অলীকডোরের চন্দ্রকথা পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
191

#অলীকডোরের চন্দ্রকথা। (পর্ব-১৬)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

গুণে গুণে আর সাতদিন বাদে বিসিএস রিটেন পরীক্ষা। চিন্তা, উৎকন্ঠা, চাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত পরীক্ষার্থীদের। এই ক্ষণে তাদের জীবনে নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, নেই আনন্দ, উচ্ছ্বাস, নেই বিশ্রাম, কিংবা ঘুম। আছে শুধু পড়া। সকাল, দুপুর, বিকেল রাত সর্বাক্ষণিক কেবল পড়ছে। পুবের বাসায় বসত করা চার ছেলের অবস্থা এখন এমনই। চার দেয়ালে কেবল চার বন্ধুর পড়ার গুঞ্জন। এক রুমে পড়ছে নাহিদ, অন্তর, আরেক রুমে পড়ছে রুবাব আর সৈকত। পড়ার চমৎকার পরিবেশ পেতে রুবাব এসে জুটেছে বন্ধুদের বাসায়। শেষ সময়ে এসে তাকেও ভীষণ সিরিয়াস দেখাচ্ছে। সবার মাঝে পড়ার গম্ভীরতা এত বেশি যে ওদের দেখাচ্ছে জঙ্গলিদের মতো। বিশেষ করে সৈকতকে। পড়ার চাপে সেলুনের দরজা মাড়ানো হয়না অনেকদিন। মাথা ভরতি চুল আর গাল ভরতি দাঁড়ি গোঁফ বেড়ে একাকার। রাত জেগে পড়বার কারণে চোখের নিচে কালি পড়েছে। নাওয়া খাওয়ার অনিয়মে চোয়ালে ভেঙে গেছে। চোখ কোটরে ডেবেছে আরও। সে কী বিধ্বস্ত অবস্থা!

পড়তে পড়তে ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছে শরীর। আবার টেনে তুলছে। এক কাপ চা খাচ্ছে, নড়ে ওঠে পড়ায় মন দিচ্ছে। মনে দৃঢ় সংকল্প। ঘড়ির কাটায় তখন সকাল ন’টা। সেই রাত এগারোটা থেকে পড়ছে। মাঝে ফজরের নামাজের বিরতি নিয়েছে কেবল। আর ওঠা হয়নি। পড়তে পড়তে হাঁপিয়ে উঠছে। মন অশান্ত হয়ে গেছে, কিসের যেন শূন্যতা টের পেল। শরীরে যেন আর এনার্জি নেই। সব একঘেয়ে লাগছে। বিরক্ত লাগছে, অসহ্য লাগছে। বিষিয়ে উঠল সে। কপাল কুঁচকে থম ধরে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আকস্মিক উঠে পড়ল। পা বাড়াল দরজার দিকে।

সারারাত পড়ে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলাতে গেছে রুবাব। দু’তিন ঘন্টার একটা বিশ্রাম না নিলেই নয়। বন্ধুকে ওমন দ্রুত পায়ে বেরুতে দেখে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে বলল,
“কী হইছে? যাস কই?”

প্রশ্নটা সৈকতকে একটা ধাক্কা দিল কি? বুক কাঁপল কি? মনে হলো কি শর্তের কথা? হয়তো বা। সে থেমে গেল কয়েক মুহুর্তের জন্য। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে সমস্ত চিন্তা দূর করে দিল। একটা দায়সারা ভাব নিয়ে বলল,
” শরীর মনে এনার্জি পাইতেছি না। নিয়া আসি।”

হাঁটা ধরল সৈকত। না ভেবে রুবাব বলল, “তুই কি এখন গ্লুকোজ খাওয়া শুরু করবি!”

সৈকত বিড়বিড় করল, ‘অত ভাগ্য আছে আমার।! দু’পলক দেখার জন্যই কত কসরত! ”

বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। ও রুম ছাড়তেই রুবাবের বোধগম্য হলো বোধহয়। বুঝেও বাঁধা দেবার ইচ্ছেটি হলো না। সেদিনে শর্ত জুড়ে দেবার পর থেকে সৈকত পাহাড়সম চাপ নিয়ে পড়ছে। দিনরাত পাগলের মতো পড়ে যাচ্ছে। যে ছেলে তার বোনকে বিয়ে করবার জন্য এত কষ্ট করতে পারে, সেই ছেলে এক আধটু ছাড় দেয়াই যায়। রুবাব পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল,
” এই পাগলের বেশে যাইতাছস কেন? মাইনসে ডরাইব।”

সৈকত ততক্ষণে দৃষ্টিসীমার বাইরে। সাত পাঁচের বালাই না করে পৌঁছাল গন্তব্যে। তারপর বসল অপেক্ষায়।

সাত সকালে বাউণ্ডুলে বেশে ভার্সিটি গেইটে দাঁড়ানো ছেলেটাকে দেখে ছাত্র কিংবা পথচারীরা ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছিল। পরনে থ্রি-কোয়ার্টার, গায়ে পাতলা কালো টি-শার্ট। এলোমেলো উসকোখুসকো চুল, দাঁড়ি গোঁফ , চোখের নিচে দাগে ভরা কেমন পাগলাটে লাগছিল দেখতে। সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই ছেলেটির। সে মত্ত অপেক্ষাতে। আসবার কালে ঘড়িও আনা হয়নি, কটা বাজে কে জানে। কাঙ্খিত মানুষটা এ পথ পেরিয়ে গেছে কি না তাও জানা নেই। ফোন ও নেই সাথে। খোঁজ বলতে ওই চোখের চাহনিটাই।

কয়েকজন মেয়ে ওর পাশ কাটতে চাইল না ভয়ে, কেমন বখাটে দেখতে ছেলেটা। যদি টিজ করে! এই ছেলেটার নিন্দে করতে করতে আসছিল মেয়ের দলটা। তাদের পেছনে দেখা গেল কাঙ্খিত মুখখানা। মেয়েটা অবশ্য ভয় পেল না। বখাটের পানে না চেয়ে নির্বিকার পাশ কাটতে চাইল। কিছু পরাস্থ হলো। পাশ কাটবার সময় মৃদু ডাক এলো কানে,
“হেই! শুনো!”

চট করে তাকাল মুন। তৎক্ষনাৎ চিনল না। সম্মুখের মানুষটার চাল চলনের এত অধঃপতন হলো যে চেনার উপায় নেই। এত বড় চুল দাঁড়িতে অন্তত কখনো দেখিনি সে। তীক্ষ্ম চোখে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল। চেনবার চেষ্টা। তখনই আগন্তুক মৃদুস্বরে ডাকল,
” কেমন আছো, চন্দ্রকথা?”

হৃদগ্রাহী ডাকটা কর্ণকুহরে পৌঁছবার পরে আর অচেনা রইল না কিছুই। সব চেনা হলো, জানা হলো। হৃদপিণ্ড ছলাৎ ছলাৎ কেঁপে উঠল। মন কেমনের হাওয়া ছুঁলো। চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। সে বিস্মিত চোখে চেয়ে রইল, ‘এটা সেই মানুষটা!’

অনুভূতি প্রকাশের পর মুন চোখে চোখ রাখে না। এই প্রথমবার চাইল ছেলেটার পানে। সেই চাহনির শেষ হচ্ছে না। ওকে ওমন দেখতে দেখে ছেলেটা চাপা হেসে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন! বেশি সুন্দর লাগছে আমাকে?”

সুন্দর না পাগল লাগছে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো পাগল।
মুনের ইচ্ছে হলো উত্তরখানা দেবার। কিন্তু সে দিতে পারল না। কেবল চাপা উদ্বেগ প্রকাশ করে মুন বলে বসল,
“এ অবস্থা কেন আপনার?”

নিজের অবস্থা সম্পর্কে অনবগত সৈকত। কদিন আয়না ও দেখা হয়নি। সেই ভ্রু কুঁচকাল,
“কী অবস্থা? ”

ওর পাগলাটে অবস্থার বর্ণনা দিল না মুন। কেবল ঠোঁট চেপে হাসল। তারপর বলল,
“কিছু না ভাইয়া।”

তড়িৎ প্রতিবাদ করে উঠল সৈকত, “ভাইয়া ডাকবে না, একদম।”

মুন মজা পেল যেন। প্রশস্ত হেসে বলল, “আচ্ছা ভাইয়া।”

সৈকত আটকে গেল হঠাৎ। কথায় নয় ওই হাসিতে। মুনের প্রাণবন্ত হাসিতে মুক্ত ঝরছে যেন, সেই মুক্তো গিয়ে ঠেকছে তার বুকে। চোখে ভর করল মুগ্ধতা। সৈকত ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে রইল। ওর বুক কাঁপছে। মস্তিষ্কের সকল ভাবনা এলোমেলো হয়ে উঠেছে। ওই হাসিতে নিজের সর্বনাশ দেখতে পেল সৈকত।
বড্ড আফসোস নিয়ে সৈকত বলে উঠল,
” উফফ, চন্দ্রকথা! তুমি তো আমাকে পাগল করে দিবে দেখছি! কবে যে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসব!”

