে কী এসবের?”

রুবাব প্রতিবাদ করল, ” বিয়ে দিব না একবারও বলি নি আমি।”

সম্পর্কের উপর লাল বাতি জ্বালিয়ে বলছে বিয়ে দিবে না বলে নি! আশ্চর্য হলো সৈকত। দ্বিধায় পড়ে বলল, “কী বলতে চাইছিস তুই!”

রুবাব চাপা শ্বাস ফেলে বলল, ” সরকারি চাকরিজীবী পাত্রের প্রতি বাবার বেশ আগ্রহ। মুনের জন্য যত সমন্ধ এসেছে বা আসতেছে তার মেজরিটি গভমেন্ট সিকিউর জব, ওয়েল সেটেল্ড, হাই প্রোফাইল। যার সাথে কথা চলছিল সেই ছেলেও হাই প্রোফাইলধারী…..

কথার মাঝে অত্যন্ত আক্রোশ নিয়ে ফোঁড়ন কাটল সৈকত, ” আমি বা আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড হাই প্রোফাইলের নই বলে বোন বিয়ে দিতে আপত্তি তোর?”

বরাবরই শান্ত ছেলে সৈকত। অশান্ত বা চঞ্চলতা তার স্বভাব নেই, অন্তর এ অবধি ছিল না। এমনটাই জানতো রুবাব। আজ যেন ভিন্ন একটা সৈকতকে দেখছে। যে উত্তেজিত, ক্ষুব্ধ, চঞ্চল। ওর এহেন ভাবে বিস্ময়ের সাথে বিরক্ত হলো রুবাব। চোখ রাঙাল, “কথা শেষ করতে তো দিবি!”

সৈকত যেন কথা কানে তোলার অবস্থায় নেই। ওর চেহারায় কেমন যেন বিষন্নতা ছেয়ে গেল, হতাশার রেখা দেখা দিল। অস্থির হয়ে বলল,
” শুধু কথা নয় তুই আমাকেও শেষ করে দিয়েছিস। আর কী বলবি তুই? সব বুঝে গেছি আমি। তুই আমি নয় আমার স্ট্যাটাস দেখে আমাকে বিচার করছিস। এতবছর ধরে আমাকে চিনিস তুই, আমিকেন্দ্রিক খারাপ স্বভাব বলতে পারবি? হয়তো পারবি না। কিংবা তুই চাইবি ও না। কারণ তোর চোখ আমার পরিবারের দিকে। আমি মিডলক্লাস ফ্যামিলিতে বিলং করি, আমার বাবা গ্রাম্য স্কুল শিক্ষক। তোদের মতো আমাদের ঢাকায় বাড়ি নেই। আমার বাবার টাকা নেই, আমার ব্যাংক ব্যালেন্স শূন্য। এসব দিয়েই বিচার করবি। স্বভাব চরিত্রের কী এসে যায়, টাকা আর স্ট্যাটাসই সব। তোদের সাথে আমার স্ট্যাটাস মিলে, মানে তোর বোন বিয়ে করার যোগ্যতা রাখিনা, এমনটাই ভাবিস তুই। তাই তো!”

থামল সৈকত। ওকে ভীষণ উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে। চোখ রক্তলাল হয়ে গেছে। রাগে কপালের রগ ফুলে উঠেছে। ইতঃপূর্বে সৈকতকে এতটা অস্থির হতে দেখেনি রুবাব। সে চকিত চেয়ে রইল। সৈকত আবার বলে উঠল,
“মনে আছে তোর, আমাদের বন্ধুত্ব শুরু হবার কথা? আমার সাথে সবার আগে নাহিদের সাথে পরিচয় হয়েছিল। তার মাস দুয়েক বাদে অন্তরের সাথে ভাব হয়েছিল। তোর সাথে নাহিদ, অন্তরের ভাব হলেও আমার সাথে হয়নি। প্রথমদিকে আমি এড়িয়ে চলেছি। কারণ, আমার ধারণা ছিল তুই বড়োলোক বাপের ছেলে। আমার অবস্থান তোর মতো অত উঁচু নয়। তুই লেভেল বিচার করে হেয় করবি। বড়োলোকরা স্ট্যাটাস দেখে সবকিছু বিচার করে। তাদের মনের কোথাও একটা অহংকারের রেশ থাকে, যা সময়ে ভেসে উঠে। তারা মানসিকতা নয় টাকা দেখে মানুষ বিচার করে। নাহিদ অন্তর বার বার বলছিল, তুই ওমন নয়। আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু পরে যখন তুই ওদের মাধ্যমে সার্কেলে যোগ হলি, একসাথে চলতে চলতে আমি ধারণা বদলে গেছিল। তুই আসোলেই ওমন নয়। আমাদের মতোই সাধারণ। স্ট্যাটাস দেখে মানুষ বিচার করিস না। ধারণা বদলাবার পরই তোর সাথে আমি মন থেকে বন্ধুত্ব করেছিলাম।
এতবছর পর আজ মনে হচ্ছে সেদিন আমিই ঠিক ছিলাম। তুই ও তাদের দলেই। স্ট্যাটাস দেখে মানুষ বিচার করিস। অহংকারবোধ, আর হেয়জ্ঞানের একটা রেশ তোর মনে ছিল যা এখন বেরিয়ে এসেছে। আমি তোকে চিনি নি। চিনলে বোধহয় তোর সাথে বন্ধুত্ব করতাম না, তোর বোনকেও বিয়ে করার স্বপ্ন দেখতাম না। সত্যিই ভুল হয়ে গেছে আমার। স্যরি!”