মুন হাসছিল। আকস্মিক হাসি থেমে গেল। ভেতরটা শিউরে উঠল। গাল লাল হলো। লোকটা কিভাবে কথা বলে! মনে লাগে একদম। মুন সৈকতের দিকে তাকাল এক পলক। সেই চাহনির গভীরতা ওর ভেতর বাহির সবটা কাঁপিয়ে তুলল। মুন আড়ষ্ট হলো।

মুনের লজ্জামাখা মুখখানা দেখে সৈকতের মাথা ফাঁকা হয়ে গেল। সারারাত জেগে যেসব পড়েছে, সব যেন ভুলে বসেছে। সৈকত নিশ্চিত, এখন ফিরে বইয়ে মনোযোগ বসবে না ওর। ওর মনোযোগ ঘিরে থাকবে এই মেয়ে। চোখে ভাসতে থাকবে এই হাসি, এই লজ্জা। এনার্জি নিতে গিয়ে বিপদ ডাকল না তো! সৈকত ধীরে বলল,
“পরীক্ষার মাঝে তুমি সামনে এসো না প্লিজ! তোমার খেয়াল আমার পড়াশোনার মনোযোগ এলোমেলো করে দিচ্ছে।”

লজ্জা কাটিয়ে বিস্ময়ের রাজ্যে পা রাখল মুন। সে হতভম্ব। তার ভার্সিটি বয়ে এসে, তার জন্য গেইটে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে, তাকে খুঁজে বের করে এখন বলছে, সামনে এসো না! মুন বিস্ময় নিয়ে বলল,
“আমি এসেছি সামনে?”

সে কথার উত্তর দিল না সৈকত। উদ্ভ্রান্তের মতো বলল, “পড়াশোনায় প্রেশারে আমার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে, জানো? সকাল থেকে ভীষণ মিস করছিলাম তোমায়। মনে হচ্ছিল, না দেখলে আমি মা রা টারা যাব। এখন তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, জীবিত থাকলে ও অন্য কিছুতে মন বসবে না। কদিন বাদে পরীক্ষা, আমাকে পড়তে হবে, কিন্তু খেয়ালে তুমি বসে আছো। পড়তে গেলে তুমি আসছো সামনে। কী যে হচ্ছে আমার!” বড্ড ব্যাকুল হয়ে বলল সৈকত।

খেয়াল শুধু সৈকতের নয়, এই ক্ষণে এলোমেলো হলো মুনের ও। নিজের জন্য সম্মুখে দাঁড়ানো মানুষটার অনুভূতির সরল স্বীকারোক্তি ওকে ঠিক থাকতে দিচ্ছে না। ক্ষণে ক্ষণে বুঝাচ্ছে, সে কতটা জুড়ে আছে মানুষটার। এই ক্ষণে সৈকতকে বড্ড কাতর দেখাচ্ছে। দেখতে কেমন রুগ্ন লাগছে, খাওয়া দাওয়া করেনা বোধহয়। পড়াশোনার চাপে নিজের খেয়াল ও রাখতে পারছে না। এই ক্ষণে প্রথম ভীষণ মায়া জন্মাল সৈকতের প্রতি। না চাইতেও তার যত্নস্বর ভেসে উঠল,
” নিজের কী হাল হয়েছে, দেখেছেন! এত প্রেশার নিলে তো পরীক্ষায় বসার আগে অসুস্থ হয়ে যাবেন। ”

মুনের সামান্য যত্নময় কথায় এক সমুদ্র সমান খুশি হলো সৈকত। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। উৎফুল্ল স্বরে বলল, “আমার জন্য চিন্তা হচ্ছে তোমার?”

মুন উত্তর দিল না, অন্যদিকে চাইল। সৈকত ঠোঁট কামড়ে হাসল। মুনের পানে চেয়ে কোমল স্বরে বলল,
” তোমার এই যত্ন, হাসি, লজ্জামাখা মুখ প্রতিদিন দেখতে হলে পরীক্ষার এক আধটু প্রেশার নিতেই হবে। তোমাকে পেতে হলে ক্যাডার হতেই হবে। না হলে যে পাওয়া হবে না তোমায়।”

মুনের মনে হয় সৈকত যাদু জানে, কথার যাদু। যে যাদু ওকে ক্ষণে ক্ষণে বশ করে। ভালো লাগার জন্ম নিচ্ছে। সৈকতের প্রেম নিবেদন সুন্দর, হৃদয়ছোঁয়া। ওমন নিবেদনের পর শক্ত থাকা যায় না, কোমল হতে হয়। হয়ে যায় নিজের অজান্তে। মুন মনকে বাঁধেনি, শাসায় নি। মন তার আপনাআপনি ঝুঁকে যাচ্ছে মানুষটার প্রতি।
সৈকতের ওমন প্রেম মাখা কথার পর কথা খুঁজে পেল না মুন। তবে একটা প্রশ্ন ঠিক উদয় হলো, যে পরীক্ষার সাথে ওর কী সম্পর্ক! প্রশ্নটা করতে গিয়েও করল না। তবুও তার না বলা প্রশ্ন বুঝে নিল সৈকত। উত্তরটা সেই দিল,
” তোমার ভাই বেকার পাত্রের হাতে বোন বিয়ে দিবে না। শর্ত দিয়েছে, বিসিএস হলেই বিয়ের কথা আগাবে, নয়তো না। এখন আমি আটকা পড়েছি তোমাতে আর তুমি আটকা পড়েছো আমার বিসিএসে। ”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৈকত। ওর স্বরে দুঃখের জোয়ার বয়ে গেল। সৈকতের তীব্র আকুলতা ছুঁয়ে দিল মুনকেও। বিস্ময়ের পারত বাড়ল, সৈকতকে দেখে যে কেউ বলবে এই ছেলের জীবনে বড়কোন ঝড় ভয়ে যাচ্ছে। দু’দণ্ড শান্তি নেই। খুব প্রেশার যাচ্ছে। সৈকতের এই ঝড়, এত প্রেশার তবে তার জন্য! তাকে পাবার জন্য সৈকত এমন পাগলপারা হয়ে পড়ছে!

সৈকতের ওমন কষ্টমাখা মুখ দেখে চেহারা ফ্যাকাসে হলো মুনের। বরাবরই কোমলমতি মন তার। অল্পতেই মন খারাপ হয়। অন্যের কষ্ট দেখলে কান্না পায়। এই ক্ষণে ওর ভীষণ মন খারাপ হলো।

সৈকত গভীর মনোযোগ দিয়ে ওকেই দেখছিল। মুনের চেহারার বদল চোখ এড়াল না। সুক্ষ্মভাবে পরখ করল। ওর আকুলতায় মুনের চেহারায় বিরক্তির লেশ খুঁজে বেড়াল, পেল না। বরং তার পরিবর্তে মলিনতা পেল। সেটা সহানুভূতি নয়, অনুভূতির লেশ। তা দেখে সৈকতের চোখ মুখে আনন্দ ঝিলিক দিল। চমৎকার হাসল সে। প্রফুল্ল স্বরে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
” চিন্তা করো না, হয়ে যাবে। ”

মুন অন্যমনস্ক ছিল। কথা না বুঝে প্রশ্ন করল, “কী হবে?”

সৈকত হেসে বলল, “বিসিএস, বিয়ে দুটোই হবে। আমি বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছি, তুমি ভালোবাসার প্রস্তুতি নাও। ”

মুনের চোয়ালে মিইয়ে আসা লজ্জা আর জিইয়ে উঠল। না সে দ্বিরুক্তি করল, আর না সায় দিল। সে কেবল নিশ্চুপ রইল। চোখ ঘুরিয়ে চাইল অন্যদিকে। ওর লজ্জা দেখে সৈকতের হাসির ঢেউ দেখা গেল চোখে মুখে। ওই ক্ষণে ওকে লাগছে সবচেয়ে সুখী, সবচেয়ে মুগ্ধমেয় মানব। প্রাণবন্ত স্বরে সৈকত বলল,

“আমি তো এখনো প্রেমের প্রস্তাব দিই নি, বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাই নি। বিয়ে করিনি, সংসার করিনি। বিয়ের রাতে তোমার মাথার লম্বা ঘোমটা তুলে ভালোবাসি ও বলিনি। কিছুই তো করিনি। এখনই লজ্জা পেলে পরে কী করবে চন্দ্রকথা?”

লাজুক স্বভাবি চন্দ্রকথার যেন ক্ষণে ক্ষণে মরণ হচ্ছে সম্মুখের পুরুষটির কথাবাণে। লজ্জায় চোখমুখ রক্তাভ হয়ে গেছে। আড়ষ্টতায় পালাবার মনস্থির করল আজও। ক্ষীণ স্বরে বলল,
” ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসি।”

বিদায় দেবার পরিবর্তে কৌতুকের স্বরে বলল,
“পালাচ্ছো?”

মুন পা বাড়াল। সৈকত পেছন থেকে বলল, ” পরীক্ষার আগে দেখা হবে না আর। নিজের খেয়াল রেখো। আর পারলে আমার জন্য দোয়া কোরো।”

মুন কয়েক পা এগিয়ে গেল। সৈকত তাকিয়ে রইল ওর যাবার পানে। সৈকতের তাকিয়ে থাকবার মাঝেই মুন থেমে গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। ওর মাঝে যেন দ্বিধার পাহাড়। ফিরবে কি ফিরবে না। সৈকত প্রসন্ন মনে ওকেই দেখছে। বুঝার চেষ্টা করছে মুনের হাবভাব। সে পূর্বের জায়গায় অনড় রইল। মুন দ্বিধা কাটিয়ে হেঁটে এলো। সৈকতের দিকটায় এসে দাঁড়াল। চাইল না ওর দিকে। নিচের দিকে তাকিয়ে ওড়নার কোণ মোড়াচ্ছিল হাতে। ওর নত মুখে লজ্জা দ্বিধা মিশে একাকার। কিছু বলতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। সৈকত কৌতুহলী হয়ে বলল,
“কিছু বলবে?”

মুন মাথা নাড়াল। যার অর্থ হ্যাঁ। সৈকত আগ্রহী গলায় বলল, “বলো!”

মুন বলতে পারল না। আড়ষ্টভাবে থমকে রইল। সৈকত ওকে সহজ করার জন্য আদুরে সুরে বলল,
” আমিই তো। এত লজ্জা কিসের? যা বলার নির্দ্বিধায় বলো।”

মুন তৎক্ষনাৎ বলল না। অনেকক্ষণ নিশ্চুপ রইল। তারপর সামনের দিকে ঘুরে গেল। সৈকতের দিকে পিঠ করে ঘুরে ধীরে বলল,
” যে ভাগ্যে থাকে, সব ঘুরে ফিরে অসম্ভব দিক মাড়িয়েও জীবনে আসবে। আমি আপনার ভাগ্যে থাকলে বিসিএস না হলেও আপনার জীবনে যাব। তাই এত প্রেশার নিবেন না, অসুস্থ হয়ে যাবেন। কেউ আমার জন্য কষ্ট পেয়ে গেলে আমার খারাপ লাগবে। এত প্রেশার নিবেন না। নিজের খেয়াল রাখবেন আর যাবার সময় সেলুন থেকে ঘুরে যাবেন।”

এক নিশ্বাসে বলে দম নিল। চোখের পলক ফেলবার আগেই পালাল। সৈকত কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব সে। মুন থেকে এমন কথা আশা করে নি ও। মেয়েটা রীতিমতো ওর চিন্তায় অস্থির! বাচ্চা মেয়েটা এসে ওকে সাহস দিয়ে গেল, আশ্বাস দিয়ে গেল। পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে গেল নিজের সদ্য জন্মানো অনুভূতি ও।

চলবে………

#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব- ১৭)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

সূর্যের প্রজ্জ্বলিত দীপ্তি তখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা শহরে। সেই দৃপ্ততা গায়ে মাখিয়ে চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে সৈকত। চোখে মুখে তীব্র প্রশান্তি, ঠোঁটের কোণে হাসির লেশ। সুখ সুখ মুখে কলিংবেল চাপল। দরজা খুলল খানিক বাদেই। দরজায় দাঁড়ানো রুবাব ওর পানে চাইল ভ্রু কুঁচকে। তারপর প্রশ্ন করল,
“আপনাকে তো চিনলাম না, ব্রাদার। ”

সৈকতকে অবাক হতে দেখা গেল না। বরং সে হেসে উঠল। প্রাণবন্ত হেসে হাত বাড়াল, ‘ হ্যালো, আমি সাফায়েত আহমেদ সৈকত। বিসিএস ক্যান্ডিডেট। সেই সাথে আপনার ভগ্নিপতি পদপ্রার্থী।”

সৈকতের ভাবখানা এমন, যে সে ইতিপূর্বে রুবাবকে দেখেনি, আজই দেখছে। প্রথম পরিচয় হচ্ছে। স্বরে সৌজন্যতাবোধে।
রুবাব বিস্মিত চোখে পরখ করছে ওকে। যাবার কালে পাগলের বেশ ধরা ছেলেটার মাঝে একটু সময়ে যেন আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। সেই ক্ষণের ক্লান্ত, পাগলাটে, বিধ্বস্ত ভাব দেখা নেই এই ক্ষণে। তার পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে এক পরিপাটি সুখী ভাব। মাথা ভরতি উসকোখুসকো চুল এখন মসৃণরূপে গোছানো। কদিনের অবহেলায় বেড়ে ওঠা দাঁড়ি গোঁফে ট্রিমার উঠেছে, সুন্দর এক মাপকাঠিতে সেজেছে। সকালবেলার ক্লান্ত মুখখানায় এখন রাজ্যের দীপ্ততা, খুশিতে উপচে পড়ছে চোখমুখ। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখে। বাহিরের রোদ্দুরের মতো সৈকতের চেহারাও জ্বলজ্বল করছে। তাপে নয়, কোমলতায়, খুশিতে, প্রশান্তিতে।
রুবাব অন্তর্ভেদী চোখে বন্ধুর খুশি দেখছে। যেই ছেলে গেল দিন দশেক যাবত পড়ালেখা প্রেশারে হাসতে ভুলে গেছে, খেতে ভুলে গেছে। গতকাল রুবাব সেলুনে যাবার সময় ডাকল ওকে, তোর চেহারার অবস্থা বেহাল। চল।
তখন সৈকত ব্যস্তভঙিতে উত্তর দিল, ” এখন এত আমোদ করার মুড নেই। প্রচুর পড়া বাকি। ”

এত করে বলার পর ও গেল না। এখন কী এমন হলো যে সৈকত আমোদে মেতেছে, নিজ থেকেই সেলুনে গিয়েছে। হাসতে ভুলে যাওয়া ছেলেটা প্রাণবন্ত হাসছে। প্রশান্তিতে ভাসছে বুক। রুবাবের অনুসন্ধানী চাহনি দেখে সৈকত বলল,
“এমন করিয়া চাহিয়া দেখিবেন না। আমি ইতিপূর্বেই অবগত করিয়াছি যে, আমার আসক্তি কেবলই এক নারীতে। কোন পুরুষে নহে। ”

রুবাব বাস্তবে ফিরল যেন। ভ্রু কুঁচকে বলল, ” আমারে পাগলে পায় নাই তোরতে আসক্ত হবো। দেখতাছি তোমার কাহিনি। সক্কাল সক্কাল পাগল হইয়্যা বের হইলা, অহন দেহি এক্কেবারে সাইজ্জা গুইজ্জা হাজির হইছো। কাহিনি কী, মামা?”

সৈকত চমৎকার হাসল। সৈকতের হাসি সুন্দর। বিগতে দিনে দাঁড়ি গোঁফে আড়াল হওয়া হাসির সৌন্দর্য এই ক্ষণে ফুটে উঠল। সুন্দর সুদর্শন ঠেকল ওকে। রুবাবের টিপ্পনীর মাঝে অন্তর এসে হাজির হলো। সৈকতকে দেখে চোখ কপালে তুলে বলল,
“আরেব্বাস! সমুদ্র দেখি ঢেউ খেলাচ্ছে। কাল এতবার বললাম, সেলুনে চল। গেলি না। বললি সময় নেই। হঠাৎ কী এমন হলো যে, এক্কেবারে সক্কাল সক্কাল বলা কওয়া ছাড়া সেলুনে থেকে বেশভূষা বদলায় আসসোস? কাহিনি কী?”

এই সকালে কী হলো, তা ভাবতেই সৈকতের হাসির রেশ বাড়ল। চোখ মুখের প্রশান্তির মাত্রা গাঢ় হলো। উত্তর দেবার ইচ্ছেতে বন্ধুর পানে চাইতেই পাশে দাঁড়ানো রুবাবের সন্দেহী নজরে নজর আটকাল। আকস্মিক কেন যেন আড়ষ্টতা ঝেঁকে বসল সৈকতের মাঝে। সে কিছু বলতে পারল না। অন্যদিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাল। তারপর হাঁটা ধরল। অন্তর বন্ধুর দিকে চেয়ে রইল বিস্মিত চোখে। সৈকত লজ্জা পেল! এই ছেলে লজ্জা ও পায়! অবাক স্বরে বলল,
“তুই লজ্জা ও পাচ্ছিস দেখি। এই দিনের আকাশে চাঁদ উঠে গেছে না কি!”

সৈকত থামল না, পিছু ফিরে চাইল না। কেবল হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিল, ” চাঁদ দিনের আকাশে উঠেনি। চাঁদ ওঠেছে আমার আকাশে, আমার হয়ে।”

সৈকত রুমে ঢুকে গেল। দুই বন্ধু হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। দুজনের বুঝতে বাকি নেই, সৈকতের এমন পরিবর্তনের কারণ মুন। হাসতে ভুলে যাওয়া ছেলেটার মুখে হাসি ফুটিয়েছে মুন। সে কী করেছে? চাঁদ উঠেছে মানে কী বুঝিয়েছে সৈকত? মুন ও! দুই তরফা হয়ে গেল! আনন্দে অন্তর চেঁচিয়ে উঠল,
“সত্যিই তোর আকাশে চাঁদ উঠে গেছে?”