সৈকত হনহন করে চলে যেতে উদ্যত হলো । দরজা অবধি গিয়ে থেমে গেল। ফিরে রক্তলাল চোখে চেয়ে প্রচন্ড কাতর স্বরে বলল,
“যদি তুই আমার স্ট্যাটাস দিয়ে আমাকে বিচার না করতি, তবে হয়তো দেখতি, তোর বোনকে আমার চেয়ে বেশি সুখে কেউ রাখতে পারতো না। আমার হয়তো তোদের মতো এত কুড়ি কুড়ি টাকা নেই, কিন্তু আমার ছোট্টো পরিসরের নিজস্ব একটা রাজ্য আছে, সেই রাজ্যে সব সুখ পাওয়া যায়। সেই সুখী রাজ্যের রাণী করে রাখতাম চন্দ্রকথাকে। কিন্তু আফসোস বন্ধু হয়েও তুই আমাকে বুঝলি না। ”

সৈকত আবারও পা চালালো। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না। তার আগেই রুবাব ধরে ফেলল। বন্ধুত্বের অধিকার নিয়ে এক হাত কাধে দিয়ে কঠোর সুরে বলল,
“শেষ তোর পলাশী যুদ্ধের কাহিনি শুনানো? শেষ হইলে এবার আমার কথা শুন। ”

সৈকত রুবাবের এত বছরের বন্ধুত্বে রাগের লেশমাত্র ছিল না। ঝগড়াঝাটি ও হয়নি। এই মুনকেন্দ্রিক ব্যাপারেই সব হচ্ছে। কখনো মনমালিন্য না করা বন্ধুত্বে আজ বাকবিতন্ডা ও হচ্ছে। সৈকত কখনো বন্ধুর সাথে ক্ষ্যাপাটে স্বরে কথা বলে নি। আজ বলছে। কাধ থেকে বন্ধুর হাত সরিয়ে বলল,
” যা শুনছি বুঝছি তাই হজম করতে পারছি না। নতুন কিছু শোনার এনার্জি নেই। সর। ”

রুবাব সরল না। আবার ধরে বলল, “আবে শা লা কথা তো শুনবি। পুরো কথা না শুনে রিয়েক্ট করতেছিস ক্যান!”

সৈকত রাগের মাঝেও প্রসঙ্গ ধরে প্রতিবাদ করল, “আমি তোর শা লা না। ”

রুবাব আকস্মিক হেসে ফেলল, “আচ্ছা যা, আমি তোর শা লা। ”

সৈকতের বিষন্ন চোখে বিস্ময়ের রেখা দেখা গেল। সে ভ্রু কুঁচকে চাইল। রুবাব ওর কাধ চাপড়ে বলল,
” চুপচাপ আমার কথা শুনবি। না বুঝে রিয়েক্ট করবি না। তুই যেটা বুঝছিস আমি সেটা মিন করিনি। আমি তোকে স্ট্যাটাস দিয়ে বিচার করিনি কখনো। আমি একবারও বলিনি, তোর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য তোর কাছে বোন বিয়ে দিব না। ভগ্নিপতি হিসেবে তুই আমার অপছন্দ সেটা একটাবারও বলিনি আমি। না বুঝে আজাইরা কথা প্যাঁচাইবি না।”

রুবাবের স্বর নরম হলো এইক্ষণে। আকস্মিক হাওয়া বদলে সৈকত চমকাল বেশ। দ্বিধান্বিত মনে বলল,
” তোকে আমি বুঝতে পারছি না রুবাব। বন্ধু হিসেবে আমি এতবছর ধরে চিনি, অথচ আজকাল তোকে আমার অচেনা লাগে। এই মনে হয় তুই আমার বন্ধু যে আমাকে সবচেয়ে ভালো বুঝে, তারপর আবার মনে হয়, তুই আমাকে বুঝা তো দূর চিনিসই না। তোর একেকবার একেক কথা। প্লিজ আশা দিস না আর! যা বলার ক্লিয়ার করে বল!”

রুবাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আগে আমি কেবল তোর বন্ধু ছিলাম। তোকে বন্ধু হিসেবেই বিচার করে এসেছি। কিন্তু এখন ভিন্ন চোখে দেখতে হচ্ছে। শুধু মাত্র বন্ধু নয়, আমি এখন মুনের ভাই। একজন মেয়ের ভাই। একটা ছেলের অভিভাবক হওয়া যত সহজ একটা মেয়ের অভিভাবক হওয়া ততটাই কঠিন। কতদিক হিসেব করে দেখতে হয়! মেয়েটা কার কাছে থাকবে, কতটা সিকিউর থাকবে তা দেখতে হয়। এই যে মুন আমার এত যত্ন আদরের বোন, আমি সবসময় চাইব এমন যত্ন আদরের একটা মানুষ হোক ওর। মেয়ের অভিভাবকদের আবেগ নয় বিবেক দিয়ে ভাবতে হয়। এই মুহুর্তে এসে আমি সাদাফ ভাইকে বুঝতে পারছি, আসোলে উনি ঠিক আছেন। এখন উনার আর আমার অবস্থা একই। আমরা শুধু একটা ছেলে নই, একটা মেয়ের ভাই। এটা কতটা কঠিন তুই ধারণা করতে পারবি না। তোর আমাকে অচেনা লাগছে কারণ, এখন তোর সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে তোর বন্ধু নয়, সে একটা মেয়ের ভাই। যার কাছ থেকে তুই তার জীবনের সবচেয়ে আদরের বোনটাকে নিতে চাচ্ছিস।”

সৈকত শূন্য চোখে চাইল। এই অনুভূতির সাথে পরিচিত নয় সে। ওর কোন বোন নেই। কাজিনমহলের সাথে সখ্যতা নেই বলে তাদের ভাই হয়ে ওঠা হয়ে উঠেনি। সৈকত রুবাবের কথার সার এখনো ধরতে পারছে না। রুবাবের আপত্তিটা কোথায়? সৈকতের চাহনিতে হাজার প্রশ্ন ভীড় করল। সেই প্রশ্নের উত্তর দিতেই রুবাব মুখ খুলল,
” এখন আমি তোর বন্ধু, মুনের ভাই দুটোরই ভূমিকা পালন করতে হবে। যেহেতু আমি তোর বন্ধু, তবে বাবা মায়ের কাছে প্রস্তাবটা আমাকেই রাখতে হবে। এবং মুনের ভাই হিসেবে বাবা মায়ের দিকটাও দেখতে হবে। এর আগে মুনের জন্য যত সমন্ধ এসেছে সবাই ওয়েল সেটেল্ড। ”

থেমে চোখ রাঙিয়ে বন্ধুর তখনকার উত্তর দিল, “ওয়েল সেটেল্ড মানে পেশাগত দিক থেকে ভালো পদে আছে, পার্মানেন্ট জব আছে। ফ্যামিলি বা বংশ না। ”

সৈকত ভ্রু উঁচাল, ” ও, আচ্ছা।”

রুবাব আবার বলা শুরু করল, ” ওসব সমন্ধ বাদ দিয়ে আমি তোর প্রস্তাব রাখব বাবা মায়ের কাছে। কিন্তু তার জন্য তো তোর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দরকার আছে। এখন তুই বেকার মানুষ। তোর চাকরি কবে হবে তার ঠিক নেই, এমতাবস্থায় বাবা মায়ের কাছে আমি তোর প্রস্তাব রাখব কী করে বল? বন্ধু হিসেবে আমি রাখতেই পারব, কিন্তু এখন ভাই হিসেবে বেকার যুবকের সমন্ধ বাবা মাকে শুনানো বেমানান না? বাবা মা কি মানবে বল?”