প্রগাঢ় সন্তোষের সুরে সৈকত বলল, হেসে, ” তাই তো দেখে এলাম।”

_____________________

দুদিন পরের কথা।

ঘড়ির কাটায় সময় তখন দুপুর ১২টা বেজে ৫৬ মিনিট। আজকের দুটো ক্লাস শেষে ভার্সিটি চত্বরের বাইরে পা রাখল মুন। প্রচন্ড গরম পড়ছে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে এলো। পেটে ক্ষিধের তোড়জোড় ও বেশ। এদিকে বান্ধবীরা সব আজ কাছছাড়া। একাই ফিরতে হবে বাসায়। এইক্ষণে বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না মুনের। বাবা এখন অফিসে, মা গেছেন খালার বাসায়। একলা বাসায় ফিরবার ইচ্ছেটি হচ্ছে না। পড়ালেখার অজুহাতে আজ কয়েকদিন রুবাব সৈকতদের ফ্ল্যাটে। সকালে সৈকতের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে ভাইয়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে। না জানি তার ভাইটা কেমন আছে। কতদিন ওরা একসাথে লাঞ্চ করে না। যেন সহস্র বছর পেরিয়ে গেছে। হুট করেই ভাইয়ের জন্য মন উতলা হলো মুনের। দেখতে ইচ্ছে হলো। অস্থির মনে নাম্বার ঘুরাল। রিসিভ হতেই আহ্লাদী সুরে বলল,
“আমার ভার্সিটির দিকে আসবে, ভাইয়া?”

বোনের এহেন আবদারে উদ্ধিগ্ন হলো রুবাব, “কী হয়েছে মুন? কোন সমস্যা? ”
মুন কোমল সুরে বলল, ” কিছু হয়নি। এমনি, তোমাকে ভীষণ মিস করছি। মনে হচ্ছে তোমার চেহারাও ভুলে গেছি।”

রুবাবের কপালের ভাঁজ মিলাল। প্রসন্নতা দেখা গেল। কোমল সুরে বলল, “পাঁচ মিনিট সময় দে। আসছি।”

রুবাব তড়িঘড়ি করেই এলো। ভাইকে দেখে আবেগে আপ্লূত হয়ে গেল মুন। রুবাবের চেহারাও বিশেষ একটা সুবিধার না। আগে থেকে বেশ শুকিয়ে গেছে। মুন মলিন স্বরে বলল, ” ভাইয়া, তুমি তো অনেক শুকিয়ে গেছ! নিজের যত্ন নাও না?”

রুবাব হেসে কথা ঘুরাল, ” কেমন আছে আমার বোনটা?”
মুন বিষন্ন সুরে বলল, ” ভালো নেই। তুমি নেই, বাসায় ভালো লাগে না । কবে ফিরবে, ভাইয়া?’

রুবাব আবার হাসল, ” রিটেন শেষ হলেই ফিরব। লাঞ্চ করেছিস?”

মুন সরল মনে বলল, ” তোমার সাথে লাঞ্চ করব বলে করা হয়নি। কতদিন আমাদের একসাথে লাঞ্চ করা হয়না!”

বোনের ভালোবাসায় মুখে প্রশান্তির ছাপ পড়ল রুবাবের। মুন ভাইকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় বসল। ভাইয়ের পছন্দের খাবার অর্ডার করল, পরিমাণে বেশি অর্ডার দিল। রুবাব হকচকিয়ে বলল,
“এত খাবার কে খাবে?”

মুন মা মা ভাব নিয়ে ভাইকে শাসাল, “সব তুমি খেয়ে শেষ করবে। নিজের চেহারা দেখেছো? অসুস্থ লাগছে তোমায়। খাওয়া নিয়ে কোন হেলাফেলা করবে না। ঠিকমতো খাবে। তাহলে পড়ার এনার্জি পাবে।”

রুবাব উত্তর দিল না। শান্ত চোখে বোনের কান্ড দেখছে। ওর ভালো লাগছে দেখতে। কদিনের ক্লান্তি সব যেন ঝরে পড়েছে। মুনকে বেশ প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে। বুঝা যাচ্ছে ভীষণ খুশি আজ সে। কারণটা কি সৈকত? অবচেতন মনে প্রশ্ন জাগল। জিজ্ঞেস করল না। কেবল বোনের গতিবিধি লক্ষ করল।

খাবার আসার পর খাবার মুখে তুলবার সময়ে আকস্মিক উদাস হয়ে গেল মুন। অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবতে লাগল। রুবাব ভ্রু কুঁচকাল,
“কী ভাবছিস?”
নড়েচড়ে বসল মুন, “কিছু না। ”

“খাওয়া শুরু কর। ”

মুন এক স্পুন মুখে নিল। খাবার যেন গলা দিয়ে নামছে না। কত চিন্তা এসে দৌড়াচ্ছে মাথায়। রুবাব আবার প্রশ্ন করল, “মুন? কী হয়েছে তোর? কী নিয়ে এত চিন্তা করছিস , বল আমায়!”

মুন আনমনে উত্তর দিল, ” আমার কিছু হয়নি। কিন্তু তোমাদের এমন শুকনো মুখ দেখতে ভালো লাগছে না আমার।”

আবার উদাস হলো মুন। নিজের কথার খেয়ালটি নেই তার। বেফাঁস যে ‘তোমার’ স্থানে ‘তোমাদের’ বলে ফেলেছে তা নিজে ধরতে পারেনি। তবে সম্মুখে বসা তার বিচক্ষণ ভাই ঠিকই ধরে ফেলল। সম্বোধন, সম্বোধনের পেছনকার মানুষ এবং মুনের উদাসীনতার কারণ সব স্পষ্ট বোধগম্য হলো তার। স্মরণে এলো, সৈকতের বলা কথা, ‘চাঁদ উঠেছে আমার কাছে, আমার হয়ে’।
সৈকতের পরিপাটি দেহভাব, চোয়ালের আনন্দভাবের সাথে মিলাল মুনের এই ক্ষণের উদাস ভাব, কপালের ভাঁজের চিন্তা। দুটো যেন এক সূত্রে গাঁথা। অনুভূতি তবে সৈকত হয়ে মুন অবধি পৌঁছে গেছে! রুবাবের চোয়াল গম্ভীর হলো আকস্মিক। নিজেকে শান্ত রেখে কোমল স্বরে বোনকে আশ্বাস দিল,
” কয়েকদিনের ব্যাপার। তারপর দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। এত চিন্তা করিস না। খা।”

ভাইয়ের আশ্বাসেও মুনের ভাবান্তর হলো না। তার চোখের উদাসীনতা সরল না। রুবাব অবাক চোখে পরখ করল তার বোনের অন্য এক রূপকে।

____________________

“আকাশে চাঁদ উঠার খুশিতে ট্রিট দিলি তবে!” খুশিতে গদগদ হয়ে বলল নাহিদ। সবে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে সৈকত। গলায় ঝুলানো টাওয়াল। মাথা মুছতে গিয়ে থেমে গেল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমি কখন ট্রিট দিলাম!”

নাহিদ অবাক চোখে প্রশ্ন করল, “তুই অর্ডার দিস নি কিছু?”
“না তো। কী হয়েছে?”

“একটু আগে তোর নামে লাঞ্চ এলো। একজনের না, তিনজনের। রুবাবকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ও বলল ও অর্ডার করেনি। আমরা ধরে নিয়েছি , তুই অর্ডার দিয়েছিস। খুশিতে গদগদ হয়ে অন্তর অর্ধেক সাবাড় ও করে ফেলেছে।কিন্তু তুই অর্ডার না দিলে আসল কোথা থেকে?”

নাহিদকে চিন্তিত দেখাল। সৈকত কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে ভাবল। ও তো কিছু অর্ডার করেনি। কাউকে বলে ও নি। বন্ধুরা সব এখানে, পরিবার দূরে। অর্ডার দেয়ার কথা না। তবে কে ওর জন্য খাবার পাঠাল?
সৈকত ডাইনিং রুমে গেল। টেবিল ভরতি খাবার দেখে চমকাল বেশ। এত খাবার কে পাঠাল। অন্তর তখন হাপুসহুপুস করে খেতে ব্যস্ত। নাহিদ ওর মাথায় ঠুয়া মেরে বলল,
“আরে ব্যা টা থাম। কে না কে পাঠাইছে খাবার, কিছু মিশিয়ে টিশিয়ে দিলে একবারে ফ্রি হিটে অক্কা পেয়ে বসবি।”

অন্তর খাবার থামিয়ে প্রশ্নবোধক চাহনি দিল। নাহিদ ঘটনার সারমর্ম জানাল ওকে। অন্তরের চোয়ালে আতঙ্ক দেখা গেল না। সে গম্ভীরমুখে বলল,
” আমি যদি এই খাবার খেয়ে ম রে যাই তবে আমার কুলখানিতে এই মেন্যু রাখবি। সবাই খেতে খেতে কান্না করবে। এক লোকমা মুখে দিবে, নাক টানবে, খাবার চিবোবে। তা দেখে তোরা তিনজন শীতল পাটি বিছিয়ে বিলাপ করবি। এটা আমার অছিয়ত। ”

বলে আবার খাওয়ায় মন দিল অন্তর। যেন খাওয়ার চেয়ে অতিব গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই ওর জীবনে। নাহিদ বিরক্তির শ্বাস ফেলল। এই ছেলের হেয়ালির ভান যাবে না কোনদিন। নাহিদ ওর থেকে চোখ ফিরিয়ে সৈকতকে প্রশ্ন করল,
“কে পাঠিয়েছে আন্দাজ করতে পারছিস?”