ধীর স্বরে বন্ধুকে বুঝানোর প্রয়াস করল রুবাব। সৈকত মনোযোগ দিয়ে শুনল বন্ধুর কথা। বেশ কিছুক্ষণ উত্তর দিল না। তারপর বলল,
“বিসিএসটা হয়ে গেলে চাকরি তো হয়ে যাবে।”

“যদি না হয়? তুই গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবি, ক্যাডারে নাম আসবে তোর?” সন্দিহান চোখে বলল রুবাব। সৈকতের চোখে আতঙ্ক দেখা গেল। রুবাব সে চাহনির বিপরীতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“আমি তোকে এখন মিথ্যা আশা দিলাম, যে হ্যাঁ আমি মুনের সাথে তোকে বিয়ে দিব। তুই আশা ধরে মুনের সাথে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লি। কিন্তু পরে যদি বাবা মা না মানে? মুনের আগের সমন্ধটায় তুই নিশ্চয়ই দেখেছিস আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেও মুনের বিয়ে ভাঙতে পারিনি। বাবা মা আমার কথা শুনেন নি। তোর চাকরি না হলে বেকার ছেলের সমন্ধ নিয়ে বাবা মায়ের সামনে গেলে বাবা মা মানবেন তার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারছি না। বন্ধু হিসেবে প্রস্তাব রাখতে পারব, কিন্তু ভাই হিসেবে পরিবার মানাতে পারব না বোধহয়। তাই আমি চাইছি না তোরা এখন সম্পর্কে জড়া। ”

অনিশ্চয়তার ভারে নুয়ে পড়ল সৈকতের চোয়ালে। গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো সে। চোখে ভয় দেখা গেল তার। বেকার প্রেমিকদের হেরে যাবার ঘটনা নতুন নয়। প্রেমিকার প্রতিষ্ঠিত পাত্রের কাছে বেকার প্রেমিক সবসময় হেরে এসেছে। সৈকত ও হেরে যাবে? চাপা শ্বাস ফেলল সৈকত। রুবাবের পানে চেয়ে গম্ভীর মুখে বলল,
“তুই সত্যিই কিছু করতে পারবি না?”

দৃঢ় স্বরে তড়িৎ জবাব দিল রুবাব, ” নিজেকে মুনের সুযোগ্য পাত্র হিসেবে উপস্থাপনের দায়িত্ব তোর। এখানে আমি কিছু করতে পারব না। তাই মিথ্যা আশা নিয়ে আমার বোনের জীবনে যাস না। ”

রুবাবের স্বরটা ভীষণ গম্ভীর। বোনের ভাই বলে কথা। সৈকত বলল, “আমি বিসিএস দিব ভালো করে। হয়ে যাবে।”

একজন পাত্রীর বড়োভাইয়ের মতো করে রুবাব গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমি কথায় নয়, ফলাফল বিশ্বাসী। আমি মিথ্যা আশ্বাস দেয়া বা নেয়া কোনটাই পছন্দ করি না। ”

যার অর্থ, আগে ক্যাডার হয়ে দেখা, তারপর কথা। রুবাবের ভাবভঙ্গি দেখে সৈকত ও গম্ভীর হলো,
” ঠিক আছে, আমি তবে সেটেল্ড হয়েই মুনের হাত চাইব। সেদিন কিন্তু ফেরাতে পারবি না। ”

রুবাব নিশ্চুপ রইল। সৈকত অসন্তোষ প্রকাশ করে বলল, “শা লা, আমি এটাই বুঝতে পারছি না, তুই আমার লাভ স্টোরির ভিলেন ক্যারেক্টারে আছিস না কি সাপোর্টিং রোলের ক্যারেক্টারে?”

“আপাতত ভিলেন ক্যারেক্টারেই ধরে নে। ” বলে হনহন করে চলে গেল রুবাব। ওর ওমন উদ্বুদ্ধ আচরণে রুষ্ট হলো সৈকত। সবকিছু সৈকতের উপর ছেড়ে দিল। নিজের কাধে কোন দায়িত্বই নেয়নি। সৈকতের ধারণা, রুবাব চাইলে মিথ্যা নয় সত্য আশাই দিতে পারতো। কিন্তু সে দিল না। সৈকত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উদাস হয়ে চেয়ে রইল আকাশের দিকে। মুনকে পেতে হলে বেকারত্ব ঘোচাতে হবে। বর্তমান চাকরির বাজারে চাকরি নয় সোনার হরিণ বিক্রি হয়। যা ভাগ্য জোটে না সবার। সৈকতের এ জুটবে না।
সামনে বিসিএস। বিগত সময়ে বিরহের অধ্যায় পড়তে গিয়ে পড়া হয়ে উঠেনি। হাতে আছে মাত্র ২৫দিন। এক কদিনে কী করে পড়া এগুবে! ভেবেই দিশেহারা সৈকত। তবে সেই উদাস মনে এক দৃঢ় সংকল্প করল, যে করেই হোক ওকে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে। মুনকে পেতেই হবে।

_____________________

রুমে থাকা নাহিদ অন্তরের দৃষ্টি অগোচর হয়নি ব্যাপারটা। দুই বন্ধুর প্রতিটি কথা কানে এসেছে তাদের। রুবাবের নির্বিকার ভাব আঘাত করল ওদেরও। সৈকতের মতো ওদেরও ধারণা রুবাব আশা দিতেই পারতো। সৈকতের অনুভূতি জানার পরেও মুন থেকে দূরে থাকার কথা বলা ঠিক হয়নি ওর। বন্ধুর প্রতি অসন্তোষ থেকেই রুমে আসতেই রুবাবকে চেপে ধরল অন্তর,
” তুই কি সত্যিই কিছু করতে পারবি না?”

রুবাব শান্ত স্বরে উত্তর দিল, “আমি কিছু করতে চাইছি না।”

“তুই একটু রুড হয়ে যাচ্ছিস? তুই মুনের ভাই হতে গিয়ে ভুলে যাচ্ছিস সৈকত তোর বন্ধু। সেই বন্ধু, যে তোর জন্য জান ও দিয়ে দিতে পারবে।” এই পর্যায়ে কঠিন হলো নাহিদের স্বর।

রুবাবের চোখে রাগ দেখা গেল। রাগত স্বরে বলল,
“তোরাও ভুলে যাচ্ছিস, আমরা তিনজনই নিজেদের চেয়ে সৈকতকে নিয়ে বেশি স্বপ্ন দেখেছি। আমরা বিশ্বাস করেছি, আমাদের সার্কেলে সবার আগে সফলতার গল্প সৈকত লিখবে। তোরা ভুললেও আমি ভুলছি না।”

রুবাবের কথায় ওরা চমকে গেল। দ্বিধায় পড়ল, রুবাব সৈকতের কথা ভেবে এমন করছে? নিজেকে ধাতস্থ করে নাহিদ বলল,
” তুই চাইতেছিসটা কি?”

রুবাব দৃঢ় স্বরে বলল, “আমি চাইতেছি, সৈকতকে নিয়ে আমরা যেই স্বপ্ন দেখেছি, যেই বিশ্বাস পুষেছি, সেই বিশ্বাস মিথ্যা না হোক। আমার বোনের জন্যও না। ”

” মুনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বললি কেন? ”

” সৈকতের যা অবস্থা, পারলে মুনকে নিয়ে সাত আসমানে উড়াল দিবে। তুই, আমি প্রেমের প্রথম অধ্যায় পাড়ি দিয়েছি, এ সময় পড়ায় কতটুকু মনোযোগ থাকে তা আমাদের কারো অজানা নয়। ” একরাশ বিরক্তি খেলে গেল রুবাবের চোয়ালে। বিরক্তিটা কার উপর বুঝা গেল না। সেই বিরক্তি নিয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে গেল রুবাব।