সৈকত সাত পাঁচ ভাবছিল। নাহিদের কথায় ধীরে বলল, “পারছি।”

নাহিদ আগ্রহী গলায় জানতে চাইল, “কে?”

সৈকত উত্তর দিল না। স্মিত হাসল। তারপর রুমে ডুকে ফোন খুঁজায় ব্যস্ত হলো। ফোন পেতেই তুলে কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে ডায়াল করল। দু’বার রিং হতেই রিসিভ হলো। কোন ভণিতা ছাড়াই সৈকত প্রশ্ন করল,
” লাঞ্চটা তুমি পাঠিয়েছো?”

অপাশ থেকে কোন উত্তর এলো না। একবারে পিনপতন নীরবতা যাকে বলে। এই নীরবতার মাঝে সম্মতি খুঁজে পেল সৈকত। ওর চোয়ালের প্রসন্নতার রেশ গাঢ় থেকে গাঢ় হলো। গভীর সুরে বলল,
“আমার জন্য চন্দ্রকথার চিন্তাও হয় তবে!”

ওপাশে ঘাপটি মেরে থাকা কন্যার মুখে রা নেই তখনো। অনেকক্ষণ বাদে মৃদুস্বরে বলল,
“খেয়ে নিবেন। রাখছি।”

মুন রাখতে গেল। সৈকত চঞ্চল স্বরে ডেকে উঠল,
“শুনো চন্দ্রকথা?”

উত্তর এলো না, তবে কল কাটাও হলো না। শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ করে কানে রাখা ফোন তখনো। আন্দাজ করে একটুখানি হাসল সৈকত। প্রসন্ন সুরে বলল,
” অভিভাবকহীন এই শহরে বন্ধুদের বাইরে আমাকে নিয়ে এত চিন্তা বোধহয় কেউ করেনি। থ্যাঙ্কিউ! খাবারের জন্য না, ওই একটুখানি যত্নের জন্য।”

ওপাশ থেকে এই ক্ষণে নিঃশ্বাসের শব্দ এলো কানে। সৈকত বুঝল, সে শুনছে গভীর মনোযোগে। মোহ নিয়ে ফের ডাকল সৈকত,
“চন্দ্রকথা?”

কিছুক্ষণ, অনেকক্ষণ বাদে ছোট্ট উত্তর এলো, “হু!”

“খাবার আনা না আনাতে আমার কোন সমস্যা নেই। আমি উপোষ ও থাকতে পারব সাচ্ছন্দ্যে। তুমি খাবারের বদলে বরং একটুখানি পাশে থেকো। এই একলা শহরে একটা সঙ্গের বড্ডো দরকার আমার। আমি তোমার আনা খাবারের নয়, তোমার একটুখানি সঙ্গের অপেক্ষায় থাকব। সময় কিংবা অসময় তুমি আসবে আমার সঙ্গে? থাকবে পাশে?” প্রগাঢ় অনুভূতি, আকুল আবেদন ঝরে গেল সৈকতের স্বর বেয়ে।

ওমন কথার পরে স্তব্ধ হয়ে গেল ওপাশের মানুষটা। হৃদকম্পনে স্বর অবরুদ্ধ হলো, বলার মতো কথা এলো না স্বরে। নিস্তব্ধতায় মাড়িয়ে গেল। সদ্যস্নাত টাওয়াল জড়ানো গায়ে সৈকত অনুভূতিতে অভিভূত হয়ে পরোক্ষ প্রেম আবেদন করেই দিল,
“আমি যদি অপেক্ষা করি, তবে কি আমাকে হতাশ হতে হবে? অপেক্ষার পরে তুমি থাকবে আমার পাশে? ”

সময় নিয়ে রয়েসয়ে কাঁপা স্বরে জবাব এলো,
“হতে হবে না।”
“কী?” ভ্রু কুঁচকাল সৈকত। আবার ক্ষীণ শব্দের উত্তর ভেসে এলো,
“হতাশ।”

সৈকত চমকাল, ভড়কাল। থমকাল ও। এ কথার পরে ওদের সম্পর্কের একটা নতুন মোড় নিবে। মুনের দিক থেকে সবুজ ইঙ্গিত আসবার অপেক্ষায় ছিল ও। সেটা কি এসে গেল! আনন্দে বিমোহিত হয়ে চঞ্চল স্বরে সৈকত বলল,
“তারমানে তুমি থাকছো আমার সাথে, আমার জীবনে, আমার চন্দ্রকথা হয়ে? ”

সৈকত স্বর আটকে এলো আনন্দে। মুন লাজুক স্বরে উত্তর দিল, “হু। ”

সৈকত আনন্দে আত্মহারা। প্রাণবন্ত হেসে ওঠল সে। উদ্ভাসিত মুখে বলল, ” চন্দ্রকথা, আমি….. তুমি… আমাকে…..

আনন্দে একটা কথা ঠিকঠাক এলো না সৈকতের। স্বর জড়িয়ে এলো। ও যেন নিজের মাঝে নেই। অপাশ থেকে মুন লাজুক বদনে উপভোগ করছে সৈকতের পাগলামো। সৈকত প্রাণোচ্ছল হয়ে বলল,
” আমার এখন তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। তুমি কোথায় আছো বলো? আমি এক্ষুনি আসছি।”

খট করে ফোন কেটে গেল। সৈকত ফিরতি ডায়াল করতে গেল। সেই ক্ষণে একটা ম্যাসেজ এলো,
” কোথাও আসতে হবে না। যতক্ষণে আসবেন ততক্ষণ রেস্ট নিন। নয়তো কদিন বাদে এক্সাম হলের বদলে পাবনায় ঠায় হবে।”

ম্যাসেজে হালকা ধমক টের পেল সৈকত। আনন্দের রেশ কাটিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। এই মেয়ে ওকে শাসন করছে!

চলবে…

#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-১৮)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

রাত্রি আঁধার কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে সবে। পূর্বাকাশে রক্তিম সূর্য্যের আবির্ভাব হয়েছে। হিমশীতল মৃদু হাওয়ায় বইছে। দূরের গাছে কিচিরমিচির ডাকছে পাখির দল। এমন সুন্দর আবহে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মুন। নির্ঘুম রাত্রির ক্লান্তি সারামুখে। চোখে উদাসীনতা। আকাশপানে চেয়ে চিন্তায় মগ্ন। রাতে এক ফোঁটা ঘুম হয়নি। শুধু আজ না, কদিন যাবতই ঘুম হচ্ছে না ঠিকঠাক। ঘুম খাওয়া কিছুই ভালো লাগছে না। এক উদাসীনতা ঘিরে ধরেছে ওকে। উদাস হয়ে কী যেন ভাবে, আনমনেই হাসে, আনমনেই মন খারাপ করে। শূন্য ঘরে বসে একলা লজ্জা পায়, ফোন হাতে নেয়, কত কী লিখতে নেয়, আবার রেখে দেয়। আবার ফোন হাতে নেয়, ইন্সটা ঘুরে একটা একাউন্টে যায়, সুদর্শন হাস্যজ্বল এক যুবকের ছবি ভাসে। মুন সেই ছবি দেখে খুব করে, কখনো জুম করে। সেই ছবি দেখেই পেরিয়ে যায় কত সময়। সামনে গেলে চোখ তুলে তাকাতেও আড়ষ্টতা হয়, সেভাবে গভীর চোখে দেখার সাহস হয়না। দেখার ইচ্ছেটা এই ছবিই পূরণ করে। তা ছাড়া সেই দিনকার ফোনালাপের পর আর মুখোমুখো ও হয়নি তারা। সম্ভব হয়নি মুনের আড়ষ্টতা আর ছবি মানবের ব্যস্ততায়।