চারবন্ধুর মহলটায় সবচেয়ে দীপ্তি মেধার চরিত্র সৈকত। ওকে নিয়ে বাবার হাজার স্বপ্ন। সৈকতের বাবা শাহীন আলীর গর্ব সৈকত। সবার কাছে উঁচু গলায় গল্প করেন ছেলের। আমার ছেলে কদিন বাদে বিসিএস ক্যাডার হয়ে বেরুবে, আমার নাম উজ্জ্বল করবে। শাহীন আলীর চোখে মুখে এই স্বপ্নটা তিনবন্ধু অনেকবারই ঠাহর করেছে। একটা সময় বন্ধুর বাবার মতো বন্ধুকে নিয়ে স্বপ্ন বেঁধেছে তাদের বুকেও। তাদের নিজেদের মাঝেও বলাবলি চলতো, আমাদের কারো না হলেও সৈকতের প্রথমবারেই বিসিএস হয়ে যাবে দেখিস?
সৈকতের প্রখর মেধায় মুগ্ধ হয়ে ওদের মনে একটাই কথা আসতো, এই ছেলে জীবনে অনেক সফল হবে। ওদের বন্ধুদের মাঝে হিংসে নেই। বন্ধুর সফলতা নিরলস কামনা ওদের। বিগত এক বছর যাবত সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে পড়ে সৈকত। সেখানে বাকিরা পড়া ধরেছে ছ’মাস হলো। ঘুম ভেঙে টেবিলে বসা সৈকতের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকালে ওদের মনে একটাই দোয়া আসতো, ওদের না হলেও এই ছেলেটার প্রথমবারেই বিসিএস হয়ে যাক। সেই স্বপ্ন, সেই আশা, সেই বিশ্বাসের কথা এইক্ষণে স্মরণে এলো নাহিদ অন্তরের। পড়ালেখার প্রতি সৈকতের উদাসীনতা চোখে পড়েছে ওদেরও। এভাবে চললে সৈকত রিটেনেও টিকবে না।
রুবাবের ভাবনা ধরতে পারল ওরা, রুবাব চাইছে সৈকত একনিষ্ঠ মনে পড়ায় মনোযোগ দিক। আগের সেই গোল নিয়ে এগিয়ে যাক। মুনের সাথে সম্পর্কে গেলে মনোযোগ ভাটা পড়বে বলে সেটা হতে দিল। আর বিয়ে ভাঙার ভয় এ জন্যই দেখাল, যাতে সৈকত এবার মুনকে বিয়ে করার জন্য হলেও জানপ্রাণ দিয়ে বিসিএস দিতে পারে।

রুবাবের মনোভাব বোধগম্য হতেই পিলে চমকে গেল দুই বন্ধুর। বিস্ময় নিয়ে চাইল, নাহিদ অন্তরের দিকে। অন্তর হাসছে, সন্তুষ্টের হাসি। নাহিদ হেসে বলল,
” সৈকতের লাইফ স্টোরিতে সবচেয়ে ভালো সাপোর্টিং রোলটা বোধহয় রুবাবেরই।”

________________

টেবিলের এক কোণে বইয়ের উপর অবহেলায় পড়ে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট হচ্ছে অনবরত। বেজে কেটে যাচ্ছে, অথচ পাশে বসা সৈকতের খেয়ালটি নেই। খেয়াল নেই নাকি খেয়ালে রাখছে না কে জানে? তার সমস্ত খেয়াল বইয়ে ডুবে আছে। এক মনে পড়ছে। দিনের বাজে বেলা বারোটা। সকালের নাস্তা ও করা হয়নি। সেই ভোর পাঁচটায় বসেছে, তারপর আর উঠাউঠি হয়নি। চোখে মুখে তীব্র গম্ভীরতা। মনে দৃঢ় সংকল্প, প্রথমবারে বিসিএস তাকে টপকাতেই হবে। চাকরি পেলেই যে প্রেয়সীর আসবে তার মনে ঘরে। বিগত কটাদিন যোগাযোগ নেই মেয়েটার সাথে, নেই মেয়ের ভাইয়ের সাথেও। সেই দিনের পর থেকে ওর সব ধ্যান জ্ঞান লেগেছে পড়ায়। ভীষণ জেদ এসেছে, রুবাবকে দেখিয়ে দিবে সে।

এর মাঝে ফোনটা আবার বেজে কেটে গেল। সৈকত ভ্রুক্ষেপহীন। পাশের রুম থেকে অন্তর এসে দাঁড়াল দরজায় ,
“এই ব্যাটা তোর শা লা য় ফোন দিতাছে। ধর।”

পড়া থামিয়ে ক্ষোভ নিয়ে সৈকত উত্তর দিল, ” ওরে বলে দে, আমি যামু না ওগো বাড়ি। শা লা একদিন বাঁকা কথা শুনাবে, আরেকটা বাড়িতে ডাকবে। পাইছে টা কি আমারে?”