ছবি মানবের কথা মনে পড়তেই মুনের চোয়াল লালরঙা হয়ে ওঠে। মানুষটা কিভাবে কথা বলে, একেকটা কথা ওর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। প্রতিটা শব্দে, অক্ষরে, অর্থে গভীর প্রেম ঝরে যায়। কদিন আগ অবধি সৈকত নামক ভাইয়ের বন্ধুটি সম্পর্কে মুনের ধারণা ছিল, সে ভীষণ চাপা, গম্ভীর, রসকষহীন কাঠখোট্টা মানুষ। কিন্তু এখন ক্ষণে ক্ষণে মনে হয় সৈকতের চেয়ে প্রাণবন্ত, প্রেমময় পুরুষ দুটো নেই। কোন জড়তা নেই, আড়ষ্টতা নেই, অকপটে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে । হুটহাট সামনে এসে গভীর স্বরে যখন ‘চন্দ্রকথা’ বলে ডাকে, তখন মুনের ভাবনা উলোটপালোট হয়ে যায়। ওই ডাক, ওই কথাতেই মুন তালগোল পাকিয়ে বসে। সৈকতের পক্ষ থেকে প্রগাঢ় অনুভূতি ছিল বরাবরই, কিন্তু মুনের পক্ষ থেকে ছিল না। সেই অনুভূতি জন্মেছে সদ্যই। একবারে হুট করে, অল্প সময়ে। সৈকতের অনুভূতি জানার পর হাতে গোনা দুইতিন বার দেখা হয়েছে। ওই দুই তিন দেখাতেই মুন যেন হারিয়ে গেছে। সৈকতের প্রতি কখন যে অনুভূতি জেগে গেছে সে টেরই পায়নি। দিনে দিনে সেই অনুভূতি তীব্র হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। এখন সৈকতের কথা ভাবতে ভালো লাগে, সৈকতকে দেখতে ইচ্ছে করে। রাতে চোখ বন্ধ করলেই সৈকতের ছবি ভাসে। শয়নেস্বপনে খেয়ালে, ধ্যানে সৈকতের বাস। এই যে আজ বিসিএস পরীক্ষা শুরু। পরীক্ষা সৈকতের, অথচ উৎকন্ঠা মুনের। চিন্তায় রাতে ঘুম হয়নি। ভাই না কি শর্ত দিয়েছে, সৈকতের বিসিএস না হলে তাদের বিয়ে দিবে। যদি বিসিএস না হয়, তবে সৈকতে হারাতে হবে! এই ক্ষণে প্রথমবারের মতো হারানোর ভয় জেগেছে মুনের মনে।

সৈকত ভাবনার মাঝে রবির তীব্র আলো এসে লাগল চোখে। ধ্যান ভগ্ন হলো মুনের। চেয়ে দেখল, সকাল হয়ে গেছে। মুন চাপা শ্বাস ফেলে রুমে চলে এলো। রুম গোছানোর সময় আকস্মিক খেয়াল হলো, নাস্তার কথা। মনে প্রশ্ন জাগল, রাত জেগে পড়ছে মানুষ গুলো, কিছু খেয়েছে? কী খেয়ে পরীক্ষা দিতে যাবে? পড়ার চাপে খাওয়া হবে বলে তো মনে হয় না। চার ঘন্টার পরীক্ষা উপোষ পেটে দিবে?

মুন বরাবরই সংসারী গোছের মেয়ে। রান্নাবান্না, টুকটাক কাজে পারদর্শী। সংসারী গোছের মেয়েরা যেখানে যায়, যার জীবনে যায় তাকে সুন্দর ভাবে গুছিয়ে আগলে রাখে। তার সব খেয়াল থাকে। রুবাব বরাবরই খামখেয়ালি। নিজের যত্ন নিতে বেজায় আলস্য সে। মুন নিশ্চিত রুবাব খালি পেটেই যাবে হলে। প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের চিন্তায় মগ্ন হয়ে মুন রান্নাঘর্র দিকে পা বাড়াল। মাকে রান্নাঘরেই পাওয়া গেল। চুলোয় সবজি ছড়িয়ে রুটি বেলছেন। মেয়েকে এত তাড়ানো উঠতে দেখে কপাল কুঁচকালেন,
“এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল তোর!”

মুন বিড়বিড় করল, “ঘুম হলে তো ভাঙবে। হয়নি।”
মুখে বলল, ” ভেঙে গেল। আজ এত তাড়াতাড়ি নাস্তা বানাচ্ছো যে?”

রুটি ঘুরাতে ঘুরাতে তারিনা উত্তর দিলেন, “ছেলেগুলোর পরীক্ষা। বাসায় নাস্তা বানানোর কেউ নেই, কী খেয়ে যাবে না যাবে আল্লাহ জানে। তাই নাস্তা পাঠাব।”

“কে যাবে নাস্তা নিয়ে?”
“তোর বাবা যাবে। ওখানে থেকে একসাথে হলে যাবে।”

মায়ের কথা শুনে মুনের মুখে স্বস্তির আভা দেখা গেল। বাবা গেলে আর চিন্তা নেই। বাবা ভাইয়ার সাথে সাথে ভাইয়ার সব বন্ধুদের খুব স্নেহ করেন। নিজ উদ্যোগে সবাইকে খাইয়ে আসবেন। মুন সবজি ভাজা দেখে নিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,
” মা, আমরা যাব না?”

কিসের এক জড়তা ওর মাঝে বিদ্যমান। আশ্চর্য! এমনটা তো আগে হয়নি। রুবাবের সব বিশেষ দিনে মুন বাবা মায়ের সাথে যাবার আবদার করেছে নির্দ্বিধায়। কোন জড়তা হয়নি। আজ এত জড়তা কেন? কেন্দ্রের দিকে যাবার কারণ শুধু ভাই বলে নয় কি? মুন নিজের উপরই অবাক হলো। তারিনা বললেন,
” আমার ছেলেটার আজ কত বিশেষ দিন। উৎসাহ দিতে যাব না? অবশ্যই যাব। আমরা গেলে ছেলেটা সাহস পাবে। তাছাড়া হল তো এদিকেই। ”

তারিনা নিজেই বললেন, “তোর বাবা তো আগে গেল। আমি আর তুই আরও পরে বেরুব।”

মুনের ঠোঁটের কোণের হাসিটা গাঢ় হলো। সে চমৎকার হাসল। সে উৎফুল্ল হয়ে বলল,
” আমি কিন্তু আসব না, মা। ভাইয়ার এক্সাম শেষ হলে ভাইয়াকে নিয়ে বাড়ি ফিরব।”

ভাইয়ের প্রতি বোনের ভালোবাসা ধরে নিয়ে তারিনা হাসছে। এরা ভাইবোন একে অন্যের জন্য অজ্ঞান। তিনি স্মিত হেসে মনে মনে বললেন, “মেয়েটা এত ভাইপাগল হয়েছে!”
অথচ তিনি যদি জানতেন, মেয়ে শুধু ভাই নয়, ভাইয়ের বন্ধুর জন্য ও পাগল হয়েছে।

_____________________

ব্যাচলর বাসাটায় হৈ-হুল্লোড় হচ্ছে খুব। চারটা ছেলে একসাথে পরিক্ষা দিতে যাচ্ছে আজ। তৈরি হচ্ছে হৈ হৈ করে। আমার ঘড়ি কই? ওয়ালেট কই? তোর শার্টটা দে, চিরুনি কই রাখছোস? এমন প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে ছুটছে সবাই। ব্যাচলর বাসায় কিছু পাওয়া যায় না। এলোমেলো, অগোছালো ঘরে বই ছাড়া একটাও কাজের জিনিস চোখে পড়ছে না। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আছে সবার। তৈরি হবার সময় সবার বাসা থেকে ফোন এলো। বাবা মা দোয়া দিল। রুবাবের বাবা স্বয়ং আছেন। মা যাবেন হলে, তাই কল আসেনি তার। রুবাবের ফোনে কল এসেছে মুনের। ব্যস্ত থাকায় ফোন কানে না ধরে স্পিকারে রেখে বলল,
“হ্যাঁ, মুন বল।”

অপাশ থেকে মুন বিজ্ঞদের মতো আদেশের ভঙ্গিতে বলল, “বাবা খাবার নিয়ে গেছেন। খেয়ে নিবে। একদম খালি পেটে বেরুবে না। তোমার তো আমার তাড়াহুড়ায় খাওয়ার অভ্যাস, দেখো খেতে গিয়ে নাকে উঠবে। ধীরস্থিরে খাওয়া শেষ করবে। চারঘন্টার পরীক্ষা, না খেলে এনার্জি পাবে না। আমি বাবার কাছে তোমার শার্ট, প্যান্ট আয়রণ করে দিয়েছি। ওগুলো পরে যাবে। কোন প্রকার প্রেশার নিবে না। একদম ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দিবে। মনে করে কলম নিও। তোমার তো আবার ভুলে যাওয়ার অভ্যাস। আ…..