অন্তর ঠোঁট চেপে হেসে বলল, “শালার লগে কাইজ্জা কইরা লাভ নাই বন্ধু, তোমার চন্দ্র সূর্য শালার বাড়িতেই আছে। মনে রাইখ্যো।”

নাহিদ বাইরের পোশাক পরে তৈরি হয়ে এলো। তাড়া দিয়ে বলল, ” এই সৈকত তুই একসাথেই রেডি হ। জুমআ থেকে তো আবার শ্বশুরবাড়িতে যাবি।” ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি।

সৈকত চোখ রাঙাল, “কোথাও যাচ্ছি না আমি। তোরাই যা।”

আজ শেখ বাড়িতে দাওয়াত পড়েছে ওদের। সৈকত সুস্থ হওয়ার ছেলের বন্ধুদের এক বেলা খাওয়ানোর প্রয়াস তারিনার। শুক্রবার সবাই বাড়িতে দেখে এদিনই ডাকলেন। বাকি দুইবন্ধু রাজি হলেও সৈকত বেঁকে বসেছে। সে যাবে না। সকাল থেকে অনবরত ফোন দিচ্ছে রুবাব। কিন্তু সৈকতের এক কথা, সে যাবে না। এত চেষ্টার পরও নাহিদ অন্তর ওকে সাথে নিতে পারল না। অগত্যা ওরা দুজনই রওনা হলো। জুম’আর নামাজ পড়ে শেখ বাড়িতে যেতেই সৈকতকে না দেখে ক্ষেপে গেছে রুবাব। ফিরতি ফোন দিল, সৈকত তুলল না। ফোনে পাওয়া গেল না ওকে। তিনটে নাগাদ সৈকতের অপেক্ষায় রইল ওরা। সাড়ে তিনটে বাজে পাওয়া গেল ওকে। নাহিদের কল তুলেছে। ওকে লাঞ্চে যেতে বলতেই ঢেকুর তুলে বলল,
“আমি তো লাঞ্চ করে ফেলেছি। রুবাবকে বলে দে অন্য একদিন যাব।”

রাগে ক্ষোভে ফোঁসফোঁস করে উঠল রুবাব। পাশ থেকে বলে উঠল, “ওরে বলে দে, ও যদি আমার সাথে এমন বেয়াদবি করে বিসিএস টেস হয়ে গেলেও বোন বিয়ে দিব না।”

সৈকত ও ঝগড়াটে সুরে বলল, “বিসিএস হয়ে গেলে তুই না, তোর বাপ ও বিয়ে দেবে। ”

রুবাব বলল, “আমি দেখে নিব।”

” তোরে আমি দেখার সুযোগ ও দিব না। বোন একটা নিয়ে খুব উড়ছিস। দেখতেও দিচ্ছিস না। খালি একবার বিয়েটা হতে দে, তোর বোন নিয়েই আমি উড়াল দিব। বোনের দেখাও পাবি না, শা লা।” সৈকতের স্বরে বিরহ। মুনকে না দেখার আফসোস বেরুল যেন।

নাহিদ অন্তর ওদের তর্কে শব্দ করে হেসে ফেলল। রুবাব কিছু বলতে গিয়ে নিজেও হেসে ফেলল। এই সেম কথা সে তার শালাকে বলেছিল। এখন সৈকত তাকে বলছে। রাগ সরিয়ে বলল, “মা, বারবার জিজ্ঞেস করতেছে তোর কথা। সবাই তোর অপেক্ষা করছে। চলে আয় ভাই। শনি মঙ্গল বুধ গ্রহে পরে যাস।”

________________

শেখ বাড়ির বসার ঘরে বাবু হয়ে বসে রুবাবের বাবার সাথে কথা বলছে নাহিদ অন্তর। রুবাব ঘরে গেছে সবে। আকস্মিক কলিংবেল বেজে উঠল। শব্দে ওদের আড্ডায় ব্যাঘাত ঘটল। তখনই উপর থেকে নেমে আসতে দেখা গেল রুবাবকে। সে ডাকতে ডাকতে এলো,
“মুন মুন?”

মুন মায়ের সাথে রান্নাঘরে ছিল, ভাইয়ের ডাকে বেরিয়ে এলো, “জ্বি, ভাইয়া?”
“কে এসেছে দেখতো?”

মুন গেইট খুলতে গেল। রুবাব এসে বসল নাহিদের পাশে। নাহিদ ভ্রু কুঁচকে ধীরে বলল, ” মেয়েটাকে দিয়ে এত খাটাস কেন? দরজাটা নিজে গিয়ে খুললেই পারতি।”

রুবাব কথার উত্তর দিল না। চুপচাপ বাবার কথায় মনোযোগ দিল।

_____________

মুন ওড়নার আঁচলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে এগিয়ে গেল গেটের দিকে। সাথে জিজ্ঞেস করল, “কে?”

ওপাশ থেকে উত্তর এলো না। বিরক্তির রেশ টেনে দরজা খুলতে খুলতে বলল,
” পরিচয়টা তো দেয়াই যায় না কি! ”

কৈফিয়ত চাইবার ভানে দ্বার খুলে চাইল মুন। সম্মুখে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে আজও চমকাল। চমক দেখা গেল সামনের মানুষটার মুখেও। অবিশ্বাস্য চোখে চাইল এক পল। তারপর স্বভাবগত ভাবে হেসে ফেলল। তৃপ্ত স্বরে নিজ মনেই ডাকল,
“চন্দ্রকথা!”

চোয়ালে অপ্রতিভ ছোঁয়া লাগল মুনের। কপালের বিরক্তি সরে কোমল হলো। লাজুক হলো গাল। অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দরজা গিয়ে, না সরল আর না আসল।

সৈকতের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, আজ মুনকে ঘরবন্দী করে রাখবে রুবাব। সৈকতের মুখোমুখি হবার সব পথ বন্ধ করে দিবে। বাড়ি বয়ে এসে মুনের সাক্ষাৎ না নিয়ে ফিরলে কষ্ট হবে ভেবেই আসতে চাইছিল না। কিন্তু এ তো দেখা যাচ্ছে, মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। পথের শুরুতেই দেখা মিলল প্রেয়সীর। খুশিতে আন্দোলিত হলো সৈকতের ভেতরে বাহির সবটা। প্রসন্ন স্বরে বলল,
” পরিচয় ক্লিয়ার হলে দেয়া যায়। আমি আসোলে কনফিউজড, কোন পরিচয় দিব। আমি সৈকত না কি আমি এই বাডির একমাত্র কন্যার….

লজ্জায় কন্ঠরোধ হলো মুনের। ভাইয়ের বন্ধুটার কথাবার্তায় হঠাৎ এত পরিবর্তন এসেছে, যে শুনলেই গায়ে শিহরণ বয়ে যায়। কেমন একটা অনুভূতি হয়। লজ্জায় নুয়ে পড়ার জোগাড় হয়। পরের শব্দটা ঢের লজ্জার বলে মুন সম্পন্ন করতে দিল না। ধীর স্বরে বলল,
“আসুন!”

দরজা থেকে সরে গিয়ে হাঁটা ধরল মুন। স্পষ্ট পালানোর চেষ্টা। সৈকত হাসল। পিছু নিয়ে ডাকল মৃদু,
“চন্দ্রকথা, শুনো?”

বুকটা ধুক করে গেল ডাকটায়। কিভাবে ডাকে লোকটা! মুন সামনে গিয়ে দাঁড়াল, “হু?”

মুনের পাশে এসে দাঁড়াল সৈকত, “আমাকে মিস করছিলে না কি!”

তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না মুন। খানিক বাদে মাথা নাড়াল। যার অর্থ মিস করছে না। সৈকত ভ্রু নাড়িয়ে বলল,
” তবে ভার্সিটি গেইটে দাঁড়িয়ে ইতিউতি তাকিয়ে কাকো খুঁজো?”

মুনের বিষম খাবার জোগাড়। উনি তো আসেনি তবে দেখল কিভাবে! ওর চোখমুখ প্রশ্নবিদ্ধ হলো। তবে স্বীকার করল না, “আমি রিক্সা খুঁজছিলাম। ”

সৈকত শব্দ করে হেসে বলল, ” আমি অপজিটে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওদিকে তাকালেই দেখতে পেতে তোমার রিক্সা ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ”

টিপ্পনী কাটল সৈকত। মুন দ্রুত পা চালাল। এই ভয়ংকর কথার মানুষের সামনে থাকা যাবে না। সৈকত আবার ডাকল। প্রগাঢ় প্রেম নিয়ে আদুরে স্বরে,
“চন্দ্রকথা?”

ওই স্বর, ওই ডাকে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল মুনের। ডাকটা ভীষণ হৃদয়ছোঁয়া। হৃদস্পন্দন বেড়ে একাকার। অশান্ত হচ্ছে মন। অন্যরকম অনুভূতি হলো মুনের, ধরণটা ধরতে পারল না। চোখ বুঝে ক্ষীণ স্বরে বলল,
“প্লিজ এ নামে ডাকবেন না আমায়!”

কদম বাড়িয়ে মুনের সামনে এসে দাঁড়াল। মুখের কাছে মুখ এনে সেই প্রেমের মত্ত মাদকতা চড়ানো স্বরে বলল,
” আমাকে বিয়ে করে ফেলো তবে, বউ ডাকব।”

চলবে…..