রুবাব হেসে বলল, ” আচ্ছা মেরি মা.. সব মনে রাখব। চিন্তা করিস না।”

মুন সতর্ক করল, “বাবা বলল, এখনো কিছু খাওনি না কি। ফোন রেখে শিগগির নাস্তা করতে বসবে। আমি কিন্তু বাবার থেকে খোঁজ নিব। সকাল সকাল উঠে আমি আর মা মিলে নাস্তা বানিয়েছে, না খেলে খুব রাগ করব।”

ভাই বোনের খুনসুটি চলল। পাশে দাঁড়ানো সৈকত চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে নাক ফুলাল। রুবাবের মতো সেও তো না খেয়ে আছে। কই তাকে তো বলছে না! তার খোঁজ কেউ নিচ্ছে না। কল না দিলেও একটা ম্যাসেজ তো দিতে পারে । চাপা শ্বাস ফেলে তৈরি হওয়ায় মন দিল। রুবাবের কথা শেষ হবার পর পরই সৈকতের কাঙ্খিত বার্তাটা এলো।

টুংটাং শব্দ করে ওঠল ফোন। সৈকত তখন মাথা আঁচড়ে অন্যদিকে গেছে। রুবাব আর অন্তর ছিল ওখানটায়। ফোনটা ওদের সামনেই রাখা। টুংটাং শব্দে বাজল ফোন। তীব্র শব্দে আনমনা হয়েই দুজনের দৃষ্টি পড়ল ফোনের দিকে। ‘চন্দ্রকথা’ নামটা নোটিফিকেশনে দেখে বিস্ময়ে ভ্রু উঁচাল দুজনই। এক মুহুর্তের জন্য গুমোট হয়ে রইল রুবাব। পরপরই চোখ ফেরাল। অন্তর একবার ফোনের দিকে চাইল, আরেকবার রুবাবের দিকে। তারপর মিটিমিটি হেসে ডাকল,
“সৈকত, চান্দের থেইক্যা বার্তা আইতাছে ।”

সেই কথা বুঝল না সৈকত। ফেরত এলো খানিক বাদেই। তখন আবার টুং করে ম্যাসেজটোন বাজল। ফোন হাতে নিল সৈকত। মুনের ম্যাসেজ দেখে তড়িঘড়ি করে ওপেন করল। মুন লিখেছে,
” বেরুচ্ছেন?
খেয়ে বেরুবেন কিন্তু।
কোন প্রেশার নিবেন না। সাবধানে যাবেন।
অল দ্যা বেস্ট।”

ছোটো ছোটো কয়েকটা ম্যাসেজ। অথচ সৈকতের মুখভঙ্গি দেখে মনে হলো কেউ তাকে বিশ্বজয়ের ট্রফি দিয়েছে। এত খুশি দেখাল ওকে। হেসে ওঠল আপনমনেই। খানিক আগে এই কথাগুলোর জন্যই অভিমান করেছিল, সেই অভিমান ঝরে গেছে। শুধু রুবাবের নয়, সৈকতের চিন্তায় ও মগ্ন মুন।

রুবাব তীর্যক চোখে সৈকতের পানে চাইল। তার বোনের প্রতি সৈকতের কতখানি আবেগ জড়িয়ে আছে তা ঢের টের পেল। টের পেল সৈকতের প্রতি বোনের উদ্বিগ্নতা ও।

_______________

প্রিলিতে উত্তীর্ণ হয়ে রিটেনে বসতে চলছে হাজারো শিক্ষার্থী। পরীক্ষার নিয়ম কানুন সব এক হলেও কেন্দ্র পড়েছে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। ঢাকার মধ্যে রুবাবদের চারবন্ধুর কেন্দ্র পড়েছে শেখবাড়ির দিকে। আজ ইংরেজি পরীক্ষা। অনুষ্ঠিত হবে ১০টায়। ঘন্টা দুয়েক আগেই হাজির হয়েছে রুবাবরা। জ্যামের কবলে পড়বার ভয়ে আগেই রওনা দিয়েছিল। দ্রুত পৌঁছে যাওয়ায় হাতে বেশ সময় আছে।
সন্তানদের জীবনের চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষায় পাশে থাকতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন নাহিদ, অন্তর সৈকতের বাবা মা। কেউ রাতে কেউ ভোরে রওনা দিয়ে সঠিক সময় কেন্দ্রের কাছে এসে পৌঁছেছেন। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছেলেদের সাহস জোগাচ্ছেন। সৈকতের স্কুল শিক্ষক বাবা ছেলের কাধ চাপড়ে সাহস, উৎসাহ দিচ্ছেন। অভিভাবকদের এই সঙ্গ ওদের সাহস, আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিল যেন।
রুবাব একা দাঁড়িয়ে আছে। বাবা এসেছিল সাথে, কোথাও চলে গেল। মায়ের সাথে সকালবেলা কথা হয়নি। দোয়া চাইতেও পারেনি। কিঞ্চিৎ খারাপ লাগছে। সেই ক্ষণে মা আর বোনকে নিয়ে ফিরলেন বাবা। তাদের দেখেই বিশ্বজয়ের হাসি ফুটল রুবাবের ঠোঁটে। তারিনা এসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া দিলেন। রুবাব হাসল। মুন হেসে থাম্বস দেখিয়ে বলল,
” অল দ্যা বেস্ট ভাইয়া!”

রুবাব হাসল উত্তরে। মুন চারপাশে চোখ বুলাল। সৈকতকে দেখা যাচ্ছে না। ইতিউতি করে ও পেল না। ভাইকে জিজ্ঞেস করতে ও পারছে না জড়তায়। কেবল আড়চোখে খুঁজতে লাগল। খানিক বাদেই খানিকটা দূরে এক জটলায় দেখা মিলল সৈকতের। নাহিদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে দুজনের বাবা। সিফাতকেও দেখা যাচ্ছে। সৈকতের মনোযোগ নেই এদিকে।

ওদের একটু সামনেই অন্তর দাঁড়িয়ে আছে। সবার আগে মুনকে ওরই নজরে পড়ল। মুন তখন ইতিউতি করে সৈকতকেই দেখছিল। বোধহয় সৈকতের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিল। কিন্তু সৈকত নির্বিকার। তা দেখে অন্তর চাপা হাসল। গলা খাঁকারি দিয়ে খানিকটা জোরেই বলল, “আরে, মুন যে! কেমন আছো?”

মুন তৎক্ষনাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল। অন্তরের কাছে এগিয়ে গেল। সৈকতে পাশেই পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘মুন’ নামটা শুনতেই তড়িৎ ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল সৈকত। দেখল মুন প্রফুল্লচিত্তে অন্তরের সাথে কথা বলছে। তাকে খুঁজল না কেন মেয়েটা!

মুনের উপস্থিতি টের পেয়ে নাহিদ এগিয়ে এলো। সৈকত নিজের অবস্থান থেকে সরল না। মুন নাহিদের সাথে কুশল বিনিময় করে ‘পরীক্ষার জন্য শুভকামনা জানাল।’ নাহিদের পর অন্তর কেউ বলল। অন্তরের পাশে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল সৈকতের সাথে। বহুপাক্ষিকতার পর দু’জোড়া দৃষ্টির মিল হলো। সেকেন্ড দশেক দুজনেই থমকে চেয়ে রইল একে অপরের প্রতি। সৈকত গভীর চোখে চেয়ে হাসল। ভ্রু নাড়াল। আড়ষ্টতা এসে ভর করল মুনের মাঝে। চোখ ফেরাল সে। অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ম্যাসেজে কথা এলেও সম্মুখে আসবার পর আর কথা এলো না। ওর লজ্জা দেখে কৌতুকের সুরে অন্তর বলল,
” মুন তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো, আমাদের বন্ধু সৈকত ও আজ রিটেন দিচ্ছে। তোমার ওকে ও শুভকামনা জানানো উচিত।”

সৈকত কাছটায় দাঁড়িয়ে দেখছিল মুনের গতিবিধি। ওর ঠোঁটের কোণে ভাসা হাসিটা সরছে না। মুন চোখ তুলে একবার চাইল সৈকতের দিকে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি ধাক্কা খেতেই চোখ সরাল। খানিক বাদে আবার তাকাল। রয়েসয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। বাকিরা কেউ না বুঝলেও সৈকত বুঝে ফেলল। সে উত্তর দিতে গেল। সেই ক্ষণে আকস্মিক সিফাত এসে দাঁড়াল। মুনের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাভরে সালাম দিল,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাবি। ”

হাসপাতালে দেয়া সালামটা মুন গ্রহণ করতে পারেনি কারণ সে তখনো অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এখন সম্পর্কটা দু’পক্ষিক হয়ে যাবার কালে সবার সামনে সালামটা এসে ধাক্কা খেল বেশ জোরেসোরে। লাজুকলতা মুন এমনিতেই লজ্জায় কাঁদা, তার উপর সবার সামনে ওমন ভাবি ডাকে অপ্রস্তুত হয়ে গেল বেশ। সৈকতের স্থান তখন মুনের পাশেই। না তাকিয়ে মুন ধরতে পারছে সৈকত ওর দিকে তাকিয়েই হাসছে। সিফাতের সালামের পর নাহিদ আফসোসের সুরে বলল,
” মেয়েটা এমনিয়তেই লজ্জা পাচ্ছে, তারউপর এখন এসে ভাবি ডেকে সালাম দেয়াটা উচিত হয়নি, সিফাত।”

সিফাত মজা পেল। চাপা হাসল। তারপর বিনম্র স্বরে বলল, “স্যরি ভাবি, আপনি লজ্জা পাবেন জানলে আমি আপনাকে সালাম দিতাম না। আমি আমার সালাম ফিরিয়ে নিচ্ছি, ভাবি। ”

সবাই মিলে মজা নিচ্ছে ওর। অন্তর বলল, ” চাঁদ সমুদ্র এক তো হয়ে গেল। এবার কি মুনকে আমাদের ও ভাবি ডাকতে হবে? ”

মুন লজ্জায় কাঁচুমাচু করছে। সৈকত প্রতিবাদের পন্থা ভুলে ওর লজ্জামাখা মুখ দেখছে। অসাড় দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। সে কী লজ্জা! ভালো লাগছে দেখতে। কিন্তু লজ্জায় মেয়েটার মুখ লাল হয়ে গেছে। অস্বস্তি হচ্ছে বোধহয়। সৈকত সবাইকে থামাতে বলল,
“এ্যাই তোরা থাম, সিফাতের ভাবি লজ্জা পাচ্ছে।” বলে না চাইতেও সে হেসে ফেলল।

মুন এবার আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। তড়িৎ ঘুরে গেল। আড়ষ্টভাব নিয়ে অসাড় দাঁড়িয়ে রইল ওদিকে। ওর ভাব দেখে এবার সমস্বরে হেসে উঠল সবাই। তীব্র চিন্তায় প্রাণ ওষ্ঠাগত সব শিক্ষার্থীর। সবাই শ্বাস আটকে দোয়া পড়ছে। এমতাবস্থায় একদল যুবকের হাসির শব্দ শুনে অবাক চোখে চাইল সবাই। রুবাবের বাবা মাও এদিকে তাকালেন। ভ্রু কুঁচকালেন। নাহিদ অন্তর তাদের ঘটনা বোধগম্য হতে না দিতে তাদের দিকে এগিয়ে গেল। কথায় ব্যস্ত রাখল তাদের।

সিফাত গেলে নিজের বাবা মায়ের কাছে। সিফাতের পুরো পরিবারের আসবার কারণ শুধুই সৈকত নয়। মায়ের ডাক্তার দেখানো ও আছে। ঢাকায় কোন আত্মীয় না থাকায় আসা হয়না। উছিলা পেয়ে ভাবলেন, ঢাকা গিয়ে ছেলেকে দেখে আসবেন আর ডাক্তার ও দেখিয়ে আসবেন। হোটেলে উঠবেন। ডাক্তার দেখিয়ে মা বাবাকে নিয়ে ফিরবে সিফাত। বাবার কাছে গিয়ে ডাক্তার সিরিয়াল আর হোটেল বুকিং নিয়ে কথা ওঠাল। দু’দিকের সবাই ব্যস্ত হলো। মাঝে একা পড়ল সৈকত আর মুন।

মুন তখন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। মুখে অস্বস্তি আর লজ্জার প্রলেপ। সৈকত চারপাশ চেয়ে হাসল একটুখানি। তারপর মুনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ধীর সুরে বলল,
“ও বাবা! চন্দ্রকথার তো দেখি অনেক লজ্জা!”

মুন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। সৈকতের দিকে তাকাল না। সৈকত হাসল,
“ম্যাসেজে খুব আদেশ ঝাড়ো, এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। এখন দুই একটা আদেশ জারি করো দেখি।”

সৈকত মুনকে সহজ করার চেষ্টা করছে। মুন সহজ হতে পারছে না। সৈকত শান্ত স্বরে বলল,
” ভাবি টাবি হয়ে গেছো বলে, সিফাত এক আধটু দুষ্টুমি করছিল। তুমি ওসব গায়ে মাখিয়ো না। ছেলেটা খুব ফাজিল হয়েছে। আমি বকে দিব।”
ছোটো বাচ্চাদের মতো সান্ত্বনা দিতে চাইল যেন সৈকত। ওর ওমন সান্ত্বনায় হাসি পেল মুনের। সামান্য হেসে বলল,
“আগে নিজেকে বকুন।”

সৈকত ভারি অবাক হলো, “আমি কী করলাম! আমি তো এখনো দুষ্টু হবার মতো কিছুই করলাম না। গুণে গুণে পাঁচদিনের গার্লফ্রেন্ড হওয়া সত্ত্বেও আমি এখন অবধি কিসটিস তো দূরে থাক,তোমার হাত ও তো ধরিনি। রাত বিরাতে তোমার বাসার সামনে গিয়েও দাঁড়াইনি। বিয়ে বাসর, বাচ্চাকাচ্চা সম্পর্কিত ব্যাপার স্যাপার তো মাথাতেই চেপে রেখেছি। মন অবধি আনিনি। তার আগেই তুমি আমাকে অপবাদ দিচ্ছ ! কদিন বাদে যখন আমি এসব করব তখন তুমি কী করবে চন্দ্রকথা!”

আফসোসে ভাসল সৈকত। মুন ওর ওমন লাগামহীন কথা শুনে লজ্জায় লাল হলো। কিছুক্ষণ বাদে যার বিসিএসের মতো পরীক্ষা, আর সে এখন পড়া বাদ দিয়ে বিয়ে বাসরের আফসোসে ভাসছে! কে বলবে এই ছেলে রিটেনের জন্য ক’মাস যাবত পাগলের মতো পড়ছে। পরীক্ষার আগে মানুষ চিন্তা করে, এই ছেলে প্রেম করছে! মুন বিরক্তি নিয়ে বলল,
“বড্ডো বাজে বকেন আপনি।”

সৈকত বড্ডো অসন্তোষ প্রকাশ করে বলল, ” তোমার জন্য আমি পড়তে পড়তে রাত দিন এক করে ফেলেছি অথচ তুমিই বুঝলে না আমায়। এ দুঃখ কোথায় রাখব আমি।”

ওর ভাব দেখে মুন হেসে ফেলল। হেসেই বলল,” হলে তো বোধহয় আপনার এত ভারি দুঃখ এলাউ করবে না। আপনি বরং আপনার দুঃখ চিন্তার ঝুলি আমার কাছে আমানত রেখে যান। ”

সুন্দর কথায় সৈকতের মুখে সুন্দর হাসি ফুটল। মুনকে বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। সে নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করল,
“খেয়ে বেরিয়েছেন?”

“হ্যাঁ। তুমি খেয়েছো তো? না কি সদ্য প্রেমিকের পরীক্ষার চিন্তায় ঘুমের মতো নাওয়া খাওয়াও বাদ দিয়েছো?” ওর পানে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল সৈকত। মুন সবে একটুখানি শান্ত হয়েছিল, আবার অশান্ত হয়ে গেল। এই লোকটা কিভাবে বুঝল, ও সৈকতের জন্য ঘুমাতে পারেনা? সে তো এ কথা কাউকেই বলেনি। মুন অস্বীকার করল দৃঢ়তার সাথে,
“আমি মোটেও কারো চিন্তায় নাওয়া খাওয়া ঘুম বাদ দিইনি।”

সৈকত টেনে বলল, “আচ্ছা! তবে তোমার চোখের নিচের ডার্ক সার্কেল কেন আমাকে বলছে, আমি তোমার চিন্তায় মত্ত। তুমি ছাড়া আমার খেয়ালে আর কিছুই নেই?”

কৌতুকের সুর সৈকতের। ওর মজা সাজা হলো যেন মুনের। চোখের নিচে এতখানি ডার্ক সার্কেল পড়েছে! সে তো খেয়ালই করেনি। সৈকত কিভাবে খেয়াল করল? মুনের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। এই কপাল ভাঁজে চেয়ে সৈকত আলতো সুরে বলল,
” বিসিএস হোক না হোক বিয়ে আমি তোমাকেই করব। জীবন উত্তর দক্ষিণ যেদিকে যাক, তুমি আমার সাথে আছো। চিন্তা করো না।”

মুন অবাক, সৈকত ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছে! অথচ ভেতরে ভেতরে ভয়ে ম র ছে নিজেই। সৈকতের চেহারাই বলে দেয় সে কতটা প্রেশার নিচ্ছে। জান প্রাণ হেলিয়ে পড়ছে। কারণ রুবাব শর্ত দিয়েছে, মুনকে বিয়ে করতে হলে বিসিএস ক্যাডার হতে হবে। সেই ছেলে এখন ওকে সান্ত্বনার বুলি ছুঁড়ছে! কী অদ্ভুত! মুন জেনে বুঝেও চুপ রইল। সৈকতের পানে চাইল। সৈকতের চোখে উদাসীনতা। মুন হাসল। কোমল স্বরে বলল,
” আচ্ছা, চিন্তা করব না।”

সৈকতের ডাক পড়ল। বন্ধুরা হলে ডুকছে। সৈকত ধীরে বলল, “আসি? ”
মুন মাথা নাড়াল। সৈকত পা বাড়াল। মুন ডাকল পিছু,
“শুনুন!”
সৈকত পিছু ফিরল, “বলো!”

মুন প্রসন্ন হেসে থাম্বস দেখিয়ে বলল, “আপনার পরীক্ষা খুব ভালো হোক। অল দ্যা বেস্ট।”

সৈকত প্রাণবন্ত হাসল, “থ্যাঙ্কিউ। ”
মুন আবার বলল, “আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব।”
সৈকত ভ্রু কুঁচকাল, “কোথায়?”

“গেটে, জীবনে দুটোতেই?” দৃষ্টি নামিয়ে স্বীকারোক্তি দিল মুন। সৈকত থেমে গেল একমুহূর্তের জন্য। পরমুহূর্তেই হেসে বলল,
“অপেক্ষা করা লাগবে না। তুমি শেখ বাড়িতেই থেকো, আমি এসে নিয়ে যাব। রাতে তো ঘুমাও নি। এখন গিয়ে একটা ঘুম দাও। পরেরবার দেখা হলে যেন চোখের নিচে কালি না দেখি। যাও। ”

চলবে……..